১১৩. সূরা ফালাক্ব -এর তাফসীর

সূরা ফালাক্ব

(প্রভাতকাল)

মদীনায় অবতীর্ণ

সূরা ১১৩, আয়াত , শব্দ ২৩, বর্ণ ৭১

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)

() বল! আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের প্রতিপালকের

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ

() যাবতীয় অনিষ্ট তে, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন

مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

() এবং অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট তে, যখন তা সমাগত হয়

وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ

() এবং গ্রন্থিতে ফুঁকদানকারিণীদের অনিষ্ট তে

وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ

() এবং হিংসুকের অনিষ্ট তে যখন সে হিংসা করে

وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ

বিষয়বস্ত্ত :

অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রির অনিষ্ট এবং জাদুকরদের হিংসুকদের অনিষ্টসহ যাবতীয় অনিষ্ট তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা

শানে নুযূল :

হযরত আয়েশা (রাঃ), যায়েদ বিন আরক্বাম আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনাগুলির সার-সংক্ষেপ এই যে, ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসাবে ইহুদীরা রাসূল (ছাঃ)-এর চুলের মাধ্যমে তাঁর মাথায় জাদু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটানো। কিন্তু আল্লাহ হিংসুকদের সে চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন

মা আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী মদীনার ইহুদী গোত্র বনু যুরাইক্বের (بنو زريق) মিত্র লাবীদ বিন ছাম (لبيد بن أعصم) নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েকে দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মাথার ছিন্ন চুল চিরুনীর ছিন্ন দাঁত চুরি করে এনে তাতে জাদু করে এবং মন্ত্র পাঠ করে চুলে ১১টি গিরা দেয়। এর প্রভাবে রাসূল (ছাঃ) কোন কাজ করলে ভুলে যেতেন ভাবতেন যে করেননি অন্য বর্ণনা অনুযায়ী ৪০ দিন বা মাস এভাবে থাকে। এক রাতে রাসূল (ছাঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, দুজন লোক এসে একজন তাঁর মাথার কাছে অন্যজন পায়ের কাছে বসে। অতঃপর তারা বলে যে, বনু যুরায়েক্ব-এর খেজুর বাগানে যারওয়ান (ذَرْوَان) কূয়ার তলদেশে পাথরের নীচে চাপা দেওয়া খেজুরের কাঁদির শুকনো খোসার মধ্যে জাদু করা চুল চিরুনীর দাঁত রয়েছে। ওটা উঠিয়ে এনে গিরা খুলে ফেলতে হবে। সকালে তিনি আলী (রাঃ)-কে সেখানে পাঠান এবং যথারীতি তা উঠিয়ে আনা হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) গিরাগুলি খুলে ফেলেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান[1]

ছালাবী, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণনা করেন যে, সময় আল্লাহ সূরা ফালাক্ব নাস নাযিল করেন। যার ১১টি আয়াতের প্রতিটি পাঠের সাথে সাথে জাদুকৃত চুলের ১১টি গিরা পরপর খুলে যায় এবং রাসূল (ছাঃ) হালকা বোধ করেন সুস্থ হয়ে যান (ইবনু কাছীর) রাসূল (ছাঃ)-কে প্রতিশোধ নিতে বলা লে তিনি বলেন, أَمَّا أَنَا فَقَدْ شَفَانِى اللهُ، وَكَرِهْتُ أَنْ أُثِيْرَ عَلَى النَّاسِ شَرًّا- ‘আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি বিষয়টি অপসন্দ করি যে, লোকদের মধ্যে মন্দ ছড়িয়ে পড়ুক[2] এমনকি তিনি মৃত্যু অবধি মুনাফিকের চেহারা দেখেননি (ইবনু কাছীর, কুরতুবী)

উল্লেখ্য যে, জাদুর হাদীছকে পুঁজি করে একদল মানুষ কুরআন হাদীছের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি রাসূল (ছাঃ) সত্যনবী কি-না, সে বিষয়েও আপত্তি তুলেছেন। ব্যাপারে স্পষ্ট জানা আবশ্যক যে, এই জাদু অহি- অবতরণে সংরক্ষণে কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটায়নি এবং তা আদৌ সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহ নিজেই অহীর হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন (হিজর ১৫/) তিনি মানুষের অনিষ্টকারিতা তে রাসূল (ছাঃ)-কে বাঁচানোর ওয়াদা করেছেন (মায়েদাহ /৬৭) এমনকি জাদুকর বা জাদু যে কখনোই সফল হবে না (ত্বোয়াহা ২০/৬৯), সেকথাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। অতএব অপপ্রচারকারীদের থেকে সাবধান থাকা আবশ্যক

গুরুত্ব :

হযরত ওক্ববা বিন আমের আল-জুহানী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَقَدْ أُنْزِلَ عَلَىَّ آيَاتٌ لَمْ يُرَ مِثْلُهُنَّ : قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ إلخ وَ قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ الخ- ‘আল্লাহ আমার উপরে এমন কিছু আয়াত নাযিল করেছেন, যার অনুরূপ আর দেখা যায়নি। তা  কুল আঊযু বি-রবিবল ফালাক্ববএবংকুল আঊযু বিরবিবন্নাস শেষ পর্যন্ত[3]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, أَلَمْ تَرَ آيَاتٍ أُنْزِلَتِ اللَّيْلَةَ لَمْ يُرَ مِثْلُهُنَّ قَطُّ ‘তুমি কি জানো আজ রাতে এমন কিছু আয়াত নাযিল হয়েছে, যার মত ইতিপূর্বে কখনোই দেখা যায়নি[4]

ফযীলত 

() হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন, তখন দুহাত একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। অতঃপর মাথা চেহারা থেকে শুরু করে যতদূর সম্ভব দেহে তিনবার দুহাত বুলাতেন[5]

() আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিন ইনসানের চোখ লাগা তে পানাহ চাইতেন। কিন্তু যখন সূরা ফালাক্ব নাস নাযিল , তখন তিনি সব বাদ দিয়ে দুটিই পড়তে থাকেন[6]

() হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অসুখে পড়তেন, তখন সূরা ফালাক্ব নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে নিজের দেহে হাত বুলাতেন। কিন্তু যখন ব্যথা-যন্ত্রণা অসহ্য হয়ে পড়ত, তখন আমি তা পাঠ করে তাঁর উপরে ফুঁক দিতাম এবং রাসূল (ছাঃ)-এর হাত তাঁর দেহে বুলিয়ে দিতাম বরকতের আশায় মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে, ‘পরিবারের কেউ পীড়িত লে রাসূল (ছাঃ) তাকে ফালাক্ব নাস পড়ে ফুঁক দিতেন [7]

() ওক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে প্রতি ছালাতের শেষে সূরা ফালাক্ব নাস পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন[8]

() একদা তিনি ওক্ববাকে বলেন, হে ওক্বায়েব! আমি কি তোমাকে শ্রেষ্ঠ দুটি সূরা শিক্ষা দেব না? অতঃপর তিনি আমাকে সূরা ফালাক্ব নাস শিক্ষা দিলেন। অতঃপর তিনি ছালাতে ইমামতি করলেন এবং সূরা দুটি পাঠ করলেন। ছালাত শেষে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, হে ওক্বায়েব! اِقْرَأْ بِهِمَا كُلَّمَا نِمْتَ وَكُلَّمَا قُمْتَ ‘তুমি দুটি সূরা পাঠ করবে যখন ঘুমাতে যাবে যখন (তাহাজ্জুদে) ছালাতে দাঁড়াবে[9]

() একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাবের বিন আব্দুল্লাহকে বলেন, اِقْرَأْ بِهِمَا وَلَنْ تَقْرَأَ بِمِثْلِهِمَا ‘ দুটি সূরা পাঠ কর। কেননা দুটির তুলনায় তুমি কিছুই পাঠ করতে পার না[10]

() অনুরূপ কথা তিনি ওক্ববা বিন আমেরকেও বলেন যে, مَا سَأَلَ سَائِلٌ بِمِثْلِهِمَا وَلاَ اسْتَعَاذَ مُسْتَعِيْذٌ بِمِثْلِهِمَا ‘কোন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে পারে না এবং কোন আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয় চাইতে পারে না দুটি সূরার তুলনায়[11]

() ইবনুআয়েশ আল-জুহানীকে একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,يَا ابْنَ عَاِئِشٍ أَلاَ  أَدُلُّكَ  أَوْ قَالَ أَلاَ أُخْبِرُكَ  بِأَفْضَلِ مَا يَتَعَوَّذُ بِهِ الْمُتَعَوِّذُوْنَ؟ قَالَ بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ. قَالَ : (قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) وَ (قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ) هَاتَيْنِ السُّوْرَتَيْنِ- ‘হে ইবনুআয়েশ! আমি কি তোমাকে আশ্রয়প্রার্থীদের শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা সম্পর্কে খবর দিব না? আর তা ফালাক্ব নাস এই সূরা দুটি[12]

() ওক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এক সফরে জুহফা আবওয়া- মধ্যবর্তী স্থানে ঝড়-বৃষ্টি ঘনঘটাপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে পড়ি। সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা ফালাক্ব নাস পড়তে থাকেন। তিনি আমাকে বললেন, হে ওক্ববা! দুটি সূরার মাধ্যমে আল্লাহর পানাহ চাও। কেননা কোন আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয় চাইতে পারে না দুটির তুলনায়[13]

(১০) ওক্ববা (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, এসময় তিনি বলেন, তুমি সকালে সন্ধ্যায় তিনবার করে সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব নাস পাঠ কর। সব কিছুতেই তা তোমার জন্য যথেষ্ট হবে (تَكْفِيْكَ مِنْ كُلَّ شَيْئٍ)[14] তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত সফরে ফালাক্ব নাস দুটি সূরা দিয়ে ফজরের ছালাতে আমাদের ইমামতি করেন[15] তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি সূরা হূদ সূরা ইউসুফ পাঠ করব? তিনি বললেনلَنْ تَقْرَأَ شَيْئًا أَبْلَغَ عِنْدَ اللهِ مِنْ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) وَ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ). ‘আল্লাহর নিকটে সূরা ফালাক্ব নাস-এর চাইতে সারগর্ভ তুমি কিছুই পড়তে পারো না[16]

হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ওক্ববা বিন আমের (রাঃ) তে বর্ণিত হাদীছসমূহমুতাওয়াতিরপর্যায়ের[17]

জাদু, ঝাড়-ফুঁক তাবীয-কবচ

ইসলামে জাদু করা নিষিদ্ধ এবং তা কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী পাপ তে বেঁচে থাক। () আল্লাহর সাথে শরীক করা () জাদু করা () অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা () সূদ খাওয়া () ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা () যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং () নির্দোষ ঈমানদার নারীর উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া[18]

ইসলামে ঝাড়-ফুঁক সিদ্ধ। কিন্তু তাবীয-কবচ নিষিদ্ধ। ঝাড়-ফুঁক স্রেফ আল্লাহর নামে তে হবে। ফালাক্ব নাস ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন সূরা ছহীহ হাদীছ সমূহে বর্ণিত দো সমূহ দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করতে হবে। কোনরূপ শিরক মিশ্রিত কালাম জাহেলী পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না[19] এমনিভাবে তাবীয ঝুলানো, বালা বা তাগা বাঁধা যাবেনা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেনمَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ ‘যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলালো, সে ব্যক্তি শিরক করল[20] তিনি বলেনمَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ ‘যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকায়, তাকে তার প্রতি সোপর্দ করা হয়[21] অর্থাৎ কোন বস্ত্তর উপরে নয়, স্রেফ আল্লাহর কালাম পড়ে আল্লাহর উপরে ভরসা করতে হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনোচিকিৎসা। যা দৈহিক চিকিৎসাকে প্রভাবিত করে। যেমন রাসূল (ছাঃ) একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে জিব্রীল (আঃ) এসে তাঁকে নিম্নোক্ত দোআর মাধ্যমে ঝাড়িয়ে দেন।بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ يُؤْذِيْكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللهُ يَشْفِيْكَ، بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ ‘আমি আল্লাহর নামে তোমাকে ঝেড়ে দিচ্ছি এমন সকল বিষয় তে, যা তোমাকে কষ্ট দেয়। প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তির বা হিংসুক চোখের অনিষ্ট তে আল্লাহ তোমাকে নিরাময় করুন। আল্লাহর নামে তোমাকে ঝেড়ে দিচ্ছি[22] জিব্রীল (আঃ) এখানে শুরুতে শেষে বিসমিল্লাহ বলেছেন এদিকে ইঙ্গিত করার জন্য যে, আল্লাহ ব্যতীত আরোগ্যদাতা কেউ নেই। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখনই কোন অসুখে পড়তেন, তখনই জিব্রীল এসে তাঁকে ঝেড়ে দিতেন[23] উল্লেখ্য যে, জিব্রীল পঠিত উপরোক্ত দো পড়ে যেকোন মুমিন বান্দা অন্য মুমিনকে ঝাড়-ফুঁক করতে পারেন

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাসান-হোসায়েনকে নিম্নোক্ত দোআর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করেছেনأُعِيْذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ ‘আমি তোমাদের দুজনকে আল্লাহর পূর্ণ বাক্য সমূহের আশ্রয়ে নিচ্ছি প্রত্যেক শয়তান তে, বিষাক্ত কীট তে প্রত্যেক অনিষ্টকারী চক্ষু তে[24]

তাফসীর :

() قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ ‘বল, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার

অর্থাৎ জাদুসহ সকল প্রকার অনিষ্ট তে বাঁচার জন্য আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। কেননা ইষ্টানিষ্ট সবকিছুর মূল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। অতএব তাঁর কাছেই বান্দাকে সর্বাবস্থায় আশ্রয় ভিক্ষা করতে হবে। আর কেবলমাত্র তাঁর হুকুমেই অনিষ্ট দূর হওয়া সম্ভব। অন্য কিছুর মাধ্যমে নয়

ফালাক্বব’ (الْفَلَقُ) অর্থপ্রভাতকাল’ (الصُّبْحُ) এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সকল অনিষ্ট মূলতঃ অন্ধকার। অনিষ্ট দূর হওয়ার পরে আসে খুশীর প্রভাত। আর মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করার একচ্ছত্র মালিক লেন আল্লাহ। যেমন তিনি বলেন, وَإِنْ يََّمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِنْ يُّرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلاَ رَادَّ لِفَضْلِهِ- ‘যদি আল্লাহ তোমাকে কোন অমঙ্গল স্পর্শ করান, তবে তা দূর করার কেউ নেই তিনি ব্যতীত। আর যদি তিনি তোমার মঙ্গল চান, তবে তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারু নেই’ (ইউনুস ১০/১০৭) অতএব দুঃখের অমানিশা ছিন্ন করে যাতে শান্তির সুপ্রভাতের আগমন ঘটে, সেই কামনা নিয়ে প্রভাতের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে বান্দাকে সর্বদা আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অত্র আয়াতে

فَلَقَ يَفْلِقُ فَلْقًا الْفَلْقُ أَىْ الشَّقُّ. অর্থ বিদীর্ণ হওয়া, ফেটে বের হওয়া। যেমন মাটি ফুঁড়ে চারা বের হয়। সেখান থেকে فَلَقٌ অর্থ সকাল, প্রত্যেক সৃষ্ট জীব, দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী নীচু যমীন বা পাহাড়ের ফাটল ইত্যাদি। কুরতুবী বলেনكل ما انْفَلَقَ عن شئ من حيوان وصبح وحب ونوى وماء فهو فَلَقٌ ‘প্রাণী, সকাল, শস্যদানা, শস্যবীজ বা পানিসহ যেকোন বস্ত্ত যা বিদীর্ণ হয়, তাই-ফালাক্ব’ (কুরতুবী) রাতের অন্ধকার ভেদ করে প্রভাতের আলো বিচ্ছুরিত হয় বলেই এখানেফালাক্বঅর্থপ্রভাতকালবলা হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছেনفَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى ‘বীজ আঁটি থেকে অংকুরোদ্গমকারীএবং فَالِقُ الْإِصْبَاحِ ‘প্রভাত রশ্মির উন্মেষকারী’ (আনআম /৯৫-৯৬) উক্ত মর্মে এখানেফালাক্ববঅর্থ কেবলপ্রভাতকালনয়; বরং সকল মাখলূক্বাত তে পারে। কেননা সকল সৃষ্টিই অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে আল্লাহর হুকুমে এবং তিনিই সকল মাখলূক্বাতের সৃষ্টিকর্তা একক পালনকর্তা। অতএব তিনিরাববুল ফালাক্ববএবং তিনিইরাববুল মাখলূক্বাত

() مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ ‘যাবতীয় অনিষ্ট তে, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন

অর্থাৎ ইবলীস তার সাথীদের প্রতারণা এবং শিরক-কুফর, যুলুম-অত্যাচার, রোগ-শোক, দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি সৃষ্টিজগতের সকল প্রকারের পরোক্ষ প্রত্যক্ষ অনিষ্টকারিতা তে হে আল্লাহ আমি তোমার পানাহ চাই। আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভাল মন্দ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মাত্র একজন, তিনি আল্লাহ। এটা নয় যে, ভাল- স্রষ্টা আল্লাহ, আর মন্দের স্রষ্টা শয়তান। বরং সবকিছুই আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানার অন্তর্ভুক্ত। তিনি উভয়টি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য এবং সম্পদে বিপদে মানুষ আল্লাহকে স্মরণ করে কি-না তা যাচাই করার জন্য

() وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ ‘এবং অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট তে, যখন তা সমাগত হয়

মানুষের অধিকাংশ অনিষ্টকারিতা রাতের অন্ধকারেই হয়ে থাকে। সেজন্য এখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রির কথা বলা হয়েছে

দ্বিতীয় আয়াতে সকল প্রকারের অনিষ্টকারিতা তে আল্লাহর শরণ নেওয়ার কথা বলার পর এক্ষণে পরপর তিনটি প্রধান অনিষ্টকারিতার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। যার প্রথমটি অন্ধকার রাত্রির অনিষ্টকারিতা যা সকলের নিকট বোধগম্য

الغَسَق অর্থ أول ظلمة الليل ‘রাত্রির প্রথম অন্ধকার غَسَقَ يَغْسِقُ غَسَقًا অর্থأَظْلَمَ  ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া’ (কুরতুবী) যেমন আল্লাহ বলেনأَقِمِ الصَّلاَةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ   ‘তুমি ছালাত কায়েম কর সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির প্রথম অন্ধকার পর্যন্ত’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৮) এর মধ্যে যোহর, আছর, মাগরিব এশার ছালাতের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সূর্য ঢলার পর থেকে যোহরের ওয়াক্ত এবং সূর্যাস্তের পর প্রথম অন্ধকারের আগমন থেকে এশার ওয়াক্ত শুরু হয়

وَقَبَ يَقِبُ وَقْبًا অর্থ أظلم، دخل، نزل، سكن ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া’, ‘প্রবেশ করা’, ‘অবতীর্ণ হওয়া’, ‘স্থিতিশীল হওয়াপ্রভৃতি। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এখানে অর্থ হবেঅন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া অর্থাৎ রাত্রির অন্ধকার যখন গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়। আর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতেই মানুষের অনিষ্টকারিতা বৃদ্ধি পায়। হাদীছে চন্দ্রকে غَاسِقٌ বলা হয়েছে। যেমন আয়েশা (রাঃ)-কে এক রাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَا عَائِشَةُ اسْتَعِيْذِيْ بِاللهِ مِنْ شَرِّ هَذَا فَإِنَّ هَذَا هُوَ الْغَاسِقُ إِذَا وَقَبَ- ‘হে আয়েশা! এর অনিষ্টকারিতা তে আল্লাহর নিকটে পানাহ চাও। কেননা এটি গাসেক্ববা আচ্ছন্নকারী যখন সে সমাগত হয়[25]

বলা বাহুল্য, চন্দ্র নক্ষত্ররাজি রাতের আকাশেই উদিত হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে রাত্রিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়সমূহ রয়েছে, যা মানুষের অনিষ্টের কারণ হয়ে থাকে। অতএব রাত্রিই মূলকথা। সেকারণ আলোচ্য আয়াতে বর্ণিতগাসেক্বঅর্থঅন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রি’, যার অনিষ্টকারিতা তে আল্লাহর নিকট পানাহ চাইতে বলা হয়েছে

() وَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ ‘এবং গ্রন্থিতে ফুঁকদানকারিণীদের অনিষ্ট তে

এটি দ্বিতীয় প্রধান অনিষ্টকারিতা, যা থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। ইবনু যায়েদ বলেন, মদীনার ইহুদী মেয়েরা রাসূল (ছাঃ)-কে জাদু করেছিল এগারোটি গিরায় এগারোটি ফুঁক দিয়ে। আর এরা ছিল লাবীদ ইবনুল ছামের মেয়ে (কুরতুবী) তবে হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ ছহীহ বুখারীর বর্ণনায় এসেছে যে, লাবীদ ছিল মুনাফিক এবং ইহুদীদের মিত্র (ইবনু কাছীর) আয়াতে স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহার করায় এটা নিশ্চিতভাবে ধারণা করা যায় যে, সে যুগে জাদু বিষয়ে মেয়েরাই ছিল প্রধান সহযোগী। জাদুর স্বাভাবিক প্রভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে কিছুটা ভাবান্তর দেখা দেয়। যেমন তিনি কোন কিছু করলে ভাবতেন করেননি। তানতাভী বলেন, এটা একটা রোগ। কিন্তু জ্ঞানের উপর এর কোন প্রভাব পড়ে না (তানতাভী)

বস্ত্ততঃ ইহুদী মুনাফিকরা চেয়েছিল রাসূল (ছাঃ)-কে পাগল বানাতে তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটাতে। এটা ছিল তাদের শত্রুতার একটি নিকৃষ্টতম রূপ। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রাসূলকে হেফাযত করেছিলেন। অমনিভাবে প্রত্যেক মুমিন বান্দাকে হেফাযত করা তাঁর কর্তব্য বলে তিনি ঘোষণা করেছেন (ইউনুস ১০/১০৩রূম ৩০/৪৭)

প্রশ্ন তে পারে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে জাদুর ক্রিয়া কেন ? তিনি তো আল্লাহর রাসূল। এর জবাব এই যে, আগুন পানির ন্যায় জাদুরও একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া আছে। নবীগণ মানুষ ছিলেন। তাই তাঁরাও এসবের প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তবে সেই প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি হওয়া না হওয়াটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন বিষয়। যেমন আল্লাহর হুকুমে আগুন ইবরাহীম (আঃ)-এর কোন ক্ষতি করেনি (আম্বিয়া ২১/৬৯) হযরত ইউনুস (আঃ)-কে নদীর পানি মাছ কোন ক্ষতি করেনি (ছাফফাত ৩৭/১৪০-১৪৫) তেমনিভাবে আল্লাহর হুকুমে জাদু ক্রিয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আত্মিক জ্ঞানগত কোন ক্ষতি করতে পারেনি। অহি- প্রচার প্রসারেও কোন ব্যত্যয় ঘটেনি, যেটা শত্রুরা কামনা করেছিল। ফালিল্লাহিল হাম্দ নবী ছাড়াও আল্লাহর অন্যান্য নেক বান্দাদেরকেও আল্লাহ এমনিভাবে রক্ষা করে থাকেন। ঈমানদারগণের ইতিহাসে এর বহু নযীর রয়েছে

উল্লেখ্য যে, আবুবকর আল-আছাম (ابو بكر الأصم) জাদুর এই ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন এবং এগুলিকে কাফেরদের রটনা বলেছেন। জামালুদ্দীন ক্বাসেমীও তা সমর্থন করেছেন এবং এই মর্মে বর্ণিত ছহীহ হাদীছগুলিকে সমালোচনা থেকে মুক্ত নয় (ليس سالِمًا من النقد) , বলে মন্তব্য করেছেন (তাফসীর ক্বাসেমী) অথচ এর পক্ষে তাঁরা কুরআনের যে দুটি আয়াত এনেছেন, দুটি আয়াতই তাঁদের দাবীর বিপক্ষে গেছে। তাঁদের প্রথম দলীলوَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ‘আল্লাহ তোমাকে মানুষের (শত্রু) হাত থেকে বাঁচাবেন’ (মায়েদাহ /৬৭) দ্বিতীয় দলীল وَلاَ يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَى ‘জাদুকর যেখানেই আসুক, সফল হবে না’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৯) বস্ত্ততঃ জাদু করা সত্ত্বেও আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে মানুষরূপী শত্রুদের অনিষ্ট থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং তাদের জাদু তাঁর উপরে সফল হয়নি। সেকারণ তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেনি

() وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ‘এবং হিংসুকের অনিষ্ট তে যখন সে হিংসা করে

এটি তৃতীয় প্রধান অনিষ্টকারিতা যা থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এটি সব শেষে আনা হয়েছে। কারণ হিংসা সকল আদম সন্তানের মধ্যে পরিব্যপ্ত এবং এটি সবচেয়ে কষ্টদায়ক সর্বাধিক ক্ষতিকর। কোন নবী-রাসূল হিংসুকদের হামলা থেকে রেহাই পাননি। সৎ ঈমানদার ব্যক্তিগণ দুনিয়াতে সর্বদা হিংসুকদের নিকৃষ্ট হামলার শিকার হয়ে থাকেন

আলোচ্য আয়াতে إِذَا حَسَدَ অর্থাৎহিংসুক যখন হিংসা করেবলার কারণ এই যে, যতক্ষণ কথায় বা কর্মে হিংসার বাস্তবায়ন না ঘটে, ততক্ষণ তা অন্যের কোন ক্ষতি করে না। যদিও হিংসার আগুনে হিংসুক নিজেই সর্বদা জ্বলতে থাকে। বস্ত্ততঃ এটাই হিংসুকের জন্য নগদ দুনিয়াবী আযাব। আর পরকালের কঠিন আযাব তো আছেই

হিংসুক কাকে বলেالَّذِى يَتَمَنَّى زَوَالَ نِعْمَةِ الْمَحْسُوْدِ ‘হিংসুক ব্যক্তি যে হিংসাকৃত ব্যক্তির নেমত বিদূরিত হওয়ার আকাংখা করে’ (কুরতুবী, তানতাভী) যখন সে কর্মের মাধ্যমে তার হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, তখন তার অনিষ্ট তে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَجْتَمِعَانِ فِىْ قَلْبِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالْحَسَدُ ‘কোন বান্দার অন্তরে ঈমান হিংসা একত্রিত হতে পারে না[26] অর্থাৎ একটি অন্তরে হয় ঈমান থাকবে, নয় হিংসা থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো মুমিন নয়। অর্থাৎ পূর্ণ মুমিন নয়

উল্লেখ্য যে, অন্যের মত নেমতের অধিকারী হওয়ার কামনা করা বৈধ। কিন্তু অন্যের নেমতের ধ্বংস কামনা করা অবৈধ। প্রথমটিকে বলা হয় الْغِبْطَةُ أو الْمُنَافَسَةُ ঈর্ষা বা আকাংখা এবং দ্বিতীয়টিকে বলা হয় الْحَسَدُ বা হিংসা। হিংসা নিষিদ্ধ নিন্দিত। ঈর্ষা সিদ্ধ কাংখিত। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেনلاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ ‘হিংসা নেই দুটি বিষয়ে ব্যতীত। . যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন। সাথে সাথে তাকে হক-এর পথে তা ব্যয় করার শক্তি দান করেছেন। . যাকে আল্লাহ প্রজ্ঞা দান করেছেন। যা দিয়ে সে কার্য নির্বাহ করে যা সে লোকদের শিক্ষা দেয়[27] এখানেহিকমতঅর্থ সুন্নাহ। এখানেহিংসা’ (حسد) দ্বারাঈর্ষা’ (الغِبْطة) বুঝানো হয়েছে। ফুযায়েল ইবনুইয়ায বলেনالْمُؤْمِنُ يَغْبِطُ، وَالْمُنَافِقُ يَحْسُدُ ‘মুমিন ঈর্ষা করে মুনাফিক হিংসা করে[28] আল্লাহ মুমিনদেরকে জান্নাতে মিশকের মোহরাংকিত বিশুদ্ধতম শরাব পান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেন,وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَ ‘অতএব প্রতিযোগীরা বিষয়ে প্রতিযোগিতা করুক’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২৬)

ইমাম কুরতুবী বলেন, হিংসা প্রথম পাপ, যা আসমানে করা হয় এবং প্রথম পাপ যা পৃথিবীতে করা হয়। আসমানে ইবলীস আদমকে হিংসা করেছিল। আর পৃথিবীতে ক্বাবীল তার ছোট ভাই হাবীলকে হিংসা করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি অভিশপ্ত, বহিষ্কৃত বিদ্বিষ্ট’ (কুরতুবী)

জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, হিংসুক ব্যক্তি তার প্রভুর সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয় পাঁচভাবে। () সে অন্যের উপর আল্লাহর দেওয়া নেমতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। () সে আল্লাহর অনুগ্রহ বণ্টনের উপরে ক্রুদ্ধ থাকে। () সে আল্লাহর কাজের বিরোধিতাকারী হয়। কেননা আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ যাকে খুশী তাকে দিতে পারেন। কিন্তু হিংসুক তার হিংসাকৃত ব্যক্তির জন্য সেটা চায় না। () সে আল্লাহর বন্ধুদের লজ্জিত করে। অথবা লজ্জিত করতে চায় উক্ত নেমতের ধ্বংস কামনা করে। () সে আল্লাহর শত্রু ইবলীসকে সাহায্য করে’ (কুরতুবী)

বাঁচার উপায় :

প্রশ্ন তে পারে, বর্ণিত তিন প্রকার অনিষ্ট তে বাঁচার পথ কি?

উত্তর :  থেকে বাঁচার একমাত্র পথ আল্লাহর উপর ভরসা করা। সব ফায়ছালা তাঁর উপরে ন্যস্ত করা এবং সূরা ফালাক্ব, নাস অন্যান্য দো সমূহ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া। অর্থ বুঝে অন্তর ঢেলে দিয়ে পূর্ণ আস্থাসহ দো করতে হবে। আল্লাহর আশ্রয় বড় আশ্রয়। যা পৃথিবীর সকল আশ্রয়ের চাইতে বড় নিরাপদ। এই আশ্রয় নমরূদের হুতাশন থেকে ইবরাহীমকে বাঁচিয়েছে, ফেরাঊনের হামলা থেকে মূসাকে বাঁচিয়েছে। যুগে যুগে অসংখ্য মুমিন বান্দাকে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। তিনি বলেন, وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘আমার দায়িত্ব মুমিনদের সাহায্য করা’ (রূম ৩০/৪৭)

আল্লাহ বলেন, قُلْ لَنْ يُصِيبَنَا إِلاَّ مَا كَتَبَ اللهُ لَنَا هُوَ مَوْلاَنَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘তুমি বল, আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কোন বিপদ আমাদের উপর আসতে পারে না। তিনিই আমাদের কর্মবিধায়ক। অতএব সকল মুমিনগণ তাঁর উপরেই ভরসা করে’ (তওবা /৫১) তিনি বলেন, مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيْبَةٍ إِلاَّ بِإِذْنِ اللهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ- اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘যে বিপদই আসুক তা আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আসেনা। যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তিনি তার হৃদয়কে সুপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ সকল বিষয়ে অবগত …‘আল্লাহ। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব মুমিনগণ যেন আল্লাহর উপরেই ভরসা করে’ (তাগাবুন ৬৪/১১, ১৩)

হৃদয়কে হিংসামুক্ত রাখার উপায় :

() হিংসা শয়তানী আমল। শয়তান সর্বদা মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। তাই তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শয়তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা থাকা এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা আবশ্যক। সেইসাথে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে সর্বদা ছালাত শেষে বা ঘুমাতে যাবার সময় বা যেকোন সময় সূরা ফালাক্ব নাস পড়া। () এছাড়া নিম্নোক্ত দোআটি পড়া আবশ্যক। আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিখিয়ে দিয়েছেন, رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيْمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلاَّ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوْفٌ رَحِيْمٌ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আমাদের সেইসব ভাইকে তুমি ক্ষমা কর। যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আর তুমি আমাদের অন্তরে মুমিনদের বিরুদ্ধে কোনরূপ বিদ্বেষ সঞ্চার করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই তুমি স্নেহশীল দয়াবান’ (হাশর ৫৯/১০) মনে রাখতে হবে যে, ভালোর প্রতি হিংসা চিরন্তন। আসমানে প্রথম হিংসা করেছে ইবলীস আদম (আঃ)-কে এবং যমীনে প্রথম হিংসা করেছে ক্বাবীল তার ভাই হাবীলকে। যুগে যুগে এটাই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এজন্য প্রবাদ বাক্য হয়ে রয়েছেهل مَاتَ الْبُخَارِيُّ غَيْرَ مَحْسُوْدٍ ؟ ‘ইমাম বুখারী কি হিংসুকের হামলা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করতে পেরেছেন’?

বস্ত্ততঃ হিংসুক ব্যক্তি আল্লাহর নেমতের শত্রু। সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায়। সে মজলিসে কেবল লজ্জা পায়। ফেরেশতাদের কাছে লানতপ্রাপ্ত হয়। একাকী সে ক্ষোভের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরে এবং আখেরাতে সে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত হয়। ফলে হিংসুকের দুনিয়া আখেরাত সবই বরবাদ। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!

কবি ইবনুল মুতায বলেন,

اصْبِرْ عَلَى حَسَدِ الْحَسُو + دِ فَإِنَّ صَبْرَكَ قَاتِلُهْ

فَالنَّارُ تَأْكُلُ بَعْضَهَا + إِنْ لَمْ تَجِدْ مَا تَأْكُلُهْ

তুমি হিংসুকের হিংসায় ছবর কর। কেননা তোমার ধৈর্য ধারণ তাকে হত্যা করবেবস্ত্ততঃ আগুন তার একাংশকে খেয়ে ফেলে, যখন সে খাওয়ার মত কিছু পায় না অতএব الحسد مذموم وصاحبه مغموم ‘হিংসা নিন্দনীয় এবং হিংসুক সদা দুঃখিত

সারকথা :

সকল বিপদাপদে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে এবং সর্বদা তাঁর শরণ নিতে হবে

[1]. বুখারী হা/৫৭৬৫, ৫৭৬৬চিকিৎসাঅধ্যায়; মুসলিম হা/২১৮৯; মিশকাত হা/৫৮৯৩

[2]. বুখারী হা/৬৩৯১

[3]. মুসলিম হা/৮১৪; নাসাঈ হা/৫৪৪০

[4]. মুসলিম হা/৮১৪, ‘মুআউবিযাতানের ফযীলতঅনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/২১৩১

[5]. বুখারী হা/৫০১৭, মুসলিম, মিশকাত হা/২১৩২

[6]. তিরমিযী হা/২০৫৮, মিশকাত হা/৪৫৬৩; সনদ ছহীহ

[7]. বুখারী হা/৫০১৬; মুসলিম হা/২১৯২; মিশকাত হা/১৫৩২জানায়েযঅধ্যায়

[8]. তিরমিযী হা/২৯০৩; আহমাদ হা/১৭৪৫৩; আবুদাঊদ হা/১৫২৩; মিশকাত হা/৯৬৯

[9]. আহমাদ হা/১৭৩৩৫; নাসাঈ হা/৫৪৩৭; ছহীহুল জামেহা/৭৯৪৮

[10]. নাসাঈ হা/৫৪৪১ সনদ হাসান ছহীহ

[11]. নাসাঈ হা/৫৪৩৮; সনদ হাসান ছহীহ

[12]. নাসাঈ হা/৫৪৩২; আহমাদ হা/১৭৩৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১১০৪

[13]. আবুদাঊদ হা/১৪৬৩; মিশকাত হা/২১৬২

[14]. তিরমিযী হা/৩৫৭৫; আবুদাঊদ হা/৫০৮২; নাসাঈ হা/৫৪২৮; মিশকাত হা/২১৬৩

[15]. আবুদাঊদ হা/১৪৬২, হাদীছ ছহীহ

[16]. নাসাঈ হা/৯৫৩; মিশকাত হা/২১৬৪

[17]. ইবনু কাছীর, উক্ত সূরার তাফসীর; /৫০৪ পৃঃ

[18]. বুখারী হা/২৭৬৬, মুসলিম হা/৮৯, মিশকাত হা/৫২

[19]. মুসলিম হা/২২০০, মিশকাত হা/৪৫৩০চিকিৎসা ঝাড়-ফুঁকঅধ্যায়-২৩

[20]. আহমাদ হা/১৭৪৫৮; হাকেম; ছহীহাহ হা/৪৯২

[21]. তিরমিযী হা/২০৭২, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৪৫৫৬

[22]. মুসলিম হা/২১৮৬, ‘চিকিৎসাঅনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১৫৩৪জানায়েযঅধ্যায়, ‘রোগী দেখতে যাওয়া রোগের ছওয়াবঅনুচ্ছেদ

[23]. মুসলিম হা/২১৮৫; মিরআত হা/১৫৪৭-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ, /২২৫ পৃঃ

[24]. বুখারী হা/৩৩৭১, মিশকাত হা/১৫৩৫

[25]. তিরমিযী হা/৩৩৬৬; মিশকাত হা/২৪৭৫ সনদ ছহীহ

[26]. নাসাঈ হা/৩১০৯, সনদ হাসান

[27]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২০২ইল্মঅধ্যায়

[28]. কুরতুবী, ইসমাঈলআজলূনী, কাশফুল খাফা /২৯৫; তাযকেরাতুল মাওযূআত /১৪

No comments

Powered by Blogger.