ওহোদ যুদ্ধের কতগুলি উল্লেখযোগ্য দিক ও শিক্ষণীয় ঘটনা

পূর্বের অংশ পড়ুন: বদর হ’তে ওহোদ

(১) ‘আব্দুল্লাহ’ নামের কাফেরগণ-
(ক) কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী বনু আব্দুদ্দার-এর নিহত ১০ জন পতাকাবাহীর প্রথম ৬ জনের সকলেই ছিল আবু তালহা আব্দুল্লাহ বিন ওছমান ইবনু আব্দিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র।
(খ) কুরায়েশ তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিল বদর যুদ্ধে নিহত উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী‘আহ।
(গ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে সরাসরি আঘাতকারী তিনজন কাফের সৈন্যের দ্বিতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূলের ললাট রক্তাক্ত হয়। ইনি ছিলেন পরবর্তীকালে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিঃ)-এর দাদা। তৃতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ লায়ছী, যার আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূলের চোখের নীচে চেহারার মধ্যে ঢুকে যায়। শেষোক্ত ব্যক্তি একই সময়ে মুহাজিরগণের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে হত্যা করে এবং চেহারায় মিল থাকার কারণে তাকেই রাসূল ভেবে রাসূল নিহত হয়েছেন বলে সে সর্বত্র রটিয়ে দেয়।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন তাঁর সৈন্যদের শিবিরে ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর উপরে হামলাকারী প্রথম কাফের সৈন্যটির নাম ছিল উছমান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুগীরাহ। দ্বিতীয় কাফির সৈন্যটির নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন জাবের। প্রথমজন হারেছ ইবনু ছাম্মাহর আঘাতে এবং দ্বিতীয় জন আবু দুজানার হাতে নিহত হয়। এইসব আব্দুল্লাহগণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও এরা আল্লাহর বিধান মানতে ও রিসালাত-এর উপরে ঈমান আনতে রাযী ছিল না। এক কথায় তারা তাওহীদে ববূরিয়াতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু তওহীদে ইবাদতে বিশ্বাসী ছিল না। মুমিন হওয়ার জন্য যা অপরিহার্য শর্ত।
(২) পিতা ও পুত্র পরস্পরের বিপক্ষে :
হিজরতের পূর্বে মদীনার আউস গোত্রের সর্দার ও ধর্ম যাজক ছিল আবু আমের ‘আর-রাহেব’। হিজরতের পরে সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশদের পক্ষে ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করে। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) তার লকব দেন আবু আমের ‘আল-ফাসেক্ব’। পক্ষান্তরে তার পুত্র ‘হানযালা’ ছিলেন মুসলিম বাহিনীর সেই তরুণ সৈন্য যিনি সবেমাত্র বিয়ে করে বাসর যাপন করছিলেন। অতঃপর যুদ্ধের ঘোষণা শুনেই নাপাক অবস্থায় ময়দানে চলে  আসেন এবং ভীষণ তেজে যুদ্ধ করে শহীদ হন। ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দেন। এজন্য তাঁকে ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ বলা হয়।
(৩) দুই ভাই পরস্পরের বিপক্ষে :
ওহোদ যুদ্ধে রাসূলের উপরে হামলাকারী তিন জনের প্রথম জন ছিল উৎবাহ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। তার নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতেই রাসূলের ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে যায়। পরে হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ (রাঃ) তার পিছনে ধাওয়া করেন এবং এক আঘাতেই তার মস্তক দেহচ্যুত করে ফেলেন ও তার ঘোড়া ও তরবারি দখল করে নেন। এই উৎবাহর ভাই ছিলেন ‘ইসলামে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী’ এবং মুসলিম বাহিনীর খ্যাতনামা বীর ও পরবর্তীকালে ইরাক বিজেতা সেনাপতি হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।
(৪) ওহোদ যুদ্ধে কুরায়েশ মহিলাদের তৎপরতা :
(ক) কুরায়েশ পক্ষে প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ ১৫ জনের মহিলা দলের নেতৃত্ব দেন। তারা নেচে গেয়ে তাদের সৈন্যদের উত্তেজিত করেন। যুদ্ধে আবু দুজানার তরবারির হাত থেকে হিন্দা বেঁচে যান তার হায় হায় শব্দে তাকে নারী হিসাবে চিনতে পারার কারণে। (খ) পলায়ণপর কুরায়েশ বাহিনী যখন পুনরায় অরক্ষিত গিরিপথ দিয়ে ময়দানে আবির্ভূত হয়, তখন কুরায়েশ বাহিনীর ভূলুণ্ঠিত যুদ্ধ পতাকা আমরাহ বিনতে আলক্বামাহ নাম্মী এক কুরায়েশ মহিলা অসীম বীরত্বের সাথে দ্রুত উঁচু করে তুলে ধরেন। যা দেখে বিক্ষিপ্ত ও পলায়ণরত কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে ও গণীমত কুড়ানোয় ব্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।
(৫) ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের ভূমিকা :
(ক) উম্মে আয়মন : যখন  তিনি দেখলেন যে, কুরায়েশ  বাহিনীর শেষোক্ত হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে মুসলিম বাহিনীর কেউ কেউ মদীনায় ঢুকে পড়ছে। তখন তিনি তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করতে লাগলেন ও বলতে লাগলেন هاكَ المغزل وهلم سيفك ‘তোমরা এই সূতা কাটার চরকা নাও এবং আমাদেরকে তরবারি দাও’। এই বলে তিনি দ্রুতগতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছেন এবং আহতদের পানি পান করাতে শুরু করেন। তার উপরে জনৈক শত্রুসৈন্য তীর চালিয়ে দিলে তিনি পড়ে যান ও বিবস্ত্র হয়ে যান’। এ দেখে আল্লাহর শত্রু হো হো করে  হেসে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছকে একটি পালকবিহীন তীর দিয়ে বলেন, এটা ওর উপরে চালাও’। সা‘দ ওটা চালিয়ে দিলে ঐ শত্রুটির গলায় বিদ্ধ হয় ও চিৎ হয়ে পড়ে বিবস্ত্র হয়ে যায় এবং রাসূল (ছাঃ) হেসে ওঠেন।
(খ) যুদ্ধ শেষে কিছু মুসলিম মহিলা ময়দানে আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা বিনতে আবুবকর, উম্মে সুলায়েম (أم سُلَيم) , উম্মে সুলাইত্ব (أم سُلَيط) প্রমুখ ছিলেন। যারা পিঠের উপরে মশক বহন করে এনে আহত সৈনিকদের পানি পান করান।[1]
(গ) যুদ্ধ শেষে ঘাঁটিতে স্থিতিশীল হওয়ার পর কন্যা ফাতিমা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যখম ধুয়ে ছাফ করেন এবং জামাতা আলী তার ঢালে করে পানি এনে তাতে ঢেলে দেন। কিন্তু যখন দেখা গেল যে, তাতে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। তখন ফাতিমা (রাঃ) চাটাইয়ের একটা অংশ জ্বালিয়ে  তার ভস্ম ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন। তাতে রক্ত বন্ধ হয়ে যায়।[2] এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মানুষ নবী ছিলেন, নূরের নবী নন। তাছাড়া এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, চিকিৎসা গ্রহণ করা নবীগণের মর্যাদার বিরোধী নয়।
(ঘ) উম্মে উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব যিনি ১৩ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত আক্বাবায়ে কুবরায় শরীক ছিলেন, তিনি অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে আহতদের সেবা-শুশ্রূষায় রত ছিলেন। যখন শুনলেন যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কাফেরদের মধ্যে ঘেরাও হয়েছেন তখন ছুটে এসে বীর বিক্রমে কাফেরদের প্রতি তীর বর্ষণ শুরু করেন। রাসূলকে আঘাতকারী ইবনু ক্বামআহকে তিনি তরবারি দ্বারা কয়েকবার আঘাত করেন। কিন্তু লৌহ বর্মধারী হওয়ায় সে বেঁচে যায়। পাল্টা তার আঘাতে উম্মে উমারাহ দারুণভাবে আহত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ঐ বিপদের সময়ে আমি ডাইনে-বামে যেদিকে তাকাই সেদিকেই উম্মে উমারাহকে দেখি, আমাকে রক্ষা করার জন্য তিনি অবিরাম গতিতে যুদ্ধ করে চলেছেন’। ঐ দিন উম্মে উমারাহর দেহে ১২টি যখম লেগেছিল।
৬। ফেরেশতারা যাঁকে গোসল দিলেন :
যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা শুনেই বাসর ঘর ছেড়ে ত্বরিৎ গতিতে যুদ্ধের ময়দানে এসে শত্রুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন সদ্য বিবাহিত যুবক হানযালা বিন আবু আমের আর-রাহিব। অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে তিনি শত্রু বাহিনীর সারিগুলি তছনছ করে মধ্যভাগে পৌঁছে যান। অতঃপর কুরায়েশ সেনাপতি আবু সুফিয়ানের মাথার উপরে তরবারি উত্তোলন করেন তাকে খতম করে দেবার জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তে শত্রুসৈন্য শাদ্দাদ বিন আউসের আঘাতে তিনি ধরাশায়ী হন ও শাহাদাত বরণ করেন।
যুদ্ধশেষে হানযালার মৃত দেহ অদৃশ্য ছিল। অনেক সন্ধানের পর এক স্থানে এমন অবস্থায় পাওয়া গেল যে, যমীন হ’তে উপরে রয়েছে এবং ওটা হ’তে টপটপ করে পানি পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে বললেন, ‘ফেরেশতারা তাকে গোসল দিচ্ছেন’। পরে তার স্ত্রীর কাছে প্রকৃত ব্যাপারটি জানা যায় যে, তিনি নাপাকীর গোসল ছাড়াই যুদ্ধের ময়াদনে ছুটে এসেছিলেন। ফলে তখন থেকে হযরত হানযালা ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ (غسيل الملائكة) বা ‘ফেরেশতাগণ কর্তৃক গোসলকৃত’ বলে অভিহিত হন।
৭। নিজেদের হাতে নিজেদের মৃত্যু :
খালেদ বিন ওয়ালীদের অতর্কিত হামলায় দিশেহারা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে দু’ধরনের লোকের সৃষ্টি হয়। একদল কাফিরদের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে জান বাঁচানোর জন্য কেউ পালিয়ে গিয়ে মদীনায় ঢুকে পড়ে। কেউ পাহাড়ের মাথায় উঠে পড়ে এবং অন্যদল শত্রু সেনাদের মধ্যে মিশে যায়। ফলে পরস্পরকে চিনতে ব্যর্থ হয়ে মুসলমানের হাতেই কোন কোন মুসলমান শহীদ হয়ে যান। এমনই অবস্থার শিকার হন খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর বৃদ্ধ পিতা হযরত ইয়ামান (রাঃ)। এ সময় হুযায়ফা চীৎকার দিয়ে বলেন, أي عباد الله أبي أبي ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমার পিতা, আমার পিতা! কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি।[3] তখন হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, يغفر الله لكم وهو أرحم الراحمين ‘আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন! তিনি শ্রেষ্ঠ ক্ষমাকারী’।[4] আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে তার পিতার রক্তমূল্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা না নিয়ে মাফ করে দেন।
৮। মুশরিকদের বেষ্টনীতে রাসূল (ছাঃ); সাথী মাত্র নয়জন জান কোরবান ছাহাবী :
যুদ্ধ চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নয় জন সাথী সহ সেনাবাহিনীর পিছনে থেকে সৈন্য পরিচালনা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পান যে, সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে খালেদ বিন ওয়ালীদ সসৈন্যে ঢুকে পড়ছে। তখন তিনি সাক্ষাত বিপদ বুঝতে পেরে নিজে আত্মরক্ষা করে শিবিরের দিকে না গিয়ে চীৎকার দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ডাক দিলেন ‘হে আল্লাহর বান্দারা এদিকে’ (إلىّ عباد الله، إلىّ عباد الله) বলে। এতে মুশরিক বাহিনী তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চারদিক থেকে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, من يردهم عنا وهو رفيقي في الجنة ‘যে ব্যক্তি আমাদের থেকে ওদের হটিয়ে দেবে সে ব্যক্তি আমার সাথে জান্নাতে থাকবে’ (মুসলিম)। তখন তাঁকে বাঁচানোর জন্য সাথী একে একে সাত জন আনছার ছাহাবীর সকলে জীবন দিলেন। এদের মধ্যে সর্বশেষ আনছার ছাহাবী ছিলেন উমারাহ ইবনু ইয়াযীদ ইবনুস সাকান (রাঃ)। বাকী রইলেন মাত্র দু’জন মুহাজির ছাহাবী হযরত ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ এবং সা‘দ বিন আবী ওয়াক্ক্বাছ (রাঃ)।[5] তাদের অতুলনীয় বীরত্বের মুখে কাফের বাহিনী এগিয়ে আসতে বাধাগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে কুরআন বলেছে, إِذْ تُصْعِدُوْنَ وَلاَ تَلْوُوْنَ عَلَى أحَدٍ وَالرَّسُوْلُ يَدْعُوْكُمْ فِيْ أُخْرَاكُمْ- ‘যখন তোমরা (ভয়ে পাহাড়ের) উপরে উঠে যাচ্ছিলে এবং পিছন দিকে কারু প্রতি ফিরে তাকাচ্ছিলে না, অথচ রাসূল তোমাদের ডাকছিলেন তোমাদের পিছন দিক থেকে … (আলে ইমরান ৩/১৫৩)
৯। রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদ হ’ল :
ত্বালহা ও সা‘দ ব্যতীত যখন রাসূলের পাশে আর কেউ  নেই।[6] তখন এই সুযোগে তাঁকে হত্যা করার জন্য কাফেররা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রথমে সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছের ভাই উৎবাহ বিন আবী ওয়াকক্বাছ রাসূলের চেহারা লক্ষ্য করে সজোরে পাথর নিক্ষেপ করে। তাতে রাসূলের ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁতটি ভেঙ্গে যায় ও নীচের ঠোটটি আহত হয়। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী এগিয়ে এসে তাঁর ললাটে তরবারির আঘাত করে যখম করে দেয়। এরপর আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ নামক এক দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী এসে তার কাঁধের উপরে ভীষণ জোরে তরবারির আঘাত করে। যা তাঁর লৌহবর্ম ভেদ করতে না পারলেও তার ব্যথা ও কষ্ট তিনি এক মাসের অধিক সময় অনুভব করেন। তারপর সে দ্বিতীয় বার আঘাত করে। যাতে তাঁর শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চোখের নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে থেকে যায়। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাচ্ছিল্য করে আব্দুল্লাহ বলে خذ هذا وأنا ابن قمئة ‘এটা লও। আমি ক্বামআহর (টুকরাকারিণীর) বেটা’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) তাকে বদ দো‘আ করে বলেন, أقمأك الله ‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন’।[7]
১০। রাসূলের উপরে হামলাকারীদের পরিণতি :
প্রথম হামলাকারী উৎবাহ বিন আবী ওয়াক্ক্বাছ যার নিক্ষিপ্ত পাথরে রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদ হয়, তার ভাই সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) এর প্রতিশোধ নিতে  চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ তার পিছে ধাওয়া করে এক আঘাতেই তার মস্তক দেহচ্যুত করে ফেলেন এবং তার ঘোড়া ও তরবারি দখল করে নেন।
দ্বিতীয় হামলাকারী আব্দুল্লাহ বিন শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূলের ললাট দেশ যখম হয়, তার পরিণতি জানা যায়নি।
তৃতীয় আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ, যার তরবারির আঘাতে রাসূলের শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চক্ষুর নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে যায় এবং যাকে রাসূল (ছাঃ) ‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন’ বলে বদদো‘আ করেছিলেন, তার পরিণতি হয়েছিল এই যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলের দো‘আ কবুল করেন এবং তার উপরে তার বকরীদের বিজয়ী করে দেন। ঘটনা ছিল এই যে, যুদ্ধ হ’তে মক্কায় ফিরে সে তার বকরী পালের খোঁজে পাহাড়ের দিকে যায় এবং তার বকরীগুলিকে পাহাড়ের চূড়ায় দেখতে পায়। অতঃপর সে সেখানে উঠে বকরী খেদিয়ে আনতে গেলে হঠাৎ শক্তিশালী পাঁঠা ছাগলটি তাকে শিংয়ের প্রচন্ড গুঁতা মেরে ফেলে দেয়। অতঃপর তাকে পাহাড় থেকে নীচে ফেলতে ফেলতে এবং শিংয়ের গুঁতা মারতে মারতে টুকরা টুকরা করে ফেলে।[8]
১১। রাসূলের পায়ের উপরে মাথা রেখে শহীদ হ’লেন যিনি :
কাফেরদের বেষ্টনীতে পড়ে গেলে সেই সংকট মুহূর্তে সপ্তম আনছার ছাহাবী উমারাহ ইবনু ইয়াযীদ ইবনুস সাকান যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে ছাহাবায়ে কেরাম এসে পড়েন ও কাফেরদের হটিয়ে দিয়ে তাকে উঠিয়ে রাসূলের কাছে নিয়ে যান। রাসূল (ছাঃ) তার মুখমন্ডল নিজের পায়ের উপরে রাখেন। অতঃপর তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়। এটাই যেন ছিল তার মনের বাসনা যে, ‘প্রাণ যেন নির্গত হয় আপনার পদচুম্বনে’। এই ঘটনায় উর্দু কবি গেয়েছেন,
سر بوقت ذبح اپنا اس ڪے زير پائے ﮨﮯ
يه نصيب الله اكبر لوﭩنے كي جائے ﮨﮯ
‘যবহের সময় নিজের মাথা
রাসূলের পায়ের উপর
দুনিয়া হ’তে প্রস্থানকালে ‘আল্লাহু আকবর’
কতই না বড় সৌভাগ্য তার!’
১২। রাসূলের দো‘আ ও বদদো‘আ :
আব্দুল্লাহ ইবনে ক্বামআহর আঘাত ও তার ‘এটা লও এবং আমি টুকরাকারিণীর বেটা’ বলে তাচ্ছিল্যের জবাবে মুখের রক্ত মুছতে মুছতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে বদদো‘আ করে বলেছিলেন, أقمأك الله ‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন’ (সে বদদো‘আ তার উপরে ফলেছিল মক্কায় ফিরে যাওয়ার পরপরই)। এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি মুখের রক্ত মুছতে মুছতে নিজের জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করে বলেন, اللهمَّ اهْدِ قَومي فانهم لا يعلمون ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কওমকে হেদায়াত কর। কেননা তারা (আমাকে) জানে না’ (শিফা-ক্বাযী আয়ায (মৃঃ ৫৪৪ হিঃ))। ত্বাবারাণীর বর্ণনায় এসেছে, اللهم اغفرلقومي এবং ছহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রার বর্ণনায় এসেছে,  إنى لم أبعث لعانا ولكن بعثت داعيا ورحمة، اللهم اغفر لقومي فانهم لا يعلمون، ‘আমি লা‘নতকারী হিসাবে প্রেরিত হইনি। বরং আমি প্রেরিত হয়েছি আহবানকারী হিসাবে ও রহমত হিসাবে। হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার কওমকে ক্ষমা কর। তারা (আমাকে) জানে না’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, كيف يَفْلَحُ قومٌ شَجُّوا وجَه نبيهم وكَسَرُوا رُبَاعِيَّتَه وهو يدعوهم إلى الإسلام ‘ঐ জাতি কিভাবে সফলকাম হবে, যারা তাদের নবীর মুখমন্ডল আহত করেছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। অথচ তিনি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করছেন’।[9] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এ সময় তিনি বলেন, اشتد عضب الله على قوم دمَّوا وجهَ رسوله ‘আল্লাহর কঠিন গযব নাযিল হৌক ঐ জাতির উপরে যারা তাঁর রাসূলের চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে’। একইরূপ কথা তিনি বলেন ঘাঁটিতে স্থিতি লাভের পর اشتد عضب الله على مَنْ دَمَّى وجهَ نبيِّه ‘আল্লাহ কঠিন গযব নাযিল করুন তাদের উপরে, যারা তাঁর নবীর চেহারাকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে’।[10] তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়, لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذَّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ- ‘আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন অথবা আযাব দিবেন, সেবিষয়ে আপনার কিছুই করণীয় নেই। কেননা তারা হ’ল যালেম (আলে ইমরান ৩/১২৮)। এতে বুঝা যায় যে, যালেমদের শাস্তি দানের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। বান্দা কেবল দো‘আ করতে পারে। কবুল করার মালিক আল্লাহ।
১৩। চলমান শহীদ :
(ক) ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ : কাফিরদের বেষ্টনীতে পড়ার সংকটকালীন অবস্থায় রাসূলকে রক্ষাকারী ৯ জন ছাহাবীর ৭ জন আনছার ছাহাবী শহীদ হওয়ার পর সর্বশেষ দু’জন মুহাজির ছাহাবী হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ ও ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ অতুলনীয় বীরত্বের সাথে লড়াই করে কাফিরদের ঠেকিয়ে রাখেন। দু’জনেই ছিলেন আরবের সেরা তীরন্দায। তাদের লক্ষ্যভেদী তীরের অবিরাম বর্ষণে কাফির সৈন্যরা রাসূলের কাছে ভিড়তে পারেনি। এই সময় রাসূল (ছাঃ) স্বীয় তূণ হ’তে তীর বের করে সা‘দকে দেন ও বলেন ارم فداك أبي وأمي ‘তীর চালাও! তোমার উপরে আমার পিতামাতা উৎসর্গীত হউন’। তার বীরত্বের প্রতি রাসূল (ছাঃ) কতবড় আস্থাশীল ছিলেন, একথাই তার প্রমাণ। কেননা আলী (রাঃ) বলেন, সা‘দ ব্যতীত অন্য কারুর জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় পিতা-মাতা উৎসর্গীত হউন, এরূপ কথা কখনো বলেননি।[11]
দ্বিতীয় মুহাজির ছাহাবী হযরত ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে হযরত জাবের (রাঃ) বলেন যে, ঐদিন তিনি একাই এগারো জনের সঙ্গে লড়াই করেন। এইদিন তিনি ৩৫ বা ৩৯টি আঘাত পান। তাঁর শাহাদাত ও মধ্যমা অঙ্গুলী কেটে যায় ও পরে অবশ হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) তার সম্পর্কে বলেন,  من سرّه أن ينظر إلى شهيد يمشى على وجه الأرض فلينظر إلى طلحة بن عبيد الله- ‘যদি কেউ ভূপৃষ্ঠে চলমান কোন শহীদকে দেখতে চায়, তবে সে যেন ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহকে দেখে’।[12] বস্ত্ততঃ তিনি শহীদ হন হযরত আলীর খেলাফতকালে ‘উটের যুদ্ধে’র দিন কুচক্রীদের হামলায়। আবুবকর (রাঃ) ওহোদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন, ذلك اليوم كله لطلحة ‘ঐ দিনটি ছিল পুরোপুরি ত্বালহার’। অর্থাৎ নিঃসঙ্গ রাসূলকে বাঁচানোর জন্য যে ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছিলেন, তা ছিল তুলনাহীন।
(খ) আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালেক ইবনু সিনান : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ললাট হ’তে রক্ত চেটে ছাফ করে দিলেন। অতঃপর তাকে নিজের রক্ত মুছতে বলা হ’ল। কিন্তু তিনি বললেন, আল্লাহর কসম আমি রক্ত মুছবো না। বলেই তিনি ময়দানে ছুটলেন ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, من أراد أن ينظر إلى رجل من أهل الجنة فلينظر إلى هذا- ‘যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখতে চায়, সে যেন এ ব্যক্তিকে দেখে’। অতঃপর তিনি যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।
১৪। ফেরেশতা নাযিল :
হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন আমি রাসূলের সাথে দু’জন সাদা পোশাকধারী লোককে দেখি, যারা তাঁর পক্ষ হ’তে প্রচন্ড বেগে লড়াই করছিলেন। যাঁদেরকে আমি এর পূর্বে বা পরে আর কখনো দেখিনি- অর্থাৎ জিব্রীল ও মীকাঈল।[13]
ফেরেশতাগণ সংকট মুহূর্তেই কেবল সহযোগিতা করেছেন, সর্বক্ষণের জন্য নয়। এই সহযোগিতা ছিল সান্ত্বনামূলক। যাতে রাসূল ও মুসলমানদের হিম্মত বৃদ্ধি পায়। নইলে একা জিব্রীলই যথেষ্ট ছিলেন কাফির বাহিনীকে নির্মূল করার জন্য।
১৫। যুদ্ধক্ষেত্রে তন্দ্রা :
কাফিরদের বেষ্টনী থেকে মুসলিম বাহিনীকে মুক্ত করে যখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ধীরে ধীরে পাহাড়ের উচ্চ ভূমির ঘাঁটিতে ফিরে আসছিলেন, তখন হঠাৎ করে অনেকের মধ্যে তন্দ্রা নেমে আসে। বদর যুদ্ধের ন্যায় এটা ছিল তাদের জন্য আল্লাহ প্রেরিত এক ধরনের প্রশান্তি। হযরত আবু ত্বালহা (রাঃ) বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন যারা তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন, আমি ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। এমনকি আমার হাত হ’তে কয়েকবার তরবারি পড়ে যায়। অবস্থা এমন ছিল যে, ওটা পড়ে যাচ্ছিল, আর আমি ধরে নিচ্ছিলাম। আবার পড়ে যাচ্ছিল, আবারও ধরে নিচ্ছিলাম’।[14]
১৬। উবাই ইবনে খালাফের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছেন, তখন দুর্ধর্ষ কুরায়েশ নেতা উবাই ইবনু খালাফ আল-জুমাহী সরোষে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে বলে, أين محمد لا نجوتُ إن نجا- ‘মুহাম্মাদ কোথায়! আজ হয় সে থাকবে, না হয় আমি থাকব’। ছাহাবীগণ তাকে শেষ করে দিতে চাইলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ছাড়, ওকে আসতে দাও! অতঃপর তিনি হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহর (حارث بن الصمة) নিকট থেকে একটা ক্ষুদ্র বর্শা চেয়ে নিয়ে ওটা নাড়া দিতেই লোকজন সব এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল, যেমন উট তার শরীর নাড়া দিলে মাছিগুলি সব উড়ে যায়। তারপর তিনি উবাইয়ের মুখোমুখি হয়ে তার গলার পার্শ্বে সামান্য খালি জায়গা লক্ষ্য করে বর্শা দিয়ে সেখানে আঘাত করেন। তাতে তার একটু অাঁচড় লাগে মাত্র। কোন রক্তপাত হয়নি। ভয়ে সে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। অতঃপর সে কুরায়েশদের কাছে ফিরে গিয়ে বলে, قتلني والله محمد ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ আমাকে হত্যা করে ফেলেছে’। লোকেরা বলল, ذهب والله فؤادك والله إنْ بك من بأس- ‘আল্লাহর কসম! আসলে (ভয়ে) তোমার জান উড়ে গেছে। নইলে আল্লাহর কসম! তোমার আঘাতের মধ্যে ভয়ের কিছু নেই’। জবাবে সে বলল, মুহাম্মাদ মক্কায় আমাকে বলেছিল, আমি তোমাকে হত্যা করব’। অতএব والله لو بصق على لقتلني ‘আল্লাহর কসম! যদি সে আজ আমার দিকে থুথু নিক্ষেপ করত, তাতেই সে আমাকে হত্যা করে ফেলত’। অতঃপর তার যন্ত্রণা এত বৃদ্ধি পায় যে, সে বলদের মত উচ্চ রবে শব্দ করতে থাকে এবং বলতে থাকে, والذي نفسي بيده لو كان الذي بي بأهل ذي المجاز لماتوا جميعا- ‘যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, ‘যে কষ্ট আমি পাচ্ছি, যদি যুল-মাজাযের সকল অধিবাসী ঐ কষ্ট পেত, তবে তারা সবাই মারা যেত’। অতঃপর মক্কা ফেরার পথে সারফ (السرف) নামক স্থানে পৌঁছে আল্লাহর এই শত্রু মৃত্যুবরণ করে। সে ছিল উমাইয়া ইবনু খালাফের ভাই এবং সে রাসূলের মুখে পচা হাড়ের গুঁড়া ফুঁকে মেরেছিল।
ঘটনা ছিল এই যে, মক্কায় থাকতে উবাই বিন খালাফ রাসূল (ছাঃ)-কে প্রায়ই ভয় দেখিয়ে বলতো আমি তোমাকে আমার তেজস্বী ‘আউদ’ (العود) ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হত্যা করব। যাকে আমি দৈনিক তিন ছা‘ (সাড়ে সাত কেজি) করে শস্যদানা খাইয়ে থাকি। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, ইনশাআল্লাহ আমিই তোমাকে হত্যা করব’। উবাই সেই কথাটাই মনে করে রেখেছিল।
১৭। ত্বালহার কাঁধে রাসূল (ছাঃ) :
পাহাড়ের ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তনের পথে একটা টিলা পড়ে যায়। রাসূল চেষ্টা করেও তার উপরে উঠতে সক্ষম হ’লেন না। তখন ৩৯টি আঘাতে জর্জরিত উৎসর্গীতপ্রাণ ছাহাবী ত্বালহা বিন উবায়দুল্লাহ মাটিতে বসে পড়ে রাসূলকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে টিলার উপরে পৌঁছে যান। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেন, اوجب طلحةُ أي الجنةَ ‘ত্বালহা জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে’।[15]
১৮। রাসূলের শহীদ হবার খবর ও তার প্রতিক্রিয়া :
মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী মদীনায় প্রেরিত ইসলামের প্রথম মুবাল্লিগ রীরকেশরী মুছ‘আব বিন ওমায়ের শহীদ হবার পর তাঁকে আঘাতকারী আব্দুল্লাহ ইবনে ক্বামআহ ফিরে গিয়ে সানন্দে ঘোষণা প্রচার করে দেয় যে, إن محمدا قد قتل ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে’। কেননা রাসূলের চেহারার সাথে মুছ‘আবের অনেকটা মিল ছিল। এই খবর উভয় শিবিরে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মুসলমানগণ ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। একদল অস্ত্র ত্যাগ এমনকি মদীনায় পলায়ন পর্যন্ত করলেন। কেউ পাহাড়ে উঠে গেলেন। অন্যদল কাফিরদের মধ্যে মিশে গেলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে  উবাইয়ের  মাধ্যমে  আবু  সুফিয়ানের নিকটে সন্ধি প্রস্তাব পাঠানোর চিন্তাও করেন। অন্যদিকে মুশরিকদের আক্রমণ থিতিয়ে পড়ল। কেননা তাদের মূল টার্গেট পূর্ণ হয়েছে। ফলে তারা এখন যুদ্ধ ছেড়ে মুসলমানদের মৃত লাশের নাক-কান কাটার মত নোংরামিতে লিপ্ত হ’ল।
১৯। রাসূলকে চিনতে পেরে খুশীতে প্রথম চীৎকার দিয়ে ওঠেন যিনি :
মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর শাহাদাতের সাথে সাথে মুসলমানদের পতাকা ‘আল্লাহর সিংহ’ আলীর হাতে তুলে দেন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)। অতঃপর তিনি নিজ সেনাদলের দিকে অগ্রসর হ’তে থাকেন। এমন সময় ছাহাবী কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) তাঁকে সর্বপ্রথম চিনতে পারেন ও খুশীতে চিৎকার করে বলে ওঠেন, يا معشر المسلمين أبشروا هذا رسول الله صلعم ‘হে মুসলিমগণ! সুসংবাদ গ্রহণ কর। এইতো আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করেন। যাতে মুশরিকেরা তাঁর অবস্থান বুঝতে না পারে। কিন্তু তার আওয়ায মুসলিম বাহিনীর কানে ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল এবং দ্রুত সেখানে ৩০ জনের মত ছাহাবী জমা হয়ে গেলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) সবাইকে নিয়ে ঘাঁটির দিকে যেতে শুরু করেন ও সেখানে গিয়ে স্থিতি লাভ করেন।
২০। রাসূলের চেহারা থেকে কড়া তুলতে গিয়ে নিজের দাঁত হারালেন যিনি :
আব্দুল্লাহ ইবনে ক্বামআর তরবারির প্রচন্ড আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূলের চোখের নীচে হাঁড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। যা বের করার জন্য হযরত আবুবকর (রাঃ) এগিয়ে গেলে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) তাকে আল্লাহর দোহাই দেন ও নিজেই দাঁত দিয়ে কামড়ে ধীরে ধীরে টান দিয়ে একটা বের করে আনেন। এতে তাঁর উপরের সম্মুখ সারির একটি ‘ছানিয়া’ (ثنية) দাঁত ভেঙ্গে পড়ে যায়। দ্বিতীয়টির বেলায় আবুবকর (রাঃ) আবার এগিয়ে গেলেন। কিন্তু এবারেও তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেন ও নিজেই সেটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধীরে ধীরে টেনে বের করেন। এতে তার আরেকটি ‘ছানিয়া’ দাঁত ভেঙ্গে পড়ে যায়। এখান থেকে তাঁর লকব হয়ে যায় ‘দুই ছানিয়া দাঁত হারানো ব্যক্তি’ (سَاقِطُ الثَّنِيَتَيْنِ)[16]
উল্লেখ্য যে, ত্বালহা যখন একাই লড়ছিলেন, তখন সামনের কাতার থেকে রাসূলের খোঁজে সর্বপ্রথম পিছনে ফিরে আসেন গুহার সাথী আবুবকর ও তারপরে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)।
২১। নাক-কান কাট ও কলিজা চিবানো মামা-ভাগিনা এক কবরে :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শহীদ হয়েছেন ভেবে নিশ্চিন্ত মনে মুশরিক সেনাদের কেউ কেউ শহীদ মুসলমানদের লাশের উপরে বীরত্ব দেখাতে শুরু করে এবং তাদের নাক-কান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ কেটে মনের ঝাল মিটাতে থাকে। এ সময় আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ বদর যুদ্ধে তার পিতার হত্যাকারী হযরত হামযার উপরে প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য তাঁর বুক ফেড়ে ফেলে কলিজা বের করে নিয়ে চিবাতে থাকে এবং তাঁর নাক ও কান কেটে কণ্ঠহার বানায়। হামযাকে ‘সাইয়েদুশ শুহাদা’ শহীদগণের নেতা রূপে এবং ‘আসাদুল্লাহ’ ও ‘আসাদু রাসূলিল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ ও আল্লাহর রাসূলের সিংহ) আখ্যায়িত করা হয়। (২) আরেকজন ছিলেন হামযার ভাগিনা ও রাসূলের ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ। যিনি যুদ্ধে নামার আগের দিন দো‘আ করেছিলেন যে, হে আল্লাহ! আমাকে কালকে এমন একজন বীর যোদ্ধার মুখোমুখি কর, যে আমাকে প্রচন্ড লড়াই শেষে হত্যা করবে এবং আমার নাক ও কান কেটে দেবে। তারপর আমি তোমার সামনে হাযির হ’লে তুমি বলবে, হে আব্দুল্লাহ! তোমার নাক ও কান কাটা কেন? আমি বলব, হে আল্লাহ! তোমার জন্য ও তোমার রাসূলের জন্য (فيك وفي رسولك)। তখন তুমি বলবে, صدقت ‘তুমি সত্য বলেছ’। এ দো‘আর সত্যায়ন করে হযরত সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ বলেন, আমার চেয়ে তার দো‘আ উত্তম ছিল এবং সেভাবেই তিনি শাহাদাত লাভে ধন্য হয়েছেন। এজন্য তাকে المجدّع في الله ‘আল্লাহর রাস্তায় নাক-কান কর্তিত’ নামে অভিহিত করা হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজে হামযা ও আব্দুল্লাহ দু’জনকে একই কবরে দাফন করেন।
২২। রাসূলের জন্য ঢাল হ’লেন যাঁরা :
আনাস (রাঃ) বলেন, ওহোদের সেই কঠিন মুহূর্তে লোকেরা যখন নবীকে ছেড়ে এদিক-ওদিক ছুটছে, তখন আবু ত্বালহা ঢাল নিয়ে রাসূলের সামনে দাঁড়িয়ে যান। রাসূল এবং তিনি একই ঢালের আড়ালে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু ত্বালহার নিক্ষিপ্ত তীর কোথায় পড়ছে, দেখার জন্য একটু মাথা উঁচু করলেই আবু ত্বালহা বলে উঠতেন, بأبي أنت وأمي لا تشرف، يصيبك سهم من سهام القوم، نحري دون نحرك- ‘আমার পিতা-মাতা আপনার উপরে উৎসর্গীত হৌন- আপনি মাথা উঁচু করবেন না। তাহ’লে ওদের নিক্ষিপ্ত তীর আপনার গায়ে লেগে যাবে। আমার বুক হৌক আপনার বুক’।[17] আবু ত্বালহা ছিলেন একজন দক্ষ তীরন্দায। এইদিন তিনি দু’টি বা তিনটি ধনুক ভেঙ্গেছিলেন। শত্রুর দিক থেকে তীর এলেই তিনি রাসূলকে বাঁচানোর জন্য নিজের বুক উঁচু করে ধরতেন। (২) একইভাবে আবু দুজানা আনছারী রাসূলকে বাঁচানোর জন্য নিজের পিঠ পেতে দেন এবং ঐদিন তার পিঠে শত্রুর নিক্ষিপ্ত বহু তীর এসে আঘাত করে।[18] নেতা ভক্তির এমন পরাকাষ্ঠা ইতিহাসে নযীরবিহীন।
২৩। প্রাণ নিয়ে খেললেন যারা :
রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদ হওয়ার পর সেই সংকট মুহূর্তে মুষ্টিমেয় যে কয়জন ছাহাবী রাসূলের নিকটে ছুটে এসে তাঁকে বাঁচানোর জন্য নিজেদের জীবন নিয়ে খেলতে থাকেন, তাঁরা ছিলেন হযরত আবু দুজানা, মুছ‘আব বিন ওমায়ের, আলী ইবনু আবী ত্বালেব, সাহ্ল ইবনু হুনায়েফ, মালেক ইবনু সিনান- আবু সাঈদ খুদরীর পিতা, উম্মে উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব আল-মাযেনিয়াহ, ক্বাতাদাহ ইবনু নু‘মান, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, হাতেব ইবনু আবী বালতা‘আহ এবং আবু ত্বালহা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)। এঁদের মধ্যে মুছ‘আব বিন উমায়ের এবং মালেক ইবনু সিনান শহীদ হয়ে যান।
২৪। দুই বৃদ্ধের শাহাদাত লাভ :
দুইজন অতি বৃদ্ধ ছাহাবী হযরত ইয়ামান ও ছাবিত বিন ওয়াক্বশকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘাঁটিতে রেখে গিয়েছিলেন প্রহরা ও ছোটখাট কাজের জন্য। কিন্তু বিপর্যয়কালে তাঁরা শাহাদাত লাভের আকাংখায় ময়দানে ছুটে যান এবং প্রথমজন ভুলক্রমে মুসলমানের হাতে এবং দ্বিতীয় জন কাফিরের হাতে শহীদ হন।
২৫। রাসূলের ধনুক কে নিল?
হযরত ক্বাতাদাহ বিন নু‘মান বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় ধনুক দ্বারা এত অধিক তীর চালিয়েছিলেন যে, ধনুকের প্রান্তদেশ ভেঙ্গে যায়’। পরে ঐ ধনুকটি ক্বাতাদাহ নিয়ে নেন এবং তার কাছেই রেখে দেন।[19]
২৬। রাসূলের মু‘জেযা :
(ক) ওহোদ যুদ্ধের দিন হযরত ক্বাতাদাহ বিন নু‘মানের একটি চোখে আঘাত লাগায় তা বেরিয়ে ঝুলে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে ওটাকে যথাস্থানে ঢুকিয়ে দেন। তাতে চোখ ঠিক হয়ে যায় এবং তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় ও দৃষ্টি শক্তি আগের চেয়ে তীক্ষ্ণ হয়।
(খ) ঘাঁটিতে পৌঁছে রাসূলকে হামলাকারী উবাই বিন খালাফকে মারার জন্য রাসূল (ছাঃ) হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহর কাছ থেকে নিয়ে যে বর্শাটি নিক্ষেপ করেছিলেন, তা কেবল তার গলায় অাঁচড় কেটে গিয়েছিল। যাতে রক্তপাত পর্যন্ত হয়নি। অথচ তাতেই সে দু’টিন পরে মারা পড়ল।
(গ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘাঁটিতে অবস্থান কালে আবু সুফিয়ান ও খালেদ বিন ওয়ালীদের নেতৃত্বে যে দলটি তাঁকে হামলা করার জন্য পাহাড়ে উঠে যায়, তারা যাতে নিকটে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেন। অতঃপর সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছকে বলেন, أجنبهم أو ارددهم ‘ওদেরকে দুর্বল করে দাও। অথবা বললেন, ওদেরকে ফিরিয়ে দাও’। তখন সা‘দ বললেন, كيف أجنبهم وحدي ‘কিভাবে আমি একা ওদের দুর্বল করে দেব’? অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে তিনবার একই নির্দেশ দিলে তিনি নিজের তূণ থেকে একটা তীর বের করে নিক্ষেপ করেন। তাতে শত্রু পক্ষের  একজন নিহত হয়। অতঃপর আমি ঐ তীর নিয়ে নিই এবং দ্বিতীয় আরেক শত্রুকে মারলাম। সেও নিহত হ’ল। আমি আবার ঐ তীর নিয়ে নিলাম ও তৃতীয় আরেক শত্রুকে মারি। তাতে সেও মারা পড়ে। তাতে শত্রুরা ভয়ে নীচে নামতে লাগল। আমি ঐ তীর এনে আমার তূণের মধ্যে রেখে দিলাম। আমি বললাম, هذا سهم مبارك ‘এটা বরকতপূর্ণ তীর’। এই তীরটি সা‘দের নিকটে আমৃত্যু ছিল এবং তার পরে তার সন্তানদের কাছে ছিল।[20] অতঃপর হযরত ওমর ও মুহাজিরগণের একটি দল ধাওয়া করে তাদেরকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নামিয়ে দেয়।
২৭। সকলে বসে বসে যোহরের ছালাত আদায় করলেন :
ওহোদ যুদ্ধ শেষে ঘাঁটিতে স্থিতি লাভের পর যোহরের ছালাতের সময় হ’লে যখমের কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বসে বসে ছালাত আদায় করেন। ছাহাবায়ে কেরামও তাঁর পিছনে বসে বসে ছালাত আদায় করেন।
২৮। আবু সুফিয়ান ও হযরত ওমরের কথোপকথন :
যুদ্ধ শেষে মাক্কী বাহিনী প্রত্যাবর্তনের প্রস্ত্ততি গ্রহণ শেষ করে প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ান ওহোদ পাহাড়ে উঠে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, أفيكم محمد ‘তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ আছে কি’? أفيكم ابن أبي قحافة ‘তোমাদের মধ্যে আবু কুহাফার বেটা (আবুবকর) আছে কি’? أفيكم عمر بن الخطاب ‘তোমাদের মধ্যে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব আছে কি’? কিন্তু কোন জবাব না পেয়ে তিনি খুশী হয়ে সঙ্গীদের বললেন, اما هؤلاء فقد كفيتموهم ‘যাক এই লোকগুলো থেকে তোমরা বেঁচে গেলে’। তখন ওমর (রাঃ) আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, يا عدو الله إن الذين ذكرتهم أحياء وقد أبقى الله ما يسوءك- ‘রে আল্লাহর শত্রু! যাদের নাম তুমি উল্লেখ করেছ, তাঁরা সবাই বেঁচে আছেন। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করার উৎস বাকী রেখেছেন’। তখন আবু সুফিয়ান বললেন, তোমাদের লোকদের ‘মুছলা’ (مثلة) করা হয়েছে অর্থাৎ নাক-কান কাটা হয়েছে। আমি যার হুকুমও দেইনি এবং এটাকে খারাপও মনে করিনি’। অতঃপর তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, أُعْلُ هُبَلُ ‘হোবল দেবতার জয় হৌক’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা বল, الله أعْلَى وأَجلُّ ‘আল্লাহ সুউচচ ও সবচেয়ে সম্মানিত’। আবু সুফিয়ান বললেন, لنا عزي ولا عزي لكم ‘আমাদের জন্য উযযা দেবী রয়েছে, তোমাদের উযযা নেই’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের বললেন, তোমরা বল, الله مولانا ولا مولى لكم ‘আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং তোমাদের কোন অভিভাবক নেই’। তখন আবু সুফিয়ান বললেন, أنعمت فعال، يوم بيوم بدر والحرب سجال- ‘কতই না ভাল কাজ হ’ল। আজকের দিনটি বদরের দিনের প্রতিশোধ। আর যুদ্ধ হ’ল বালতির ন্যায়।’ অর্থাৎ যুদ্ধে কখনো একদল জয়ী হয়, কখনো অন্যদল। যেমন বালতি একবার একজনে টেনে তোলে, আরেকবার অন্যজনে। জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন,لا سواء قتلانا في الجنة وقتلاكم في النار- ‘না সমান নয়। আমাদের নিহতেরা জান্নাতে, আর তোমাদের নিহতেরা জাহান্নামে’।
এরপর আবু সুফিয়ান ওমর (রাঃ)-কে কাছে ডাকলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন। কাছে গেলে আবু সুফিয়ান বললেন, أنشدك الله يا عمر أقتلنا محمدًا ‘আমি তোমাকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি হে ওমর! আমরা কি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি’? ওমর বললেন,  اللهم لا ‘আল্লাহর কসম! না। وإنه ليستمع كلامك الآن ‘তিনি এখন তোমার কথা শুনছেন’। জবাবে আবু সুফিয়ান বললেন, أنت أصدق من ابن قمئة وأبر- ‘তুমি আমার নিকটে ইবনু ক্বামআর চাইতে অধিক সত্যবাদী ও অধিক সৎ।’
২৯। জান্নাতের সুগন্ধি লাভ :
(ক) আনাস বিন নাযার : ইনি আনাস ইবনু মালেকের চাচা ছিলেন এবং ইনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে না পারায় দুঃখিত ছিলেন। যুদ্ধের দ্বিতীয় ভাগে মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়কালে বসে থাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ওমর, ত্বালহা সহ মুহাজির ও আনছারদের একদল লোককে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ما تنتظرون ‘কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? তারা বললেন, قتل رسول الله صلعم ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিহত হয়েছেন’। আনাস বললেন, ما تصنعون بالحياة بعده؟ قوموا فموتوا على ما مات عليه رسول الله- ‘তাঁর পরে বেঁচে থেকে আপনারা কি করবেন? উঠুন, যার উপরে আল্লাহর রাসূল জীবন দিয়েছেন, তার উপরে আপনারাও জীবন দিন’। এরপর তিনি বললেন, اللهم إني أعتذر إليك مما صنع هؤلاء يعني المسلمين وأبرأ إليك مما صنع هؤلاء يعني المشركين- ‘হে আল্লাহ এই লোকগুলি অর্থাৎ মুসলমানেরা যা করছে সেজন্য আমি তোমার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং ওরা অর্থাৎ মুশরিকেরা যা করছে, তা হ’তে আমি নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করছি’। একথা বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হ’লে আউস নেতা সা‘দ ইবনে মু‘আয (রাঃ)-এর সাথে মুলাক্বাত হয়। তিনি তাকে বললেন, হে আবু উমার! কোথায় যাচ্ছেন? আনাস বিন নাযার জবাবে বললেন, واها لريح الجنة يا سعد إني أجده دون أحد ‘ওহ, জান্নাতের সুগন্ধি হে সা‘দ! আমি ওটা পাচ্ছি ওহোদের পিছন থেকে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,إني لاجد ريح الجنة من دون أحد-
অতঃপর তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন ও প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হ’লেন। ঐদিন তাকে বর্শা তীর ও তরবারির ৮০টির অধিক যখম লেগে দেহ ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। কেবল আঙ্গুলগুলি দেখে তার ভগ্নী রবী‘ বিনতে নযর তাকে (একটি অক্ষত আঙ্গুল) চিনতে পারেন।
(খ) সা‘দ বিন রবী‘ : যুদ্ধ শেষে আহত ও নিহতদের সন্ধানকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যায়েদ ইবনু ছাবিতকে পাঠান সা‘দ ইবনু রবী‘-এর সন্ধানে। বলে দিলেন যদি তাকে জীবিত পাও, তবে আমার সালাম বলো এবং আমার কথা বলবে যে, রাসূল তোমাকে বলেছেন, كيف تجدك ‘তুমি নিজেকে কেমন পাচ্ছ? যায়েদ বলেন, আমি তাকে যখন পেলাম, তখন তাঁর মৃত্যু ক্ষণ এসে গিয়েছে। তিনি ৭০-এর অধিক যখম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আমি তাকে রাসূলের সালাম জানিয়ে তাঁর কথাটি জানিয়ে দিলাম। তখন তিনি রাসূলকে সালাম দিতে বললেন এবং বললেন, তুমি রাসূলকে বলো يا رسول الله أجد ريح الجنة- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি’। অতঃপর আমার কওম আনছারদের বলো, তাদের একজনও বেঁচে থাকতে যদি শত্রুরা রাসূলের নিকট পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে আল্লাহর নিকটে তাদের কোন ওযর চলবে না’। পরক্ষণেই তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হ’ল। ইনি ছিলেন ১৩ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত বায়‘আতে কুবরার দিন রাসূলের নিযুক্ত ১২ জন নক্বীবের অন্যতম এবং খাযরাজ গোত্রের অন্যতম নেতা। একদিন হযরত আবু বকর (রাঃ) সা‘দের ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলেন, এটি সা‘দের মেয়ে। যিনি আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। তিনি ক্বিয়ামতের দিন নুক্বাবায়ে মুহাম্মাদীর মধ্যে শামিল হবেন।
৩০। আল্লাহ জীবিত আছেন : রাসূলের মৃত্যু সংবাদে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আনছারদের ডাক দিয়ে ছাবিত ইবনু দাহদাহ বলে ওঠেন, يا معشر الانصار إن كان محمد قد قتل فان الله حي لا يموت قاتلوا على دينكم فان الله مظفركم ناصركم- ‘হে আনছারগণ! যদি মুহাম্মাদ নিহত হয়ে থাকেন, তবে আল্লাহ জীবিত আছেন, তিনি মরেন না। তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপরে যুদ্ধ করো। কেননা আল্লাহ তোমাদের বিজয় দানকারী ও সাহায্যকারী’। … তার একথা শুনে একদল আনছার উঠে দাঁড়াল এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে ছাবিত সরাসরি খালিদ ইবনে ওয়ালীদের বাহিনীর উপরে হামলা চালালেন, পরে খালিদের বর্শার আঘাতে তিনি শহীদ হন। সঙ্গীরাও শহীদ হয়ে যান।
৩১। এক ওয়াক্ত ছালাত আদায় না করেও যিনি জান্নাতী হ’লেন :  আউস গোত্রের আমর বিন ছাবিত আল-উছায়রিম (عمرو بن ثابت الأصيرم) -কে আহতদের মধ্যে দেখতে পেয়ে হতাহতদের সন্ধানকারী মুসলিম বাহিনী হতবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ما الذي جاء بك أحدب على قومك أم رغبة في الإسلام- ‘হে উছায়রিম! কোন বস্ত্ত তোমাকে এখানে এনেছে? নিজ সম্প্রদায়কে সাহায্য করার উত্তেজনা, না ইসলামের আকর্ষণ? উত্তরে তিনি বললেন, بل رغبة في الإسلام، آمنت بالله ورسوله ثم قاتلت مع رسول الله حتى أصابني ما ترون- ‘ইসলামের আকর্ষণ। আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি। অতঃপর আল্লাহর রাসূলের পক্ষে যুদ্ধ করেছি। অতঃপর যে অবস্থায় উপনীত হয়েছি, তাতো তোমরা দেখছই’। এরপরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বিষয়টি রাসূলকে বলা হ’লে তিনি বলেন, هومن أهل الجنة ‘সে জান্নাতবাসী’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, عمل قليلا وأجر كثيرا ‘কম আমল করল এবং পুরস্কার বেশী পেল’। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ولم يصل لله صلاة قط ‘অথচ তিনি আল্লাহর জন্য এক রাক‘আত ছালাতও কখনো আদায় করেননি’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ولم يسجد لله سجدة ‘অথচ তিনি কখনো আল্লাহর জন্য একটি সিজদাও করেননি’। উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বায়‘আতের পর ১২ জন মুসলমানের সাথে ইসলামের প্রথম মুবাল্লিগ হযরত মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে মদীনায় পাঠানো হ’লে তাঁর দাওয়াতে আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম কবুল করেন এবং স্বীয় গোত্রের সকলকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ইসলাম কবুলের আহবান জানান। নইলে তাদের সঙ্গে তিনি কথা বলা হারাম ঘোষণা করেন। এমতাবস্থায় সন্ধ্যার মধ্যে সবাই ইসলাম কবুল করে। কেবলমাত্র উছায়রিম বাকী থাকে। উক্ত ঘটনার চার বছর পরে ওহোদ যুদ্ধের দিন তিনি স্বেচ্ছায় ইসলামের কলেমা পাঠ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যান এবং শহীদ হয়ে যান।
৩২। ইসলামের পক্ষে লড়াই করেও যারা জাহান্নামী হ’ল :
(১) মদীনার বনু যাফর (بنو ظَفر) গোত্রের কুযমান (قزمان) ওহোদ যুদ্ধে রাসূলের পক্ষে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিল। সে একাই কুরায়েশ বাহিনীর ৪ জন পতাকাবাহীসহ ৭/৮ জন শত্রুসৈন্য খতম করেছিল। যুদ্ধের ময়দানে তাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেলে মুসলিম সেনারা তাকে উঠিয়ে তার মহল্লায় নিয়ে যান। তখন সে বলল, والله إن قاتلت إلا عن أحساب قومي، ولولا ذلك ما قاتلت- ‘আল্লাহর কসম! আমি যুদ্ধ করেছি আমার বংশ মর্যাদা রক্ষার জন্য। যদি এটা না থাকত, তাহ’লে আমি যুদ্ধই করতাম না’। অতঃপর যখন তার যখমের যন্ত্রণা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, তখন সহ্য করতে না পেরে নিজেকে নিজে যবেহ করে ফেলে। তার প্রসঙ্গ এলে রাসূল (ছাঃ) বলতেন, إنه من أهل النار ‘নিশ্চয়ই সে জাহান্নামী’। প্রকৃত অর্থে সে ছিল একজন মুনাফিক। বংশ মর্যাদা রক্ষার উত্তেজনাই তাকে যুদ্ধে টেনে এনেছিল। এ প্রসঙ্গেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إن السيف لا يمحوا النفاق، رواه الدارمي باسناد صحيح- ‘তরবারি নিফাককে দূরীভূত করে না’।[21] অর্থাৎ শহীদ হ’লেও মুনাফেকীর পাপ দূর হয় না।
(২) হারিছ বিন সুওয়াইদ বিন ছামিত আনছারী : এ ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে মুসলমান ছিল। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সে মুনাফিক ছিল। মুসলমানদের পক্ষে সে ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করে। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে সে তার স্বপক্ষীয় মুজাযযার বিন যিয়াদ আল-বালাওয়া আনছারীকে হত্যা করে এবং মক্কায় পালিয়ে যায়। সে তাকে মেরে কুফরী অবস্থায় কোন এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল। আর এজন্য সে যুদ্ধের ময়দানকে সুযোগ হিসাবে বেছে নিয়েছিল।[22] এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেবলমাত্র আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্য ব্যতীত দেশ, জাতি, গোত্র বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে যুদ্ধকারীর পরিণতি জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নয়। রাসূলের পতাকাতলে জিহাদে শরীক হয়েও উক্ত ব্যক্তিদ্বয় জান্নাত থেকে মাহরূম হয়ে গেল নিয়তে ত্রুটি থাকার কারণে। এজন্যেই হাদীছে এসেছে, إنما الأعمال بالنيات ‘সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[23]
৩৩। উত্তম ইহুদী :
ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নিহতদের মধ্যে মুখাইরীক্ব (مخيريق) নামক মদীনার বনু নাযীর ইহুদী গোত্রের  অন্যতম আলেমকে পাওয়া গেল। যুদ্ধ চলাকালে তিনি তার গোত্রকে বলেন, يا معشر يهود والله لقد علمتم أن نصر محمد عليكم حق- ‘তোমরা জান যে, মুহাম্মাদকে সাহায্য করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য’। তারা বলল, اليوم يوم السبت ‘আজকে যে শনিবার’। তিনি বললেন, لا سبت لكم ‘তোমাদের জন্য কোন শনিবার নেই’। এই বলে তিনি তরবারি ও অন্যান্য সরঞ্জাম উঠিয়ে নিয়ে বলেন, إن أصبت فمالى لمحمد يصنع فيه ما يشاء ‘যদি আমি নিহত হই, তবে আমার মালামাল মুহাম্মাদের হবে। তিনি তা নিয়ে যা খুশী করবেন’। এরপর তিনি যুদ্ধে গিয়ে নিহত হন। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, مخيريق خير يهود ‘মুখাইরীক্ব একজন উত্তম ইহুদী ছিল’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পরিত্যক্ত সাতটি খেজুর বাগান আল্লাহর রাস্তায় ওয়াফক করে দেন এবং এটাই ছিল মদীনার প্রথম ওয়াকফ ভূমি।
৩৪। শহীদের রক্ত মিশকের ন্যায় সুগন্ধিময় :
ওহোদ যুদ্ধে নিহত শহীদগণের লাশ পরিদর্শনের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أنا شهيد على هؤلاء ‘আমি এই লোকদের ব্যাপারে সাক্ষী থাকব’। অতঃপর তিনি বলেন, مَا مِنْ جَرِيْحٍ يَجْرَحُ فِيْ اللهِ إِلاَّ وَاللهِ يَبْعَثُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَدْمَى جَرْحَهُ، اللَّوْنُ لَوْنُ الدَّمِ وَالرِّيْحُ رِيْحُ الْمِسْكِ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় আহত হয়, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উঠাবেন যে, তার ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত বইতে থাকবে। রং তো রক্তেরই হবে। কিন্তু সুগন্ধি হবে মিশকের মত’।[24]
৩৫। লেংড়া শহীদ :
আমর ইবনুল জামূহ লেংড়া ছিলেন বিধায় তার ব্যাঘ্যসম চার পুত্র জিহাদে যান ও পিতাকে বারণ করেন। কিন্তু তিনি রাসূলকে এসে বললেন, আমি যদি এই লেংড়া পায়ে যুদ্ধ করে নিহত হই, তাহ’লে কি জান্নাত পাব? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, হাঁ পাবে। কিন্তু তোমার জন্য যুদ্ধ মাফ। তখন তিনি বলে উঠলেন, فوالذى بعثك بالحق لأطأن بها الجنة اليوم إن شاء الله ‘যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, আল্লাহ চাহেন তো আজই আমি জান্নাতের বুকে চলাফেরা করতে চাই’। তিনি যুদ্ধে নামেন ও শহীদ হয়ে যান।
৩৬। শুহাদা কবর স্থান :
অনেকে শহীদদের লাশ মদীনায় স্ব স্ব বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সব লাশ ফেরত আনতে নির্দেশ দেন। অতঃপর বিনা গোসলে তাদের পরিহিত যুদ্ধ পোষাকে (বর্তমান শুহাদা কবরস্থানে) দাফন করা হয়। একটি কবরে দু’/তিনজনকে দাফন করা হয়। একটি কাপড়ে দু’জনকে কাফন পরানো হয়। অতঃপর লাহদ (اللحد) বা পাশখুলি কবর খোড়া হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করেন, أيهم أكثر أخذًا للقرآن؟ এদের মধ্যে সর্বাধিক কুরআন জানতেন কে’? লোকেরা ইঙ্গিত দিলে তিনি তাকেই আগে কবরে নামাতেন। তিনি জাবের (রাঃ)-এর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু হারাম এবং আমর ইবনুল জামূহকে এক কবরে রাখেন। কেননা তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল’।
অনুরূপ হযরত হামযা (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শকে একই কবরে রাখা হয়। কেননা তিনি ছিলেন হামযার ভাগিনা ও দুধভাই। তাদের জন্য কাফনের কাপড় যথেষ্ট না হওয়ায় মাথা ঢেকে দিয়ে পায়ের উপরে ‘ইযখির’ (الإذخر) ঘাস চাপিয়ে দেওয়া হয়। মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর কাফনের কাপড়ে কমতি হ’লে অনুরূপভাবে ইযখির ঘাস দিয়ে পা ঢাকা হয়। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, হামযার জন্য দো‘আ করার সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এত কেঁদেছিলেন যে, তাঁর স্বর উঁচু হয়ে যায় এবং আমরা তাঁকে এত কাঁদতে কখনো দেখিনি। এখানেও শহীদদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, أنا شهيد على هؤلاء يوم القيامة ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি এদের সকলের উপরে সাক্ষী হব’। এই ছহীহ বর্ণনা মতে কারু জানাযা হয়নি। তবে দাফন শেষে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান এবং আল্লাহর প্রশংসা শেষে দীর্ঘ দো‘আ করেন।[25]
৩৭। ভাইয়ের লাশ দেখতে মানা :
হযরত হামযার বোন হযরত ছাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্ত্বালিব ছুটে এসেছেন ভাইয়ের লাশ শেষবারের মত দেখার জন্য। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হযরত যুবায়েরকে বললেন, তিনি যেন তার মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি বাধা না মেনে বলেন, কেন বাধা দিচ্ছ। আমি শুনেছি, আমার ভাইয়ের নাক-কান কাটা হয়েছে। وذلك في الله ‘আর তা হয়েছে আল্লাহর পথে’। তাতে আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট রয়েছি। لأحتسبن ولأصبرن إن شاء الله ‘আমি একে পূণ্য মনে করব এবং অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করব ইনশাআল্লাহ। একথা বলার পর তিনি ভাইয়ের লাশের কাছে পৌঁছেন এবং তার জন্য দো‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
৩৮। শহীদগণের জন্য বিদায়ী দো‘আ :
দাফন শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে পিছনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে আল্লাহর প্রশংসা করেন ও তাঁর নিকটে প্রার্থনা করেন।[26] উল্লেখ্য যে, চারদিকে অনুচ্চ ও অনাড়ম্বর পাচিল দিয়ে বর্তমানে শোহাদা কবরস্থানটি ঘেরা রয়েছে। নির্দিষ্টভাবে কোন কবরের চিহ্ন সেখানে নেই।
৩৯। মদীনা ফেরার পথে মহিলাদের আকুতিপূর্ণ ঘটনা সমূহ :
(ক) হামনাহ বিনতে জাহশ : মদীনায় ফেরার সময় পথিমধ্যে হামনাহ বিনতে জাহ্শের (حمنة بنت جحش) সাথে সাক্ষাৎ হ’লে তাকে প্রথমে তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ, অতঃপর মামু হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের শাহাদাতের খবর দেওয়া হয়। উভয় খবরে তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন। এরপর তাঁকে তাঁর স্বামী মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর শাহাদাতের খবর শুনানো হ’লে তিনি চীৎকার দিয়ে ওঠেন ও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন (فصاحت وولولت)। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إن زوج المرأة منها بمكان ‘নিশ্চয়ই স্বামীর জন্য স্ত্রীর নিকটে রয়েছে এক বিশেষ মর্যাদা’। উল্লেখ্য যে, মুছ‘আবকে হত্যা করে আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ লায়ছী, যে রাসূলের উপর হামলা করেছিল ও তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হয়েছিল।
(খ) বনু দীনার গোত্রের এক মহিলাকে তার স্বামী, ভাই ও পিতার শাহাদাতের খবর শুনানো হ’লে তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাদের জন্য ইস্তিগফার করেন। অতঃপর তিনি বলেন, রাসূলের খবর কি? বলা হ’ল, তিনি ভাল আছেন যেমন তুমি চাচ্ছ হে অমুকের মা’। তখন তিনি অস্থির চিত্তে বলে উঠলেন, أرونيه حتى أنظر إليه ‘আমাকে একটু দেখিয়ে দাও, যাতে আমি স্বচক্ষে তাঁকে দেখতে পারি’। তারপর তাকে দেখিয়ে দিতেই খুশী হয়ে তিনি রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, كل مصيبة بعدك جَلَلٌ ‘আপনাকে পাওয়ার পর সব বিপদই তুচ্ছ’। এই মহিলা ছিলেন হিন্দ, যিনি লেংড়া শহীদ আমর ইবনুল জামূহ আনছারী (রাঃ)-এর স্ত্রী।[27]
(গ) আউস গোত্রের নেতা সা‘দ-এর মা দৌড়ে আসছেন। ঐ সময় তার পুত্র সা‘দ ইবনু মু‘আয রাসূলের ঘোড়ার লাগাম ধরে চলছিলেন। কাছে এলে সা‘দ বললেন, ‘হে রাসূল, ইনি আমার মা। রাসূল (ছাঃ) তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘মারহাবা’। অতঃপর তিনি থেমে যান এবং তাঁকে তার পুত্র আমর ইবনু মু‘আযের শাহাদাতের জন্য সমবেদনা জানান ও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেন। তখন উম্মে সা‘দ বলেন, أما إذ رأيتك سالمًا فقد اشتويت المصيبة- ‘যখন আমি আপনাকে নিরাপদ দেখেছি, তখন আমি সব মুছীবতকে নগণ্য মনে করেছি’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহোদ যুদ্ধের সকল শহীদের জন্য দো‘আ করেন এবং উম্মে সা‘দকে উদ্দেশ্য করে বলেন, يا ام سعد ابشري وبشرى أهلهم أن قتلاهم ترافقوا في الجنة جميعا وشفعوا في أهلهم جميعا- ‘হে উম্মে সা‘দ! সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং শহীদ পরিবারগুলিকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও যে, তাদের শহীদগণ সকলে জান্নাতে একত্রে রয়েছে এবং তাদের পরিবারবর্গের ব্যাপারে তাদের সবারই শাফা‘আত কবুল করা হবে’। উম্মে সা‘দ বললেন, رضينا يا رسول الله ومن يبكي عليهم بعد هذا؟ ‘আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপরে আর কে তাদের জন্য কান্নাকাটি করবে? অতঃপর তিনি বললেন, ادع لمن خلفوا منهم ‘হে রাসূলুল্লাহ! তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য দো‘আ করুন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করলেন,  اللهم اذهب حزن قلوبهم واجبر مصيبتهم وأحسن الخلف على من خلفوا- ‘হে আল্লাহ! তুমি তাদের অন্তরের দুঃখ দূর করে দাও। তাদের বিপদ নিরাময় করে দাও এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের উত্তমরূপে তদারকী কর’।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: বনু নাযীর যুদ্ধ


[1] বুখারী হা/৪০৬৪, ২/৫৮১
[2] বুখারী হা/৪০৭৫, ২/৫৮৪
[3] বুখারী হা/৪০৬৫, ১/৫৩৯, ২/৫৮১
[4] ইবনে হিশাম ২/৮৭-৮৮; হাকেম ৩/২০২, সনদ ছহীহ
[5] মুসলিম হা/৪৬৪১, ২/১০৭
[6] বুখারী হা/৪০৬০, ২/৫৮১, ১/৫১৭
[7] ফাৎহুল বারী ৭/৪৩২, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায়, ২৪ অনুচ্ছেদ
[8] ফাৎহুলবারী ৭/৪৩২
[9] মানছূরপুরী বলেন, এ সময় কাফেরদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার জন্য কিছু ছাহাবীর দাবীর প্রেক্ষিতে তিনি উক্ত রূপ কথা বলেন
[10] ইবনে হিশাম ২/৮৬; বুখারী হা/৪০৭৩-৭৬
[11] ইবনু হিশাম ২/৮২; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬১০৩
[12] ইবনু হিশাম ২/৮ ০; তিরমিযী, মিশকাত হা/৬১১৩
[13] বুখারী হা/৪০৫৪
[14] বুখারী ২/৫৮২
[15] ইবনু হিশাম ২/৮৬; তিরমিযী, আহমাদ মিশকাত হা/৬১১২
[16] ইবনু হিশাম ২/৮০
[17] বুখারী হা/৩৮৮১
[18] ইবনু হিশাম ২/৮২
[19] ইবনু হিশাম ২/৮২
[20] যাদুল মা‘আদ ২/৯৫
[21] দারেমী, মিশকাত হা/৩৮৫৯
[22] ইবনু হিশাম ২/৮৯
[23] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১
[24] ইবনে হিশাম ২/৯৮; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮০২ ‘জিহাদ’ অধ্যায়
[25] আহমাদ, হাকেম ৩/২৩
[26] বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৪১, সনদ হাসান ও মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৫৩১, ২২০০১, সনদ ছহীহ
[27] যুরকানী ৬/২৯০; রাহমাতুললিল আলামীন ২/৩৪৩ টীকা-১

No comments

Powered by Blogger.