প্রশ্নঃ ৩৮. জিলহজ মাসে কি নয়টি রোজা রাখা উত্তম, না কি শুধু আরাফার দিন রোজা রাখা উত্তম?
প্রশ্নঃ ৩৮. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, জিলহজ মাসে কি নয়টি রোজা রাখা উত্তম? না কি শুধু আরাফার দিন রোজা রাখা উত্তম? তাছাড়া জিলহজ মাসের ফজিলত সম্পর্কে জানতে চাই
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام
ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
১- অধিকাংশ ফকীহগণ যিলহজ্বের প্রথম নয় দিন রোযা রাখা উত্তম বলেছেন। কারো পক্ষে সম্ভব হলে সে পুরো নয় দিনই রোযা রাখল। কারণ, যিলহজ্বের পুরো দশকের আমলই আল্লাহর কাছে প্রিয়। এ দশককে আমলে প্রাণবন্ত রাখার জন্য রোযার বিকল্প কোনো আমল নেই। কারণ, রোযা আল্লাহর কাছে অত্যধিক প্রিয় আমল। সুতরাং আমাদের যাদের জন্য সম্ভব যিলহজ্বের প্রথম দশক তথা নয় যিলহজ্ব পর্যন্ত রোযা রাখতে চেষ্টা করি। হাদীস শরীফে এসেছে-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্বের নয়টি দিবস রোযা রাখতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩৩৪; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৮৩৯৩
হাফসা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন-
أَرْبَعٌ لَمْ يَكُنْ يَدَعُهُنّ النّبِيّ
صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صِيَامَ عَاشُورَاءَ، وَالْعَشْرَ، وَثَلَاثَةَ
أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْغَدَاةِ.
চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্বের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামায। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪১৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৪২২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৭০৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬৩৩৯
কারো পক্ষে যদি পুরো নয় দিনই রোযা রাখা সম্ভব হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু পুরো নয় দিন যদি সম্ভব না হয়, নয় যিলহজ্বের রোযার ফযীলত থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। কারণ, এ দিনের রোযার ফযীলত সম্পর্কে আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى
اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ، وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.
আরাফার দিনের (নয় যিলহজ্বের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
অতএব, সম্ভব হলে যিলহজ্বের পুরো নয় দিনই রোযা রাখা (যা কিছু যঈফ বর্ণনায় এসেছে)। পুরো নয় দিন সম্ভব না হলে অন্তত নয় যিলহজ্বের রোযা রাখা চাই।
যিলহজ্বের প্রথম নয় দিন রোযা রাখার কথা কিছু (যঈফ) বর্ণনায় পাওয়া যায়। কিন্তু এ নয় দিনের রোযার বিশেষ কোনো ঘোষিত ফযীলত নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায় না; শুধু ইয়াওমে আরাফা তথা নয় যিলহজ্বের রোযার ফযীলতের কথা হাদীসে এসেছে, যা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি।
২- জিলহজ মাসের ফজিলত সম্পর্কে একটি প্রবন্ধঃ
হাদীস ও আসারের আলোকে যিলহজ্ব মাস : গুরুত্ব ফযীলত ও আমল
আসমান-যমীনের সৃষ্টি অবধি আল্লাহ তাআলা বছরকে বার মাসে বিভক্ত করেছেন। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এটিই আল্লাহর নিয়ম। এর মধ্য থেকে আল্লাহ চারটি মাসকে করেছেন সম্মানিত ও মহিমান্বিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ
اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ
مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ.
আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
إِنّ الزّمَانَ قَدِ اسْتَدَارَ
كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللهُ السّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، السّنَةُ اثْنَا عَشَرَ
شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاَثٌ مُتَوَالِيَاتٌ: ذُو القَعْدَةِ،
وَذُو الحِجّةِ، وَالمُحَرّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ الّذِي بَيْنَ جُمَادَى،
وَشَعْبَانَ.
নিশ্চয় সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল (কারণ, আরবরা মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে ফেলেছিল)। বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ্ব, মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মাঝের মাস। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২
যিলহজ্ব : সম্মানিত চার মাসের শ্রেষ্ঠ মাস
এ চার মাসের মধ্যে যিলহজ্ব মাসের ফযীলত সবচেয়ে বেশি। কারণ, এ মাসেই আদায় করা হয় ইসলামের অন্যতম প্রধান রোকন ও নিদর্শন হজ্ব এবং অপর নিদর্শন ও মহান আমল কুরবানী।
এ মাস আল্লাহর কাছে সম্মানিত। এতে রয়েছে এমন দশক, আল্লাহ তাআলা যার কসম করেছেন। বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্ব মাসকে শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন-
أَلَا وَإِنّ أَحْرَمَ الشُّهُورِ
شَهْرُكُمْ هَذَا.
জেনে রাখো! সবচেয়ে সম্মানিত মাস হল, তোমাদের এ মাস (যিলহজ্ব)। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৯৩১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৭৬২
ইবরাহীমী ঈমান ও সমর্পণে উজ্জীবিত হওয়ার মাস
এ মাসে আমরা আদায় করি হজ্ব ও কুরবানী। আর এ দুই আমল ধারণ করে আছে ইবরাহীম আ.-এর ঈমান ও সমর্পণের বহু নিদর্শন। শিরক ও মুশরিকদের থেকে চির বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করা এবং আল্লাহর নির্দেশের সামনে সমর্পিতচিত্তে নিজ সন্তানকে কুরবানী করতে উদ্যত হওয়া এবং জনমাবহীন মরু প্রান্তরে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে যাওয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া- এ সবই ছিল ইবরাহীম আ.-এর দৃঢ় ঈমান ও নিঃশর্ত সমর্পণের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাইতো আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
فِیْۤ اِبْرٰهِیْمَ وَ الَّذِیْنَ مَعَهٗ، اِذْ قَالُوْا لِقَوْمِهِمْ اِنَّا
بُرَءٰؤُا مِنْكُمْ وَ مِمَّا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَ
بَدَا بَیْنَنَا وَ بَیْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَ الْبَغْضَآءُ اَبَدًا حَتّٰی
تُؤْمِنُوْا بِاللهِ وَحْدَهٗۤ.
তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের (আকীদা-বিশ্বাস) অস্বীকার করি। আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরকালের জন্য শত্রæতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে। যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। -সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ৪
এটাকেই বলে, ‘আলহুব্বু ফিল্লাহ ওয়াল বুগযু ফিল্লাহ’,-আল্লাহর জন্যই ভালবাসা স্থাপন, আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ পোষণ। ভালবাসা ও বিদ্বেষ পোষণের মানদÐ হল ঈমান। এর মাধ্যমেই ঈমান পূর্ণতা পায়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ أَحَبّ لِله، وَأَبْغَضَ لِلهِ،
وَأَعْطَى لِلهِ، وَمَنَعَ لِلهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ.
যে আল্লাহর জন্য (অন্যকে) ভালোবাসে, আল্লাহর জন্যই (কারো সাথে) বিদ্বেষ পোষণ করে, (কাউকে কিছু দিলে) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই দেয়, আর কাউকে কোনো কিছু দেওয়া থেকে বিরত থাকলে সেটাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করে, সে স্বীয় ঈমানকে পূর্ণ করল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬৮১
আর আল্লাহর হুকুমের সামনে সমর্পণের যে আদর্শ ইবারাহীম আ. আমাদের জন্য রেখে গেছেন সে বিষয়েই ইরশাদ হয়েছে-
اِذْ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗ اَسْلِمْ قَالَ
اَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
(স্মরণ করুন,) যখন ইবরাহীমের রব তাকে বললেন, আত্মসমর্পণ কর, সে বলল, জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। -সূরা বাকারা (২) : ১৩১
আর ইবরাহীম আ.-এর এ সমর্পণের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল, আল্লহর হুকুমে নিজ সন্তানকে কুরবানী করতে উদ্যত হওয়া। এ পরীক্ষায় তিনি ও তাঁর সন্তান আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সমর্পণের যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন সেটিই কুরআনে বিবৃত হয়েছে এভাবে-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْیَ قَالَ
یٰبُنَیَّ اِنِّیْۤ اَرٰی فِی الْمَنَامِ اَنِّیْۤ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَا ذَا
تَرٰی، قَالَ یٰۤاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِیْۤ اِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ
الصّٰبِرِیْنَ، فَلَمَّاۤ اَسْلَمَا وَ تَلَّهٗ لِلْجَبِیْنِ، وَ نَادَیْنٰهُ اَنْ
یّۤاِبْرٰهِیْمُ، قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْیَا ۚ اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِی
الْمُحْسِنِیْنَ، اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِیْنُ، وَ فَدَیْنٰهُ
بِذِبْحٍ عَظِیْمٍ.
অতপর সে (ইসমাঈল) যখন তার পিতার সাথে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কী বল! সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। ইনশাআল্লাহ! আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতপর যখন তারা (পিতাপুত্র) দুজনই (আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার সামনে) আত্মসমর্পণ করল এবং ইবরাহীম তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। নিশ্চয় আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে (ইসমাঈলকে) মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০২-১০৭
আমার সবকিছু আল্লাহর জন্য : এ স্মরণ তাজা করি এ মাসে
হাজ্বী সাহেবান দুনিয়ার সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমনকি ইহরামের মাধ্যমে দৈনন্দিনের স্বাভাবিক পোশাকও বর্জন করে দুই প্রস্থ সেলাইবিহীন কাপড়ে ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক-হাজির! বান্দা হাজির!!’ বলে নিজেকে আল্লাহর সমীপে পেশ করে। সফেদ পোশাকে, ধুলোধূসরিত বদনে আল্লাহর ঘরে হাজিরি দেয়। এ হাজিরি শুধু আল্লাহর জন্য, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। প্রতিনিয়ত তাদের যবান সতেজ থাকে লাব্বাইক ধ্বনিতে-
لَبّيْكَ اَللّٰهُمّ لَبّيْكَ، لَبّيْكَ
لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبّيْكَ، إِنّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ
شَرِيْكَ لَكَ.
আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। আমি হাজির, আপনার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিআমত আপনারই এবং সকল রাজত্ব আপনার। আপনার কোনো শরীক নেই।
তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম কুরবানী করে। আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে পশু কুরবানী করে। তখন এ দুআ পড়ে-
اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ
وَ مَمَاتِیْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ، لَا شَرِیْكَ لَهٗ، وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ
وَ اَنَا مِنَ الْمُسْلِمِیْن.
আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি। এবং আমি মুসলিমদের একজন।
আল্লাহর দেওয়া সম্পদ ব্যয় করে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কুরবানী করে। আবার সে পশুর গোস্ত আল্লাহ বান্দাকেই দান করেন ভক্ষণ করার জন্য। আর আল্লাহ চান বান্দার তাকওয়া, খালেস নিয়ত ও তাঁর হুকুমের সামনে সমর্পণ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا
دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ .
আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের গোস্ত আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭
এ সবকিছুই বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেয়- আমি আল্লাহর জন্য, আমার সবকিছু আল্লাহর জন্য।
নেক আমলে অগ্রগামী হওয়ার মাস
আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে বান্দাদের দান করেছেন ফযীলতপূর্ণ বিভিন্ন দিবস-রজনী। বছরের কোনো কোনো মাস, দিন বা রাতকে করেছেন ফযীলতপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যাতে এগুলোকে কাজে লাগিয়ে বান্দা ক্ষমা লাভ করতে পারে, নেক আমলে সমৃদ্ধ হতে পারে এবং আল্লাহর প্রিয় হতে পারে। এর মধ্যে যিলহজ্ব মাস অন্যতম প্রধান ফযীলতপূর্ণ মাস।
এ মাসের প্রথম দশককে আল্লাহ তাআলা করেছেন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ দিনগুলোতেই হজ্বের মৌলিক আমল সম্পাদিত হয়। দশ যিলহজ্ব সারা বিশ্বের মুসলিমগণ কুরবানী করেন। এ দিনগুলোর নেক আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
مَا مِنْ أَيّامٍ الْعَمَلُ الصّالِحُ
فِيهَا أَحَبّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ يَعْنِي أَيّامَ الْعَشْرِ،
قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: وَلَا
الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ
يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.
অর্থাৎ আল্লাহর নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭২৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৯৬৮
হজ্ব : এ মাসের প্রধান আমল
এ মাসের সবচেয়ে প্রধান আমল হল হজ্ব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ لِلهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ
مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللهَ غَنِیٌّ عَنِ
الْعٰلَمِیْنَ.
মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ্ব করা তার জন্য অবশ্যকর্তব্য। আর যে এই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি সামান্যও মুখাপেক্ষী নন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭
সুতরাং যাদের উপর হজ্ব ফরয হয়েছে এবং তারা হজ্বে গিয়েছেন, তাদেরকে মোবারকবাদ; আল্লাহ তাদের মাবরুর হজ্ব নসীব করেন। কিন্তু যাদের উপর হজ্ব ফরয হওয়া সত্তে¡ও এখনও হজ্বে যাননি বা যাওয়ার নিয়ত করেননি আজই হজ্বের নিয়ত করুন।
লক্ষ্য করুন, উপরের আয়াতের শেষে আল্লাহ কী বলেছেন-
وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللهَ غَنِیٌّ عَنِ
الْعٰلَمِیْنَ.
আর যে এই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি সামান্যও মুখাপেক্ষী নন।
আরো শুনুন ওমর রা. কী বলেছেন। তিনি বলেছেন-
من أطاق الحج فلم يحج، فسواء عليه يهوديا
مات أو نصرانيا
যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও হজ্ব করল না তার ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করা আর খ্রিস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করা সমান কথা। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৮৪ (সূরা আলে ইমরান ৯৭ নং আয়াতের অধীনে)
সুতরাং আর দেরি নয়; এখনই নিয়ত করুন ও আগামী বছর হজ্বে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تَعَجّلُوا إِلَى الْحَجِّ يَعْنِي
الْفَرِيضَةَ فَإِنّ أَحَدَكُمْ لَا يَدْرِي مَا يَعْرِضُ لَهُ.
তোমরা দ্রæততর সময়ের মধ্যে ফরয হজ্ব আদায় কর। কেননা তোমাদের কেউই একথা জানে না যে, আগামীতে তার ভাগ্যে কী আছে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৮৬৭
তাছাড়া কেন আমি নিজেকে হজ্বের এ ফযীলতসমূহ থেকে বঞ্চিত করব? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ حَجّ لِلهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ
يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمّهُ.
যে ব্যক্তি একমাত্র অল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্ব করে এবং কোনো অশ্লীল কাজ বা গুনাহে লিপ্ত হয় না, সে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে বাড়ী ফেরে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন-
الحَجّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ
إِلّا الجَنّةُ.
মাবরুর (মকবুল) হজ্বের প্রতিদান জান্নাত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৯
তালবিয়া : আমিও শামিল এ ধ্বনির মিছিলে
لَبّيْكَ اَللّٰهُمّ لَبّيْكَ، لَبّيْكَ
لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبّيْكَ، إِنّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ
شَرِيْكَ لَكَ.
আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। আমি হাজির, আপনার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিআমত আপনারই এবং সকল রাজত্ব আপনার। আপনার কোনো শরীক নেই।
শুভ্র-সফেদ লেবাসের মানুষগুলোর মুখে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হচ্ছে এ ধ্বনি। তারা মক্কার প্রতিটি অলি-গলি সজিব সতেজ করে তুলেছেন এ ধ্বনিতে। এটি বায়তুল্লাহ্য় উপস্থিত হয়ে বাইতুল্লাহর রবের সমীপে হাজিরী ও সমর্পণের ঘোষণা। এ শুধু হজ্ব ও হাজ্বীর ধ্বনি নয়, এ ধ্বনি সারা বিশ্বের প্রতিটি মুমিনের, প্রতিটি মুসলিমের। এ শুধু হজ্ব ও হাজ্বীর ঘোষণা নয়, এ ঘোষণা সারা বিশ্বের প্রতিটি মুমিনের, প্রতিটি মুসলিমের।
কারণ এ ধ্বনিতে রয়েছে- ঈমান, তাওহীদ, তাফবীয, ইহসান, শোকর ও তাওয়াক্কুলের মর্ম ও ব্যঞ্জনা। নিজেকে এবং নিজের সকল কিছুকে আল্লাহ তাআলার হাওয়ালা করে দেওয়ার ঘোষণা। তালবিয়ার মাধ্যমে বান্দা নিজেকে আল্লাহর সমীপে পেশ করে এবং সমর্পিত হয় তাঁর সামনে। এটিই তালবিয়ার মর্মবাণী। আর এ শুধু হাজ্বীর কর্তব্য নয়, সকল মুমিনের কর্তব্য; শুধু হজ্ব মওসুমের কর্তব্য নয়, সারা জীবনের কর্তব্য।
হাজ্বীদের খেদমত : এ মাসের একটি পুণ্যময় আমল
হাজ্বীগণের খেদমত বড় সৌভাগ্যের আমল। কারণ, হাজ্বীগণ হলেন আল্লাহর মেহমান, আমাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশে প্রেরিত প্রতিনিধি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْغَازِي فِي سَبِيلِ اللهِ، وَالْحَاجّ
وَالْمُعْتَمِرُ وَفْدُ اللهِ، دَعَاهُمْ، فَأَجَابُوهُ، وَسَأَلوهُ،
فَأَعْطَاهُمْ. قال البوصيري : إسناده حسن
অর্থাৎ আল্লাহর রাহে (ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে) জিহাদকারী, হজ্ব ও উমরা আদায়কারী- এরা আল্লাহর ওয়াফ্দ (মেহমান)। আল্লাহ তাদের ডেকেছেন আর তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তারা আল্লাহর কাছে চেয়েছেন আর আল্লাহ তাদের দিয়েছেন। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৬১৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮৯৩
‘ওয়াফ্দ’ বলা হয় সরকারি মেহমানকে। সরকার যত বড় হয় মেহমানের মর্যাদা তত বেশি হয়। এরপর যদি সে হয় সরকারের পক্ষ থেকে দাওয়াতপ্রাপ্ত। তাহলে তো কথাই নেই! ‘ওয়াফ্দ’-এর মাঝে এ বিষয়টিও থাকে যে, তারা দরবারে গিয়ে নিজ কওমের পক্ষ থেকে প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়টিই একটি হাদীসে এসেছে-
الْحَاجّ وَفْدُ اللهِ، وَالْحَاجّ وَفدُ
أَهْلِه. مرسلا عن أبي قلابة، بإسناد رجاله ثقات.
অর্থাৎ, হাজ্বী আল্লাহর মেহমান। এবং নিজের ‘আহলের’ পক্ষ থেকে প্রতিনিধি। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১২৬৫৯
সুতরাং যিলহজ্বের আমলের মধ্যে আল্লাহর মেহমান-হাজ্বীদের খেদমতকে আমরা গনীমত মনে করি। আর হাজ্বীদের (যমযম পান করানোর) খেদমতকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমালুন ছালিহুন-নেক আমল’ বলেছেন। এমনকি নিজেও উক্ত খেদমতে শরীক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে-
ثُمّ أَتَى زَمْزَمَ وَهُمْ يَسْقُونَ
وَيَعْمَلُونَ فِيهَا، فَقَالَ: اعْمَلُوا فَإِنّكُمْ عَلَى عَمَلٍ صَالِحٍ ثُمّ
قَالَ: لَوْلاَ أَنْ تُغْلَبُوا لَنَزَلْتُ، حَتّى أَضَعَ الحَبْلَ عَلَى هَذِهِ
يَعْنِي: عَاتِقَهُ، وَأَشَارَ إِلَى عَاتِقِهِ.
অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যমযমের কাছে আসলেন। দেখলেন, লোকেরা হাজ্বীদের যমযম পান করানোর খেদমতে নিয়োজিত। এ দেখে তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের কাজে ব্যস্ত থাকো; কারণ, তোমরা নেক কাজের মধ্যে রয়েছ। যদি এ কাজে আমার উপস্থিতির কারণে লোকদের ভিড় বেড়ে গিয়ে তোমাদের কাজে ব্যাঘাৎ হওয়ার আশংকা না হত তাহলে আমি কূপ থেকে পানি তোলার রশি এখানে চড়িয়ে নিতাম, অর্থাৎ নিজ কাঁধে উঠিয়ে নিতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৬৩৫
আর যাদের হজ্বে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তারা আরো বেশি করে হজ্বগামীদের খেদমত করি। কারণ, হতে পারে এর ওসিলায় আল্লাহ আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবেন, হজ্বের তাওফীক দান করবেন।
আশারায়ে যিলহজ্ব : আল্লাহ কসম করেছেন যে দশ রাতের
আমরা জেনেছি, যিলহজ্ব মাস আশহুরে হুরুম তথা সম্মানিত চার মাসের অন্যতম প্রধান মাস। আবার এ মাসের মধ্যে প্রথম দশক হল প্রধান। এ দশক এতটাই ফযীলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত যে, আল্লাহ তাআলা এ দশ রাতের কসম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ الْفَجْرِ، وَ لَیَالٍ عَشْرٍ.
শপথ ফযরের, শপথ দশ রাত্রির। -সূরা ফাজ্র (৮৯) : ১-২
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও মুজাহিদ রাহ.-সহ অনেক সাহাবী, তাবেঈ ও মুফাসসির বলেন, এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা যিলহজ্বের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫
এ দশককে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন বলা হয়েছে। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَفْضَلُ أَيّامِ الدّنْيَا أَيّامُ
الْعَشْرِ، عَشْرِ ذِي الْحِجّةِ، قَالَ: وَلَا مِثْلُهُنّ فِي سَبِيلِ اللهِ؟
قَالَ: لَا مِثْلُهُنّ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ عَفّرَ وَجْهَهُ فِي
التّرَابِ.
দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হল, যিলহজ্বের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর রাস্তায়ও কি তার সমতুল্য নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায়ও তার সমতুল্য নেই। তবে ঐ ব্যক্তি, যার চেহারা ধূলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত লাভ করেছে। -মুসনাদে বাযযার, হাদীস ১১২৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২০১০; মাজমাউল যাওয়াইদ ৪/৮; (قال الهيثمي : إسناده حسن ورجاله ثقات)
সম্মানিত মাস সম্মানিত দশক
গুনাহের মাধ্যমে এর সম্মান বিনষ্ট না করি
মুমিন তো আল্লাহর দেওয়া বিভিন্ন সুযোগকে গনীমত মনে করে কাজে লাগায়। এসকল ফযীলতপূর্ণ মওসুমে নেক আমলের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে তার আমলের খাতা। কিন্তু কখনো কখনো কারো দ্বারা এমন হয়ে যেতে পারে যে, নেক আমলের তো তাওফীক হল না; কিন্তু গুনাহের কালিমায় কলুষিত হল আমলনামা। এমনটি কখনোই কাম্য নয়। এক কবি বড় সুন্দর বলেছেন-
قوت نيکی نداری بد مکن
নেক আমল করতে যদি নাও পার, গুনাহে লিপ্ত হয়ো না।
নেক আমল যতটুকু করতে পারি-না পারি; গুনাহের মাধ্যমে যেন এ সম্মানিত দিনগুলোর অসম্মান না করি। এর মাধ্যমে তো আমি নিজেকেই অসম্মানিত করছি।
ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. লাতাইফুল মাআরিফে যিলহজ্বের আলোচনায় বলেন-
احذروا المعاصي فإنها تحرم المغفرة في
مواسم الرحمة.
রহমতের মওসুমসমূহে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে। -লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ৩৭৯
আর যে আয়াতে আল্লাহ তাআলা চারটি মাসকে সম্মানিত ঘোষণা করেছেন সে আয়াতের শেষে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ
(...তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত) ...সুতরাং এ মাসসমূহে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬
আল্লাহর নাফরমানী নিজের উপর সবচেয়ে বড় যুলুম। কারণ, এর ক্ষতি তো নিজের উপরই আপতিত হবে। সুতরাং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এ মাসের প্রথম কাজ, সাথে সাথে নেক আমলেও যতœবান হওয়া দরকার।
নেক আমলের মাধ্যমে হক আদায় করি এ দশকের
এখন আমরা কীভাবে এ দশকের হক আদায় করতে পারব এবং এর ফযীলত লাভ করতে পারব? হাদীস শরীফে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এ দশকের হক আদায়ের পথ ও পদ্ধতি শিখিয়েছেন। বিভিন্ন আমল বাতলেছেন। এর ফযীলত ঘোষণার মাধ্যমে উৎসাহিত করেছেন আমলের প্রতি। সুতরাং হাদীস শরীফে বর্ণিত আমলের মাধ্যমেই আমরা এ দশকের হক আদায় করতে পারি। আসুন আমরা জেনে নিই কী কী আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে এ দশকের আমল হিসেবে।
যিকির-তাসবীহতে প্রাণবন্ত করি যিলহজ্বের দশককে
যিকির আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয় আমল। এ দশকের আমল হিসেবে বিশেষভাবে যিকিরের কথা এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ أَيّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ
وَلَا أَحَبّ إِلَيْهِ الْعَمَلُ فِيهِنّ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ الْعَشْرِ،
فَأَكْثِرُوا فِيهِنّ مِنَ التّهْلِيلِ وَالتّكْبِيرِ وَالتّحْمِيدِ.
আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহজ্বের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৪৪৬; আদদাআওয়াতুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫৩৪
এছাড়া যিলহজ্বের এ দশকের বিভিন্ন আমলও প্রাণবন্ত থাকে আল্লাহর যিকিরে। হাজ্বীগণ ইহরাম বাঁধার পর থেকে উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে তালবিয়ার মাধ্যমে স্মরণ করতে থাকেন আল্লাহকে। জামরায় কংকর নিক্ষেপের সময়ও বলেন- আল্লাহু আকবার। সারা বিশ্বের মুসলিমগণ আইয়ামে তাশরীকে ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীকের মাধ্যমে আল্লাহর যিকির করেন। কুরবানীর দিন কুরবানী করার সময় বলেন- বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। এমনকি হজ্বের আমলসমূহের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِنّمَا جُعِلَ الطّوَافُ بِالْبَيْتِ
وَبَيْنَ الصّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْيُ الْجِمَارِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللهِ.
নিশ্চয়ই বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সায়ী এবং জামারাতে কংকর নিক্ষেপের আমল বিধিবদ্ধ করাই হয়েছে আল্লাহর যিকিরের জন্য। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৮৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ৯০২
মোটকথা, যিলহজ্বের এ দিনগুলো যেন প্রাণবন্ত থাকে আল্লাহর যিকিরে।
যিলহজ্ব শুরু হলে নখ-চুল না কাটি
আমারও সাদৃশ্য হোক হাজীদের সাথে
ইহরাম করার পর হাজ্বী সাহেবদের জন্য নখ-চুল কাটাসহ আরো কিছু বিষয় নিষেধ। কিন্তু যারা হজ্বে যাননি তাদের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখ-চুল না কাটার মাধ্যমে অন্যরাও সাদৃশ্য অবলম্বন করতে পারে হাজ্বী সাহেবদের সাথে এবং লাভ করতে পারে বিশেষ ফযীলত। হাদীস শরীফে এ আমলের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، أَنّ النّبِيّ صَلّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ: إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجّةِ،
وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ.
উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন যিলহজ্বের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২৩
এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ফকীহগণ কুরবানীকারীর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তাই যিলকদ মাসেই চুল-নখ কেটে যিলহজ্বের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা চাই। যাতে তা বেশি লম্বা হয়ে না যায়, যা সুন্নতের খেলাফ।
আর যে ব্যক্তি কুরবানী করবে না তার জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য কি না- এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, এ হুকুম কেবলমাত্র কুরবানীকারীদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের দলীল পূর্বোক্ত হাদীস। আর কেউ কেউ বলেন, কুরবানী যারা করবে না তাদের জন্যও এ আমল রয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত-
أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلّمَ قَالَ لِرَجُلٍ: أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللهُ
عَزَّ وَجَلّ لِهَذِهِ الْأُمّةِ، فَقَالَ الرّجُلُ: أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ
إِلّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: لَا، وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ
شَعْرِكَ، وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ، وَتَقُصّ شَارِبَكَ، وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ،
فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللهِ عَزّ وَجَلّ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে কুরবানীর দিবসে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে, যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কুরবানী করব? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫
এই হাদীসে যেহেতু কুরবানীর দিন চুল-নখ কাটার কথা আছে তাহলে এর আগে না কাটার দিকে ইঙ্গিত বুঝা যায়।
২. ওলীদ বিন মুসলিম বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে নাফে রাহ. বলেছেন-
أَنّ ابْنَ عُمَرَ، مَرّ بِامْرَأَةٍ
تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِ ابْنِهَا فِي أَيّامِ الْعَشْرِ فَقَالَ: لَوْ أَخّرْتِيهِ
إِلَى يَوْمِ النّحْرِ كَانَ أَحْسَنَ.
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এক নারীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। মহিলাটি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, যদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভাল হত। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫২০
৩. এ সম্পর্কে আরেকটি বর্ণনা হল-
قال مسدد وحدثنا المعتمر بن سليمان التيمي
سمعت أبي يقول: كان ابن سيرين يكره إذا دخل العشر أن يأخذ الرجل من شعره حتى يكره
أن يحلق الصبيان في العشر.
মুতামির ইবনে সুলাইমান আততাইমী বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, ইবনে সীরীন রাহ. যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা অপছন্দ করতেন। এমনকি এই দশকে ছোট বাচ্চাদের মাথা মুÐন করাকেও অপছন্দ করতেন। -আল মুহাল্লা, ইবনে হাযম ৬/২৮
এসব দলীলের কারণে কারো কারো মতে সকলের জন্যই যিলহজ্বে প্রথম দশকে নখ, গোঁফ ও চুল না-কাটা উত্তম। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, এ বিধানটি কুরবানীদাতার জন্য তাকিদপূর্ণ।
যিলহজ্বের প্রথম নয় দিন রোযা রাখি......।
ইয়াওমে আরাফা : গুরুত্ব ও ফযীলত
এ দিন আল্লাহর কাছে অনেক মহিমান্বিত। এদিনেই আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনকে পূর্ণতা দানের ঘোষণা দিয়েছেন এবং বান্দাদের প্রতি তাঁর নিআমতকে পূর্ণ করেছেন। এদিনেই হজ্বের মূল আমল উকূফে আরাফা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ এ দিনের কসম করেছেন। এ দিনের দুআ আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ দুআ। এ দিনের রোযার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার দুই বছরের গুনাহ মাফ করেন। এদিন আল্লাহ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।
যে আয়াত নাযিল হয়েছে ইয়াওমে আরাফায়
আরাফার দিনেই ঐ আয়াত নাযিল
হয়েছে, যে আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনের পূর্ণতাদানের ঘোষণা দিয়েছেন। তারেক ইবনে শিহাব বর্ণনা করেন, এক ইহুদী ওমর ইবনে খাত্তাব রা. কাছে এল এবং বলল-
يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ آيَةٌ فِي
كِتَابِكُمْ تَقْرَءُونَهَا، لَوْ عَلَيْنَا نَزَلَتْ، مَعْشَر الْيَهُودِ،
لَاتّخَذْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ عِيدًا، قَالَ: وَأَيّ آيَةٍ؟ قَالَ: اَلْیَوْمَ
اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ
لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا .
হে আমীরুল মুমিনীন! আপনাদের কিতাবে (কুরআনে) একটি আয়াত রয়েছে, উক্ত আয়াত যদি আমরা ইহুদীদের উপর নাযিল হত তাহলে আমরা ঐ দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতাম। ওমর রা. জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ আয়াত? সে তখন বলল-
اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ
وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا .
[আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিআমত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩]
ওমর রা. বলেন-
إِنِّي لَأَعْلَمُ الْيَوْمَ الّذِي
نَزَلَتْ فِيهِ، وَالْمَكَانَ الّذِي نَزَلَتْ فِيهِ، نَزَلَتْ عَلَى رَسُولِ
اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ فِي يَوْمِ جُمُعَةٍ.
আমি খুব ভালো করে জানি, এ আয়াত কবে নাযিল হয়েছে, কোথায় নাযিল হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হয়েছে এক জুমার দিন, আরাফায় (আশিয়্যাতা আরাফা-আরাফার বিকেলে)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩০১৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮
ইয়াওমে আরাফায় বান্দাকে মুক্তি দেওয়া হয় জাহান্নাম থেকে
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ
يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النّارِ، مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ، وَإِنّهُ
لَيَدْنُو، ثُمّ يُبَاهِي بِهِمِ الْمَلَائِكَةَ، فَيَقُولُ: مَا أَرَادَ
هَؤُلَاءِ؟
আরাফার দিনের মত আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার নিকটবর্তী হন এবং বান্দাদের নিয়ে ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, কী চায় তারা? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৮
জাবের রা. থেকে বর্ণিত আরেক বর্ণনায় রয়েছে-
يَنْزِلُ اللهُ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا
فَيُبَاهِي بِأَهْلِ الْأَرْضِ أَهْلَ السّمَاءِ، فَيَقُولُ: انْظُرُوا إِلَى
عبادي شعثا غبرا ضاحين، جاؤوا مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ يَرْجُونَ رَحْمَتِي،
وَلَمْ يَرَوْا عَذَابِي، فَلَمْ يُرَ يَوْمٌ أَكْثَرُ عِتْقًا من النار من يوم
عرفة.
আল্লাহ তাআলা নিকটতম আসমানে আসেন এবং পৃথিবীবাসীকে নিয়ে আসামেনর অধিবাসী অর্থাৎ ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করেন। বলেন, দেখ তোমরা- আমার বান্দারা উস্কোখুস্কো চুলে, ধুলোয় মলিন বদনে, রোদে পুড়ে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে সমবেত হয়েছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশী। অথচ তারা আমার আযাব দেখেনি। ফলে আরাফার দিনের মত আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৮৫৩
আরাফার দুআ শ্রেষ্ঠ দুআ
ইয়াওমে আরাফায় যে দুআ-যিকির করেছেন নবীগণ
যিলহজ্বের দশকের মধ্যে ইয়াওমে আরাফা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনে দুআ-যিকিরের গুরুত্ব আরো বেশি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নবীগণ এ দিনে যে দুআ-যিকির করেছেন তা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
خَيْرُ الدّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ،
وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِي: لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ
وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ
شَيْءٍ قَدِيرٌ.
শ্রেষ্ঠ দুআ (-যিকির) আরাফার দুআ। এ দিনের দুআ-যিকির হিসেবে সর্বোত্তম হল ঐ দুআ, যা আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ করেছেন। তা হল-
لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا
شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
-জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৮৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৭৭৮
আইয়ামে তাশরীক : এ দিনগুলো পানাহার ও তাকবীর-যিকিরের জন্য
যিলহজ্ব মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখকে পরিভাষায় আইয়ামে তাশরীক বলে। আইয়ামে তাশরীক-এর অন্যতম প্রধান আমল হল, আল্লাহর যিকির-তাকবীর।
হাজ্বীগণ জামারাতে কংকর নিক্ষেপের সময় বলেন- আল্লাহু আকবার। কুরবানীদাতাগণ কুরবানী করার সময় বলেন- বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। প্রতি ফরয নামাযের পর হাজ্বীগণসহ সারা বিশ্বের মুসলিম তাকবীরে তাশরীক বলে। এভাবে যিকির-তাকবীরে জীবন্ত থাকে আইয়ামে তাশরীক। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ اذْكُرُوا اللهَ فِیْۤ اَیَّامٍ
مَّعْدُوْدٰتٍ.
তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর। -সূরা বাকারা (২) : ২০৩
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এখানে اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ দ্বারা উদ্দেশ্য- আইয়ামে তাশরীক। (দ্র. সহীহ বুখারী, বাবু ফাদলিল আমাল ফী আইয়ামিত তাশরীক; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, হাদীস ১০৮৭২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَيّامُ التّشْرِيقِ أَيّامُ أَكْلٍ،
وَشُرْبٍ، وَذِكْرِ اللهِ.
আইয়ামে তাশরীক পানাহার ও আল্লাহর যিকিরের জন্য। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৭২২
এই দিনগুলোতে সাহাবায়ে কেরাম সর্বদা আল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন। হযরত ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের সুর তুলত। ইবনে ওমর রা. পথে-ঘাটে, হাঁটা-বসায়, বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে তাকবীর বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলো তো তাঁর তাকবীরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবীরে মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন। -সহীহ বুখারী-ফাতহুল বারী ২/৫৩০-৫৩৬
সার্বক্ষণিক যিকির ও তাকবীরের আমল ছাড়াও আশারায়ে যিলহজ্ব ও আইয়ামে তাশরীক-এই তের দিনের প্রায় প্রতিটি ইবাদত ও আমলের সাথে যিকির ও তাকবীরকে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যেন সব আমল-ইবাদতের মূল কথা হল যিকরুল্লাহ, তাকবীর ও তাওহীদ।
তাকবীরে তাশরীক : যে যিকির গুঞ্জরিত হয় পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে
তালবিয়া উচ্চারিত হচ্ছে হাজ্বীগণের মুখে, শুধু মক্কায়। কুরবানীদাতার মুখে- বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। কিন্তু তাকবীরে তাশরীক এমন এক যিকির, যা দ্বারা গুঞ্জরিত হয় মক্কাসহ পৃথিবীর প্রতিটি জনপদ। এ যিকির উচ্চারিত হয়, প্রতিটি মসজিদে, প্রতিটি মুসলিমের ঘরে; প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর, নারী-পুরুষ সকলের মুখে। তাকবীরে তাশরীকের পুরো বাক্যজুড়ে রয়েছে তাওহীদ, আল্লাহর বড়ত্ব ও প্রশংসা-
اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ
إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلهِ الْحَمْدُ
৯ যিলহজ্ব ফজর হতে ১৩ যিলহজ্ব আসর পর্যন্ত মোট তেইশ ওয়াক্তের নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। জামাতে নামায পড়া হোক বা একাকি, পুরুষ বা নারী, মুকীম বা মুসাফির সকলের উপর ওয়াজিব। এমনকি ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত কোনো নামায কাযা হয়ে গেলে এবং ঐ কাযা এই দিনগুলোর ভিতরেই আদায় করলে সে কাযা নামাযের পরও তাকবীরে তাশরীক পড়বে। পুরুষগণ তাকবীর বলবে উচ্চ আওয়াজে আর নারীগণ নি¤œস্বরে।
ইয়াওমুন নাহ্র : সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত দিন এটি
দশ যিলহজ্ব ইয়াওমুন নাহর-কুরাবানীর দিন। এ দিন হাজ্বী সাহেবান মিনায় কুরবানী করেন আর সারা বিশ্বের মুসলিমগণ নিজ নিজ দেশে কুরবানী করেন। এ দিনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত দিন বলেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে কুরত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إنّ أَعْظَمَ الْأَيّامِ عِنْدَ اللهِ
يَوْمُ النّحْرِ، ثُمّ يَوْمُ الْقَرِّ.
নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন ইয়াওমুন নাহর-দশ যিলহজ্ব। তারপর ইয়াওমুল কার-এগার যিলহজ্ব; যেদিন মানুষ মিনায় অবস্থান করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৭৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯০৭৫
বিদায় হজ্বে ইয়াওমুন নাহরের ভাষণে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلَا إِنّ أَحْرَمَ الْأَيّامِ يَوْمُكُمْ
هَذَا.
জেনে রাখো, তোমাদের এ দিন (ইয়াওমুন নাহর) সবচেয়ে সম্মানিত দিন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৯৩১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৭৬২
এ দিন আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশিত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ
اللهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمّةِ.
আমাকে ‘ইয়াওমুল আযহা’র আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে); এ দিবসকে আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫
ঈদুল আযহার কিছু সুন্নত ও আদব
ঈদুল আযহার দিন নামাযের পরে খাব
এমন করাই মুস্তাহাব। সহজে সম্ভব হলে এ মুস্তাহাব আমলের প্রতি লক্ষ্য রাখাই ভালো।
আব্দুল্লাহ ইবনে বুরাইদা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-
كَانَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلّمَ لَا يَخْرُجُ يَوْمَ الفِطْرِ حَتّى يَطْعَمَ، وَلَا يَطْعَمُ يَوْمَ
الأَضْحَى حَتّى يُصَلِّيَ.
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন কোনো কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। আর ঈদুল আযহার দিন নামায না পড়ে কিছু খেতেন না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৪২
কোনো বর্ণনায় আছে-
وَلَا يَطْعَمُ يَوْمَ النّحْرِ حَتّى
يَذْبَحَ.
আর কুরবানী ঈদের দিন যবেহ করার আগে কিছু খেতেন না। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৪২৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৬১৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩০৪২
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে-
وَلَا يَأْكُلُ يَوْمَ الْأَضْحَى حَتّى
يَرْجِعَ فَيَأْكُلَ مِنْ أُضْحِيّتِهِ.
আর ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহ থেকে ফেরার আগে কিছু খেতেন না; (কুরবানীর পশু যবেহ হওয়ার পর) নিজ কুরবানীর পশুর গোস্ত থেকে খেতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৯৮৪; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ১৭১৫; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার, হাদীস ৬৮৪৬
সশব্দে তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যাব
নাফে রাহ. ইবনে ওমর রা.-এর আমল বর্ণনা করেন-
أَنّهُ كَانَ إِذَا غَدَا يَوْمَ
الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ يَجْهَرُ بِالتّكْبِيرِ حَتّى يَأْتِيَ الْمُصَلّى
ثُمّ يُكَبِّرُ حَتّى يَأْتِيَ الْإِمَامُ.
ইবনে ওমর রা. ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের সকালে সশব্দে তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যেতেন এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবীর বলতে থাকতেন। -সুনানে দারাকুতনী, বর্ণনা ১৭১৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৬১২৯
প্রথমে ঈদের নামায তারপর কুরবানী করব
বারা ইবনে আযিব রা. বলেন-
خَطَبَنَا النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلّمَ يَوْمَ النّحْرِ، قَالَ: إِنّ أَوّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا
هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمّ نَرْجِعَ، فَنَنْحَرَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ
أَصَابَ سُنّتَنَا، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ، فَإِنّمَا هُوَ لَحْمٌ
عَجّلَهُ لِأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ النّسُكِ فِي شَيْءٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে খুতবা দিলেন। তাতে বললেন, আমাদের এই দিবসে প্রথম কাজ নামায আদায় করা, এরপর কুরবানী করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরীকা মতো হবে। আর যে আগেই যবেহ করেছে (তার কাজ তরীকা মতো হয়নি অতএব) তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কুরবানী নয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬১; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৯০৭
ঈদের দিন একে অপরের সাথে দেখা হলে বলব...
জুবায়ের ইবনে নুফাইর রাহ. বলেন-
كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللّهِ صَلّى
اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا الْتَقَوْا يَوْمَ الْعِيدِ يَقُولُ بَعْضُهُمْ
لِبَعْضٍ تَقَبّلَ اللّهُ مِنّا وَمِنْكَ.
সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন-
تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكَ.
আল্লাহ কবুল করুন আমাদের পক্ষ হতে ও আপনার পক্ষ হতে। -ফাতহুল বারী ২/৫১৭
যবেহের সময় এই দুআ পড়ব
জাবির রা. থেকে বর্ণিত-
ذَبَحَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلّمَ يَوْمَ الذّبْحِ كَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ مُوجَأَيْنِ،
فَلَمّا وَجّهَهُمَا قَالَ إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي...
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন দু’টি সাদা-কালো, বড় শিং বিশিষ্ট, খাসি দুম্বা যবেহ করেছেন। যখন তিনি তাদের শায়িত করলেন তখন বললেন-
إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي فَطَرَ
السّموَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلّةِ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ
الْمُشْرِكِينَ، إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ
الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ
الْمُسْلِمِينَ، اللّهُمّ مِنْكَ وَلَكَ، وَعَنْ مُحَمّدٍ وَأُمّتِهِ بِاسْمِ اللهِ،
وَاللهُ أَكْبَرُ.
এরপর যবেহ করলেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫০২২; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৭১৬
সুতরাং আমরা যবেহ-এর সময় বলব-
إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي فَطَرَ
السّموَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلّةِ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ
الْمُشْرِكِينَ، إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ
الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ
الْمُسْلِمِينَ، اللّهُمّ مِنْكَ وَلَكَ،بِاسْمِ اللهِ، وَاللهُ أَكْبَرُ.
অহেতুক কষ্ট দেয়া ছাড়া সুন্দরভাবে যবেহ করব
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওছ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى
كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ
فَأَحْسِنُوا الذّبْحَ، وَلْيُحِدّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ
ذَبِيحَتَهُ.
আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর। যখন যবেহ করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে যবেহ কর। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে এবং তার পশুকে শান্তি দিবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৫৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮১৫; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৪০৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪০৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৭০
কুরবানীর পশুর গোশত : নিজে খাব অন্যদের খাওয়াব
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ الْبُدْنَ جَعَلْنٰهَا لَكُمْ مِّنْ
شَعَآىِٕرِ اللهِ لَكُمْ فِیْهَا خَیْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَیْهَا
صَوَآفَّ، فَاِذَا وَجَبَتْ جُنُوْبُهَا فَكُلُوْا مِنْهَا وَ اَطْعِمُوا
الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ، كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ
تَشْكُرُوْنَ.
কুরবানীর উট (ও গরু)কে তোমাদের জন্য আল্লাহর ‘শাআইর’ (নিদর্শনাবলি)-এর অন্তর্ভুক্ত করেছি। তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং যখন তা সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো থাকে, তোমরা তার উপর আল্লাহর নাম নাও। তারপর যখন (যবেহ হয়ে যাওয়ার পর) তা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার গোশত হতে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও, এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৬
জাবির রা. থেকে বর্ণিত-
أَنّهُ نَهَى عَنْ أَكْلِ لُحُومِ
الضّحَايَا بَعْدَ ثَلَاثٍ، ثُمَّ قَالَ بَعْدُ: كُلُوا، وَتَزَوّدُوا،
وَادّخِرُوا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (বিশেষ একটি কারণে) তিন রাত পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বলেন, ‘খাও, পাথেয় হিসাবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর এক বর্ণনায় আছে-
فَكُلُوا وَادّخِرُوا وَتَصَدّقُوا.
‘খাও, সংরক্ষণ কর এবং সদকা কর।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭১
কুরবানীর পশুর গোশত-চামড়া দ্বারা কসাইয়ের পারিশ্রমিক দিব না
আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-
أَمَرَنِي رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ أَقُومَ عَلَى بُدْنِهِ، وَأَنْ أَتَصَدّقَ بِلَحْمِهَا
وَجُلُودِهَا وَأَجِلّتِهَا، وَأَنْ لَا أُعْطِيَ الْجَزّارَ مِنْهَا، قَالَ:
نَحْنُ نُعْطِيهِ مِنْ عِنْدِنَا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর (কুরবানীর উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজেদের পক্ষ থেকে দিব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭১৬
সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও কি মুসলিম কুরবানী থেকে বিরত থাকতে পারে?
ছাহেবে নেসাবের উপরই কেবল আল্লাহ কুরবানী ওয়াজিব করেছেন। যার সামর্থ্য নেই তার উপর তো কুরবানী ওয়াজিব নয়। আর অর্থ-সামর্থ্য তো আল্লাহ দান করেন। আল্লাহর দেওয়া সম্পদ থেকেই তো আমরা কুরবানী করি। এটি তাঁর দানের শুকরিয়া। এখন সামর্থ্য থাকার পরও যদি কোনো মুসলিম কুরবানী না করেন সেটা হবে আল্লাহর দানের নাশোকরি। এর পরিণাম ভয়াবহ। এজন্যই কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন দয়ার নবী। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ،
فَلَا يَقْربَنّ مُصَلّانَا.
সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৩; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ৪৭৪৩
একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য কুরবানী করব
যাকে আল্লাহ কুরবানী করার তাওফীক দিয়েছেন তার উচিত একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার উদ্দেশ্যে কুরবানী করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَنْ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا
دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ .
আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোস্ত আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭
আসুন, গোনাহ থেকে বেঁচে থেকে এ মাসের সম্মান রক্ষা করি। নেক আমলের মাধ্যমে এ মাসের যথাযথ কদর করি। তাকবীর-তাসবীহ-যিকিরে প্রাণবন্ত করি এ মাসকে। তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে ধন্য হই ক্ষমা লাভে। একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য হজ্ব-কুরবানীসহ অন্যান্য আমল করি। যিলহজ্বের রোযার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করি নেক আমলের ভাণ্ডার। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
মাসিক আলকাউসার।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেনঃ হাফেজ মাওলানা শুআইব মাহদী মাহী
মুহাদ্দিস, 'মুসলিম বাংলা' হাদীস বিভাগ।
No comments