আতিথেয়তার আদব সমূহ
আতিথেয়তার আদব সমূহ
মানুষ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী বা অন্য কারো নিকটে অতিথি হয় ও আতিথ্য গ্রহণ করে। ইসলাম এক্ষেত্রে কিছু আদব পালন করার নির্দেশ দিয়েছে। এগুলি মেনে চলার মাধ্যমে পাস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর করা এবং নেকী অর্জনের চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। নিম্নে আতিথেয়তার আদব উল্লেখ করা হ’ল।-
ক. আপ্যায়নকারীর জন্য আদব :
মেযবানকে কিছু শিষ্টাচার পালন করতে হবে। এতে সে
ছওয়াবের অধিকারী হবে এবং মেহমানের সমাদরও যথাযথ হবে। আপ্যায়নকারীর জন্য নিম্নের
আদবগুলি মেনে চলা উচিত।
১. আল্লাহভীরুদের দাওয়াত দেওয়া :
দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে
মুত্তাক্বী-পরহেযগার ব্যক্তিদের মনোনীত করার জন্য রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِىٌّ ‘মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে
বন্ধু বানাবে না এবং আল্লাহভীরু লোক ছাড়া অন্য কেউ যেন তোমার খাদ্য না খায়’।[1] এই নিষেধের দ্বারা
উদ্দেশ্য হচ্ছে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব না করা ও তাদের সঙ্গী না হওয়া। যেমন আল্লাহ
বলেন,لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ، ‘আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী
এমন কোন সম্প্রদায়কে তুমি পাবে না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের
সাথে বন্ধুত্ব করে। যদিও তারা তাদের বাপ-দাদা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বেরাদর বা
আত্মীয়-স্বজন হৌক’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)। আর ‘মুত্তাক্বী ব্যতীত অন্যদের
খাদ্য খাওয়াবে না’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল মুত্তাক্বীদের সাহচর্যকে
আবশ্যক করে নেওয়া ও তাদের সাথে মেশা এবং পাপীদের সংশ্রব ত্যাগ করা। অর্থাৎ
আল্লাহভীরুদের সম্মান করা।[2]
খাত্ত্বাবী বলেন, এ নির্দেশ
দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়ানোর ক্ষেত্রে নয়। কেননা
আল্লাহ বলেন,وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا، إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا، ‘তারা আল্লাহর মহববতে অভাবগ্রস্ত,
ইয়াতীম ও বন্দীদের আহার্য প্রদান করে। (এবং তারা বলে) শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি
লাভের জন্য আমরা তোমাদের খাদ্য দান করে থাকি এবং তোমাদের নিকট থেকে আমরা কোন
প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না’ (দাহর ৭৬/৮-৯)।
আর বন্দী সাধারণত কাফের হয়ে থাকে। এখানে তাক্বওয়াহীন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব না
করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।[3]
২. শুধু ধনীদের বেছে বেছে
দাওয়াত না দেওয়া :
কোন অনুষ্ঠানে বেছে বেছে
কেবল ধনীদের দাওয়াত দেওয়া এবং দরিদ্রদের পরিত্যাগ করা শরী‘আত সম্মত নয়। বর্তমানে মানুষ
উপহার-উপঢৌকন লাভের জন্য দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধনীদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। হাদীছে
একে নিকৃষ্ট অনুষ্ঠান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,شَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ، يُدْعَى لَهَا الْأَغْنِيَاءُ وَيُتْرَكُ الْفُقَرَاءُ، ‘যে ওয়ালীমায় ধনীদের দাওয়াত
দেয়া হয় এবং গরীবদের উপেক্ষা করা হয় তাহ’ল সর্বাধিক নিকৃষ্ট ওয়ালীমা’।[4]
৩. দাওয়াত যেন গর্ব-অহংকার
প্রকাশের জন্য না হয় :
মানুষকে খাদ্য খাওয়ানো নেকী
অর্জনের মাধ্যম এবং এটা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে
আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
أَنَّ رَجُلًا سَأَلَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ؟ قَالَ: تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتَقْرَأُ السَّلَامَ، عَلَى مَنْ عَرَفْتَ، وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ،
‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কোন্ ইসলাম উত্তম? (অর্থাৎ ইসলামে কোন
কাজ উত্তম)। তিনি বললেন, (ক্ষুধার্তকে) খাদ্য খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে
সালাম দেয়া’।[5] সুতরাং নেকী অর্জনের এই কাজটি যেন গর্ব-অহংকারের বিষয়ে
পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যথা তা গোনাহের কারণ হবে। বস্ত্ততঃ খাদ্য
খাওয়ানোর উদ্দেশ্য হবে ছওয়াব লাভ, রাসূলের অনুসরণ এবং ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ককে সুদৃঢ় ও
মযবূত করা।
৪. মেহমানকে স্বাগত জানানো :
মেহমানকে অভ্যর্থনা জানানো
মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) তাঁর নিকটে আগত মেহমানদেরকে স্বাগত জানাতেন। ইবনু আববাস
(রাঃ) বলেন, আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দল নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আসলে তিনি
বললেন,مَرْحَبًا بِالْوَفْدِ وَالْقَوْمِ، غَيْرَ خَزَايَا وَلاَ نَدَامَى ‘এই প্রতিনিধি দলের প্রতি ‘মারহাবা’, লাঞ্ছনা ও লজ্জা বিহীন’।[6] অন্যত্র এসেছে, উম্মু
হানী বিনতু আবূ তালিব (রাঃ) বলেন, আমি মক্কা বিজয়ের বছর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর
নিকট গিয়ে দেখলাম যে, তিনি গোসল করছেন আর তাঁর মেয়ে ফাতিমা (রাঃ) তাঁকে আড়াল করে
রেখেছেন। তিনি বলেন, আমি তাঁকে সালাম প্রদান করলাম। তিনি জানতে চাইলেন, এ কে? আমি
বললাম, আমি উম্মু হানী বিনতু আবূ তালিব। তিনি বললেন, মারহাবা, হে উম্মু হানী![7]
৫. অতিথিকে সম্মান করা :
অতিথিকে সম্মান করা রাসূল
(ছাঃ)-এর নির্দেশ। তাই সাধ্যমত মেহমানকে সম্মান করা মেযবানের জন্য যরূরী। রাসূল
(ছাঃ) বলেন, وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও
আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন মেহমানের সম্মান করে’।[8] সুতরাং মেহমানকে সম্মান
করা ঈমানের বহিঃপ্রকাশ।
৬. অতিথিকে দ্রুত খাবার
পরিবেশন করা ও তার প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখা :
অতিথি বাড়ীতে আসার পর
যথাসম্ভব দ্রুত তাকে আপ্যায়ন করা। অর্থাৎ বিলম্ব না করে খাদ্য পরিবেশন করা। কেননা
এটা তার সমাদর ও যত্নের অন্যতম দিক। যেমন আল্লাহ বলেন,
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ، إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ سَلَامٌ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ، فَرَاغَ إِلَى أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ، فَقَرَّبَهُ إِلَيْهِمْ قَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ،
‘তোমার কাছে কি ইবরাহীমের
সম্মানিত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে? যখন তারা তার কাছে আসল ও বলল, ‘সালাম’। উত্তরে সেও বলল, ‘সালাম’। এরা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর
সে দ্রুত চুপিসারে নিজ পরিবারবর্গের কাছে গেল এবং একটি মোটা-তাজা গো-বাছুর (ভাজা)
নিয়ে আসল। অতঃপর সে তা তাদের সামনে পেশ করল ও বলল, ‘তোমরা কি খাবে না’? (যারিয়াত
৫১/২৪-২৭)। এ আয়াতে প্রতীয়মান হয় যে, ইবরাহীম (আঃ) মেহমানদের জন্য দ্রুত খাদ্য
প্রস্ত্তত করলেন এবং তাদের সামনে পেশ করলেন।
আপ্যায়নের পাশাপাশি অন্যান্য
প্রয়োজন যেমন গোসলখানা, টয়লেট ইত্যাদি দেখিয়ে দেওয়া, সাবান, তেল, তোয়ালে, লুঙ্গি
ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।
৭. মেহমানের আপ্যায়ন নিজে
করা :
মেহমানের আপ্যায়ন সাধ্যপক্ষে
মেযবানকে নিজেই করা উচিত। যেমন ইবরাহীম (আঃ) নিজেই মেহমানদের জন্য খাদ্যের
ব্যবস্থা করেছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, فَرَاغَ إِلَى أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ، فَقَرَّبَهُ إِلَيْهِمْ قَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ، ‘অতঃপর সে দ্রুত চুপিসারে নিজ
পরিবারবর্গের কাছে গেল এবং একটি মোটা-তাজা গো-বাছুর (ভাজা) নিয়ে আসল। অতঃপর সে তা
তাদের সামনে পেশ করল ও বলল, ‘তোমরা কি খাবে না’? (যারিয়াত
৫১/২৬-২৭)। এজন্য ইমাম বুখারী অধ্যায় রচনা করেছেন,باب إِكْرَامِ الضَّيْفِ وَخِدْمَتِهِ إِيَّاهُ بِنَفْسِهِ ‘মেহমানের সম্মান করা এবং
নিজেই মেহমানের খিদমত করা’ অনুচ্ছেদ।[9]
৮. অতিথির সাথে অভিনয় বা ভান
না করা :
অতিথির সাথে কৃত্রিম আচরণ না
করা কিংবা এমন কোন ব্যবহার না করা যাতে তার নিকটে অভিনয় প্রকাশ পায়। আনাস (রাঃ)
বলেন, كُنَّا عِنْدَ عُمَرَ فَقَالَ نُهِينَا عَنِ التَّكَلُّفِ، ‘আমরা ওমর (রাঃ)-এর কাছে
ছিলাম। তখন তিনি বললেন, (যাবতীয়) কৃত্রিমতা হ’তে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে’।[10] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ)
বলেন,لاَ يَتَكَلَّفَنَّ أَحَدٌ لِضَيْفِهِ مَا لاَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ- ‘কেউ যেন তার মেহমানের সাথে
এমন কৃত্রিম আচরণ না করে, যা করার সাধ্য (প্রকৃতপক্ষে) তার নেই’।[11] অনেকে মেহমানের
সমাদরের জন্য অন্যের নিকট থেকে টাকা ঋণ নিয়ে অতিরক্তি খরচ করে থাকে। অনেকে খরচের
ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। এটা রাসূলের সুন্নাত নয়। বরং নিজের সাধ্যের মধ্যে
মেহমানের সমাদর করতে হবে।
৯. অতিথিকে নিজেদের উপরে
প্রাধান্য দেওয়া :
নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনের
উপরে অতিথিকে প্রাধান্য দেওয়া। এতে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করা যায়। এক্ষেত্রে আবু
তালহা (রাঃ) ও তার স্ত্রী কর্তৃক মেহমান আপ্যায়নের ঘটনা স্মর্তব্য। আবূ হুরায়রা
(রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে আসল। তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে
লোক পাঠালেন। তারা জানালেন, আমাদের নিকট পানি ছাড়া কিছুই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বললেন, কে আছ যে এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসাবে নিয়ে নিজের সাথে খাওয়াতে পার?
তখন এক আনছার ছাহাবী [আবূ ত্বলহা (রাঃ)] বললেন, আমি। এ বলে তিনি মেহমানকে নিয়ে
গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মেহমানকে সম্মান কর। স্ত্রী
বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনছার বললেন, তুমি আহার
প্রস্তুত কর, বাতি জ্বালাও এবং বাচ্চারা খাবার চাইলে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সে
বাতি জ্বালাল, বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়াল এবং সামান্য খাবার যা তৈরি ছিল তা উপস্থিত
করল। বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তারা
স্বামী-স্ত্রী দু’জনই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মত শব্দ করতে
লাগলেন এবং মেহমানকে বুঝাতে লাগলেন যে, তারাও সঙ্গে খাচ্ছেন। তারা উভয়েই সারা রাত
অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গেলেন, তখন তিনি
বললেন, আল্লাহ তোমাদের গত রাতের কান্ড দেখে হেসে দিয়েছেন অথবা বলেছেন খুশী হয়েছেন
এবং এ আয়াত নাযিল করেছেন। ‘আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়,
যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্ততঃ যারা নিজেদেরকে হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে বাঁচাতে পেরেছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।[12]
১০. ডানদিক থেকে খাবার
পরিবেশন শুরু করা :
প্রথমে ডান দিক থেকে খাবার
পরিবেশন করা সুন্নাত। সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) বলেন,
أُتِىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِقَدَحٍ فَشَرِبَ مِنْهُ، وَعَنْ يَمِيْنِهِ غُلاَمٌ أَصْغَرُ الْقَوْمِ، وَالأَشْيَاخُ عَنْ يَسَارِهِ فَقَالَ يَا غُلاَمُ أَتَأْذَنُ لِىْ أَنْ أُعْطِيَهُ الأَشْيَاخَ. قَالَ مَا كُنْتُ لأُوْثِرَ بِفَضْلِى مِنْكَ أَحَدًا يَا رَسُولَ اللهِ. فَأَعْطَاهُ إِيَّاهُ-
‘নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট একটি
পেয়ালা আনা হ’ল। তিনি তা হ’তে পান করলেন। তখন তাঁর ডান
দিকে ছিল একজন বয়ঃকনিষ্ঠ বালক আর বয়স্ক লোকেরা ছিলেন তাঁর বাম দিকে। তিনি বললেন,
হে বালক! তুমি কি আমাকে অবশিষ্ট (পানিটুকু) বয়স্কদেরকে দেয়ার অনুমতি দিবে? সে বলল,
হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার নিকট থেকে ফযীলত পাওয়ার ব্যাপারে আমি আমার চেয়ে
অন্য কাউকে প্রাধান্য দিব না। অতঃপর তিনি তা তাকে প্রদান করলেন’।[13] অন্যত্র এসেছে, আনাস
ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
حُلِبَتْ لِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم شَاةٌ دَاجِنٌ وَهِىَ فِى دَارِ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، وَشِيْبَ لَبَنُهَا بِمَاءٍ مِنَ الْبِئْرِ الَّتِى فِى دَارِ أَنَسٍ، فَأَعْطَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْقَدَحَ فَشَرِبَ مِنْهُ، حَتَّى إِذَا نَزَعَ الْقَدَحَ مِنْ فِيهِ، وَعَلَى يَسَارِهِ أَبُو بَكْرٍ وَعَنْ يَمِيْنِهِ أَعْرَابِىٌّ فَقَالَ عُمَرُ وَخَافَ أَنْ يُعْطِيَهُ الأَعْرَابِىَّ أَعْطِ أَبَا بَكْرٍ يَا رَسُولَ اللهِ عِنْدَكَ. فَأَعْطَاهُ الأَعْرَابِىَّ الَّذِى عَلَى يَمِيْنِهِ، ثُمَّ قَالَ الأَيْمَنَ فَالأَيْمَنَ.
‘রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য একটি
বকরীর দুধ দোহন করা হ’ল। তখন তিনি আনাস ইবনু মালেক (রাঃ)-এর ঘরে
অবস্থান করছিলেন এবং সেই দুধের সঙ্গে আনাস ইবনু মালেকের বাড়ীর কূয়ার পানি মেশানো হ’ল। তারপর পাত্রটি আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ)-কে দেয়া হ’ল। তিনি তা হ’তে পান করলেন। পাত্রটি তাঁর
মুখ হ’তে আলাদা করার পর তিনি
দেখলেন যে, তাঁর বাম দিকে আবূবকর ও ডান দিকে একজন বেদুঈন রয়েছে। পাত্রটি তিনি হয়ত
বেদুঈনকে দিয়ে দিবেন এ আশঙ্কায় ওমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আবূবকর
(রাঃ) আপনারই পাশে, তাকে পাত্রটি দিন। তিনি বেদুঈনকে পাত্রটি দিলেন, যে তাঁর ডান
পাশে ছিল। অতঃপর তিনি বললেন, ডান দিকের লোক বেশী হক্বদার’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন, الأَيْمَنُوْنَ، الأَيْمَنُوْنَ، أَلاَ فَيَمِّنُوْا ‘ডান দিকের ব্যক্তিদেরই
(অগ্রাধিকার), ডান দিকের ব্যক্তিদের (অগ্রাধিকার)। শোন! ডান দিক থেকেই শুরু করবে’।[15] আনাস (রাঃ) বলেন, এটাই
সুন্নাত, এটাই সুন্নাত, এটাই সুন্নাত।[16]
১১. মেহমানের সামনে রাগ না
করা ও অসহনশীল না হওয়া :
মেহমানের সামনে রাগ প্রকাশ
করা এবং তার সম্মুখে অসহনশীল আচরণ করা সমীচীন নয়। আব্দুর রহমান ইবনু আবূ বকর (রাঃ)
হ’তে বর্ণিত যে, একবার আবূ বকর
ছিদ্দীক (রাঃ) কিছু লোককে মেহমান হিসাবে গ্রহণ করলেন। তিনি (তাঁর পুত্র) আব্দুর
রহমানকে নির্দেশ দিলেন, তোমার এ মেহমানদের নিয়ে যাও। আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট
যাচ্ছি। আমি ফিরে আসার পূর্বেই তুমি তাঁদের খাওয়ানো সেরে নিও। আব্দুর রহমান তাদের
নিয়ে চলে গেলেন এবং তাঁর ঘরে যা ছিল তা সামনে পেশ করে দিয়ে তাদের বললেন আপনারা
খেয়ে নিন। তাঁরা বললেন, আমাদের এ বাড়ীর মালিক কোথায়? তিনি বললেন, আপনারা খেয়ে নিন।
তাঁরা বললেন, বাড়ীর মালিক না আসা পর্যন্ত আমরা খাব না। তিনি বললেন, আমাদের তরফ
থেকে আপনারা আপনাদের খাবার খেয়ে নিন। কারণ আপনারা না খেলে তিনি এলে আমার উপর
রাগান্বিত হবেন। কিন্তু তাঁরা অস্বীকার করলেন। আমি ভাবলাম যে, তিনি অবশ্যই আমার
উপর রাগান্বিত হবেন।
তারপর তিনি ফিরে আসলে আমি
তাঁর থেকে এক পাশে সরে পড়লাম। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কী করেছেন। তখন
তারা তাঁকে সব বর্ণনা করলেন। তখন তিনি বললেন, হে আব্দুর রহমান! তখন আমি চুপ
থাকলাম। তিনি আবার ডাকলেন, হে আব্দুর রহমান! এবারেও আমি চুপ থাকলাম। তিনি আবার
ডেকে বললেন, ওরে মূর্খ! আমি তোকে কসম দিচ্ছি। যদি আমার কথা শুনে থাকিস, তবে কেন
আসছিস না? তখন আমি বেরিয়ে এসে বললাম, আপনি আপনার মেহমানদের জিজ্ঞেস করুন।
তখন তারা বললেন, সে ঠিকই
আমাদের খাবার এনে দিয়েছিল। তিনি বললেন, তবুও কি আপনারা আমার অপেক্ষা করছেন?
আল্লাহর কসম! আমি আজ রাতে তো খাব না। মেহমানরাও বললেন, আল্লাহর কসম! আপনি যে
পর্যন্ত না খাবেন ততক্ষণ আমরাও খাবো না। তখন তিনি বললেন, আমি আজ রাতের মত মন্দ রাত
আর দেখিনি। আমাদের প্রতি আক্ষেপ। আপনারা কি আমাদের খাবার কবুল করলেন না? তখন তিনি
আব্দুর রহমানকে (ডেকে) বললেন, তোমার খাবার নিয়ে এসো। তিনি তা নিয়ে আসলে তিনিই
খাবারের উপর নিজ হাত রেখে বললেন, বিসমিল্লাহ। এ প্রথম ঘটনাটা শয়তানের কারণেই
ঘটেছে। তারপর তিনি খেলেন এবং তারাও খেলেন।[17]
১২. সেবার মাধ্যমে অতিথিকে
কষ্ট না দেওয়া :
অতিথির সেবা-যত্ন করতে গিয়ে
এমন অতিরিক্ত কিছু না করা যাতে সেটা তার কষ্টের কারণ হয়। যেমন জোর করে বেশী খাবার
তুলে দেওয়া কিংবা তার সাথে বেশী সময় দিতে গিয়ে এবং তার সাথে আলাপচারিতা করতে গিয়ে
তার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো ইত্যাদি।
১৩. মেহমানের কারণে বিরক্তি
বা অস্বস্তি প্রকাশ না করা :
মেহমানের আগমনের কারণে
বিরক্তি প্রকাশ না করা এবং তার সাথে কথাবার্তা ও আচরণে যেন সেটা প্রকাশ না পায়
সেদিকে লক্ষ্য রাখা। তার সাথে হাসিমুখে ও ভালভাবে কথা বলা এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে
সাক্ষাৎ করা। তার আগমনে মেযবান অসন্তুষ্ট নয়, এটা যাতে মেহমানের সামনে ফুটে ওঠে
সেই চেষ্টা করা।
১৪. মেহমান খাবার গ্রহণ শেষ
করার পূর্বে খাবার তুলে না নেওয়া :
খাবার পরিবেশনের পরে লক্ষ্য
রাখতে হবে যে, মেহমান তার প্রয়োজন মত খাবার গ্রহণ করেছেন কি-না। তার প্রয়োজন পূর্ণ
হওয়ার পূর্বে খাবার উঠিয়ে নেওয়া সমীচীন নয়। অনেক ক্ষেত্রে মেহমান লজ্জায় খাবার কম
খেতে পারে কিংবা খাদ্যের পাত্র তুলে নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করলে প্রয়োজন থাকা
সত্ত্বেও তিনি শরমে খাবার গ্রহণ শেষ করতে পারেন। তাই পাত্র তোলার পূর্বে এ বিষয়ে
খেয়াল রাখতে হবে।
১৫. বিদায়কালে মেহমানের সাথে
বাড়ীর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া :
মেহমান যখন চলে যেতে চাইবেন
তখন তার সাথে বাড়ীর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া মুস্তাহাব। এতে বদান্যতা যেমন প্রকাশ
পায়, তেমনি এটা মেহমানের সমাদর ও যত্নের পূর্ণতা এবং তার উত্তম আতিথেয়তার
বহিঃপ্রকাশ।[18]
খ. মেহমানের জন্য আদব :
মেযবানের ন্যায় মেহমানেরও
কিছু আদব রয়েছে। মেহমানের করণীয় সম্পর্কে আবু লাইছ সামারকান্দী বলেন, মেহমানের ৪টি
করণীয়- ১. তাকে যেখানে আসন দেওয়া হবে, সেখানে বসবে, ২. মেযবান তাকে যেভাবে আপ্যায়ন
করবে তাতে সন্তুষ্ট থাকবে, ৩. মেযবানের অনুমতি ব্যতীত তার বাড়ী থেকে বের হবে না,
৪. খানা শেষে মেযবানের জন্য দো‘আ করবে।[19] এ আদবগুলো পালন করলে সমাজ সুন্দর
হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। এছাড়া আরো যেসব আদব রয়েছে নিম্নে সেগুলো পেশ করা
হ’ল।-
১. দাওয়াত কবুল করা :
কাউকে দাওয়াত দেওয়া হ’লে দাওয়াত কবুল করা উচিত।
কোন অযুহাত দেখিয়ে তা প্রত্যাখ্যান কর উচিত নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ دُعِىَ إِلَى عُرْسٍ أَوْ نَحْوِهِ فَلْيُجِبْ ‘যাকে বিবাহ বা অনুরূপ কোন
অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হয়, সে যেন তা কবুল করে’।[20] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ)
বলেন,إِذَا دُعِىَ أَحَدُكُمْ إِلَى طَعَامٍ فَلْيُجِبْ فَإِنْ شَاءَ طَعِمَ وَإِنْ شَاءَ تَرَكَ، ‘তোমাদের কাউকে খাওয়ার দাওয়াত
দেয়া হ’লে সে যেন তা কবুল করে।
অতঃপর ইচ্ছা হ’লে খাবে নতুবা (খাওয়া) পরিত্যাগ করবে’।[21]
২. দাওয়াত কবুল করার
ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র পার্থক্য না করা :
দাওয়াত কবুল করার ক্ষেত্রে
ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য করা উচিত নয়। কেননা গরীবের দাওয়াত কবুল না করলে সমাজের
সদস্যদের মাঝে পারস্পরিক বন্ধন ছিন্ন হবে। ভ্রাতৃত্বের সুসম্পর্ক বিনষ্ট হবে।
উচু-নীচু পার্থক্য করার কারণে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য তৈরী হবে। আর এ কারণে
দাওয়াতদাতা মেহমানকে অহঙ্কারী ভাববে।
৩. ছিয়ামের কারণে অনুপস্থিত
না থাকা :
কেউ দাওয়াত দিলে ছিয়াম
অবস্থায়ও অংশগ্রহণ করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا دُعِىَ أَحَدُكُمْ فَلْيُجِبْ فَإِنْ كَانَ صَائِمًا فَلْيُصَلِّ وَإِنْ كَانَ مُفْطِرًا فَلْيَطْعَمْ. ‘তোমাদের কাউকে দাওয়াত দেয়া হ’লে সে যেন তা কবুল করে। সে
ছায়েম হ’লে দাওয়াতকারীর জন্য দো‘আ করবে। আর ছায়েম না হ’লে খাবার খাবে’।[22] অন্যত্র তিনি বলেন,إِذَا دُعِيَ أَحَدُكُمْ إِلىَ طَعَامٍ فَلْيُجِبْ فَإِنْ كَانَ مُفْطِرًا فَلْيَأْكُلْ وَإِنْ كَانَ صَائِمًا فَلْيَدْعُ بِالْبَرَكَةِ. ‘তোমাদের কাউকে খাওয়ার দাওয়াত
দেয়া হ’লে সে যেন তা কবুল করে। সে
ছায়েম না হ’লে খাবার খাবে। আর ছায়েম হ’লে দাওয়াতকারীর জন্য বরকতের
দো‘আ করবে’।[23]
৪. মেযবানের বাড়ীতে যেতে
দীর্ঘক্ষণ বিলম্ব না করা :
কাউকে দাওয়াত দেওয়া হ’লে মেযবানের বাড়ীতে যেতে
অধিক বিলম্ব না করা, তাহ’লে মেযবান অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হবেন। আবার
অতি দ্রুত গমন না করা, যাতে মেযবানের খাবার তৈরীর পূর্বেই তার বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত
হয়। এতে তার কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
৫. মেযবানের বাড়ীতে প্রবেশ ও
বিদায়কালে অনুমতি নেওয়া :
মেযবানের বাড়ীতে প্রবেশকালে
সালাম দেওয়ার মাধ্যমে অনুমতি নেওয়া যরূরী। যাতে মেযবান বাড়ীর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ
ঠিক করতে পারেন এবং মেহমানকে তার উপযুক্ত বসার ব্যবস্থা করতে পারেন। আর তিনি খানা
প্রস্ত্তত করতে পারেন। অনুমতি গ্রহণের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَنْ يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَى طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِينَ إِنَاهُ وَلَكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِيْنَ لِحَدِيثٍ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে
অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা খাওয়ার জন্য আহার্য প্রস্ত্ততির অপেক্ষা না করে নবীগৃহে
প্রবেশ করো না। তবে যখন তোমাদের ডাকা হবে, তখন প্রবেশ করো। অতঃপর খাওয়া শেষে
বেরিয়ে পড়ো। অহেতুক গল্প-গুজবে রত হয়ো না’ (আহযাব ৩৩/৫৩)।
অনুরূপভাবে বিদায়কালেও মেযবানের অনুমতি নিয়ে তার বাড়ী থেকে বের হওয়া উচিত।
৬. মেযবানের বাড়ীতে তিন
দিনের অধিক না থাকা :
কোথাও বেড়াতে গিয়ে মেযবানের
বাড়ীতে তিন দিনের বেশী থাকা উচিত নয়। কেননা এটা সুন্নাত পরিপন্থী। আবূ শুরায়হ্
আদাবী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন কথা বলেছিলেন,
তখন আমার দু’কান শুনছিল ও আমার দু’চোখ দেখছিল। তিনি বলছিলেন,
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ جَارَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ جَائِزَتَهُ قَالَ وَمَا جَائِزَتُهُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ يَوْمٌ وَلَيْلَةٌ وَالضِّيَافَةُ ثَلَاثَةُ أَيَّامٍ فَمَا كَانَ وَرَاءَ ذَلِكَ فَهُوَ صَدَقَةٌ عَلَيْهِ،
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ
দিনের উপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও
শেষ দিনের উপর বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে তার প্রাপ্যের বিষয়ে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল, মেহমানের প্রাপ্য কী হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি
বললেন, একদিন একরাত ভালভাবে আপ্যায়ন করা। আর তিন দিন হ’লে (সাধারণ) আপ্যায়ন। তার
চেয়ে অধিক হ’লে তা মেযবানের জন্য ছাদাক্বা’।[24]
অন্য বর্ণনায় আছে,وَلاَ يَحِلُّ لِرَجُلٍ مُسْلِمٍ أَنْ يُقِيمَ عِنْدَ أَخِيهِ حَتَّى يُؤْثِمَهُ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يُؤْثِمُهُ قَالَ يُقِيمُ عِنْدَهُ وَلاَ شَىْءَ لَهُ يَقْرِيهِ بِهِ. ‘কোন মুসলিমের জন্য তার
ভাইয়ের নিকট এতটা থাকা বৈধ নয়, যাতে সে তাকে গোনাহগার করে ফেলে। লোকেরা জিজ্ঞেস
করল, হে আল্লাহর রাসূল! তাকে কিভাবে গোনাহগার করে ফেলে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘সে তার কাছে থেকে যায়, অথচ
ওর এমন কিছু থাকে না, যার দ্বারা সে মেহমানের আপ্যায়ন করতে পারে’।[25]
মেহমানের হক সম্পর্কে উকবাহ
বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা বললাম, হে
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাদের কোন জায়গায় পাঠালে আমরা এমন কওমের কাছে হাযির
হই, যারা আমাদের মেহমানদারী করে না। এ ব্যাপারে আপনার হুকুম কী? তখন তিনি আমাদের
বললেন, যদি তোমরা কোন কওমের নিকট হাযির হও, আর তারা তোমাদের মেহমানদারীর জন্য
উপযুক্ত যত্ন নেয়, তবে তোমরা তা গ্রহণ করবে। আর যদি তারা না করে, তাহ’লে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী
তাদের থেকে মেহমানের হক আদায় করে নেবে’।[26]
অন্যত্র তিনি বলেন,أَيُّمَا ضَيْفٍ نَزَلَ بِقَوْمٍ فَأَصْبَحَ الضَّيْفُ مَحْرُوْمًا فَلَهُ أَنْ يَّأْخُذَ بِقَدْرِ قِرَاهُ وَلاَ حَرَجَ عَلَيْهِ، ‘কোন অতিথি যদি কোন
সম্প্রদায়ের নিকটে গমন করে এবং সে বঞ্চিত অবস্থায় সকাল করে, তাহ’লে সে তার প্রয়োজন অনুসারে
আতিথ্য গ্রহণ করতে পারে। এতে তার কোন দোষ নেই’।[27]
৭. দাওয়াত দেওয়া হয়নি এমন
কাউকে সাথে নিয়ে আসতে চাইলে মেযবানের অনুমতি নেওয়া :
অনেক সময় দাওয়াত খেতে যাওয়ার
সময় মেহমান সাথে কাউকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে মেযবানের পূর্বানুমতি গ্রহণ
করা উচিত। আবূ মাস‘ঊদ আনছারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ مِنَ الأَنْصَارِ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ أَبُو شُعَيْبٍ، وَكَانَ لَهُ غُلاَمٌ لَحَّامٌ فَقَالَ اصْنَعْ لِى طَعَامًا أَدْعُو رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَامِسَ خَمْسَةٍ، فَدَعَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَامِسَ خَمْسَةٍ، فَتَبِعَهُمْ رَجُلٌ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِنَّكَ دَعَوْتَنَا خَامِسَ خَمْسَةٍ وَهَذَا رَجُلٌ قَدْ تَبِعَنَا، فَإِنْ شِئْتَ أَذِنْتَ لَهُ، وَإِنْ شِئْتَ تَرَكْتَهُ، قَالَ بَلْ أَذِنْتُ لَهُ-
‘আনছার গোত্রের আবূ শু‘আয়ব নামক জনৈক ব্যক্তির এক
কসাই গোলাম ছিল। সে তাকে বলল, আমার জন্য কিছু খাবার প্রস্তুত কর, আমি রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-কে দাওয়াত করতে চাই। পাঁচজনের মধ্যে তিনি হবেন একজন। তারপর সে নবী করীম
(ছাঃ)-কে দাওয়াত করল। তিনি ছিলেন পাঁচজনের অন্যতম। তখন এক ব্যক্তি তাদের পিছে পিছে
আসতে লাগল। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি তো আমাকে আমাদের পাঁচজনের পঞ্চম ব্যক্তি
হিসাবে দাওয়াত দিয়েছ। এ লোকটা আমাদের পিছে চলে এসেছে। তুমি ইচ্ছে করলে তাকে অনুমতি
দিতে পার, আর ইচ্ছে করলে বাদও দিতে পার। সে বলল, আমি বরং তাকে অনুমতি দিচ্ছি’।[28]
৮. স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও খুশি
মনে ফিরে আসা :
খাবার গ্রহণ শেষে মেযবানের
বাড়ী থেকে খুশি মনে দ্রুত ফিরে আসা উচিত। সেখানে বসে খোশ-গল্প করে সময় অতিবাহিত
করে মেযবানের কাজে ব্যাঘাত ঘটানো সমীচীন নয়। আল্লাহ বলেন,فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِينَ لِحَدِيثٍ ‘অতঃপর খাওয়া শেষে বেরিয়ে
পড়ো। অহেতুক গল্প-গুজবে রত হয়ো না’ (আহযাব ৩৩/৫৩)।
আর যরূরী প্রয়োজনীয় কথা থাকলে তা সংক্ষেপে শেষ করে চলে আসাই শালীনতার পরিচয়।
৯. খাবার গ্রহণের পরে
মেযবানের জন্য দো‘আ করা :
খাদ্য গ্রহণের পরে মেযবানের
জন্য দো‘আ করা সুন্নাত। মেযবানের
জন্য নিম্নোক্ত দো‘আ করা যায়-
اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيْمَا رَزَقْتَهُمْ وَاغْفِرْلَهُمْ وَارْحَمْهُمْ-
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা বা-রিক্
লাহুম ফীমা রাঝাক্বতাহুম ওয়াগফির লাহুম ওয়ার হাম্হুম।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে যে
রিযিক দিয়েছ তাতে তুমি বরকত দান কর, তাদেরকে ক্ষমা করে দাও এবং তাদের উপর রহমত
বর্ষণ কর’।[29] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
اللَّهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَنِى وَأَسْقِ مَنْ أَسْقَانِى
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা আত‘ঈম মান আত‘আমানী ওয়াসক্বি মান
আসক্বানী।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে খাদ্য
খাওয়াও যে আমাকে খাবার খাওয়াছে। আর তাকে পান করাও যে আমাকে পান করিয়েছে’।[30]
১০. মেযবানের কৃতজ্ঞতা
স্বীকার করা :
আপ্যায়নকারী কষ্ট করে
মেহমানকে সাধ্যমত আপ্যায়ন করল, এজন্য তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত। আর শুকরিয়া
আদায় না করলে আল্লাহ শাস্তি দিবেন। তিনি বলেন, لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার
কর, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বেশী বেশী করে দেই। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহ’লে (মনে রেখ) নিশ্চয়ই আমার
শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/৭)।
মানুষের কৃতজ্ঞতা স্বীকার
করা যরূরী। কারণ যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে
পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللهَ ‘যে লোক মানুষের কৃতজ্ঞতা
আদায় করে না, সে আল্লাহ্ তা‘আলারও কৃতজ্ঞতা আদায় করে না’।[31]
অতএব আপ্যায়নের ক্ষেত্রে বা
আতিথ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত আদব বা শিষ্টাচার সমূহ মেনে চলা যরূরী। এর ফলে
সমাজে যেমন সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করবে, তেমনি অশেষ ছওয়াব হাছিল হবে। আল্লাহ
আমাদের সবাইকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলার তাওফীক্ব
দান করুন-আমীন!
– ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
[1]. তিরমিযী হা/২৩৯৫;
আবূদাঊদ হা/৪৮৩২, ছহীহুল জামে‘ হা/৭৩৪১, ছহীহ আত-তারগীব হা/৩০৩৬, সনদ হাসান।
[2]. দলীলুল ফালেহীন
লিতুরুকে রিয়াযিছ ছালেহীন, ৩/২২৯ পৃঃ।
[3]. আওনুল মা‘বূদ ১৩/১২৩।
[4]. বুখারী হা/৫১৭৭; মুসলিম
হা/১৪৩২, আবূদাঊদ হা/৩৭৪২; ইবনু মাজাহ হা/১৯১৩।
[5]. বুখারী হা/১২, ২৮, ৩২,
৬২; মুসলিম হা/৩৯, নাসাঈ হা/৫০০০; আবূদাউদ হা/৫১৯৪।
[6]. বুখারী হা/৬১৭৬।
[7]. বুখারী হা/৩৫৭, ৩১৭১;
মুসলিম হা/৩৩৬; মিশকাত হা/৩৯৭৭।
[8]. বুখারী হা/৬০১৮-১৯;
মুসলিম হা/৪৭; মিশকাত হা/৪২৪৩।
[9]. বুখারী, তরজমাতুল বাব,
নং ৮৫।
[10]. বুখারী হা/৭২৯৩।
[11]. ছহীহুল জামে‘ হা/৭৬০৮; ছহীহাহ হা/২৪৪০।
[12]. বুখারী হা/৩৭৯৮;
মুসলিম হা/২০৫৪।
[13]. বুখারী হা/২৩৫১,
২৩৬৬; মুসলিম হা/২০৩০; মিশকাত হা/৪২৭৪।
[14]. বুখারী হা/২৩৫২,
২৫৭১; মুসলিম হা/২০২৯।
[15]. বুখারী হা/২৫৭১;
মিশকাত হা/৪২৭৩।
[16]. বুখারী হা/২৫৭১।
[17]. বুখারী হা/৬০২, ৬১৪০।
[18]. ফাৎহুল বারী ৯/৫২৮
পৃঃ।
[19]. আল-ফতাওয়া
আল-হিন্দিয়া, ৫/৩৪৪ পৃঃ।
[20]. মুসলিম হা/৩৫৮৭।
[21]. মুসলিম হা/৩৫৯১।
[22]. মুসলিম হা/৩৫৯৩;
আবূদাঊদ হা/২৪৬০; মিশকাত হা/২০৭৮।
[23]. ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৮।
[24]. বুখারী হা/৬০১৯, ৬১৩৫,
৬৪৭৬; মুসলিম হা/৪৮।
[25]. মুসলিম ৪৮; তিরমিযী
হা/১৯৬৭-৬৮; আবূদাঊদ হা/৩৭৩৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৭২।
[26]. বুখারী হা/৬১৩৭, ২৪৬১;
আবূদাঊদ হা/৩৭৫২; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৭৬।
[27]. ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৩০; ছহীহ আত-তারগীব
হা/২৫৯১; ছহীহাহ হা/৬৪০।
[28]. বুখারী হা/৫৪৩৪, ২০৮১;
মিশকাত হা/৩২১৯।
[29]. মুসলিম হা/২০৪২;
মিশকাত হা/২৩১৫।
[30]. মুসলিম হা/৫৪৮৩, ‘অতিথির সমাদর’ অনুচ্ছেদ।
[31]. তিরমিযী হা/১৯৫৫; মিশকাত হা/৩০২৫; ছহীহাহ হা/৬৬৭।
No comments