মায়মূনা বিনতে হারেস (রাঃ) এর জীবনী

ভূমিকা :
নবীপত্নী উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ) ছিলেন বহু দুর্লভ গুণের অধিকারিণী এক বিদুষী মহিলা। ছাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন সমস্যায় তিনি অতি বিচক্ষণতার সাথে সমাধান দিতেন। উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আল্লাহভীতি, দানশীলতা, ইবাদত-বন্দেগী, আল্লাহ তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রভৃতি গুণাবলীর জন্য তিনি ছিলেন সবার প্রিয় পাত্রী। অহি- নির্মল আলোতে তাঁর জীবন ছিল উদ্ভাসিত। রিসালাতে মুহাম্মাদীর সংস্পর্শে এসে দ্বীন সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারিণী এই বিদুষী মহিলার সংক্ষিপ্ত জীবনাদর্শ আমরা এখানে আলোচনার প্রয়াস পাব

নাম বংশপরিচয় :
তাঁর প্রকৃত নাম ছিল বাররা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন মায়মূনা তাঁর পিতার নাম হারেছ। মাতার নাম হিন্দ বিনতু আওফ। মায়মূনা (রাঃ)-এর পূর্ণ বংশধারা হচ্ছে- মায়মূনা বিনতুল হারেছ ইবনু হাযান ইবনে বুজায়র ইবনিল হাযম ইবনে রুওয়ায়বা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হেলাল ইবনেআমির ইবনে ছাছাআহ ইবনে মুআবিয়াহ ইবনে বকর ইবনে হাওয়াযিন ইবনে মানছূর ইবনে ইতরামা ইবনে খাফসা ইবনে কায়স ইবনে আয়লান ইবনে মুযার হাকিম নাইসাপুরী বুজায়র ইবনিল হাযম-এর স্থলে বুজায়র ইবনিল হুরম (بجير ابن الهرم) উল্লেখ করেছেনমায়মূনা (রাঃ)-এর মায়ের বংশধারা হচ্ছে- হিন্দ বিনতু আওফ ইবনে যুহায়র ইবনিল হারিছ ইবনে হাতামা ইবনে জারাশ মতান্তরে জারীশ তিনি হুমায়রমতান্তরে কিনানা গোত্রের মহিলা ছিলেন

মায়মূনা (রাঃ) ছিলেন আববাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী উম্মুল ফযল লুবাবা আল-কুবরা বিনতুল হারিছ, ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরার স্ত্রী লুবাবা আছ-ছুগরা বিনতুল হারিছ আসমা বিনতুল হারিছের বোন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে الأخوات مؤمنات (মুমিনা বোনগণ) বলে অভিহিত করেছেন তিনি প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস সাইফুল্লাহ খ্যাত খালিদ বিন ওয়ালীদের খালা ছিলেন

জন্ম শৈশব :
মায়মূনা (রাঃ)-এর জন্ম শৈশব সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ কিছু বলেননি। ফলে তাঁর জন্ম শৈশব সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে ৭ম হিজরী সনে ৩৭ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়১০ সে হিসাবে তাঁর জন্ম ৫৯২ হিজরীতে হয়েছিল বলে ধরে নেয়া যায়

প্রথম বিবাহ :
জাহেলী যুগে তাঁর প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল মাসঊদ ইবনু আমর ইবনে ওমাইর আছ-ছাক্বাফীর সাথে। কোন কারণে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটলে আবু রুহম ইবনু আব্দুল ওয্যা ইবনে আবী কায়েস-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। তিনি বানু মালেক ইবনে হাসাল ইবনে আমের ইবনে লুই-এর লোক ছিলেন। ৭ম হিজরীতে তিনি মারা যান১১

রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহ :
খায়বার যুদ্ধের পরে ৭ম হিজরীর শাওয়াল মতান্তরে যুলক্বাদাহ মাসে কাযা ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনের পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন১২  সময় মায়মূনা (রাঃ)-এর বয়স হয়েছিল ২৬ বছর১৩ মতান্তরে ৩৭ বছর১৪ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক মায়মূনা (রাঃ)-কে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাপারে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। . রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাযা ওমরা আদায়ের বছর মক্কার উদ্দেশ্য রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে আওস ইবনু খাওলী আবু রাফেকে আববাস (রাঃ)-এর নিকটে পাঠান। কিন্তু তারা পথ হারিয়ে ফেলেরাবেগউপত্যকায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। অবশেষেকুদাইদনামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে পেয়ে তাঁর কাফেলার সাথে যুক্ত হয়ে মক্কায় গমন করেন। রাসূল মক্কায় পৌঁছে আববাস (রাঃ)-এর নিকট দূত পাঠান। দূত উক্ত বিষয়টি আববাসের নিকটে উল্লেখ করে। অন্য বর্ণনায় আছে, মায়মূনা তার বিষয়টি রাসূলের নিকটে পেশ করে। তখন রাসূল (ছাঃ) আববাসের বাড়ীতে গিয়ে মায়মূনাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে আববাস (রাঃ) তাকে রাসূলের সাথে বিবাহ দেন১৫

() রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাফর ইবনু আবু তালেবের মাধ্যমে মায়মূনার নিকটে প্রস্তাব পাঠালে তিনি বিষয়টি আববাস (রাঃ)-এর নিকটে উপস্থাপন করেন। তখন আববাস (রাঃ) তাকে রাসূলের সাথে বিবাহ দেন১৬

() মায়মূনা (রাঃ) রাসূলের প্রতি তার মনের আকর্ষণের কথা স্বীয় সহোদর বোন উম্মুল ফযল-এর নিকট ব্যক্ত করেন। তখন উম্মুল ফযল তার স্বামী আববাস (রাঃ)-এর সাথে বিষয়ে আলাপ করেন। আববাস (রাঃ) একথা রাসূলের নিকটে পেশ করেন। এমনকি তিনি রাসূলের নিকট মায়মূনাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে মায়মূনা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন১৭

() রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু রাফে অন্য একজন আনছার লোককে মায়মূনার নিকটে পাঠান। তারা মায়মূনাকে রাসূলের সাথে বিবাহ দেন তিনি মদীনা থেকে (মক্কার উদ্দেশ্যে) বের হওয়ার পূর্বে১৮

() বাররা বিনতুল হারিছ ওরফে মায়মূনা (রাঃ) নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য দান করেছিলেন। সম্পর্কে  আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেনوَامْرَأَةً مُّؤْمِنَةً إِنْ وَهَبَتْ نَفْسَهَا لِلنَّبِيِّ إِنْ أَرَادَ النَّبِيُّ أَنْ يَّسْتَنْكِحَهَا خَالِصَةً لَّكَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِيْنَ- ‘কোন মুমিনা নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পণ করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য, অন্য কোন মুমিনের জন্য নয়’ (আহযাব ৫০)১৯

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে যখন বিবাহের প্রস্তাব পাঠান তখন মায়মূনা (রাঃ) একটি উটে চড়েছিলেন। রাসূলের প্রস্তাবে তিনি খুশি হয়ে বলেন,اَلْجَمَلُ وَمَا عَلَيْهِ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم- ‘ উট এবং এর উপর যা আছে সব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য২০ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে ৪০০ দিরহাম মতান্তরে ৫০০ দিরহাম মহর দিয়েছিলেন২১তিনি ছিলেন নবী করীম (ছাঃ)-এর সর্বশেষ বিবাহিতা স্ত্রী২২

বাসর যাপন :
৭ম হিজরীর শাওয়াল মাসে কাযা ওমরা সম্পন্নের পর মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পথেতানঈম’-এর নিকটবর্তী মক্কা থেকে ১০ বা ১২ মাইল দূরেসারিফনামক স্থানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-এর সাথে বাসর যাপন করেন২৩

নবী করীম (ছাঃ) মক্কায় তিন দিন অবস্থান করেন। তৃতীয় দিনে হুয়াইতাব ইবনু আব্দুল ওয্যা আরো কয়েক জন কুরাইশ লোক নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার (মক্কায় অবস্থানের) সময় শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং তুমি আমাদের এখান থেকে চলে যাও। তিনি বললেন, ‘তোমাদের কি , তোমরা আমাকে পরিত্যাগ করেছ, আর আমি তোমাদের সামনে বাসরের আয়োজন করেছি এবং তোমাদের জন্য খাদ্য প্রস্ত্তত করেছি! ইতিমধ্যে তোমরা হাযিরও হয়েছ তারা বলল, তোমার খাদ্যের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। তুমি আমাদের এখান থেকে চলে যাও। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে নিয়ে বের লেন এবংসারিফনামক স্থানে এসে যাত্রা বিরতি করেন। এখানেই তিনি বাসর যাপন করেন২৪

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কি মুহরিম অবস্থায় মায়মূনা (রাঃ)-কে বিবাহ করেছিলেন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে হালাল অবস্থায় না মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে দুধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। মুহাম্মাদ ইবনু সাআত-তাবাক্বাতুল কুবরাগ্রন্থে ১১টি বর্ণনা পেশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে হালাল অবস্থায় বিবাহ করেছেন। পক্ষান্তরে তিনি বিভিন্ন সূত্রে ১৭টি বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন যে, তাঁদের বিবাহ মুহরিম অবস্থায় সম্পন্ন হয়েছিল২৫ অনুরূপভাবে হাকিম নাইসাপুরী (রহঃ) পক্ষে-বিপক্ষে কয়েকটি বর্ণনা পেশ করেছেন২৬ হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী পক্ষে-বিপক্ষে কতিপয় বর্ণনা উল্লেখ করে মুহরিম অবস্থায় বিবাহ সংক্রান্ত বর্ণনাকে মুতাওয়াতির বলেছেন২৭ উক্ত বর্ণনাগুলোর মধ্যে দুএকটি নিম্নে উল্লেখ করা -
عَنْ يَزِيْدَ بْنِ الْأَصَمِّ حَدَّثَتْنِيْ مَيْمُوْنَةُ بِنْتُ الْحَارِثِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَهَا وَهُوَ حَلاَلٌ قَالَ وَكَانَتْ خَالَتِيْ وَخَالَةَ ابْنِ عَبَّاسٍ-
ইয়াযীদ ইবনুল আছাম তে বর্ণিত তিনি বলেন, মায়মূনা বিনতুল হারিছ (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে হালাল অবস্থায় বিবাহ করেছেন। রাবী বলেন, তিনি আমার ইবনু আববাসের খালা ছিলেন২৮ অন্য বর্ণনায় আছে,
عَنْ يَزِيْدَ بْنِ الْأَصَمِّ ابْنِ أَخِيْ مَيْمُوْنَةَ عَنْ مَيْمُوْنَةَ قَالَتْ تَزَوَّجَنِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ حَلاَلاَنِ بِسَرِفَ-
ইয়াযীদ ইবনুল আছাম (মায়মূনার ভাগ্না) তে বর্ণিত তিনি বলেন, মায়মূনা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহসারিফনামক স্থানে আমাকে বিবাহ করেন এবং আমরা হালাল অবস্থায় ছিলাম২৯
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ عِكْرِمَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَ مَيْمُوْنَةَ وَهُوَ مُحْرِمٌ-
ইকরিমা ইবনু আববাস (রাঃ) তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করেছেন৩০ আবুশ শাছা থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে৩১

সমন্বয় :
উপরোক্ত দুই ধরনের বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে মনীষীগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যথা- . রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করেছেন এবং হালাল অবস্থায় বাসর যাপন করেছেন। . সময় পর্যন্ত মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করা হারাম হয়নি৩২ . কারো মতে, তিনি তখন হারামের সীমানার মধ্যে ছিলেন। এজন্য তাকে মুহরিম বলা হয়েছে। কিন্তু মূলতঃ তিনি হালাল ছিলেন। . রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হালাল অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন বাসর যাপন করেছিলেন এবং বিবাহের কথা প্রকাশ করেছিলেন মুহরিম অবস্থায়৩৩যেরূপ ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বাগাভী (রহঃ) বলেন,وَالْاَكْثَرُوْنَ عَلٰى أَنَّهُ تَزَوَّجَهَا حَلاَلاً وَظَهَرَ أَمْرَ تَزْوِيْجِهَا وَهُوَ مُحْرِمٌ ثُمَّ بَنَى بِهَا وَهُوَ حَلاَلٌ بِسَرِفَ فِىْ طَرِيْقِ مَكَّةَ. ‘অধিকাংশ বিদ্বান মতে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হালাল অবস্থায় তাকে (মায়মূনাকে) বিবাহ করেছেন এবং বিবাহের বিষয়টি মুহরিম অবস্থায় প্রকাশ করেছেন। আর মক্কার পথেসারিফনামক স্থানে তার সাথে বাসর যাপন করেন হালাল অবস্থায়৩৪

বিবাহের কারণ :
তৎকালীন আরব সমাজে বিভিন্ন গোত্রের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। সম্পর্কের কারণেই ছোট ছোট গোত্রগুলো বিশালাকার ধারণ করে। এই বৈবাহিক সম্পর্ক পরিচিতির সূত্র ধরে মরুর পথে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে বহু দূর দূরান্ত থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে যাতায়াত করত। সম্পর্কের ফলে নির্ভয়ে তারা এক শহর থেকে অন্য শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সফর করত। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপ্লব সাধিত হয়। অনুরূপভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে ইসলামী দাওয়াত সুদীর্ঘ কাল থেকে ব্যাপকতা লাভ করে আসছে। সেই দিক থেকে বিবাহ ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক মায়মূনা (রাঃ)-কে বিবাহ করার উল্লেখযোগ্য কতিপয় কারণ হচ্ছে- () আববাস (রাঃ)-এর পরিবার-পরিজনের সাথে সুসম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করা। কেননা তারা বিবাহ বন্ধনকে মনে-প্রাণে কামনা করছিলেন। () মায়মূনা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। এতে তিনি বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার মানসিক অবস্থা ঠিক করার জন্য এবং বিভিন্ন সমস্যা থেকে হেফাযত করার জন্য তাকে বিবাহ করেন। () মক্কার মুশরিকদের অন্তরকে প্রভাবিত করার জন্য, বিশেষতঃ মায়মূনা (রাঃ)-এর গোত্র বনু হেলালের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য রাসূল (ছাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন। কেননা আরবরা বৈবাহিক সম্পর্ককে মহৎ মানবিকতা, আশ্রয় দান সহায়তা হিসাবে গণ্য করত। বিবাহের ফলে দেখা যায়, গোত্রের লোক দলে দলে ইসলাম কবুল করছে৩৫

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :
উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রাঃ) বহু দুর্লভ গুণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারিণী ছিলেন। নিম্নে তাঁর কতিপয় উত্তম গুণাবলী উপস্থাপন করা ল।-

. তাকওয়া বা আল্লাহভীতি : বিশ্ব জাহানের মালিক মহান আল্লাহকে তিনি সবচেয়ে বেশী ভয় করতেন। জীবনের প্রতিটি কাজে তা প্রতিফলিত এবং তাঁর সাথে যারা ওঠা-বসা করতেন তারা তাঁর বৈশিষ্ট্যকে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) মায়মূনা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁর অনুপম গুণ প্রতিভাত হয়েছে। তিনি বলেনأَمَا اَنَّهَا كَانَتْ مِنْ أَتْقَانَا لِلَّهِ، وَأَوْصَلَنَا لِلرِّحْمِ،জেনে রেখো, নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহভীরু এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারীণী৩৬

. দানশীলতা : মায়মূনা (রাঃ) অতীব দানশীলা মহিলা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার এগুণটি পসন্দ করতেন। মায়মূনা (রাঃ)-এর একজন দাসী ছিল। তিনি তাকে আল্লাহ্র নামে আযাদ করে দেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট একথা বর্ণনা করলে তিনি বললেন, তুমি যদি অর্থ তোমার ভাই ইবনুল হারিছকে দিতে তবে অধিক ছওয়াব পেতে৩৭

() ইবাদত-বন্দেগী : মায়মূনা (রাঃ) অতি ইবাদতগুযার মহিলা ছিলেন। তিনি ছালাত আদায়ের সময়ে তনুত্রাণ পরিধান করে তথা আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃত করে ছালাত আদায় করতেন৩৮ তিনি হজ্জ করতে গিয়ে ইহরাম অবস্থায় মাথা কামিয়ে ফেলেন। অবস্থায়ই তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাথায় তখন নতুন চুলে ভরা ছিল৩৯ মায়মূনা (রাঃ)-এর সম্ভবতঃ জানা ছিল না যে, হজ্জ বা ওমরায় মহিলাদের মাথা কামানো নিষেধ, বরং চুল ছোট করতে হয়। কেননা হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَلِيٍّ رضي الله عنه قَالَ نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ تَحْلِقَ الْمَرْأةُ رَأسَهَا
আলী (রাঃ) তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহিলাদের মাথা কামাতে নিষেধ করেছেন৪০ অন্য বর্ণনায় এসেছেلَيْسَ عَلَى النِّسَاءِ الْحَلْقُ إِنَّمَا عَلَى النِّسَاءِ التَّقْصِيْرُ 
মহিলাদের উপর মাথা কামানো নেই, তাদের জন্য আবশ্যক চুল খাটো করা৪১

() দ্বীনের বিধানের প্রতি কঠোরতা : আল্লাহ রাসূলের আদেশ-নিষেধের প্রতি তিনি খুবই মনোযোগী ছিলেন। আল্লাহ্র হুকুমের বিপরীত কোন কাজ তে দেখলে, তিনি তা বরদাশত করতেন না। একদা তাঁর এক নিকটাত্মীয় তাঁর গৃহে আসল। তখন লোকটির মুখ থেকে শরাবের গন্ধ আসছিল। তিনি বললেন, যদি তুমি মুসলমানদের নিকটে যাও, তাহলে তারা তোমাকে বেত্রাঘাত করবে কিংবা তোমাকে পবিত্র করে ছাড়বে। তুমি আমার নিকটে আর কখনো আসবে না৪২

() বুদ্ধিমত্তা : তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীছ থেকে তাঁর ফিক্বহী সূক্ষ্মতার পরিচয় মেলে। উদাহরণ স্বরূপ একটি হাদীছ উল্লেখ করা - একবার ইবনু আববাস (রাঃ) মলিন মুখে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে বৎস! তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেন, উম্মু আম্মার (তাঁর স্ত্রী) আমার চুলে চিরুণী করে দিত। কিন্তু সে মাসিক স্রাবে রয়েছে। তিনি বললেন, কী চমৎকার! আমার রকম দিনে নবী করীম (ছাঃ) আমার কোলে মাথা রেখে শয়ন করতেন কুরআন মাজীদ পড়তেন। আমি অবস্থায় মসজিদে বিছানা (চাটাই) রেখে আসতাম। বৎস! হাতেও কি এসব হয় কখনও?৪৩

ইলমী খিদমত :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইন্তিকালের পরও দীর্ঘ দিন মায়মূনা (রাঃ) জীবিত ছিলেন। মহানবী (ছাঃ)-এর অনেক হাদীছই উম্মুল মুমিনীনদের মাধ্যমে পরবর্তীদের কাছে সম্প্রসারিত হয়েছে। ক্ষেত্রে মায়মূনা (রাঃ)-এর অবদান অনস্বীকার্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তে তিনি হাদীছ শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তা বর্ণনাও করেছেন। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, মায়মূনা (রাঃ) তে ৭৬টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে৪৪ হাফেয যাহাবী বলেন, তাঁর থেকে মোট ১৩টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী মুসলিম যৌথভাবে ৭টি, ইমাম বুখারী এককভাবে ১টি এবং ইমাম মুসলিম (রহঃ) এককভাবে ৫টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন৪৫ তবে আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাঁর থেকে বর্ণিত পুনরুক্তিসহ ছহীহ বুখারীতে ২১টি, ছহীহ মুসলিমে ১৮টি, জামি আত-তিরমিযীতে ৪টি, সুনান আবু দাঊদে ১৫টি, সুনান নাসাঈতে ২৬টি এবং সুনান ইবনু মাজাহতে ১১টি হাদীছ সংকলিত হয়েছে

তাঁর থেকে যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন
তাঁর থেকে যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য লেন- ইবনু আববাস (মৃঃ ৮৬/৭০৫), আব্দুল্লাহ ইবনু শাদ্দাদ ইবনুল হাদ (মৃঃ ৮১/৭০০), আব্দুর রহমান ইবনুস সায়েব আল-হিলালী, ইয়াযীদ ইবনু আছাম, (এরা সকলেই তাঁর ভাগ্নে), তাঁর পূর্ব স্বামীর ছেলে ওবায়দুল্লাহ আল-খাওলানী, নদবা (দাসী), আতা ইবনু ইয়াসার, সুলায়মান ইবনু ইয়াসার (মৃঃ ১০০/৭১৮), ইবরাহীম ইবনু আব্দুললাহ (মৃঃ ৪১/৬৬১), কুরায়ব (ইবনু আববাসের দাস) (মৃঃ ৯৮/৭১৬), ওবায়দা ইবনু সাববাক, ওবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা (মৃঃ ৯৪/৭১২), আলিয়া বিনতু সাবী (রাঃ) প্রমুখ৪৬

খাদ্যশস্য দান :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খায়বারের উৎপাদিত ফসল থেকে মায়মূনা (রাঃ)-কে ৮০ ওয়াসাক্ব খেজুর এবং ২০ ওয়াসাক্ব যব বা গম প্রদান করেন৪৭

ইন্তিকাল :
মায়মূনা (রাঃ) ৫১হিঃ/৬৭১খৃঃসারিফনামক স্থানে ইন্তিকাল করেন। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়৪৮মুহাম্মাদ ইবনু ওমর আল-ওয়াকেদী বলেন, তিনি ইয়াযীদ ইবনু মুআবিয়ার খিলাফতকালে ৬১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন৪৯ হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, তিনি ৬৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন৫০ মায়মূনা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে সর্বশেষে ইন্তিকাল করেন৫১অথচ ইয়াযীদ ইবনুল আছামের বর্ণনা তে জানা যায় যে, আয়েশা (রাঃ) মায়মূনা (রাঃ)-এর পরেও জীবিত ছিলেন। আর আয়েশা (রাঃ) সর্বসম্মতিক্রমে ৬০ হিজরীর পূর্বে ইন্তিকাল করেন। মায়মূনা (রাঃ)-এর মৃত্যু সন নিয়ে আরো কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন ৪৯ হিঃ, ৬৩ হিঃ ৬৬ হিঃ। তবে বর্ণনাগুলো সঠিক নয়। বরং প্রথম বর্ণনাটিই অধিক বিশুদ্ধ৫২ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর মতান্তরে ৮১ বছর৫৩

জানাযা দাফন
তিনিসারিফেমৃত্যুবরণ করেন। কারো মতে, তিনি মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন এবং সারিফে নীত হন৫৪ যখন তাঁর লাশ কাঁধে উঠানো হয়, তখন ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী। সুতরাং বেশী নাড়াচাড়া করো না। আদবের সাথে আস্তে নিয়ে চলো৫৫ ইবনু আববাস (রাঃ) তাঁর জানাযা পড়ান।সারিফনামক স্থানে যেখানে তাঁর বাসর উদ্যাপিত হয়েছিল, সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়। ইবনু আববাস (রাঃ), ইয়াযীদ ইবনুল আছাম, আব্দুল্লাহ ইবনু শাদ্দাদ ইবনুল হাদী এবং ওবায়দুল্লাহ আল-খাওলানী (রাঃ) তাঁকে কবরে নামান৫৬ ইয়াযীদ ইবনু আছাম বলেন, যখন আমরা মায়মূনা (রাঃ)-এর মৃতদেহ কবরে রাখলাম, তখন তাঁর মাথাটা একদিকে ঝুকে গেল। তখন আমি চাদর খুলে তাঁর মাথার নীচে দিলে ইবনু আববাস তা উঠিয়ে ফেলেন এবং তাঁর মাথার নীচে কিছু নুড়ি পাথর দিয়ে দেন৫৭

সমাপনী :
উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রাঃ) ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশীয় অভিজাত পরিবারের এক বিদুষী মহিলা এবং বহু অনুপম গুণের অধিকারিণী। তিনি চরিত্র-মাধুর্যে যেমন অনুসরণীয় ছিলেন, তেমনি ইলমী খিদমতে তাঁর জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছেন। নবীপত্নী এই মহিয়সী ছাহাবীর জীবনী থেকে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনী থেকে ইবরাত হাছিল করতে পারলে আমাদের ইহকালীন পরকালীন জীবন হবে সুন্দর সুখময়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.