যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে, সে বিরাট কল্যাণ পেয়ে গেছে —আল-বাক্বারাহ ২৬৯
তিনি যাকে চান, তাকে প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে, সে বিরাট কল্যাণ পেয়ে গেছে। আর চিন্তাশীল মানুষরা ছাড়া কেউ শিক্ষা নেবে না। [আল-বাক্বারাহ ২৬৯]
হিকমাহ অর্থাৎ প্রজ্ঞা এসেছে ইহ্কাম احكم থেকে, যার অর্থ কথা বা কাজে পরিপূর্ণতা, পারফেকশন।[১৪] প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার। আমাদের অনেক জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু যদি প্রজ্ঞা না থাকে, তাহলে সেই জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার হবে না। যেমন: আমরা অনেকেই জানি, আল্লাহ تعالى আমাদের ক্বদর/ভাগ্যের মালিক, তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ব্যাপারে কুর’আনের আয়াতগুলো আমরা পড়েছি, আমাদের জ্ঞান যথেষ্টই আছে। কিন্তু তারপরও আমরা বাচ্চার কপালে কালো টিপ দেই, যেন অশুভ চোখ না লাগে। স্বামীর নাম নেওয়া যাবে না, তাতে অমঙ্গল হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পেছনে তাকানো যাবে না, তাতে যাত্রা অশুভ হয়। কুর‘আনের আয়াতের সাথে হাবিজাবি দু’আ লেখা তাবিজ পড়ি, যেন অসুখ না হয়। —এরকম শত শত ভুল ধারণায় আমরা বিশ্বাস করি, কারণ আমাদের জ্ঞান থাকলেও প্রজ্ঞা আসেনি। আমরা শিখিনি আমাদের জ্ঞান কীভাবে কাজে লাগাতে হয়।
আবার, আমরা অনেকেই জানি কুর‘আনে পরিষ্কার করে বলা আছে যে, নারীদের ‘খিমার’ (মাথা ঢেকে বুক পর্যন্ত কাপড় ছেড়ে দেওয়া) পড়তে হবে এবং এমন ঢিলেঢিলা কাপড় পড়তে হবে, যেন দেহের অবয়ব বোঝা না যায়। কিন্তু তারপরেও আমরা হিজাবকে এক ধরনের উগ্র ফ্যাশনে পরিণত করি। এগুলো হচ্ছে প্রজ্ঞার অভাব। জ্ঞান আছে, কিন্তু সেই জ্ঞানের আসল উদ্দেশ্য কী, সেটার বোঝার মত বোধ নেই।
আবার, অনেকে মনে করেন: নিজে কুর’আন পড়ে বুঝে চললেই হবে। কুর’আন কারও কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। সাহাবীরা, তাদের অনুসারীরা কীভাবে কুর’আন বুঝে গেছেন, কীভাবে অনুসরণ করে গেছেন —এগুলো আমাদের জানার কোনো দরকার নেই। আজকের যুগ পাল্টে গেছে। আজকে আমাদেরকে নিজেদের কুর’আন পড়ে, বুঝে, নিজেদের সিদ্ধান্ত মতো জীবনযাপন করতে হবে।
ধরুন, একজন সিদ্ধান্ত নিল যে, সে বাজার থেকে সার্জারির উপর বেশ কিছু বই পড়ে নিজেই প্র্যাকটিস করে একজন সার্জন হয়ে যাবে। তার কোনো বড় সার্জনের কাছ থেকে শেখার কোনো দরকার নেই। সে নিজেই পারবে বই পড়ে অপারেশন করতে। সার্জারির উপর যথেষ্ট ভালো বই আছে, বিস্তারিত ছবি দেওয়া আছে, ইউটিউবে আজকাল সার্জারির ভিডিও পর্যন্ত পাওয়া যায়। এত কিছু থাকতে কেন আমাদেরকে কেনো সার্জনের কাছ থেকে সার্জারি করা শিখতে হবে?
একজন বড় সার্জন আমাদেরকে প্রজ্ঞা শেখাবেন। তিনি শেখাবেন কখন কোন পরিস্থিতিতে কী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখন বইয়ের নিয়ম মানা যাবে, কখন নিয়ম এদিক-ওদিক করতে হবে। বইয়ের গদবাধা নিয়মের বাইরেও যে অনেক কিছু বিবেচনার আছে, সেগুলো তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখাবেন। সার্জারির আগে রোগীকে কী জানালে, কী না জানালে সার্জারি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, তা শেখাবেন। সার্জারির পরে কী কী সতর্কতা নিলে ইনফেকশন কম হবে, তা শেখাবেন। এইসব প্রজ্ঞা বই পড়ে আসে না। এগুলো কারও কাছ থেকে শিখতে হয়, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করতে হয়।
একইভাবে ইসলামের শিক্ষা শুধু কিছু আয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি আয়াতের পেছনে প্রজ্ঞা রয়েছে। কখন কোন প্রেক্ষাপটে কুর’আনের কোন আয়াত প্রযোজ্য, কখন কোন প্রেক্ষাপটে তা প্রযোজ্য নয় —এগুলো আমাদেরকে রাসুলের عليه السلام, তার অনুসারীদের এবং ফিকহ-এ অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখতে হবে। না হলে আমরা কুর’আনের আয়াতের আক্ষরিক অনুবাদ করে, পরিস্থিতি বিবেচনা না করে, প্রজ্ঞা ব্যবহার না করে ঝাপিয়ে পড়ব নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে। যার ফলাফল হবে ভয়াবহ। ‘শুধু কুর‘আন’ নামে একদলের জন্ম হবে, যারা কুর‘আন ছাড়া আর কোনো ধর্মীয় বই মানবে না। একদল উগ্রপন্থী জিহাদির জন্ম হবে, যারা কুর‘আনের আয়াতের প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই, যে কোনো সময়ে, যে কোনো পরিস্থিতিতে জিহাদের আয়াতগুলোকে সশস্ত্র মারামারির আয়াত বানিয়ে ফেলবে।
একারণেই কুর‘আনে বলা হয়েছে যে, নবী-রসূলরা শুধু আল্লাহর تعالى বাণীই শেখাবেন না, একইসাথে প্রজ্ঞা শেখাবেন, যেন আল্লাহর تعالى বাণীকে আমরা ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি।
ও আমাদের প্রভু, ওদের মধ্যে থেকে একজনকে রসূল হিসেবে গড়ে তুলুন, যে ওদেরকে আপানার আয়াত শোনাবে, তাদেরকে আপনার বিধি-বিধান এবং প্রজ্ঞা শেখাবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোচ্চ ক্ষমতা-কর্তৃত্বের অধিকারী, পরম প্রজ্ঞাবান। [আল-বাক্বারাহ ১২৯]
যদি কুর‘আনের আয়াত শুনিয়ে, বিধি বিধান শেখালেই যথেষ্ট হতো, তাহলে প্রজ্ঞা শেখানোর কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে বলেছেন যে, রাসুল عليه السلام প্রজ্ঞা শেখাবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন। শুধু কুর‘আন ধরিয়ে দিয়েই বলবেন না যে, কুর‘আনই যথেষ্টও, আর কিছু জানার দরকার নেই। বিস্তারিত পড়ুন: কুর‘আনের কথা’র আল-বাক্বারাহ ১২৯-এর ব্যাখ্যা।
আল্লাহ আমাকে হিকমাহ না দিলে আমি কী করবো?
আয়াতে যেহেতু বলা হয়েছে যে,
তিনি যাকে চান, তাকে প্রজ্ঞা দান করেন
— তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, যদি আল্লাহ تعالى আমাকে প্রজ্ঞা না দেন, তাহলে আমার কী দোষ?
এই আয়াতেই বলা হয়েছে যে, চিন্তাশীল মানুষরা অর্থাৎ أُولُو الْأَلْبَاب ছাড়া কেউ শিক্ষা নেবে না। আমাদেরকে প্রথমে আলবাব অর্থাৎ চিন্তাশীল মানুষদের একজন হতে হবে। চিন্তাশীল মানুষরা কারা?
নিশ্চয়ই আকাশগুলো এবং পৃথিবীর সৃষ্টিতে, এবং দিন ও রাতের আবর্তনে চিন্তাশীল মানুষদের জন্য বিরাট নিদর্শন রয়েছে। [আল-ইমরান ৩:১৯০]
তাদের কাহিনীতে চিন্তাশীল মানুষদের জন্য অনেক শেখার বিষয় রয়েছে। এগুলো কোনো মনগড়া কাহিনী নয়। বরং এটা তোমাদের কাছে যা আছে, তাকেই সমর্থন করে, এবং সবকিছুকে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করে। এটা বিশ্বাসীদের জন্য পথপ্রদর্শক এবং দয়া। [ইউসুফ ১২:১১১]
এটা এমন এক বই, যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি এক কল্যাণ হিসেবে, যেন এর আয়াতগুলো নিয়ে তারা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে, এবং চিন্তাশীল মানুষেরা যেন এর থেকে শিক্ষা নিতে পারে। [সদ ৩৮:২৯]
সুতরাং চিন্তাশীল মানুষরা হচ্ছে তারাই, যারা গভীরভাবে চিন্তা করে আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। এরা কোনো কিছু পড়লে, বা শুনলে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয় না। এদের মন পরিষ্কার। এদের মাথাভর্তি রাজনীতি, দুর্নীতি, খেলা, সিনেমা, তারকা, বিনোদনের খবর গিজগিজ করে না। এদের মাথায় সারাক্ষণ গানের সুর বাজতে থাকে না। এরা সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা করে, দিন-রাত কেন হয়, অর্থাৎ বিজ্ঞান নিয়ে তারা চিন্তা করে। এরা কুর‘আনে দেওয়া বিভিন্ন কাহিনীর মধ্যে শিক্ষণীয় কী আছে, তা বোঝার চেষ্টা করে। সেগুলো বুঝে তারা সে অনুযায়ী নিজেদেরকে পরিবর্তন করে।[১] এরাই আল্লাহর تعالى অনুগ্রহে হিকমাহ অর্থাৎ প্রজ্ঞা পেতে পারে। আর যে একবার প্রজ্ঞা পেয়ে যায়, সে বিরাট কল্যাণ পেয়ে যায়। সে দুনিয়াতে সফল হয়, আর আখিরাতে তার জন্য অপেক্ষা করে অনন্ত সফলতা এবং শান্তি।
আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বিশেষভাবে আল্বাব অর্থাৎ পরিষ্কার মনের, চিন্তাশীল মানুষদের কথা বলেছেন। আল্লাহ تعالى কুর‘আনে আরও বহু ধরনের মানুষের উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু প্রজ্ঞা পাওয়ার জন্য তিনি تعالى এই বিশেষ ধরনের মানুষদের বেছে নিয়েছেন। যেমন, তিনি বলতে পারতেন ذِى حِجر অর্থাৎ বুদ্ধিমান মানুষদের কথা, যাদের মস্তিষ্ক প্রখর। অথবা তিনি আক্বল বা বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের কথা বলতে পারতেন, যারা বিবেক দিয়ে নিজেদের বুদ্ধিকে খারাপ কাজে ব্যবহার করা থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে। অথবা তিনি হালিম বা সহনশীল মানুষ, যারা নিজেদেরকে সংযত রাখতে পারেন, রাগ দমন করে রাখতে পারেন, তাদের কথা বলতে পারতেন। অথবা তিনি أُوْلِى ٱلنُّهَىٰ নুহা বা অত্যন্ত বুদ্ধিমান, যৌক্তিক, প্রখর উপলব্ধির মানুষদের কথা বলতে পারতেন, যাদের বোঝার ক্ষমতা গভীর, যারা অত্যন্ত অভিজ্ঞ। কিন্তু এদের কথা না বলে তিনি আল্বাব অর্থাৎ চিন্তাশীল মানুষদের কথা বলেছেন, যারা আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে।
হিকমাহ বা প্রজ্ঞা লাভ করা তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা গভীরভাবে চিন্তা করে কোনো কিছুর পেছনে আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন। এরাই বিরাট কল্যাণ লাভ করেন। আল্লাহ تعالى যখন কোনো কিছুকে বিরাট কল্যাণ বলেন, সেটা কত বড় ব্যাপার হতে পারে, তা আমাদের কল্পনার বাইরে। যেমন, তিনি কুর‘আন-এর মত এত বড় একটা ব্যাপারকেও শুধুই ‘কল্যাণ’ বলেছেন, ‘বিরাট কল্যাণ’ বলেননি। অথচ তিনি প্রজ্ঞাকে বিরাট কল্যাণ বলেছেন। যে এই বিরাট কল্যাণ পাবে, সে সবদিক থেকে সফল হয়ে যাবে। তাই আমাদের কাজ হবে মাথা ভর্তি আবর্জনা পরিষ্কার করে, গভীরভাবে সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা করা, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করা, প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেন ঘটে, কিভাবে ঘটে, এগুলোর পেছনে উদ্দেশ্য কী —এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। আর কুর‘আনের আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। অনুবাদ দ্রুত না পড়ে, ধীরে সুস্থে পড়ে আয়াতগুলোকে নিয়ে চিন্তা করা। যত বেশি চিন্তা করবো, আমাদের চিন্তার গভীরতা তত বেশি বাড়বে। আমরা প্রজ্ঞা পাওয়ার জন্য তত বেশি যোগ্য হবো। আর একবার প্রজ্ঞা পেয়ে গেলেই আমাদের সফল হওয়ার নিশ্চয়তা অনেক বেড়ে যাবে।
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স
No comments