তাই, নামাজিরা শেষ হয়ে যাক —আল-মাউন
যে লোকটা বিচারদিনকে অস্বীকার করে তাকে খেয়াল করেছ? এরা এতিমদেরকে তাড়িয়ে দেয়। অভাবীদের খাবার তাদেরকে দিতে উৎসাহও দেয় না। তাই, নামাজিরা শেষ হয়ে যাক। যারা নামাজের ব্যাপারে খামখেয়ালী। যারা লোক দেখিয়ে করে। ছোটখাটো উপকার করতেও তারা মানা করে। [আল-মাউন]
এরা এতিমদেরকে তাড়িয়ে দেয়
আমাদের যাদের ছোট বাচ্চা আছে, তারা জানি দিনের মধ্যে কতবার তারা বাবা-মাকে ডাকে। বাবা-মা কিছুক্ষণের জন্য চোখের আড়াল হলেই তারা অস্থির হয়ে ‘বাবা! মা! কোথায় তোমরা?’ ডাকাডাকি শুরু করে। আর আজকের নিষ্ঠুর সমাজে অল্প বয়সে বাবা-মা হারিয়ে ফেলা একটি ছোট বাচ্চা কীভাবে একা বেঁচে থাকে, কী খায়, কোথায় ঘুমায়, জ্বর হলে কে তাকে মাথায় পানি ঢেলে দেয়, রাতের বেলা কে তাকে কোলে নিয়ে হেঁটে ঘুম পাড়ায়? —এগুলো নিয়ে আমরা কতখানি ভাবি? সারাদিন আমাদের মনের কোনায় চিন্তা চলতে থাকে: নিজের বাচ্চাকে কী খাওয়াবো, কখন ঘুম পাড়াবো, কোথায় পড়াবো, কোথায় ঘুরতে নিয়ে যাবো, কী খেলনা কিনে দেবো — আর ওদিকে লক্ষ লক্ষ ছোট বাচ্চারা বাবা-মা ছাড়া একা বড় হচ্ছে চরম অবহেলা, অনাদরে, মানুষের নিষ্ঠুর ব্যবহার সহ্য করে। আমাদের চারপাশের এই ভয়ংকর কঠিন বাস্তবতাকে আমরা কোনো কারণে যতটা পারি ভুলে থাকার চেষ্টা করি। নিজের জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ কীভাবে পূরণ করা যায়, সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকি।
মানুষের জন্য কল্যাণ করা ইসলামের মূলভিত্তিগুলোর একটি। কু’রআনে আল্লাহ تعالى বহু আয়াতে বহুভাবে আমাদেরকে বলেছেন যে, শুধু নামাজ, রোজা, হাজ্জ ইত্যাদি ধর্মীয় রীতিনীতিগুলো পালন করলেই হবে না, একইসাথে আমাদেরকে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে, সামাজিক, নৈতিক দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে। এতিমদের কথা কু’রআনে বহুবার এসেছে, কারণ আল্লাহর تعالى কাছে এতিমদের গুরুত্ব অনেক বেশি। বাবা-মা হারিয়ে ফেলা এতিমের থেকে বেশি আর কেউ আমাদের সামাজিক সেবার দাবীদার হতে পারে না। এতিমদের প্রতি মুসলিমদের দায়িত্ব কতখানি, কীভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে, করার পুরষ্কার এবং না করার শাস্তি সম্পর্কে আমাদের বহুবার সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। এই সূরাহ’য় কঠিনভাবে বলা হয়েছে যে, যারা এতিমদেরকে তাড়িয়ে দেয়, এরা কিয়ামতকেই অস্বীকার করেছে। কারও যদি ইসলাম এবং বিচার দিনে সত্যিই কোনো বিশ্বাস থাকতো, তাহলে সে কোনোদিন এরকম অমানবিক কাজ করতে পারত না।
এখন আমরা ভাবতে পারি, “আমি তো এতিমদের তাড়িয়ে দেই না? আমার কাছে কোনো এতিমই নেই। থাকলে আমি কোনোদিনও তাদেরকে তাড়িয়ে দিতাম না। আমি এত খারাপ না।”
আমাদের কাছে মাঝে মধ্যেই এতিমদের সাহায্য করার আবেদন আসে। এলাকার এতিমখানা থেকে হয়ত কেউ চাঁদা চাইতে আসে। আমরা দারোয়ানকে বলে দেই এদেরকে যেন ঢুকতে দেওয়া না হয়। অনেক সময় মসজিদে এতিমদের জন্য দান করার আবেদন আসে। দান বাক্স যখন আমাদের সামনে আসে, তখন আমরা সেটাকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেই। হয়ত কোনো গরিব আত্মীয় ফোন করে এতিমদের জন্য কিছু টাকা চায়। আমরা তাকে রমজানে ফোন করতে বলি। রমজানে ফোন আসলে যাকাত দেওয়া শেষ বলে রেখে দেই। এগুলো হচ্ছে এতিমদের তাড়িয়ে দেওয়ার আধুনিক উদাহরণ। আগেকার যুগের মত আজকাল আমরা এতিমদের অভিভাবকের দায়িত্ব আর নেই না। আজকাল এতিমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনাদরে, অবহেলায়, ধুঁকে ধুঁকে বড় হতে থাকে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যখন এতিমদের হয়ে আমাদের কাছে আসে সাহায্যের জন্য, আমরা তখন তাদের তাড়িয়ে দেই।
আমরা কয়জন জানি আমাদের এলাকায় এতিম কারা? আমরা প্রতিদিন মসজিদে নামাজ পড়তে ঢুকি এবং নামাজ শেষে বের হয়ে যে যার কাজে চলে যাই। নামাজের সময় পাশে বসা ছেড়া কাপড় পড়া মলিন মুখের অসহায় দেখতে মানুষটার খবর নেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করি না। এতিমদের সাথে ইহসান করতে হলে প্রথমে আমাদেরকে তো আগে জানতে হবে আমাদের চারপাশে এতিম কারা!
আমাদেরকে মসজিদ দেওয়া হয়েছে যেন আমরা এলাকার মুসলিম ভাই-বোনদের খোঁজ খবর রাখি। একে অন্যের সাথে পরিচিত হই। বিপদে আপদে এগিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আজকে মসজিদ শুধুমাত্র একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার জায়গায় পরিণত হয়েছে। কোনোমতে নামাজ শেষ করে ডানে-বামে না তাকিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে যেতে পারলেই বাঁচি। কে আবার কখন, কোন সমস্যা নিয়ে হাজির হয়?[১]
আজকে কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেই যা এতিমদের সঠিকভাবে প্রতিপালন করার জন্য তহবিল গঠন করে, বাজেটের একটি অংশ নির্দিষ্ট রেখে, ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় করে এতিমদের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করবে। বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দল যদি সেটা করার চেষ্টাও করে, তাহলে সেই রাজনৈতিক দল যেন কোনোদিন জিততে না পারে, তার জন্য দেশের ধনকুবেররা ব্যবস্থা করে ফেলবে। একমাত্র ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই এতিমদের প্রতিপালনকে তাদের বাধ্যতামূলক ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে নিয়ে দেশের সকল এতিমদের অভিভাবক হওয়ার দায়িত্ব নেবে।
অভাবীদের খাবার তাদেরকে দিতে কাউকে উৎসাহও দেয় না
মিসকিন مسكين হচ্ছে খুবই গরিব মানুষরা, যাদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, কাপড় যোগাড় করা খুবই কঠিন। এরা সবসময় অভাবী। একজন এতিমের হয়ত উত্তরাধিকার সুত্রে সম্পত্তি থাকতে পারে। কিন্তু এদের কোনো সম্পত্তি থাকা তো দুরের কথা, মৌলিক চাহিদা পূরণ করার মতো সামান্য অবস্থাও নেই। এরা হচ্ছে সমাজের ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা।
আজকে আপনার-আমার পরিবার নিয়ে থাকার জন্য বাসা আছে। রাতে খাওয়ার মতো খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। কালকে বাইরে পড়ার মতো কাপড় আছে। কিন্তু মিসকিনদের এসব কিছুই নেই। তারা প্রতিটা দিন কষ্টে, ভয়ে থাকে: কীভাবে তারা আগামীকাল কিছু খাবার, পড়ার মতো পরিষ্কার কাপড়, থাকার মতো জায়গা জোগাড় করবে। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করা ছাড়া আর কিছু নিয়ে চিন্তা করার মতো অবস্থা তাদের নেই।[১][১১]
আজকে এমন কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেই, যা বাধ্যতামূলকভাবে দেশের সকল মিসকিনদের অভাব দূর করে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। একমাত্র একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে, জনগণের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত সংগ্রহ করে, একটি তহবিল গঠন করে, দেশের মিসকিনদের অভাব দূর করার ব্যবস্থা করা।
যতদিন ইসলামিক আইন প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে, ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতি ধনীদেরকে আরও ধনী বানিয়ে যাবে এবং গরিবদেরকে আরও গরিব বানাতে থাকবে। আজকে পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই, যা সম্পত্তি সুষমভাবে বণ্টন করে ধনী-গরিবের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য, তা দূর করতে পারে। যার ফলে সবসময় এমন কিছু মানুষ থেকে যায়, যারা তাদের প্রয়োজনের চেয়ে হাজার গুণ বেশি সম্পত্তি নিয়ে থাকে, যা তারা আমোদ ফুর্তিতে নষ্ট করে। অন্যদিকে এমন কিছু মানুষ সবসময় থেকে যায়, যারা দুই বেলা খাবারও জোগাড় করতে পারে না। সম্পদ সুষমভাবে বণ্টনের এমন কোনো পদ্ধতি কোনো সরকার যদি তৈরি করার চেষ্টাও করে, তখন দেশের বড় বড় ধনকুবেররা ব্যবস্থা করে দিবে যেন সেই সরকার বেশিদিন টিকে থাকতে না পারে।
আল্লাহর تعالى বিরুদ্ধে মানুষের একটি সাধারণ অভিযোগ হলো: আল্লাহ تعالى কেন পৃথিবীতে এত মানুষ পাঠাল, কিন্তু তাদের জন্য যথেষ্ট খাবার, প্রাকৃতিক সম্পদ, থাকার জায়গা দিয়ে পাঠাল না। এটি একটি বিরাট ভুল ধারণা যে, পৃথিবীতে এত যে গরিব মানুষ, তার মূল কারণ পৃথিবীতে সম্পদের অভাব। মাত্র ১% মানুষ পুরো পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি সম্পদ দখল করে রেখেছে।[১৭৩] শুধু তাই না, মাত্র ২% সবচেয়ে ধনী মানুষগুলো পুরো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি বাড়ি এবং জমির মালিক। বাকি অর্ধেক জমি এবং বাড়ির মধ্যে বাকি ৯৮% জনসংখ্যা বসবাস করছে। মানুষের মধ্যে আজকে যে এই চরম বৈষম্য, তার প্রধান কারণ মানুষের সীমাহীন লোভ, দুর্নীতি এবং ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতি। সুদ একটি বড় কারণ যা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন বড় লোকরা বসে বসে আরও বড় লোক হয়, আর মধ্যবিত্ত এবং গরিবরা দিনরাত খাটার পরেও দিনে দিনে আরও গরিব হতে থাকে।
পুরো পৃথিবীর সব মানুষকে, পুরো ৬ বিলিয়ন মানুষের প্রত্যেককে একটি বাসা এবং সামনে একটি ছোট বাগান দিলেও তাদর সবাইকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যেই জায়গা দেওয়া যাবে। বাকি পুরো যুক্তরাষ্ট্র সহ পুরো পৃথিবী খালি পড়ে থাকবে! আল্লাহ আমাদেরকে এক বিরাট পৃথিবী দিয়েছেন, কিন্তু মাত্র ২% লোভী মানুষের কারণে আজকে ১.৬ বিলিয়ন মানুষ দিনে একবেলাও খেতে পারে না।[৩৯৪]
বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার খরচ করলে, সারা পৃথিবী থেকে ক্ষুধা দূর করে ফেলা সম্ভব। একটি লোকও তখন না খেয়ে থাকবে না। অথচ বছরে ১২০০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় অস্ত্রের পেছনে। একটি দেশের খাবার অপচয়ের পেছনে নষ্ট হয় ১০০ বিলিয়ন ডলার। ‘অবিস’ বা অতিরিক্ত মোটারা বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত খাবার খায়, যা দিয়ে সারা পৃথিবীতে না-খাওয়া মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করা যেত।[১৭৪] একদিকে মানুষ না খেয়ে মারা যায়, আর অন্যদিকে মানুষ অতিরিক্ত খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়।
আল্লাহ কখনই মানব জাতির কোনো ক্ষতি করেন না, বরং মানুষরাই মানুষের ক্ষতি করে। [ইউনুস ১০:৪৪]
সুরা আল-মাউন-এ আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এই লোকগুলো অভাবীদেরকে খাবার দিতেই উৎসাহ দেয় না, নিজেরা দেওয়া তো দূরের কথা। কারণ এরা যদি অন্যদেরকে খাবার দিতে বলে, তাহলে তো মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করবে, “তুমি কোথায় দান করছ? তুমি কাদের খাওয়াও?” — তখন তো তাদের ভেতরের খবর বেড়িয়ে যাবে। এজন্য তারা নিজেদের গা বাঁচাতে কাউকে গরিব লোকদের জন্য কিছু করার কথা বলতেও যায় না।
এই আয়াতে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আল্লাহ تعالى বলেননি যে, তারা অভাবীদের খাবার দেয় না। বরং তিনি বলেছেন, তারা ‘অভাবীদের খাবার’ তাদেরকে দিতে উৎসাহ দেয় না। খাবারটা আমাদের না যে, আমরা দয়া করে তাদেরকে দিচ্ছি। বরং খাবারটা অভাবীদেরই। আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। আজকে আমরা যে ব্যাংক ব্যলান্সের পাহাড় নিয়ে বসে আসি, সেটা ভর্তি হচ্ছে হাজারো অভাবীর খাবার। আমরা হাজারো অভাবীর খাবার ব্যাংকের মন্ধে তালা বন্ধ করে রেখেছি। তারপর সেই অভাবীদের খাবার থেকে লাভ, সুদ খাচ্ছি। আজকে আমরা যে জমি-জমা করে নিশ্চিন্ত মনে বসে আছি, সেই জমি-জমার মধ্যে অভাবীদের খাবার রয়েছে। বিরাট বাড়ি, আলিসান গাড়ি, ব্যাংক ভর্তি কোটি কোটি টাকা, শহরে, গ্রামে জমি-জমা, এগুলোর মধ্যে অভাবীদের ভাগ লুকিয়ে রয়েছে। আমরা যদি তা বের করে তাদেরকে না দেই, তাহলে সেগুলো প্রচণ্ড মার দিয়ে, ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছ থেকে গুণে গুণে বের করা হবে।
তাই, নামাজিরা ধ্বংস হয়ে যাক
সর্বনাশ! নামাজিরা ধ্বংস হয়ে যাবে? তাও আবার ‘ওয়াইল’ ويل এর মত ভয়াবহ শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে নিদারুণ দুর্দশা, কষ্ট, বিপদ আছড়ে পড়া? এই আয়াতে আল্লাহ تعالى অভিশাপ দিচ্ছেন যে, যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে, কিন্তু এতিমদের তাড়িয়ে দেয়, অভাবীদের খাবার দেয় না, মানুষকে দিতে উৎসাহও দেয় না, তারা ধ্বংস হয়ে যাক। এখানেই আয়াত শেষ করে দেওয়ার মধ্যে আমাদের শেখার ব্যাপার রয়েছে। এই কথা শুনে যেন নামাজিরা চমকে ওঠে, “কী! নামাজিরা ধ্বংস হয়ে যাবে? সর্বনাশ, আল্লাহ কী বলছেন!” এই বিরতির অর্থ হচ্ছে, এর আগে আল্লাহ تعالى যা বলেছেন, তার সাথে এই অভিশাপ জড়িত এবং এরপরে আল্লাহ تعالى যা বলবেন, তার সাথেও জড়িত। অর্থাৎ আমরা দুই ধরনের মানুষের কথা জানতে পারবো, যাদেরকে আল্লাহ تعالى ধ্বংস করে দেবেন বলে অভিশাপ দিয়েছেন।[১]
যারা নামাজের ব্যাপারে খামখেয়ালী
আল্লাহ تعالى যদি বলতেন, এরা নামাজের ‘মধ্যে’ খামখেয়ালী তাহলে আমরা সবাই শেষ হয়ে যেতাম, কারণ আমাদের নামাজগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে দায়সারা দায়িত্ব পালন করা। আর আমরা যখন নামাজে দাঁড়াই, তখন আমাদের মনের ভেতরে যে চিন্তাগুলো চলতে থাকে, সেটাকে যদি কথায় প্রকাশ করা যায়, তাহলে তা দেখতে হবে অনেকটা এরকম—
আলহামদু লিল্লাহি … দেশের কী অবস্থা, চারিদিকে মারামারি, খুনাখুনি, অজ্ঞান পার্টি … মালিকি ইয়াওমিদ্দিন … আহ্ হা, গতকালকে পরীক্ষায় তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তর তো ভুল লিখে এসেছি … ইয়াকা নাবুদু ওয়া ইয়াকা … ♫ মোরা একটি দেশকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি ♫ … কুল হু আল্লাহু আহাদ … আজকে মুরগি আর সবজি করতে বলতে হবে … সামি’ আল্লাহু লিমান হামিদাহ … ওহ্ হো! চার রাকআতের জায়গায় তো তিন রাকআত পড়ে বসে পড়েছি, যাকগে কিছু হবে না … আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ … ওযু করেছিলাম? …
আমাদের বেশিরভাগেরই নামাজ পড়তে দাঁড়ালে এমন কোনো দুনিয়ার চিন্তা নেই, যেটা আসে না। একজন একাউন্টেন্ট তার কঠিন সব হিসাব নামাজে দাঁড়িয়ে সমাধান করে ফেলেন। একজন প্রোগ্রামার তার প্রোগ্রামের বাগগুলো ঠিক করে ফেলেন নামাজে দাঁড়িয়ে। একজন ডাক্তার কীভাবে অপারেশন করবেন, তার রিহার্সাল করে ফেলেন নামাজে দাঁড়িয়ে। আর তারপরে আমরা ভাবি, “নামাজ পড়ে আমার তো কোনো লাভ হচ্ছে না? আমার ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ তো তেমন বাড়ছে না? এত বার নামাজে আল্লাহর تعالى কাছে চাচ্ছি, তাওতো কিছু পাচ্ছি না। নামাজ পড়ে আসলেই কী কোনো লাভ হয়?”
পড়ো, যা তোমাকে এই কিতাবে প্রকাশ করা হয়েছে, নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অশ্লীল এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখে… [আনকাবুত ২৯:৪৫]
নামাজ মানুষকে অশ্লীল কাজ এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখবে —এই গ্যারান্টি আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিয়েছেন। এখন নামাজ পড়ে আমরা যদি অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে না পারি, অন্যায় কাজ করা বন্ধ করতে না পারি—তাহলে আমরা যা করছি, সেটা কি সত্যিই নামাজ, নাকি শুধুই কার্ডিও-ভাস্কুলার এক্সারসাইজ, সেটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখা দরকার।
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এরা নামাজের ব্যাপারে খামখেয়ালী। আসর ওয়াক্ত প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওদিকে টিভিতে সিরিয়ালে টানটান উত্তেজনা চলছে। ভাবছি, “এইতো, আর কিছুক্ষণ পরেই সিরিয়াল শেষ হয়ে যাবে। মাগরিবের সাথে পড়ে নেবো।” মেহমান এসেছে। তুমুল আড্ডা চলছে। ওদিকে মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভাবছি, “এখন উঠে চলে গেলে সবাই আবার কী মনে করে। তারচেয়ে ঈশা’র সাথে পড়ে নেবো।” —এগুলো হচ্ছে নামাজের ব্যাপারে খামখেয়ালী। যারা নামাজের ব্যাপারে এরকম খামখেয়ালী, তারা আল্লাহর تعالى সাথে তাদের সম্পর্ককে কোনো গুরুত্ব দেয় না। তাদের কাছে আল্লাহর تعالى গুরুত্ব টিভির থেকে কম। আল্লাহর تعالى সম্মান মেহমানদের থেকেও নীচে। অফিসের বসকে তারা ভয় পায়, কিন্তু আল্লাহকে تعالى ভয় পায় না। এইসব চরম অকৃতজ্ঞ, বেয়াদপ মানুষদের আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এরা ধ্বংস হয়ে যাক। আল্লাহ تعالى তাদেরকে সব দেন, আর তারা তাঁর تعالى সাথেই এরকম করার দুঃসাহস দেখায়।
আল্লাহ تعالى আমাদের কুর‘আনে একবার, দুইবার, দশবার, বিশবার নয়, কমপক্ষে একাশি বার বলেছেন নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে। আক্বিমুসসালাহ অর্থ শুধুই নামাজ পড়া নয়। বরং নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। আক্বিমু অর্থ দাঁড় করাও। প্রাচীন আরবরা যখন কোনো শক্ত পিলার স্থাপন করতো, বা শক্ত দেওয়াল তৈরি করতো, তার জন্য তারা কু’মু শব্দটি ব্যবহার করতো। এখানে কু’মু ব্যবহার করে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন যে, আমাদের প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে পাঁচটি শক্ত পিলার দাঁড় করাতে হবে। সেই পিলারগুলো কোনোভাবেই নড়ানো যাবে না। আমাদের পড়ালেখা, কাজ, খাওয়া, বিনোদন, ঘুম সবকিছু এই পিলারগুলোর আশেপাশে দিয়ে যাবে। আমাদের দৈনন্দিন রুটিনে নামাজ তার জায়গায় শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, কোনোভাবেই তাদেরকে নড়ানো যাবে না।[১]
যারা লোক দেখিয়ে করে
এরা নামাজ পড়ার সময় নিশ্চিত করে যে, আশেপাশের মানুষ যেন দেখে সে কত লম্বা সময় সিজদা দিচ্ছে। মানুষকে শুনিয়ে মুনাজাতে নাকের পানি টানে। একটু পর পর রুমাল বের করে চোখ মুছে আড়চোখে দেখে কেউ দেখছে কিনা। এদের নামাজ হচ্ছে লোক দেখানো। আল্লাহর تعالى প্রতি তারা এতটাই বেয়াদপ যে, নামাজ যাওবা পড়ে, সেই নামাজ হয়ে যায় লোক দেখানো। এই চরম অকৃতজ্ঞ মানুষদের আল্লাহ تعالى শেষ করে দেবেন। কঠিন কষ্ট অপেক্ষা করছে এদের জন্য।
ছোটখাটো উপকার করতেও তারা মানা করে
মাউন অর্থ হচ্ছে প্রতিবেশীদেরকে ছোটখাটো উপকার করা, যেমন তাদেরকে ঘরের সরঞ্জাম ধার দেওয়া। ঐচ্ছিক এবং বাধ্যতামূলক দান করা। প্রচলিত নিয়মের প্রতি অনুগত থাকা। ধরুন, প্রতিবেশী আমার কাছে একটু লবণ ধার চাইতে এসেছে। আমি তাকে ঝাঁজ দেখালাম, “লবণ নাই! গতমাসেই না তেল দিলাম?” অথচ আমার কাছে ঠিকই লবণ আছে। এটা হচ্ছে ইয়ামনাউনাল মাউন —এরা ছোটখাট উপকারও করতে চায় না। যাদের ভেতরটা এতটাই কঞ্জুষ, তাদেরকে আল্লাহ تعالى অভিশাপ দিয়েছেন যেন তারা শেষ হয়ে যায়।
উপসংহার
সুরা আল-মাউন-এর ভাষা বড়ই কঠিন। এক শ্রেণির মানুষের প্রতি আল্লাহর تعالى রাগ পরিষ্কারভাবে এতে ফুটে উঠেছে। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হলো যে, এখানে এমন সব মানুষদের কথা বলা হয়েছে, যাদেরকে আমরা সচরাচর এত খারাপ ভাবি না, যাদের বেলায় ‘ওয়াইল’ এর মত ভয়ংকর শব্দ ব্যবহার করা যায়। কুর‘আনে আমরা দেখি আল্লাহ تعالى এই শব্দ ব্যবহার করেছেন তাদের বেলায়, যারা নিজের হাতে কিতাব লিখে তারপর সেটা আল্লাহর تعالى কাছ থেকে এসেছে বলে চালিয়ে দেয়। যারা কিয়ামত কোনোদিন হবে, এটা বিশ্বাসই করে না। —ভয়ংকর সব অপরাধ। অথচ এই সূরাহ’য় আমরা দেখছি যারা নামাজের ব্যাপারে খামখেয়ালি, লোক দেখানো নামাজ পড়ে, মানুষকে ছোটখাটো সাহায্যও করে না, এতিমদের তাড়িয়ে দেয়, অভাবীদের খাবার দিতে মানুষকে উৎসাহ দেয় না — এইসব মানুষদেরকেও আল্লাহ تعالى একই কাতারে ফেলেছেন। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলামে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একইসাথে মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করা, একজন সুন্দর মনের মানুষ হওয়াটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ। [১৭৩] ধনী-গরিবদের মধ্যে সম্পদের বিশাল ব্যবধান — http:/en.wikipedia.org/wiki/Distribution_of_wealth [৩৯৪] Episode 1: Overpopulation: The Making of a Myth | Overpopulation is a myth. (2017). Overpopulationisamyth.com. Retrieved 6 July 2017, from https:/overpopulationisamyth.com/overpopulation-the-making-of-a-myth
No comments