হে আল্লাহ! রমজানই হোক বান্দার গোনাহ মাফের বসন্তকাল

রমজানই ইবাদতের মৌসুম। রমজানই গোনাহ মাফের বসন্তকাল। বছরের সেরা ফজিলতের মাসও এটি। মাসের রোজা পালন, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, দান-সাদকা-ফেতরা, লাইলাতুল কদর- সব ইবাদতই গোনাহ থেকে মুক্তি লাভের উপায়। সে কারণেই রমজানই একমাত্র মাস, যে মাসটি মুমিন বান্দার জন্য গোনাহ থেকে মুক্তি লাভের বসন্তকাল।

মাসের প্রতিটি ইবাদতে মানুষের আগের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেয় বলে ঘোষণা দেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মাসে মুমিন মুসলমান সাহরি গ্রহণ, রোজা পালন, ইফতার, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, তাওবাহ-ইসতেগফার দোয়ার মাধ্যমে জীবনের সব গোনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারে।

রোজাদারের গোনাহ থেকে মুক্তি লাভের অনেক উপলক্ষ রয়েছে। তাই রোজাদার মাসে নিজেদের গোনাহ থেকে মুক্ত করতে না পারলে রয়েছে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিশাপের ঘোষণা। কারণ রমজানের প্রতিটি কাজের সঙ্গেই রয়েছে গোনাহ থেকে মুক্তি লাভের উপলক্ষ্য। রোজাদারের জন্য দুঃসংবাদ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন- একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে আরোহন করেই বললেন- আমিন! আমিন!! আমিন!!! তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এটা কী করলেন? জবাবে প্রিয় নবি বললেন, এই মাত্র জিবরিল আলাইহিস সালাম আসলেন এবং বললেন, তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যে তার বাবা-মা দুজনকে বা তাদের কোনো একজনকে পেল অথচ তারা তার জান্নাতে প্রবেশের কারণ হলো না। আমি বললাম- আমিন (অর্থাৎ তাই হোক)
অতঃপর দ্বিতীয় বার তিনি (জিবরিল) বললেন ধুলায় ধূসরিত হোক তার নাক, যে রমজান মাস পেল অথচ তার মাগফেরাত হলো না। আমি বললাম- আমিন। অতঃপর তিনি বললেন, ধুলায় ধূসরিত হোক তার নাক, যার সামনে আপনার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো অথচ সে আপনার প্রতি সালাম পাঠালো না। তখনও আমি বললাম- আমিন।' (আদাবুল মুফরাদ)

সুতরাং বোঝা গেল রমজান মাস দোয়া কবুল আত্মশুদ্ধির মাস। ক্ষমা লাভের মাস। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাস। মর্যাদা বাড়ানোর মাস। সুতরাং মুমিন মুসলমানের হৃদয় আত্মায় যে গোনাহ পাপ-পঙ্কিলতা জম্মেছে তা থেকে ক্ষমা লাভে রোজা পালন, ইফতার, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, সাহরি লাইলাতুল কদর সন্ধাদনে গোনাহ থেকে ক্ষমা লাভে চেষ্ট করা। হাদিসে এসেছে-
-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করছেন, 'তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। তাদের একজন হলেন রোজাদার ব্যক্তি।'

- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন- ‘রোজাদারের ঘুমও ইবাদততুল্য, চুপ থাকা তাসবিহ-তাহলিল তুল্য, আমল ইবাদত সওয়াব হাসিলে বেশি অগ্রগণ্য, দোয়া কবুলযোগ্য তার গোনাহ ক্ষমার যোগ্য।’ (বায়হাকি)

মাসটিকে গোনাহ মাফের বসন্তকাল করতেই প্রিয় নবি ঘোষিত ইবাদতে কাটানোই সর্বোত্তম। তাই বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা জরুরি। হাদিসের ঘোষণাগুলো হলো-

>> রমজানের রোজা পালন

গিবত, পরনিন্দা, জুলুম-অত্যাচার, অন্যায় অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থেকে ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা যথাযথভাবে পালন করায় রয়েছে গোনাহ থেকে মুক্তি লাভের ঘোষণা। হাদিসে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ايْمَانًا وَ اِحْتِسَابًا غُفِرَلَهُ مَا تَقَدَّم مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থাৎ 'যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা পালন করে, তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।' (বুখারি মুসলিম)

>> রমজানের রাতের নামাজ
রমজান মাসে কিয়ামুল লাইল বা রাতের নামাজ (তারাবিহ তাহাজ্জুদ) আদায় করা। কেননা রোজাদার ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের নিয়তে রমাজানের রাতের নামাজে তারাবিহ তাহাজ্জুদ আদায় করলে তার গোনাহ মাফ হয়ে যায়। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ ايْمَانًا وَ اِحْتِسَابًا غُفِرَلَهُ مَا تَقَدَّم مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থাৎ 'যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের আশায় রমজানের রাতে নামাজ আদায় করে, তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।' (বুখারি মুসলিম)

>> কদরের রাতের নামাজ
হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত হলো লাইলাতুল কদর। ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের নিয়তে রাতে বেশি বেশি নামাজ আদায় করলে আল্লাহ তাআলা বান্দার আগের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَنْ قَامَ لَيْلَةُ الْقَدْرِايْمَانًا وَ اِحْتِسَابًا غُفِرَلَهُ مَا تَقَدَّم مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থাৎ 'যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের আশায় (রমজানের) লাইলাতুল কদরে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।' (বুখারি মুসলিম)

হাদিসে নির্দেশিত ইবাদতগুলোর পাশাপাশি রমজানের রোজা পালনের সঙ্গে সঙ্গে গোনাহ মাফের ছোট ছোট আবেদনগুলো করা। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়াগুলো পড়ার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন-

- رَبِّ اغْفِرْلِىْ وَتُبْ عَلَيَّ اِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الْغَفُوْرُ
উচ্চারণ- ‘রাব্বিগফিরলি, ওয়া তুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আংতাত তাওয়াবুল গাফুর।

অর্থ : পরওয়াদেগার! তুমি আমাকে মাফ কর এবং আমার তাওবা কবুল কর। কেননা তুমি হলে তাওবা কবুলকারী এবং ক্ষমাকারী। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ মিশকাত)

অতপর হজরত আদম হাওয়া আলাইহিস সালাম-এর ঐতিহাসিক ক্ষমা লাভের দোয়াটি বেশি বেশি পড়া-
- رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
উচ্চারণ : 'রাব্বানা জ্বালামনা আংফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।'
অর্থ : 'হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব।' (সুরা আরাফ : আয়াত ২৩)

- اَللَّهُمَّ اِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি।
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাকে ভালোবাসেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।'

- اَللَّهُمَّ اِنِّى اَسْئَلُكَ الْهُدَى وَ التُّقَى وَ الْعَفَافَ وَالْغِنَى
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা ওয়াত্তুক্বা ওয়াল আফাফা ওয়াল গিনা।
অর্থ : 'হে আল্লাহ! আপনার কাছে হেদায়েত চাই, আপনার ভয় চাই, রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি চাই, সচ্ছলতা কামনা করি।'

- رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ
উচ্চারণ : 'রাব্বানা আমান্না ফাগফিরলানা ওয়ারহামনা ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন।'
অর্থ : 'হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অতএব তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর আমাদের প্রতি রহম কর। তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু।' (সুরা মুমিনুন : আয়াত ১০৯)

- رَّبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ
- উচ্চারণ : 'রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতা খায়রুর রাহিমিন।'
অর্থ : 'হে আমার পালনকর্তা, ক্ষমা করুন রহম করুন। রহমকারীদের মধ্যে আপনি শ্রেষ্ট রহমকারী।' (সুরা মুমিনুন : আয়াত ১১৮)

ঈমানদার বান্দা হজরত মুসা আলাইহিস সালামের দোয়াটির মাধ্যমে নিজেদের গোনাহ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে। আর তাহলো-
- رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
উচ্চারণ : রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি ফাগাফারা লাহু ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিম।
অর্থ : ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা কাসাস : ১৫-১৬)

সুতরাং রমজানে প্রত্যেক রোজাদার গোনাহ থেকে মুক্তি লাভ হৃদয়ের গভীর আকুলতা, আন্তরিকতা আশাবাদ নিয়ে তাওবা করবে। এভাবে বেশি বেশি তাওবা করতে থাকরে আল্লাহ তাআলার জন্য ক্ষমার দরজা খুলে দেন। তখন গোনাহ থেকে মুক্তি লাভে মাসটি হয়ে যায় বান্দার জন্য সত্যিকারের বসন্তকাল।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাওবাহ-ইসতেগফারের মাধ্যমে গোনাহ থেকে মুক্তি লাভে মাসটিকে বসন্তকালে পরিণত করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-হাদিসে বর্ণিত ক্ষশা লাভের দোয়া ইসতেগফারগুলো পড়ার তাওফিক দান করুন। রমজানই হোক মুমিন বান্দার জন্য গোনাহ থেকে ক্ষমা লাভের বসন্তকাল। আমিন।

No comments

Powered by Blogger.