যয়নাব বিনতে খুযাইমা (রাঃ) এর জীবনী

. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম

ভূমিকা :
উম্মুল মুমিনীন যয়নাব বিনতু খুযাইমা (রাঃ) ছিলেন অতীব দানশীলা মহিলা। তিনি গরীব-দুঃখী দুস্থদের উদার হস্তে দান করতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণকারী উম্মুল মুমিনীনদের অন্যতম ছিলেন। তাঁর সৌভাগ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং তার জানাযার ছালাত পড়িয়েছিলেন। দানশীলতার পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগীতেও তিনি ছিলেন অন্যান্য নবী পত্নীগণের ন্যায় অগ্রবর্তী সারিতে। উত্তম চরিত্র মাধুর্যের অধিকারিণী মহিলা ছাহাবী যয়নাব (রাঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী নিবন্ধে আলোচনার প্রয়াস পাব।

নাম বংশ পরিচয় :
তাঁর নাম যয়নাব, উপাধিউম্মুল মাসাকীনবা দীন-দুঃখীদের জননী। জাহেলী যুগেও তাঁকে নামে ডাকা ত। কারণ তিনি দরিদ্রদের বেশী বেশী খাদ্য দান করতেন তাঁর পিতার নাম খুযাইমা। তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে- যয়নাব বিনতু খুযাইমা ইবনিল হারেছ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আবদে মানাফ ইবনে হেলাল ইবনে আমের ইবনে ছাছাআহ তাঁর মায়ের নাম হিন্দ বিনতু আওফ ইবনিল হারেছ ইবনে হিমাতাহ আল-হুমায়রিয়া তিনি ছিলেন উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রাঃ)-এর বৈপিত্রীয় বোন
জন্ম শৈশব :
যয়নাব (রাঃ)-এর জন্মকাল সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহের সময় তার বয়স হয়েছিল ৩০ বছর সে হিসাবে তাঁর জন্ম ৫৯৫ খৃষ্টাব্দে হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। তাঁর শৈশব-কৈশোর সম্পর্কেও কিছুই জানা যায় না।
প্রথম বিবাহ :
প্রথমে কার সাথে যয়নাব (রাঃ)-এর বিবাহ হয়েছিল ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। ব্যাপারে যে মতগুলি পাওয়া যায় তা হচ্ছে- () তুফায়েল ইবনুল হারেছ ইবনিল মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের সাথে যয়নাব (রাঃ)-এর প্রথম বিবাহ হয় অতঃপর তুফায়েলের ভাই ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ যয়নাবকে বিবাহ করেন। ওবায়দাহ বদর যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন () তাঁর প্রথম স্বামী ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ। তিনি ওহোদ যুদ্ধে নিহত হন () তিনি তুফায়েল ইবনিল হারেছের অধীনে ছিলেন। তুফায়েল যয়নাব (রাঃ)-কে তালাক দিলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বিবাহ করেন। () সীরাতে ইবনে হিশামে আছে, তিনি প্রথমে জাহম ইবনু আমর ইবনিল হারেছ আল-হিলালীর নিকটে ছিলেন। তারপরে ওবায়দা ইবনিল হারেছ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব তাঁকে বিবাহ করেন () ছালাহুদ্দীন মকবূল আহমাদ বলেন, রাসূলুল্লাহর পূর্বে তাঁর চাচাদের বংশের দুজনের সাথে যয়নাব (রাঃ)-এর বিবাহ হয়েছিল। প্রথমতঃ তুফায়েল ইবনুল হারেছ তাঁকে বিবাহ করেন এবং পরে তিনি তাঁকে তালাক দেন। অতঃপর তার ভাই ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ তাঁকে বিবাহ করেন। তিনি বদর যুদ্ধে নিহত হন১০
মোদ্দাকথা তুফায়েল যয়নাব (রাঃ)-কে প্রথম বিবাহ করেন। তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটলে তার ভাই ওবায়দার সাথে যয়নাব (রাঃ)-এর দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন হয়। তিনি বদর যুদ্ধে শহীদ লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে যয়নাব (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। এটাই প্রসিদ্ধ গ্রহণযোগ্য মত১১
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহ :
যয়নাব (রাঃ)-এর পূর্বের স্বামীর মৃত্যুর পরে হিজরতের ৩১ মাসের মাথায় তথা ৩য় হিজরীর রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বিবাহ করেন। রাসূলে কারীম (ছাঃ) তাকে ১২ উকিয়া১২  নশ১৩ মোহর দিয়েছিলেন১৪ অন্য বর্ণনায় আছে, যয়নাব (রাঃ)-এর চাচা কাবীছাহ ইবনু আমর আল-হিলালী তাঁকে রাসূলের সাথে বিবাহ দেন। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ৪০০ দেরহাম মোহর দিয়েছিলেন১৫ মাহমূদ শাকের বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন যয়নাব (রাঃ)-কে বিবাহ করেন, তখন তার বয়স ছিল ৬০ বছর। আর এই অধিক বয়সের কারণেই তাকে কেউ বিবাহ করতে চাচ্ছিল না১৬ একথা ঠিক নয়। কেননা সর্বাধিক বিশুদ্ধ মতে, তিনি ৩০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন১৭ সুতরাং ৬০ বছর বয়সে বিবাহ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
যয়নাব (রাঃ)-কে বিবাহের কারণ :
যয়নাব (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিবাহের পিছনে কতিপয় সামাজিক ধর্মীয় কারণ বিদ্যমান ছিল। স্রেফ উপভোগের জন্য লে রাসূল (ছাঃ) তাকে বিবাহ করতেন না। কেননা তিনি একদিকে ছিলেন বিধবা এবং অপরদিকে মধ্যম বয়সী১৮ এছাড়া তিনি অতীব সুন্দরী বা অধিক জ্ঞানবতী বিদুষী মহিলাও ছিলেন না১৯ তাকে বিবাহ করার অন্য কারণ ছিল। তন্মধ্যে কতিপয় কারণ নিম্নে উদ্ধৃত ল।- () যয়নাব (রাঃ)-এর স্বামীর ইন্তিকালের পরে তিনি আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। তাঁকে বিবাহ করতে তেমন কেউ রাযী ছিল না। তেমনি তাঁর পরিবারের কেউ তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণ করেনি। কারণ তখনও তাঁর পরিবারের কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। এমতাবস্থায় যয়নাব (রাঃ) নিদারুণ আর্থিক সংকটে নিপতিত হন। তাঁর ভরণ-পোষণে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে অসহায় যয়নাব (রাঃ)-কে আশ্রয় দিতে এবং তাঁর অসহায়ত্ব দূর করতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বিবাহ করেন২০ () যয়নাব (রাঃ)-এর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বিবাহ করেছিলেন। কেননা তার পূর্ব স্বামী ছিল রাসূলের চাচাত ভাই২১ () বদর  যুদ্ধে  তার  নির্ভীক  বীর  স্বামী শহীদ হওয়ায় তার অন্তরে যে ব্যথা সৃষ্টি হয়, তা দূরীভূত করে তার হৃদয়কে প্রশান্ত করা তার প্রতি সহানুভূতি স্বরূপ রাসূল (ছাঃ) তাকে বিবাহ করেন২২ () যয়নাব (রাঃ)-এর পিতৃবংশ হাওয়াযেন-এর বনু আমির শাখার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মানসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে স্ত্রীত্বে বরণ করেন২৩
রাসূলের নিকটে অবস্থান :
রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে তিনি কতদিন অবস্থান করেছিলেন ব্যাপারে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। () মাহমূদ শাকের বলেনوعاشت عنده عامين ثم توفيت فى حياته، ‘তিনি রাসূলের নিকটে দুবছর জীবন যাপন করেন। অতঃপর রাসূলের জীবদ্দশায়ই তিনি ইন্তিকাল করেন২৪ () হাকিম নাইসাপুরী বলেনولم تلبث عنده إلا يسيرًا، ‘তিনি রাসূলের নিকটে অল্প দিন অবস্থান করেন২৫ () হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেনلم تمكث عنده إلا شهرين أو أكثر، ‘তিনি রাসূলের নিকট কেবল দুমাস বা তার চেয়ে কিছু বেশী দিন অবস্থান করেন২৬ () সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ জরদানী বলেনولم تلبث عنده إلا شهرين أوثلاثة ثم مات، ‘তিনি রাসূলের নিকটে শুধু দুমাস বা তিন মাস অবস্থান করেন। অতঃপর মৃত্যুবরণ করেন২৭ () ইবনু সা ইবনুল কালবী বলেন, فمكث عنده ثمانية أشهر، ‘অতঃপর তিনি রাসূলের নিকটে মাস অবস্থান করেন২৮ () হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী ইবনুল ইমাদ আল-হাম্বলী বলেছেন, যয়নাব (রাঃ) রাসূলের নিকটে তিন মাস অবস্থান করেন২৯ মোটকথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে যয়নাব (রাঃ) অল্পকাল ছিলেন এবং রাসূলের জীবদ্দশাতেই ইন্তিকাল করেন৩০ তাঁর থেকে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি৩১
দানশীলতা :
যয়নাব (রাঃ)-এর দানশীলতা ছিল সুপরিজ্ঞাত। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই তিনি স্বীয় কবীলার নিকট দানশীলা হিসাবে পরিচিতা ছিলেন। কোন দীন-দুঃখী তাঁর নিকটে এসে খালি হাতে ফিরে যেত না। তিনি গরীব-দুঃখীদের এমনভাবে সেবা-যত্ন করতেন যে, তাঁকেউম্মুল মাসাকীনবাগরীবদের জননীউপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল৩২ ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর মধ্যে দান-খয়রাত করার প্রবণতা অব্যাহত ছিল। দরিদ্র-অভাবী মানুষের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। তাঁর অনুপম গুণাবলীর দ্বারা তিনি পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন। তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে . আয়েশা আব্দুর রহমান বলেন, ঐতিহাসিক চরিতকারগণ যয়নাব বিনতু খুযাইমার বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য করলেও গরীব-দুঃখীদের প্রতি তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্য, সহানুভূতি-সহমর্মিতার এই উত্তম বিশেষণের ব্যাপারে সকলেই ঐকমত্য হয়েছেন। যত গ্রন্থে যয়নাব বিনতু খুযাইমার নাম উল্লেখিত হয়েছে সেখানেই তাঁর উপাধিউম্মুল মাসাকীনতথাদরিদ্রদের জননীউল্লেখ করা হয়েছে৩৩ রাসূলের স্ত্রী হিসাবে বরিত হওয়ার পরও রাসূলের সেবা অন্তঃপুরের ব্যস্ততা গরীব-দুঃখীদের সেবা-যত্ন থেকে তাঁকে দূরে সরাতে পারেনি। গুণ আমৃত্যু তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল৩৪
রাসূলের আনুগত্য অল্পে তুষ্টি :
ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল অকৃত্রিম অতুলনীয়। রাসূলের স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা তিনি লাভ করেছিলেন, এজন্য তার মনে কোন অহংকার ছিল না। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে যা পেতেন তার প্রতিই সন্তুষ্ট থাকতেন। অল্পে তুষ্টির উত্তম গুণ তাঁর মধ্য ছিল সদা অমলিন। কোন উচ্চাভিলাষ কোন আত্মঅহংকার তাঁর উত্তম বিশেষণ থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বরং সরল-সহজ, অনাড়ম্বর নির্ঝঞ্ঝাট জীবন-যাপনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন৩৫
ইন্তিকাল দাফন :
যয়নাব (রাঃ)-এর মৃত্যু সন নিয়েও কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। ইবনুল কালবী বলেনوماتت فى ربيع الآخر سنة أربع ‘তিনি ৪র্থ হিজরীর রবীউল আখির মাসে ইন্তিকাল করেন৩৬ ইবনু সা বলেনوتوفيت فى آخر شهر ربيع الآخر على رأس تسعة وثلاثين شهرًا- ‘তিনি হিজরতের ৩৯ মাসের মাথায় রবীউল আখির মাসের শেষে মৃত্যুবরণ করেন৩৭ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩০ বছর৩৮ . আয়েশা আব্দুর রহমান বলেনوالراحج انها ماتت فى الثلاثين من عمرها- ‘অগ্রাধিকারযোগ্য কথা হচ্ছে যে, তিনি ৩০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন৩৯
উম্মুল মুমিনীনদের মধ্যে খাদীজা (রাঃ) প্রথম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইন্তিকাল করেন, যাকে মক্কারজিহুননামক স্থানে দাফন করা হয়। অতঃপর যয়নাব বিনতু খুযাইমা (রাঃ) রাসূলের জীবদ্দশায় মদীনায় ইন্তিকাল করেন৪০ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জানাযা ছালাত পড়ান। তাঁকেবাক্বীউল গারক্বাদেদাফন করা হয়৪১ যয়নাব (রাঃ)-এর তিন ভাই তাঁর কবরে নেমেছিলেন৪২ উম্মুল মুমিনীনের মধ্যে যয়নাব বিনতু খুযাইমাই (রাঃ) ছিলেন ভাগ্যবতী মহিলা, যাকে প্রথমবাক্বীউল গারক্বাদেদাফন করা হয়৪৩

উপসংহার :

ইসলামপূর্ব জাহেলীযুগ থেকেই যয়নাব (রাঃ) দুস্থ মানবতার সেবায় ছিলেন নিবেদিতা প্রাণ। ইসলামে দাখিল হওয়ার পর নিবিষ্টমনে মহান আল্লাহ্র ইবাদত করার পাশাপাশি তিনি গরীব-দুঃখী অসহায় মানুষের পাশে  দাঁড়াতেন। আর তাঁর সৎকাজের সুমহান পুরস্কার আল্লাহ তাকে পার্থিব জীবনে দান করেছেন। তাঁর অসহায়ত্বের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পাশে এসে দাঁড়ান এবং তাকে স্ত্রী হিসাবে বরণ করেন। তিনি উম্মুল মুমিনীন হওয়ার বিরল সম্মানে ভূষিতা হন। যদিও রাসূলের সাথে তার দাম্পত্য জীবন ছিল অতি অল্প সময়ের; কিন্তু তাঁর সৌভাগ্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং তার জানাযা ছালাত পড়িয়েছেন। পরিশেষে বলব, যয়নাব (রাঃ) তাঁর সংগ্রামী জীবনে সদা দীন-দুঃখীদের পাশে ছিলেন। তাদের প্রয়োজন পূরণই ছিল তাঁর সতত সাধনা। এই অনুপম গুণই তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। আল্লাহ আমাদেরকেও তাঁর মত গুণাবলী অর্জনের তাওফীক্ব দিন- আমীন!

No comments

Powered by Blogger.