অল্পে তুষ্টি (পর্ব ৩)
ইমাম
কুরতুবী (রহঃ)
বলেন, অল্পে
তুষ্টি ও
যুহ্দ (দুনিয়া
বিমুখতা) একই
সূত্রে গাঁথা।
যাহেদ ও
অল্পে তুষ্ট
ব্যক্তির কতিপয়
আলামত আছে।
যেমন :
(১) সে
তার অর্জিত
সম্পদ নিয়ে
অতি উৎফুল্ল
হবে না।
আবার যা
পায়নি, তার
জন্য দুশ্চিন্তাও
করবে না।
(২) তার
সহায়-সম্পদ
কখনো তাকে
আল্লাহর ইবাদত
থেকে গাফেল
করবে না;
বরং পার্থিব
কাজে জড়িয়ে
পড়লেও তার
হৃদয় সর্বদা
আল্লাহর ভালোবাসায়
ভরপুর থাকবে।
(৩) তার
পার্থিব আশা-আকাঙ্ক্ষা খুবই
কম হবে।
দুনিয়ার দীর্ঘ
আশা-প্রত্যাশা
নিয়ে সে
কখনো বুঁদ
হয়ে থাকবে
না।
(৪) তার
সম্পদ কম
হ’লেও
আল্লাহর পথে
দান-ছাদাক্বাহ
করতে সে
কখনো কৃপণতা
করবে না
এবং অল্প
সম্পদের দোহাই
দিয়ে ছাদাক্বাহ
করা থেকে
নিজেকে নিবৃত্ত
রাখবে না।[1]
ইমাম
মাওয়ার্দী (রহঃ)-এর মতে,
অল্পে তুষ্টির
কিছু স্তর
আছে। কেউ
উঁচু পর্যায়ের
অল্পে তুষ্ট,
আবার কেউ
তার চেয়ে
নীচু পর্যায়ের
অল্পে তুষ্ট।
তিনি বলেন,
অল্পে তুষ্টির
তিনটি স্তর
রয়েছে।
(১) দুনিয়ার
যৎসামান্য সম্পদে
পরিতুষ্ট থেকে
বাকী সকল
পার্থিব সম্ভার
থেকে অন্তরকে
নির্মোহ রাখা
এবং সম্পদের
অধিক্যকে অপসন্দ
করা। এটা
সর্বোচ্চ পর্যায়ের
‘কানা‘আত’
বা অল্পে
তুষ্টি।
(২) যতটুকু
সম্পদ প্রয়োজন
কেবল ততটুকুতেই
ক্ষান্ত থাকা
এবং এর
অতিরিক্ত সম্পদ
ও আধিক্যের
লোভ দমন
করে রাখা।
এটা মধ্যম
পর্যায়ের অল্পে
তুষ্টি।
(৩) জীবন
ধারণের জন্য
সম্পদ সমান্য
হ’লেও
সে ব্যাপারে
অভিযোগ না
করা। কিন্তু
প্রয়োজনের চেয়েও
যদি অধিক
সম্পদ হস্তগত
হয়, তাহ’লে সেটাকে
খারাপ মনে
না করা।
এটা সর্বনিমণ
পর্যায়ের অল্পে
তুষ্টি। কেননা
এই পর্যায়ে
ভয় (رهبة) ও আগ্রহ
(رغبة) উভয়ের সংমিশ্রণ
ঘটে। আর
আগ্রহ হ’ল প্রয়োজনের
চেয়ে অধিক
সম্পদ প্রাপ্তিকে
অপসন্দ না
করা’।[2]
অল্পে তুষ্ট না থাকার ক্ষতিকর দিক সমূহ :
অল্পে
তুষ্ট লোকেরা
নিঃসন্দেহে মহান
মানুষ। অল্পে
তুষ্ট না
থাকলে বিভিন্ন
অপকারিতা ও
অকল্যাণের সম্মুখীন
হ’তে
হয়।
নিমেণ
অল্পে তুষ্ট
না থাকার
কিছু অপকারিতা
তুলে ধরা
হ’ল।-
(১) রিযিকে বরকত থাকে না :
আধিক্যের
লোভ-লালসায়
যারা অন্ধ
হয়ে যায়,
তারা কখনো
অল্পে তুষ্ট
থাকতে পারে
না। আর
অল্পে তুষ্ট
না থাকার
কারণে আল্লাহ
তাদের জীবন-জীবিকা ও
রুটি-রূযী
থেকে বরকত
উঠিয়ে নেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন,إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَبْتَلِي العَبْدَ فِيمَا
أَعْطاهُ، فإنْ رَضِيَ بِما قَسَمَ الله لهُ بُورِكَ لهُ فِيهِ ووَسَّعَهُ وإنْ لَمْ
يَرْضَ لمْ يُبارِكْ لهُ ولَمْ يَزِدْ عَلىَ مَا كُتِبَ لهُ-
‘মহান আল্লাহ
তার বান্দাকে
যা কিছু
প্রদান করেন,
তা দিয়ে
তাকে পরীক্ষা
করেন। সুতরাং
আল্লাহ তার
(বান্দার) জন্য
যা নির্ধারণ
করেছেন, সে
যদি তাতে
খুশী থাকে,
তাহ’লে
তার রিযিকে
বরকত দেওয়া
হয় এবং
প্রবৃদ্ধি দান
করা হয়।
আর সে
যদি তাতে
পরিতৃপ্ত থাকতে
না পারে,
তাহ’লে
তার জীবিকায়
কখনো বরকত
দেওয়া হয়
না এবং
তার নির্ধারিত
রিযিকে কখনো
প্রবৃদ্ধি আসে
না’।[3]
এই
হাদীছের ব্যাখ্যায়
ছান‘আনী
(রহঃ) বলেন,
মায়ের পেটে
থাকতেই বান্দার
জন্য নির্ধারিত
রিযিক লিখে
দেওয়া হয়।
জন্মের পর
বান্দা সেই
রিযিকে সন্তুষ্ট
থাকলে, তার
রিযিকে বরকত
দিয়ে বাড়িয়ে
দেওয়া হয়।
আর সে
যদি তাতে
পরিতুষ্ট না
থাকতে পারে,
তাহ’লে
সে নির্ধারিত
রিযিকটুকুই পায়।
তা বৃদ্ধিও
করা হয়
না এবং
তাতে বরকতও
দেওয়া হয়
না।[4]
(২) ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করা যায় না :
আল্লাহর
উলূহিইয়াত, রুবূবিইয়াত
ও ছিফাতের
ব্যাপারে হৃদয়কে
পরিতুষ্ট না
করা পর্যন্ত
ঈমান পূর্ণতা
লাভ করতে
পারে না।
আর বিদ্বানদের
মতে আল্লাহর
রুবূবিইয়াতে সন্তুষ্ট
থাকার অর্থ
হ’ল-
বান্দার ব্যাপারে
আল্লাহর যে
কোন সিদ্ধান্তে
খুশি হওয়া।
এজন্য ঈমানের
স্বাদ পরিপূর্ণভাবে
আস্বাদন করার
অন্যতম প্রধান
উপায় হ’ল অল্পে
তুষ্টি। অল্পে
তুষ্টির মাধ্যমে
আল্লাহর রুবূবিইয়াতের
স্বীকৃতি দেওয়া
হয় এবং
আল্লাহর নির্ধারিত
ফায়ছালার প্রতি
সন্তুষ্টি প্রকাশ
করা হয়।
সুতরাং আল্লাহর
বণ্টিত রিযিক
পেয়েও যারা
অভিযোগ করে,
বিরক্তি প্রকাশ
করে- তারা
ঈমানের স্বাদ
লাভে ব্যর্থ
হয়। আর
যারা রাযী-খুশি থাকে
তাদের হৃদয়
ঈমানের আলোকে
আলোকিত হয়।
ইমাম ইবনুল
ক্বাইয়িম (রহঃ)
বলেন, أَنَّ مَنْ مَلَأَ قَلْبَهُ مِنَ الرِّضَا
بِالْقَدَرِ: مَلَأَ اللهُ صَدْرَهُ غِنًى وَأَمْنًا وَقَنَاعَةً، ‘যে ব্যক্তি
তাক্বদীরের প্রতি
সন্তুষ্টির মাধ্যমে
হৃদয়কে পূর্ণ
করে, আল্লাহ
তার বক্ষকে
প্রাচুর্য, নিরাপত্তা
ও অল্পে
তুষ্টি দিয়ে
ভরে দেন’।[5] ঈমানের স্বাদ
আস্বাদনের উপায়
বর্ণনা করে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন,ذَاقَ طَعْمَ الْإِيْمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللهِ
رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا، ‘সে ব্যক্তি
ঈমানের স্বাদ
পেয়েছে, যে
আল্লাহকে রব
হিসাবে, ইসলামকে
দ্বীন হিসাবে
এবং মুহাম্মাদ
(ছাঃ)-কে
রাসূল হিসাবে
পেয়ে সন্তুষ্ট
হয়েছে’।[6]
ইবনুল
ক্বাইয়িম (রহঃ)
বলেন, الْقَنَاعَةُ تُثْمِرُ الرِّضَاءَ، ‘অল্পে তুষ্টির
মাধ্যমে রেযামন্দি
হাছিল হয়’।[7] অর্থাৎ অল্পে
তুষ্ট থাকার
উপহার হ’ল আল্লাহ
সন্তুষ্টি লাভ।
একবার ইয়াহইয়া
বিন মু‘আয (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস
করা হ’ল,مَتَى يَبْلُغُ الْعَبْدُ إِلَى مَقَامِ الرِّضَا؟
‘বান্দা কখন
রেযামন্দি বা
আল্লাহর সন্তুষ্ট
লাভের পর্যায়ে
পৌঁছে? তখন
তিনি বললেন,إِذَا
أَقَامَ نَفْسَهُ عَلَى أَرْبَعَةِ أُصُولٍ فِيمَا يُعَامِلُ بِهِ رَبَّهُ،
فَيَقُولُ: إِنْ أَعْطَيْتَنِي قَبِلْتُ. وَإِنْ مَنَعْتَنِي رَضِيتُ. وَإِنْ
تَرَكْتَنِي عَبَدْتُ. وَإِنْ دَعَوْتَنِي أَجَبْتُ، ‘যখন সে
আল্লাহর সাথে
চারটি নীতির
ওপর অটল
থেকে বলবে,
(হে আল্লাহ!)
যদি আপনি
আমাকে দেন,
আমি গ্রহণ
করব; যদি
দেওয়া থেকে
বিরত থাকেন,
সন্তুষ্ট থাকব;
যদি আমাকে
ত্যাগ করেন,
তবুও আপনার
ইবাদত করব;
যদি আমাকে
ডাকেন, (আপনার
ডাকে) সাড়া
দেব’।[8]
সুতরাং
এটা প্রমাণিত
যে, যারা
অল্পে তুষ্ট
থাকে না
তারা ঈমানের
প্রকৃত স্বাদ
আস্বাদন থেকে
বঞ্চিত হন।
আদতে তারা
নিজেদেরকে বঞ্চিত
করেন। সেজন্য
আমাদের কর্তব্য
হ’ল-
জীবনের যাবতীয়
কষ্ট-ক্লেষ,
বিপদাপদে আল্লাহর
ফায়ছালাতে রাযী-খুশি থাকা
এবং ধৈর্যধারণ
করা। যেমন
অসুস্থ ব্যক্তি
তিতা ঔষধও
সন্তুষ্টিচিত্তে সেবন
করে ফেলে।
ছিয়াম পালনকারী
তীব্র গরমের
দিনেও ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্টে
সন্তুষ্ট থাকে।
পার্থিব জীবনে
আমাদের অবস্থা
সেই রকমই
হওয়া উচিত।
(৩) আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ :
তাক্বদীরের
ভালো-মন্দের
প্রতি অবিচল
বিশ্বাস রাখা
ঈমানের অবিচ্ছেদ্য
অংশ। সেকারণ
অল্পে তুষ্ট
না থাকা
তাক্বদীরের প্রতি
অসন্তুষ্টির নামান্তর।
যারা নির্ধারিত
রিযিক পেয়েও
অসন্তুষ্ট হয়,
আল্লাহ তাদের
প্রতি অসন্তুষ্ট
ও ক্রুব্ধ
হন। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ
عِظَمَ الجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ البَلَاءِ، وَإِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلَاهُمْ،
فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ، ‘নিশ্চয়ই বড়
পরীক্ষায় বড়
প্রতিদান রয়েছে।
আল্লাহ যখন
কোন সম্প্রদায়কে
ভালোবাসেন, তখন
তাদের পরীক্ষা
করেন। সুতরাং
যে ব্যক্তি
(সেই পরীক্ষায়
নিপতিত হয়ে)
সন্তুষ্ট থাকে,
আল্লাহ তার
প্রতি সন্তুষ্ট
হয়ে যান।
আর যে
ব্যক্তি তাতে
অসন্তুষ্ট হয়,
আল্লাহ তার
প্রতি নাখোশ
হন’।[9] সুতরাং যারা
আল্লাহর পক্ষ
থেকে নির্ধারিত
রিযিক পেয়ে
অসন্তুষ্ট হবে,
আল্লাহ তার
প্রতি অসন্তুষ্ট
ও রাগান্বিত
হবেন।
(৪) সুখ হারিয়ে যায় :
যারা
অল্পে তুষ্ট
থাকতে পারে
না, তাদের
হৃদয় থেকে
সুখ উধাও
হয়ে যায়।
পৃথিবীর তাবৎ
সম্পদ তার
হস্তগত হ’লেও সে
পরিতৃপ্ত হ’তে পারে
না। ফলে
সে সুখের
নাগাল পায়
না। কেননা
তখন সে
মনের দিক
থেকে গরীব
ও দরিদ্র
হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন,لَيْسَ الغِنَى عَنْ كَثْرَةِ العَرَضِ،
وَلَكِنَّ الغِنَى غِنَى النَّفْسِ، ‘ধনের
আধিক্য হ’লে ধনী
হয় না,
অন্তরের ধনীই
প্রকৃত ধনী’।[10]
এই
হাদীছে ব্যাখ্যায়
ওলামায়ে কেরাম
বলেন,لأن النفس بغير القناعة لا تشبع بالمال والعرض
ولو ملكت الدنيا، وما دام المرء لم يشبع فإنه يشعر بالضيق والكآبة كأنه لا يملك شيئا،
إذن ليس هناك وسيلة لإشباع النفس إلا امتلاك القناعة، ‘এর কারণ
হ’ল
অল্পে তুষ্টি
ছাড়া মানুষ
সম্পদ ও
মালামাল দিয়ে
পরিতৃপ্ত হয়
না। এমনকি
দুনিয়া ভর্তি
সম্পদ দিয়েও
মানুষ কখনোই
তৃপ্ত হয়
না। কেননা
মানসিক সঙ্কীর্ণতা
ও বিষণ্ণতার
কারণে তার
মনে হয়
সে কোন
সম্পদের মালিক
হ’তে
পারেনি। অতএব
অল্পে তুষ্টির
অধিকারী হওয়া
ছাড়া মানুষের
পরিতৃপ্তি লাভের
কোন উপায়
নেই’।[11] তাই অতৃপ্ত
হৃদয় মানুষের
জীবন থেকে
সুখ ছিনিয়ে
নেয়।
(৫) অপমান ও লাঞ্ছনা নেমে আসে :
অল্প
তুষ্ট মানুষ
সদা সম্মানিত
ও প্রশংসিত
হয়। কিন্তু
অল্পে তুষ্টি
বিবর্জিত জীবন
সর্বদা অপমান
ও লাঞ্ছনার
শিকার হয়।
পূর্বসূরী বিদ্বানগণ
বলেন, عَزَّ مَنْ قَنَعَ ذَلَّ مَنْ طَمِعَ، ‘যে ব্যক্তি
অল্পে তুষ্ট
থাকে, সে
সম্মানিত হয়
এবং যে
লোভ করে,
সে লাঞ্ছিত
হয়’।[12] আবূ মুহরিয
আত্ব-তুফাওয়ী
(রহঃ) বলেন,
আমাদের বাড়ির
পরিচারিকা আমাকে
উপদেশ দিয়ে
বলতেন,يا بني استعن بعز القناعة عن ذل المطالب، ‘বেটা! চাওয়ার
লাঞ্ছনা থেকে
নিবৃত্ত হয়ে
অল্পে তুষ্টির
সম্মানকে তুমি
যথেষ্ট মনে
করো’।[13]
ওলামায়ে
কেরাম আরো
বলেন,أَطْيَبُ العَيْشِ القَنَاعَةُ وَأَنْكَدُ
الْعَيْشِ الجَشَعُ وَمِنْ الأَخْلاقِ الذَّمِيمَةِ التي تَجْعَلُ الإِنْسَانَ بَخِيلاً
بِمَا فِي يَدِهِ مُتَطَلِّعًا لِمَا فِي أَيْدِي النَّاسِ، ‘অল্পে তুষ্টি
হচ্ছে পবিত্র
জীবন এবং
লোভ হ’ল দুর্দশার
জীবন। আর
নিন্দিত চরিত্র
তো সেটাই,
যা মানুষকে
নিজের সম্পদ
ব্যয়ে কৃপণ
করে তোলে
এবং অন্য
মানুষের সম্পদের
প্রতি আগ্রহী
করে তোলে’।[14] কবি বলেন,
إِنِّي إِذَا ذَلَّ الْحَرِيصُ + عَزَزْتُ فِي ظِلِّ الْقَنَاعَة،
‘লোভী যখন
অপমানিত হয়,
তখন আমি
অল্পে তুষ্টির
ছায়ায় সম্মানিত
হয়ে উঠি’।[15]
(৬) মানুষ প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয় :
মানুষ
যখন দুনিয়ার
সম্পদ, ক্ষমতা,
মান-সম্মানের
প্রতি লোভী
হয়, তখন
তারা প্রবৃত্তির
দাসে পরিণত
হয়। ছাবিত
ইবনু আসলাম
(রহঃ) বলেন,الْحُرُّ
عَبْدٌ مَا طَمِعَ، وَالْعَبْدُ حُرٌّ مَا قَنَعَ، ‘স্বাধীন ব্যক্তি
দাস হয়ে
থাকে, যতক্ষণ
সে লোভে
ডুবে থাকে।
আর গোলাম
স্বাধীনই থাকে,
যতক্ষণ পর্যন্ত
সে অল্পে
তুষ্ট থাকে’।[16] আববাসী যুগের
কবি আবুল
‘আতাহিয়াহ বলেন,
أَطَعْت مَطَامِعِي فَاسْتَعْبَدَتْنِي + وَلَوْ أَنِّي قَنَعْت
لَصِرْت حُرَّا،
‘আমি আমার
লোভ-লালসার
আনুগত্য করেছি,
ফলে সে
আমাকে গোলাম
বানিয়েছে। যদি
আমি অল্পে
তুষ্ট থাকতাম,
তাহ’লে
আমি স্বাধীন
থাকতাম’।[17]
ইমাম
ইবনে তায়মিয়াহ
(রহঃ) বলেন,فَالْعَبْد
لَا بُد لَهُ من رزق وَهُوَ مُحْتَاج إِلَى ذَلِك فَإِذا طلب رزقه من الله صَار عبدا
لله فَقِيرا إِلَيْهِ وَإِذا طلبه من مَخْلُوق صَار عبدا لذَلِك الْمَخْلُوق
فَقِيرا إِلَيْهِ، ‘জীবিকা
ছাড়া বান্দা
বাঁচতে পারে
না। যখন
সে আল্লাহর
কাছে রিযিক
তালাশ করে,
তখন সে
আল্লাহরই গোলাম
থাকে এবং
তাঁরই মুখাপেক্ষী
থাকে। কিন্তু
যখন সে
কোন সৃষ্টির
কাছে রিযিক
কামনা করে,
তখন সে
ঐ সৃষ্টির
দাসে পরিণত
হয় এবং
তার দিকে
অভাবী ও
মুখাপেক্ষী হয়ে
পড়ে’।[18] সুতরাং অল্পে
তুষ্ট থাকলে
ক্রীতদাসও স্বাধীনতার
স্বাদ আস্বাদন
করতে পারে।
পক্ষান্তরে স্বাধীন
ব্যক্তি যখন
অল্পে তুষ্ট
না হয়ে
লোভাতুর হয়ে
পড়ে, তখন
তার মনস্তাত্ত্বিক
স্বাধীনতার পরাজয়
ঘটে এবং
সে প্রবৃত্তির
দাসে পরিণত
হয়। ফলে
সে সর্বদা
তার কামনা-বাসনা অনুযায়ী
সার্বিক জীবন
পরিচালনা করতে
থাকে।
(৭) মানুষকে হারাম উপার্জনে প্ররোচিত করে :
যখন
বান্দা তার
স্বল্প উপার্জন
নিয়ে পরিতুষ্ট
থাকে, তখন
আল্লাহ তার
সম্পদে বরকত
দান করেন
এবং তাকে
অভাবমুক্ত রাখেন।
কিন্তু বান্দা
যখন অল্পে
তুষ্ট থাকতে
পারে না,
তখন যথেষ্ট
সম্পদ থাকা
সত্ত্বেও সে
আধিক্যের লোভ-লালসায় জড়িয়ে
পড়ে এবং
সম্পদ বৃদ্ধির
বিভিন্ন উপায়-পন্থা তালাশ
করতে থাকে।
ফলে হালাল-হারাম বিবেচনা
না করে
সে উপার্জন
করতে শুরু
করে। তাই
কখনো তাকে
হারাম পথে
আয়-রোজগার
করতে হয়।
কখনো অল্পে
তুষ্ট না
থাকা লোভী
স্ত্রীর প্ররোচনায়
স্বামী হারাম
উপার্জনে অভ্যস্ত
হয়ে পড়ে।
আবার কখনো
নিজেই অর্থলিপ্সায়
পড়ে ভিক্ষার
হাত প্রসারিত
করে। অথচ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
ভিক্ষাবৃত্তিকে দারুণভাবে
অপসন্দ করেছেন।
তিনি বলেছেন,مَنْ
سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا، فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا فَلْيَسْتَقِلَّ
أَوْ لِيَسْتَكْثِرْ، ‘যে
ব্যক্তি সম্পদ
বাড়ানোর জন্য
মানুষের কাছে
সম্পদ ভিক্ষা
করে বেড়ায়।
মূখ্যত সে
জ্বলন্ত অঙ্গার
ভিক্ষা করে।
কাজেই এখন
তার ভেবে
দেখা উচিত,
সে (আগুনের
ফুলকি) বেশী
নিবে না
কম নিবে’।[19]
স্মর্তব্য
যে, শুধু
রাস্তায় বসে
ভাঙ্গা থালা
নিয়ে মানুষের
কাছে হাত
পাতা কিংবা
মানুষের দারে
দারে গিয়ে
হাত পাতার
নাম ভিক্ষা
নয়; বরং
ভিক্ষার বিভিন্ন
রকমভেদ আছে।
যেমন আমাদের
সমাজে কেউ
সচ্ছল হওয়া
সত্ত্বেও অভাবীর
ছদ্মবেশ ধারণ
করে, কোন
কোন পেশাজীবী
যথেষ্ট বেতন
পাওয়া সত্ত্বেও
টিপ্স, চা-বিস্কুট খাওয়া,
বখশিশ, উপরি
কামাইয়ের লক্ষ্যে
বিভিন্ন অযুহাতে
মানুষের কাছে
হাত পাতে
বা ভিক্ষা
করে। আবার
কারো কারো
পর্যাপ্ত সম্পদ
থাকার পরেও
যাকাতের মাল
গ্রহণের জন্য
অপরের দারস্থ
হন। কেউ
কেউ ভক্তির
চোরাগলি দিয়ে
ভক্তের পকেট
ছাফ করে
ফেলেন। এসব
লোকদের জন্য
রাসূল (ছাঃ)
কঠিন হুঁশিয়ারী
উচ্চারণ করেছেন।
(৮) বান্দাকে শাস্তির সম্মুখীন করে :
যারা
নিজেদের প্রাপ্ত
সম্পদে পরিতুষ্ট
থাকতে পারে
না, তারা
কখনো আল্লাহর
নে‘মতের
শুকরিয়া আদায়
করতে পারে
না। ফলে
তারা আল্লাহর
নে‘মতকে
অবজ্ঞা করতে
থাকে। আল্লাহ
বলেন,لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ
كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ، ‘যদি
তোমরা কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ কর,
তাহ’লে
আমি আরো
বাড়িয়ে দেব।
আর যদি
অকৃতজ্ঞ হও,
(তাহ’লে
জেনে রেখ!)
নিশ্চয় আমার
শাস্তি অত্যন্ত
কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/১৭)।
মুফাস্সিরগণ
বলেন, বান্দা
যদি আল্লাহর
নে‘মতের
শুকরিয়া আদায়
না করে,
তাহ’লে
আল্লাহ এক
পর্যায়ে তার
থেকে সেই
নে‘মত
ছিনিয়ে নিবেন
এবং তাকে
কঠিন শাস্তি
দিবেন’।[20] হাসান বছরী
(রহঃ) বলেন,إن
الله ليمتع بالنعمة ما شاء فإذا لم يشكر عليها قلبها عذابا، ‘আল্লাহ (তাঁর
বান্দাকে) স্বীয়
ইচ্ছামত নে‘মত উপভোগ
করতে দেন।
কিন্তু বান্দা
এর শুকরিয়া
আদায় না
করলে তিনি
সেই নে‘মতকে শাস্তিতে
রূপান্তরিত করেন’।[21] সুতরাং কোন
ব্যক্তি যদি
অল্পে তুষ্ট
না থাকতে
পারে, সে
কখনোই আল্লাহর
শুকরিয়া আদায়
করতে পারবে
না। ফলে
এই অকৃতজ্ঞতা
ও ধনলিপ্সা
তাকে আল্লাহর
আযাবের দিকে
ঠেলে দিবে।
মহান
আল্লাহ আমাদের
সার্বিক জীবনে
অল্পে তুষ্ট
থাকার তাওফীক্ব
দান করুন
এবং অল্পে
তুষ্ট না
থাকার এই
পরিণতিগুলো থেকে
হেফাযত করুন-আমীন!
পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। শেষ পর্ব।
[2]. মাওয়ার্দী, আদাবুদ দুনইয়া ওয়াদ্দীন (লেবানন : দারু মাকতাবাতিল হায়াত, ১৯৮৬ খ্রি.) পৃ: ১২৬-১২৭।
[3]. ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৬৯; ছহীহাহ্ হা/১৬৫৮, সনদ ছহীহ।
[4]. আত-তানবীর শারহুল জামি‘ইছ ছাগীর ৩/৩৬৭।
[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ মু‘তাছিম বিল্লাহ বাগদাদী (বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৬হি./১৯৯৬খ্রি.) ২/২০২।
[6]. মুসলিম হা/৩৪; তিরমিযী হা/২৬২৩; মিশকাত হা/৯।
[7]. মাদারিজুস সালেকীন ২/২৯।
[8]. মাদারিজুস সালেকীন ২/১৭২।
[9]. তিরমিযী হা/২৩৯৬; ইবনু মাজাহ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/১৫৬৬, সনদ হাসান।
[10]. বুখারী হা/৬৪৪৬; মুসলিম হা/১০৫১; মিশকাত হা/৫১৭০।
[11]. মিক্বদাদ মুহাম্মাদ আলী, ‘ইলমুল আখলাক্বিল ইসলামিইয়াহ, (রিয়াদ : দারু ‘আলিমিল কুতুব, ২য় মুদ্রণ, ১৪২৪হি./২০০৩খ্রি.) পৃঃ ৯১।
[12]. আবূ সাঈদ হানাফী, বুরাইক্বা মাহমূদিইয়াহ (দিমাশ্ক্ব : মাত্ববা‘আতুল হালাবী, ১৩৪৮হি.) ৩/২৩।
[13]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া, তাহক্বীক্ব : আহমাদ ইবনে আলী (কায়রো: দারুল হাদীছ, ১৪২১হি./২০০০খ্রি.) ২/২৫৮।
[14]. আব্দুল আযীয সালমান, মাওয়ারিদুয যাম্আন, ১/৩০২।
[15]. ইবনুল জাওযী, যাম্মুল হাওয়া, পৃ: ১৪৩।
[16]. আবূ নু‘আইম ইস্পাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ১৩/৩২৪।
[17]. ইবনুল মুফলিহ, আল-আদাবুশ শার‘ইয়াহ (দিমাশ্ক্ব : মাকতাবাতু ‘আলামিল কুতুব, তাবি) ৩/৩০৯।
[18]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-‘উবূদিয়্যাহ, তাহক্বীক্ব : সা‘ঈদ রাসলান (কায়রো : দারুল গাদা আল-জাদীদ, ১ম সংস্করণ, ১৪৩৩হি./২০১২খ্রি.) পৃ: ৫৪।
[19]. মুসলিম হা/১০৪১; মিশকাত হা/১৮৩৮।
[20]. জামালুদ্দীন ক্বাসেমী, মাহাসিনিত তা’ওয়ীল (তাফসীরে ক্বাসেমী) ৬/৩০১।
[21]. ইবনুল ক্বাইয়িম, উদ্দাতুছ ছাবেরীন (মদীনা মুনাওয়ারা : মাকতাবাতু দারিত তুরাছ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৪০৯হি./১৯৮৯খ্রি.) পৃ: ১২০।
No comments