বাবা ও সন্তানের ভালোবাসা এমনই হওয়া চাই...
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক অবলম্বনে ‘তোমার সন্তানও তোমাকে এভাবে ভালোবাসবে ...’ শিরোনামের লেখাটি আজও মনে পড়ে। কিছু কিছু স্ট্যাটাস বার বার পড়লেও মনে হয় আবার পড়ি, এ স্ট্যাটাসটিও এমনই। তাছাড়া সহকর্মী টিটু ভাইয়ের বাবার মৃত্যুতে তার দেয়া স্ট্যাটাসটিও ছিল অসাধরণ, হৃদয়ের দরদমাখা আকুতি...। পাঠকের জন্য তা তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। তাতেও যদি বাবার প্রতি ভালোবাসার একটু হক আদায় হয়, বাবা হারানো সন্তান যদি ফিরে পায় একটু শীতল অনুভূতি, আবার কোনো অবহেলিত বাবা যদি সন্তানের কাছে ফিরে পায় এক চিলতে ভালোবাসা। সে আশায়...
গত এক বছরে পরিচিত অনেকেই বাবাকে হারিয়েছেন। মিষ্টি হাসির মানুষ, সহকর্মী মুজাহিদুল ইসলাম টিটু ভাইও তাদের একজন। তিনি হারিয়েছেন, তার বাবাকে... না ফেরার দেশে যাওয়া বাবাদের আল্লাহ বেহেশত নসিব করুন, আমিন।
বাবার স্মৃতিচারণ করে ফেসবুকে দেয়া টিটু ভাইয়ের দীর্ঘ স্ট্যাটাসটি আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে... তার বাবা ১৯ মার্চ ইন্তেকাল করেছেন। একান্তই ভালোবাসায় ভরপুর ছিল ৩ খণ্ডের বিশাল সে স্ট্যাটাস। তার এক টুকরো ছিল এমন-
'ছোটবেলায় আকাশের সীমানা নিয়া খুব কৌতূহল ছিলো। বাড়ির পিছনে বিলের দিকে তাকাইলে মনে হইতো বিলের শেষে হয়তো আকাশটা নাইমা পড়ছে। আব্বার সঙ্গে মাঝে মাঝে বিলের দিকে যাওয়া হইতো, কিন্তু বিলে যাইয়া মনে হইতো আকাশটা আরো সামনে নামছে।
ছোটবেলায় আমার মনে আব্বার অবস্থান আকাশের মতোই ছিলো। বাজারে গেলে কারো দোকানে আব্বার কথা বললেই যা চাইতাম তাই পাওয়া যাইতো। একটা ছোট বাচ্চার জীবনে আর কী লাগে?
আমার বাড়ি থাইকা অনেকটা দূরে গেলেও লোকে যখন জিগাইতো, তোমার বাপের নাম কী? বাপের নাম বলার পরে, লোকজনে কইতো, ও আইচ্ছা তুমি মাস্টারসাবের পোলা!
আমাদের গ্রাম কিংবা পাশের গ্রামে সালিশি থেকে শুরু কইরা হেন কোন ফাঙ্কশন ছিলো না যেখানে আব্বার অবস্থান ছিলো না। তাই ছোটবেলায় মনে বদ্ধমূল ধারণা হইলো আব্বাই নায়ক!
হুম ছোটবেলায় আব্বাই আমার হিরো ছিলেন।
সেই হিরো চলে গেলেন। যার সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্তও এক বিছানায় ঘুমাইছি, কত কথা, কত তর্ক, কত মান-অভিমান.....
আমার সেই রাগী আব্বা আজ নাই এই দুনিয়ায়।‘
আজকের 'বাবা দিবসে' বাবা হারানো সন্তানদের প্রতি যেমন সমবেদনা তেমনি পরপারে পাড়ি দেয়া বাবাদের প্রতি রইলো আন্তরিক দোয়া-
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’
অর্থ : ‘হে রব! আমার বাবা-মার প্রতি রহম করুন। যেভাবে শৈশবে তারা আমাদের প্রতি রহম দিল ছিল।' আমিন।
দ্বিতীয় স্ট্যাটাস : ‘তোমার সন্তানও তোমাকে এভাবে ভালোবাসবে ...’
কোনো এক হজের সফরে...
বৃদ্ধ এক বাবা তার ছেলেকে নিয়ে উটের পিঠে চড়ে এক কাফেলার সঙ্গে হজের উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর দিকে পথ চলতে শুরু করেন। হঠাৎ পথিমধ্যে বাবা তার ছেলেকে বললেন, বাবা! তুমি কাফেলার সঙ্গে চলতে থাক, আমি আমার প্রয়োজন সেরে তোমাদের সঙ্গে যোগ দেব। আমাকে নিয়ে ভয় পেয়ো না। এ কথা বলে ছেলেকে উটের উপর রেখে বাবা নেমে পড়লেন।
ছেলে উটের পিঠে চড়ে কাফেলার সঙ্গে চলতে থাকল। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কাফেলা পথচলা বন্ধ করে তাঁবু স্থাপন করল। এদিকে বাবা এখনও ফিরে আসেনি। ছেলে তার বাবাকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কাফেলার কোথাও বাবাকে খুঁজে পেলো না।
বাবার সন্ধানে ছেলে...
এবার ছেলে উট ও কাফেলা ফেলে ভয়ে ভয়ে উল্টো পথে পেছনের দিকে বাবার সন্ধানে হাঁটা শুরু করলো।
পেছনে অনেক দূর যাওয়ার পর...
ছেলে দেখলো তার বৃদ্ধ বাবা অন্ধকারে পথ হারিয়ে একা একা বসে আছে। ছেলে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। পরম মমতা ও ভালোবাসায় বাবাকে নিজ কাঁধে উঠিয়ে নিলো। তারপর কাফেলার দিকে চলতে শুরু করলো।
বাবা ছেলেকে বলল...
বাবা! আমাকে নামিয়ে দাও, আমি হেঁটেই যেতে পারবো।
ছেলে বলল, ‘বাবা তোমাকে কাঁধে নিয়ে চলতে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তোমাকে কাঁধে নিয়ে পথচলা এবং আল্লাহর জিম্মাদারি আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে বেশি উত্তম।
বাবার আনন্দ অশ্রু...
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বাবা কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখ থেকে আনন্দ অশ্রু ঝরছে। বাবার চোখের পানি ছেলের মুখের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। ছেলে বুঝতে পারছে যে, তার বাবা কাঁদছেন।
ছেলে তার বাবাকে বলল, বাবা! কাঁদছ কেন? তোমাকে নিয়ে চলতে তো আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না।
বাবার কান্নার কারণ ও অনুভূতি প্রকাশ...
বাবা তার ছেলেকে বলল, তোমার কষ্ট হচ্ছে এ কথা ভেবে আমি কাঁদছি না। বরং আমার কাঁন্নার কারণ হলো-
‘আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগের কথা। আমি যখন তোমার মতো ছোট, তখন এ রাস্তা দিয়েই আমি ও আমার বাবা হজে গিয়েছিলাম। আমি আমার বাবাকে এভাবেই কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।
তখন আমার বাবা ও আমার মধ্যে এ রকম কথা-বার্তাই হয়েছিল। আর বাবা আমার জন্য এই বলে দোয়া করেছিলেন যে- ‘তোমার সন্তানও তোমাকে ভালোবেসে এভাবে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে যাবে।’
আজ বাবার দোয়ার বাস্তবরূপ দেখতে পেয়েই কাঁদছি বাবা!
আমার জন্য বাবার দোয়া কবুল হয়েছে।
শুকরিয়া ও প্রশংসা সেই মহান প্রভুর, যিনি আমার জন্য আমার বাবার দোয়া কবুল করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ স্ট্যাটাস আমাদের এ শিক্ষাই দেয় যে-
যে ছেলে-মেয়ে তার বাবা-মাকে ভালোবাসবে, খেদমত করবে, তাঁদের জন্য দোয়া করবে। তাদের অভাব অনুভব করবে, সেসব ছেলে-মেয়েও একদিন বাবা-মা হবে। তার সন্তানও তাঁকে ভালোবাসবে, সেবা করবে এবং দোয়া করবে।
সুতরাং বৃদ্ধ বয়সে নিজের সুখ শান্তির জন্য হলেও প্রত্যেক সন্তানের উচিত, বাবা-মাকে ভালোবাসা। বাবা-মার সেবা করা। বাবা-মার জন্য দোয়া করা।
সন্তানের জন্য মনে রাখা জরুরি...
বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা, সেবাযত্ন কিংবা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কোনো দিন-ক্ষণ নেই। বাবা-মার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা যেন থাকে প্রতি মুহূর্ত, প্রতিক্ষণ। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণায়, 'বাবা-মা-ই যে দুনিয়াতে সন্তানের জন্য জান্নাত এবং জাহান্নাম। যারা বাবা-মাকে ভালোবাসবে, যত্ন নেবে, তারাই হবে সফলকাম।'
সুতরাং বাবাকে বুঝতে শিখুন, তার শাসনকে ভুল না বুঝে জীবন চলার নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করুন। কাছে না থাকলেও প্রতিদিন একটি বারের জন্য হলেও ফোন দিন। তার খোঁজখবর নিন। বাবাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন। প্রিয় মুহূর্ত আর প্রিয় স্থানগুলোতে চেষ্টা করুন বাবাকেও সঙ্গে রাখবার। কেবল বাবা দিবসকে ঘিরেই যেন বাবার প্রতি কর্তব্যবোধ জাগ্রত না হয়; এ প্রত্যাশা সব সন্তানের প্রতি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে প্রতি মুহূর্তে তাদের বাবা-মার জন্য দোয়া করার তাওফিক দান করুন। তাদের সেবা করার তাওফিক দান করুন। তাদেরকে ভালোবাসার তাওফিক দান করুন। আমিন।
No comments