রমজানের ইতিকাফে দুই হজ ও দুই ওমরার সওয়াব
আল্লামা ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ (রহ.) লিখেছেন, ‘ইতিকাফের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে—পার্থিব মোহনীয়তার সব জাল ছিঁড়ে আল্লাহর সঙ্গে পরিপূর্ণ ও গভীর প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপন করা। রমজানের পবিত্র মাসে আল্লাহর ঘরে নির্জনবাস ও ইতিকাফের মাধ্যমে হৃদয় ও আত্মার এমন অভাবনীয় উৎকর্ষ সাধিত হয় যে, মানুষের হৃদয়ে তখন আল্লাহর স্মরণ ও তার প্রতি গভীর প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া দ্বিতীয় অন্যটি আর স্থান পায় না। মহান প্রতিপালকের ধ্যান-চিন্তা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা-ভাবনায় সে উৎসাহবোধ করে না। তার হৃদয়ের সব অনুভূতি তখন আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও সহায়ক হয়ে থাকে। মাখলুকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার পরিবর্তে আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ঐকান্তিকতা সৃষ্টি হয়। কবরের নিঃসঙ্গ অন্ধকারে যেখানে কোনো বন্ধু ও সাহায্যকারী থাকবে না, সেখানে এ সম্পর্ক এক মহামূল্যবান পাথেয়রূপে কাজে আসবে। এই হলো ইতিকাফের উদ্দেশ্য ও রমজানুল মুবারকের শেষ ১০ দিনের সঙ্গে একে সম্পৃক্ত করার গভীর তাৎপর্য ও রহস্য।’ (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা : ১৮৭)
ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘মসজিদের ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা। চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফিরিশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য, কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসুল (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তার বিবিগণসহ সব সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করেছেন।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : ২/৪২)
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাসুল (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন রীতিমতো ইতিকাফ পালন করেছেন। তার ইন্তিকালের পর তার স্ত্রীরা পুণ্যের এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ হচ্ছে সুন্নাতে মুআক্কাদা আলাল কিফায়া। অর্থাৎ মসজিদের মুসল্লিদের পক্ষ থেকে বা মহল্লার মধ্য থেকে কোনো এক ব্যক্তি ইতিকাফ করলে তা সব মুসল্লি বা মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে।
২০তম রমজানে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে থেকে ২৯-৩০ তারিখ যেদিন ঈদের চাঁদ দেখা যাবে, সেদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। যিনি ইতিকাফ করেন, তাঁকে মুতাকিফ বলা হয়ে থাকে। ইতিকাফ যেকোনো সময় করা যায়। যখনই কেউ ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবস্থান করে, তখনই তা ইতিকাফ বলে গণ্য হবে। তবে ২০ রমজানের সূর্যাস্তের আগে থেকে শাওয়াল তথা ঈদের চাঁদ উদিত হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করা সুন্নাত।
ইতিকাফ শুরু হওয়ার পর প্রাকৃতিক প্রয়োজন এবং ফরজ গোসলের প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের চৌহদ্দি থেকে বের হওয়া যায় না। অবশ্য খাবার পানির ব্যবস্থা করার কেউ না থাকলে সে জন্য বের হওয়া যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত হয় এমন মসজিদে নিয়ত সহকারে ইতিকাফ পালন করতে হয়।
ইতিকাফ চলাকালে চুপ করে বসে থাকা কিংবা অলসতা-উদাসীনতায় সময় নষ্ট করা উচিত নয়। বরং তাসবিহ, কোরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ ইত্যাদি ইবাদতে ব্যতিব্যস্ত থাকা চাই। ইতিকাফের ফজিলত বর্ণনা করে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন—‘যে ব্যক্তি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ পালন করবে, তাকে দুটি হজ ও দুটি ওমরাহর সমমান সাওয়াব দেওয়া হবে।’ (বায়হাকি)
আত্মশুদ্ধি, শুদ্ধাচার, হৃদয়ের নিষ্কলুষতা, পবিত্রতা অর্জন ও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ ইতিকাফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তা ছাড়া রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত ‘লাইলাতুল কদর’ সন্ধান করাও ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
No comments