জান্নাত প্রত্যাশী মুমিনের ২৪ ঘণ্টার কর্মসূচি

মানুষের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। ছোট্ট জীবন শেষে রয়েছে পরকালের সীমাহীন জীবন। যে জীবনের শুরু আছে শেষ নেই। দুনিয়ায় মানুষ নির্দিষ্ট কিছু অবস্থান করেই গ্রহণ করবে মৃত্যুর স্বাদ। দুনিয়াতে মানুষ এক একটি দিন অতিবাহিত করেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কারণেই প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহ আনহু দিন চলে যাওয়া নিয়ে আফসোস করে বলেছেন-
আমি এমন দিনের উপর অনুশোচনা করি যেই দিনের সূর্য ডুবে গেছে, আমার জীবন থেকে একটি দিন কমে গেছে অথচ তাতে আমার আমল বৃদ্ধি পায়নি।

আসলেই তাই, মানুষের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু কাজের পরিধি অনেক বেশি। সে কারণেই পরকালের চূড়ান্ত সফলতায় সংক্ষিপ্ত সময়কে কাজে লাগানো খুব বেশি জরুরি। যার ফলে মানুষ সহজেই দুনিয়ার শান্তি পরকালের মুক্তি লাভে ধন্য হবে।

বছরের প্রথম দিন থেকেই প্রতিটি মানুষকে প্রতিজ্ঞা করা উচিত, প্রতিটি দিনই মানুষ নতুন করে জীবন শুরু করবে। প্রতিটি দিনই জান্নাতের প্রত্যাশায় ভালো কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখবে।

প্রখ্যাত দাঈ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল মাদানি, সর্বস্তরের মুমিন মুসলমানের জন্য ২৪ ঘণ্টার একটি দিক-নির্দেশনামূলক কাজের কর্মসূচি প্রণয়ন করেছেন। সে আলোকেই মুমিন মুসলমান নিজেদের সংক্ষিপ্ত জীবনে সাজিয়ে নিতে পারে। আর তাহলো-

>> ঘুমাতে যাওয়া থেকে ফজর পর্যন্ত করণীয়
-
ঘুমানোর আগে তাহাজ্জুদের নামাজ নফল রোজা রাখার নিয়ত করা।
-
দেরি না করে রাতের প্রথমভাগেই ঘুমিয়ে পড়া।
-
ঘুমানোর আগে ওজু করে জিকির দোয়া পড়ে ঘুমের আদবগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে ঘুমিয়ে পড়া।
-
ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া।
-
ঘুম থেকে জেগে ওঠার শুকরিয়ায় দোয়া পড়া-
الْـحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أمَاتَنَا وإِلَيْهِ النُّشُورُ
উচ্চারণ : ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আহইয়ানা বাদা মা আমাতান ওয়া ইলাইহন নুশুর।
-
ঘুম থেকে উঠে মেসওয়াক করে ওজু করা।
-
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া রাকাআত করে রাকাআত) অতপর বিতর নামাজ পড়া।
-
নফল রোজার নিয়তে সাহরি খাওয়া।
উল্লেখ্য যে, নফল রোজা রাখার উত্তম নিয়ম হলো, এক দিন পরপর এক দিন রোজা রাখা। তা সম্ভব না হলে সপ্তাহে প্রতি সোম বৃহস্পতিবার ২দিন রোজা রাখা। তাও সম্ভব না হলে আরবি মাসের ১৩, ১৪ ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের রোজা রাখা। যদি তাও সম্ভব না হয় তবে মাসের যে কোনো দিন ৩টি রোজা রাখা। কেননা আল্লাহ তাআলা ৩টি রোজার বিনিময় সারা মাস রোজা রাখার সাওয়াব দান করবেন।

>> প্রতিদিন ফজর থেকে সূর্য ওঠা পর্যন্ত করণীয়
-
ফজরের আজান হলে তার উত্তর দেয়া।
-
ফজরের দুই রাকাআত সুন্নাত ঘরে আদায় করা।
-
মসজিদে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়া এবং দোয়া পড়া।
-
মসজিদে প্রবেশ করেই দুই রাকাআত দুখুলিল মসজিদ নামাজ আদায় করা।
-
ঘরে ফজরের সুন্নাত না পড়ে থাকলে মসজিদে গিযে বসার আগেই তা আদায় করা।
-
প্রথম কাতারে ইমামের ডানদিকে বসে নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।
-
জামাআতের সময় হওয়ার আগ পর্যন্ত কুরআন তেলাওয়াত, জিকির, ইসতেগফার, দোয়া ইত্যাদি পড়া এবং ফরজ নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।
-
ফজরের নামাজের ইকামত শুরু হলে তার উত্তর দেয়া।
-
তাকবিরে তাহরিমাসহ অত্যন্ত ভয়-ভীতি, বিনয়, নম্রতা একাগ্রতার সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করা।
-
নামাজ শেষ করার পর যথাস্থানে বসে পরবর্তী দোয়া জিকিরগুলো যথাযথ করা।
-
সূর্য উঠা পর্যন্ত সেখানে বসেই দোয়া, জিকির কুরআন তেলাওয়াতে নিয়োজিত থাকা।
-
সূর্য উঠার কিছুক্ষণ (২০/২৫ মিনিট) পর ইশরাকের নামাজ পড়া। এভাবে ইবাদত বন্দেগিতে রয়েছে একটি পূর্ণ হজ ওমরা ফজিলত।
-
অতপর কুরআনে ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহর জমিনে জীবিকার সন্ধ্যানে নেমে পড়া।

>> সূর্য উঠা থেকে সারাদিনের করণীয়
জীবন জীবিকার তাগিদে যার যার দুনিয়ার কাজ বা দায়িত্ব পালনে নেমে পড়া। হক আদায় করে যার যার দায়িত্ব পালন করা। কেননা সব দায়িত্ব পালনও যেন আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে পরিণত হয়। কাজের সময়গুলোতে রয়েছে কিছু করণীয়-
-
যার যার দায়িত্ব যথাযথ পালন করা। তা হতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি কিংবা অন্য যে কোনো পেশার কাজ।
-
নামাজের ওয়াক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যথাসময়ে জামাআতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা। ক্ষেত্রে নারীরা স্ব স্থানে আর পুরুষরা মসজিদে গিয়ে তাকবিরে তাহরিমার সঙ্গে নামাজ আদায় করা।
-
ফরজ নামাজের আগের পরের সুন্নাত নামাজ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করা।
-
জোহরের নামাজে প্রায় এক/দেড় ঘণ্টা আগে রাকাআত করে সালাতুজ জোহা বা চাশত/আওয়াবিনের নামাজ আদায় করা। এক্ষেত্রে রাকাআত নামাজ পড়া উত্তম।
-
পুরো দিনে কমপক্ষে পারা কুরআন পড়া জরুরি। এতে মাসে পুরো কুরআন তেলাওয়াত সম্পন্ন হয়ে যাবে। পাশাপাশি সাধ্যমতো কুরআনের অনুবাদ তরজমা পড়ে নাজিলের কারণগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করে জীবন গড়া।
-
প্রতিদিন আমলের নিয়তে কমপক্ষে /৩টি হাদিস অনুবাদসহ পড়া। এক্ষেত্রে হাদিস সংকলনের বিখ্যাত গ্রন্থ রিয়াদুস সালেহিন অধিক উপযোগি।
-
প্রতিদিন সাধ্যমতো গরিব দুঃখীদের আর্থিক সহায়তা করা কিংবা তাদের খাবার খাওয়ানো। এটি মহান আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয় ইবাদত।
পরিবার আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশিদের কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া। তার খেদমত করা। তার জন্য দোয়া করা এবং তাকে সান্ত্বনা দেয়া।
-
কেউ মার গেলে তার জানাজায় অংশগ্রহণ করা। সম্ভব হলে দাফন প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করা।
-
নিকটাত্মীয় বা দ্বীনি ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে দ্বীনি আলোচনা নসিহত করা।
-
একাকি কিংবা কাউকে সঙ্গে নিয়ে কবর কবের জেয়ারত করা এবং মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা। তবে প্রতিদিন নিয়ম করে কবরস্থানে না গিয়ে মাঝে যাওয়াই উত্তম।
-
প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলো দ্বীন ঈমানি বিষয়ে মানুষের মাঝে দাওয়াতি কাজ করা। বেনামাজি ব্যক্তিকে নামাজের উপদেশ দেয়া এবং কুরআন সুন্নাহভিত্তিক ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতেই মানুষের মাঝে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করা।
-
সমাজে কোনো অন্যায় বা গোনাহের কাজ ঘটতে দেখলে তা বাধা দেয়া। সম্ভব না হলে মুখে তা থেকে বিরত থাকতে বলা। যদি তাতেও অপরাগ হয় তবে নিরবে তা বন্ধে কাজ করে যাওয়া। হাদিসে যেটিকে মনে মনে ঘৃণা করতে বলা হয়েছে। আসলে সেটি হবে নিরবে অন্যায় বন্ধে কাজ করে যাওয়া। আর এটিকে হাদিসের ভাষায় দুর্বল ঈমান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
-
মানুষের সাথে সব সময় চলাফেরা উত্তম আচরণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখানো।
-
যত ব্যস্ততা বা হতাশাই থাকুক না কেন সব সময় হাসি মুখে কথা বা ভাব বিনিময় করা। সুন্দর মিষ্টি ভাষায় কথা বলা, বিনয় নম্রতা দেখানো। সবেই রয়েছে সদকার সাওয়াব।

>> সন্ধ্যা থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত করণীয়
-
আসরের নামাজের পর থেকে সূর্যাস্ত মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত সময় তাসবিহ, দোয়া জিকির-আজকার করা।
-
কোনো মসজিদ বা দ্বীনি মারকাজে আলেম-ওলামার ইসলামি দরসে অংশগ্রহণ করা। নেক কাজের নিয়তে সাদেকিন বা সত্যবাদীদের সংস্পর্শে কিছু সময় অতিবাহিত করা।
-
রোজাদার হলে ইফতার সামনে নিয়ে বসা এবং সময় হওয়ার পর ইফতার করা।
-
মাগরিবের নামাজ জামাআতের সঙ্গে মসজিদে আদায় করা।
-
মাগরিবের জামাআত দেরিতে শুরু হলে কিংবা সময় পাওয়া গেলে জামাআতের আগে রাকাআত নফল পড়ে নেয়া।
-
মাগরিব ইশার নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে কিছু নফল নামাজ আদায় করা। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ে নফল নামাজ পড়ার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। সময়টি মানুষ বেহুদা কথা বার্তা বা অবহেলায় কাটিয়ে দেয়।
-
ইশার নামাজ জামাআতের সঙ্গে আদায় করা এবং নামাজের পর দিনের কর্মব্যস্ততা কিংবা সারাদিনের ভালো-মন্দ কর্মকাণ্ড নিয়ে ইহতিসাব বা আত্ম-সমালোচনা করা।
-
সারাদিনের মন্দ বা ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা-ইসতেগফার করা এবং ভালো কাজগুলো জন্য শুকরিয়া আদায় করা।
-
পরবর্তী দিনটিতে যেন আমলের উন্নতি হয় সে জন্য আল্লাহর কাছে মিনতি-রোনাজারি সাহায্য প্রার্থনা করা এবং বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফার করা।

- দিন শেষে সময় বের করে স্ত্রীকে সময় দেয়া। তার সঙ্গে দ্বীনি আলোচনা তথা খোশগল্প করা। তাদের কাজে সহায়তা করা। অতঃপর অযথা দেরি না করে রাতের ইবাদতের নিয়েতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নতুন বছরের শুরুতেই প্রতিদিন আমলি জীবন-যাপনের প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ থাকার তাওফিক দাক করুন। দুনিয়ার কল্যাণ পরকালের নাজাতের তাওফিক দান করুন। আমিন।

No comments

Featured Post

আরাফার ময়দানের শ্রেষ্ঠ দোয়া The best dua of Araf Maidan

আরাফাতের দিনের শ্রেষ্ঠ দোয়া জিলহজ মাসের ৯ তারিখকে বলা হয় ইওয়ামে আরাফা বা আরাফা দিবস। এ দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান কর...

Powered by Blogger.