উম্মুল মুমিনীন সাফিয়া (রাঃ) এর জীবনী
বংশ পরিচয় : হযরত সাফিয়া (রা:) বিনতে হুয়ায় ইবনে আখতাব ছিলেন লাকী ইবনে ইয়াকু এর বংশধরায় হযরত হারুন ইবনে ইমরান (আ:) এর বংশধরার। এ কারণে তাকে সাফিয়া (রা:) বিনতে হুয়ায় ইসরাইলিয়া বলা হয়। তাঁর পিতা হুয়ায় ইবনে আখতাব মদীনার বিখ্যাত ইহুদী গোত্র বনু নাদীর এবং মাতা বাররা বিনতে সামওয়াল ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জার সন্তান।মূলত সাফিয়া (রা:) এর আসল নাম যয়নব। যেহেতু তিনি খায়বার যুদ্ধের গনীমতের মাল হিসাবে মুসলমানদের কাছে আসে এবং বন্টনের সময় রাসূল (সা:) এর ভাগে পড়েন,আর তৎকালীন আরবে নেতা বা বাদশাহর অংশের গনীমতের মালকে সাফিয়া বলা হতো। তাই যয়নবও সেখানে সাফিয়া নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান।
হযরত সাফিয়া (রা:) এর পিতা হুয়ায় ইবনে আখতাব ইহুদীদের নামকরা গোত্র বনু নজিরের সরদার ছিলেন। নবীর বংশধর হওয়ার কারণে হুয়ায় নিজের কওমের মধ্যে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। এবং সমগ্র জাতি তার সামনে মাথা নত করে রাখতো।
বিয়ে : বনু কুরায়জার সালাম ইবনে মাশকাম ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি ও নেতা। তাঁর সাথে হযরত সাফিয়ার (রা:) প্রথম বিয়ে হয়।এ বিয়ে টেকেনি ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর হিজাযের বিখ্যাত সওদাগর ও খায়বারের অন্যতম নেতা আবু রাফে এর ভাতিজা কিনানা ইবনে আবিল হুকাইকের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। সম্মান ও প্রতিপত্তির দিক দিয়ে কিনানা ইবনে আবিল সালামের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলেন না, তিনি খায়বারের অতি প্রসিদ্ধ দূর্গ আল কামুসের নেতা এবং বড় কবি ছিলেন।
রাসূল (সা:) এর সাথে বিয়ে : খায়বার যুদ্ধ ইহুদীদের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রমাণিত হলো। হযরত সাফিয়া (রা:) খান্দানের সকল সদস্যই হয় এই যুদ্ধে নিহত বা যুদ্ধবন্দী হয়েছিল নিহতদের মধ্যে তাঁর পিতা, ভাই এবং স্বামী ছিলেন। যুদ্ধের পর সকল বন্দী ও গনীমতের মাল একত্রিত করা হলো। বংশীয় মর্যাদায় হযরত সাফিয়া (রা:) বনু কুরায়জা ও বনু নাজিরের নেত্রী, বংশীয় মর্যাদায় তিনি অনেক উঁচুতে আসীন। তাই সাহাবীরা তাকে রাসূল (সা:) এই পরামর্শকে কবুল করলেন ; দাহিয়া কালবী (রা:) অন্য বাঁদী দিয়ে সাফিয়া (রা:) কে মুক্ত করে দিলেন এবং তাকে নিজের গৃহে ফিরে যাওয়া অথবা রাসূল (সা:)কে বিয়ে করার স্বাধীনতা প্রদান করলেন।
ধৈর্য ও দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক : যুদ্ধের পর বেলাল (রা:) হযরত সাফিয়া (রা:) এবং তার আত্মীয় এক বোনকে ধরে নিয়ে এলেন। সে রাস্তায় নিহত ইহুদীদের লাশ রক্ষা ও অবস্থায় মাটিতে পড়েছিলো। তাদের মধ্যে হযরত সাফিয়া (রা:) পিতা, ভাই এবং স্বামীর লাশও ছিলেন। শোকগ্রস্ত ও অত্যন্ত বেদনার সাথে সাফিয়া (রা:) এইসব লাশের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু তার সঙ্গী বোন খুব ক্রন্দন ও বুক চাপড়ানো শুরু করলেন, তখন আল্লাহর রাসূল (সা:) বেলাল (রা:) বললেন : বেলাল! তোমার অন্তরে দয়া বলে কিছু নেই। তুমি এই মহিলাদের সেই রাস্তা দিয়ে এনেছো যে রাস্তায় তাদের পিতা ও ভাই মাটি ও রক্তে একাকার হয়ে পড়ে রয়েছে, ইসলাম গ্রহণের পর কেউ ইহুদী বলে কটাক্ষ করলে তিনি ভীষণ কষ্ট পেতেন। কিন্তু কিছু না বলে ধৈর্যধারণ করতেন। একদিন রাসূল (সা:) তার ঘরে এলেন।
এ সময় হযরত সাফিয়া (রা:) কাঁদছিলেন, কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আয়েশা (রা:) ও যয়নব (রা:) বলে থাকেন, আমরা সকল স্ত্রীর মধ্যে উত্তম। কেননা আমার নবীর স্ত্রী হওয়া ছাড়াও তার আত্মীয়ও। কিন্ত তুমিতো ইহুদী কন্যা। রাসূল (সা:) সাফিয়া (রা:)কে খুশি করার জন্য বললেন : যদি আয়েশা (রা:) ও যয়নব (রা:) এই কথাই বলে থাকে যে, তাদের বংশের সাথে নবী (সা:) বংশের সম্পর্ক রয়েছে তাহলে তুমি তাদেরকে কেন বলোনি যে,আমার পিতা হারুন (আ:) আমার চাচা মুসা (আ:) এবং আমার স্বামী মুহাম্মদ (সা:)।
উদার ও দানশীল : হযরত সাফিয়া (রা:) যখন উম্মুল মুমীনিন হিসেবে মদীনায় আগমন করলেন তখন হযরত ফাতেমা (রা:) তাকে দেখতে এলেন, এ সময় তিনি কানের মূল্যবান ঝুমকো খুলে হযরত ফাতেমা (রা:) কে উপহার দেন এবং তাঁর সাথে আগত অন্যান্য মহিলাদেরকেও কোন না কোন উপহার ভাগ করে দেন। তিনি স্বভাবগতই ছিলেন অত্যন্ত উদার ও দানশীল। ইবনে সা’দ লিখেছেন, যে ঘরখানিতে তিনি বসবাস করতেন জীবদ্দশায় তা তিনি দান করে গেছেন।
সাফিয়া (রা:)’র প্রতি রাসূল (সা:) এর ভালোবাসা : রাসূল (সা:) তাকে অত্যন্ত্ ভালোবাসতেন এবং তার মন যোগানোর চেষ্টা করতেন।একবার সফরে অন্যান্য স্ত্রীরাও(রা:) রাসূল (সা:) এর সঙ্গে ছিলেন। ঘটনাক্রমে সাফিয়া (রা:) উট অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাফিয়া (রা:) এতে ভয় পেয়ে যান এবং কান্না শুরু করেন, খবর পেয়ে রাসূল (সা:) আসেন এবং নিজের পবিত্র হাতে তাঁর চোখের পানি মুছে দেন। কিন্তু এতে তার কান্না না থেমে আরও বেড়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে রাসূল (সা:) সকলকে নিয়ে সেখানে যাত্রা বিরতি করেনে। এবং হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রা:) কে বলেন, যয়নব তুমি সাফিয়াকে একটি উট দাও। হযরত যয়নব (রা:) অত্যন্ত্ দানশীল ও ভদ্র ছিলেন। কিন্তু এসময় তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আমি উট দিব এই ইহুদী মহিলাকে ? তাঁর এমন প্রত্যুত্তরে রাসূল (সা:) ভীষণ নাখোশ হন এবং দ্ইু অথবা তিন মাস যয়নব (রা:) সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি। অবশেষে হযরত আয়েশা (রা:)’র মধ্যস্থতায় অতি কষ্টে র্সাূল (সা:) এর অসন্তুষ্ট দূর করান।
আর একবার হযরত আয়েশা (রা:) সাফিয়া (রা:) দৈহিক গঠন সম্পর্কে একটি মন্তব্য করলে রাসূল (সা:) বলেন, তুমি এমন একটি কথা বলেছো তা যদি সাগরেও ছেড়ে দেয়া হয়,তাতে মিশে যাবে (অর্থাৎ,সাগরের পানিও ঘোলা করে ফেলবে)।
রাসূল (সা:) প্রতি ভালোবাসা : রাসূল (সা:) প্রতি হযরত সাফিয়ার ছিলো অন্তহীন ভালোবাসা। রাসূল (সা:) যখন আয়েশা (রা:) গৃহে অন্তিম রোগশয্যায় তখন একদিন সাফিয়া (রা:) সহ সব স্ত্রীরা রাসূল (সা:) কে দেখতে ও সেবা করতে একত্র হন। হযরত সাফিয়ার সময় অত্যন্ত্ ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন : হে আল্লাহর নবী ! আপনার এই কষ্ট যদি আমিই ভোগ করতাম,খুশী হতাম। তার এমন বক্তব্যে সবাই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল যেন , তার কথায় তারা সন্দেহ করছেন। তখন রাসূল (সা:) বললেন, আল্লাহর কসম সে সত্য বলছে।
ভুল স্বীকারের : একবার কোন কথায় রাসূল (সা:) হযরত সাফিয়ার (রা:) ওপর অসন্তুষ্ট হলেন। তখন হযরত সাফিয়া (রা:) হযরত আয়েশা (রা:) নিকট গেলেন এবং বললেন, আপনি জানেন আমি কোন বস্তুর বিনিময়েই আমার পালাকে কাউকে দেয়নি। কিন্তু আপনি যাদ নবী (সা:) কে আমার ব্যাপারে রাজি করিয়ে দেন তাহলে আমার পালার দিন আপনাকে দিয়ে দিব। হযরত আয়েশা (রা:) এই কাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং রাসূল (সা:) এর খিদমতে হাজির হলেন।
তিনি বললেন,“ আয়েশা আজ তো তোমার পালার দিন নয়। অত:পর আয়েশা (রা:) রাসূল (সা:) কে সব ঘটনা খুলে বললেন এবং রাসূল (সা:) সাফিয়া (রা:) ওপর অত্যন্ত্ খুশী হয়ে গেলেন।
স্পষ্টবাদিতা : হযরত ওমর (রা:)’র শাসনামলে হযরত সাফিয়া (রা:) একদল দাসী আমীরুল মুমিনিনের কাছে অভিযোগ করলো উম্মুল মুমীনিন (রা: )’র নিকট থেকে এখনো ইহুদীর গন্ধ আসে। কেননা এখনো তিনি শনিবারকে ভালো মনে করেন এবং ইহুদীদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক রাখেন। হযরত ওমর (রা:) অবস্থা তদন্তের জন্য স্বয়ং উম্মুল মুমীনিন সাফিয়ার (রা:) নিকট তাশরীফ নিলেন।
জবাবে তিনি বললেন,‘যখন থেকে খোদা আমাকে শনিবারের পরিবর্তে শুক্রবার দিয়েছেন, তখন থেকেই শনিবারের প্রতি ভালোবাসার প্রয়োজন থাকেনি। হাঁ ইহুদীদের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। কেননা তারা আমার আত্মীয় এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখতে হয়। হযরত ওমর (রা:) তার স্পষ্টবাদিতায় খুব খুশী হয়ে ফিরে এলেন। এরপর হযরত সাফিয়া (রা:) দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন,আমীরুল মুমিনুনের (রা:) নিকট আমার বিরুদ্ধে তোমাকে অভিযোগ করার ব্যাপারে কোন বস্তু উদ্বুদ্ধ করেছে? সে বললো,“শয়তান আমাকে প্ররোচনা দিয়েছে”।
উম্মুল মুমিনিন (রা:) বললেন, “যাও,আমি তোমাকে খোদার রাস্তায় আযাদ করে দিলাম”।
নৈতিক গুনাবলী : সকল বিশেষজ্ঞ হযরত সাফিয়া (রা:) নৈতিক গুনাবলীর অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন। আল্লামা ইবনে আবদলি বলেছেন
- সাফিয়া (রা:) ছিলেন ধৈর্যশীল,বুদ্ধিমতি ও বিদুষী নারী।
- ইবনুল আমীর বলেছেন: তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমতি মহিলা।
আল্লামা জাহাবী বলেছেন : হযরত সাফিয়া (রা:) ছিলেন ভদ্র, বুদ্ধিমতি, উঁচু বংশীয়, রূপবতী ও দীনদার মহিলা।
জ্ঞান পিপাসা : ইলম ও ফজিলতের ক্ষেত্রে হযরত সাফিয়া (রা:) মর্যাদা অত্যন্ত বুলন্দ ছিলো। কুফার মহিলারা প্রায়ই তার নিকট মাসলা জানতে আসতেন। হযরত সাফিয়া (রা:) থেকে দশটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
মৃত্যু : হিজরী ৫০ সালের রমযান মাসে ৬০ বছর বয়সে হযরত সাফিয়া (রা:) মদীনায় ইন্তেকাল করেন। হযরত সাইদ ইবনুল আস (রা:) তার জানাযার নামায পড়ান, জান্নাতুল বাকীতে তার লাশ দাফন করা হয়।
No comments