তোমরা যদি সেই নারীদের বিয়ের ইঙ্গিত দাও (বাক্বারাহ: ২৩৪-২৪২)
গত হাজার বছর ধরে ভারত উপমহাদেশে বিধবারা ভয়ঙ্কর অত্যাচার এবং অন্যায়ের শিকার হচ্ছে। হিন্দু আঞ্চলিক প্রথা অনুসারে বিধবাদের একসময় স্বামীর চিতায় জীবন্ত জ্বলে মরতে বাধ্য করা হতো।
না হলে ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে তাদের অর্ধমৃতের মতো বেঁচে থাকতে হতো। বিধবারা সারাজীবন সাদা কাপড় পড়ে থাকতো, কখনো সাজতে পারত না, প্রথা অনুসারে মাথা কামিয়ে ফেলতে হতো। স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোনো অধিকার ছিল না। বিধবা হয়ে যাওয়ার পর তাদের দেখাশুনা, ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর পক্ষ থেকে কেউ নিত না। তাদের জন্য পেঁয়াজ, রসুন, আমিষ ইত্যাদি খাওয়া সারা জীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যেত। সমাজ তাদেরকে দেখত এক অশুভ, অস্পৃশ্য, ঘৃণিত সত্তা হিসেবে। স্বামীর মৃত্যুর জন্য বিধবার পোড়া কপালকে দোষ দেওয়া হতো।[৩৭৮][৩৭৯][৩৮০] এই হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা। আর ইসলাম আসার আগে প্রাচীন আরবে বিধবাদের নিয়ে কী করা হতো তা বর্ণনা করার ভাষা নেই।[১৪][১২]আজকে লক্ষ লক্ষ নারী বাল্য বিয়ে করে স্বামী হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অল্প বয়সে মা হয়ে স্বামী হারিয়ে, শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ভীষণ কষ্টের জীবন পার করে। পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে ৪ কোটি বিধবা রয়েছে, যার একটি বড় অংশ আশ্রমে থাকে, না হয় রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে, না হলে পতিতালয়ে থেকে জীবন যাপন করছে। —এদের কেউ দেখে না। তাদের সন্তানরা তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কোথাও তারা মানুষ হিসেবে সম্মান পায় না।[৩৭৮][৩৭৯][৩৮০]
বহু যুগ ধরে উপমহাদেশের বেশিরভাগ মুসলিমরা ইসলাম এবং হিন্দু সংস্কৃতি মিলিয়ে একটা খিচুড়ি ধর্ম পালন করছে। যার ফলে মুসলিমরা না শান্তি পাচ্ছে, না অন্যায় বন্ধ হচ্ছে, না সমাজের সংস্কার হচ্ছে। হিন্দুদের মতো অনেক মুসলিম পরিবারে স্বামী মারা গেলে বিধবা স্ত্রীর ‘পোড়া কপালকে’ দোষ দেওয়া হয়, যেখানে ইসলামে পরিষ্কারভাবে বলা আছে: মৃত্যুর সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আল্লাহর ﷻ হাতে এবং ‘পোড়া কপাল’, ‘কুফা’ এই ধারণাগুলো হচ্ছে শিরক।[৩৮৩] এখনো গ্রামে-গঞ্জে মুসলিম সমাজে বিধবাদের অশুভ, কুলক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। অনেক মুসলিম পরিবারে বিধবাদের আর কখনো বিয়ে করতে দেওয়া হয় না। বেশিরভাগ মুসলিম পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় বিধবাদের কথা চিন্তাও করবে না, যেখানে কিনা রাসুল ﷺ-এর মাত্র একজন স্ত্রী ছিলেন কুমারী, আর বিভিন্ন সময়ে ৮ জন স্ত্রী হয়েছিলেন বয়স্ক বিধবা।
মুসলিমরা যদি কুরআন পড়ত, তাহলে দেখত বিধবাদের সম্পর্কে আল্লাহ ﷻ কত সুন্দর শিক্ষা দিয়েছেন, যা ১৪০০ বছর আগে মুসলিমরা অনুসরণ করে বিধবাদের জীবনকে সুন্দর, সম্মানের করে দিয়েছিল। লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো: ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি —এই তিন ধর্মেই বিধবাদের সম্মান দেওয়া হয়েছে। তাদের জীবন নিরাপদে, সুন্দরভাবে পার করার জন্য আবারো বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। বিধবাদের ঠিকমতো দেখাশুনা করার দায়িত্ব সমাজের উপর দেওয়া হয়েছে। একইসাথে বিধবাদের যত্ন নেওয়ার বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে বড় পুরষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।[৩৮৩] শুধুই হিন্দু ধর্ম বাদে। এথেকেই বোঝা যায় যে, ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্মের উৎস একজন অত্যন্ত দয়ালু, নারী-পুরুষের প্রতি সদয় দৃষ্টিভঙ্গির একজন সত্তা, যার পুরুষদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নেই। আর হিন্দু ধর্মের উৎস পুরুষতান্ত্রিক, নারী-বিদ্বেষী, অমানবিক এক বা একাধিক সত্তা।
সূরা আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে শিখিয়েছেন বিধবাদের সম্পর্কে ইসলামের নিয়ম কী হবে। আমরা লক্ষ করলে দেখবো, নিয়মগুলো বেশিরভাগই নারীদের পক্ষে। আয়াতগুলো নিয়ে ঠিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এই নিয়মগুলোর পেছনে কী বিরাট প্রজ্ঞা রয়েছে—
তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মারা যায়, তাদের স্ত্রীরা চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যখন সেই সময় (ইদ্দত) পার হবে, তখন যদি তারা গ্রহণযোগ্য-সুন্দরভাবে নিজেদের ব্যাপারে কিছু করতে চায়, তাহলে তোমাদের কোনো গুনাহ হবে না। তোমরা যা কিছুই করো, আল্লাহ ﷻ তার সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৩৪]
চার মাস দশ দিন কেন?
চার চান্দ্র মাস এবং দশ দিন হচ্ছে ১২৬ দিন, অর্থাৎ ঠিক ১৮ সপ্তাহ। ১৮ সপ্তাহে একটি বাচ্চা পুরোপুরি মানব আকৃতি নেয়। এসময় তার চোখ, কান, নাক, মাথা, হাত, পা ইত্যাদির গঠন সম্পূর্ণ হয়, দাঁত, নখ তৈরি হয়। লিভার, পরিপাক তন্ত্র সম্পূর্ণ হয়ে হজমি রস নিঃসরণ হয়।[৩৮১] এই সময় ছেলে বা মেয়ে অনুসারে যৌনাঙ্গ, জরায়ু সম্পূর্ণ তৈরি হয় এবং বাচ্চা কী হবে তা পরিষ্কারভাবে নির্ণয় করা যায়।[৩৮২] গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা এই সময়ের পর থেকে একেবারেই কমে মাত্র ৩% হয়ে যায়।[৩৮৩] এছাড়া এই দশ দিনেই বাচ্চার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয় বলে মত রয়েছে।[১২][১৪]
একারণে চার মাস দশ দিন অপেক্ষা করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বিধবা গর্ভবতী কিনা এবং বাচ্চা জীবিত কিনা। এর আগে বিয়ে করে ফেললে যদি বাচ্চা জন্ম হয়, তাহলে বাচ্চার বাবা কে, তা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যদি বিধবা সত্যিই গর্ভবতী হন, তাহলে তাকে বাচ্চা জন্ম দেওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হবে।[১২][১৪] তাই চার মাস দশ দিন অপেক্ষার পর তিনি প্রায় নিশ্চিত হতে পারেন যে, তাকে গর্ভকালীন পুরো সময়টাই অপেক্ষা করতে হবে, কারণ এর পরে বাচ্চা হারানোর সম্ভাবনা কম, যদি না আল্লাহ ﷻ অন্য কিছু ইচ্ছা করেন।[১২][১৪]
ইদ্দতের সময় শুধুই যে বিয়ে করা যাবে না তা নয়,
একই সাথে সাজসজ্জা করা থেকেও দূরে থাকতে হবে। কারণ নিজেকে আকর্ষণীয় করে পরপুরুষের কাছে উপস্থাপন করা থেকে দূরে থাকতে হবে।[৩][১২][১৪] এই সময়টুকু পুরোটাই ঘরে বসে থাকতে হবে কিনা, নাকি বাইরে জীবিকার প্রয়োজনে যাওয়া যাবে, এমনকি ভ্রমণেও যাওয়া যাবে —তা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে মতভেদ আছে।[৩][১৪]
তারপর ইদ্দত পূরণ করার পর বিধবা ইচ্ছে করলে আবার বিয়ে করতে পারেন। ইসলামী সীমার মধ্যে থেকে গ্রহণযোগ্যভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন। আয়াতে আল্লাহ ﷻ বলেছেন, বিধবা মা’রুফ-ভাবে নিজের ব্যাপারে কিছু করতে পারে। মা’রুফ হচ্ছে— ১) সবার কাছে ভালো বলে পরিচিত এমন কিছু, ২) কোনো কাজ বা কিছু যার ফলাফল যে ভালো হবে তা যুক্তি দিয়ে বোঝা যায়, ৩) এমন কোনো কাজ যা শারিয়াহ এর ভিত্তিতে ভালো, ৪) সুন্দর আচরণ, সমতা, মমতা, কল্যাণকর, ৫) আন্তরিকতা, সৎ উপদেশ।[লেন অভিধান] অনেকে নিজেদের পরিবারের খানদানি সম্মান চলে যাবে
ভেবে বিধবাদের বিয়ে দিতে চান না। এটা অন্যায়। আল্লাহ ﷻ বিধবাদের অধিকার দিয়েছেন, যেন তারা প্রয়োজন মনে করলে ইদ্দত শেষ করার পরেই বিয়ে করে ফেলতে পারে। বিধবারা মা’রুফভাবে এই কাজ করলে বিধবার অভিভাবক বা বিচারকদের কোনো দোষ হবে না। তাই কেউ যেন এতে বাঁধা না দেয়।[১৪]
আমরা একটু চিন্তা করলেই দেখতে পারি, এই ব্যবস্থাটা কত সুন্দর। এটা হিন্দু ধর্মের বিধবাদের যাবতীয় সমস্যা, কষ্টের, অন্যায়ের পথ বন্ধ করে দেবে। সমস্যা হচ্ছে মুসলিম সমাজের, যা ইসলাম ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্ম মিশিয়ে, এক খিচুড়ি ধর্ম বানিয়ে অনুসরণ করা শুরু করেছে। যার ফলে মুসলিম নারীরা না শান্তি পাচ্ছে, না তাদের উপর অন্যায় করা বন্ধ হচ্ছে, না সমাজের কোনো সংস্কার হচ্ছে।
এর পরে আল্লাহ ﷻ আমাদের শেখাবেন হালালভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পদ্ধতি—
যদি তোমরা সেই নারীদের বিয়ের ইঙ্গিত দাও, অথবা মনে মনে গোপন রাখো, তাহলে তোমাদের কোনো দোষ হবে না। আল্লাহ ﷻ জানেন যে, তোমরা তাদের কথা ভাবো। কিন্তু তাদের সাথে কোনো গোপন অঙ্গীকার করবে না। তাদেরকে সম্মান-সৌজন্যতা বজায় রেখে জানিয়ে দাও, আর নির্দিষ্ট সময় (ইদ্দত) পার না হওয়া পর্যন্তও বিয়ে করার কথা দেবে না। মনে রেখো, আল্লাহ ﷻ জানেন তোমাদের অন্তরে কী আছে, তাই তাঁর প্রতি সাবধান! একইসাথে মনে রেখো, আল্লাহ ﷻ অনেক ক্ষমা করেন, তিনি অনেক সহনশীল। [আল-বাক্বারাহ ২৩৫]
অনেক পরিবারে কেউ বিধবা হলে, সে যদি অত্যন্ত সুন্দরী হয়, বা অনেক সম্পদশালী হয়, এবং তার উপর বাচ্চা না থাকে, তাহলে তাকে বিয়ে করার জন্য পাত্রের লাইন লেগে যায়। আর আগেকার মুসলিম আরব সমাজে বিধবাদের বিয়ে করাটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তখন বিধবাদেরকে কোনো ধরনের ‘ভয়ঙ্কর প্রাণী’ মনে করতো না। তাই এই সময়টাতে কেউ যেন বিয়ের আকাঙ্ক্ষায় মজনু হয়ে সীমালঙ্ঘন করে না ফেলে, সে জন্য এই আয়াতে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে কোনো ধরনের গোপন বিয়ের কথা দেওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ।[১৪] কারো বিয়ে করার যতই ইচ্ছা থাকুক, আগে ইদ্দত পার হবে, তারপর বিয়ের কথা দেওয়া যাবে। এর আগে পর্যন্ত সরাসরি না বলে বিয়ের ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে, যেন বিধবা বুঝতে পারে তার জন্য পাত্র তৈরি আছে।[৪][১২][১৪] পাত্রও যেন বুঝতে পারে বিধবা বিয়ে করার প্রস্তাব একেবারেই বাতিল করে দেবে না। সুতরাং, চার মাস দশ দিন অপেক্ষা করার পর বিফলে যাওয়া সম্ভাবনা কম।[১২] কিন্তু কোনো ধরনের পাকা কথা দেওয়ার আগে ইদ্দত পার করতে হবে। আল্লাহ ﷻ এই ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে সাবধান করে দিয়েছেন।
কিন্তু এর পরেই আল্লাহ ﷻ আবার নমনীয় হয়ে বলেছেন যে, তিনি অনেক ক্ষমা করেন, অনেক সহনশীল। তিনি জানেন বিয়ে করার চিন্তা মাথায় আসলে মানুষের কী অবস্থা হয়। শুধু সীমা পার না করলেই চলবে। আল্লাহ ﷻ হচ্ছেন حليم হালিম যার অর্থ রাগ করার পরেও যিনি অনেক ভালোবাসেন, অনেক সহনশীল। যেমন, মা-কে حِلْم বলা হয়, কারণ মা সন্তানের উপর বার বার রাগ করলেও, তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসা চলে যায় না। আল্লাহ ﷻ এই ভালোবাসা এবং সহানুভূতির সর্বোচ্চ পর্যায় ধারন করেন। তাঁর বান্দারা বার বার পাপ করে, তিনি বান্দাদের উপর রাগ করেন, কিন্তু তারপরেও তিনি বান্দাদের অনেক ভালোবাসেন।[১]
এরপরের আয়াত হচ্ছে বিয়ে করে ফেলার পর যখন স্বামী বা স্ত্রীর মাথায় হাত পড়ে ‘হায় হায়’ অবস্থা হয়, তখনকার নিয়ম—
স্ত্রীদের স্পর্শ করার আগে অথবা মোহর ঠিক করার আগে যদি তালাক দিয়ে দাও, তাহলে তোমাদের কোনো পাপ হবে না। কিন্তু তাদেরকে খরচপত্র দাও, সচ্ছলরা তাদের সামর্থ্য অনুসারে এবং গরীবরা তাদের সামর্থ্য অনুসারে। যথাযথ খরচপত্র দাও। যারা ইহসান করে, তাদের জন্য এটা কর্তব্য। [আল-বাক্বারাহ ২৩৬]
অনেক সময় দেখা যায়, বিয়ে করার পরেই স্বামী বা স্ত্রী উপলব্ধি করে যে, বিরাট ভুল হয়ে গেছে, এই বিয়ে করাটা উচিত হয়নি। যেমন, অনেক সময় দেখা যায় ইন্টারনেটে বসে বিদেশে থাকা ছেলে বা মেয়ের সাথে বিয়ে পড়ানো হয়েছে। তারপর স্বামী-স্ত্রী দুজনে কয়েকদিন ইন্টারনেটে কথা বলে উপলব্ধি করেছে যে, তারা আসলে একে অন্যের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। একজন কুশল বিনিময়ের সময় “What’s up?” বললে, অন্যজন উপরে তাকায়। এভাবে স্বামী, স্ত্রী উভয়ে যখন উপলব্ধি করে যে, তাদের মধ্যে পার্থক্য এতটাই বেশি যে, এতটা ভিন্নতা নিয়ে বাকি জীবন পার করা তাদের পক্ষে সম্ভব না, তখন যদি তালাক হয়ে যায়, তাহলে স্ত্রীকে ইদ্দত পার করার দরকার নেই।[১]
আবার এরকমও হয় যে, বিয়ের পরই হয়তো স্বামীকে জাহাজে করে কাজে দূরে চলে যেতে হয়েছে। তারপর স্বামী বিদেশে গিয়ে অন্য কারো প্রেমে পড়েছে। স্বামী আর তার বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে সংসার
করবে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনে ফোনে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তাদের মধ্যে আর সম্পর্ক আগানো সম্ভব না। যেহেতু এখনো স্বামী স্ত্রীকে স্পর্শ করেনি, সুতরাং তালাক দিয়ে দিলে আর ইদ্দত পার করতে হবে না।
কিন্তু এই ধরনের তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীকে সমাজে প্রচলিত রীতি অনুসারে যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণযোগ্য উপহার, খরচপত্র ইত্যাদি দেওয়া, যেন স্ত্রীকে কোনো কষ্টের পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। স্বামী তার আর্থিক সামর্থ্য অনুসারে স্ত্রীর জন্য ভালো হয় এরকম যথেষ্ট পরিমাণে দেবে। তবে ধনী হলে কোনো বাড়াবাড়ি করা যাবে না, আর গরীব বলে কিপ্টেমি করা যাবে না।[১২]এভাবে স্বামী কিছু সম্পদ হারাবে, স্ত্রী কিছু সম্পদ লাভ করবে। এই সম্পদ হারানোর চিন্তা মাথায় থাকলে, স্বামীরা ঠিকমতো চিন্তাভাবনা না করেই হুট করে বিয়ে করে, তারপর স্ত্রীর মনে কষ্ট দিয়ে তালাক দেওয়া আগে বহুবার চিন্তা করবে। বিয়ে যে একটা খেলা নয়, সেটা পুরুষদের সাবধান করে দেওয়ার জন্য এই নিয়ম।
এই আয়াতে مَتِّعُوهُنَّ ব্যবহার করে শুধুই দেওয়া নয়, যথেষ্ট পরিমাণে দেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। কিছু একটা দিয়ে দায় সারা দায়িত্ব পালন করলে হবে না। এধরনের তালাক যেকোনো নারীর জন্য কঠিন একটা সময়। বিয়ে করে সংসার করার কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা সব রাতারাতি ভেঙ্গে যায় তালাকে। এই কঠিন সময়টা নারীদের জন্য কিছুটা সহজ করে দেওয়ার জন্য স্বামীকে যথেষ্ট পরিমাণে, রীতি অনুসারে মার্জিত উপহার দিতে হবে। উপহার দেওয়ার সময় মা’রুফ এর শর্তগুলো পূরণ করতে হবে।
যদি স্পর্শ করার আগে কিন্তু মোহর নির্ধারণ করার পরে তালাক দাও, তাহলে যে মোহর বাধ্যতামূলক করেছ, তার অর্ধেক দাও। তবে স্ত্রী মাফ করে দিলে, বা যার হাতে বিবাহ-বন্ধন, সে মাফ করে দিলে আর দিতে হবে না। মাফ করে দেওয়াটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী। আর তোমরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতির কথা ভুলে যেও না। তোমরা কী করো, আল্লাহ ﷻ তা অবশ্যই দেখেন। [আল-বাক্বারাহ ২৩৭]
মোহর ঠিক করা হয়ে গেলে সেটা একটা অঙ্গীকার। এক্ষেত্রে স্বামী যদি স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগেই তালাক দেয়, তাহলে স্বামীকে অর্ধেক মোহর দিতে হবে। এই নিয়ম আবারো পুরুষদের সাবধান করে দেয় যে, বিয়ে কোনো খেলা নয়। একজন নারীর জীবন নিয়ে খেলার আগে সাবধান। কিন্তু যদি স্ত্রী মোহর নিতে না চায়, সেটা ক্ষমা করে হোক বা তিক্ততার কারণেই হোক, তাহলে কোনো মোহর না দিলেও হবে। তবে যার হাতে বিবাহ-বন্ধন, অর্থাৎ স্বামী যদি পুরো মোহরটাই নিজে থেকে দিতে চায়, তাহলে খুবই ভালো কথা। অনেক সময় এভাবে বিয়ে করে তালাক দিয়ে চলে যাওয়ার সময় স্বামী অনুতপ্ত হয়। অনুতাপ কমানোর জন্য সে নিজে থেকে যদি স্ত্রীকে পুরো মোহর দিয়ে দিতে চায়, তাহলে সে দিতে পারে, এবং সেটা স্ত্রীর গ্রহণ করা উচিত। এই নিঃস্বার্থ কাজটি স্বামীকে তাকওয়া অর্জন করতে সাহায্য করবে।
“আর তোমরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতির কথা ভুলে যেও না”
— আয়াতের এই অংশটি অত্যন্ত সুন্দর। আমরা মুসলিমরা যেন আমাদের মধ্যে সহানুভূতির কথা ভুলে না যাই। জীবনে যতই তিক্ততা, মতবিরোধ থাকুক, তালাকের মতো কঠিন অবস্থায় রাগ, দুঃখ, কষ্ট নিয়ে দিন পার করুক না কেন, আমাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, মমতার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। এই সহানুভূতি আমাদের মনুষ্যত্বের পরিচয়। সবচেয়ে বড় কথা এটি আমাদের তাকওয়ার প্রমাণ। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে থেকেও আমরা একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে, আল্লাহর ﷻ উপস্থিতির প্রতি আমাদের যে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে, তিনি যে সব কিছু দেখছেন, সেটারই প্রমাণ দেই। যখনই আমরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতির কথা ভুলে গিয়ে নোংরা ভাষা, চিৎকার চেঁচামেচি, রেষারেষি, হিংসা, কুৎসা রটানো শুরু করি, তখনি আমরা সেই মুহূর্তগুলোতে তাকওয়া হারিয়ে ফেলি। আল্লাহ ﷻ যে আমাদের নোংরা আচরণ দেখছেন,
সেটা ভুলে যাই। যদি সত্যিই আল্লাহর ﷻ উপস্থিতি সবসময় অনুভব করতাম, তাকওয়া বজায় রাখতাম, তাহলে যে কোনো ধরনের নোংরা আচরণ করার আগে আমাদের বুক কাঁপত।
মানুষের মধ্যে সহানুভূতি থাকলে মানুষ তখন একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে, বিপদে পাশে দাঁড়ায়। তখন তাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হওয়ার পথ তৈরি হয়। তখন নিজেদের মধ্যে তিক্ততা থাকলেও সহানুভূতির কারণে ভদ্রতা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটি, অপবাদ, কালিমা দেওয়া থেকে দূরে থাকে। সহানুভূতি একটি খুবই সুন্দর গুণ। এই গুণ মানুষকে ক্ষমা করতে শেখায়, ভুলত্রুটি উপেক্ষা করতে শেখায়। একদল মানুষ যখন এই গুণ অর্জন করে, তখন তাদের মধ্যে ঐক্য এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়। আজকে মুসলিমদের মধ্যে যে এত বিভাজন, এত কাদা ছুড়াছুড়ি, এত তিক্ততা, এর কারণ আমরা একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেছি। অল্পতেই আমরা একে অন্যেকে আর সহ্য করতে পারি না। তখন তাকে দমন করে, নিজেকে জাহির করার এক অন্ধ আক্রোশে তাকে শেষ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। যতদিন পর্যন্ত মুসলিমদের ভেতরে একে অন্যের প্রতি নির্মল সহানুভূতি তৈরি না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য আসবে না। জোর করে ঐক্য চাপিয়ে দিলে তা তুচ্ছ কারণে যখন তখন ভেঙ্গে যেতে থাকবে।
এর পরের আয়াতে, যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন, তাদের জন্য নির্দেশ এসেছে—
তোমরা যারা স্ত্রী রেখে মারা যাও, তারা তাদের জন্য অসিয়তনামা করে যাবে, যেন এক বছর পর্যন্ত তাদের ভরণপোষণ দেওয়া হয় এবং তাদেরকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া না হয়। তবে তারা স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেলে তোমাদের কোনো পাপ হবে না, যদি তারা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের ব্যাপারে কিছু করে। আল্লাহর ﷻ সব ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব, তিনি পরম প্রজ্ঞাবান। [আল-বাক্বারাহ ২৪০]
তালাকপ্রাপ্তাদের রক্ষণাবেক্ষণ যেন ঠিকভাবে করা হয়, স্বামী বেঁচে থাকুক বা মারা যাক না কেন, সেটা এরপরের আয়াতে আল্লাহ ﷻ আবারো জোর দিয়ে বলছেন—
তালাকপ্রাপ্তাদের জন্য যথাযথ ভরণপোষণ হবে। যারা তাকওয়া অর্জন করেছে, তাদের জন্য এটা কর্তব্য। [আল-বাক্বারাহ ২৪১]
আয়াতটির ভাব কঠিন। আয়াতটি আসলে বলে না যে, “তালাকপ্রাপ্তাদের জন্য যথাযথ ভরণপোষণ দেবে”, এখানে কাউকে দিতে বলা হচ্ছে না। বরং আয়াতটির ভাব হচ্ছে, “বিশেষ করে তালাকপ্রাপ্তাদের জন্য যথাযথ ভরণপোষণ”। যেমন, আপনি আপনার বাচ্চাকে বললেন, “দশটা বাজে, বিছানায় শুতে যাও, ঘুমিয়ে পড়ো।” সে বেশি পাত্তা দিলো না। তখন আপনি বিছানার দিকে আঙ্গুল তুলে গম্ভীর হয়ে থেমে থেমে বললেন, “দশটা। বিছানা। ঘুম।”
এরপরও যারা টালবাহানা করবে, নানা অজুহাত দেখাবে, যেন স্ত্রীদেরকে বেশি কিছু দিতে না হয়, তাদের জন্য শেষ সাবধান বাণী—
এভাবে আল্লাহ ﷻ তাঁর বাণীকে তোমাদের জন্য একদম পরিষ্কার করে দেন, যাতে করে তোমরা বিবেক-বুদ্ধি খাঁটাও। [আল-বাক্বারাহ ২৪২]
কেউ যেন দাবি না করে যে, তালাকের আয়াতগুলো পরিষ্কার না, বেশি জটিল, আমি বুঝতে পারিনি আমাকে কী করতে হবে, বা ইসলাম নিয়ে আমার পড়াশুনা কম, আমি জানতাম না এই সব নিয়ম আছে ইত্যাদি। আল্লাহর ﷻ বাণী একদম পরিষ্কার। কোনো ভুল বোঝার সুযোগ নেই। আর মুসলিম হয়ে কোনোদিন কুরআন পুরোটা একবারও বুঝে পড়েনি, এই ধরণের ফালতু অজুহাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিঃদ্রঃ তালাক সম্পর্কিত এই আলোচনাগুলো মোটেও সম্পূর্ণ নয়। এব্যাপারে বিস্তারিত জানতে তাফসীর পড়ুন। আর তালাক সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে পারিবারিক আইনে অভিজ্ঞ মুফতির সাথে আলোচনা করুন। প্রত্যেকের পরিস্থিতি বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
– ওমর আল জাবির
সূত্র
·
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
·
[২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
·
[৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
·
[৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
·
[৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word
Meaning of The Quran
·
[৬]
সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
·
[৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
·
[৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
·
[৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
·
[১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
· [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
No comments