যখন কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শর্তে ঋণ দেবে, তখন তা লিখে রাখবে — আল-বাক্বারাহ ২৮২-২৮৩


ভাই, দাড়িওয়ালা দেখে নিশ্চিন্ত মনে ধার দিয়েছিলাম এক বছর পার হয়ে গেছে, টাকা ফেরত তো দেয়ই না, ফোন করলেও এখন আর ধরে না ইসলাম কি এই শেখায়?” — আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, যদি কাউকে টাকা ধার দেই, তাহলে সেটা লিখে রাখার দরকার নেই পরিচিতদের মধ্যে ধার দিচ্ছি, লিখিত চুক্তি করতে গেলে কেমন যেন দেখায় আর তাছাড়া ধর্মপ্রাণ মানুষ কি আর টাকা নিয়ে ফেরত দেবে না? আমরা অনেকেই জানি না যে, কাউকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার দিলে সেটা লিখিত চুক্তি করে রাখাটা ফরজ কুরআনে আল্লাহ এই নিয়ে এক বিরাট আয়াত দিয়েছেন, যেন মুসলিমদের মধ্যে ধার দেওয়া নিয়ে ঝামেলা কমানো যায় মুসলিম মানেই এই না যে, তারা ধার নিলে সময় মতো ফেরত দেবে বরং সময় মতো ধার ফেরত দেওয়া নিয়ে মুসলিমদের মধ্যেই প্রচুর ঝামেলা হয় দেখেই কুরআনের সবচেয়ে বড় আয়াতে বলা আছে কীভাবে ধার দেওয়ার সময় লিখিত চুক্তি করে রাখতে হবে এই আয়াতটিতে খুব পরিষ্কারভাবে ধার দেওয়ার নিয়ম, বাধ্যতা, সাক্ষীর দায়িত্ব ইত্যাদি বর্ণনা করা আছে

বিশ্বাসীরা শোনো! যখন কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শর্তে ঋণ দেবে, তখন তা লিখে রাখবে। চুক্তিলেখক চুক্তির শর্তগুলো ঠিকঠাকমতো লিখে দেবে। আল্লাহ যেহেতু তাকে লেখা শিখিয়েছেন, কাজেই সে যেন লিখতে অস্বীকার না-করে। দেনাদার লোক চুক্তির যা যা শর্ত বলবে সে তা লিখবে। বলার সময় সে যেন তার প্রভু আল্লাহকে মনে রাখেকোনো ঊনিশ-বিশ না-করে। সে যদি কম বুঝে, দুর্বল হয় বা ঠিকমতো বলতে না-পারে, তাহলে তার অভিভাবক যেন ঠিকঠাকভাবে সব বলে দেয়।
চুক্তির সময় তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে। দুজন পুরুষ পাওয়া না-গেলে তোমাদের সম্মতিতে সাক্ষীদের মধ্যে একজন পুরুষ দুজন নারীকে সাক্ষী রাখতে পারো; যাতে একজন নারী ভুল করলে অন্যজন মনে করিয়ে দিতে পারে।
সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলে সাক্ষীরা যেন অস্বীকার না-করে। ঋণ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে হয়, তাহলে তা ছোট-বড় যা- হোক, লিখে রাখার ব্যাপারে হেলাফেলা করবে না। কারণ, আল্লাহর কাছে এটা বেশি সুবিচারপূর্ণ, প্রমাণ হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তবে তাৎক্ষণিক লেনদেন হলে না-লিখলে সমস্যা নেই। আর যখন পরস্পর বেচাকেনা করো, তখন সাক্ষী রাখো। চুক্তিলেখক বা সাক্ষীর কাউকেই কোনো ক্ষতি করা যাবে না। করলেই তোমাদের অপরাধ হবে। আল্লাহর প্রতি সাবধান!
আল্লাহই তোমাদের শেখান। আর আল্লাহ সবকিছুই ভালোভাবে জানেন। [আল-বাকারাহ ২৮২]

এই আয়াতটি হচ্ছে ঋণের উপর একটি সম্পূর্ণ আইন সঙ্কলন। আল্লাহ تعالى একটি আয়াতের মধ্যেই ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম আমাদেরকে বলে দিয়েছেন। এই আয়াতে বিশটিরও বেশি আইন রয়েছে। কোনো আইনজীবীকে যদি বলা হতো ঋণের যাবতীয় আইন নিয়ে লিখতে, তাহলে সে পঞ্চাশ পৃষ্ঠার এক বই লিখে নিয়ে আসতো, যা পড়তে গেলে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত। তারপর সেই বইয়ে কথার মধ্যে বহু ফাঁকফোকর পাওয়া যেত। কয়েকবার তার সংশোধনী বের হতো। অথচ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন সুন্দর একটি আয়াত দিয়েছেন, যা কবিতার ছন্দের মতো পড়তে পারি, সুমধুর তিলাওয়াতে শুনতে পারি এবং শোনার সময় সংবিধান শোনার মতো একঘেয়ে মনে হয় না। একইসাথে এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কোনো ফাঁকফোকর নেই। কেউ দাবি করতে পারবে না যে, এই আয়াতে আইনগুলোর মধ্যে অমুক ফাঁক পাওয়া গেছে। আর ইসলাম যে বাস্তবতা বিমুখ, শুধুই ধর্ম-কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো ধর্ম নয়, তার প্রমাণ এই আয়াত।[১১]

নির্দিষ্ট মেয়াদ শর্তে যখন ঋণ দেওয়া হয়, তখন তা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে লিখিত চুক্তি করে রাখতে হবে এবং সাক্ষী রাখতে হবে। এটা মুসলিমদের জন্য ফরজ বা ওয়াজিব।[১২][১৪][][] তবে কিছু আলিম বলেছেন যে, এটা করতে শুধুই উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, আসলে তা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু যারা এই কথা বলেন, তারা নাসিখ, মান্সুখের (কুরআনের এক আয়াত দিয়ে অন্য আয়াত বাতিল) মূলনীতি ভেঙে ফেলেছেন এবং কুরআনের বাণীর স্পষ্ট বিরোধিতা করেছেন বলে আত-তাবারি বিস্তারিত প্রমাণ দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, কুরআনের আয়াতে এত স্পষ্টভাবে বলে দেওয়ার পরেও কোনোভাবেই কেউ নিজের মতো ব্যাখ্যা করতে পারেন না।[১৪]

লিখিত চুক্তি করার এই নির্দেশ ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক ঋণ উভয়ের জন্য। কত দেওয়া হচ্ছে, কবে ফেরত দেওয়া হবে, কে নিচ্ছে, কে দিচ্ছে, কিস্তিগুলো কী হবে ইত্যাদি সবকিছু লিখিত চুক্তি করতে হবে, যেন পরে এই ব্যাপারে কোনো ধরনের মতবিরোধের সুযোগ না হয়। অনেক সময় আমাদের মনে হয়, “মুরুব্বি মানুষ, কীভাবে আমি তাকে লিখিত চুক্তি করতে বলি? উনি কী মনে করেন?” অথবা, “গরিব মানুষ, পড়ালেখা জানে না। বেচারা বিপদে পড়ে আমার কাছে ধার চাইতে এসেছে। তাকে লিখিত চুক্তি করতে বলি কীভাবে? লোকটা দুঃখ পাবে।” — আল্লাহ تعالى আমাদের এভাবে ভাবতে নিষেধ করেছেন। বরং তিনি تعالى আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন

ঋণ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে হয়, তাহলে তা ছোট-বড় যা- হোক, লিখে রাখার ব্যাপারে হেলাফেলা করবে না। কারণ, আল্লাহর কাছে এটা বেশি সুবিচারপূর্ণ, প্রমাণ হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম

এই আয়াতটি আল্লাহ تعالى দিয়েছিলেন হাজার বছর আগের আরবদের, যখন আজকের মতো সহজলভ্য কাগজ ছিল না। মানুষ লিখত পাতা, চামড়া, হাড়ের উপরে। কলমও ছিল দুর্লভ। পড়ালেখা জানত হাতেগোনা কয়েকজন। সেই অবস্থায়ও তিনি تعالى ঋণের ব্যাপারে লিখতে বলেছেন। এথেকেই বোঝা যায় লিখিত চুক্তি করা কতটা জরুরি

ঋণ নিয়ে ভয়ংকর সব সমস্যা হয়। আত্মীয়ে-আত্মীয়ে সম্পর্ক চিরজীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে তালাক হয়ে যায়। মানুষ মানুষকে খুনও করে ফেলে। খবরের কাগজ খুললে শিরোনাম দেখা যায়, “এনজিও ঋণ নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ খুন”, “নারায়ণগঞ্জে খুন : স্ত্রীর ঋণ নেয়ার কারণ জানতেন না স্বামী”, “ঋণের বোঝার চাপে শিশু খুন করতেও বাধেনি লাকি …”, “ঋণ পরিশোধ থেকে বাঁচতেই মাকে খুন করে জকিগঞ্জের …!” ইত্যাদি ভয়ংকর সব ঘটনা। একারণে ঋণ সংক্রান্ত সব সন্দেহ, ভুল বোঝাবুঝির অবসান করতে ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িকভাবে দেওয়া, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শোধ করতে হবে এমন সব ঋণ, তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে লিখিত চুক্তি করতে হবে। শুধু তাই না, দুই জন পুরুষ, অথবা একজন পুরুষ এবং দুই জন নারীকে সাক্ষী রাখতে হবে, যেন কেউ চুক্তি লেখককে বা ঋণ দাতা বা গ্রহীতাকে পরে কোনো দোষ দিতে না পারে

চুক্তি লেখার সময় সব শর্ত বলবে ঋণ গ্রহীতা, ঋণ দাতা নয়। আল্লাহ تعالى এখানে দুর্বল পক্ষকে শক্তিশালী করে দিয়েছেন। ঋণ দাতা শর্ত লিখে দিলে গ্রহীতার উপর অন্যায় করতে পারে দেখেই তাকে শর্ত বলে দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি। একইসাথে ঋণ গ্রহীতা যদি নিজে সুবিধা বেশি নেওয়ার চেষ্টা করে, তখন ঋণ গ্রহীতা সোজা ঋণ দেতে অস্বীকার করতে পারে। সুতরাং এই ব্যবস্থায় কোনো পক্ষই অন্যায় করার সুযোগ পাবে না

চুক্তির সময় তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে। দুজন পুরুষ পাওয়া না-গেলে তোমাদের সম্মতিতে সাক্ষীদের মধ্যে একজন পুরুষ দুজন নারীকে সাক্ষী রাখতে পারো; যাতে একজন নারী ভুল করলে অন্যজন মনে করিয়ে দিতে পারে।

প্রথমে আমাদেরকে দুজন পুরুষ সাক্ষী হিসেবে খুঁজতে হবে। কারণ ঋণের ব্যাপারে যখন ঝামেলা হয়, তখন সেটা অনেক সময় ভয়ংকর পর্যায়ে চলে যায়। সেই পরিস্থিতি একজন পুরুষ থেকে নারীর জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। মহিলা সাক্ষীদেরকে সম্ভ্রম বা জীবন হারানোর ভয় দেখিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ানো আজকাল অহরহ ঘটছে। বিশেষ করে মা-দেরকে তাদের সন্তানদের হুমকি দিয়ে অনেক সময় মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ানো যায়। আদালতে একজন মহিলাকে হাজির করানোটা একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার। আদালতে যখন সাক্ষীদেরকে হাজির করানো হয়, তখন তাদেরকে আসামিদের মতই অবহেলা করে রাখা হয়। দিনের পর দিন মামলা পেছাতে থাকে। বার বার সংসার, কাজ ফেলে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। আর থানায় নিয়ে একজন মহিলা সাক্ষীর বক্তব্য নেওয়াটাও বাজে অভিজ্ঞতা। এই সব সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে দুইজন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে নেওয়া

কিন্তু অনেক সময় পরিস্থিতি এমন হয় যে, দুইজন পুরুষ পাওয়া যায় না। তখন একজন পুরুষ এবং দুই জন নারীকে সাক্ষী হিসেবে নিতে হবে, যেন একজন নারী ভুল করলে অন্যজন তা শুধরিয়ে দিতে পারে। শোধরানোর কাজটা করবে নারী, পুরুষ নয়। এরকম পরিস্থিতি হতে পারে যে, পাওনাদার পুরুষ সাক্ষীকে ঘুষ দিয়ে হাত করে ফেলেছে। তখন পুরুষ সাক্ষী গিয়ে একজন মহিলা সাক্ষীকে হুমকি-ধামকি দিয়ে তার পক্ষে সাক্ষী দিতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। সেই অবস্থায় অন্য নারী তা শুধরিয়ে দিতে পারে। দুই জন নারীকে একই সাথে বাগিয়ে ফেলা অপেক্ষাকৃত কঠিন

অথবা একজন নারী সাক্ষী অভিযোগ তুলেছে পুরুষ সাক্ষীর বিরুদ্ধে। তখন সেই পুরুষ সাক্ষী যদি দাবি করে যে, মহিলা মিথ্যা বলছে, সেটা ততটা নির্ভরযোগ্য হবে না, কারণ সে এখানে নিজেই অপরাধী হিসেবে কথা উঠেছে। তখন অন্য মহিলা যদি ভুল ধরিয়ে দিয়ে পুরুষ সাক্ষীর পক্ষে কথা বলে, তাহলে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়

আজকাল কিছু উঠতি নারীবাদী কুরআনের এই আয়াত দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, “দেখেছো? ইসলাম নারীদেরকে পুরুষদের থেকে ছোট মনে করে। দুইজন পুরুষ ঠিকই সাক্ষী হতে পারবে, কিন্তু শুধু দুইজন নারী কেন পারবে না? আবার একজন পুরুষ সাক্ষী হচ্ছে দুইজন নারী সাক্ষীর সমান! কত বড় অপমান!” —যারা এসব দাবি করে, তাদের সমস্যা হচ্ছে জীবন সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা কম। এদেরকে ধরে কয়েকদিন থানায় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ারে চুপচাপ বসিয়ে রাখলে বুঝতে পারবে কেন সেটা নারীদের জায়গা নয়। কয়েকটা মামলায় সাক্ষী হিসেবে ফাঁসিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য করলেই বুঝে যাবে কেন ইসলাম নারীদেরকে এসব জায়গা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে

যখন এই সব জায়গায় সে একা যাবে, সাথে অন্য কোনো নারী থাকবে না, তারপর তাকে একা হাজারো পুরুষের মুখোমুখি হতে হবে, তখন সে বুঝে যাবে কেন দুইজন নারীকে সাক্ষী হতে বলা হয়েছে। যখন পুরুষ সাক্ষী পাওনাদারের সাথে হাত মিলিয়ে তাকে একা পেয়ে সম্ভ্রম, সন্তানের ক্ষতি করার জন্য শাসিয়ে যাবে, তখন আরেকজন নারীকে পাশে পাওয়াটা কত দরকার ছিল, তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে। জীবন যুদ্ধ কত নোংরা হতে পারে, সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যতদিন নারীবাদীরা নিজেরা না যাচ্ছে, ততদিন এরা এরকম অবাস্তব দাবি করে যাবে। এরা পুরুষের সমান অধিকার চায়, কিন্তু পুরুষের মতো সুয়ারেজের পাইপে ঢুকে ময়লা পরিষ্কার করতে চায় না। এরা পুরুষের সমান সুযোগ-সুবিধা চায়, কিন্তু পুরুষের মতো আকাশছোঁয়া দালানের মাথায় উঠে, দড়ি বেধে শূন্যে ঝুলে জানালা লাগানোর মতো ভয়ংকর ঝুঁকির কাজ, বা দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলন্ত ব্রিজ বানানোর কাজ, অথবা দুর্গম পাহাড়ের ভিতরে গভীর খনিতে ঢুকে খনিজ বের করার মতো নোংরা কাজ করতে চায় না। দাবি আদায়ের বেলায় সোচ্চার, কিন্তু কাজের বেলায়

এছাড়া বিভিন্ন সাইকোলজির গবেষণায় দেখা গেছে, কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে নারীরা স্বাভাবিকভাবেই ছলনার আশ্রয় নেয়। এটা তাদের স্বভাবগত। অবশ্যই এর ব্যতিক্রম রয়েছে। বহু নারী আছেন যাদের নীতিবোধ এতটাই ইস্পাত দৃঢ় যে, তারা পুরো পুরুষজাতিকে লজ্জায় ফেলে দেবেন। কিন্তু সেটা পরিসংখ্যানগতভাবে নগণ্য। সঠিক পরিসংখ্যান নিলে দেখা যায় বেশিরভাগ নারী কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য, বা নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য, বা কোনো পক্ষের দুরবস্থার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লে তখন ছলনা এবং মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এটা কোনো কারণে নারীদের মানসিকতার একটি অংশ।[১০] পুরুষদের মধ্যে যেমন হিংস্রতা, গায়ের জোরে আদায় করার প্রবণতা স্বাভাবিক, সেরকম নারীদের মধ্যে অহিংস্র ছলনার আশ্রয় নেওয়াটা স্বাভাবিক

তাছাড়া শহর বাদ দিলে মানবজাতির বিরাট অংশ থাকে গ্রামে, যেখানে নারীরা ব্যবসাবাণিজ্যর সাথে জড়িত থাকে না, পড়ালেখার হারও কম। সেক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের থেকে অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকে, যার কারণে দুজন নারী সাক্ষী নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কুরআনের আয়াত দেওয়া হয় সামগ্রিকভাবে মানবজাতির অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে। শুধু শহরের দিকে বা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দিকে লক্ষ্য করে আয়াতগুলো বুঝতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি হয়

আল্লাহ যেহেতু তাকে লেখা শিখিয়েছেন, কাজেই সে যেন লিখতে অস্বীকার না-করে

আয়াতের এই অংশটি অদ্ভুত। চুক্তি লেখক যে লিখতে পারে, সে যে শিক্ষিত মানুষ হয়েছে, তার কৃতিত্ব আল্লাহ تعالى নিচ্ছেন। এখানে তিনি تعالى আমাদেরকে শেখাচ্ছেন যে, আমরা যে আজকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হয়েছি, পঁচিশ বছর ধরে পড়াশুনা করে আইনজীবী হয়েছি, তার কৃতিত্ব আল্লাহর تعالى তিনি ব্যবস্থা করে না দিলে আজকে আমরা শিক্ষিত হতাম না। ইসলামি দায়িত্ব পালন করার সময় আমরা যেন এই কথা সব সময় মনে রাখি। আজকে আমরা যেই যোগ্যতার বড়াই করি, যেই ডিগ্রি, সার্টিফিকেট দেখিয়ে উপরে উঠি, সেটা শুধু আমাদের নিজেদের অর্জন নয়, আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় রেখেছিলেন দেখেই তা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং, কেউ আমাদেরকে ঋণের চুক্তি লিখে দেওয়ার অনুরোধ করলে, তাকে—“অন্যের কাছে যান, আমি এইসব ছোটখাটো কাজ করি না। আমি একজন ব্যরিস্টার!”—বলে তাড়িয়ে দেওয়ার আগে যেন মনে রাখি যে, আমার যোগ্যতা আল্লাহর تعالى অনুগ্রহের ফল। তিনি চাইলে আমাকে যে কোনো সময় পথে বসিয়ে দিতে পারেন

উল্লেখ্য, এই আয়াতটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেওয়া ঋণের বেলায় প্রযোজ্য। ক্বরদে হাসানাহ বা কোনো ধরনের সময়ের দাবি না রেখে দেওয়া ঋণের জন্য নয়। একই সাথে হাতে হাতে আদান প্রদান করলেও লিখিত চুক্তি করার দরকার নেই।[১৪] আর ভ্রমণে থাকলে, সাথে কোনো লেখক না থাকলে, এই ধরনের লিখিত চুক্তি করার দরকার নেই, তা এর পরের আয়াতে এসেছে

যদি সফরে থাকো, আর চুক্তিলেখক না-পাও, তাহলে হাতের কাছে বন্ধক রাখার মতো কিছু রাখতে হবে। তবে তোমরা যদি বন্ধক না-রেখে একে অপরের উপর আস্থা রাখতে চাও, তাহলে যার উপর আস্থা রাখা হয়েছে, সে যেন তার আস্থার প্রতিদান দেয় এবং আল্লাহর ব্যাপারে সাবধান থাকে।
তোমরা সাক্ষী গোপন করবে না। যে করে তার অন্তর অবশ্যই অপরাধী। আর তোমরা কী করো না-করো আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৮৩]

কিছু আলিম মনে করেন, এই আয়াতে ঋণের লিখিত চুক্তির ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়েছে। আগের আয়াতে যে বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে, তা এই আয়াতে এসে বাতিল হয়ে গেছে। এখন ঋণের লিখিত চুক্তি করলেও হবে, না করলেও হবে, তবে করা ভালো। অথচ এই আয়াতটি পরিষ্কারভাবে এমন পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে, যখন চুক্তি লেখক পাওয়া যাচ্ছে না। এর সাথে আগের আয়াতের কোনোই সম্পর্ক নেই। [সূত্র: আত-তাবারি[১৪] — সুতরাং আমরা দেখতে পাই, কোনো আলিম কুরআনের কোনো আয়াতের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেই সেটা সবসময় শুদ্ধ হয় না। আমাদেরকে দেখতে হবে, কোন আলিমের ব্যাখ্যার পেছনে কত শক্ত প্রমাণ রয়েছে

আমাদের অনেকের জীবনেই ঋণ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আত্মীয়দের কাছে ঋণ নিয়ে বা দিয়ে কোনো লিখিত চুক্তি এবং সাক্ষী না করার কারণে পরে বড় ধরনের মনমালিন্য, ঝগড়া হয়েছে। বন্ধুরা টাকা নিয়ে আর টাকা ফেরত দেয়নি। চাইতে গেলে অস্বীকার করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিশ্বাস করে ঋণ দেওয়ার পর সেই মানুষের আসল চেহারা দেখা গেছে। ঋণ নিয়ে মানুষের মধ্যে হাজারো সমস্যা হয় দেখেই আল্লাহ تعالى সাক্ষী সহ লিখিত চুক্তি করার ব্যাপারে এত জোর দিয়েছেন। কিন্তু মুসলিমরা নামাজ, রোজা, যাকাতকে ফরজ জেনে যেভাবে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে, সাক্ষীসহ লিখিত চুক্তির ব্যাপারটা ফরজ হওয়ার পরেও গুরুত্ব দেয়নি। ফলাফল অশান্তি, তিক্ততা

[] বাইয়িনাহ এর কুরআনের তাফসীর। [] ম্যাসেজ অফ দা কুরআনমুহাম্মাদ আসাদ। [] তাফহিমুল কুরআনমাওলানা মাওদুদি। [] মারিফুল কুরআনমুফতি শাফি উসমানী। [] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [] তাদাব্বুরে কুরআনআমিন আহসান ইসলাহি। [] তাফসিরে তাওযীহুল কুরআনমুফতি তাক্বি উসমানী। [] বায়ান আল কুরআন: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কুরআনমাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কুরআন তাফসীরআব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআনগুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ানইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কুরআনুল কারীমবাংলা অনুবাদ সংক্ষিপ্ত তাফসীরবাদশাহ ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ

No comments

Powered by Blogger.