বদর হ’তে ওহোদ
পূর্বের অংশ পড়ুন: রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা প্রচেষ্টা সমূহ
(২হিঃ ১৭ই রামাযান হ’তে ৩হিঃ ৭ই শাওয়াল)
বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভূতপূর্ব বিজয়ে ৪টি পক্ষ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়। মক্কার কুরায়েশরা, মদীনার ইহুদী ও মুনাফিকেরা এবং মদীনার আশপাশের নাজদ প্রভৃতি এলাকার বেদুঈনরা। যারা ছিল স্রেফ দস্যুশ্রেণী। ডাকাতি ও লুণ্ঠন ছিল যাদের পেশা। ঈমান ও কুফর কোনটির প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ ছিল না। উপরোক্ত চারটি গোষ্ঠীর প্রত্যেকেই নিশ্চিত ছিল যে, মদীনায় কোন ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হ’লে তা অবশ্যই তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। সেকারণ তারা সাধ্যমত সকল উপায়ে মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকে। এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা নিম্নে সংক্ষেপে উদ্ধৃত হ’ল-
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র : বদর যুদ্ধে গ্লানিকর পরাজয়ে এবং শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে কুরায়েশরা যখন ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহারা, তখন এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অন্যতম নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বদর যুদ্ধের সামান্য পরে একদিন কা‘বা গৃহের রুকনে হাতীমে বসে ওমায়ের বিন ওহাব আল-জামহীর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করল যে, তুমি তোমার ছেলেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে হত্যা করবে। বিনিময়ে আমি তোমার যাবতীয় ঋণ পরিশোধের ও তোমার পরিবার পালনের দায়িত্ব নিচ্ছি। উল্লেখ্য যে, ওমায়ের-এর পুত্র ওহাব বদর যুদ্ধে বন্দী হয়ে মদীনায় ছিল। দু’জনের মধ্যে এই চুক্তি হওয়ার পরে এবং তা সম্পূর্ণ গোপন রাখার শর্তে ওমায়ের বিন ওহাব ভালভাবে বিষ মাখানো একটা তরবারি নিয়ে মদীনায় গিয়ে হাযির হ’ল। হযরত ওমর (রাঃ) তাকে ঘাড় ধরে রাসূলের কাছে নিয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ছেড়ে দিতে বললেন। অতঃপর ওমায়ের তাঁর নিকটে এসে আরবদের রীতি অনুযায়ী বলল, أنعموا صباحا ‘সুপ্রভাত’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বল্লেন, আল্লাহ আমাদেরকে এর চাইতে উত্তম অভিবাদন রীতি প্রদান করেছেন অর্থাৎ সালাম, السلام عليكم যা হ’ল জান্নাতীদের অভিবাদন (ইউনুস ১০/১০)।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে তার ছেলের মুক্তির জন্য রাসূলের সহানুভূতি কামনা করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে তরবারি কেন এনেছ? সে বলল, এর ধ্বংস হৌক। এটা কি আমাদের কোন কাজে লেগেছে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বারবার সত্য কথা বলার তাকীদ দিলেও সে চেপে যায়। তখন তিনি মক্কায় তাদের দু’জনের মধ্যকার গোপন শলা-পরামর্শের কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে হতবাক হয়ে গেল। অতঃপর কলেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে উত্তম রূপে দ্বীন ও কুরআন শিখতে বললেন এবং তার ছেলেকে মুক্তি দিলেন। কিছুদিন পর সে রাসূলের অনুমতি নিয়ে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ করল এবং সেখানে তার হাতে অনেকে মুসলমান হ’ল। ছাফওয়ান শপথ করল যে, তার সঙ্গে কখনো কথা বলবে না এবং তার কোন উপকার করবে না। অবশ্য ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর ছাফওয়ান মুসলমান হয়ে যান।
(২) ইহুদী চক্রান্ত : কয়েকটি নমুনা : (ক) মক্কার কাফেরদের প্রদত্ত নানাবিধ অপবাদের ন্যায় মদীনার ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রা‘এনা (راعنا) বলে ডাকতে থাকে। আরবী ভাষায় যার অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধানকারী’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ। এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করতে চাইত। কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের হিব্রু ভাষা অনুযায়ী راعينوا অর্থাৎ شريرنا ‘আমাদের দুষ্ট ব্যক্তিটি’ অর্থ গ্রহণ করত। তাদের এই চালাকি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ পাক এটাকে নিষিদ্ধ করে ‘উনযুরনা’ (انظرنا) অর্থাৎ ‘আমাদের দেখাশুনা করুন’- লকবে ডাকতে নির্দেশ দিলেন (বাক্বারাহ ২/১০৪)।
(খ) ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেন যে, শাস বিন ক্বায়েস (شاس بن قيس) নামক জনৈক বৃদ্ধ ইহুদী মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। একদিন সে ছাহাবায়ে কেরামের একটি মজলিসের নিকট দিয়ে গমন করছিল, যেখানে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের ছাহাবী ছিলেন। দুই গোত্রের লোকদের মধ্যকার এই প্রীতিপূর্ণ বৈঠক তার নিকটে অসহ্য ছিল। কেননা উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা টিকিয়ে রেখে উভয় গোত্রের নিকটে অস্ত্র বিক্রি ও সূদ ভিত্তিক ঋণদান ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে। ইসলাম আসার পর এসব বন্ধ হয়েছে এবং তারা পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেছে। যাতে দারুণ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায় মদীনার কুসিদজীবী ইহুদী গোত্রগুলি।
ঐ বৃদ্ধ একজন যুবক ইহুদীকে উক্ত মজলিসে পাঠাল এই নির্দেশ দিয়ে যে, সে যেন সেখানে গিয়ে উভয় গোত্রের মধ্যে ইতিপূর্বে সংঘটিত বু‘আছ (بعاث) যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হ’তে যেসব বিদ্বেষমূলক ও আক্রমণাত্মক কবিতা সমূহ পঠিত হ’ত, তা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। যুবকটি যথারীতি তাই-ই করল এবং উভয় গোত্রীয় ছাহাবীদের মধ্যে লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরী হয়ে গেল। এমনকি উভয় পক্ষ ‘হার্রাহ’ (الحرة) নামক স্থানের দিকে ‘অস্ত্র অস্ত্র’ (السلاح السلاح) বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
এ খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন মুহাজির ছাহাবীকে সাথে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হ’লেন এবং সবাইকে শান্ত করলেন। তখন সবাই বুঝলেন যে, এটি শয়তানী প্ররোচনা (نزغة من الشيطان) ব্যতীত কিছুই নয়। তারা তওবা করলেন ও পরস্পরে বুক মিলিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। এভাবে শাস বিন ক্বায়েস ইহুদী শয়তানের জ্বালানো আগুন দ্রুত নিভে গেল।
(গ) ২য় হিজরীর ১৫ শাওয়াল বনু ক্বায়নুক্বার দুর্গ অবরোধ : মদীনার তিনটি ইহুদী গোত্র বনু নাযীর, বনু কুরায়যা ও বনু ক্বায়নুক্বা। এদের মধ্যে শেষোক্তটি ছিল সর্বাধিক শক্তিশালী, সম্পদশালী ও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ। বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানাবিধ কষ্টদায়ক ও বিদ্রূপাত্মক আচরণ শুরু করে। এমনকি মুসলিম মহিলাদের নিয়েও তারা উপহাস করতে কসুর করত না। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং একদিন তাদের বাজারে উপস্থিত হ’লেন ও তাদের ডেকে নানাভাবে উপদেশ দিলেন। অবশেষে বললেন, يا معشر اليهود اسلموا قبل أن يصيبكم مثل ما اصاب قريشا- ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা অনুগত হও কুরায়েশদের ন্যায় অবস্থাপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই’। এতে তারা উত্তেজিত হয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কিছু কুরায়েশকে হত্যা করে ধোঁকায় পড়ো না। ওরা আনাড়ী। ওরা যুদ্ধবিদ্যার কিছুই জানে না। যদি তুমি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, তবে তুমি আমাদের মত কাউকে পাবে না’। এরূপ কথা শুনেও পূর্বের সন্ধিচুক্তির কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সংযত রইলেন।
এরপর থেকে তারা চক্রান্ত ও হাঙ্গামার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং একদিন তারা এমন এক কান্ড ঘটিয়ে বসে যা উভয় পক্ষের সংঘাতকে অপরিহার্য করে তোলে।-
এরপর থেকে তারা চক্রান্ত ও হাঙ্গামার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং একদিন তারা এমন এক কান্ড ঘটিয়ে বসে যা উভয় পক্ষের সংঘাতকে অপরিহার্য করে তোলে।-
আবু আওন সূত্রে ইবনে হেশাম বর্ণনা করেন যে, একদিন জনৈকা মুসলিম মহিলা বনু ক্বায়নুক্বার বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এক ইহুদী স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে বসেন। তখন কতগুলো দুষ্টমতি ইহুদী তার মুখের অবগুণ্ঠন খুলতে চায়। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তখন ঐ স্বর্ণকার ঐ মহিলার অগোচরে তার কাপড়ের এক প্রান্ত তার পিঠের উপরে গিরা দেয়। কাজ শেষে মহিলা উঠে দাঁড়াতেই কাপড়ে টান পড়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। দুবৃত্তরা তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এতে মহিলাটি লজ্জায় ও ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠেন। এমতাবস্থায় একজন মুসলমান ঐ স্বর্ণকারের উপরে লাফিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলেন। প্রত্যুত্তরে এক ইহুদী ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলমানটিকে হত্যা করে। ফলে সন্ধি ভঙ্গ হয় এবং সংঘাত বেধে যায়। ২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল শনিবারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সসৈন্যে তাদের দুর্গ অবরোধ করেন ও দু’সপ্তাহ অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর তিনি তাদেরকে মদীনা হ’তে চিরদিনের মত বিতাড়িত করেন। তারা সিরিয়া অঞ্চলে হিজরত করে এবং কিছু দিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সেখানে মৃত্যু বরণ করে।
(ঘ) ৩য় হিজরীর ১৪ই রবীউল আউয়াল; কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ড : কা‘ব বিন আশরাফ ছিল একজন খ্যাতনামা ইহুদী পুঁজিপতি, কবি ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তার দুর্গটি ছিল মদীনার পূর্ব-দক্ষিণে দু’মাইল দূরে বনু নাযীর গোত্রের পশ্চাদভূমিতে। বদর যুদ্ধে কুরায়েশ নেতাদের চরম পরাজয়ে সে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়তে থাকে এবং রাসূলের ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে ও কুরায়েশ নেতাদের প্রশংসা করে কবিতা বলতে থাকে। কিন্তু তাতে তার ক্ষোভের আগুন প্রশমিত না হওয়ায় সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশ নেতাদের কবিতার মাধ্যমে উত্তেজিত করতে থাকে। সে যুগে কবিতাই ছিল সাহিত্যের বাহন এবং কারু প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করার প্রধান হাতিয়ার। কোন বংশে কোন কবি জন্মগ্রহণ করলে সে বংশ তাকে নিয়ে গর্ব করত এবং তাকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হ’ত। আবু সুফিয়ান এবং মক্কার নেতারা তাকে জিজ্ঞেস করলأديننا أحب إليك أم دين محمد وأصحابه وأي الفريقين أهدى سبيلا؟ ‘আমাদের দ্বীন তোমার নিকটে অধিক প্রিয় না মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দ্বীন? এবং এ দু’টি দলের মধ্যে কোন দলটি অধিক সুপথপ্রাপ্ত? সে বলল, أنتم أهدى منهم سبيلا وأفضل ‘তোমরাই তাদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত ও উত্তম’। এ প্রসঙ্গে সূরা নিসা ৫১ আয়াতটি নাযিল হয়। এরপর সে মদীনা ফিরে এসে একই রূপ আচরণ করতে থাকে। এমনকি ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা রটনা করতে থাকে ও নানাবিধ ব্যঙ্গাত্মক কবিতা বলতে থাকে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, من لكعب بن الأشرف فإنه أذى الله ورسوله- ‘কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে আছ? কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে’। তখন আউস গোত্রের মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহর নেতৃত্বে আববাছ বিন বিশর ও কা‘ব বিন আশরাফের দুধভাই আবু নায়েলাহ সহ পাঁচ জন প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। দলনেতা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ কার্য সিদ্ধির জন্য কিছু প্রতারণামূলক কথা ও কাজের আশ্রয় নেবার অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে অনুমতি দেন।
সে মোতাবেক প্রথমে মুহাম্মাদ ও পরে আবু নায়েলা কা‘বের কাছে গিয়ে রাসূলের বিরুদ্ধে অনেক কথার মধ্যে একথাও বলল যে, এ লোক আমাদেরকে দারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। এই ব্যক্তি আমাদের কাছে ছাদাক্বাহ চাচ্ছে। আমরা আমাদের পরিবার-পরিজনের কষ্ট নিবারণের জন্য আপনার নিকটে কিছু খাদ্য-শস্য কামনা করছি। কা‘ব কিছু বন্ধকের বিনিময়ে দিতে রাযী হ’ল। প্রথমে নারী বন্ধক, অতঃপর পুত্র বন্ধক, অবশেষে অস্ত্র বন্ধকের ব্যাপারে নিষ্পত্তি হ’ল। আবু নায়েলাহ বলল, আমারই মত কষ্টে আমার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আছে। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসব। আপনি তাদেরও কিছু খাদ্য-শস্য দিয়ে অনুগ্রহ করুন। অতঃপর পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখের চাঁদনী রাতে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ তার দলবল নিয়ে কা‘বের বাড়ীতে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বাকী‘এ গারক্বাদ পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং বলেন, انطلقوا على اسم الله اللهم أعنهم- ‘আল্লাহর নামে অগ্রসর হও। হে আল্লাহ তুমি এদের সাহায্য কর’। অতঃপর তিনি বাড়ী ফিরে এসে ছালাত ও দো‘আয় রত হ’লেন।
দুধভাই আবু নায়েলাহ কা‘বের দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে ডাক দিল। এ সময় কা‘বের নববধূ তাকে বাধা দিয়ে বলল, أسمع صوتا كأنه يقطر منه الدم ‘আমি এমন এক ডাক শুনলাম, মনে হ’ল তা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে’। কিন্তু কা‘ব কোনরূপ সন্দেহ না করে বলল, এরা তো আমার ভাই। তাছাড়া إن الكريم لو دعى إلى طعنة أجاب- ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যদি তরবারির দিকেও আহুত হন, তথাপি তিনি তাতে সাড়া দিয়ে থাকেন’। অতঃপর সে বেরিয়ে এলো। তারপর সকলে মিলে কিছু দূর এগিয়ে যেতেই পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তাকে শেষ করে ফেলা হ’ল।
কাজ সেরে তার মাথা নিয়ে বাক্বীয়ে গারক্বাদে ফিরে এসে তারা জোরে তাকবীর ধ্বনি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাকবীর ধ্বনি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং খুশী হয়ে বলেন, أفلحت الوجوه ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’। তারাও বললেন, ووجهك يا رسول الله ‘এবং আপনার চেহারাও হে আল্লাহর রাসূল’! এ সময় ঐ দুষ্টের কাটা মাথাটা তার সামনে রাখা হ’লে তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করেন।
কা‘ব বিন আশরাফকে গোপনে হত্যা করায় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের স্বার্থে এরূপ দুশমনকে গুপ্তহত্যা করা চলে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী ও অপপ্রচারকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। মুসলিম মহিলাদের ইয্যত নিয়ে কুৎসা রটনাকারীদের জন্য একই শাস্তি নির্ধারিত। এই ধরনের দুশমন নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন বোধে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া যাবে। তবে এ ধরনের সবকিছুতে সর্বোচ্চ সরকারী নির্দেশ আবশ্যিক হবে। এককভাবে কারু জন্য এরূপ করা সিদ্ধ নয়।[1]
বদর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়, ‘সাভীক্ব’ যুদ্ধে ছাতুর বস্তাসহ অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম ফেলে আবু সুফিয়ানের জান নিয়ে পালিয়ে আসার গ্লানিকর তিক্ত অভিজ্ঞতা ও সবশেষে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে মদীনার পথ ছেড়ে নাজদের পথ ধরে সিরিয়া যাত্রী কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লুট হওয়া এবং দলনেতা ছাফওয়ানের কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার লজ্জাষ্কর পরিণতির প্রেক্ষাপটে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের সাথে কালবিলম্ব না করে একটা চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে বদর যুদ্ধে নিহত নেতা আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা, উৎবাহর ভাই আব্দল্লাহ ও সাভীক যুদ্ধে পালিয়ে আসা আবু সুফিয়ান এবং সর্বশেষ বাণিজ্য কাফেলা ফেলে পালিয়ে আসা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধের পুঁজি : বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে বিবেচিত কুরাইশের যে বাণিজ্য কাফেলা আবু সুফিয়ান স্বীয় বুদ্ধিবলে মুসলিম বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলের, সেই বাণিজ্য সম্ভারের সবটুকুই মালের মালিকদের সম্মতিক্রমে ওহোদ যুদ্ধের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। যার বিক্রয়লব্ধ মাল ও অর্থের পরিমাণ ছিল ১,০০০ উট ও ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা। এ প্রসঙ্গে সূরা আনফাল ৩৬ আয়াতটি নাযিল হয়। যাতে বলা হয়, إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنْفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُوْنَ- আল্লাহর রাস্তা হ’তে লোকদের ফিরানোর জন্য কাফেররা যত ধনসম্পদ ব্যয় করুক না কেন, সবই ওদের মনস্তাপের কারণ হবে। ওরা পরাভূত হবে। অতঃপর কাফেররা জাহান্নামে একত্রিত হবে’ (আনফাল ৮/৩৬)।
মাক্কীদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি : মুসলিম শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য তারা সাধারণ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে দিল যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক বেদুঈন, কেনানা ও তেহামার অধিবাসীদের মধ্যকার যেকোন ব্যক্তি যেন এই যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীতে শরীক হয়। লোকদের উত্তেজিত ও উৎসাহিত করার জন্য দু’জন কবি আবু ‘ইযযা (أبو عزة) এবং মুসাফে‘ বিন আবদে মানাফ আল-জুমাহী (مُسافع بن عبد مناف الْجُمَحِي) -কে কাজে লাগানো হয়। প্রথমজন বদরযুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। পরে রাসূলের বিরোধিতা করবে না, এই শর্তে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি লাভ করে। তাকে গোত্রনেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসলে তাকে ধনবান করে দেবেন। অন্যথায় তার কন্যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন’। উক্ত দুই কবি অর্থ-সম্পদের লোভে সর্বত্র যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আসতেই মক্কায় তিন হাযার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দার নেতৃত্বে ১৫ জন মহিলাকেও সঙ্গে নেওয়া হ’ল, যাতে তাদের দেওয়া উৎসাহে সৈন্যরা অধিক উৎসাহিত হয় এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সৈন্যরা জীবনপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়। অতঃপর যুদ্ধ সম্ভারের মধ্যে ছিল বাহন হিসাবে ৩০০০ উট, ২০০ যুদ্ধাশ্ব এবং ৭০০ লৌহবর্ম। খালেদ ইবনু ওয়ালীদ ও ইকরিমা বিন আবু জাহলকে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক করা হয়। আবু সুফিয়ান হ’লেন পুরা বাহিনীর অধিনায়ক এবং যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করা হয় প্রথা অনুযায়ী বনু আব্দিদ্দার গোত্রের হাতে।
মদীনায় সংবাদ প্রাপ্তি :
কুরায়েশ নেতাদের এই ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততির খবর রাসূলের চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (যিনি তখনো প্রকাশ্যে মুসলমান হননি) একজন বিশ্বস্ত পত্রবাহকের মাধ্যমে দ্রুত মদীনায় পাঠিয়ে দেন এবং তাতে তিনি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন। ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র তিনদিনে অতিক্রম করে পত্রবাহক সরাসরি গিয়ে রাসূলের হাতে পত্রটি পৌঁছে দেয়। তিনি তখন ক্বোবায় অবস্থান করছিলেন। হযরত উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) পত্রটি রাসূল (ছাঃ)-কে পাঠ করে শুনান। তিনি কা‘বকে পত্র প্রাপ্তির বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন ও দ্রুত মদীনায় এসে মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠকে বসেন। অন্যদিকে মদীনার চারপাশে পাহারা দাঁড় করানো হ’ল। স্বয়ং রাসূলের দ্বাররক্ষী হিসাবে রাত্রি জেগে পাহারা দেবার জন্য আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয, খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ এবং উসায়েদ বিন হুযায়ের প্রমুখ আনছার নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে নিয়োজিত করলেন। চারদিকে গোয়েন্দা প্রেরণ করা হ’ল মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর নেওয়ার জন্য। গোয়েন্দাগণ মুহূর্তে মুহূর্তে রাসূলের নিকটে তাদের খবর পৌঁছে দিতে থাকেন।
পরামর্শ বৈঠকের বিবরণ : মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের উক্ত পরামর্শ বৈঠকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে নিজের দেখা একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, إني قد رأيت والله خيرًا، ‘আল্লাহর কসম! আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি’। আমি দেখি যে, কতগুলি গরু যবেহ করা হচ্ছে। দেখি যে, আমার তরবারির মাথায় কিছুটা ভগ্নদশা। আরো দেখি যে, আমার হাতখানা একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছি’। এর ব্যাখ্যা এই হ’তে পারে যে, আমার কিছু ছাহাবী এ যুদ্ধে নিহত হবে। তরবারির মাথা ভাঙ্গার অর্থ আমার পরিবারের কেউ নিহত হবেন। আর সুরক্ষিত বর্ম অর্থ মদীনা সুরক্ষিত থাকবে।
অতঃপর যুদ্ধ কৌশল হিসাবে তিনি প্রথমে নিজের মত প্রকাশ করে বলেন, নগরীর অভ্যন্তরে থেকেই যুদ্ধ করা সমীচীন হবে। কেননা চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত হওয়ার কারণে আমরা সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে আছি (إنا فى جُنَّة حصينة)।’ খাযরাজ গোত্রের অন্যতম প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ বিন উবাই (মুনাফিক সর্দার) সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের এ মত সমর্থন করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে, এতে আমাদের পুরুষেরা তাদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করবে এবং আমাদের মেয়েরা ও বালকেরা বাড়ীর ছাদের উপর থেকে ওদেরকে পাথর ছুঁড়ে মারবে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি মদীনাতেই থাকুন। বের হবেন না। আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই শত্রুদের দিকে বের হব না। তাহ’লে তারা আমাদের কাবু করে ফেলবে’।[2] এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ না করা এবং শত্রুদের জিতিয়ে দেওয়া। অথচ কেউ যেন সেটা বুঝতে না পারে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া এবং সর্বসমক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাওয়া।
অতঃপর যুদ্ধ কৌশল হিসাবে তিনি প্রথমে নিজের মত প্রকাশ করে বলেন, নগরীর অভ্যন্তরে থেকেই যুদ্ধ করা সমীচীন হবে। কেননা চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত হওয়ার কারণে আমরা সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে আছি (إنا فى جُنَّة حصينة)।’ খাযরাজ গোত্রের অন্যতম প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ বিন উবাই (মুনাফিক সর্দার) সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের এ মত সমর্থন করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে, এতে আমাদের পুরুষেরা তাদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করবে এবং আমাদের মেয়েরা ও বালকেরা বাড়ীর ছাদের উপর থেকে ওদেরকে পাথর ছুঁড়ে মারবে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি মদীনাতেই থাকুন। বের হবেন না। আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই শত্রুদের দিকে বের হব না। তাহ’লে তারা আমাদের কাবু করে ফেলবে’।[2] এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ না করা এবং শত্রুদের জিতিয়ে দেওয়া। অথচ কেউ যেন সেটা বুঝতে না পারে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া এবং সর্বসমক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাওয়া।
এতে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, কপট সাথীরা সর্বদা নেতার মতের সাথে জী হুযুর বলে থাকে। পক্ষান্তরে নেতার শুভাকাংখীরা সর্বদা সতর্কভাবে নেতাকে সুপরামর্শ দেয়। তাতে তাদের নিজেদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও তারা নেতা ও সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
অতঃপর উপরোক্ত প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত তলব করলে একদল বুযর্গ ছাহাবী (جماعة من فضلاء الصحابة) , বিশেষ করে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, তাঁরা দ্রুত বলে উঠলেন, হে রাসূল! আমরা তো এদিনের অপেক্ষাতেই ছিলাম এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করছিলাম। আজ সেটা আমাদের কাছে এসে গেছে এবং অতীব নিকটবর্তী হয়েছে। অতএব اخرُج إلى أعدائنا، لا يرون أنَّا جَبُنَّا عنهم وضَعُفنا- ‘আপনি শত্রুদের দিকে বের হউন। যাতে তারা আমাদেরকে কাপুরুষ ও দুর্বল বলে ধারণা করতে না পারে’। রাসূলের চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, যিনি বদর যুদ্ধে নিজের তরবারির চমক দেখিয়েছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, والذى أنزل عليك الكتاب لا اطعم طعاما حتى أجالدهم بسيفي خارج المدينة ‘সেই সত্তার কসম! যিনি আপনার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন। আমি খাদ্য গ্রহণ করব না, যতক্ষণ না আমি মদীনার বাইরে গিয়ে আমার তরবারি দ্বারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব’। আনছারদের বাকী প্রায় সবাই বললেন, আমরা জাহেলী যুগে বাইরে গিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করতাম। এখন ইসলামী যুগে আমরা বাইরে গিয়ে মুকাবিলার অধিক হকদার। অতএব শত্রুদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাঁর পূর্বমত পরিবর্তন করলেন এবং অধিকাংশের মত অনুযায়ী (رأي الأغلبية) মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর একটি জানাযা শেষে পোষাক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এতে ছাহাবীগণ লজ্জিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে বাধ্য করতে চাই না। আপনি চাইলে মদীনাতে থেকেই যুদ্ধ করুন। কিন্তু তিনি বললেন, কোন নবীর জন্য এটা সঙ্গত নয় যে, যুদ্ধের পোষাক পরিধানের পর তা খুলে ফেলেন’। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বৈষয়িক ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া আমীরের জন্য সঙ্গত। এর পরেও তাঁকে বাধ্য করা যাবে না। বরং তাঁর সিদ্ধান্ত সকলকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। তবে বিধানগত বিষয়ে অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া বৈধ নয়’ (আন‘আম ১১৫-১১৬)।
মাক্কী বাহিনীর অবস্থান ও শ্রেণীবিন্যাস :
মাক্কী বাহিনী মহা সমারোহে বিনা বাধায় বুক ফুলিয়ে এসে মদীনার দ্বারপ্রান্তে ওহোদ পাহাড়ের সন্নিকটে মদীনার উত্তরে ‘আয়নায়েন’ (عينين) নামক স্থানে শিবির সন্নিবেশ করে। আসার পথে মদীনার উপকণ্ঠে ‘আবওয়া’ (الأبواء) নামক স্থানে পৌঁছলে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ রাসূলের আম্মা বিবি আমেনার কবর উৎপাটন করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এর ভয়ংকর পরিণতির কথা চিন্তা করে। এভাবে মাক্কী বাহিনী মদীনায় পৌঁছে যায় ৩য় হিজরীর ৬ই শাওয়াল শুক্রবার তারিখে। তাদের ডান বাহুর অধিনায়ক ছিলেন খালেদ ইবনু ওয়ালীদ এবং বাম বাহুর অধিনায়ক ছিলেন ইকরিমা বিন আবু জাহল। তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী‘আহ এবং পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন ছাফওয়ান ইবনু উমাইয়া। আবু সুফিয়ান ছিলেন সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মধ্যভাগে অবস্থান নেন।
ইসলামী বাহিনীর বিন্যাস ও অগ্রযাত্রা :
দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে মাক্কী বাহিনীর যাবতীয় খবর রাসূলের নিকটে পৌঁছে যায়। তিনি তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ত্বরিৎ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ৬ই শাওয়াল শুক্রবার বাদ আছর রওয়ানা করেন। ইতিপূর্বে তিনি জুম‘আর খুৎবায় লোকদেরকে ধৈর্য ও দৃঢ়তার উপদেশ দেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাত লাভের সুসংবাদ শুনান। অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমকে তিনি মদীনার দায়িত্বে রেখে যান, যাতে তিনি মসজিদে ছালাতের ইমামতি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর এক হাযার ফৌজকে মুহাজির, আউস ও খাযরাজ- তিন বাহিনীতে ভাগ করেন। ঐ দিন যুদ্ধের পতাকা ছিল কালো রংয়ের। তিনি মুহাজির বাহিনীর পতাকা দেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর হাতে। তিনি শহীদ হবার পর দেন আলী (রাঃ)-এর হাতে। আউসদের পতাকা দেন উসায়েদ বিন হুযায়ের-এর হাতে এবং খাযরাজদের পতাকা দেন হাবাব ইবনুল মুনযির-এর হাতে। এক হাযারের মধ্যে ১০০ ছিলেন বর্ম পরিহিত। রাসূল (ছাঃ) উপরে ও নীচে দু’টি লৌহবর্ম পরিধান করেন। অশ্বারোহী কেউ ছিলেন কি-না এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
আল্লাহ তাঁকে শত্রু থেকে রক্ষা করবেন (মায়েদাহ ৬৭) এটা জেনেও তিনি এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন স্বীয় উম্মতকে এটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, সকল কাজে দুনিয়াবী রক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করতে হবে।
আল্লাহ তাঁকে শত্রু থেকে রক্ষা করবেন (মায়েদাহ ৬৭) এটা জেনেও তিনি এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন স্বীয় উম্মতকে এটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, সকল কাজে দুনিয়াবী রক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করতে হবে।
মদীনা থেকে বাদ আছর আউস ও খাযরাজ নেতা দুই সা‘দকে সামনে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে ‘শায়খান’ (الشيخان) নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় সেনাবাহিনী পরিদর্শন করেন। বয়সে কম ও অনুপযুক্ত বিবেচনা করে তিনি দশজনকে বাদ দেন। এরা ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন ওমর, উসামাহ বিন যায়েদ, উসায়েদ বিন যুহায়ের, (أسيد بن ظهير) যায়েদ বিন ছাবেত, যায়েদ বিন আরক্বাম, আরাবাহ বিন আউস (عرابة بن اوس) , আমর ইবনু হাযম, আবু সাঈদ খুদরী, যায়েদ বিন হারেছাহ আনছারী এবং সা‘দ ইবনু হিববাহ (سعد بن حبة)। ১৫ বছর বয়স উত্তীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও রাফে‘ বিন খাদীজ এবং সামুরাহ বিন জুনদুবকে নেওয়া হয়। এর কারণ ছিল এই যে, দক্ষ তীরন্দায হিসাবে রাফে‘ বিন খাদীজকে নিলে সামুরাহ বলে উঠে যে, আমি রাফে‘ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। আমি তাকে কুস্তিতে হারিয়ে দিতে পারি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুযোগ দিলে সত্য সত্যই তিনি কুস্তিতে জিতে যান। ফলে দু’জনেই যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি পান।[3] এর মাধ্যমে জিহাদ ও শাহাদাতের প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ পরিমাপ করা যায় এবং এটাও প্রমাণিত হয় যে, জিহাদের জন্য কেবল আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং দৈহিক শক্তি এবং আনুষঙ্গিক প্রস্ত্ততি আবশ্যক।
ইতিপূর্বে ছানিয়াতুল বিদা‘ (ثنية الوداع) পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী দেখতে পেয়ে তাদের সম্পর্কে জানতে চান। সাথীরা বললেন যে, ওরা আমাদের পক্ষে যুদ্ধে যাবার জন্য বেরিয়েছে। ওরা খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনু ক্বায়নুক্বার ইহুদী। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেন (فأبى أن يستعين بأهل الكفر على أهل الشرك)। এখানে কুরায়েশকে মুশরিক এবং ইহুদীদেরকে তিনি ‘কাফের’ বলে অভিহিত করেন। অবশ্য কুরআনে কুরায়েশ দলকে ‘কাফির’ বলা হয়েছে’ (আনফাল ৩৬)। মূলতঃ শেষনবীকে অস্বীকার করায় দু’টি দলই কাফের। আর পরিণতির দিক দিয়ে কাফির ও মুশরিক সমান।
শায়খানে সন্ধ্যা নেমে আসায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করেন। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জনকে পাহারায় রেখে বাকী সবাই ঘুমিয়ে যান। শেষ রাতে ফজরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাহিনীসহ আবার চলতে শুরু করেন এবং শাওত্ব (الشوط) নামক স্থানে পৌঁছে ফজর ছালাত আদায় করেন। এখান থেকে মাক্কী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কুরায়েশ বাহিনী দেখে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই ৩০০ জনকে অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সেনা দলকে ফিরিয়ে নিয়ে এই কথা বলতে বলতে চলে গেল যে, ما ندري علام نقتل أنفسنا ‘জানি না আমরা কিসের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি’? তারপর সে এ যুক্তি পেশ করল যে, إن الرسول صلى الله عليه وسلم ترك رأيه وأطاع غيره- ‘রাসূল (ছাঃ) তার কথা পরিত্যাগ করেছেন ও অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন’। অর্থাৎ তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেননি। অথচ এখানে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীতে ফাটল সৃষ্টি করা, যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আগ্রাসী বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে তার নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী খতম হয়ে যাবে ও তার জন্য পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইসলামী সংগঠনে ফাটল সৃষ্টিকারী মুনাফিক ও সুবিধাবাদী নেতাদের চরিত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরূপই হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের পশ্চাদপসারণ দেখে আউস গোত্রের মধ্যে বনু হারিছাহ এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বনু সালামারও পদস্খলন ঘটবার উপক্রম হয়েছিল এবং তারাও মদীনায় ফিরে যাবার চিন্তা করছিল। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাদের চিত্ত চাঞ্চল্য দূরীভূত হয় এবং তারা যুদ্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। এ দু’টি দলের প্রতি ইঙ্গিত করেই সূরা আলে ইমরান ১২২ আয়াত নাযিল হয়, إِذْ هَمَّت طَّآئِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلاَ وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ- ‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ ছিলেন তাদের অভিভাবক। অতএব আল্লাহর উপরেই যেন বিশ্বাসীগণ নির্ভর করে’ (আলে ইমরান ৩/১২২)। এ সময় মুনাফিকদের ফিরানোর জন্য হযরত জাবিরের পিতা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারাম তাদের পিছে পিছে চলতে থাকেন ও বলতে থাকেন যে, تعالوا قاتلوا في سبيل الله أو ادفعوا- ‘এসো আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর’। কিন্তু তারা বলল, لو نعلم أنكم تقاتلون لم نرجع ‘যদি আমরা জানতাম যে, তোমরা প্রকৃতই যুদ্ধ করবে, তাহ’লে আমরা ফিরে যেতাম না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ তাদের বলেন, أبعدكم الله أعداء الله، فسيغني الله عنكم نبيه- ‘দূর হ আল্লাহর শত্রুরা। সত্বর আল্লাহ তাঁর নবীকে তোদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করবেন’। এ প্রসঙ্গেই সূরা আলে ইমরান ১৬৬-৬৭ আয়াত নাযিল হয় যেখানে বলা হয়, وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ، وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُواْ، ‘এর দ্বারা তিনি মুমিনদের বাস্তবে জেনে নেন’ ‘এবং মুনাফিকদেরও জেনে নেন’ (আলে ইমরান ৩/১৬৬-৬৭)। অর্থাৎ মুনাফিকদের উক্ত জওয়াব ছিল কেবল মুখের। ওটা তাদের অন্তরের কথা ছিল না। এভাবেই আল্লাহ মুসলিম সেনাদলকে ইহুদী ও মুনাফিক থেকে মুক্ত করে নেন এবং অবশিষ্ট প্রায় ৭০০ সেনাদল নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওহোদের দিকে অগ্রসর হন। এ সময় এক অন্ধ মুনাফিক মারবা‘ ইবনু ক্বাইযী (مربع بن قيظي) -এর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে গেলে সে মুসলিম বাহিনীর মুখের দিকে ধূলো ছুঁড়ে মেরে রাসূলের উদ্দেশ্যে বলে, তুমি যদি সত্যিকারের রাসূল হও, তবে তোমার জন্য আমার এ বাগানে প্রবেশ করার অনুমতি নেই’। মুসলিম সেনারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হ’লে রাসূল (ছাঃ) তাদের নিষেধ করে বলেন, ওকে হত্যা করো না। هذا أعمى القلب و أعمى البصر ‘সে অন্তরেও অন্ধ, চোখেও অন্ধ’।
এখানে দু’টো জিনিষ বুঝা যায় যে, ইসলামী জিহাদের প্রয়োজনে যেকোন জনপদ অতিক্রম করা যায়। এজন্য কারু অনুমতির প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়তঃ কাউকে হত্যা করা যাবে না। যতক্ষণ না সে অস্ত্র ধারণ করে হত্যায় উদ্যত হয়।
ইসলামী বাহিনীর শিবির সন্নিবেশ ও শ্রেণীবিন্যাস :
অতঃপর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করেন ও সেখানে শিবির স্থাপন করেন। শত্রু সেনারা যাতে পিছন দিক হ’তে হামলা করতে না পারে, সেজন্য তিনি পূর্ব-দক্ষিণের সংকীর্ণ ও স্বল্পোচ্চ গিরিপথে আউস গোত্রের বদরী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি তীরন্দায দলকে নিযুক্ত করেন। যে স্থানটি এখন ‘জাবালুর রুমাত’ (جبل الرماة) বা তীরন্দাযদের পাহাড় বলে পরিচিত। তাদেরকে বলে দেওয়া হয় যে, জয় বা পরাজয় যাই-ই হৌক না কেন, তারা যেন নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ঐ স্থান পরিত্যাগ না করে এবং শত্রুপক্ষ যেন কোনভাবেই এপথ দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। এমনকি আমাদের মৃত লাশে যদি পক্ষীকূল ছোঁ মারতে থাকে, তথাপি তোমরা উক্ত স্থান পরিত্যাগ করবে না। অথবা আমরা বিজয়ী হয়ে যদি গণীমত কুড়াতে থাকি, তথাপি তোমরা তাতে শরীক হবে না’। فلا تبرحوا حتى أرسل إليكم ‘অতএব তোমরা হটবে না, যতক্ষণ না আমরা তোমাদের ডেকে পাঠাই’।[4] কেননা শত্রুপক্ষ পরাজিত হ’লে কেবলমাত্র এপথেই তাদের পুনরায় হামলা করার আশংকা ছিল। দূরদর্শী সেনাপতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই তাদেরকে এমন কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করেন। তিনি পাহাড়কে আড়াল করে পিছন ও দক্ষিণ বাহুকে নিরাপদ করেন। আর যে গিরিপথ দিয়ে শত্রুপক্ষের প্রবেশের আশংকা ছিল, সেপথটি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। আর শিবির স্থাপনের জন্য একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। যাতে পরাজিত হ’লেও শত্রুপক্ষ সেখানে পৌঁছতে না পারে এবং তেমন কোন ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে তিনি শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর তিনি মুনযির বিন ‘আমরকে ডান পার্শ্বের এবং যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামকে বাম পার্শ্বের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদকে তার সহকারী নিয়োগ করেন। বাম বাহুর প্রধান দায়িত্ব ছিল কুরায়েশ অশ্বারোহী বাহিনী ও তাদের অধিনায়ক খালেদ বিন ওয়ালীদকে ঠেকানো। তিনি বড় বড় যোদ্ধাগণকে সম্মুখ বাহিনীতে রাখেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নয়জন দেহরক্ষী নিয়ে পিছনে অবস্থান নেন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকেন।
কুরায়েশদের রাজনৈতিক চাল :
(১) যুদ্ধ শুরুর কিছু পূর্বে আবু সুফিয়ান আনছারদের কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান যে, তোমরা আমাদের ও আমাদের স্বগোত্রীয়দের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের থেকে সরে আসব। তোমাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই’। কিন্তু আনছারগণ তাদের কূটচাল বুঝতে পেরে ভীষণভাবে তিরষ্কার করে বিদায় করলেন।
(২) প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কুরায়েশ পক্ষ দ্বিতীয় পন্থা গ্রহণ করল। ইসলামের পূর্বে আউস গোত্রের অন্যতম নেতা ও পুরোহিত ছিল ‘আবু আমের’ আর-রাহিব। আউস গোত্র ইসলাম কবুল করলে সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশদের সঙ্গে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তার ধারণা ছিল যে, সে ময়দানে উপস্থিত হ’লে আনছাররা ফিরে যাবে। সেমতে সে ময়দানে এসে আনছারদের উদ্দেশ্যে উচ্চকণ্ঠে ডাক দিয়ে তাদেরকে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হ’ল না। সংখ্যার আধিক্য ও সরঞ্জামের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের ব্যাপারে কুরায়েশরা কিরূপ ভীত ছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তা কিছুটা অাঁচ করা যায়।
উল্লেখ্য যে, রাসূলের মদীনায় হিজরতের দিন থেকে হুনায়েন যুদ্ধ পর্যন্ত সকল রণাঙ্গনে আবু আমের আর-রাহিব মুসলমানদের বিরুদ্ধে অংশ নেয়। সেই-ই ওহোদের যুদ্ধে গোপনে গর্ত খুঁড়ে রাখে। যাতে পড়ে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আহত হন এবং তিনি মারা গেছেন বলে রটিয়ে দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালানো হয়। তারই চক্রান্তে ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারই প্ররোচনায় রোম সম্রাট সরাসরি মদীনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা নেন। যা প্রতিরোধ করার জন্য প্রচন্ড দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যেও রাসূলকে রোম সীমান্ত অভিমুখে ৯ম হিজরীতে অভিযান চালাতে হয়। যা ‘তাবূক অভিযান’ নামে পরিচিত। অবশেষে সে খৃষ্টানদের কেন্দ্রস্থল সিরিয়ায় আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। অথচ তার পুত্র হানযালা ছিলেন বিখ্যাত ছাহাবী এবং ওহোদ যুদ্ধের খ্যাতিমান শহীদ ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’।
ইতিমধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহর নেতৃত্বে কুরায়েশ মহিলারা বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে নিজেদের সৈন্যদের উত্তেজিত করে তুলল। এক পর্যায়ে তারা গেয়ে উঠল,
إنْ تُقْبِلوا نُعانِقْ + ونَفْرِشُ النَّمارق
او تُدْبِروا نُفارِقْ + فِراقَ غيرَ وَامِق
او تُدْبِروا نُفارِقْ + فِراقَ غيرَ وَامِق
‘যদি তোমরা অগ্রসর হও, তবে আমরা তোমাদের আলিঙ্গন করব ও তোমাদের জন্য শয্যা রচনা করব’। ‘আর যদি তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো, তবে আমরা পৃথক হয়ে যাব তোমাদের থেকে চিরদিনের মত।’ তাতে তাদের সবাই একযোগে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
যুদ্ধ শুরু : ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী এবং তাদের সেরা অশ্বারোহী বীরদের অন্যতম তালহা বিন আবু তালহা আব্দুল্লাহ আল-আবদারী উটে সওয়ার হয়ে এসে প্রথমে দ্বৈরথ যুদ্ধে মুকাবিলার আহবান জানান। মুসলিম বাহিনীর বামবাহুর প্রধান যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে যান এবং সিংহের মত এক লাফে উটের পিঠে উঠে তাকে সেখান থেকে মাটিতে ফেলে যবেহ করে হত্যা করেন। এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ খুশীতে তাকবীর ধ্বনি দেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুবায়েরের প্রশংসায় বলেন, إنَّ لكل نبي حَواريًّا وحواريَّ الزبيرُ- ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক নবীর একজন নিকট সহচর থাকেন। আমার সহচর হ’ল যুবায়ের’।
প্রধান পতাকাবাহীর পতনের পর তার পরিবারের আরও পাঁচ জন পরপর নিহত হয় এবং এভাবে দশ/বারো জন পতাকাবাহী মুসলিম বাহিনীর হাতে খতম হয়। যার মধ্যে একা কুযমান ৪ জনকে এবং আলী (রাঃ) ৮ জনকে হত্যা করেন। আউস গোত্রের বনু যাফর (بنو ظفر) বংশের কুযমান (قزمان) ইবনুল হারেছ ছিল একজন মুনাফিক’। সে এসেছিল নিজ বংশের গৌরব রক্ষার্থে, ইসলামের স্বার্থে নয়।
মাক্কী বাহিনীর পতাকাবাহীদের একে একে নিহত হওয়ার পর মুসলিম সেনাদল বীরদর্পে এগিয়ে যান ও মুশরিকদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। এই সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলকে আহবান করে বলেন, من يأخذ هذا السيف بحقه؟ কে আছ আমার এই তরবারি তার হক সহ গ্রহণ করবে? আলী, যুবায়ের, ওমর সহ বহু ছাহাবী একযোগে এগিয়ে এলেন তরবারি নেবার জন্য। কিন্তু এ সময় আবু দুজানাহ বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ তরবারির হক কি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, أن تضربَ به وجوهَ العدو حتى يَنْحنى ‘তুমি এর দ্বারা শত্রুদের মুখে মারবে, যাতে ওরা আমার থেকে সরে যায়’। তখন আবু দুজানাহ বললেন, أنا آخذ بحقه يارسول الله ‘আমি এর হক আদায় করব হে আল্লাহর রাসূল’। তখন তিনি তাকেই তরবারি দিলেন। রাসূলের তরবারি হাতে পেয়ে আবু দুজানা খুশীতে আত্মহারা হয়ে মাথায় লাল পাগড়ী বেঁধে নিম্নের কবিতা বলতে বলতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যান।-
أنا الذي عاهدَنِي خليلي + ونحن بالسَّفْح لدَى النخيل
ألاَّ أقومَ الدهرَ في الكَيُّول + أضرِبُ بسيفِ الله والرسول
ألاَّ أقومَ الدهرَ في الكَيُّول + أضرِبُ بسيفِ الله والرسول
‘আমরা যখন খেজুর বাগানের প্রান্তে ছিলাম, তখন আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ আমার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, কখনোই আমি পিছনের সারিতে থাকবো না। বরং সর্বদা সম্মুখ সারিতে থেকে আল্লাহ ও রাসূলের তরবারি দ্বারা প্রতিপক্ষকে মারব’।[5] উল্লেখ্য যে, বদরী ছাহাবী আবু দুজানাহ সিমাক বিন খারাশাহ আনছারী আল-খাযরাজী (রাঃ) সম্পর্কে লোকদের মধ্যে একথা প্রচলিত ছিল যে, তিনি যখন তার লাল পাগড়ীটি পরে যুদ্ধে নামেন, তখন আমৃত্যু লড়ে যান।
যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) বলেন, রাসূলের তরবারি চেয়েও না পাওয়াতে আমি দুঃখিত ছিলাম এবং শপথ করি যে, রাসূলের তরবারি দিয়ে আবু দুজানা কেমন যুদ্ধ করেন, আমি তা দেখব। তাই আমি সর্বদা তার পিছে পিছে থাকতাম। দেখলাম, তিনি শত্রুপক্ষের যাকেই সামনে পান, তাকেই শেষ করে ফেলেন। এভাবে তিনি মুশরিক সারিগুলি ছিন্ন ভিন্ন করে তীব্র গতিতে গিয়ে এমন একজনের মাথার উপরে তরবারি উঠান, যে মুশরিক সৈন্যদের দারুণভাবে উত্তেজিত করছিল। মাথার উপরে তরবারি দেখে সে হায় হায় করে উঠলে আবু দুজানা বুঝতে পারেন যে, ওটি একজন মহিলা। তখন তিনি অতি কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করেন এবং বলেন, কোন মহিলাকে হত্যা করে রাসূলের তরবারিকে কলংকিত করব না’।[6] উক্ত মহিলা ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ। বদর যুদ্ধে যার পিতা উৎবাহ, চাচা শায়বাহ, ভাই ওয়ালীদ ও পুত্র হানযালা বিন আবু সুফিয়ান নিহত হয় এবং যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি ওহোদ যুদ্ধে এসেছিলেন ও নর্তকী দলের নেতৃত্ব দিয়ে নিজ দলের সৈন্যদের উত্তেজিত করছিলেন।
এই যুদ্ধে হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের বীরত্ব ছিল কিংবদন্তীতুল্য। প্রতিপক্ষের মধ্যভাগে প্রবেশ করে তিনি সিংহ বিক্রমে লড়াই করছিলেন। তাঁর অস্ত্রচালনার সামনে শত্রু পক্ষের কেউ টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহর এই সিংহকে কাপুরুষের মত গোপন হত্যার মাধ্যমে শহীদ করা হয়। তাকে হত্যাকারী ওয়াহ্শী বিন হারব ছিল মক্কার নেতা জুবায়ের ইবনু মুত্ব‘ইমের হাবশী গোলাম। যার চাচা তু‘আইমা বিন ‘আদী বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। ওয়াহ্শী ছিল বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী, যা সাধারণতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ত না। মনিব তাকে বলেছিল, তুমি আমার চাচার বিনিময়ে যদি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার, তাহ’লে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে’। ওয়াহশী বলেন যে, আমি কেবল আমার নিজের মুক্তির স্বার্থেই যুদ্ধে আসি এবং সর্বক্ষণ কেবল হামযার পিছনে লেগে থাকি। আমি একটি বৃক্ষ বা একটি পাথরের পিছনে ওঁৎ পেতে ছিলাম। ইতিমধ্যে যখন তিনি আমার সম্মুখে জনৈক মুশরিক সেনাকে এক আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন এবং তাকে আমার আওতার মধ্যে পেয়ে যাই, তখনই আমি তাঁর অগোচরে তাঁর দিকে বর্শাটি ছুঁড়ে মারি, যা তাঁর নাভীর নীচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। তিনি আমার দিকে তেড়ে আসেন। কিন্তু পড়ে যান ও কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমি তার দেহ থেকে বর্শাটি বের করে নিয়ে চলে যাই’। এরপর মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেওয়া হয়।[7]
উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের পর ওয়াহশী ত্বায়েফে পালিয়ে যান। অতঃপর সেখানকার প্রতিনিধি দলের সাথে ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে রাসূলের নিকট ইসলাম কবুল করেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে ভবিষ্যতে পুনরায় সামনে আসতে নিষেধ করেন। ফলে তিনি রাসূলের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো আর মদীনায় আসেননি। আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফত কালে ভন্ড নবী মুসায়লামা কাযযাবকে ইয়ামামার যুদ্ধে ঐ বর্শা দিয়েই তিনি হত্যা করেন এবং বলেন, قد قتلتُ خيرَ الناس بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم وقد قتلتُ شَرَّ الناس، ‘আমি রাসূলের পরে শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করেছিলাম। আজ আমি নিকৃষ্টতম মানুষটিকে হত্যা করলাম’।[8] রোমকদের বিরুদ্ধে ইয়ারমূকের যুদ্ধেও তিনি শরীক হন। তিনি ওছমান (রাঃ) অথবা আমীর মু‘আবিয়ার খেলাফতকালে ইরাকের হিমছে বসবাস করেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
‘সাইয়িদুশ শুহাদা’ হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওহোদ যুদ্ধে তিনি একাই ৩০ জনের অধিক শত্রু সেনাকে হত্যা করেন।[9] কেবল আবু দুজানা ও হামযা নয়, অন্যান্য বীরকেশরী ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্বের সম্মুখে কাফির বাহিনী কচুকাটা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি তারা তাদের সেনা শিবির ছেড়ে সবকিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, মুশরিক বাহিনীর মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে গেল। তাদের নারীরা পায়ের গোছা বের করে ছুটতে লাগল। মুসলিম বাহিনী তাদের পিছনে তরবারি নিয়ে ধাওয়া করল। অতঃপর সবাই তাদের পরিত্যক্ত মালামাল জমা করতে শুরু করল।[10]
তীরন্দাযদের ভুল ও তার খেসারত :
কাফিরদের পলায়ন ও গণীমত জমা করার হিড়িক দেখে গিরিপথ রক্ষী তীরন্দায দল ভাবল, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অতএব আর এখানে থাকার কি প্রয়োজন? গণীমতের মাল ও দুনিয়ার লোভরূপী শয়তান সাময়িকভাবে তাদের মাথায় চেপে বসল। ‘গণীমত’ ‘গণীমত’ (الغنيمة الغنيمة) বলতে বলতে তারা ময়দানের দিকে ছুটে চলল। অধিনায়ক আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের (রাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ১০ জন বাদে বাকী ৪০ জনের সবাই ছুটলো ময়দানের দিকে। শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর ধুরন্ধর সেনাপতি খালেদ ইবনু ওয়ালীদ সুযোগ বুঝে নক্ষত্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঐ ক্ষুদ্র বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ও তাঁর সাথীগণ সকলে প্রাণপণ লড়াই করে শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর খালেদ ও তার পশ্চাদবর্তী কুরায়েশ সেনাদল অতর্কিতে এসে অপ্রস্ত্তত মুসলিম সেনাদলের উপরে হামলা করল। ঐ সময় আমরাহ বিনতে আলক্বামা (عمرة بنة علقمة الحارثية) নাম্মী জনৈকা কুরায়েশ মহিলা তাদের ভূলুণ্ঠিত পতাকা তুলে ধরলে চারদিক থেকে মাক্কী বাহিনী পুনরায় ময়দানে ছুটে আসে এবং অগ্র-পশ্চাৎ সবদিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। শুরু হ’ল মহা পরীক্ষা। মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে মহা বিপর্যয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সময় আহত হন। অতঃপর সুকৌশলে স্বীয় বাহিনীকে উচ্চভূমিতে তাঁর ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন। ফলে মুসলিম বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও সাক্ষাৎ পরাজয় থেকে বেঁচে যায়। তীরন্দাযদের ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনীর নিশ্চিত বিজয় এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
জয়-পরাজয় পর্যালোচনা :
ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রথম দিকে বিজয়ী হয় এবং শত্রু বাহিনী ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু তীরন্দাযগণের মারাত্মক ভুলের কারণে অরক্ষিত গিরিসংকট দিয়ে শত্রুবাহিনী অতর্কিতে ময়দানে ঢুকে পড়ে। যাতে মুসলিম বাহিনী চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে আহত হন। তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হয়। এছাড়া মুসলিম বাহিনীর সর্বমোট ৭০ জন শাহাদাত বরণ করেন। যার মধ্যে মুহাজির ৪ জন, ইহুদী ১ জন, বাকী ৬৫ জন আনছারের মধ্যে আউস গোত্রের ২৪ জন ও খাযরাজ গোত্রের ৪১ জন ছিলেন। কুরায়েশ বাহিনীর নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন ২২ জন, কেউ বলেছেন ৩৭ জন। কিন্তু এ হিসাব মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তারাই বলছেন যে, একা হামযা (রাঃ) ৩০ জনের অধিক শত্রু সৈন্য খতম করেছেন। তাছাড়া আলী (রাঃ) হত্যা করেছেন ৮ জনকে, কুযমান হত্যা করেছেন ৮ জনকে। এতদ্ব্যতীত যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম, মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, আবু দুজানা, আবুবকর, ওমর, আছেম বিন ছাবেত, হাতেব ইবনু আবী বালতা‘আহ, আবু তালহা, উম্মে ‘উমারাহ, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ, মুছ‘আব বিন উমায়ের, উসায়েদ বিন হুযায়ের, হাববাব ইবনুল মুনযির, সা‘দ বিন মু‘আয, সা‘দ বিন ওবাদাহ, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ, সা‘দ ইবনু রাবী‘, নযর ইবনু আনাস, আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ, হানযালাহ, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ও তাঁর পিতা ইয়ামান, আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালিক ইবনু সিনান, জাবের-এর পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম, হারিছ ইবনু ছম্মাহ, উছায়রিম, মুখাইরীক্ব, আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ, রাফে‘ বিন খাদীজ, সামুরাহ বিন জুনদুব, মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ, ক্বাতাদাহ ইবনু নু‘মান, আনাস ইবনু নাযার, ছাবিত ইবনু দাহদাহ ও তার সঙ্গীরা, আব্দুর রহমান ইবনু ‘আউফ, সাহল ইবনু হুনায়েফ প্রমুখ বীর যোদ্ধাদের হাতে কত শত্রু সৈন্য খতম হয়েছে, তার হিসাব কোথায়? তিন হাযারের দুর্ধর্ষ কুরায়েশ বাহিনী কোনরূপ চরম মূল্য না দিয়েই কি ময়দান ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছিল? অতএব মুসলিম বীরদের হাতে তাদের যে অগণিত সৈন্য হতাহত হয়েছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়।
দ্বিতীয়তঃ কুরায়েশ বাহিনী বিজয়ী হ’লে মুসলিম বাহিনীর ঘাঁটি দখল করল না কেন? তাদের মালামাল লুট করল না কেন? তারা মদীনার উপরে চড়াও হ’ল না কেন? সে যুগের প্রথানুযায়ী বিজয়ী দল হিসাবে তারা সেখানে ৩ দিন অবস্থান করল না কেন? কেন একজন মুসলিম সৈন্যও তাদের হাতে বন্দী হ’ল না? অথচ কাফের বাহিনীর দু’জন কবির অন্যতম আবু ‘ইযযাহ মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয় এবং ইতিপূর্বে বদরের যুদ্ধে বন্দী হওয়ার পর মুক্তিপণ হিসাবে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করায় তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। অতএব এটাকে ‘অমীমাংসিত যুদ্ধ’ বলা চলে। তবে আখেরাতের হিসাবে মুসলমানেরা সর্বদাই লাভবান এবং তারাই বিজয়ী। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَهِنُوْا فِي ابْتِغَاءِ الْقَوْمِ إِنْ تَكُوْنُوْا تَأْلَمُوْنَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُوْنَ كَمَا تَأْلَمُوْنَ وَتَرْجُوْنَ مِنَ اللهِ مَا لاَ يَرْجُوْنَ وَكَانَ اللهُ عَلِيْماً حَكِيْمًا- ‘শত্রুদলের পশ্চাদ্ধাবনে তোমরা শৈথিল্য প্রদর্শন করো না। যদি তোমরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাক, তবে তারাও আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে যেমন তোমরা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছ। (তবে পার্থক্য এই যে,) তোমরা আল্লাহর নিকট থেকে (জান্নাত) আশা কর, যা তারা আশা করে না। আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/১০৪)।
যুদ্ধশেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐদিনই অর্থাৎ ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সন্ধ্যায় মদীনায় ফিরে আসেন। কিন্তু কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় হামলা করতে পারে এই আশংকায় পরদিন ৮ই শাওয়াল রবিবার তাদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করেন কেবলমাত্র ঐসব সেনাদের নিয়ে যারা আগের দিন ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই অনুমতি চেয়েও ব্যর্থ হয়। তবে সঙ্গত কারণে জাবের বিন আব্দুল্লাহকে অনুমতি দেন এবং ৮ মাইল দূরে গিয়ে ‘হামরাউল আসাদ’ (حمراء الأسد) নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন ও চারদিন পর ১২ই শাওয়াল ফিরে আসেন।
ঘটনা ছিল এই যে, এখানে পৌঁছে মা‘বাদ বিন আবী মা‘বাদ আল-খুযাঈ নামক জনৈক ব্যক্তি মুসলমান হন। তিনি রাসূলের হিতাকাংখী ছিলেন। তাছাড়া বনু হাশেম ও বনু খুযা‘আহর মধ্যে পূর্ব থেকেই মৈত্রী চুক্তি ছিল। তিনি রাসূলের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আবু সুফিয়ানের নিকট গমন করেন। আবু সুফিয়ানের বাহিনী তখন মদীনা থেকে ৩৬ মাইল দূরে ‘রাওহা’ (الروحاء) নামক স্থানে অবতরণ করেছে। কিন্তু তখন সাথীদের চাপে আবু সুফিয়ান পুনরায় মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। এমন সময় মা‘বাদ সেখানে পৌঁছে যান এবং আবু সুফিয়ানকে রাসূলের পশ্চাদ্ধাবন বিষয়ে অবহিত করেন ও তাকে দারুনভাবে ভীত করে ফেলেন। এমনকি বলেন যে, মুহাম্মাদের বিরাট বাহিনী টিলার পিছনে এসে গেছে। তোমরা এখুনি পালাও। আবু সুফিয়ান তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানতেন না। ফলে তার কথায় বিশ্বাস করলেন ও দ্রুত মক্কায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে মা‘বাদকে বলে দিলেন যে, তুমি মুহাম্মাদকে জানিয়ে দিয়ো যে, আমরা অতি সত্বর পুনরায় তাদের উপর হামলা করব এবং তাকে ও তার সাথীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলব’। মা‘বাদ রাযী হলেন। অতঃপর তিনি রাসূলের নিকট এসে উক্ত খবর জানালে মুসলিম বাহিনীর ঈমানী তেজ আরো বেড়ে যায় এবং তারা বলে ওঠেন, حسبنا الله ونعم الوكيل ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।
অন্য দিকে আবু সুফিয়ানের গুপ্তচর মু‘আবিয়া বিন মুগীরাহ বিন আবুল ‘আছ যে ব্যক্তি উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নানা ছিল, মদীনায় পৌঁছে তার চাচাতো ভাই ওছমান (রাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নেয়। ওছমানের আবেদনক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে তিন দিনের জন্য অনুমতি দেন এবং বলেন, এর পরে পাওয়া গেলে তাকে হত্যা করা হবে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা ছেড়ে গেলে সে গোপন সংবাদ সংগ্রহে লিপ্ত হয় এবং ৪দিন পর রাসূল (ছাঃ) ফিরে আসার সাথে সাথে পালিয়ে যায়। তখন তিনি যায়েদ বিন হারেছাহ ও আম্মার বিন ইয়াসিরকে পাঠান এবং তার পিছু ধাওয়া করে তাকে পাকড়াও করে হত্যা করেন। এভাবে ওহোদ যুদ্ধের পরবর্তী চক্রান্ত সমূহ শেষ করে দিয়ে রাসূল (ছাঃ) নিশ্চিন্ত হন।
ওহোদ যুদ্ধের বিষয়ে কুরআন :
ওহোদ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের ১২১ হ’তে ১৭৯ পর্যন্ত পরপর ৬০টি আয়াত নাযিল হয়। যার মধ্যে যুদ্ধের এক একটি পর্বের আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর ঐসব কারণগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলির ফলে মুসলিম বাহিনী মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেখানে মুনাফিকদের অপতৎপরতার কথাও উল্লেখিত হয়েছে। অতঃপর যুদ্ধের ফলাফল ও এর অন্তর্নিহিত গুঢ় রহস্যের উপরে আলোকপাত করে বলা হয়েছে, مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلَى مَا أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىَ يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ- ‘নাপাককে পাক হ’তে পৃথক করে না দেয়া পর্যন্ত আল্লাহ এমন নন যে, ঈমানদারগণকে সে অবস্থাতেই ছেড়ে দিবেন, যে অবস্থায় তোমরা আছ। আর আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানাবেন…’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)।
অর্থাৎ মুনাফিকদের পৃথক করা ও মুমিনদের ঈমানের দৃঢ়তা পরখ করা ছিল এ যুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আর একথাগুলি অহীর মাধ্যমে না জানিয়ে বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়াই ছিল ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের অন্যতম তাৎপর্য।
ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের রহস্য :
ইবনু হাজার বলেন, বিদ্বানগণ বলেন যে, ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ রহস্য ও তাৎপর্য সমূহ নিহিত ছিল। যেমন- (১) রাসূলের অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে মুসলমানদের হুঁশিয়ার করা। কেননা তীরন্দাযগণের অবাধ্যতার ফলে আকস্মিক এই বিপর্যয় নেমে আসে (২) রাসূলগণের জন্য সাধারণ নিয়ম এই যে, তারা প্রথমে বিপদগ্রস্থ হন এবং শেষে বিজয়ী হন। কেননা যদি তাঁরা সর্বদা কেবল বিজয়ী হ’তে থাকেন, তাহ’লে মুমিনদের মধ্যে এমন লোকও ঢুকে পড়বে, যারা তাদের নয়। আবার যদি তারা কেবল পরাজিত হ’তেই থাকেন, তাহ’লে রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্যই হাছিল হবে না। সেকারণ জয় ও পরাজয় দু’টিই একত্রে রাখা হয়, যাতে প্রকৃত ঈমানদার ও কপট বিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। (৩) কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য দেরীতে আসলে মুমিনদের হৃদয়ে অধিক নম্রতার সৃষ্টি হয় এবং অহংকার চূর্ণ হয়। তারা অধিক ধৈর্যশীল হয়। পক্ষান্তরে মুনাফিকগণ দিশেহারা হয়। (৪) আল্লাহ মুমিন বান্দাদের জন্য জান্নাতে উচ্চ মর্যাদার এমন স্তর সমূহ নির্ধারণ করেছেন, যেখানে পৌঁছানোর জন্য তাদের আমল সমূহ যথেষ্ট হয় না। তখন আল্লাহ তাদের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা ও বিপদাপদ সমূহ নির্ধারণ করেন। যাতে তারা সেখানে পৌঁছতে পারেন। (৫) আউলিয়াগণ অর্থাৎ আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের জন্য সবচেয়ে বড় মর্যাদা হ’ল শাহাদাত লাভ করা। সেকারণ আল্লাহ তাদের নিকটে সে সুযোগ পৌঁছে দেন। (৬) আল্লাহ তার শত্রুদের ধ্বংস করতে চান। সেকারণ তিনি এমন কার্যকারণ সমূহ নির্ধারণ করে থাকেন, যা তাদের কুফরী, সীমালংঘন ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে রূপ লাভ করে। এর দ্বারা তিনি মুমিনদের গোনাহ সমূহ দূর করে দেন ও কাফির-মুনাফিকদের সংকুচিত ও ধ্বংস করেন।[11]
বলা বাহুল্য যে, উপরোক্ত রহস্য ও তাৎপর্য সমূহ কেবল ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুমিনগণের জন্যই নয়, বরং যুগে যুগে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী সকল মুমিনের জন্য প্রযোজ্য।
ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আক্বীদা :
ছাহাবায়ে কেরাম নিষ্পাপ মা‘ছূম ছিলেন না। শয়তান সাময়িকভাবে হ’লেও তাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে (আলে ইমরান ৩/১৫৫)। সেজন্য আল্লাহ পাক মাঝে-মধ্যে পরীক্ষায় ফেলে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেন, যেমন ওহোদের যুদ্ধে করেছেন। তবে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিয়েছেন (আলে ইমরান ৩/১৫২) এবং তাদের উপরে সন্তুষ্ট হয়েছেন (তওবা ৯/১০০)। তাদের বিশাল সৎকর্ম সমূহ ছোট খাট গোনাহ সমূহকে ধুয়ে ছাফ করে নিয়ে গেছে (হূদ ১১/১১৪)। রাসূলের ভাষায় ‘ওহোদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করলেও ছাহাবায়ে কেরামের কোন একজনের (সৎকর্মের) সমপরিমাণ বা তার অর্ধেকও হবে না।[12] ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, শাম বিজয় কালে সেখানকার নাছারাগণ ছাহাবীগণকে দেখে বলেছিল, ‘আল্লাহর কসম! এঁরা আমাদের হাওয়ারীদের চাইতে উত্তম’ (هؤلاء خير من الحواريين) ইবনু কাছীর বলেন, তারা সত্য কথাই বলেছিল। কেননা ছাহাবীগণ সম্পর্কে বিগত এলাহী কিতাব সমূহেও বর্ণনা রয়েছে।[13]
পরবর্তী অংশ পড়ুন: ওহোদ যুদ্ধের কতগুলি উল্লেখযোগ্য দিক ও শিক্ষণীয় ঘটনা
[1] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৫১-৫৭; বুখারী হা/৪০৩৭ ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ; মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৯১; ইরওয়া হা/১১৯১।
[2] ইবনু হিশাম ২/৬৩।
[3] ইবনু হিশাম ২/৬৬।
[4] বুখারী, ‘জিহাদ’ অধ্যায় ১/৪২৬, হা/৩০৩৯; ফাৎহুল বারী ৭/৪০৩।
[5] ইবনু হিশাম ২/৬৭-৬৮।
[6] আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৬০-৬১।
[7] ইবনু হিশাম ২/৭১-৭২।
[8] ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩; বায়হাক্বী ৯/৯৭-৯৮; ফাৎহুল বারী ৭/৪২৭।
[9] আল-ইছাবাহ, ২/২৮৬, ক্রমিক সংখ্যা ১১০২।
[10] বুখারী হা/৪০৪৩, ২/৫৭৯।
[11] যাদুল মা‘আদ ২/৯৯-১০৮; ফাৎহুল বারী ৭/৩৪৭ পৃঃ।
[12] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৯৮।
[13] ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফাৎহ ২৯ আয়াত।
No comments