ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের গুরুত্ব, ফযীলত এবং প্রয়োজনীয়তা
ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের গুরুত্ব, ফযীলত এবং প্রয়োজনীয়তা
যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি মানুষকে আশরাফুল মাখলূকাত বা সৃষ্টির সেরা করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তিনি মানব জাতিকে একে অপরের কল্যাণ সাধনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দান করা।[1]
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের খাদ্য দানের গুরুত্ব ব্যাপক। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হল।-
গুরুত্ব ও ফযীলত
১. মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন করা : পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দানের আদেশ দিয়েছেন এবং উৎসাহিত করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ﺃَﻭْ ﺇِﻃْﻌَﺎﻡٌ ﻓِﻲ ﻳَﻮْﻡٍ ﺫِﻱ ﻣَﺴْﻐَﺒَﺔٍ، ﻳَﺘِﻴﻤًﺎ ﺫَﺍ ﻣَﻘْﺮَﺑَﺔٍ،
ﺃَﻭْ ﻣِﺴْﻜِﻴﻨًﺎ ﺫَﺍ ﻣَﺘْﺮَﺑَﺔٍ – ‘অথবা ক্ষুধার দিনে অন্নদান করা ইয়াতীম নিকটাত্মীয়কে। অথবা ভূলুণ্ঠিত অভাবগ্রস্তকে’
(বালাদ ৯০/১৪-১৬) ।
অন্যত্র তিনি বলেন, ﻭَﻳُﻄْﻌِﻤُﻮْﻥَ
ﺍﻟﻄَّﻌَﺎﻡَ ﻋَﻠَﻰ ﺣُﺒِّﻪِ ﻣِﺴْﻜِﻴْﻨًﺎ ﻭَﻳَﺘِﻴْﻤًﺎ ﻭَﺃَﺳِﻴْﺮًﺍ ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা আল্লাহর প্রতি ভালবাসার টানে খাদ্য দান করে অভাবী, ইয়াতীম ও কয়েদীদেরকে’ (দাহর ৭৬/৮) । তাই আমরা ক্ষুধার্ত দরিদ্র ব্যক্তিকে খাদ্য দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী বান্দা হিসাবে গণ্য হ’তে পারি।
২. সর্বোত্তম আমল : ইবাদত মূলতঃ দুইভাগে বিভক্ত। এক. মহান আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত ইবাদত। তাকে হাক্কুল্লাহ বলে যেমন- ছালাত, ছিয়াম ইত্যাদি। দুই. বান্দার সাথে সম্পৃক্ত ইবাদত, যাকে হাক্কুল ইবাদ বলে। যেমন- মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা, মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা ইত্যাদি। হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দান করা। ক্ষুধায় কাতর ব্যক্তি সব দিক দিয়ে দুর্বল হয়, খাবারের অভাবে সে অসহায় ও অচল হয়ে পড়ে তাই ক্ষুধার্তকে আহার করিয়ে পরিতৃপ্ত করা মহান আল্লাহর কাছে পসন্দনীয় আমল। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ﺃَﻥَّ ﺭَﺟُﻼً
ﺳَﺄَﻝَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰَّ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺃَﻯُّ ﺍﻹِﺳْﻼَﻡِ ﺧَﻴْﺮٌ ﻗَﺎﻝَ : ﺗُﻄْﻌِﻢُ
ﺍﻟﻄَّﻌَﺎﻡَ، ‘একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করলেন, ইসলামে কোন কাজটি শ্রেষ্ঠ? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ইসলামে সবচেয়ে ভাল কাজ হচ্ছে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার খাওয়ানো’।[2] তাই ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানকারী ব্যক্তি সর্বোত্তম আমলকারী বলে গণ্য হবেন।
৩. মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ : ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের খাদ্য দানকারী ব্যক্তি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ধন্য হবেন।
মহান আল্লাহ বলেন, ﺇِﻧَّﻤَﺎ
ﻧُﻄْﻌِﻤُﻜُﻢْ ﻟِﻮَﺟْﻪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻻَ ﻧُﺮِﻳْﺪُ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺟَﺰَﺍﺀً ﻭَﻻَ ﺷُﻜُﻮْﺭًﺍ – ‘তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদের আহার্য দান করি, তোমাদের নিকট এর কোন প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও কামনা করি না’ (দাহর ৭৬/৯) ।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ﺍﻟﺮَّﺍﺣِﻤُﻮﻥَ
ﻳَﺮْﺣَﻤُﻬُﻢُ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﻦُ ﺍﺭْﺣَﻤُﻮﺍ ﻣَﻦْ ﻓِﻰ ﺍﻷَﺭْﺽِ ﻳَﺮْﺣَﻤْﻜُﻢْ ﻣَﻦْ ﻓِﻰ
ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﺀِ – ‘দয়াশীলদের উপরে দয়াময় আল্লাহ দয়া করে থাকেন। তোমরা যমীনবাসীদের উপরে দয়া কর, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের উপরে দয়া করবেন’।[3] অপর হাদীছে এসেছে, ﻻَ ﻳَﺮْﺣَﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣَﻦْ ﻻَ ﻳَﺮْﺣَﻢُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱَ ‘যে ব্যক্তি অনুগ্রহ করে না, তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হয় না।[4] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
ﻭَﻣَﻦْ ﻛَﺎﻥَ ﻓِﻰ ﺣَﺎﺟَﺔِ
ﺃَﺧِﻴﻪِ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻓِﻰْ ﺣَﺎﺟَﺘِﻪِ، ﻭَﻣَﻦْ ﻓَﺮَّﺝَ ﻋَﻦْ ﻣُﺴْﻠِﻢٍ ﻛُﺮْﺑَﺔً
ﻓَﺮَّﺝَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻨْﻪُ ﻛُﺮْﺑَﺔً ﻣِﻦْ ﻛُﺮُﺑَﺎﺕِ ﻳَﻮْﻡِ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ، ﻭَﻣَﻦْ ﺳَﺘَﺮَ
ﻣُﺴْﻠِﻤًﺎ ﺳَﺘَﺮَﻩُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ –
‘আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিনের বিপদ সমূহের একটি বড় বিপদ দূর করে দিবেন’।[5] ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করার ফলে মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়, এতে করে আমরা দুনিয়াতেই মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতে পারি। আবার ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের মাধ্যমে তার কষ্ট লাঘব করা হয় এতে মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতে আমাদের কষ্ট সমূহ হ’তে কিছু লাঘব করে দিবেন।
৪. মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় : আমরা সর্বদা মহান আল্লাহর অফুরন্ত নে‘মতের মাঝে ডুবে আছি। শুধু আমাদের শরীরের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই কত সুঠাম ও সুশ্রী করে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। কথা বলার জন্য দিয়েছেন বাকশক্তি, তার নে‘মতরাজি অবলোকন করার জন্য দিয়েছেন অমূল্য দৃষ্টি শক্তি। ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের মাধ্যমে আমরা তার দেওয়া এই সমস্ত নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি এবং তার দেখানো পথে চলতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন, ﺃَﻟَﻢْ ﻧَﺠْﻌَﻞْ
ﻟَﻪُ ﻋَﻴْﻨَﻴْﻦِ، ﻭَﻟِﺴَﺎﻧًﺎ ﻭَﺷَﻔَﺘَﻴْﻦِ، ﻭَﻫَﺪَﻳْﻨَﺎﻩُ ﺍﻟﻨَّﺠْﺪَﻳْﻦِ، ﻓَﻼَ
ﺍﻗْﺘَﺤَﻢَ ﺍﻟْﻌَﻘَﺒَﺔَ، ﻭَﻣَﺎ ﺃَﺩْﺭَﺍﻙَ ﻣَﺎ ﺍﻟْﻌَﻘَﺒَﺔُ، ﻓَﻚُّ ﺭَﻗَﺒَﺔٍ، ﺃَﻭْ
ﺇِﻃْﻌَﺎﻡٌ ﻓِﻲ ﻳَﻮْﻡٍ ﺫِﻱ ﻣَﺴْﻐَﺒَﺔٍ، ﻳَﺘِﻴﻤًﺎ ﺫَﺍ ﻣَﻘْﺮَﺑَﺔٍ، ﺃَﻭْ ﻣِﺴْﻜِﻴﻨًﺎ
ﺫَﺍ ﻣَﺘْﺮَﺑَﺔٍ ، ‘আমরা কি দেইনি তাকে দু’টি চোখ? এবং জিহবা ও দু’টি ঠোঁট? আর আমরা তাকে দেখিয়েছি দু’টি পথ। কিন্তু সে তো গিরিসংকটে প্রবেশ করেনি। তুমি কি জানো গিরিসংকট কি? তা হ’ল দাসমুক্তি। অথবা ক্ষুধার দিনে অন্নদান করা ইয়াতীম নিকটাত্মীয়কে। অথবা ভূলুণ্ঠিত অভাবগ্রস্তকে’ (বালাদ ৯০/৮-১৬) ।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে মহান আল্লাহ প্রথমে তাঁর দেওয়া কিছু অমূল্য নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। চক্ষু-কর্ণ, জিহবা ইত্যাদি যা ছাড়া মানুষের স্বাভাবিক অবয়ব কল্পনা করা যায় না। অতঃপর তিনি দু’টি পথের কথা বলেছেন, একটি ভাল, অপরটি মন্দ। মানুষকে তিনি চক্ষু-কর্ণ দেওয়ার মাধ্যমে কোনটি ভাল কোনটি মন্দ পথ তারও সম্যক জ্ঞান দিয়েছেন। অতঃপর বলেছেন, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে না হয় অকৃতজ্ঞ। অর্থাৎ তাঁর দেখানো পথে না চললে অকৃতজ্ঞ হবে আর তাঁর পথে চললে কৃতজ্ঞ হবে। তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়ার পথটিও তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, তাহ’ল সৎকাজ, দাস মুক্তি ও ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান। এ কাজের মধ্য দিয়েই আমরা তাঁর পথের অনুসারী হয়ে কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হ’তে পারি। এতে করে দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদের সম্মান ও সম্পদ আরো বৃদ্ধি পাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ﻟَﺌِﻦْ
ﺷَﻜَﺮْﺗُﻢْ ﻟَﺄَﺯِﻳﺪَﻧَّﻜُﻢْ ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বেশী বেশী করে দিব’ (ইবরাহীম ১৪/৭) ।
৫. রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য : গরীব, অসহায় ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দানকারী ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর অনুগত্যকারী ব্যক্তি বলে গণ্য হবেন। কেননা রাসূল (ছাঃ) ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ﺭُﺩُّﻭﺍ
ﺍﻟﺴَّﺎﺋِﻞَ ﻭَﻟَﻮْ ﺑِﻈِﻠْﻒٍ ﻣُﺤْﺘَﺮِﻕٍ ‘তোমরা ভিক্ষুক (ক্ষুধার্তকে) কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটা খুর হ’লেও’।[6] অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্ণ আনুগত্যকারী উম্মত হ’তে চাইলে আমাদেরকে ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করতে হবে। কেননা তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয় যে নিজে পেট পুরে আহার করে কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে’।[7] তিনি আরো বলেন, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর। তাহ’লে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[8]
৬. বিশেষ সাহায্য লাভ : ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান এমন একটি আমল, যার দ্বারা একজনের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হয়। কারণ ক্ষুধার্তকে দান করে নিঃস্ব মুসলিম ভাইয়ের অভাব পূরণের চেষ্টা করলে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। আর এতে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করা যায়। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে লোক তার কোন মুসলিম ভাইয়ের অভাব পূরণের চেষ্টা করে মহান আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন।[9] অন্যত্র তিনি আরো বলেছেন, ‘যে লোক কোন গরীবের চলার পথ সহজ করে দেয় ইহকালে ও পরকালে মহান আল্লাহ তার চলার পথ সহজ করে দিবেন’।[10] তাই আমাদেরকে গরীব ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের মাধ্যমে তার অভাব পূরণের চেষ্টা করতে হবে।
৭. ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানে আল্লাহর সন্তোষ্ট : ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করলে মহান আল্লাহ খুশি হন। একদা এক ব্যক্তি মহানবী (ছাঃ)-কে এসে বললেন, আমি ক্ষুধায় কাতর হয়ে গেছি। আল্লাহর নবী (ছাঃ) ত্বরিৎ তাঁর এক স্ত্রীর নিকট খবর পাঠালেন। তখন খবর আসল বাড়ীতে পানি ব্যতীত কিছুই নেই। অতঃপর তিনি অন্য স্ত্রীর নিকট খবর পাঠালেন তিনিও জানালেন আল্লাহর কসম বাড়ীতে পানি ব্যতীত কিছুই নেই। এমনকি তিনি সকল স্ত্রীর নিকটেই খবর পাঠালেন এবং সকলে একই কথা বলল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নবী (ছাঃ) ছাহাবীদের মাঝে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন কে এই রাতে এই ক্ষুধার্তকে মেহমান হিসাবে গ্রহণ করবে? ছাহাবীদের মধ্যে একজন ছাহাবী আবু তালহা আনছারী (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি এই ক্ষুধার্তকে মেহমান হিসাবে গ্রহণ করলাম। অতঃপর আবূ তালহা (রাঃ) ক্ষুধার্ত ব্যক্তিটিকে সাথে নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন। তার স্ত্রীকে বললেন, তোমার নিকট কোন খাবার আছে কি? রাসূল (ছাঃ)-এর ক্ষুধার্ত মেহমানের আপ্যায়ন কর। তার স্ত্রী বললেন, ঘরে কেবল বাচ্চাদের স্বল্প খাবার আছে। আবূ তালহা (রাঃ) তার স্ত্রীকে বললেন, তাতেই চলবে। তুমি বাচ্চাদেরকে কোন জিনিস দ্বারা ভুলিয়ে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে আর মেহমান যখন আমাদের ঘরে প্রবেশ করবে তখন তুমি বাতি নিভিয়ে দিবে এবং তাকে বুঝাবে যে আমরাও খাবার খাচ্ছি। অতঃপর তারা পরিকল্পনা মত তাই করলেন এবং দু’জনে উপবাসে রাত কাটিয়ে দিলেন। পরদিন সকাল বেলা আবূ তালহা (রাঃ) যখন নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে গেলেন, তখন নবী করীম (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে বললেন, জিব্রীল (আঃ) এসে আমাকে খবর দিয়েছেন তোমরা কাল রাতে ঐ ক্ষুধার্ত মেহমানের সাথে যে আচরণ করেছ তাতে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা আশ্চর্য হয়েছেন অথবা তিনি হেসেছেন’।[11]
৮. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী, অবিরাম ছালাত ও ছিয়াম পালনকারীর ন্যায় : গরীব ক্ষুধার্তদের খাদ্য দান করা, তাদের খাদ্যের জন্য চেষ্টা-সাধনা করা এতই মর্যাদাপূর্ণ যে, ঐ ব্যক্তি মহান আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মর্যাদা লাভ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, বিধবা ও মিসকীনদের জন্য চেষ্টা সাধনাকারী মহান আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য’।[12] ক্ষুধার্তের জন্য প্রচেষ্টাকারী শুধু জিহাদকারীর মর্যাদা লাভ করবে তা নয়; এমনকি সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে অব্যাহতভাবে দিনে (নফল) ছিয়াম পালনকারী এবং প্রতি রাত্রে ছালাত (তাহাজ্জুত) আদায়কারীর ন্যায়। প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমার মনে হয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিসকীনদের জন্য চেষ্টা-সাধনাকারীদের সম্বন্ধে একথাও বলেছেন যে, ঐ ব্যক্তি একাধারে ছালাত ও ছিয়াম পালনকারীর ন্যায়’।[13]
৯. জান্নাতের অফুরন্ত নে‘মত লাভ : মহান আল্লাহর ভালবাসা পাবার লক্ষ্যে দুস্থ-গরীবের প্রতি খাদ্য দানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং সে জান্নাতের অফুরন্ত নে‘মতরাজি ভোগ করতেই থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসার খাতিরে খাদ্য দান করে ক্ষুধার্ত ইয়াতীম, মিসকীন ও কয়েদীদেরকে। যার কারণে মহান আল্লাহ তাদেরকে ক্বিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনের অনিষ্টতা হ’তে রক্ষা করবেন। শুধু তাই নয় তাদেরকে দান করবেন আনন্দ এবং সজীবতা। তাদের ধৈর্যশীলতার জন্য দিবেন জান্নাতের রেশমী পোশাক। জান্নাতে তারা উচ্চ আসনে হেলান দিয়ে বসবে’ (দাহর ৭৬/৮-২২) ।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা বেশী বেশী ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর, তাহ’লে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[14]
১১. সামাজিক গুরুত্ব :
(১) মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা পূরণ : খাদ্য মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা। এই অন্নের তাড়নায়ই বহু দরিদ্র ব্যক্তি নানাবিধ সামাজিক অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি। এসবের মূলে রয়েছে অভাব। তাই ক্ষুধার্ত দরিদ্রদেরকে খাদ্য দানের মাধ্যমে সমাজে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে, যার ফলে কমে যাবে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই। বিরাজ করবে স্থিতিশীলতা।
(২) পারস্পারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় : ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের মাধ্যমে সমাজে বসবাসরত উচ্চ শ্রেণী দরিদ্র শ্রেণীর সাহচর্যে আসে, তাদের পাশে দাঁড়ায়। ফলে উভয় শ্রেণীর মধ্যে ব্যবধান কমে যায় এতে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধা-ভালবাসা, আন্তরিকতা ইত্যাদি বৃদ্ধিপায়।
(৩) বৈষম্যহ্রাস : ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের মাধ্যমে একজনের কষ্টে আরেক জনের এগিয়ে আসা হয়। ফলে সমাজে শান্তি স্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও সম্প্রীতির সমাজ গড়ে উঠে। ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানের মাধ্যমে ধনীরা দরিদ্রদের কাছে আসে ফলে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য অনেকাংশে কমে যায় এবং ক্ষুধার্ত ব্যক্তিরাও খাবার পেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করে।
ক্ষুধার্তকে না খাওয়ানোর শাস্তি :
ক্ষুধার্তকে না খাওয়ানো ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয় এবং দুনিয়া-আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে।
(১) ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতকে অস্বীকারকারী যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে না এবং খাদ্য দান করতে উৎসাহিত করে না। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, ﺃَﺭَﺃَﻳْﺖَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻳُﻜَﺬِّﺏُ ﺑِﺎﻟﺪِّﻳﻦِ، ﻓَﺬَﻟِﻚَ
ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻳَﺪُﻉُّ ﺍﻟْﻴَﺘِﻴﻢَ، ﻭَﻟَﺎ ﻳَﺤُﺾُّ ﻋَﻠَﻰ ﻃَﻌَﺎﻡِ ﺍﻟْﻤِﺴْﻜِﻴْﻦِ – ‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে বিচার দিবসে মিথ্যারোপ করে? সে হ’ল ঐ ব্যক্তি, যে ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দেয় এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে উৎসাহিত করে না’ (মাঊন ১০৭/১-৩) ।
মুমিন কখনো ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান না করে থাকতে পারে না। আর যে এটা করে সে প্রকৃত মুমিন নয়। তাইতো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্পষ্টভাবে বলেছেন, ঐ ব্যক্তি অবশ্যই মুমিন নয় যে নিজে পেট ভর্তি করে খায় আর তার গরীব প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে’।[15]
(২) দুনিয়াতেই ভয়াবহ আযাবের সম্মুখীন : ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে না এমন ব্যক্তি দুনিয়াতেই আল্লাহর পক্ষে থেকে শাস্তি বা গযবের সম্মুখীন হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তার রূযী সংকুচিত করেন, তখন সে বলে যে, আমার প্রভু আমাকে হেয় করেছেন। কখনোই এরূপ নয়। বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না। এবং অভাবগ্রস্তকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না’
(ফজর ৮৯/১৬-১৮) ।
অতএব ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান না করলে এবং তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য মানুষকে উৎসাহিত না করলে মহান আল্লাহ যে দুনিয়াতে আমাদের নে‘মত কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শাস্তি দিবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। অতীতেও তিনি এমন ব্যক্তিদের দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কয়েকজনের একটি বাগান ছিল। যখন বাগানের ফলগুলি পাড়ার উপযুক্ত হয়েছিল। তারা রাতের বেলা বলল, আমরা অবশ্যই সকালে ফলগুলি সংগ্রহ করব, তারা ইনশাআল্লাহ বলল না এবং তারা সিদ্ধান্ত নিল বাগানে কোন ক্ষুধার্তকে ঢুকতে দিবে না এবং খাদ্য দান করবে না। সারা রাত তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইল। সেই রাতেই আল্লাহর গযবে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। পরদিন যখন তারা বাগানে পৌঁছল, তারা বলল, আমরা পথ ভুল করিনি তো? কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তারা বুঝতে পারল। তারা মহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করল এবং বাগানের মালিকেরা বাগানটি ধ্বংসের জন্য একে অপরকে দোষারপ করতে লাগল। কেননা তারা ক্ষুধার্তকে খাবার না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় ছিল
(ক্বালাম ৬৮/১৭-৩১) ।
(৩) পরকালে আযাবের ফেরেশতার সম্মুখীন : ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে না এমন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করবে। জাহান্নামের পাহারাদার আযাবের ফেরেশতার কঠিন প্রশ্নের ও সম্মুখীন হবে ঐ ব্যক্তি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে কোন অপরাধে তোমরা সাকারে (জাহান্নাম) এসেছ। জাহান্নামীরা বলবে, আমরা তো মুছল্লী ছিলাম না। আর আমরা ক্ষুধার্তকে খাওয়াতাম না’
(মুদ্দাছছির ৭৪/৪২-৪৪) ।
(৪) জাহান্নামে সরাসরি প্রবেশ : মহান আল্লাহর উপর ঈমানহীন, অভাবী, নিঃস্ব-ক্ষুধার্তদেরকে খাদ্য দান করতে উৎসাহ দেয় না এমন ব্যক্তি অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ঐ ব্যক্তিকে ধর এবং গলায় রশি লাগিয়ে দাও অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে, সে তো ঈমান আনেনি মহান আল্লাহর উপরে আর সে অভাবী-ক্ষুধার্তদেরকে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেনি’ (হাক্কাহ ৩০-৩৪) ।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষুধার্তদের খাদ্য দান করার তাওফীক দান করুন এবং এর দ্বারা দুনিয়া-আখেরাতে তার শাস্তি হ’তে বাঁচার এবং জান্নাত লাভ করার তাওফীক দিন-আমীন!
– ফরহাদুযযামান
[1]. বুখারী, হা/১২ ।
[2]. বুখারী হা/১২; মুসলিম হা/৩৯; মিশকাত হা/৪৬২৯।
[3]. তিরমিযী হা/১৯২৪; আবুদাঊদ হা/৪৯৪১; মিশকাত হা/৪৯৬৯।
[4]. বুখারী হা/৭৩৭৬; মুসলিম হা/২৩১৯; মিশকাত হা/৪৯৪৭।
[5]. বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮।
[6]. আহমাদ হা/১৬৬৯৯; নাসাঈ হা/২৫৬৫, মিশকাত হা/১৯৪২, সনদ ছহীহ।
[7]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৩৩৮৯; হাকেম হা/২১৬৬; মিশকাত হা/৪৯৯১; ছহীহাহ হা/১৪৯।
[8]. তিরমিযী হা/১৯৮৪; বায়হাক্বী শো‘আব হা/৩০৯০; মিশকাত হা/১২৩২; ইরওয়া হা/৯৮০।
[9]. মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪।
[10]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪; তিরমিযী হা/১৭০২; নাসাঈ হা/৩১৭৯।
[11]. বুখারী হা/৪৮৮৯; মিশকাত হা/৬২৫২।
[12]. বুখারী হা/৬০০৬; মুসলিম হা/২৯৮২; মিশকাত হা/৪৯৫১।
[13]. বুখারী হা/৬০০৭; মুসলিম হা/২৯৮২; মিশকাত হা/৪৯৫১।
[14]. তিরমিযী হা/১৯৮৪; বায়হাক্বী শো‘আব হা/৩০৯০; মিশকাত হা/১২৩২; ইরওয়া হা/৯৮০।
[15]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৩৩৮৯; হাকেম হা/২১৬৬; মিশকাত হা/৪৯৯১; ছহীহাহ হা/১৪৯।
No comments