১১২. সূরা ইখলাছ -এর তাফসীর

সূরা ইখলাছ

(বিশুদ্ধ করণ)

মক্কায় অবতীর্ণ

সূরা ১১২, আয়াত , শব্দ ১৫, বর্ণ ৪৭

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)

() বল, তিনি আল্লাহ এক

قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ

() আল্লাহ মুখাপেক্ষীহীন

اللَّهُ الصَّمَدُ

() তিনি (কাউকে) জন্ম দেননি এবং তিনি (কারও) জন্মিত নন

لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ

() তাঁর সমতুল্য কেউ নেই

وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

বিষয়বস্ত্ত :

আল্লাহ স্বীয় সত্তা গুণাবলীতে একক অনন্য এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই- সেকথাই আলোচিত হয়েছে পুরা সূরাটিতে

শানে নুযূল :

উবাই ইবনু কা (রাঃ) বলেন, মুশরিকরা বলেছিল, انْسُبْ لَنَا رَبَّكَ فَأَنْزَلَ اللهُ ‘আমাদেরকে তোমার রব-এর বংশধারা বল। তখন অত্র সূরাটি নাযিল হয়[1] ইকরিমা বলেন, ইহুদীরা বলত, আমরা ইবাদত করি আল্লাহর বেটা ওযায়েরকে। নাছারারা বলত, আমরা ইবাদত করি আল্লাহর পুত্র মসীহ ঈসাকে। মজূসীরা বলত, আমরা ইবাদত করি সূর্য চন্দ্রের। মুশরিকরা বলত, আমরা ইবাদত করি মূর্তি-প্রতিমার। তখন আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর অত্র সূরা নাযিল করেন (ইবনু কাছীর) রাবী মাদানী লেও মক্কার ঘটনা বলায় কোন সমস্যা নেই। তিনি মাক্কী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) প্রমুখদের কাছ থেকে ঘটনা শুনে বলতে পারেন। রিজালশাস্ত্রের পরিভাষায় একেমুরসাল ছাহাবীবলা হয়, যা সর্বজনগ্রাহ্য

ফযীলত :

() আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে বললেন, তোমরা সকলে জমা হও। আমি তোমাদের নিকট এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠ করব। তখন সবাই জমা ল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বেরিয়ে এসে সূরা ইখলাছ পাঠ করলেন। তারপর ভিতরে গেলেন। তখন আমরা একে অপরকে বলতে লাগলাম, إِنِّي أَرَى هَذَا خَبَرًا جَاءَهُ مِنَ السَّمَاءِ ‘আমি মনে করি এটি এমন একটি খবর, যা তাঁর নিকট আসমান থেকে এসেছে অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম এক তৃতীয়াংশ কুরআন শুনাব। শুনো! إِنَّهَا تَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ ‘ সূরাটিই কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান[2] অর্থাৎ গুরুত্ব নেকীতে এক তৃতীয়াংশের সমান। এটি তিনবার পড়লে পুরা কুরআন পাঠ করার সমতুল্য হবে না। যেমন ছালাতে তিনবার পড়লে তা সূরা ফাতেহা পাঠের জন্য যথেষ্ট হবে না

ইমাম কুরতুবী বলেন, কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, ‘সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান মূলতঃছামাদনামটির কারণে। কেননা নামটি কুরআনের অন্য কোথাও নেই। অনুরূপভাবেআহাদনামটিও

আরও বলা হয়েছে যে, কুরআন তিনভাগে নাযিল হয়েছে। একভাগেআহকাম’ (الأحكام) তথা আদেশ-নিষেধসমূহ। একভাগে জান্নাতের সুসংবাদ জাহান্নামের দুঃসংবাদসমূহ (الوعد والوعيد) এবং অন্যভাগে আল্লাহর নাম গুণসমূহ (الأسماء والصفات) শেষোক্ত ভাগটি একত্রিত হয়েছে অত্র সূরাতে ইমাম কুরতুবী বলেন, ব্যাখ্যাটি সমর্থিত হয় ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত অপর একটি হাদীছ দ্বারা। যেমন-

() হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ جَزَّأَ الْقُرْآنَ ثَلاَثَةَ أَجْزَاءٍ فَجَعَلَ قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ جُزْءًا مِنْ أَجْزَاءِ الْقُرْآنِ – ‘আল্লাহ কুরআনকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। অতঃপর সূরাটিকে একটি ভাগে পরিণত করেছেন[3]

() আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি এক ব্যক্তিকে সূরা ইখলাছ বারবার পড়তে দেখল। তখন ব্যক্তি পরদিন সকালে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে বিষয়টি পেশ করল। যেন লোকটি সূরাটি পাঠ করাকে খুব কম মনে করছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জবাবে তাকে বললেন, وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ إِنَّهَا لَتَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ- ‘যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ করে বলছি, নিশ্চয়ই এটি এক-তৃতীয়াংশ কুরআনের সমান[4]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) প্রমুখাৎ অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদের বলেন, তোমরা কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠ করতে পার? তাঁরা বললেন, আমাদের মধ্যে এমন শক্তি কার আছে হে আল্লাহর রাসূল? তখন তিনি বললেনقُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশ[5]

() হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক ছাহাবীকে সেনাপতি করে কোথাও একটি ছোট সেনাদল পাঠান। তিনি সেখানে ছালাতের ইমামতিতে প্রতি ক্বিরাআতের শেষে সূরা ইখলাছ পাঠ করেন। সেনাদল ফিরে এলে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বিষয়টি উত্থাপন করেন। রাসূল (ছাঃ) তাদের বলেন, শুনে দেখো সে কেন এটা করেছিল? তখন লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করলে উক্ত ছাহাবী বলেন, لِأَنَّهَا صِفَةُ الرَّحْمَنِ فَأَنَا أُحِبُّ أَنْ أَقْرَأَ بِهَا ‘কেননা এটি আল্লাহর গুণাবলী সম্বলিত সূরা। তাই আমি এটা পড়তে ভালবাসি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَخْبِرُوهُ أَنَّ اللهَ يُحِبُّهُ ‘ওকে খবর দাও যে, আল্লাহ ওকে ভালবেসেছেন[6]

() প্রায় একই মর্মে আনাস (রাঃ) প্রমুখাৎ তিরমিযী বর্ণিত অন্য একটি হাদীছে এসেছে যে, আনছারদের জনৈক ব্যক্তি ক্বোবা মসজিদে ইমামতি করতেন এবং তিনি প্রতি রাকআতে ক্বিরাআতের পূর্বে সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। এতে মুছল্লীরা আপত্তি করলে রাসূল (ছাঃ) তাকে কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! إِنِّىْ أُحِبُّهَا ‘আমি একে ভালবাসি রাসূল (ছাঃ) বললেনإِنَّ حُبَّهَا أَدْخَلَكَ الْجنَّةَ ‘নিশ্চয় এর ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে[7]

ইবনুলআরাবী বলেন, এটি একই সূরা প্রতি রাকআতে পাঠ করার দলীল। তিনি বলেন, আমি ২৮ জন ইমামকে দেখেছি যারা রামাযান মাসে তারাবীহতে স্রেফ সূরা ফাতিহা সূরা ইখলাছ দিয়ে তারাবীহ শেষ করেছেন মুছল্লীদের উপর হালকা করার জন্য এবং এই সূরার ফযীলতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য। কেননা রামাযানে তারাবীহতে কুরআন খতম করা সুন্নাত নয়’ (কুরতুবী)

() হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে যাচ্ছিলাম। এমন সময় তিনি একজনকে সূরা ইখলাছ পাঠ করতে শুনে বললেনوَجَبَتْ ‘ওয়াজিব হয়ে গেল আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কি ওয়াজিব ? তিনি বললেন, ‘জান্নাত[8]

গুরুত্ব :

পবিত্র কুরআন মূলতঃ তিনটি বিষয়ে বিভক্ত। তাওহীদ, আহকাম নছীহত। সূরা ইখলাছেতাওহীদপূর্ণভাবে থাকার কারণে তা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। এর অর্থ এটা নয় যে, সূরাটি তিনবার পাঠ করলেই পুরা কুরআন পাঠ করা হয়ে গেল বা তার সমান নেকী পাওয়া গেল। এই সূরা যে ব্যক্তি বুঝে পাঠ করে, তার হৃদয় আল্লাহর নাম গুণাবলী বিষয়ে শিরকী চিন্তাধারা থেকে খালেছ পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। কারণেই সূরার নামইখলাছবা শুদ্ধিকরণ রাখা হয়েছে এবং কারণে সূরার গুরুত্ব সর্বাধিক

তাফসীর :

() قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ ‘বল, তিনি আল্লাহ এক

هُوَ মর্যাদা বোধক সর্বনাম (ضمير الشأن) মুবতাদাاللهُ ১ম খবর এবং أَحَدٌ ২য় খবর। শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার ক্ষেত্রেআহাদশব্দটি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা স্বীয় কর্মে গুণাবলীতে তিনি পূর্ণ (ইবনু কাছীর)

এখানে রাসূল (ছাঃ)-কে বলা লেও উদ্দেশ্য বিশ্ববাসী। অর্থাৎ তুমি মুশরিকদের বলে দাও যে, আল্লাহ এক অদ্বিতীয় সত্তা। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর আগে বা পিছে কেউ নেই। তিনিই আদি, তিনিই অন্ত

বিশ্বের সকল জ্ঞানী সমাজ ধর্মীয় সম্প্রদায় বিষয়ে একমত যে, সৃষ্টি জগতের অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। কিন্তু মতভেদ কেবল এক্ষেত্রে যে, তিনি একাই সবকিছু করেন, না তাঁর কোন শরীক আছে? ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্মের লোকেরা আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করেছে। যেমন ইহুদীগণ ওযায়েরকে এবং নাছারাগণ ঈসাকেআল্লাহর পুত্রবলেছে (তওবা /৩০) ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী নাছারাগণ আল্লাহকেতিন উপাস্যের একজনবলেছে (মায়েদাহ /৭৩) অন্যদিকে ভারতীয় বহু ঈশ্বরবাদীদের তো ভগবানের সংখ্যাসীমা নেই

এইসব বে-দলীল কাল্পনিক কথার জবাব অত্র আয়াতে আল্লাহ ছোট্ট একটি শব্দে দিয়েছেন- ‘আহাদতিনিএকওয়াহেদআহাদদুটি শব্দেরই অর্থএক তবে পার্থক্য এই যে, ওয়াহেদ-এরছানীবা দ্বিতীয় রয়েছে। কিন্তু আহাদ-এর কোন ছানী বা দ্বিতীয় নেই। তিনি লা-ছানী লা-শরীক। নামে একাধিক সত্তার কোন সম্ভাবনাই নেই। আল্লাহরআহাদনামটি কুরআনের অন্য কোথাও নেই। কেবল সূরাতেই রয়েছে। এতে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর একক হুকুমেই সৃষ্টিজগত পরিচালিত হয়। এতে অন্যের কোন অংশীদারিত্ব নেই। তিনি এক অদ্বিতীয়। বান্দাকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাই বলেনإِنَّنِيْ أَنَا اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِيْ وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِيْ- ‘নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তুমি আমার ইবাদত কর এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য ছালাত কায়েম কর’ (ত্বোয়াহা ২০/১৪) তিনি বলেন,

مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ إِلاَّ أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوْهَا أَنْتُمْ وَآبَآؤُكُمْ مَّا أَنْزَلَ اللهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ ِللهِ أَمَرَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ-

তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কিছু নামের উপাসনা করে থাক। যেসব নাম তোমরা তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ সবের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। বস্ত্ততঃ বিধান দেওয়ার ক্ষমতা কারু নেই আল্লাহ ব্যতীত। তিনি আদেশ করেছেন যে, তোমরা কারু ইবাদত করো না তাঁকে ব্যতীত। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানেনা’ (ইউসুফ ১২/৪০)

পৃথিবীতে সর্ব প্রাচীন শিরক মূর্তিপূজার শিরক, যা হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগে শুরু হয়। যুগে যুগে নবীগণ মানুষকে থেকে বিরত হয়ে একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানিয়েছেন। সর্বশেষ পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধেই ইসলামের উত্থান ঘটে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিভিন্ন নামে সেই পৌত্তলিকতাই আজ মুসলমানের ঘরে-বাইরে জেঁকে বসেছে। কবরপূজা, ছবি-মূর্তি, প্রতিকৃতি-ভাষ্কর্য, মিনার-সৌধ এমনকি আগুনপূজাও হচ্ছে এখন নামধারী মুসলমানদের মাধ্যমে। এরপরেও আমরা আল্লাহর রহমতের আশা করি কিভাবে? বরং এখনও তাঁর গযবে আমরা ধ্বংস হয়ে যাইনি এটাই সৌভাগ্য। যেমন ইতিপূর্বে নূহের কওম, আদ, ছামূদ, শুআয়েব, লূত প্রমুখ নবীর কওম ধ্বংস হয়ে গেছে আল্লাহর গযবে

আয়াতেআল্লাহআহাদদুটি নামকে পাশাপাশি উল্লেখ করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ লেন সকল পূর্ণতা গুণের সমষ্টি (مجمع صفات الكمال) অর্থাৎ বান্দার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল লেন আল্লাহ। তিনি ব্যতীত অন্য কারু কাছে চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই বা তাদের দেওয়ারও কোন ক্ষমতা নেই

পাশাপাশিআহাদনামটি উল্লেখ করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তিনি লেন সকল পরাক্রম গুণের সমষ্টি (مجمع صفات الجلال) অর্থাৎ পৃথিবীতে যিনি যত বড় ক্ষমতাধর হৌন না কেন, কেউ একা কিছু করতে পারেন না অন্যের সাহায্য ব্যতীত। পক্ষান্তরে আল্লাহ এমনই এক প্রতাপান্বিত সত্তা, যার কোন পরামর্শদাতা বা সাহায্যকারীর প্রয়োজন নেই। তিনি একাই সবকিছু করেন। إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئاً أَنْ يَّقُوْلَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ ‘তাঁর কাজ এমনই যে, যখনই তিনি কিছু ইচ্ছা করেন, বলেন হও, তখনি হয়ে যায়’ (ইয়াসীন ৩৬/৮২) অতএবআল্লাহনামটি এনে যেমন তাঁকে বান্দার যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সমস্ত পূর্ণতা গুণের সমষ্টি বুঝানো হয়েছে, তেমনি পাশাপাশিআহাদনামটি এনে তাঁকে একক অদ্বিতীয় ক্ষমতাধর এবং সকল শক্তি প্রতাপ গুণের সমষ্টি বুঝানো হয়েছে

এর মধ্যে এবিষয়েও পরিষ্কার ইঙ্গিত রয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। আল্লাহর নাযিলকৃত কোন বিধানকে লংঘন, পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারে না। যদিও পৃথিবীর প্রায় সকল রাজা-বাদশাহ এবং গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রপ্রধানগণ নিজেদের মেকী সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে সর্বদা একাজটিই করে চলেছেন এবং নিরীহ জনগণকে নিজেদের গোলামীর যিঞ্জীরে আবদ্ধ নিষ্পেষিত করে যাচ্ছেন

() اَللهُ الصَّمَدُ ‘আল্লাহ মুখাপেক্ষীহীন

صَمَدَ يَصْمِدُ صَمْدًا অর্থ قصد ‘সংকল্প করা সেখান থেকে الصَّمَدُ অর্থ الَّذِي يُصْمَدُ إِلَيْهِ فِي الْحَاجَاتِ ‘প্রয়োজনে যার মুখাপেক্ষী তে হয় অথবা السَّيِّدُ الَّذِي يُصْمَدُ إِلَيْهِ فِي النَّوَازِلِ وَالْجَوَائِحِ ‘ নেতা, যাকে কামনা করা হয় বিপদে কষ্টে’ (কুরতুবী) এখানে অর্থ المستغنى عن كل أحد والمحتاج إليه كل أحد ‘যিনি সকলের থেকে মুখাপেক্ষীহীন। অথচ সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী’ (ফাৎহুল ক্বাদীর) সুদ্দী বলেনالمقصود في الرغائب والمستعان به في المصائب ‘যিনি সকল সৎকর্মের উদ্দিষ্ট সত্তা এবং সকল বিপদে সাহায্য প্রার্থনার স্থল’ (কুরতুবী)

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘ছামাদঅর্থ الَّذِي يُصْمَدُ الْخَلاَئِقُ إِلَيْهِ فِي حَوَائِجِهِمْ وَمَسَائِلِهِمْ ‘সৃষ্টিজগত নিজেদের প্রয়োজনে সমস্যায় যার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে’ (ইবনু কাছীর) আল্লাহকেছামাদবলা হয়েছে। কারণ তিনি স্বীয় গুণাবলীতে পূর্ণ এবং সমস্ত সৃষ্টিজগত তাঁর মুখাপেক্ষী। এটি একটি পৃথক পূর্ণাঙ্গ বাক্য

উল্লেখ্য যে, প্রথম আয়াতে বর্ণিতআহাদ’-এর ন্যায় অত্র আয়াতে বর্ণিতছামাদনামটিও মাত্র এখানেই এসেছে। কুরআনের অন্য কোথাও আনা হয়নি। একারণেই সূরা ইখলাছ আল্লাহর অনন্য নাম গুণাবলীর একত্র সমাহার। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَا بِكُمْ مِّنْ نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللهِ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فَإِلَيْهِ تَجْأَرُوْنَ-

তোমাদের কাছে যেসব নেমত রয়েছে, তা আল্লাহরই পক্ষ তে। অতঃপর যখন তোমরা কষ্টে পতিত হও, তখন তাঁর নিকটেই কান্নাকাটি করে থাক’ (নাহল ১৬/৫৩) অর্থাৎ সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন

() لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ ‘তিনি (কাউকে) জন্ম দেননি এবং তিনি (কারও) জন্মিত নন

অর্থ ليس له ولد ولا والد ولا صاحبة ‘তাঁর কোন সন্তান নেই বা পিতা নেই বা কোন স্ত্রী নেই’ (ইবনু কাছীর) যেভাবে ইহুদী-নাছারাগণ বলে থাকে। কেননা জন্ম হওয়া জন্ম নেওয়ার বিষয়টি কেবল সৃষ্টিকুলের সাথে সংশ্লিষ্ট, যাদের পেট রয়েছে। অথচ আল্লাহর সত্তা এসব থেকে মুক্ত পবিত্র। তিনি কারু উত্তরাধিকারী নন এবং কেউ তাঁর উত্তরাধিকারী নয়। যেমন আল্লাহ নিজের পরিচয় দিয়ে বলেনبَدِيْعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنَّى يَكُوْنُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَّهُ صَاحِبَةٌ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ وهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ- ‘তিনিই আসমান যমীনের প্রথম সৃষ্টিকর্তা। কিভাবে তাঁর পুত্র সন্তান হবে? অথচ তাঁর কোন স্ত্রী নেই। আর তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই সকল বিষয়ে অবহিত’ (আনআম /১০১) একই ধরনের বক্তব্য এসেছে সূরা বনু ইস্রাঈল ১৭/১১১, মারিয়াম ১৯/৮৮-৯২, আম্বিয়া ২১/২৬-২৭, ছাফফাত ৩৭/১৪৯-৫৪, ১৫৮-১৫৯, নাজম ৫৩/২১-২৩ প্রভৃতি আয়াত সমূহে

بَدَعَ يَبْدَعُ بَدْعًا وَبِدْعًا وبِدْعَةً অর্থকোন কাজ প্রথম সৃষ্টি করানমুনা ছাড়াই কোন কাজ সৃষ্টি করাঅনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনয়ন করাইত্যাদি। আল্লাহ লেন অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনয়নকারী। অতএব তিনি কারু পিতা বা পুত্র তে পারেন না

لَمْ يَلِدْ (তিনি কাউকে জন্ম দেননি) বলার মধ্যে তিনটি ভ্রান্ত দলের প্রতিবাদ করা হয়েছে। মুশরিক, ইহুদী নাছারা। মুশরিকরা ফেরেশতাদেরআল্লাহর কন্যাবলত (ইসরা ১৭/৪০) ইহুদীরা ওযায়ের নবীকেআল্লাহর বেটাবলত (তওবা /৩০) নাছারারা মসীহ ঈসাকেআল্লাহর পুত্রবলত (তওবা /৩০) وَلَمْ يُولَدْ (এবং তিনি কারু জন্মিত নন) বলার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তিনিই আদি সৃষ্টিকর্তা। তাঁর পূর্বে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ ‘তিনিই আদি, তিনিই অন্ত। তিনি প্রকাশ্য, তিনি গোপন এবং তিনি সর্ব বিষয়ে অবগত’ (হাদীদ ৫৭/)

() وَلَمْ يَكُنْ لَّهُ كُفُواً أَحَد ٌ ‘তাঁর সমতুল্য কেউ নেই

অর্থাৎ সত্তা গুণাবলীতে আল্লাহর সাথে তুলনীয় কিছুই নেই। যেমন আল্লাহ বলেনلَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ ‘তাঁর অনুরূপ কিছুই নয়। তিনি সবকিছু শোনেন দেখেন’ (শূরা ৪২/১১) এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নিজস্ব আকার রয়েছে, যা কারু সাথে তুলনীয় নয়। যেমন ক্যাসেট ভিডিও সবকিছু শোনে দেখে। তাদের নিজস্ব আকার আছে, যা মানুষের মত নয়। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর হাত, পা, চেহারা ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণিত হয়ছে (মায়েদাহ /৬৪; ক্বলম ৬৮/৪২; বাক্বারাহ /১১৫) কিন্তু তা কারু সাথে তুলনীয় নয়

জান্নাতে মুমিনগণ আল্লাহকে দেখতে পাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وُجُوْهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ‘অনেক চেহারা সেদিন উজ্জ্বল হবেতাদের প্রতিপালকের দিকে তারা তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২২-২৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عِيَانًا فَنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ فَقَالَ إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ لاَ تُضَامُّوْنَ فِى رُؤْيَتِهِ ‘তোমরা তোমাদের প্রভুকে স্পষ্ট দেখতে পাবে। অতঃপর তিনি পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা সত্বর তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে, যেমন তোমরা এই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ, যা দেখায় তোমাদের কোন বাধা হবে না[9] কিন্তু অবিশ্বাসী কপট বিশ্বাসীরা এই দর্শন লাভের মহা সৌভাগ্য তে বঞ্চিত হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, كَلاَّ إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوْبُوْنَ ‘কখনোই না। অবশ্যই সেদিন তারা তাদের প্রভুর দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৫)

আল্লাহ সবই শোনেন। কিন্তু তাঁর শ্রবণের বিষয়টি অন্য কারু সাথে তুলনীয় নয়। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল বিজ্ঞান কলেজের প্রফেসর উইলিয়াম প্রাণীজগতের শ্রবণেন্দ্রিয় সম্পর্কে গবেষণায় ডুব দিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, He who planted ears, shall He not hear? ‘যিনি কান সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি নিজে শুনতে পান না?’ অথচ দেড় হাযার বছর আগেই কুরআন সেকথা বলে দিয়েছে যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সবকিছু শোনেন দেখেন। তাঁর নিজস্ব সত্তা স্বরূপ আছে। যা মহান আল্লাহর সত্তার সাথে মানানসই তাঁর উপযুক্ত। যা অন্য কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি বান্দার সকল ধারণা কল্পনার ঊর্ধ্বে। অতি যুক্তিবাদীরা তাঁর বিষয়ে নানা কথা বলেন। কিন্তু আল্লাহ বলেনسُبْحَانَ اللهِ عَمَّا يَصِفُوْنَ ‘তারা যা বলে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র’ (ছাফফাত ৩৭/১৫৯) অতএব তিনি নিরাকার নির্গুণ সত্তা বলে লোকেরা যেসব কথা বলে থাকে, তা থেকে তিনি মুক্ত। যেমন আল্লাহ বলেনسُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُوْنَ ‘তারা যা কিছু আরোপ করে, তা থেকে তোমার পালনকর্তা পবিত্র, যিনি সকল সম্মানের অধিকারী’ (ছাফফাত ৩৭/১৮০) সুবহান্নাল্লাহি ওয়া বেহামদিহী, সুবহানাল্লাহিলআযীম

উল্লেখ্য, আল্লাহর আদেশ বিধানের পরিবর্তনকারী কেউ নেই (আনআম /১১৫; রা ১৩/৪১; কাহফ ১৮/২৭) তাঁর সত্তার যেমন কোন তুলনা নেই, তাঁর প্রেরিত বিধান তথা ইসলামী শরীআতেরও কোন তুলনা নেই। ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম (আলে ইমরান /১৯) অন্য কোন সত্তাকে আল্লাহর সমতুল্য গণ্য করা যেমন শিরক, তেমনি নিজেদের রচিত আইন বিধানকে ইসলামী আইন বিধানের সমতুল্য বা তার চাইতে উত্তম গণ্য করাও অনুরূপ শিরক (নূর ২৪/৬৩) একইভাবে মানুষের মনগড়া বিধান বাস্তবায়নের জন্য সমর্থন দান চেষ্টা সাধনা করা কবীরা গোনাহ (নিসা /৮৫; বনু ইসরাঈল ১৭/১৮, হজ্জ ২২/৫১; সাবা ৩৪/) কেননা ইসলামী বিধান ব্যতীত অন্য কিছুই আল্লাহর নিকটে গৃহীত হবে না। যেমন আল্লাহ বলেনوَمَن يَّبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِيْناً فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করবে, কখনোই তা কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের     অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান /৮৫) মানুষ কেবল মসজিদে আল্লাহর দাসত্ব করবে, আর বাইরে এসে মানুষের মনগড়া আইনের দাসত্ব করবে। নিজেদের সুবিধামত কুরআনের কিছু অংশ মানবে কিছু অংশ ছাড়বে, এটা পুরোপুরি কুফরীর শামিল (নিসা /১৫০-১৫১; বাক্বারাহ /৮৫) আল্লাহ চান সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্বের মাধ্যমে মানবতার সার্বিক মুক্তি (নাহল ১৬/৩৬; নিসা /৬০) মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব (বনু ইস্রাঈল ১৭/৭০) তার দাসত্ব পাওয়ার হকদার কেবলমাত্র তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। যিনি একক লা-শারীক (ত্বোয়াহা ২০/১৪) তিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী (বাক্বারাহ /১৬৫) তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। সূরা ইখলাছ একথাই মানুষকে জানিয়ে দেয়

সারকথা :

স্বীয় সত্তা গুণাবলীতে আল্লাহ একক তুলনাহীন- এই নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাসকে যাবতীয় শিরকের কালিমা তে মুক্ত রাখার আহবানই সূরা ইখলাছের সারকথা



[1]. তিরমিযী হা/৩৩৬৪তাফসীরঅধ্যায়, সনদ হাসান; হাকেম /৫৪০ পৃ:

[2]. বুখারী হা/৫০১৫; মুসলিম হা/৮১২; ছহীহুল জামেহা/১৯৭; কুরতুবী হা/৬৫২৪

[3]. মুসলিম হা/৮১১; আহমাদ হা/২৭৫৩৮

[4]. বুখারী হা/ ৫০১৩, ৬৬৪৩, ৭৩৭৪; আবুদাঊদ হা/১৪৬১; নাসাঈ হা/১০০৩

[5]. বুখারী হা/৫০১৫; কুরতুবী হা/৬৫২৩

[6]. বুখারী হা/৭৩৭৫, মুসলিম হা/৮১৩; মিশকাত হা/২১২৯; কুরতুবী হা/ ৬৫২৬

[7]. তিরমিযী হা/২৯০১, বুখারী তালীক্ব হা/৭৭৪; আলবানী বলেন, হাসান ছহীহ

[8]. তিরমিযী হা/২৮৯৭, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/২১৬০

[9]. বুখারী হা/৫৫৪, মুসলিম হা/৬৩৩; মিশকাত হা/৫৬৫৫-৫৬ক্বিয়ামতের অবস্থাঅধ্যায়-২৮

No comments

Powered by Blogger.