নবীকে কেমন ভালোবাসেন?


নবীজীর প্রতি ভালবাসা মুমিনের ঈমান : কিছু বর্ণনা, কিছু দৃষ্টান্ত

বাশীরুদ্দীন আদনান

আমরা ছিলাম পথহারা, দিশেহারা। হেদায়াত ও সফলতার পথ সম্পর্কে ছিলাম অজ্ঞ। অতপর মহান রাব্বুল আলামীন হেদায়েতের বার্তা দিয়ে প্রেরণ করলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তিনি এসে আমাদেরকে সত্য-মিথ্যা চিনিয়েছেন। আমাদের নিকট সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন। নাজাতের পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পন্থা শিখিয়েছেন। এ ছিল আমাদের প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের বর্ণনা পবিত্র কুরআনে মাজীদে এভাবে এসেছে-

لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ.

আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন; তিনি তাদেরই নিজেদের মধ্য হতে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন, যদিও তারা এর আগে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল। Ñসূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৪

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমনিভাবে নবীগণের সর্দার তেমনিভাবে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেও তিনি সকলের চেয়ে মহান। তিনি এমন এক উৎকৃষ্ট সমাজ রেখে গেছেন, যার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীরাও উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে। কারণ তিনি সমাজ বিনির্মাণ করেছেন ওহীর ভিত্তিতে, যে ওহী মানব সভ্যতার প্রকৃত উৎকর্ষ নিশ্চিত করে। আর তাই এই  উম্মতের জন্য তাঁকে মনোনীত করা উম্মতের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ। তবে এই অনুগ্রহ থেকে তারাই মূলত উপকৃত হয়, যারা ঈমান আনে। তাই আয়াতে ব্যাপকভাবে উম্মতের বদলে শুধু মুমিনদের কথা বলা হয়েছে।

তিনি এসেছেন রহমত হয়ে

তিনি জগদ্বাসীর জন্য রহমত হয়ে এসেছেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেনÑ

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ.

(হে নবী!) আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি। Ñসূরা আম্বিয়া (২১) : ১০৭

ইমাম ত্ববারী রাহ. বলেছেন-

أن الله أرسل نبيه محمدا صلى الله عليه وسلم رحمة لجميع العالم، مؤمنهم وكافرهم. فأما مؤمنهم فإن الله هداه به، وأدخله بالإيمان به، وبالعمل بما جاء من عند الله الجنة. وأما كافرهم فإنه دفع به عنه عاجل البلاء الذي كان ينزل بالأمم المكذّبة رسلها من قبله.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগতের সকলের প্রতি আল্লাহ পাকের রহমত। মুমিন-কাফির নির্বিশেষে সকল মাখলুকই কিয়ামত পর্যন্ত এই মহান রহমতের মাধ্যমে উপকৃত হতে থাকবে। মুমিনকে তো আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে হিদায়াত দান করেছেন। তাঁর উপর ঈমান আনা এবং তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে পয়গাম নিয়ে এসেছেন সে অনুযায়ী আমল করার কারণে তাকে জান্নাত দেবেন। আর এই উম্মতের অবিশ্বাসীকে তাঁর কারণে পূর্ববর্তী উম্মতের অবিশ্বাসীর মতো নগদ শাস্তি দেবেন না। তাফসীরে ত্ববারী ১৮/৫৫২

মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, কাফেরদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জিহাদ করেছেন সেটাও ব্যাপকার্থে প্রকাশ্য রহমত ছিল। কেননা এর মাধ্যমে বড় রহমত, যা তিনি আল্লাহর তরফ থেকে নিয়ে এসেছিলেন তার হেফাজত হয়েছিল। তাছাড়া এর ফলে এমন অনেকের ঈমানের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি খুলে গিয়েছিল, যে ব্যাপারে তারা স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বয়ে বেড়াচ্ছিল। (দ্র. তাফসীরে উসমানী)

উম্মতের প্রতি নবীজীর দরদ

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দয়া-মমতার সাগর। উম্মতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মায়া, সীমাহীন মমতা এবং তাদের কল্যাণ সাধনে ছিলেন সদা ব্যাকুল, ব্যতিব্যস্ত। তাদেরকে তিনি নিঃস্বার্থ ভালোবাসতেন। তিনি তাদের থেকে না এর কোনো প্রতিদান চাইতেন, আর না কৃতজ্ঞতা কামনা করতেন। চাইতেন শুধু তাদের নাজাত ও সফলতা। চাইতেন যেন উম্মত হেদায়েতের পথ হারিয়ে না ফেলে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আযাব তাদেরকে আক্রান্ত না করে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রা. বলেছেন-

أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: تَلَا قَوْلَ اللهِ عَزّ وَجَلّ فِي إِبْرَاهِيمَ: رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضْلَلْنَ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِیْ فَاِنَّهٗ مِنِّیْ، وَقَالَ عِيسَى عَلَيْهِ السّلَامُ: اِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَاِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَ اِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ، فَرَفَعَ يَدَيْهِ وَقَالَ: اللهُمّ أُمّتِي أُمّتِي، وَبَكَى، فَقَالَ اللهُ عَزّ وَجَلّ: يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ إِلَى مُحَمّدٍ، وَرَبّكَ أَعْلَمُ، فَسَلْهُ مَا يُبْكِيكَ؟ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ الصّلَاةُ وَالسّلَامُ، فَسَأَلَهُ فَأَخْبَرَهُ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِمَا قَالَ، وَهُوَ أَعْلَمُ، فَقَالَ اللهُ: يَا جِبْرِيلُ، اذْهَبْ إِلَى مُحَمّدٍ، فَقُلْ: إِنّا سَنُرْضِيكَ فِي أُمّتِكَ، وَلَا نَسُوءُكَ.

অর্থাৎ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত পাঠ করলেন, যাতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কথা উল্লেখ আছে : (তরজমা) “হে আমার রব! এসব প্রতীমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত হবে।” (আর সেই আয়াতও পড়লেন যেখানে আছে) (তরজমা) “(এবং ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন,) যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হিকমতও পরিপূর্ণ।” অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাত তুলে কেঁদে কেঁদে বললেন- 

اللهُمّ أُمّتِي أُمّتِي.

‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!!’ তখন আল্লাহ তাআলা বললেন, হে জিবরাঈল! মুহাম্মাদকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর সে কেন কাঁদে? যদিও তোমার রবই ভালো জানেন। অতপর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবীজীর কাছে এসে তা জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব খুলে বললেন। যদিও আল্লাহ তাআলা সব জানেন। অতপর আল্লাহ তাআলা বললেন, হে জিবরাঈল! মুহাম্মাদকে গিয়ে বলো, আমি অচিরেই তোমার উম্মতের ব্যাপারে তোমাকে সন্তুষ্ট করব, ব্যথিত করব না। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২০২

আরেক হাদীছে উদাহরণ টেনে নবীজী উম্মতের প্রতি তাঁর দরদকে এভাবে বুঝিয়েছেন-

مَثَلِي وَمَثَلُكُمْ كَمَثَلِ رَجُلٍ أَوْقَدَ نَارًا، فَجَعَلَ الْجَنَادِبُ وَالْفَرَاشُ يَقَعْنَ فِيهَا، وَهُوَ يَذُبُّهُنَّ عَنْهَا، وَأَنَا آخِذٌ بِحُجَزِكُمْ عَنِ النَّارِ، وَأَنْتُمْ تَفَلَّتُونَ مِنْ يَدِي.

অর্থাৎ, আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত সে ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত, যে আগুন জ্বালালো, ফলে ফড়িংদল পতঙ্গরাজি তাতে পড়তে লাগল। আর সে ব্যক্তি তাদের তা থেকে তাড়াতে লাগল। অনুরূপ আমিও আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমর ধরে টানছি, আর তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৮৫

উম্মতের হেদায়েত লাভে তাঁর দরদ ও আত্মত্যাগের মাত্রা বুঝবার জন্য কুরআন কারীমের এই একটি আয়াতই যথেষ্ট-

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلٰۤی اٰثَارِهِمْ اِنْ لَّمْ یُؤْمِنُوْا بِهٰذَا الْحَدِیْثِ اَسَفًا

অর্থাৎ, মনে হয় যেন আপনি ওদের পিছনে পরিতাপ করতে করতে স্বীয় প্রাণ নাশ করে ফেলবেন, যদি ওরা এই বাণীর প্রতি ঈমান না আনে। Ñসূরা কাহ্ফ (১৮) : ৬

এমনকি অকৃতজ্ঞ উম্মতের ধৃষ্টতার সামনেও তাঁর দয়ার বাঁধ ছিল অটল। তায়েফবাসীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাওহীদের বাণী, হেদায়েতের পয়গাম। তাদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন মুক্তির পথ। কিন্তু তাদের অজ্ঞতা তাদের উপর চেপে বসল। চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে তারা নবীজীর উপর চড়াও হল। পাথরের আঘাতে তাঁকে জর্জরিত করল। আঘাতে আঘাতে তাঁকে রক্তাক্ত করে ফেলল। কেঁপে উঠল আল্লাহর আরশ। পাঠালেন জিবরীল আমীনকে। জিবরীল বললেন-

إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَمَا رَدّوا عَلَيْكَ، وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْكَ مَلَكَ الْجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ، قَالَ: فَنَادَانِي مَلَكُ الْجِبَالِ وَسَلّمَ عَلَيّ، ثُمّ قَالَ: يَا مُحَمّدُ، إِنّ اللهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَأَنَا مَلَكُ الْجِبَالِ وَقَدْ بَعَثَنِي رَبّكَ إِلَيْكَ لِتَأْمُرَنِي بِأَمْرِكَ، فَمَا شِئْتَ، إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الْأَخْشَبَيْنِ

আপনার কওম আপনার উদ্দেশে যা বলেছে এবং আপনার সাথে যে আচরণ করেছে আল্লাহ তা দেখেছেন। আপনার আদেশ পালনে পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাকে পাঠিয়েছেন। তখন পাহাড়ের ফিরিশতা আমাকে সম্বোধন করে সালাম দিল এবং বলল, আমি পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতা। হে মুহাম্মাদ! আপনার কওমের বক্তব্য আল্লাহ শুনেছেন। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার আদেশ পালন করতে। আপনি আমাকে কী আদেশ করবেন করুন। আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে আমি দুই পাহাড়ের মাঝে এদেরকে পিষে ফেলব।

কিন্তু দয়ার সাগর নবীজী জবাব দিলেন-

بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلَابِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا.

(আমি এটা চাই না;) বরং আমি আশা রাখি, আল্লাহ তাআলা এদের বংশধরদের মাঝে এমন মানুষ বের করবেন, যারা এক আল্লাহ্র ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৯৫; সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৩১

একান্ত জাগতিক বিষয়েও উম্মতের বিপদাপদে নবীজী ছিলেন নিঃস্বার্থ সহযোগিতার আধার। সাহাবী হযরত আবূ হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَا مِنْ مُؤْمِنٍ إِلّا وَأَنَا أَوْلَى النّاسِ بِهِ فِي الدّنْيَا وَالآخِرَةِ، اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ: اَلنَّبِیُّ اَوْلٰی بِالْمُؤْمِنِیْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ فَأَيّمَا مُؤْمِنٍ تَرَكَ مَالًا فَلْيَرِثْهُ عَصَبَتُهُ مَنْ كَانُوا، فَإِنْ تَرَكَ دَيْنًا، أَوْ ضَيَاعًا فَلْيَأْتِنِي فَأَنَا مَوْلاَهُ.

অর্থাৎ, দুনিয়া ও আখেরাতে আমি প্রত্যেক মুমিনেরই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতর। ইচ্ছা হলে তোমরা এ আয়াতটি তিলাওয়াত কর-

اَلنَّبِیُّ اَوْلٰی بِالْمُؤْمِنِیْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ.

(মুমিনদের পক্ষে নবী তাদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ঠ।) তাই সম্পদ রেখে কোনো মুমিন মারা গেলে আত্মীয়-স্বজন তার ওয়ারিস হবে। আর যদি সে ঋণ কিংবা অসহায় পরিজন রেখে যায়, তবে তারা যেন আমার নিকট আসে। আমিই তাদের অভিভাবক। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৮১

দেখুন, স্বার্থহীনতার কেমন আদর্শ ছিলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একদিকে অসহায় উম্মতের অভিভাবক তিনি। কিন্তু অপরদিকে তাদের বিত্ত বৈভবের দাবিদার নন। আর তাই তো অন্যত্র নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنّمَا أَنَا لَكُمْ مِثْلُ الْوَالِد.

অর্থাৎ, আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। Ñসহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ৮০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৪৩১

বরং তিনি কি জন্মদাতা পিতার চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ নন?

ইহলোক পাড়ি দিয়ে আখিরাতের কঠিন মুহূর্তেও এ উম্মতের মুক্তির সুপারিশ করবেন তিনি। এই প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ يَدْعُو بِهَا فَيُسْتَجَابُ لَهُ، فَيُؤْتَاهَا، وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

অর্থাৎ, প্রত্যেক নবীকে এমন একটি বিশেষ দুআর অধিকার দেয়া হয়েছে, যা কবুল করা হবে। তারা (দুনিয়াতে) সে দুআ করেছেন এবং তা কবুলও করা হয়েছে। আর আমি আমার দুআ কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের উদ্দেশ্যে মূলতবী রেখেছি। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৯

ইমাম নববী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন-

في هذا الحديث بيان كمال شفقة النبي صلى الله عليه وسلم على أمته، ورأفته بهم، واعتنائه بالنظر في مصالحهم المهمة، فأخر النبي صلى الله عليه وسلم دعوته لأمته إلى أهم أوقات حاجاتهم.

অর্থাৎ, এই হাদীসে উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ মায়া-মমতা ও দরদের কথা এবং তাদের কল্যাণসাধনে তাঁর প্রচেষ্টার কথা  ফুটে উঠেছে। তাইতো তিনি এই উম্মতের জন্য তাঁর বিশেষ দুআ তাদের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য তুলে রেখেছেন।

যার মমতার বিস্তৃতি এত তাঁর জন্য তো মনের চাওয়া-

نکل جاۓ جاں تیرے قدموں کے نیچے                       یہی دل کی حسرت یہی آرزو ہے

তোমার চরণতলে জীবন সঁপে দিই, এই তো হৃদয়ের আশা আকুলতা ।

উম্মতের প্রতি নবীজী কী পরিমাণ দয়ার্দ্র ও অনুগ্রহশীল ছিলেনÑ এখানে তার কিঞ্চিতই বিবৃত হল। আল্লাহ তাআলা এককথায় বড় সুন্দরভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন-

لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ.

(হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছে। তোমাদের যেকোন কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু। সূরা তাওবা (৯) : ১২৮

তো যেই নবী উম্মতের জন্য এতটা মহানুভব ছিলেন; সেই নবীর প্রতি উম্মতের আচরণ কেমন হওয়া চাই!

নবীজীর প্রতি ভালবাসা মুমিনের ঈমান

মুমিনের জীবনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। মহব্বতে রাসূল তো ঈমানের রূহ, মুমিনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই ইশ্ক ও মহব্বত ছাড়া না ঈমানের পূর্ণতা আসে, আর না তার স্বাদ অনুভূত হয়। আর নিছক ভালবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং পার্থিব সমস্ত কিছুর উপর এই ভালবাসাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে ভালবাসার প্রকাশ ঘটতে হবে। হযরত আনাস রা. বলেছেন-

قَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنّاسِ أَجْمَعِينَ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষ থেকে প্রিয় হব। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫

এ শুধু নীতিবাক্য নয়; বাস্তবেই মুমিনকে পৌঁছাতে হবে নবীপ্রেমের এ স্তরে। সকলের উপর, সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহ-আল্লাহর রাসূলকে; এমনকি নিজের জানের উপরও। শুনুন ওমর রা.-এর ঘটনাÑ আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম রা. বলেন-

كُنّا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَهُوَ آخِذٌ بِيَدِ عُمَرَ بْنِ الخَطّابِ، فَقَالَ لَهُ عُمَرُ: يَا رَسُولَ اللهِ، لَأَنْتَ أَحَبّ إِلَيّ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ إِلّا مِنْ نَفْسِي، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لاَ، وَالَذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ، فَقَالَ لَهُ عُمَرُ: فَإِنّهُ الآنَ، وَاللهِ، لَأَنْتَ أَحَبّ إِلَيّ مِنْ نَفْسِي، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: الآنَ يَا عُمَرُ!

একদিন আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। নবীজী ওমর রা.-এর হাত ধরা ছিলেন। ওমর রা. বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার জান ছাড়া। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না ওমর, এতে হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান তাঁর কসম! (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না,) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হই। পরক্ষণেই ওমর রা. বললেন, হাঁ এখন তা হয়েছে; আল্লাহর কসম! (এখন থেকে) আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ ওমর! এখন হয়েছে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৩২

আল্লাহ ও আল্লাহ্র রাসূলের ভালোবাসা যদি সবকিছুর উপরে না হয় তাহলে মুমিন পথ চলবে কীভাবে? আল্লাহ ও আল্লাহ্র রাসূলের আদেশের সামনে সমর্পিত হবে কীভাবে? আজ বাধা হবে সন্তান, কাল স্ত্রী, পরশু পিতা। কখনো বা জানের মায়ায় লংঘিত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ। আর মুমিন তো সেই, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত ও নির্দেশের সামনে সবকিছু পিছে ঠেলতে জানে।

নবীজীর প্রতি ভালবাসা মুমিনের সম্বল

মুমিনের সবচে বড় দৌলত ঈমান। এই মহা দৌলতের স্বাদ যার নসীব হয়, সমস্ত দুঃখ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।

از  محبت  تلخہا  شیریں  شود

মহব্বতের কারণে সকল তিক্ত মিষ্টে পরিণত হয়।

আর এই স্বাদ সে-ই পায়, যার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থাকে। হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

ثَلَاثٌ مَنْ كُنّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنّ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ: مَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبّ إِلَيْهِ مِمّا سِوَاهُمَا...

অর্থাৎ, তিনটি গুণের অধিকারী ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে। তন্মধ্যে প্রথম হল, যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সবচেয়ে প্রিয় হবে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৭

ঈমানের স্বাদ আস্বাদনের নগদ ও সবচেয়ে বড় ফায়দা হল ইবাদত ও আনুগত্যে আগ্রহ লাভ হওয়া। বরং ইবাদতই তখন প্রশান্তির কারণ হয়ে যায়।

إذا حلت الحلاوة قلبا

نشطت في العبادة الأعضاء

অর্থাৎ, হৃদয়ে যখন ঈমানের মিষ্টতা সঞ্চারিত হয়, তখন ইবাদতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্যমী হয়ে ওঠে।

নবীজীর প্রতি ভালবাসা যেমনিভাবে ঈমান ও আমলে উৎকর্ষ লাভের উপায়, তেমনি তা আখিরাতে মহাসাফল্য অর্জনের সম্বল। আর প্রত্যেক মুমিনের কাক্সিক্ষত সে সাফল্য হল আখিরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গলাভ। স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন-

المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبّ

অর্থাৎ, ব্যক্তি যাকে ভালবাসে তার সাথেই তার হাশর হবে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৪০

এ সম্পর্কে বড়ই শিক্ষণীয় ও চমৎকার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন হযরত আনাস রা.। তিনি বলেছেন-

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ مَتَى السّاعَةُ؟ قَالَ: وَمَا أَعْدَدْتَ لِلسّاعَةِ؟ قَالَ: حُبّ اللهِ وَرَسُولِهِ، قَالَ: فَإِنّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ.

قَالَ أَنَسٌ: فَمَا فَرِحْنَا، بَعْدَ الْإِسْلَامِ فَرَحًا أَشَدّ مِنْ قَوْلِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَمَ: فَإِنّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ.

قَالَ أَنَسٌ: فَأَنَا أُحِبّ اللهَ وَرَسُولَهُ، وَأَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ، فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ مَعَهُمْ، وَإِنْ لَمْ أَعْمَلْ بِأَعْمَالِهِمْ.

অর্থাৎ, এক ব্যক্তি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল : ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিয়ামত কবে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কী প্রস্তুতি নিয়েছ কিয়ামতের? সে জবাব দিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালবাস, (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে।

হযরত আনাস রা. বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমাদের কাছে সবচে’ খুশির বিষয় ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথাÑ ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালবাস, (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে।’

আনাস রা. বলেন, আর আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। আবু বকর ও উমরকেও। তাই আশা রাখি, আখেরাতে আমি তাঁদের সাথেই থাকব, যদিও তাঁদের মতো আমল আমি করতে পারিনি। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩৯

আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবাইকে আখিরাতে তাঁর  রাসূলের সঙ্গ দান করেন আমীন।

আনুগত্যই ভালবাসার দাবি

ভালবাসার সারকথাই হচ্ছে, আমি যাকে ভালবাসি তাঁর চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়ার সাথে একাত্ম থাকা। রুওয়াইম ইবনে আহমাদ আল বাগদাদী রাহ. মহব্বতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন

المحبة الموافقة في جميع الأحوال  (كلمة الإخلاص للحافظ ابن رجب ص৩২)

অর্থাৎ, ভালোবাসা হল প্রেমাষ্পদের সাথে সর্বাবস্থায় একাত্ম থাকা।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বতের প্রকাশ হচ্ছে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ করা। যদি তা অগ্রাহ্য করা হয় তাহলে মহব্বতের দাবি করা অযৈাক্তিক। হাকীম মাহমূদ ওয়াররাক রাহ. বলেছেন

لو كان حبك صادقا لأطعته

إن المحب لمن يحب مطيع

অর্থাৎ, যদি তোমার প্রেম খাঁটি হতো তবে তো তুমি তার অনুগত হতে। কারণ প্রেমিক তো প্রেমাষ্পদের অনুগত থাকে। Ñশরহুয যুরকানী আলাল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ, পৃ. ১১৮

দরূদ পাঠ ভালবাসার প্রকাশ

স্বীকৃত বাস্তবতা হল-

من أحب شيئا أكثر ذكره.

অর্থাৎ, যে যাকে ভালোবাসে সে তার কথা বেশি বলে। বারবার তার আলোচনা করতে থাকে।

সুতরাং নবীপ্রেমিকের কাজই হবে তাঁর আনুগত্য, আর শ্বাস-প্রশ্বাস হবে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ। সে যত বেশি তাঁর স্মরণ করবে ততই তার অন্তরে তাঁর প্রতি মহব্বতের প্লাবন হতে থাকবে। ইবনুল কায়্যিম রাহ. দরূদের সুফল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনÑ

أنها سبب لدوام محبته للرسول صلى الله عليه وسلم وزيادتها وتضاعفها

অর্থাৎ, দরূদপাঠ হল ইশকে রাসূলের স্থায়িত্ব ও প্রবৃদ্ধির কারণ।

তাছাড়া দরূদ পাঠ তো এমনিতেই অনেক সাওয়াব ও ফযিলতের বিষয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে মুমিনদেরকে দরূদ পাঠের আদেশ করে বলেছেনÑ

إِنَّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا .

অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি বিশেষ রহমত নাযিল করেন এবং তাঁর জন্য রহমতের দুআ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি অধিক পরিমাণে সালাত ও সালাম পেশ কর। Ñসূরা আহযাব (৩৩) : ৫৬

কোনও এক কবি বলেছেন-

اس دور سکوں سوز میں تسکیں نہ ملیگی                        کیف دل و جاں ذکر پیمبر سے ملیگا

অর্থাৎ, এ অশান্তির কালে শান্তি কোথাও নেই। শান্তি তো পয়গম্বর মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্মরণে।

 

সাহাবীগণের নবীপ্রেমের কিছু নমুনা

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন। তাঁরা সত্যিকারের নবীপ্রেমের বেনজীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

হযরত আবু সুফিয়ান রা. ইসলাম গ্রহণের আগেই এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন-

ما رأيت من الناس أحدا يحب أحدا كحب أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم محمدا

অর্থাৎ, আমি কাউকে এতটা ভালবাসতে দেখিনি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সঙ্গীরা যতটা ভালবাসে। Ñসীরাতে ইবনে হিশাম ২/১৭২; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪/৬৫

এমনিভাবে হযরত উরওয়া ইবনে মাসঊদ রা. ইসলাম গ্রহণের আগে হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় মুশরিকদের পক্ষ হয়ে কথা বলতে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর তিনি নিজ কওমের নিকট এই অনুভূতি পেশ করেছিলেন-

وَاللهِ لَقَدْ وَفَدْتُ عَلَى المُلُوكِ، وَوَفَدْتُ عَلَى قَيْصَرَ، وَكِسْرَى، وَالنّجَاشِيِّ، وَاللهِ إِنْ رَأَيْتُ مَلِكًا قَطّ يُعَظِّمُهُ أَصْحَابُهُ مَا يُعَظِّمُ أَصْحَابُ مُحَمّدٍ مُحَمّدًا، وَاللهِ إِنْ تَنَخّمَ نُخَامَةً إِلّا وَقَعَتْ فِي كَفِّ رَجُلٍ مِنْهُمْ، فَدَلَكَ بِهَا وَجْهَهُ وَجِلْدَهُ، وَإِذَا أَمَرَهُمْ ابْتَدَرُوا أَمْرَهُ، وَإِذَا تَوَضَأَ كَادُوا يَقْتَتِلُونَ عَلَى وَضُوئِهِ.

অর্থাৎ, আমি অনেক রাজা বাদশাহদের কাছে প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছি। কায়সার কিসরা ও নাজাশীর কাছেও গিয়েছি। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে তার সঙ্গীরা যেভাবে ভক্তি করে সেভাবে আমি আর কাউকে দেখিনি তাদের বাদশাহকে ভক্তি করতে। আল্লাহর কসম! তিনি থুথু ফেললেই তাদের কেউ না কেউ তা হাতে নিয়ে নেয় এবং তা চেহারায় ও শরীরে মাখে। তিনি যখন তাদেরকে আদেশ করেন তখন তারা তাঁর আদেশ পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর যখন তিনি অযু করেন তখন তাঁর ওযুতে ব্যবহৃত পানি পাওয়ার জন্য লড়াই করার উপক্রম হয়। সহীহ বুখারী, হাদীস ২৫৮১    

হযরত আনাস রা. বলেন-

لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَالْحَلّاقُ يَحْلِقُهُ، وَأَطَافَ بِهِ أَصْحَابُهُ، فَمَا يُرِيدُونَ أَنْ تَقَعَ شَعْرَةٌ إِلّا فِي يَدِ رَجُلٍ.

অর্থাৎ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তাঁর চুল মুবারক মু-ন করা হচ্ছে আর তাঁর সাহাবীরা তাঁকে ঘিরে আছে। তাঁরা চাইছিলেন তাঁর একটি চুলও যেন মাটিতে না পড়ে। বরং কারো না কারো হাতেই পড়ে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস  ২৩২৫

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. মৃত্যুশয্যায় আয়েশা সিদ্দীকা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলেন-

فِي أَيِّ يَوْمٍ تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ؟ قَالَتْ: يَوْمَ الِاثْنَيْنِ، قَالَ: فَأَيّ يَوْمٍ هَذَا؟ قَالَتْ: يَوْمُ الِاثْنَيْنِ، قَالَ: أَرْجُو فِيمَا بَيْنِي وَبَيْنَ اللّيْلِ.

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন্ দিন ইন্তেকাল করেছেন? আয়েশা রা. জানালেন, সোমবার। তিনি বললেন, আজ কী বার? জবাব দিলেন, সোমবার। তখন তিনি বললেন, হায় যদি আমার মওত রাতের আগেই হতো! সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৮৭

ভালবাসার দৃষ্টান্ত দেখুন। আমার মৃত্যুও যেন হয় সে দিনে, যে দিনে প্রেমাষ্পদের মৃত্যু হয়েছিল।

হযরত আম্র ইবনুল আস রা. মৃত্যুশয্যায় বলেছেন-

وَمَا كَانَ أَحَدٌ أَحَبّ إِلَيّ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَلَا أَجَلّ فِي عَيْنِي مِنْهُ، وَمَا كُنْتُ أُطِيقُ أَنْ أَمْلَأَ عَيْنَيّ مِنْهُ إِجْلَالًا لَهُ، وَلَوْ سُئِلْتُ أَنْ أَصِفَهُ مَا أَطَقْتُ؛ لِأَنِّي لَمْ أَكُنْ أَمْلَأُ عَيْنَيّ مِنْهُ.

এই পৃথিবীতে আমার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই-এর চেয়ে অধিক প্রিয় ও মহান আর কেউ নেই। আমার হৃদয়ে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার এ অবস্থা ছিল যে, আমি তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। আমাকে যদি তাঁর দেহাবয়বের বর্ণনা দিতে বলা হয়, আমি পারব না। কারণ, আমি দুচোখ ভরে তাঁকে দেখতে পারিনি। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯২  

হযরত জাবের রা. বলেন, উহুদ যুদ্ধের সময় রাতে আমার আব্বা আমাকে ডেকে বললেন-

مَا أُرَانِي إِلّا مَقْتُولًا فِي أَوّلِ مَنْ يُقْتَلُ مِنْ أَصْحَابِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَإِنِّي لاَ أَتْرُكُ بَعْدِي أَعَزّ عَلَيّ مِنْكَ، غَيْرَ نَفْسِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.

আমার প্রবল ধারণা, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গীদের মধ্যে আগেভাগেই শহীদ হবো। আর আমি তোমাকেই সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে রেখে যাচ্ছি, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া (কারণ, তিনিই আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়)। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৫১

এই উহুদ যুদ্ধেরই ভয়াবহ মুহূর্তে আরেক সাহাবী হযরত আবু তালহা রা. নিজে ঢাল হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আক্রমণ প্রতিহত করছিলেন। একপর্যায়ে যখন নবীজী উঁকি দিয়ে দেখতে উদ্যত হলেন তখন আবু তালহা রা. বলে উঠলেন-

يَا نَبِيّ اللهِ، بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي، لاَ تُشْرِفْ يُصِيبُكَ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ القَوْمِ، نَحْرِي دُونَ نَحْرِكَ.

ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কুরবান হোক! আপনি উঁকি দেবেন না; পাছে আপনার গায়ে কোনো তীর এসে লাগে। আমার বুক আপনার জন্য উৎসর্গিত। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮১১

কবির ভাষায়-

تمنا یہی ہے یہی آرزو ہے

یہ جان حزیں کاش تجھ  پر فدا ہو

আশা-আকাক্সক্ষা এই তো ছিল শুধু, জীবন যদি হতো তোমাতে বিলীন।

আরেক নারী সাহাবীর ঘটনা তো আরও বিস্ময়কর। উহুদ যুদ্ধেরই ঘটনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনূ দীনারের এক নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যার স্বামী ও ভাই উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। লোকেরা যখন তাকে সমবেদনা জানাতে গেল তখন তিনি জানতে চাইলেন, নবীজী কেমন আছেন?। তারা বলল, ভালো আছেন আলহামদু লিল্লাহ। (তাতেও তাঁর মন শান্ত হল না। বললেন)

أَرُونِيهِ حَتّى أَنْظُرَ إِلَيْهِ.

তবুও আমি নিজে দেখতে চাই; আমাকে দেখাও। অতপর যখন তাকে দেখানো হল তিনি বললেন-

كُلّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ.

(আল্লাহ্র রাসূল, আপনি নিরাপদ আছেন!) আপনার (নিরাপত্তার) পরে সমস্ত বিপদ তুচ্ছ। Ñদালাইলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকী ৩/৩০২; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৯৯

এরকম আরও বহু দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সাহাবায়ে কিরাম রিযওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীরাও নবীপ্রেমের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবার হৃদয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দেন। তাঁর সুন্নাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করার তাওফীক দান করুনÑ আমীন। কবির ভাষায়Ñ

کوئی طلب ہے مجھے زیست  میں تو اتنی ہے

نبی کی چاہ ملے اور بے پناہ ملے

অর্থাৎ, আমার জীবনে যদি কেনো চাওয়া থাকে তবে তা এতটুকুই, যেন নবীর ভালোবাসা অফুরন্ত পাই।

আমরা কিভাবে আমাদের অন্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা বাড়াতে পারি?

উত্তর

আলহামদুলিল্লাহ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার তীব্রতা ব্যক্তির ঈমানের ওপর নির্ভর করে। ব্যক্তির ঈমান বৃদ্ধি পেলে তাঁর প্রতি ভালোবাসাও বেড়ে যায়। কারণ তাঁর প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে- নেককাজ ও আল্লাহ্‌র নৈকট্য। ইসলামী শরিয়তে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসা ফরয।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সেই আল্লাহর শপথ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না; যতক্ষণ না আমি তার নিজের জীবনের চেয়ে, তার বাবা-মা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র হই।’ (বুখারি)রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে:

এক: তিনি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে প্রেরিত। সমস্ত মানুষের কাছে আল্লাহ্‌র দ্বীন বা ধর্ম পৌঁছে দেয়ার জন্য বিশ্ববাসীর মধ্য থেকে আল্লাহ্‌ তাঁকে মনোনীত করেছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে ভালোবাসেন বিধায় ও তাঁর প্রতি রাজি থাকায় তাঁকে নির্বাচিত করেছেন। যদি আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট না হতেন তাহলে তাঁকে মনোনীত করতেন না। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ্‌ যাকে ভালোবাসেন তাঁকে ভালোবাসা এবং আল্লাহ্‌ যার প্রতি সন্তুষ্ট তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া এবং জানা উচিত, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্‌ তাআলার ‘খলিল’। কেউ ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছলে বলা হয় খলিল।

জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা যাওয়ার পাঁচদিন পূর্বে আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: “নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আমার কোন খলিল থাকা থেকে আমি আল্লাহ্‌র কাছে নিজের অবমুক্ততা ঘোষণা করছি। কারণ আল্লাহ্‌ তাআলাই আমাকে খলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যদি আমি আমার উম্মতের মধ্যে কাউকে খলিল হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকে গ্রহণ করতাম।”[সহিহ মুসলিম (৫৩২)]

দুই: আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে যে মর্যাদায় ভূষিত করেছেন আমাদেরকে তাঁর সে মর্যাদা জানা এবং আরও জানা যে, তিনি হচ্ছেন— শ্রেষ্ঠ মানুষ।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কিয়ামতের দিন আমি হব বনী আদমের নেতা। আমার কবর প্রথম উন্মুক্ত করা হবে, আমিই হব প্রথম সুপারিশকারী ব্যক্তি এবং প্রথম যার সুপারিশ গৃহীত হবে”[সহিহ মুসলিম (২২৭৮)]

তিন: আমাদেরকে আরও জানতে হবে যে, আমাদের কাছে দ্বীন পৌঁছানোর জন্য তিনি নানা কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেছেন। যার ফলে দ্বীন আমাদের কাছে পৌঁছেছে। আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমাদের আরও জানা কর্তব্য যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁকে পেটানো হয়েছে, গালমন্দ করা হয়েছে, গালি দেয়া হয়েছে, কাছের লোকজনও তাঁর থেকে দূরে সরে গেছেন, তাঁকে পাগল, মিথ্যাবাদী, যাদুকর ইত্যাদি অভিধা দেয়া হয়েছে। তিনি কাফেরদের সাথে লড়াই করেছেন; যাতে করে দ্বীন রক্ষা পায় এবং আমাদের কাছে দ্বীন পৌঁছে। কাফেরেরা তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং তাঁকে নিজ পরিবার, সম্পদ ও দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক জোট তৈরী করা হয়েছে।

চার: তাঁকে তীব্র ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাঁর সাহাবায়ে কেরামের অনুকরণ করা। সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে নিজ সম্পদ ও সন্তানের চেয়ে; বরং নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আসুন এ রকম কিছু নমুনা জানি:

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “একবার আমি দেখেছি নাপিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চুল ফেলছে; আর সাহাবীরা তাঁর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে; যেন একটা চুল পড়লেও সেটা কারো একজনের হাতে পড়ে।”[সহিহ মুসলিম (২৩২৫)]

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “ওহুদ যুদ্ধের এক পর্যায়ে সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তখন আবু তালহা (রাঃ) ঢাল হাতে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্মুখে প্রাচীরের ন্যায় অটল হয়ে দাঁড়ালেন। আবু তালহা (রাঃ) সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। অনবরত তীর ছুড়তে থাকায় তাঁর হাতে দুই বা তিনটি ধনুক ভেঙ্গে যায়। সে সময় তীর ভর্তি শরাধার নিয়ে যে কেউ তাঁর নিকট দিয়ে যেতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেই বলতেন, তোমার তীরগুলো বের করে আবু তালহাকে দাও। এক সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা উঁচু করে শত্রুদের অবস্থা অবলোকন করতে চাইলে আবু তালহা (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক। আপনি মাথা উঁচু করবেন না। মাথা উঁচু করলে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর এসে আপনার গায়ে লাগতে পারে। আমার বক্ষ যেন (ঢাল স্বরূপ) আপনার বক্ষের সামনে থাকে।...”[সহিহ বুখারী (৩৬০০) ও সহিহ মুসলিম (১৮১১)]

পাঁচ: তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা; সেটা তাঁর কথা হোক কিংবা কাজ। রাসূলের সুন্নত যেন হয় আপনার জীবনাদর্শ। সারা জীবন তাঁর সুন্নত অনুসারে চলবেন। তাঁর কথাকে সকল কথার উপর প্রাধান্য দিবেন, তাঁর নির্দেশকে সকল নির্দেশের উপর প্রাধান্য দিবেন। এছাড়া আপনি তাঁর সাহাবায়ে কেরাম যে আকিদা পোষণ করত সে আকিদা পোষণ করবেন, এরপর তাবেয়িগণ যে আকিদা পোষণ করত সে আকিদা পোষণ করবেন, তাঁদের পর আজ অবধি যারা তাঁদেরকে যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন তথা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত; তাদের আকিদা পোষণ করবেন। বিদআতের অনুসরণ করবেন না; বিশেষত রাফেযিদের অনুসরণ করবেন না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে রাফেযিরা কঠোর হৃদয়ের অধিকারী। রাফেযিরা তাদের ইমামগণকে তাঁর উপরে প্রাধান্য দেয় এবং ইমামদেরকে তাঁর চেয়ে বেশি ভালোবাসে।

আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর রাসূলের ভালোবাসা দান করেন, আমাদের কাছে তাঁকে সন্তানসন্ততি, পিতামাতা, পরিবার-পরিজন ও নিজেদের জানের চেয়ে বেশি প্রিয় করে দেন।

নবিজীকে কেন ভালোবাসবেন?

No comments

Powered by Blogger.