একে অন্যকে সত্যের প্রতি তাগাদা দেয় এবং ধৈর্য-নিষ্ঠ হতে তাগাদা দেয়—আল-আসর
ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের শপথ। মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা নয়, যারা বিশ্বাস করে, ভালো কাজ করে, একে অন্যকে সত্যের প্রতি তাগাদা দেয় এবং ধৈর্য-নিষ্ঠ হতে তাগাদা দেয়। —আল-আসর
আপনি আরাম করে ঘুমিয়ে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আপনার মনে হলো যে, কিছু একটা ঘাপলা আছে। এরকম তো হওয়ার কথা না। চোখ খুলে দেখলেন যে, আপনি আসলে এক অতল নীল সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছেন। উপরে সূর্যের আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। আপনি যদি এখনি চেষ্টা করেন তাহলে সাঁতরে উপরে উঠতে পারেন। এই অবস্থায় আপনি দুটো কাজ করতে পারেন। আপনি ভাবতে পারেন, “থাক না, আরামেই তো ঘুমিয়ে ছিলাম। আবার ঘুম দেই।” চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে গেলেন। সুন্দর স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। একসময় আপনি তলিয়ে গেলেন।
অথবা আপনি প্রাণপণে হাত-পা ছুড়ে সাঁতরে উপরে উঠতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদূর না যেতেই আপনার পায়ে বাঁধা একটা শিকলে টান লাগলো। নীচে তাকিয়ে দেখলেন যে, আপনার পায়ের সাথে শিকল দিয়ে আপনার ঘুমন্ত ভাইয়ের পা আটকানো। সেও আপনার মতো ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। আপনি একা কোনোভাবেই সাঁতরে উপরে উঠতে পারবেন না। তখন আপনি জলদি সাঁতরে ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলেন। সে একসময় জেগে উঠলো। আপনার ডাক শুনে, পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সেও জলদি সাঁতরে উপরে উঠতে লাগলো। কিন্তু কিছুদূর না যেতেই আপনারা দুজনেই আবার পায়ের শিকলে টান লেগে আটকে গেলেন। নীচে তাকিয়ে দেখলেন এক লম্বা শিকলে আপনার বাবা, মা, আত্মীয়, সমাজের অন্য মানুষরা সবাই বাঁধা। সবাই ঘুমিয়ে আছে। গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। আপনার বাঁচার তখন একটাই পথ খোলা: একে একে সবাইকে ডেকে তুলে একসাথে সাঁতরে উপরে ওঠার চেষ্টা করা। কিন্তু সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। আপনার দম শেষ হয়ে যাচ্ছে…[১]
সূরাহ আল-আসর এর বাণীকে আমরা এভাবে কল্পনা করতে পারি: বেশিরভাগ মানুষ অতল গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। তাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যারা নিজেরা জেগে উঠে বাস্তবতা উপলব্ধি করছে, তারপর অন্যকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, ওপরে উঠতে একে অন্যকে তাগাদা দিচ্ছে—শুধু তারাই পারছে সাঁতরে উপরে উঠতে। বাকিরা সবাই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই সূরাহ’র একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে: শুধু নিজে ভালো হওয়ার চেষ্টা করলেই হবে না। অন্যদেরকেও ভালো হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, তাগাদা দিতে হবে। আমরা যদি মনে করি: আমি নিজে নামাজ-রোজা করবো, যাকাত দেবো, যতটা পারি ভালো হয়ে জীবন পার করে যাবো, অন্যের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী? — তাহলে বিরাট ভুল হবে।
আমরা যারা আজকে ধর্মের পথে ফিরে এসেছি, তারা অনেকেই নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যায় আমাদের নিজেদের পরিবারেই সন্তান, স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা ধর্মবিমুখ। তাদেরকে ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা আমরা করি না। নিজেকে বাঁচাতে যতটা না পরিশ্রম করি, কাছের মানুষকে বাঁচানোর প্রতি তার ধারেকাছেও আন্তরিকতা নেই। সূরাহ আসর আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে, কিয়ামতের দিন আমাদের বেঁচে যাওয়া নির্ভর করছে: আমরা নিজে ভালো হয়ে চলতে পেরেছি কিনা এবং একইসাথে অন্যর ভালোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছি কিনা।
আল্লাহ تعالى কিন্তু বলেননি: যে ঈমান এনেছে, বা ভালো কাজ করেছে, বা একে অন্যকে সত্যের প্রতি তাগাদা দিয়েছে, বা একে অন্যকে ধৈর্য-নিষ্ঠার প্রতি তাগাদা দিয়েছে। বরং আল্লাহ এই চারটি শর্তের মধ্যে ‘এবং’ জুড়ে দিয়েছেন। যার অর্থ: আমাদেরকে এই চারটি শর্তই পূরণ করতে হবে। একটিও বাদ দেওয়া যাবে না। সূরাহ আসর জান্নাতে গিয়ে কোনো বিরাট পুরস্কার পাওয়ার উপদেশ নয়, বরং জাহান্নাম থেকে বেঁচে ফেরার নুন্যতম শর্ত।
ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের শপথ
আমাদের সবার কাছে একটি সম্পদ রয়েছে: সময়। ধনী-গরিব, সুস্থ-অসুস্থ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, চাকুরিজীবী-গৃহকর্ত্রী যে যা-ই হই না কেন, সবাইকে একটি সম্পদ দেওয়া হয়েছে: সময়। আমরা প্রত্যেকে এই সময় নামের মূলধন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি। আমরা সবাই আসলে এক-একজন ব্যবসায়ী, কারণ আমাদের কাজ হচ্ছে এই মূলধন খাটিয়ে যতটা সম্ভব লাভ করে যাওয়া। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে এই মূলধন একটু একটু করে ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই একে আমরা কীভাবে ব্যবহার করে কত লাভ করতে পারছি, তার উপর নির্ভর করে একসময় কে সফল হবো, আর কে দেউলিয়া হয়ে শেষ হয়ে যাবো।[১][৪][৭]
আসর عصر হচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়া সময়। এটা دهر বা ‘সময়’ বলতে আমরা সাধারণত যে অনন্ত প্রবাহমান কিছু বুঝি, তা নয়। আল্লাহ تعالى সময়ের ধারণার উপর শপথ করেননি, বরং তিনি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন সময়ের ফুরিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যর প্রতি। হারিয়ে যাওয়া সেই সময়, যা কখনও ফিরে পাওয়া যায় না।[২] ‘ওয়াল-আসর’ হচ্ছে আমাদেরকে তাগাদা দেওয়া, “খেয়াল করেছো? সময় যে ফুরিয়ে যাচ্ছে!”[৭][৪]
আজকে মানবজাতির একটা বিরাট অংশ সময়কে কোনো গুরুত্ব দেয় না। প্রতিদিন ভোরে মানুষ যখন সবচেয়ে বেশি প্রডাক্টিভ থাকে, সেই সময়টাই তারা নষ্ট করে ফেলে ঘুমিয়ে থেকে। যত দেরি করে পারা যায় ঘুম থেকে উঠে, যেন কোনোমতে খেয়ে কাজে চলে যাওয়া যায়। দিনের মধ্যে ঘণ্টাখানেক সময় চলে যায় ফেইসবুকে ফালতু জিনিসপত্র দেখে, টিভিতে অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান দেখে। তারপর সময় চলে যায় গল্পের বই, ভিডিও গেম, মুভি, কার্টুন দেখে। এভাবে প্রতিদিন আমরা আমাদের মূলধন ‘সময়’ দুহাতে উড়িয়ে শেষ করছি। মানবজাতিকে পাঠানো হয়েছে উচ্চতর অর্জন করার জন্য। কিন্তু আজকে মানবজাতির একটা বিরাট অংশ নিম্নতর প্রাণীর মতো শুধুই জৈবিক চাহিদা মেটানো আর বিনোদনে জীবন শেষ করে দিচ্ছে। আল্লাহ تعالى যথার্থই বলেছেন—
মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে
আজকাল আমরা সফলতা বলতে বুঝি — নিজের বাড়ি, গাড়ি, টাকা, জমি-জমা, ডিগ্রি। এগুলো যার যত বেশি আছে, সে তত সফল। আমাদেরকে এই কথা এতবার বলা হয়েছে যে, আমরা বিশ্বাস করে ফেলেছি: সফল হওয়া মানেই হচ্ছে যাবতীয় ত্যাগ স্বীকার করে এগুলো অর্জন করা। এগুলো যারা অর্জন করতে পারেনি তারা বিফল।
আল্লাহ تعالى বলছেন, না, ভুল! বেশিরভাগ মানুষ আজকে বিফল, কারণ তারা সফলতার এই ভুল ধারনা মেনে নিয়ে নিজেদেরকে শেষ করে ফেলছে। যারা সফলতার এই ভুল ধারনা বয়ে বেড়াচ্ছে, তারা সবাই আসলে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। এই ভুল ধারনার কারনে আজকে মানবজাতির বেশিরভাগই ক্ষতির মধ্যে আছে, কিছু ব্যাতিক্রম বাদে।
কিন্তু তাই বলে আল্লাহ تعالى মানুষকে বলেননি সারাজীবন গরিব হয়ে থেকে, কোনোমতে তিনবেলা খেয়ে-পরে জীবন পার করতে। সুন্দর জামাকাপড় পরা, হালাল উপায়ে নিজের বাড়ি করা, গাড়ি কেনা, সম্পদের অধিকারী হওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু এটাকে কেউ যদি সফলতা মনে করে, তাহলে সে বিরাট ভুল করেছে। সফলতার সংজ্ঞা এটা নয়।
আবু বকর (রা) ছিলেন সেই যুগের মিলিয়নিয়ার। তিনি তার সম্পদ দিয়ে মুসলিম দাসদের ভীষণ অত্যাচার থেকে মুক্ত করেছেন, যুদ্ধের খরচ দিয়েছেন, গরিব মুসলিমদের ভরণপোষণ দিয়েছেন। চতুর্থ খলিফা উথমান (রা) ছিলেন সেই যুগের বিলিয়নিয়ার। ইসলামি সাম্রাজের সবচেয়ে বেশি প্রসার হয়েছে তার হাতে। ইসলামের প্রচার এবং প্রসারে ধনবান সাহাবিদের অবদান অনেক। কিন্তু এরা কেউ তাদের বিত্তবান স্ট্যাটাসকে সফলতা মনে করেননি। তারা ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন সফলতার আসল সংজ্ঞা কী।
আসুন দেখি সফলতার আসল সংজ্ঞা কী—
তবে তারা নয়…
কারা? যারা নিচের চারটি শর্ত পূরণ করবে, তারা আর ক্ষতির মধ্যে থাকবে না। এরা তখন প্রতিমুহূর্তে ভেবে দেখবে কীভাবে তাদের মূলধন ‘সময়’ সবচেয়ে ভালভাবে বিনিয়োগ করা যায় ভবিষ্যতের আসল সফলতার জন্য। তখন এদের চিন্তাভাবনা আমূল পাল্টে যাবে।
এরা তখন তাদের অভ্যাসগুলোকে নিয়ে ভেবে দেখবে কোনটা রাখা যায়, আর কোনটা জলদি বাদ দিতে হবে। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো পুনরায় বিবেচনা করে দেখবে যে, কোনগুলো সত্যিকারের সফলতা এনে দেয়, আর কোনগুলো সফলতার ভুল ধারণার পেছনে ছোটা মাত্র।
এই উপলব্ধি আসার পর তারা ফালতু সময় নষ্ট করে এমন সব বন্ধুদের জীবন থেকে বিদেয় করে দেবে। এরপর থেকে তাদের সাথেই মিশবে, যারা তাঁর মূলধনকে আরও ভালভাবে বিনিয়োগে বুদ্ধি দিতে পারে। শপিং সেন্টারে ঘোরা বন্ধ হয়ে যাবে। মোবাইলে সময় দেওয়া কমে যাবে। প্রত্যেক দিন চার পদের রান্না না করে বরং তিন দিন পর পর দুই পদের রান্না করে যে বিপুল পরিমাণ সময় সাশ্রয় হয়, তা নিজের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করবে। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে, ভোরে উঠে ফজরের নামাজের পরে পড়াশুনা, কাজ করা শুরু করবে।
নিচের এই চারটি বৈশিষ্ট্য একজন মানুষকে আমূলে বদলে দেবে। সত্যিকারের সফলতা কাকে বলে তা উপলব্ধি করতে শেখাবে। সেই সাফল্য অর্জনের জন্য প্রতিমুহূর্তে কাজ করতে নিজের ভেতরে একধরনের অদম্য আগ্রহ তৈরি করবে। এরা প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারবে ‘সময়’ আসলে কত মূল্যবান সম্পদ।
এই চারটি বৈশিষ্ট হচ্ছে―
১) যারা বিশ্বাস করে
প্রথম কাজ হচ্ছে আল্লাহর تعالى প্রতি ঈমান আনা। ঈমান না থাকলে একজন মানুষ যতই ভালো কাজ করুক, তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে না। কারও উদ্দেশ্য যদি হয় লোক দেখানো কাজ, আল্লাহকে تعالى খুশি করা নয়, তাহলে সেই ভালো কাজগুলো করেও সে কোনো সওয়াব পাবে না। মাঝখান থেকে তাঁর মূল্যবান সময় এবং সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে। কারও উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের জন্যই মানুষের উপকার করা—“মানব ধর্মই আসল ধর্ম”, “জীবে প্রেম করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”—তখন সে মানুষের উপকার করার এমন সব পদ্ধতি বেছে নেবে, যা আল্লাহ تعالى পছন্দ করেন না। তখন তার কষ্টটাই বাতিল। উপকার করতে গিয়ে তখন সে উল্টো অনেকগুলো গুনাহ কামিয়ে ফেলবে।
একারণে আল্লাহর تعالى প্রতি সঠিক বিশ্বাস আনাটা জরুরি। সেটা আনতে হলে কুর‘আন পড়তে হবে, ইসলামকে জানার আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে। বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ করা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটা কাজের জন্য যে আল্লাহকে تعالى যে জবাব দিতে হবে, তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ঈমানের যে ছয়টি অঙ্গ আছে, তা নিজের ভেতরে পাকাপোক্ত করতে হবে। তবে এটা করতে সময় লাগে। রাতারাতি কেউ মুমিন হয়ে যান না। তাছাড়া কেউ দাবি করতে পারবে না যে, “আমি আজকে সাচ্চা ঈমানদার হয়েছি।” বরং ঈমান একটা লম্বা সফর। আমাদের কাজ হচ্ছে ঈমান দৃঢ় করতে আজীবন চেষ্টা করে যাওয়া, যেন আল্লাহর تعالى কাছে গিয়ে বলতে পারি যে, আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। বাকি সব তাঁর হাতে। তিনিই تعالى জানেন আমাদের অন্তরে আসলে কী ছিল।
২) ভালো কাজ করে
‘আমাল সালিহ’ অর্থ হচ্ছে সৎকাজ, সংস্কার, ভুল কিছুকে ঠিক করা, ভাঙ্গা জিনিস জোড়া লাগানো, শান্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। সাধারণভাবে ইসলাম সমর্থিত যে কোনো ভালো কাজকেই ‘আমাল সালিহ’ বলা হয়।
আল্লাহর تعالى প্রতি বিশ্বাস আনার পর আমাদের কাজ হচ্ছে বেশি করে ভালো কাজ করা। কারণ আল্লাহর تعالى প্রতি বিশ্বাস আনার পরেও কেউ যদি ভালো কাজ না করে, তাহলে তার বিশ্বাস আসলেই আছে কিনা তা প্রশ্নের ব্যাপার। আর আমরা যখন ভালো কাজ করতে যাই বা করার পরিকল্পনা করি, তখন আমাদের উপর শুরু হয় শয়তানের কুমন্ত্রণা বৃষ্টি। সে সবদিক থেকে চেষ্টা করে আমাদেরকে আটকে রাখার। কিন্তু যখন কাজটা করে ফেলি, তখন শয়তান হেরে যায়, আর আমরা জিতে যাই। এভাবে শয়তান দুর্বল হয়ে যায়, আর আমরা শক্তিশালী হয়ে যাই। বার বার ভালো কাজ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের শয়তানকে বার বার ঘায়েল করতে থাকি। নিজেদেরকে তার বিরুদ্ধে আরও বেশি শক্তিশালী করতে থাকি। এভাবে আমরা যত বেশি শয়তানকে দমিয়ে রাখার দক্ষতা অর্জন করবো, তত কম গুনাহ করবো। তখন জান্নাতে যাওয়া তত বেশি সহজ হবে।
৩) একে অন্যকে সত্যের প্রতি তাগাদা দেয়
‘হাক্ক’ বা ‘সত্য’ হচ্ছে আল্লাহর কথা, ইসলামের কথা, ন্যায়ের কথা, অধিকারের কথা। সত্যের প্রতি তাগাদা দেওয়া অর্থ মানুষকে ইসলামের পথে ডাকা। আল্লাহর تعالى প্রতি সচেতন হতে বলা। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে বলা। অন্যায় হতে দূরে থাকতে বলা। মানুষকে যাবতীয় ভুল বিশ্বাস, অভ্যাস, সংস্কৃতি, কুসংস্কার থেকে দূরে সরিয়ে আল্লাহর تعالى দেওয়া সঠিক শিক্ষার প্রতি ডাকা।[১৮]
তবে ‘ডাকা’ অর্থ করলে ভুল অনুবাদ হবে। আল্লাহ تعالى হকের দিকে শুধুই ডাকতে বলেননি, বরং তাগাদা দিতে বলেছেন। আমরা ফোন করে নিরস গলায় বলবো না, “ভাইসাব, সলাত বালেগ ব্যাক্তির উপর ফরজ। সলাত কায়েম না করিলে জাহান্নামে যাইবেন। তাই কালকে থেকে পাঁচ ওয়াক্ত সলাত খুশুর সহিত আদায় করিবেন। না করিলে বড়ই গুনাহগার হইবেন।” বরং আমাদের বলার ভাষা হবে, “ভাই, চলেন না আজকে মাগরিবের নামাজটা একসাথে পড়ি? দেখবেন, অনেক ভালো লাগবে। আর ভাই, আপনাকে কিন্তু আমি এখন থেকে ফোন করে ফজরের নামাজের সময় উঠিয়ে দেবো। রাগ করবেন না কিন্তু? কয়েকটা দিন ফজর নামাজ পড়ে দেখেন। সারাদিন অনেক খুশি-খুশি লাগবে। আপনি নিজেই দেখবেন আপনার মনে কেমন যেন শান্তি-শান্তি লাগছে।”
হকের পথে ডাকা সহজ কাজ নয়। কারণ এটা করতে গেলে সমাজের অনেক ভুলের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তুলতে হয়। সংস্কৃতির খারাপ দিকগুলোর প্রতিবাদ করে সুশীলদের আক্রমণের স্বীকার হতে হয়। আরও দুঃখের ব্যাপার হলো: যাদের কাছ থেকে আমাদের সাহায্য পাওয়ার কথা―ইসলামি ধারায় পড়াশুনা করা জ্ঞানীগুণী ভাই-বোনেরা―তারাই উল্টো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যখন আমরা ঠিক তাদের মতো করে ইসলাম প্রচার করি না এবং তাদের মনমতো কথা বলি না। সাহায্য করার বদলে উল্টো তারা ধারালো লেখনী দিয়ে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তাই, হকের পথে ডাকতে গেলে জীবনে অশান্তি আসবেই। মানুষ যখন নিজের পরিবারের মধ্যেইে হকের কথা বলতে যায়, তখনি শুরু হয় তর্ক, ঝগড়া, অশান্তি, সম্পর্ক নষ্ট। আর সমাজ, সংস্কৃতি, সরকারের অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ করতে গেলে তো জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাবেই।
কিন্তু তারপরেও আমাদেরকে হকের কথা বলতে হবে। কারণ এটা হচ্ছে নুন্যতম চারটি শর্তের একটি। প্রজ্ঞা ব্যবহার করে যখন যেখানে যেই কথা বললে সত্যিই কিছু অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, সেভাবেই বলতে হবে। যাদেরকে হকের দিকে তাগাদা দিচ্ছি তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে হবে। অল্পতেই রেগে গেলে হবে না। উদারতা, সহনশীলতার সাথে হকের কথা বলতে হবে। কেউ আমার সাথে একমত না হলেই তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ধৈর্যের সাথে ইসলামের বাণী প্রচার করতে হবে। ন্যায়ের কথা বলতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। —এগুলো না করলে সর্বনাশ। আমরা তখন প্রতিনিয়ত ক্ষতির মধ্যে ডুবে থাকা আমজনতার একজন হয়ে যাবো। জাহান্নাম থেকে বেঁচে ফেরার নুন্যতম শর্তও পূরণ করবো না।
৪) ধৈর্য-নিষ্ঠ হতে তাগাদা দেয়
‘তাওয়াসা বিস্সবর’ হচ্ছে সবরের প্রতি উৎসাহ দেওয়া, তাগাদা দেওয়া। আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে ‘সবর’ কী, কারণ সবর নিয়ে অনারবদের মধ্যে ভুল ধারনা আছে।
আমাদের জীবনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, কষ্টে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন মুরব্বিদেরকে বলতে শোনা যায়, “সবর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” দেশে-বিদেশে মুসলিমদেরকে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, কু’রআন পোড়ানো হচ্ছে, রাস্তাঘাটে টুপি-দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলে পেটানো হচ্ছে, আর মসজিদের ইমামদেরকে জুমুআহ’র খুতবায় বলতে শোনা যাচ্ছে, “সবর করেন ভাই সাহেবরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইসলামের বিজয় নিকটেই—ইন শাআ আল্লাহ।”
ব্যাপারটা এমন যে, আমরা ধৈর্য নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু নামাজ পড়লেই আল্লাহ تعالى আমাদের হয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবেন। এই বহুল প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ‘সবর’ শব্দের অর্থ ঠিকমত না জানা।
সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাব, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করব না, এই ভেবে যে, একদিন আল্লাহ تعالى সব ঠিক করে দিবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতায়[৭] আছে—
তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল।
আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা[৭] এর লেখা—
শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল।
উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করা।[৫] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর تعالى আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া।[৪] মানুষ সাধারণত সবর বলতে প্রথমটিকেই বুঝে থাকে। কিন্তু একজন মুসলিমের জন্য এই তিনটিই বাধ্যতামূলক। এই তিনটির একটিও যদি বাদ যায়, তাহলে তা কু’রআন এবং হাদিসের ভাষায় সবর নয়।[৪]
সবর করা সহজ কাজ নয়। আজকের প্রতিকুল পরিবেশে মুসলিমদের ধৈর্যের সাথে কষ্টের সময় পার করা, অবস্থার পরিবর্তনে চেষ্টা করে যাওয়া বড়ই কঠিন। আর আল্লাহর تعالى প্রতি আস্থা, বিশ্বাসে অটল থাকা খুবই কঠিন কাজ। মুসলিমদের প্রায়ই দেখা যায় বিপদে পড়লে প্রশ্ন করতে, “কেন? আমার এত বিপদ হবে কেন? আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, কত গরিবের উপকার করি। তাহলে আমার এরকম কঠিন অসুখ হয় কেন? আমার পরিবারে এত অশান্তি কেন? আমার বন্ধুরা তো দেখি কত ভালো আছে। ওরা তো নামাজও ঠিকমতো পড়ে না। সারাদিন ফুর্তি করে বেড়ায়। তাহলে আমার কপালে এত কষ্ট কেন?” —এগুলো হচ্ছে ঈমান হারিয়ে ফেলার পূর্বাভাস এবং আল্লাহর تعالى দেওয়া পরীক্ষা ঈমানের সাথে পাশ না করে ফেল করার লক্ষণ। আর আল্লাহর تعالى দেওয়া পরীক্ষায় ফেল করলে তার পরিণাম কখনই ভালো হয় না। একারণে কষ্টের সময়গুলো সবরের সবগুলো শর্ত পূরণ করে পার করার জন্য মানুষকে বার বার বোঝাতে হয়, উৎসাহ দিতে হয়, তাগাদা দিতে হয়। না হলে মানুষের ঈমানের ভিত যে কোনো সময় ভেঙ্গে যায়।
উপসংহার
যারা ধর্মের পথে ফিরে আসেন, তারা দেখেন যে, যেই কাজগুলো আগে তিনি অভ্যাসবশত প্রায়ই করতে, করে আনন্দ পেতেন, বা ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে করতেন, সেগুলো এখন আর করতে ভালো লাগে না। বরং মাঝে মাঝে তার মনে হয়, “এই কাজ কীভাবে আমি আগে করতাম? আমার কি বিবেক ছিল না? আমি এত খারাপ ছিলাম আগে?”
ইসলামের পথে ফিরে আসার পর অনেকেই উপলব্ধি করেন যে, আজকে আমজনতা যেসব অভ্যাস লালন করে, যে ধরনের বিনোদন হরহামেশা করে, যে ধরণের সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করে, সেগুলো আসলে কতটা খারাপ। আল্লাহ تعالى যখন মানুষের অন্তরকে খুলে দেন, তখন সে পরিষ্কার চোখ দিয়ে তার চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় যে, তার চারপাশটা আসলে কত নোংরা। সে বুঝতে পারে যে, আশেপাশের মানুষের চোখ ভীষণ ময়লা হয়ে গেছে। তারা যে কী নোংরা আবর্জনার মধ্যে ডুবে আছে, সেটা তারা দেখেও বুঝতেও পারছে না।
এই উপলব্ধি আসার পর তার দায়িত্ব হচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরা আশেপাশের মানুষগুলোরও চোখ খুলে দেওয়ার। তখন প্রতি পদে বাঁধা আসা শুরু হয়। কাছের মানুষগুলো দূরে চলে যায়। সুসম্পর্কগুলো রাতারাতি শত্রুতায় পরিণত হয়। কিন্তু এর মধ্যেও ধৈর্য ধরে রেখে, নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যেতে হবে।
আর যারা আমাদের আগেই জেগে উঠে এই কাজে লেগে আছেন, তাদেরকে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে, যেন তারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন। কারণ এই কাজ তিক্ততায় ভরা। দিনের পর দিন মানুষের কটু কথা, বাজে ব্যবহার, উপহাস, আক্রমণ সহ্য করে আগ্রহ ধরে রাখা খুবই কঠিন। একারণে মুসলিম ভাই-বোনদেরকে ক্রমাগত উৎসাহ এবং তাগাদা দিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি তাদেরকে উৎসাহ না দেই, কষ্টের সময় পাশে না দাঁড়াই, তাহলে তারা কার কাছে যাবে?
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ।
No comments