মানুষকে কষ্ট দেওয়ার পরিণতি

মানুষকে কষ্ট দেওয়ার পরিণতি

দুনিয়াতে মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম হাওয়া (আঃ) তাঁদের থেকেই দুনিয়াতে মানুষ বিস্তার লাভ করেছে (নিসা /) সে হিসাবে পৃথিবীর সকল মানুষ ভাই ভাই। আদর্শিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মুসলমানরা ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর (হজ্জ ২২/৭৮) সুতরাং যেদিক দিয়েই বিবেচনা করা হোক না কেন পৃথিবীর সকল মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। তাই মানুষ একে অপরকে কিংবা এক মুসলমান অপর মুসলমানকে কষ্ট দিতে পারে না। কারণ পরস্পরকে কষ্ট দেওয়ার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। নিবন্ধে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার পরিণতি আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।-

মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া নিষেধ :

মুসলমানকে কষ্ট দিতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوْا فَقَدِ احْتَمَلُوْا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِيْنًا، ‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে’ (আহযাব ৩৩/৫৮) মুমিনকে কষ্ট দিতে নিষেধ করে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

يَا مَعْشَرَ مَنْ قَدْ أَسْلَمَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يُفْضِ الإِيْمَانُ إِلَى قَلْبِهِ لاَ تُؤْذُوْا الْمُسْلِمِينَ وَلاَ تُعَيِّرُوهُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ تَتَبَّعَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ وَلَوْ فِى جَوْفِ رَحْلِهِ،

হে জামাআত! যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছ, কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান মযবূত হয়নি। তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিবে না, তাদের লজ্জা দিবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা যে লোক তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবে আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন তাকে অপমান করে ছাড়বেন, সে তার উটের হাওদার ভিতরে অবস্থান করে থাকলেও[1] 

মানুষকে কষ্ট দেওয়ার মাধ্যম :

মানুষকে প্রধানত কথা কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া হয়ে থাকে। কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বলতে গালি দেওয়া, গীবত-তোহমত, চোগলখুরী করা, খোঁটা দেওয়া, তুচ্ছ জ্ঞান করা ইত্যাদি বোঝায়। আর কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া বলতে যুলুম করা, ধোঁকা-প্রতারণা, রাস্তা বন্ধ করা, সম্পদ জবর দখল করা হত্যা করা ইত্যাদি বুঝায়।

. কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া :

আঘাতের ক্ষত ব্যথা দ্রুত সেরে যায়। কিন্তু কথার মাধ্যমে দেওয়া আঘাত ক্ষতের নিরাময় সহজে হয় না। সেজন্য কবি বলেন,

جِرَاحَاتُ السِّنَانِ لَهَا الْتِئَامُ * وَلاَ يَلْتَامُ مَا جَرَحَ اللِّسَانُ

তরবারির আঘাতের ক্ষতের প্রতিষেধক আছে, কিন্তু জিহবার ক্ষতের কোন প্রতিষেধক নেই[2] তাই কথার মাধ্যমে দেওয়া আঘাত মানুষ সবচেয়ে বেশী স্মরণে রাখে এবং আঘাত সর্বাধিক ব্যথাতুর হয়। কথার দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমগুলি নিম্নে উল্লেখ করা ল।-

. গালি দেওয়া :

মানুষকে গালি দেওয়া লে সে কষ্ট পায়। আর এটা কবীরা গোনাহ। পরকালে এর প্রতিকার হবে নেকী প্রদান বা গোনাহ বহনের মাধ্যমে। তাছাড়া কাউকে গালি দেওয়া গোনাহ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসিকী এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরী[3] মুসলমানকে গালি দেওয়া নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। রাসূল (ছাঃ) বলেন,سَابُّ الْمُؤْمِنِ كَالْمُشْرِفِ عَلَى الْهَلَكَةِ، ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিপতিত করার ন্যায়[4] উভয় গালিদাতাকে রাসূল (ছাঃ) শয়তান বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, الْمُسْتَبَّانِ شَيْطَانَانِ يَتَكَاذَبَانِ وَيَتَهَاتَرَانِ، ‘উভয় গালমন্দকারী দুই শয়তান। এরা পরস্পরের উপর মিথ্যা দোষারোপ করে এবং অসত্য বলে[5]

কোন মুসলিমকে গালি দিলে শয়তানকে সহযোগিতা করা হয়। আবূ হুরায়রা (রাঃ) তে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদ পানকারী জনৈক ব্যক্তিকে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট হাযির করা ল। তিনি আদেশ দিলেন, ওকে তোমরা মার। আবূ হুরায়রা বলেন, (তাঁর আদেশ অনুযায়ী আমরা তাকে মারতে আরম্ভ করলাম।) আমাদের কেউ তাকে হাত দ্বারা মারতে লাগল, কেউ তার জুতা দ্বারা, কেউ নিজ কাপড় দ্বারা। অতঃপর যখন সে ফিরে যেতে লাগল, তখন কিছু লোক বলে উঠল, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুক। একথা শুনে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, لاَ تَقُولُوْا هَكَذَا لاَ تُعِينُوْا عَلَيْهِ الشَّيْطَانَ ‘এরূপ বলো না এবং ওর বিরুদ্ধে শয়তানকে সহযোগিতা করো না[6]

গালিদাতাদের মধ্যে যে প্রথমে শুরু করবে সব গোনাহ তার উপরে বর্তাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْمُسْتَبَّانِ مَا قَالاَ فَعَلَى الْبَادِئِ مَا لَمْ يَعْتَدِ الْمَظْلُومُ، ‘পরস্পর গালিগালাজকারীর মধ্যে যে প্রথমে আরম্ভ করে উভয়ের দোষ তার উপর বর্তাবে, যতক্ষণ না অপরজন সীমালঙ্ঘন করে[7] এমনকি গালিদাতা পরকালে নিঃস্ব হবে এবং নেকী দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা কি জান, নিঃস্ব কে? তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে নিঃস্ব হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যার দিরহামও (নগদ অর্থ) নেই, কোন সম্পদও নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সেই ব্যক্তি হচ্ছে নিঃস্ব, যে ক্বিয়ামত দিবসে ছালাত, ছিয়াম, যাকাতসহ বহু আমল নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সাথে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত (হত্যা) করেছে, কাউকে মারধর করেছে ইত্যাদি অপরাধও নিয়ে আসবে। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল তে ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ বদলা (বিনিময়) নেয়ার আগেই তার সৎ আমল নিঃশেষ হয়ে গেলে তাদের গুনাহসমূহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে[8] সুতরাং মুসলমানকে গালি দিয়ে তাকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, যাতে পরকালে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন তে না হয়।

. গীবত-তোহমত :

গীবত-তোহমতের মাধ্যমেও মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়। গীবত অর্থ দোষচর্চা, পরনিন্দা। আর তোহমত অর্থ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা। দুটিই পরিবারে সমাজে নানা বিশৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টির জন্য দায়ী। মানুষের মধ্যকার সুসম্পর্কে চিড় ধরাতে এদুটি বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। দুটি গোনাহ সমাজের মানুষ হেসে-খেলে করে থাকে। এমনকি অনেকে একে দোষের মনে করে না। অথচ উভয়টিই কবীরা গোনাহ বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট। বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ গোনাহ মাফ করবেন না। কারণ এর মাধ্যমে মানুষের ইয্যত-সম্মান নষ্ট হয়, তার হক বিনষ্ট হয়। তাই থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। অনেকে দোষচর্চা করে মনে করেন যে, তিনি সঠিক কথাইতো বলছেন। সুতরাং সেটা দোষের হবে কেন? কিন্তু কারো মধ্যে থাকা দোষ-ত্রুটি তার অবর্তমানে আলোচনা করাই গীবত। আবূ হুরায়রা (রাঃ) তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ قَالُوا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِى أَخِى مَا أَقُولُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ.

তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? তারা বলল, আল্লাহ তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তোমার মুসলিম ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপসন্দ করে। জিজ্ঞেস করা , যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সে ত্রুটি বিদ্যমান থাকে, যা আমি বলি? তিনি বললেন, তুমি যে দোষ-ত্রুটির কথা বললে, তার মধ্যে সে দোষ-ত্রুটি থাকলেই তুমি তার গীবত করলে। আর যদি দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান না থাকে, তবে তুমি মিথ্যারোপ করলে[9]

গীবত বা দোষচর্চা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ، ‘আর একে অপরের পিছনে গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক’ (হুজুরাত ৪৯/১২)

অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) গীবত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু বারযাহ আসলামী (রাঃ) বলেন,يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ الإِيْمَانُ قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِيْنَ- ‘হে ঐসব লোক! যারা কেবল মুখে ঈমান এনেছ। কিন্তু তাদের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না[10]

পার্থিব শাস্তি : রাসূল (ছাঃ) পার্থিব শাস্তির বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, আরবরা সফরে গেলে একে অপরের খিদমত করত। আবুবকর ওমর (রাঃ)-এর সাথে একজন লোক ছিল যে তাদের খিদমত করত। তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। অতঃপর জাগ্রত লে লক্ষ্য করলেন যে, সে তাদের জন্য খাবার প্রস্ত্তত করেনি (বরং ঘুমিয়ে আছে) ফলে একজন তার অপর সাথীকে বললেন, এতো তোমাদের নবী করীম (ছাঃ)-এর ন্যায় ঘুমায়। অন্য বর্ণনায় আছে, তোমাদের বাড়িতে ঘুমানোর ন্যায় ঘুমায় (অর্থাৎ অধিক ঘুমায়) অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে বললেন, তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গমন করে তাঁকে বল যে, আবুবকর ওমর (রাঃ) আপনাকে সালাম প্রদান করেছেন এবং আপনার নিকট তরকারী চেয়েছেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, যাও, তাদেরকে আমার সালাম প্রদান করে বলবে যে, তারা তরকারী খেয়ে নিয়েছে। (একথা শুনে) তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট গমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা আপনার নিকট তরকারী চাইতে ওকে পাঠালাম। অথচ আপনি তাকে বলেছেন, তারা তরকারী খেয়েছে। আমরা কি তরকারী খেয়েছি? তিনি বললেন, তোমাদের ভাইয়ের গোশত দিয়ে। যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উভয়ের দাঁতের মধ্যে তার গোশত দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেন, আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি বললেন, না বরং সেই তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে[11]

আয়েশা (রাঃ) তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বললাম, আপনার জন্য ছাফিয়ার এই এই হওয়া যথেষ্ট। কোন কোন বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ছাফিয়া বেঁটে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সমুদ্রের পানিতে মিশানো হয়, তাহলে তার স্বাদ পরিবর্তন করে দেবে[12]

ক্বায়েস বলেন, আমর ইবনুল আছ (রাঃ) তার কতিপয় সঙ্গী-সাথীসহ ভ্রমণ করছিলেন। তিনি একটি মৃত খচ্চরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যা ফুলে উঠেছিল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! কোন ব্যক্তি যদি পেট পুরেও এটা খায়, তবুও তা কোন মুসলমানের গোশত খাওয়ার চেয়ে উত্তম[13]

পরকালীন শাস্তি : রাসূল (ছাঃ) উম্মতকে গীবতের পরকালীন শাস্তি সম্বন্ধেও অবহিত করেছেন। আনাস (রাঃ) তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَمَّا عُرِجَ بِى مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمِشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلاَءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِى أَعْرَاضِهِمْ- ‘মিরাজে গিয়ে আমাকে এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাদের নখগুলি সব ছিল পিতলের। যা দিয়ে তারা তাদের মুখ বুক খামচাচ্ছিল। আমি জিব্রীলকে বললাম, এরা কারা? তিনি বললেন, যারা মানুষের গোশত খেত অর্থাৎ গীবত করত এবং তাদের সম্মান নষ্ট করত[14]

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَكَلَ بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْلَةً فَإِنَّ اللهَ يُطْعِمُهُ مِثْلَهَا مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ كُسِىَ ثَوْبًا بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ فَإِنَّ اللهَ يَكْسُوهُ مِثْلَهُ مِنْ جَهَنَّمَ وَمَنْ قَامَ بِرَجُلٍ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ فَإِنَّ اللهَ يَقُومُ بِهِ مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের গীবতের বিনিময়ে এক গ্রাসও খাদ্য ভক্ষণ করবে, আল্লাহ তাকে সমপরিমাণ জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করাবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে অপমান করার বিনিময়ে কোন কাপড় পরিধান করবে, আল্লাহ তাকে সমপরিমাণ জাহান্নামের আগুন পরিধান করাবেন। আর যে ব্যক্তি কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে লোকদের নিকট নিজের বড়ত্ব যাহির করে এবং শ্রেষ্ঠত্ব দেখায়, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ স্বয়ং ব্যক্তির শ্রুতি রিয়া প্রকাশ করে দেবার জন্য দন্ডায়মান হবেন[15]

তোহমত বা অপবাদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا، ‘যে ব্যক্তি কোন অপরাধ কিংবা পাপ করে, অতঃপর তা কোন নির্দোষ ব্যক্তির উপর চাপায়, সে নিজেই উক্ত অপবাদ প্রকাশ্য পাপভার বহন করবে’ (নিসা /১১২) তিনি আরো বলেন,إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ، ‘মিথ্যা তো কেবল তারাই রচনা করে যারা আল্লাহর আয়াত সমূহে বিশ্বাস করে না এবং তারাই মিথ্যাবাদী’ (নাহল ১৬/১০৫)

. চোগলখুরী করা :

মানুষকে কষ্ট দেওয়ার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে চোগলখুরী করা। আর তা হচ্ছে দুই ভাই বা বন্ধুর মাঝে সম্পর্ক বিনষ্টের উদ্দেশ্যে একে অপরের কাছে পরস্পরের দোষ উল্লেখ করা। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ مَا الْعَضْهُ هِىَ النَّمِيْمَةُ الْقَالَةُ بَيْنَ النَّاسِ.

মিথ্যা অপবাদ কি জিনিস আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না? তা হচ্ছে চোগলখুরী করা। জনসমক্ষে কারো সমালোচনা করা[16] আরেকটি হাদীছে এসেছে, আব্দুর রহমান ইবনু গানম আসমা বিনতু ইয়াযীদ (রাঃ) তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

خِيَارُ عِبَادِ اللهِ الَّذِيْنَ إِذَا رُءُوْا ذُكِرَ اللهُ وَشِرَارُ عِبَادِ اللهِ الْمَشَّاءُوْنَ بِالنَّمِيْمَةِ الْمُفَرِّقُوْنَ بَيْنَ الْأَحِبَّةِ الْبَاغُونَ الْبُرَآءَ الْعَنَتَ-

আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যাদেরকে দেখলে আল্লাহকে স্মরণ হয়। আর আল্লাহ তাআলার নিকৃষ্ট বান্দা তারা, যারা মানুষের পরোক্ষভাবে নিন্দা করে বেড়ায়, বন্ধুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং পূত-পবিত্র লোকেদের পদস্খলন প্রত্যাশা করে[17] অন্য একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِخِيَارِكُمْ. قَالُوْا بَلَى. قَالَ فَخِيَارُكُمُ الَّذِيْنَ إِذَا رُؤُوْا ذُكِرَ اللهُ تَعَالَى، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِشِرَارِكُمْ. قَالُوا بَلَى. قَالَ فَشِرَارُكُمُ الْمُفْسِدُوْنَ بَيْنَ الأَحِبَّةِ الْمَشَّاءُونَ بِالنَّمِيْمَةِ الْبَاغُوْنَ البُرَآءَ الْعَنَتَ.

আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের মধ্যকার উৎকৃষ্ট লোকদের সম্পর্কে অবহিত করবো না? ছাহাবীগণ বলেন, হ্যঁা। তিনি বলেন, যাদের দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। তিনি আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের মধ্যকার নিকৃষ্ট লোকদের সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, যারা চোগলখুরী করে বেড়ায়, বন্ধুদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে এবং পুণ্যবান লোকদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়[18]

চোগলখুরীর পরকালীন শাস্তি সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,مَرَّ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِحَائِطٍ مِنْ حِيْطَانِ الْمَدِينَةِ أَوْ مَكَّةَ فَسَمِعَ صَوْتَ إِنْسَانَيْنِ يُعَذَّبَانِ فِى قُبُوْرِهِمَا، فَقَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِى كَبِيْرٍ، ثُمَّ قَالَ : بَلَى، كَانَ أَحَدُهُمَا لاَ يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ، وَكَانَ الآخَرُ يَمْشِى بِالنَّمِيْمَةِ- ‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনা বা মক্কার একটি বাগানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দুটি কবর থেকে দুজন মানুষের শব্দ শোনেন, যাদেরকে কবরে আযাব দেওয়া হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, দুটি কবরে আযাব হচ্ছে। তবে সেটি তেমন বড় কোন কারণে নয়। অতঃপর তিনি বললেন, এদের এক ব্যক্তি পেশাব থেকে আড়াল (সতর্কতা অবলম্বন) পর্দা করত না এবং অন্য ব্যক্তি চোগলখুরী করত[19]

. মন্দ নামে ডাকা :

মানুষকে মন্দ নামে ডাকা তাকে কষ্ট দেওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম। যেটা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَلَا تَنَابَزُوْا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ، ‘আর তোমরা একে অপরকে মন্দ লকবে ডেকো না। বস্ত্ততঃ ঈমান আনার পর তাকে মন্দ নামে ডাকা ফাসেকী কাজ। যারা থেকে তওবা করে না, তারা সীমালংঘনকারী’ (হুজুরাত ৪৯/১১)

জুরাইরা ইবনুয যাহহাক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের বনী সালিমাহ সম্পর্কে আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘তোমরা একে অপরকে মন্দ লকবে ডেকো না। বস্ত্ততঃ ঈমান আনার পর তাকে মন্দ নামে ডাকা ফাসেকী কাজ’ (হুজুরাত ৪৯/১১) বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন আমাদের মাঝে আগমন করেন তখন আমাদের প্রত্যেকেরই দু’-তিনটা করে নাম ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হে অমুক! এভাবে ডাকলে তারা বলতেন, হে আল্লাহর রাসূল! থামুন, সে ব্যক্তি নামে ডাকলে অসন্তুষ্ট হবে। অতঃপর আয়াত নাযিল তোমরা একে অপরকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না[20]

. উপহাস করা :

কোন মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সবারই কোন না কোন দিক দিয়ে দুর্বলতা থাকে। তাই কোন মানুষকে উপহাস করা উচিত নয়। এতে মানুষ মনে অত্যন্ত কষ্ট পায়। এটা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُوْنُوْا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! কোন সম্প্রদায় যেন কোন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। আর নারীরা যেন নারীদের উপহাস না করে। তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম’ (হুজুরাত ৪৯/১১)

. তুচ্ছজ্ঞান করা :

কোন মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করলে বা হেয় ভাবলে সে যারপর নাই কষ্ট পায়। কাজ থেকে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন এবং এর অশুভ পরিণতি বর্ণনা করেছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

لاَ تَحَاسَدُوْا وَلاَ تَنَاجَشُوْا وَلاَ تَبَاغَضُوْا وَلاَ تَدَابَرُوْا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا. الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ. التَّقْوَى هَا هُنَا. وَيُشِيْرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ.

তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পর ধোঁকাবাজি করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অগোচরে শত্রুতা করো না এবং একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করবে না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে থাকো। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না। তাক্বওয়া এখানে, কথা বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার স্বীয় বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। কোন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ইয্যত-আব্রু হারাম[21]

তিনি আরো বলেন, إِنَّ مِنْ أَرْبَى الرِّبَا اسْتِطَالَةَ الْمَرْءِ فِي عِرْضِ أَخِيهِ. ‘সবচেয়ে বড় সূদ অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের মানহানি করা[22]

(চলবে)

[1]তিরমিযী হা/২০৩২; মিশকাত হা/৫০৪৪; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৩৯।

[2]. তুহফাতুল আহওয়াযী /১৭৩; মিরক্বাত /৫৯ পৃঃ।

[3]. বুখারী হা/৪৮, ৬০৪৪, ৭০৭৬; মুসলিম হা/৬৪; মিশকাত হা/৪৮১৪।

[4]বায্যার, ছহীহুল জামেহা/৩৫৮৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৭৮০।

[5]আহমাদ হা/১৭৫২২; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪২৭; ছহীহুল জামেহা/৬৬৯৬।

[6]. বুখারী হা/৬৭৭৭; আবূদাঊদ হা/৪৪৭৭; মিশকাত হা/৩৬২৬।

[7]. মুসলিম হা/২৫৮৭; আবূদাঊদ হা/৪৮৯৪; মিশকাত হা/৪৮১৮।

[8]. মুসলিম হা/২৫৮১; তিরমিযী হা/২৪১৮; মিশকাত হা/৫১২৭।

[9]. মুসলিম হা/২৫৮৯; ছহীহুল জামেহা/৮৬; ছহীহাহ হা/১৪১৯।

[10]. আবূদাঊদ হা/৪৮৮০; তিরমিযী হা/২০৩২; মিশকাত হা/৫০৪৪।

[11]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬০৮।

[12]আবূদাঊদ হা/৪৮৭৫; মিশকাত হা/৪৮৫৭; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৪।

[13]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩২, সনদ ছহীহ।

[14]. আবূদাঊদ হা/৪৮৭৮-৭৯; মিশকাত হা/৫০৪৬; ছহীহাহ হা/৫৩৩।

[15]. আবূদাঊদ হা/৪৮৮১; মিশকাত হা/৫০৪৭শিষ্টাচার সমূহঅধ্যায়; ছহীহাহ হা/৯৩৪।

[16]. মুসলিম হা/৬৮০২।

[17]. আহমাদ হা/১৭৯৯৮; বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান হা/৬৭০৮; ছহীহাহ হা/২৮৮৯; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/২৪৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৮১৪; মিশকাত হা/৪৮৭১-৭২।

[18]আহমাদ হা/২৭৬৪২; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩২৩, সনদ হাসান।

[19]. বুখারী হা/২১৬; মুসলিম হা/২৯২; মিশকাত হা/৩৩৮।

[20]. আবূ দাঊদ হা/৪৯৬২; ইবনু মাজাহ হা/৩৭২১।

[21]মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৮৫।

[22]আবূদাঊদ হা/৪৮৭৬; ছহীহাহ হা/১৪৩৩, ৩৯৫০; ছহীহুল জামেহা/২২০৩, ২৫৩১; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৩।

No comments

Featured Post

দোয়া-ই নুর- Doya e Nur

Powered by Blogger.