হযরত মূসা ও হারূণ (আঃ)এর জীবনী– ২

পূর্বের অংশ পড়ুনহযরত মূসা হারূণ (:) –

নবুঅত পরবর্তী ১ম পরীক্ষা : জাদুকরদের মুকাবিলা

মূসা (আঃ) ফেরাঊনের মাঝে জাদু প্রতিযোগিতার দিন ধার্য হবার পর মূসা (আঃ) পয়গম্বর সূলভ দয়া প্রকাশে নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেনوَيْلَكُمْ لاَ تَفْتَرُوا عَلَى اللهِ كَذِباً فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَى- (طه ৬১)- ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহলে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। যারাই মিথ্যারোপ করে, তারাই বিফল মনোরথ হয়’ (ত্বোয়াহা ২০/৬১)

কিন্তু এতে কোন ফলোদয় না। ফেরাঊন উঠে গিয়েতার সকল কলা-কৌশল জমা করল, অতঃপর উপস্থিত ’ (ত্বোয়াহা ২০/৬০)অতঃপর তারা তাদের কাজে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করল এবং গোপনে পরামর্শ করলতারা বলল, এই দুজন লোক নিশ্চিতভাবেই জাদুকর। তারা তাদের জাদু দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায় এবং আমাদের উৎকৃষ্ট জীবনধারা রহিত করতে চায়অতএব (হে জাদুকরগণ!) তোমরা তোমাদের যাবতীয় কলা-কৌশল সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধভাবে এসো। আজ যে জয়ী হবে, সেই- সফলকাম হবে’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৩-৬৪)

জাদুকররা ফেরাঊনের নিকট সমবেত হয়ে বলল, জাদুকর ব্যক্তিটি কি দিয়ে কাজ করে? সবাই বলল, সাপ দিয়ে। তারা বলল, আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমাদের উপরে এমন কেউ নেই, যে লাঠি রশিকে সাপ বানিয়ে কাজ করতে পারে (হাদীছুল কুতূননাসাঈ, ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর) অতএবআমাদের জন্য কি বিশেষ কোন পুরস্কার আছে, যদি আমরা বিজয়ী হই’? ‘সে বলল, হ্যাঁ। তখন অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (রাফ /১১৩-১১৪)

জাদুকররা উৎসাহিত হয়ে মূসাকে বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি (তোমার জাদুর লাঠি) নিক্ষেপ কর, না হয় আমরা প্রথমে নিক্ষেপ করি’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৫) মূসা বললেন, ‘তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারাতাদের রশি লাঠি নিক্ষেপ করল’ (শোআরা ২৬/৪৪), তখন লোকদের চোখগুলিকে ধাঁধিয়ে দিল এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল এক মহাজাদু প্রদর্শন করল’ (রাফ /১১৬)তাদের জাদুর প্রভাবে মূসার মনে যেন তাদের রশিগুলো লাঠিগুলো (সাপের ন্যায়) ছুটাছুটি করছেতাতে মূসার মনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার ’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৬-৬৭) এমতাবস্থায় আল্লাহঅহিনাযিল করে মূসাকে অভয় দিয়ে বললেনقُلْنَا لاَ تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَى- وَأَلْقِ مَا فِي يَمِيْنِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ وَلاَ يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَى- (طه 68-69)-  ‘তুমিই বিজয়ী হবে’ ‘তোমার ডান হাতে যা আছে, তা (অর্থাৎ লাঠি) নিক্ষেপ কর। এটা তাদের সবকিছুকে যা তারা করেছে, গ্রাস করে ফেলবে। তাদের ওসব তো জাদুর খেল মাত্র। বস্ত্ততঃ জাদুকর যেখানেই থাকুক সে সফল হবে না’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৮-৬৯)

জাদুকররা তাদের রশি লাঠি সমূহ নিক্ষেপ করার সময় বললوَقَالُوْا بِعِزَّةِ فِرْعَوْنَ إِنَّا لَنَحْنُ الْغَالِبُوْنَ- (الشعراء ৪৪)- ‘ফেরাঊনের মর্যাদার শপথ! আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব’ (শোআরা ২৬/৪৪) তারপর মূসা (আঃ) আল্লাহর নামে লাঠি নিক্ষেপ করলেন। দেখা গেল তা বিরাট অজগর সাপের ন্যায় রূপ ধারণ করল এবং জাদুকরদের সমস্ত অলীক কীর্তিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল’ (শোআরা ২৬/৪৫)

এদৃশ্য দেখে যুগশ্রেষ্ঠ জাদুকরগণ বুঝে নিল যে, মূসার জাদু আসলে জাদু নয়। কেননা জাদুর সর্বোচ্চ বিদ্যা তাদের কাছেই রয়েছে। মূসা তাদের চেয়ে বড় জাদুকর লে এতদিন তার নাম শোনা যেত। তার উস্তাদের খবর জানা যেত। তাছাড়া তার যৌবনকাল অবধি সে আমাদের কাছেই ছিল। কখনোই তাকে জাদু শিখতে বা জাদু খেলা দেখাতে বা জাদুর প্রতি কোনরূপ আকর্ষণও তার মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। তার পরিবারেও কোন জাদুকর নেই। তার বড় ভাই হারূণ তো সর্বদা আমাদের মাঝেই দিনাতিপাত করেছে। কখনোই তাকে এসব করতে দেখা যায়নি বা তার মুখে এখনকার মত বক্তব্য শোনা যায়নি। হঠাৎ করে কেউ বিশ্বসেরা জাদুকর হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে অলৌকিক কোন সত্তার নিদর্শন রয়েছে, যা আয়ত্ত করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। সময় মূসার দেওয়া তাওহীদের দাওয়াত আল্লাহর গযবের ভীতি তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করল। আল্লাহ বলেনَفوَقَعَ الْحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ، فَغُلِبُواْ هُنَالِكَ وَانقَلَبُواْ صَاغِرِينَ- (الأعراف ১১৮-১১৯)- ‘অতঃপর সত্য প্রতিষ্ঠিত এবং বাতিল হয়ে গেল তাদের সমস্ত জাদুকর্মএভাবে তারা সেখানেই পরাজিত এবং লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল’ (রাফ /১১৮-১১৯) অতঃপর فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سَاجِدِينَ، قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ، رَبِّ مُوسَى وَهَارُونَ- (الشعراء ৪৬-৪৮)- ‘তারা সিজদায় পড়ে গেল এবংবলে উঠল, আমরা বিশ্বচরাচরের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যিনি মূসা হারূণের রব’ (শোআরা ২৬/৪৬-৪৮; ত্বোয়াহা ২০/৭০; রাফ /১২০-১২১)

পরাজয়ের দৃশ্য দেখে ভীত-বিহবল ফেরাঊন নিজেকে সামলে নিয়ে উপস্থিত লাখো জনতার মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য জাদুকরদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, –آمَنتُمْ لَهُ قَبْلَ أَنْ آذَنَ لَكُمْ إِنَّهُ لَكَبِيرُكُمُ الَّذِي عَلَّمَكُمُ السِّحْرَ- (طه ৭১)  ‘আমার অনুমতি দানের পূর্বেই তোমরা তাকে মেনে নিলে? নিশ্চয়ই সে (অর্থাৎ মূসা) তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৭১; রাফ /১২৩; শোআরা ২৬/৪৯) অতঃপর সম্রাট সূলভ হুমকি দিয়ে বললفَلَسَوْفَ تَعْلَمُونَ لَأُقَطِّعَنَّ أَيْدِيَكُمْ وَأَرْجُلَكُم مِّنْ خِلاَفٍ وَلَأُصَلِّبَنَّكُمْ أَجْمَعِينَ- (الشعراء ৪৯)- ‘শীঘ্রই তোমরা তোমাদের পরিণাম ফল জানতে পারবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব’ (শোআরা ২৬/৪৯) জবাবে জাদুকররা বললلاَ ضَيْرَ إِنَّا إِلَى رَبِّنَا مُنقَلِبُونَ- إِنَّا نَطْمَعُ أَن يَّغْفِرَ لَنَا رَبُّنَا خَطَايَانَا أَنْ كُنَّا أَوَّلَ الْمُؤْمِنِينَ- (الشعراء ৫০-৫১)- ‘কোন ক্ষতি নেই। আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করব(৫০)আশা করি আমাদের পালনকর্তা আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সমূহ ক্ষমা করবেন’ (শোআরা ২৬/৪৯-৫১; ত্বোয়াহা ২০/৭১-৭৩; রাফ /১২৪-১২৬)

উল্লেখ্য যে, জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার এই দিনটি (يوم الزينة) ছিল ১০ই মুহাররম আশূরার দিন (يوم عاشوراء) (ইবনু কাছীর, ‘হাদীছুল ফুতূন) তবে কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, এটি ছিল তাদের ঈদের দিন। কেউ বলেছেন, বাজারের দিন। কেউ বলেছেন, নববর্ষের দিন (তাফসীরে কুরতুবী, ত্বোয়াহা ৫৯)

ফেরাঊনের ছয়টি কুটচাল :

জাদুকরদের পরাজয়ের পর ফেরাঊন তার রাজনৈতিক কুটচালের মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চাইল। তার চালগুলি ছিল, () সে বলল: এই জাদুকররা সবাই মূসার শিষ্য। তারা চক্রান্ত করেই তার কাছে নতি স্বীকার করেছে। এটা একটা পাতানো খেলা মাত্র। আসলেমূসাই বড় জাদুকর’ (ত্বোয়াহা ২০/৭১) () সে বলল, মূসা তার জাদুর মাধ্যমেনগরীর অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বের করে দিতে চায়’ (রাফ /১১০) এবং মূসা তার সম্প্রদায় এদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। () সে বলল মূসা যেসব কথা বলছেআমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সেসব কথা কখনো শুনিনি’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৬) () সে বলল, হে জনগণ! লোকটি তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৬) () সে বলল, মূসা তোমাদের উৎকৃষ্ট (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক) জীবন ব্যবস্থা রহিত করতে চায়’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৩) () সে মিসরীয় জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিয়েছিল (ক্বাছাছ ২৮/) এবং একটির দ্বারা অপরটিকে দুর্বল করার মাধ্যমে নিজের শাসন শোষণ অব্যাহত রেখেছিল। আজকের বহুদলীয় গণতন্ত্র বা দলতন্ত্র ফেলে আসা ফেরাঊনী তন্ত্রের আধুনিক রূপ বলেই মনে হয়। নিজেই সবকিছু করলেও লোকদের খুশী করার জন্য ফেরাঊন বললفَمَاذَا تَأْمُرُونَ ‘অতএব হে জনগণ! তোমরা এখন কি বলতে চাও’? (শোআরা ২৬/৩৫; রাফ /১১০) এযুগের নেতারা যেমন নিজেদের সকল অপকর্ম জনগণের দোহাই দিয়ে করে থাকেন

ফেরাঊনী কুটনীতির বিজয় জনগণের সমর্থন লাভ :

অধিকাংশের রায় যে সবসময় সঠিক হয় না বরং তা আল্লাহর পথ তে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, তার বড় প্রমাণ ফেরাঊনী কুটনীতির বিজয় মূসার আপাত পরাজয়। ফেরাঊনের ভাষণে উত্তেজিত জনগণের পক্ষে নেতারা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, হে সম্রাটأَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ- (الأعراف ১২৭)- ‘আপনি কি মূসা তার সম্প্রদায়কে এমনিই ছেড়ে দেবেন দেশময় ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য এবং আপনাকে আপনার উপাস্যদেরকে বাতিল করে দেবার জন্য’ (রাফ /১২৭)

জাদুকরদের সত্য গ্রহণ :

ধূর্ত কুটবুদ্ধি ফেরাঊন বুঝলো যে, তার ঔষধ কাজে লেগেছে। এখুনি মোক্ষম সময়। সে সাথে সাথে জাদুকরদের হাত-পা বিপরীতভাবে কেটে অতঃপর খেজুর গাছের সাথে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিল। সে ভেবেছিল, এতে জাদুকররা ভীত হয়ে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে। কিন্তু ফল উল্টা ল। তারা একবাক্যে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিল,

لَن نُّؤْثِرَكَ عَلَى مَا جَاءنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا فَاقْضِ مَا أَنتَ قَاضٍ إِنَّمَا تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- إِنَّا آمَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا وَمَا أَكْرَهْتَنَا عَلَيْهِ مِنَ السِّحْرِ وَاللهُ خَيْرٌ وَأَبْقَى- (طه ৭২-৭৩)-

আমরা তোমাকে ঐসব সুস্পষ্ট নিদর্শন ( মুজেযার) উপরে প্রাধান্য দিতে পারি না, যেগুলো (মূসার মাধ্যমে) আমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং প্রধান্য দিতে পারি না তোমাকে সেই সত্তার উপরে যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনেই যা করার করবে(৭২)আমরা আমাদের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যাতে তিনি আমাদের পাপসমূহ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ, (তার পাপসমূহ) তা মার্জনা করেন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ চিরস্থায়ী’ (ত্বোয়াহা ২০/৭২-৭৩)

তারা আরও বলল,

قَالُوْا إِنَّا إِلَى رَبِّنَا مُنقَلِبُونَ- وَمَا تَنقِمُ مِنَّا إِلاَّ أَنْ آمَنَّا بِآيَاتِ رَبِّنَا لَمَّا جَاءتْنَا ، رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْراً وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ-َ- (الأعراف ১২৫-১২৬)-  

আমরা (তো মৃত্যুর পরে) আমাদের পরওয়ারদিগারের নিকটে ফিরে যাববস্ত্ততঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো কেবল একারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সমূহের প্রতি, যখন তা আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। অতএব رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ধৈর্যের দুয়ার খুলে দাও এবং আমাদেরকেমুসলিমহিসাবে মৃত্যু দান কর’ (রাফ /১২৫-১২৬)

এটা ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, ইতিপূর্বে ফেরাঊনের দরবারে মূসার লাঠির মুজেযা প্রদর্শনের ঘটনা থেকেই জাদুকরদের মনে প্রতীতি জন্মেছিল যে, এটা কোন জাদু নয়, এটা মুজেযা। কিন্তু ফেরাঊন তার পারিষদবর্গের ভয়ে তারা মুখ খুলেনি। অবশেষে তাদেরকে সমবেত করার পর তাদেরকে সম্রাটের নৈকট্যশীল করার বিরাট পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়। এগুলো নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক আর্থিক প্রলোভনের চাপ ভিন্ন কিছুই ছিল না

জাদুকরদের মুসলমান হয়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিল মুকাবিলার পূর্বে ফেরাঊন তার জাদুকরদের উদ্দেশ্যে মূসার প্রদত্ত উপদেশমূলক ভাষণ। যেখানে তিনি বলেছিলেন,

وَيْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوا عَلَى اللهِ كَذِباً فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَ- (طه ৬১)-  

দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহলে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। বস্ত্ততঃ তারাই বিফল মনোরথ হয়, যারা মিথ্যারোপ করে’ (ত্বোয়াহা ২০/৬১)

মূসার মুখে একথা শুনে ফেরাঊন তার সভাসদরা অহংকারে স্ফীত লেও জাদুকর সাধারণ জনগণের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে জাদুকরদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে যায় এবং তারা আপোষে বিতর্কে লিপ্ত হয়। যদিও গোপন আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভবতঃ রাজকীয় সম্মান বিরাট অংকের পুরস্কারের লোভে পরিশেষে তারা একমত হয়

জাদুরকদের পরিণতি :

জাদুকরদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল কি-না, সে বিষয়ে কুরআনে স্পষ্টভাবে কিছু বলা না লেও ত্বোয়াহা ৭২ তে ৭৬ পর্যন্ত বর্ণিত আয়াত সমূহের বাকভঙ্গিতে বুঝা যায় যে, তা তৎক্ষণাৎ কার্যকর হয়েছিল। কেননা নিষ্ঠুরতার প্রতীক ফেরাঊনের দর্পিত ঘোষণার জবাবে দৃঢ়চিত্ত ঈমানদার জাদুকরদের মুখ দিয়ে যে কথাগুলো বের হয়েছিল, তা সকল ভয় দ্বিধা-সংকোচের ঊর্ধ্বে উঠে কেবলমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির মুখেই শোভা পায়। সেকারণ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, উবায়েদ ইবনু উমায়ের অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন أَصْبَحُوْا سَحَرَةً وَأَمْسَوْا شُهَدَاءَ ‘যারা সকালে জাদুকর ছিল, তারা সন্ধ্যায় শহীদ হয়ে মৃত্যুবরণ করল[25] মূলতঃ এটাই প্রকৃত মারেফাত, যা যেকোন ভয়-ভীতির মুকাবিলায় মুমিনকে দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় অবিচল রাখে আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায়। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বেহামদিহী

জনগণের প্রতিক্রিয়া :

আল্লাহ বলেন,

 فَمَا آمَنَ لِمُوسَى إِلاَّ ذُرِّيَّةٌ مِّنْ قَوْمِهِ عَلَى خَوْفٍ مِّنْ فِرْعَوْنَ وَمَلَئِهِمْ أَن يَّفْتِنَهُمْ وَإِنَّ فِرْعَوْنَ لَعَالٍ فِي الأَرْضِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الْمُسْرِفِينَ-(يونس ৮৩)-    

ফেরাঊন তার পারিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে তার সম্প্রদায়ের কিছু লোক ব্যতীত কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি। আর ফেরাঊন তার দেশে ছিল পরাক্রান্ত এবং সে ছিল সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউনুস ১০/৮৩) এতে বুঝা যায় যে, ক্বিবতীদের মধ্যে গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা বেশী থাকলেও প্রকাশ্যে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল

উল্লেখ্য যে, অত্র আয়াতেতার কওমের কিছু লোক ব্যতীত’  (إِلاَّ ذُرِّيَّةَّ مِّنْ قّوْمِهِ) বলতে ইবনু আববাস (রাঃ) ‘ফেরাঊনের কওমের কিছু লোকবলেছেন। কিন্তু ইবনু জারীর অনেক বিদ্বান মূসার নিজ কওমবনু ইস্রাঈলের কিছু লোকবলেছেন। এর জবাবে হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, এটা প্রসিদ্ধ কথা যে, বনু ইস্রাঈলের সকলেই মূসাকে নবী হিসাবে বিশ্বাস করত একমাত্র ক্বারূণ ব্যতীত। কেননা সে ছিল বিদ্রোহী এবং ফেরাঊনের সাথী। আর মূসার কারণেই বনু ইস্রাঈলগণ মূসার জন্মের আগে পরে সমানভাবে নির্যাতিত ছিল (রাফ /১২৯) অতএব অত্র আয়াতে যে মুষ্টিমেয় লোকের ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবেই ছিলেন ক্বিবতী সম্প্রদায়ের। আর তারা ছিলেন, ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া, ফেরাঊনের চাচাতো ভাই জনৈক মুমিন ব্যক্তি যিনি তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন এবং ফেরাঊনের খাজাঞ্চি তার স্ত্রী। যেকথা ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন[26]

ফেরাঊনের স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া :

জাদুকরদের সঙ্গে মুকাবিলা তথা সত্য মিথ্যার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ফেরাঊনের নেককার স্ত্রী মূসার পালক মাতা (أمه البديلة) ‘আসিয়াউক্ত মুকাবিলার শুভ ফলাফলের জন্য সদা উদগ্রীব ছিলেন। যখন তাঁকে মূসা হারূণের বিজয়ের সংবাদ শোনানো , তখন তিনি কালবিলম্ব না করে বলে ওঠেনآمَنْتُ بِرَبِّ مُوْسَى وَ هَارُوْنَ ‘আমি মূসা হারূণের পালনকর্তার উপরে ঈমান আনলাম নিজ স্ত্রীর ঈমানের খবর শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফেরাঊন তাকে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে[27] মৃত্যুর পূর্বে বিবি আসিয়া কাতর কণ্ঠে স্বীয় প্রভুর নিকটে প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَضَرَبَ اللهُ مَثَلاً لِلَّذِينَ آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتاً فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ-

আল্লাহ ঈমানদারগণের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ফেরাঊনের স্ত্রীর, যখন সে বলেছিল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তোমার নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর! আমাকে ফেরাঊন তার পারিষদবর্গের হাত থেকে উদ্ধার কর এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (তাহরীম ৬৬/১১)

কুরআনে বর্ণিত চারজন নারীর দৃষ্টান্ত :

পবিত্র কুরআনের সূরা তাহরীমের ১০-১২ আয়াতে আল্লাহ পাক চারজন নারীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে তা থেকে সকলকে উপদেশ হাছিল করতে বলেছেন। প্রথম দুজন দুনবীর পত্নী। একজন নূহ (আঃ)-এর স্ত্রী, অন্যজন লূত্ব (আঃ)-এর স্ত্রী। দুজন নারী তাওহীদ বিষয়ে আপন আপন স্বামীর তথা স্ব স্ব নবীর দাওয়াতে বিশ্বাস আনয়ন করেননি। বরং বাপ-দাদার আমলের শিরকী আক্বীদা রীতি-নীতির উপরে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হয়েছেন। পয়গম্বরগণের সাথে বৈবাহিক সাহচর্য তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারেনি

বাকী দুজন নারীর একজন বিশ্বসেরা নাস্তিক দাম্ভিক সম্রাট ফেরাঊনের পুণ্যশীলা স্ত্রীআসিয়াবিনতে মুযাহিম। তিনি মূসা (আঃ)-এর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে স্বীয় ঈমান ঘোষণা করেন। ফেরাঊনের ঘোষিত মৃত্যুদন্ড তিনি হাসিমুখে বরণ করে নেন। কোন কোন রেওয়ায়াত অনুসারে আল্লাহ পাক দুনিয়াতেই তাঁকে জান্নাতের গৃহ প্রদর্শন করেছেন[28] চতুর্থ জন লেন হযরত ঈসা (আঃ)-এর মাতা মারিয়াম বিনতে ইমরান। স্বীয় ঈমান সৎকর্মের বদৌলতে তিনি আল্লাহর নিকটে মহান মর্যাদার অধিকারিণী হন। থেকে বুঝানো হয়েছে যে, পুরুষ হৌক বা নারী হৌক প্রত্যেকে স্ব স্ব ঈমান আমলের কারণে জান্নাতের অধিকারী হবে, অন্য কোন কারণে নয়

মূসা (আঃ)-এর উপরে ঈমান আনয়নকারিনী আসিয়াকে শেষনবী (ছাঃ) জগৎ শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার মধ্যে শামিল করেছেন। উক্ত চারজন লেন ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম, মারিয়াম বিনতে ইমরান, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ[29]

নবুঅত-পরবর্তী ২য় পরীক্ষা : বনু ইস্রাঈলদের উপরে আপতিত ফেরাঊনী যুলুম সমূহ :

জাদুর পরীক্ষায় পরাজিত ফেরাঊনের যাবতীয় আক্রোশ গিয়ে পড়ল এবার নিরীহ বনু ইস্রাঈলগণের উপর। জাদুকরদের ঈমান আনয়ন, অতঃপর তাদের মৃত্যুদন্ড প্রদান, বিবি আসিয়ার ঈমান আনয়ন তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান ইত্যাদি নিষ্ঠুর দমন নীতির মাধ্যমে এবং অত্যন্ত নোংরা কুটচাল মিথ্যা অপবাদ সমূহের মাধ্যমে মূসার ঈমানী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল ফেরাঊন। কিন্তু এর ফলে জনগণের মধ্যে মূসার দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে ফেরাঊন তার অহংকারী পারিষদবর্গ নতুনভাবে দমন নীতির কৌশলপত্র প্রণয়ন করল। তারা নিজেরা বিধর্মী লেও সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করল। অন্যদিকেবিভক্ত কর শাসন কর’-এই কুটনীতির অনুসরণে ফেরাঊনের ক্বিবতী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কেবল বনু ইস্রাঈলদের উপরে চূড়ান্ত যুলুম নির্যাতনের পরিকল্পনা করল

১ম যুলুমঃ বনু ইস্রাঈলের নবজাতক পুত্রসন্তানদের হত্যার নির্দেশ জারি :

ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের নেতারা ইতিপূর্বে ফেরাঊনকে বলেছিলأَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ ‘আপনি কি মূসা তার সম্প্রদায়কে এমনি ছেড়ে দিবেন দেশময় ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য এবং আপনাকে আপনার উপাস্যদেরকে বাতিল করে দেবার জন্য(রাফ /১২৭) নেতারা মূসা হারূণের ঈমানী দাওয়াতকেফাসাদবলে অভিহিত করেছিল। এক্ষণে দেশময় মূসার দাওয়াতের ব্যাপক প্রসার বন্ধ করার জন্য এবং ফেরাঊনের নিজ সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকদের ব্যাপকহারে মূসার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্রোত বন্ধ করার জন্য নিজেদের লোকদের কিছু না বলে নিরীহ বনু ইস্রাঈলদের উপরে অত্যাচার শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ফেরাঊন বললسَنُقَتِّلُ أَبْنَاءَهُمْ وَنَسْتَحْيِـي نِسَاءَهُمْ وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ- (الأعراف ১২৭)- ‘আমি এখুনি টুকরা টুকরা করে হত্যা করব ওদের পুত্র সন্তানদেরকে এবং বাঁচিয়ে রাখব ওদের কন্যা সন্তানদেরকে। আর আমরা তো ওদের উপরে (সবদিক দিয়েই) প্রবল’ (রাফ /১২৭) এভাবে মূসার জন্মকালে বনু ইস্রাঈলের সকল নবজাতক পুত্র হত্যা করার সেই ফেলে আসা লোমহর্ষক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তির ঘোষণা প্রদান করা

দল ঠিক রাখার জন্য এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের রোষাগ্নি প্রশমনের জন্য ফেরাঊন অনুরূপ ঘোষণা দিলেও মূসা হারূণ সম্পর্কে তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয়নি। যদিও ইতিপূর্বে সে মূসাকে কারারুদ্ধ করার এমনকি হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল (শোআরা ২৬/২৯; মুমিন ৪০/২৬) কিন্তু জাদুকরদের পরাজয়ের পর এবং নিজে মূসার সর্পরূপী লাঠির মুজেযা দেখে ভীত বিহবল হয়ে পড়ার পর থেকে মূসার দিকে তাকানোর মত সাহসও তার ছিল না

যাই হোক ফেরাঊনের উক্ত নিষ্ঠুর ঘোষণা জারি হওয়ার পর বনু ইস্রাঈলগণ মূসার নিকটে এসে অনুযোগের সুরে বললأُوْذِينَا مِنْ قَبْلِ أَن تَأْتِينَا وَمِنْ بَعْدِ مَا جِئْتَنَا ‘তোমার আগমনের পূর্বেও আমাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে। আবার এখন তোমার আগমনের পরেও তাই করা হচ্ছে’ (রাফ /১২৯) অর্থাৎ তোমার আগমনের পূর্বে তো আশায় আমাদের দিন কাটত যে, সত্বর আমাদের উদ্ধারের জন্য একজন নবীর আগমন ঘটবে। অথচ এখন তোমার আগমনের পরেও সেই একই নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাহলে এখন আমাদের উপায় কি?

আসন্ন বিপদের আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমের লোকদের সান্ত্বনা দিয়ে মূসা (আঃ) বললেনعَسَى رَبُّكُمْ أَن يُّهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ ‘তোমাদের পালনকর্তা শীঘ্রই তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দেশে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর’ (রাফ /১২৯) তিনি বললেনاسْتَعِينُوا بِاللهِ وَاصْبِرُوْا إِنَّ الأَرْضَ ِللهِ يُوْرِثُهَا مَنْ يَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকটে এবং ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই পৃথিবী আল্লাহর। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। বস্ত্ততঃ চূড়ান্ত পরিণাম ফল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত’ (রাফ /১২৮)

মূসা (আঃ) তাদেরকে আরও বলেন,

يَا قَوْمِ إِنْ كُنتُمْ آمَنتُمْ بِاللهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوْا إِنْ كُنتُم مُّسْلِمِينَ- فَقَالُواْ عَلَى اللهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا لاَ تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِّلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ- وَنَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ- (يونس ৮৪-৮৬)-  

হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহর উপরে ঈমান এনে থাক, তবে তাঁরই উপরে ভরসা কর যদি তোমরা আনুগত্যশীল হয়ে থাক জবাবে তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপরে যালেম কওমের শক্তি পরীক্ষা করো নাআর আমাদেরকে অনুগ্রহ করে কাফের সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (ইউনুস ১০/৮৪-৮৬)

উপরোক্ত আয়াত সমূহে বুঝা যায় যে, পয়গম্বর সূলভ দরদ দূরদর্শিতার আলোকে মূসা (আঃ) স্বীয় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমকে মূলতঃ দুটি বিষয়ে উপদেশ দেন। এক- শত্রুর মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা এবং দুই- আল্লাহর সাহায্য না আসা পর্যন্ত সাহসের সাথে ধৈর্য ধারণ করা। সাথে সাথে একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, সমগ্র পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর। তিনি যাকে খুশী এর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন এবং নিঃসন্দেহে শেষফল মুত্তাক্বীদের জন্যই নির্ধারিত

২য় যুলুমঃ ইবাদতগৃহ সমূহ ধ্বংস করা :

পুত্র শিশু হত্যাকান্ডের ব্যাপক যুলুমের সাথে সাথে ফেরাঊন বনু ইস্রাঈলদের ইবাদতগৃহ সমূহ ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়। বনু ইস্রাঈলদের ধর্মীয় বিধান ছিল এই যে, তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে উপাসনালয়ে গিয়ে উপাসনা করতে ত। এক্ষণে সেগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ায় বনু ইস্রাঈলগণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। সময় মূসা হারূণের প্রতি আল্লাহ পাক নিম্নোক্ত নির্দেশ পাঠান-

وَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى وَأَخِيهِ أَنْ تَبَوَّءَا لِقَوْمِكُمَا بِمِصْرَ بُيُوتاً وَاجْعَلُوْا بُيُوتَكُمْ قِبْلَةً وَأَقِيمُوا الصَّلاَةَ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ-(يونس ৮৭)-

আর আমরা নির্দেশ পাঠালাম মূসা তার ভাইয়ের প্রতি যে, তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য মিসরের মাটিতে বাসস্থান নির্ধারণ কর এবং তোমাদের ঘরগুলিকে কিবলামুখী করে তৈরী কর সেখানে ছালাত কায়েম কর এবং মুমিনদের সুসংবাদ দাও(ইউনুস ১০/৮৭)

বলা বাহুল্য যে, উপরোক্ত বিধান নাযিলের ফলে বনু ইস্রাঈলগণ স্ব স্ব ঘরেই ছালাত আদায়ের সুযোগ লাভ করে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তাদেরকে যে ক্বিবলার দিকে ফিরে ছালাত আদায় করতে নির্দেশ দেন, সেটা ছিল কাবা শরীফ’ (কুরতুবী, রূহুল মাআনী) বরং কোন কোন বিদ্বান বলেছেন যে, বিগত সকল নবীর ক্বিবলা ছিল কাবা গৃহ। লক্ষণীয় যে, মূসার অতুলনীয় নবুঅতী মোজেযা থাকা সত্ত্বেও এবং তাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে আল্লাহর স্পষ্ট ওয়াদা থাকা সত্ত্বেও ফেরাঊনী যুলুমের বিরুদ্ধে আল্লাহ মূসাকে যুদ্ধ ঘোষণার নির্দেশ দেননি। বরং যুলুম বরদাশত করার ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দেন। ইবাদতগৃহ সমূহ ভেঙ্গে দিয়েছে বলে তা রক্ষার জন্য জীবন দিতে বলা হয়নি। (টীকা: অতএব উপাসনালয় ধ্বংস করা ফেরাঊনী কাজ) বরং স্ব স্ব গৃহকে কেবলামুখী বানিয়ে সেখানেই ছালাত আদায় করতে বলা হয়েছে। এর দ্বারা একটা মূলনীতি বেরিয়ে আসে যে, পরাক্রান্ত যালেমের বিরুদ্ধে দুর্বল মযলূমের কর্তব্য ধৈর্য ধারণ করা আল্লাহর উপরেই সবকিছু সোপর্দ করা

ফেরাঊনের বিরুদ্ধে মূসার বদ দো :

وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ آتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلأَهُ زِينَةً وَأَمْوَالاً فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّوْا عَنْ سَبِيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلاَ يُؤْمِنُوْا حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الأَلِيمَ- قَالَ قَدْ أُجِيبَتْ دَّعْوَتُكُمَا فَاسْتَقِيمَا وَلاَ تَتَّبِعَآنِّ سَبِيلَ الَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ- (يونس ৮৮-৮৯)-

মূসা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি ফেরাঊনকে তার সর্দারদেরকে পার্থিব আড়ম্বর সমূহ সম্পদরাজি দান করেছ, যা দিয়ে তারা লোকদেরকে তোমার রাস্তা থেকে বিপথগামী করে। অতএব হে আমাদের প্রভু! তুমি তাদের সম্পদরাজি ধ্বংস করে দাও তাদের অন্তরগুলিকে শক্ত করে দাও, যাতে তারা অতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান না আনে, যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে(৮৮) জবাবে আল্লাহ বললেন, তোমাদের দো কবুল হয়েছে। অতএব তোমরা দুজন অটল থাক এবং অবশ্যই তোমরা তাদের পথে চলো না, যারা জানে না’ (ইউনুস ১০/৮৮-৮৯)

মূসা হারূণের উপরোক্ত দো আল্লাহ কবুল করলেন। কিন্তু তার      বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে করলেন না। বরং সময় নিলেন অন্যূন বিশ বছর। এরূপ প্রলম্বিত কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহ মাযলূমের ধৈর্য পরীক্ষার সাথে সাথে যালেমেরও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন এবং তাদের তওবা করার হেদায়াত প্রাপ্তির সুযোগ দেন। যাতে পরে তাদের জন্য ওযর পেশ করার কোন সুযোগ না থাকে। যেমন আল্লাহ বলেনوَلَوْ يَشَاءُ اللهُ لاَنتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান’ (মুহাম্মাদ ৪৭/)

প্রশ্ন তে পারে, এত যুলুম সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের হিজরত করার নির্দেশ না দিয়ে সেখানেই পুনরায় ঘর বানিয়ে বসবাসের নির্দেশ দিলেন কেন? এর জবাব দুভাবে দেওয়া যেতে পারে

এক- ফেরাঊন তাদেরকে হিজরতে বাধা দিত। কারণ বনু ইস্রাঈলগণকে তারা তাদের জাতীয় উন্নয়নের সহযোগী হিসাবে এবং কর্মচারী সেবাদাস হিসাবে ব্যবহার করত। তাছাড়া পালিয়ে আসারও কোন পথ ছিল না। কেননা নীলনদ ছিল বড় বাধা। নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলে ফেরাঊনী সেনারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করত

দুই- ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের মধ্যে মূসা হারূণের দাওয়াত সম্প্রসারণ করা। মূলতঃ এটিই ছিল আল্লাহর মূল উদ্দেশ্য। কেননা যতদিন তারা মিসরে ছিলেন, সেখানকার অধিবাসীদের নিকটে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছেন এবং তার ফলে বহু আল্লাহর বান্দা পথের সন্ধান পেয়ে ধন্য হয়েছেন। ফেরাঊন দেখেছিল তার দুনিয়াবী লাভ শান-শওকত। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছিলেন তাওহীদের প্রচার প্রসার মানুষের হেদায়াত। সেটিই হয়েছে। ফেরাঊনেরা এখন মিসরের পিরামিডের দর্শনীয় বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। অথচ মিসর সহ বলা চলে পুরা আফ্রিকায় এখন ইসলামের জয়-জয়কার অব্যাহত রয়েছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ

ফেরাঊনী আচরণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

() দুষ্টু শাসকগণ তার পদে অন্য কাউকে ভাবতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘ফেরাঊন পৃথিবীতে উদ্ধত হয়ে উঠেছিল’ (ইউনুস ১০/৮৩) সে দাবী করেছিল, ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা’ (নাযেআত ৭৯/২৪) অতএবআমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে আমি জানি না’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৮) যেহেতু সে তৎকালীন পৃথিবীর এক সভ্যতাগর্বী সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র সম্রাট ছিল, সেহেতু তার দাবী মিথ্যা ছিল না। এর দ্বারা সে নিজেকেসৃষ্টিকর্তাদাবী করত না বটে, কিন্তু নিজস্ব বিধানে প্রজাপালনের কারণে নিজেকেই সর্বোচ্চ পালনকর্তা ভেবেছিল। তার অহংকার তার চক্ষুকে নবী মূসার অহীর বিধান মান্য করা থেকে অন্ধ করে দিয়েছিল। যুগে যুগে আবির্ভূত স্বেচ্ছাচারী শাসকদের অবস্থা থেকে মোটেই পৃথক ছিল না। আজও নয়। প্রত্যেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ শাসক মনে করে এবং পদে কাউকে শরীক ভাবতে পারে না

() তারা তাদের বিরোধীদেরকে ধর্ম বিরোধী সমাজ বিরোধী বলে। ফেরাঊন বলেছিল, তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও। সে ডাকুক তার পালনকর্তাকে। আমি আশংকা করছি যে, সে তোমাদের দ্বীন এবং প্রচলিত উৎকৃষ্ট রীতিনীতি পরিবর্তন করতে চায় এবং দেশে ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় (মুমিন ৪০/২৬, ত্বোয়াহা ২০/৬৩) সকল যুগের ফেরাঊনরা তাদের বিরুদ্ধ বাদীদের উক্ত কথাই বলে থাকে

() তারা সর্বদা নিজেদেরকে জনগণের মঙ্গলকামী বলে। নিজ সম্প্রদায়ের জনৈক গোপন ঈমানদার ব্যক্তি যখন মূসাকে হত্যা না করার ব্যাপারে ফেরাঊনকে উপদেশ দিল, তখন তার জবাবে ফেরাঊন বলল, ‘আমি তোমাদেরকে কেবল মঙ্গলের পথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন ৪০/২৯) সকল যুগের ফেরাঊনরাও একই কথা বলে আল্লাহর বিধানকে এড়িয়ে চলে এবং নিজেদের মনগড়া বিধান প্রতিষ্ঠায় জনগণের নামে জনগণের উপরে যুলুমের স্টীম রোলার চালিয়ে থাকে

() তাদের দেওয়া জেল-যুলুম হত্যার হুমকির বিপরীতে ঈমানদারগণ সর্বদা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেন পরিণামে মযলূম বিজয়ী হয় যালেম পর্যুদস্ত হয়। যেমন কারাদন্ড হত্যার হুমকি ফেরাঊনী যুলুমের উত্তরে মূসার বক্তব্য ছিলوَقَالَ مُوسَى إِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّنْ كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لاَّ يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ ‘আমি আমার তোমাদের পালনকর্তার আশ্রয় প্রার্থনা করছি সকল অহংকারী থেকে যে বিচার দিবসে বিশ্বাস করে না’ (মুমিন ৪০/২৭) ফলেআল্লাহ তাকে তাদের চক্রান্তের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করলেন এবং পরে ফেরাঊন গোত্রকে শোচনীয় আযাব গ্রাস করল’ (মুমিন ৪০/৪৫) এযুগেও মযলূমের কাতর প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করে থাকেন যালেমকে বিভিন্নভাবে শাস্তি দিয়ে থাকেন

ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে আপতিত গযব সমূহ এবং মূসা (আঃ)-এর মুজেযা সমূহ :

ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে শক্তি পরীক্ষার ঘটনার পর মূসা (আঃ) অন্যূন বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে আল্লাহর বাণী শোনান এবং সত্য সরল পথের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। সময়কালের মধ্যে আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে প্রধান ৯টি মুজেযা দান করেন। তবে প্লেগ মহামারী সহ (রাফ /১৩৪) মোট নিদর্শনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। যার মধ্যে প্রথম দুটি শ্রেষ্ঠ মুজেযা ছিল অলৌকিক লাঠি আলোকময় হস্ততালু। যার পরীক্ষা শুরুতেই ফেরাঊনের দরবারে এবং পরে জাদুকরদের সম্মুখে হয়ে গিয়েছিল। এরপর বাকীগুলি এসেছিল ফেরাঊনী কওমের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে তাদেরকে সাবধান করার জন্য। মূলতঃ দুনিয়াতে প্রেরিত সকল এলাহী গযবের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষের হেদায়াত। যেমন আল্লাহ বলেনوَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ- (السجدة ২১)- ‘কাফির ফাসিকদেরকে (জাহান্নামের) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) আমরা অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা (আমার দিকে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ ৩২/২১)

মযলূম বনু ইস্রাঈলদের কাতর প্রার্থনা এবং মূসা হারূণের দো আল্লাহ কবুল করেছিলেন। সেমতে সর্বপ্রথম অহংকারী ফেরাঊনী কওমের দুনিয়াবী জৌলুস সম্পদরাজি ধ্বংসের গযব নেমে আসে। তারপর আসে অন্যান্য গযব বা নিদর্শন সমূহ। আমরা সেগুলি একে একে বর্ণনা করার প্রয়াস পাব। যাতে এযুগের মানুষ তা থেকে উপদেশ হাছিল করে

মোট নিদর্শন সমূহ, যা মিসরে প্রদর্শিত হয়-

() লাঠি () প্রদীপ্ত হস্ততালু () দুর্ভিক্ষ () তূফান () পঙ্গপাল () উকুন () ব্যাঙ () রক্ত () প্লেগ (১০) সাগরডুবি। প্রথম দুটি এবং মূসার ব্যক্তিগত তোতলামি দূর হওয়াটা বাদ দিয়ে বাকী ৮টি নিদর্শন নিম্নে বর্ণিত -

১ম নিদর্শন : দুর্ভিক্ষ

মূসা (আঃ)-এর দো কবুল হওয়ার পর ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে প্রথম নিদর্শন হিসাবে দুর্ভিক্ষের গযব নেমে আসে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ أَخَذْنَا آلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِيْنَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ- (أعراف ১৩০)- ‘তারপর আমরা পাকড়াও করলাম ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে তারা উপদেশ হাছিল করে’ (রাফ /১৩০)

নিরীহ বনু ইস্রাঈলগণের উপরে দুর্ধর্ষ ফেরাঊনী যুলুম প্রতিরোধে এটা ছিল মযলূমদের সমর্থনে আল্লাহ প্রেরিত প্রথম হুঁশিয়ারী সংকেত। এর ফলে তাদের ক্ষেতের ফসল বাগ-বাগিচার উৎপাদন চরমভাবে হরাস পেয়েছিল। খাদ্যাভাবে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে যায়। ফলে কোন উপায়ান্তর না দেখে ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের নেতারা মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। দয়ার্দ্রচিত্ত মূসা (আঃ) অবশেষে দো করলেন। ফলে দুর্ভিক্ষ রহিত হয়ে গেল এবং তাদের বাগ-বাগিচা মাঠ-ময়দান পুনরায় ফল-ফসলে ভরে উঠলো। কিন্তু ফেরাঊনী সম্প্রদায় এতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে বরং অহংকারে স্ফীত হয়ে খোদ মূসাকেই দায়ী করে তাঁকেঅলক্ষুণে-অপয়া বলে গালি দেয় এবং উদ্ধতভাবে বলে ওঠে যেوَقَالُوْا مَهْمَا تَأْتِنَا بِهِ مِنْ آيَةٍ لِّتَسْحَرَنَا بِهَا فَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِيْنَ- (الأعراف ১৩২)- ‘আমাদের উপরে জাদু করার জন্য তুমি যে নিদর্শনই নিয়ে আস না কেন, আমরা তোমার উপরে কোন মতেই ঈমান আনব না’ (রাফ /১৩২) আল্লাহ বলেন,

فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الطُّوْفَانَ وَالْجَرَادَ وَالْقُمَّلَ وَالضَّفَادِعَ وَالدَّمَ آيَاتٍ مُّفَصَّلاَتٍ فَاسْتَكْبَرُوْا وَكَانُوْا قَوْماً مُّجْرِمِيْنَ- (الأعراف ১৩৩)-

অতঃপর আমরা তাদের উপরে পাঠিয়ে দিলাম তূফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পরে এক। তারপরেও তারা অহংকার করতে থাকল। বস্ত্ততঃ তারা ছিল পাপী সম্প্রদায়’ (রাফ /১৩৩) অত্র আয়াতে দুর্ভিক্ষের পরে পরপর পাঁচটি গযব নাযিলের কথা বলা হয়েছে। তারপর আসে প্লেগ মহামারী অন্যান্য ছোট-বড় আযাব’ (রাফ /১৩৪) এরপরে সর্বশেষ গযব সাগরডুবি’ (ইউনুস ১০/৯০) যার মাধ্যমে এই গর্বিত অহংকারীদের একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর তাফসীর অনুযায়ী آيَاتٌ مُفَصَّلاَتٌ বাএকের পর এক আগত নিদর্শনসমূহঅর্থ , এগুলোর প্রত্যেকটি আযাবই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত থেকে রহিত হয়ে যায় এবং কিছু দিন বিরতির পর অন্যান্য আযাবগুলি আসে ফেরাঊন সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী চরিত্র ফুটে ওঠে নিম্নোক্ত বর্ণনায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَلَمَّا وَقَعَ عَلَيْهِمُ الرِّجْزُ قَالُواْ يَا مُوسَى ادْعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَ لَئِنْ كَشَفْتَ عَنَّا الرِّجْزَ لَنُؤْمِنَنَّ لَكَ وَلَنُرْسِلَنَّ مَعَكَ بَنِي إِسْرَائِيلَ- فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُمُ الرِّجْزَ إِلَى أَجَلٍ هُم بَالِغُوهُ إِذَا هُمْ يَنكُثُونَ-  (الأعراف ১৩৪-১৩৫ )

আর যখন তাদের উপর কোন আযাব পতিত , তখন তারা বলত, হে মূসা! তুমি আমাদের জন্য তোমার প্রভুর নিকট দো কর, যা (কবুলের) ওয়াদা তিনি তোমাকে দিয়েছেন। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে আযাব দূর করে দাও, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমার উপর ঈমান আনব এবং তোমার সাথে বনু ইস্রাঈলদের অবশ্যই পাঠিয়ে দেবঅতঃপর যখন আমরা তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নিতাম নির্দিষ্ট একটা সময়ে, যে পর্যন্ত তাদের পৌঁছানো উদ্দেশ্য , তখন তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত’ (রাফ /১৩৪-৩৫) এই নির্ধারিত সময়ের মেয়াদ কত ছিল, সে বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে, যার প্রায় সবই ধারণা প্রসূত। অতএব আমরা তা থেকে বিরত রইলাম

ব্যাপারে কুরআনে একটি মৌলিক বক্তব্য এসেছে এভাবে যে,

فَإِذَا جَاءتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوْا لَنَا هَـذِهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوْا بِمُوْسَى وَمَن مَّعَهُ أَلاَ إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِندَ اللهِ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ- (الأعراف ১৩১)-

যখন তাদের শুভদিন ফিরে আসত, তখন তারা বলত যে, এটাই আমাদের জন্য উপযুক্ত। পক্ষান্তরে অকল্যাণ উপস্থিত লে তারা মূসা তার সাথীদেরঅলক্ষুণেবলে অভিহিত করত। জেনে রাখ যে, তাদের অলক্ষুণে চরিত্র আল্লাহর ইলমে রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা জানে না’ (রাফ /১৩১) এতে বুঝা যায় যে, একটা গযব শেষ হওয়ার পর শুভদিন আসতে এবং পিছনের ভয়াবহ দুর্দশার কথা ভুলতে পুনরায় গর্বে স্ফীত তে নিশ্চয়ই বেশ দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ত। আমরা পূর্বেই ঐতিহাসিক বর্ণনায় জেনেছি যে, জাদুকরদের সাথে পরীক্ষার পর মূসা (আঃ) বিশ বছরের মত মিসরে ছিলেন। তারপরে সাগর ডুবির গযব নাযিল হয়। অতএব জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার পর তে সাগর ডুবি পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ প্লেগ সহ আয়াতে বর্ণিত আটটি গযব নাযিল হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনুল মুনযির যে বলেছেন যে, প্রতিটি আযাব শনিবারে এসে পরের শনিবারে চলে যেত এবং পরবর্তী আযাব আসা পর্যন্ত তিন সপ্তাহের অবকাশ দেওয়া কথাটি তাই মেনে নেওয়া মুশকিল বৈ-কি

২য় নিদর্শন : তূফান

দুর্ভিক্ষের পরে মূসা (আঃ)-এর দোআর বরকতে পুনরায় ভরা মাঠ ভরা ফসল পেয়ে ফেরাঊনী সম্প্রদায় পিছনের সব কথা ভুলে যায় গর্বে স্ফীত হয়ে মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে থাকে। তারা সাধারণ লোকদের ঈমান গ্রহণে বাধা দিতে থাকে। তারা তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পুনরায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে। ফলে তাদের উপরে গযব আকারে প্লাবন জলোচ্ছ্বাস নেমে আসে। যা তাদের মাঠ-ঘাট, বাগান-ফসল, ঘর-বাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এতে ভীত হয়ে তারা আবার মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার তারা ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা করে আল্লাহর নিকটে দো করার জন্য মূসা (আঃ)-কে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। ফলে মূসা (আঃ) দো করেন আল্লাহর রহমতে তূফান চলে যায়। পুনরায় তারা জমি-জমা আবাদ করে অচিরেই তা সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। দৃশ্য দেখে তারা আবার অহংকারী হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আসলে আমাদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যেই প্লাবন এসেছিল, আর সেকারণেই আমাদের ফসল এবার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বাম্পার ফলন হয়েছে। আসলে আমাদের কর্ম দক্ষতার ফল হিসাবে এটাই উপযুক্ত। এভাবে তারা অহংকারে মত্ত হয়ে আবার শুরু করল বনী ইস্রাঈলদের উপরে যুলুম-অত্যাচার। ফলে নেমে এল তৃতীয় গযব

৩য় নিদর্শন : পঙ্গপাল

একদিন হঠাৎ হাযার হাযার পঙ্গপাল কোত্থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ফেরাঊনীদের সব ফসল খেয়ে ছাফ করে গেল। তারা তাদের বাগ-বাগিচার ফল-ফলাদি খেয়ে সাবাড় করে ফেলল। এমনকি কাঠের দরজা-জানালা, আসবাব-পত্র পর্যন্ত খেয়ে শেষ করল। অথচ পাশাপাশি বনু ইস্রাঈলদের ঘরবাড়ি, শস্যভূমি বাগ-বাগিচা সবই সুরক্ষিত থাকে

এবারও ফেরাঊনী সম্প্রদায় ছুটে এসে মূসা (আঃ)-এর কাছে কাতর কণ্ঠে নিবেদন করতে থাকে, যাতে গযব চলে যায়। তারা এবার পাকা ওয়াদা করল যে, তারা ঈমান আনবে বনু ইস্রাঈলদের মুক্তি দেবে। মূসা (আঃ) দো করলেন আযাব চলে গেল। পরে ফেরাঊনীরা দেখল যে, পঙ্গপালে খেয়ে গেলেও এখনও যা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ফলে তারা আবার শয়তানী ধোঁকায় পড়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল পূর্বের ন্যায় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন শুরু করল। ফলে নেমে এল পরবর্তী গযবউকুন

৪র্থ নিদর্শন : উকুন

উকুনসাধারণতঃ মানুষের মাথার চুলে জন্মে থাকে। তবে এখানে ব্যাপক অর্থে ঘুণ পোকা কেড়ি পোকাকেও গণ্য করা হয়েছে। যা ফেরাঊনীদের সকল প্রকার কাঠের খুঁটি, দরজা-জানালা, খাট-পালংক আসবাব-পত্রে এবং খাদ্য-শস্যে লেগেছিল। তাছাড়া দেহের সর্বত্র সর্বদা উকুনের কামড়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এভাবে উকুন ঘুণপোকার অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে এক সময় তারা কাঁদতে কাঁদতে মূসা (আঃ)-এর দরবারে এসে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো এবং প্রতিজ্ঞার পরে প্রতিজ্ঞা করে বলতে লাগলো যে, এবারে আযাব ফিরে গেলে তারা অবশ্যই ঈমান আনবে, তাতে বিন্দুমাত্র অন্যথা হবে না। মূসা (আঃ) তাদের জন্য দো করলেন এবং আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল এবং পূর্বের ন্যায় অবাধ্য আচরণ শুরু করল। আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার অবকাশ দেওয়াকে তারা তাদের ভালত্বের পক্ষে দলীল হিসাবে মনে করতে লাগল এবং হেদায়াত দূরে থাক, তাদের অহংকার ক্রমে বাড়তে লাগল। মূলতঃ এগুলো ছিল তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের অবস্থা। নইলে সাধারণ মানুষ মূসা হারূণের দাওয়াত অন্তরে কবুল করে যাচ্ছিল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর এতেই ছিল মূসা (আঃ)-এর সান্ত্বনা। আল্লাহ বলেনوَإِذَا أَرَدْنَا أَن نُّهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوْا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا- (الإسراء ১৬)- ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে উদ্বুদ্ধ করি। অতঃপর তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়। ফলে উক্ত জনগোষ্ঠীর উপরে আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা উক্ত জনপদকে সমূলে বিধ্বস্ত করি’ (ইসরা ১৭/১৬) ফেরাঊনীদের উপরে সেই অবস্থা এসে গিয়েছিল। তাদের নেতারা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা তাদের লোকদের বুঝাতে লাগলো যে, এসবই মূসার জাদুর খেল। আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই। ফলে নেমে এল এবারব্যাঙ’-এর গযব

৫ম নিদর্শন : ব্যাঙ

বারবার বিদ্রোহ করা সত্ত্বেও দয়ালু আল্লাহ তাদের সাবধান করার জন্য আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনরায় গযব পাঠালেন। এবার এল ব্যাঙ। ব্যাঙে ব্যাঙে ভরে গেল তাদের ঘর-বাড়ি, হাড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, বিছানা-পত্তর সবকিছু। বসতে ব্যাঙ, খেতে ব্যাঙ, চলতে ব্যাঙ, গায়ে-মাথায় সর্বত্র ব্যাঙের লাফালাফি। কোন জায়গায় বসা মাত্র শত শত ব্যাঙের নীচে তলিয়ে যেতে ত। এই নরম জীবটির সরস অত্যাচারে পাগলপরা হয়ে উঠল পুরা ফেরাঊনী জনপদ। অবশেষে কান্নাকাটি করে কাকুতি-মিনতি করে তারা এসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো মূসা (আঃ)-এর কাছে। এবার পাকাপাকি ওয়াদা করল যে, আযাব চলে যাবার সাথে সাথে তারা ঈমান আনবেই। কিন্তু না, যথা পূর্বং তথা পরং। ফলে পুনরায় গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। এবারে এলরক্ত

৬ষ্ঠ নিদর্শন : রক্ত

তাদের অহংকার ঔদ্ধত্য চরমে উঠলে হঠাৎ একদিন দেখা গেলরক্ত খাদ্য পানপাত্রে রক্ত, কূয়া পুকুরে রক্ত, তরি-তরকারিতে রক্ত, কলসি-বালতিতে রক্ত। একই সাথে খেতে বসে বনু ইস্রাঈলের থালা-বাটি স্বাভাবিক। কিন্তু ফেরাঊনী ক্বিবতীর থালা-বাটি রক্তে ভরা। পানি মুখে নেওয়া মাত্র গ্লাসভর্তি রক্ত। অহংকারী নেতারা বাধ্য হয়ে বনু ইস্রাঈলী মযলূমদের বাড়ীতে এসে খাদ্য পানি ভিক্ষা চাইত। কিন্তু যেমনি তাদের হাতে তা পৌঁছত, অমনি সেগুলো রক্তে পরিবর্তিত হয়ে যেত। ফলে তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। না খেয়ে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। অবশেষে পূর্বের ন্যায় আবার এসে কান্নাকাটি। মূসা (আঃ) দয়া পরবশে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু নেতাগুলো পূর্বের মতই তাদের গোমরাহীতে অনড় রইল এবং ঈমান আনলো না। এদের এই হঠকারিতা কপট আচরণের কথা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবেفَاسْتَكْبَرُوْا وَكَانُوْا قَوْمًا مُّجْرِمِيْنَ-(الأعراف ১৩৩)- ‘অতঃপর তারা আত্মম্ভরিতা দেখাতে লাগলো। বস্ত্ততঃ এরা ছিল পাপাসক্ত জাতি’ (রাফ /১৩৩) ফলে নেমে এল এবার প্লেগ মহামারী

৭ম নিদর্শন : প্লেগ

রক্তের আযাব উঠিয়ে নেবার পরও যখন ওরা ঈমান আনলো না, তখন আল্লাহ ওদের উপরে প্লেগ মহামারী প্রেরণ করেন (রাফ /১৩৪) অনেকে এটাকেবসন্তরোগ বলেছেন। যাতে অল্প দিনেই তাদের সত্তর হাযার লোক মারা যায়। অথচ বনু ইস্রাঈলরা ভাল থাকে। এলাহী গযবের সাথে সাথে এগুলি ছিল মূসা (আঃ)-এর মুজেযা এবং নবুঅতের নিদর্শন। কিন্তু জাহিল আত্মগর্বী নেতারা একেজাদুবলে তাচ্ছিল্য করত

প্লেগের মহামারীর ফলে ব্যাপক প্রাণহানিতে ভীত হয়ে তারা আবার এসে মূসা (আঃ)-এর নিকটে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল। মূসা (আঃ) আবারও তাদের জন্য দো করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা পূর্বের ন্যায় আবারো ওয়াদা ভঙ্গ করল। ফলে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অবধারিত হয়ে গেল। আল্লাহ বলেনإِنَّ الَّذِيْنَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَتُ رَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ-وَلَوْ جَاءتْهُمْ كُلُّ آيَةٍ حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الأَلِيْمَ- (يونس ৯৬-৯৭)- ‘নিশ্চয়ই যাদের উপরে তোমার প্রভুর আদেশ নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা কখনো বিশ্বাস আনয়ন করে না, যদিও সব রকমের নিদর্শনাবলী তাদের নিকটে পৌছে যায়, এমনকি তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’ (ইউনুস ১০/৯৬-৯৭)

৮ম নিদর্শন : সাগর ডুবি

ক্রমাগত পরীক্ষা অবকাশ দানের পরও যখন কোন জাতি সম্বিত ফিরে পায় না। বরং উল্টা তাদের অহংকার বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে ওঠে, তখন তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক বলেন,

وَلَقَدْ أَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنْ أَسْرِ بِعِبَادِي فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقاً فِي الْبَحْرِ يَبَساً لاَّ تَخَافُ دَرَكاً وَّلاَ تَخْشَى- (طه ৭৭)-

আমরা মূসার প্রতি এই মর্মে অহী করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্কপথ নির্ধারণ কর। পিছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশংকা কর না এবং (পানিতে ডুবে যাওয়ার) ভয় কর না’ (ত্বোয়াহা ২০/৭৭)

আল্লাহর হুকুম পেয়ে মূসা (আঃ) রাত্রির সূচনা লগ্নে বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে রওয়ানা লেন। তাঁরা সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সমুদ্র কোনটা ছিল ব্যাপারে মুফতী মুহাম্মাদ শফী তাফসীর রূহুল মাআনীর বরাত দিয়ে ৮৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ওটা ছিলভূমধ্যসাগর[30] একই তাফসীরে ৪৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেনলোহিত সাগর কিন্তু মাওলানা মওদূদী খ্যাতনামা পাশ্চাত্য মনীষী লুইস গোল্ডিং-এর তথ্যানুসন্ধান মূলক ভ্রমণ কাহিনী IN THE STEPS OF MOSSES, THE LAW GIVER -এর বরাতে লিখেছেন যে, ওটা ছিললোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হরদ মিসরের আধুনিক তাফসীরকার তানতাভীও (মৃঃ ১৯৪০ খৃঃ) বলেন যে, লোহিত সাগরে ডুবে মরা ফেরাঊনের লাশ ১৯০০ খৃষ্টাব্দের মে মাসে পাওয়া গিয়েছিল[31] যদিও তা ১৯০৭ সালে পাওয়া যায়[32]

উল্লেখ্য যে, হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো জন পুত্র মিসরে এসেছিলেন। পরবর্তী চারশত বছরে তাদের বংশ বৃদ্ধি পেয়ে ইস্রাঈলী বর্ণনা অনুযায়ী ছয় লাখ ৩০ হাযার ছাড়িয়ে যায়। মাওলানা মওদূদী বলেন, সময় মিসরে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ২০ শতাংশের মাঝামাঝি[33] তবে কুরআন হাদীছ থেকে কেবল এতটুকু জানা যায় যে, তাদের বারোটি গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের জনসংখ্যা ছিল বিপুল

নবুঅত-পরবর্তী ৩য় পরীক্ষা নাজাত লাভ

মূসার নবুঅতী জীবনে এটি ছিল একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা। ইবরাহীমের অগ্নি পরীক্ষার ন্যায় এটিও ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক মহা পরীক্ষা। পিছনে ফেরাঊনের হিংস্র বাহিনী, সম্মুখে অথৈ সাগর। এই কঠিন সময়ে বনু ইস্রাঈলের আতংক হাহাকারের মধ্যেও মূসা ছিলেন স্থির নিস্কম্প। দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় তিনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাসে অটল থাকেন এবং সাথীদের সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। হিজরতের রাতে একইরূপ জীবন-মরণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)

যাই হোক ফেরাঊন খবর জানতে পেরে তার সেনাবাহিনীকে বনু ইস্রাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ বলেন,

فَأَتْبَعُوهُم مُّشْرِقِينَ- فَلَمَّا تَرَاءى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَى إِنَّا لَمُدْرَكُونَ- قَالَ كَلاَّ إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ- فَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ- وَأَزْلَفْنَا ثَمَّ الْآخَرِينَ- وَأَنجَيْنَا مُوسَى وَمَن مَّعَهُ أَجْمَعِينَ- ثُمَّ أَغْرَقْنَا الْآخَرِينَ- (الشعراء ৬০-৬৬)-

সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল’ (শোআরা ২৬/৬০) ‘অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বললإِنَّا لَمُدْرَكُونَ ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম’ (৬১)তখন মূসা বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন(৬২)অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল(৬৩)ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপরদলকে (অর্থাৎ ফেরাঊন তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম(৬৪)এবং মূসা তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম(৬৫)অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম’ (শোআরা ২৬/৬০-৬৬)

এখানেপ্রত্যেক ভাগবলতে তাফসীরকারগণ বারো গোত্রের জন্য বারোটি ভাগ বলেছেন। প্রত্যেক ভাগের লোকেরা পানির দেওয়াল ভেদ করে পরস্পরকে দেখতে পায় কথা বলতে পারে, যাতে তারা ভীত না হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি এগুলো কল্পনা না করলেও চলে। বরং উপরে বর্ণিত কুরআনী বক্তব্যের উপরে ঈমান আনাই যথেষ্ট। সাড়ে ছয় লক্ষ লোক এবং তাদের সওয়ারী গবাদি পশু সাংসারিক দ্রব্যাদি নিয়ে নদী পার হবার জন্য যে বিরাট এলাকা প্রয়োজন, সেই এলাকাটুকু বাদে দুপাশে দুভাগে যদি সাময়িকভাবে পানি দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সেটাতে বিশ্বাস করাই শ্রেয়। ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া শ্রীলংকার সাগরে যেসুনামী’ (TSUNAMI) হয়ে গেল, তাতে ৩৩ ফুট উঁচু ঢেউ দীর্ঘ সময় যাবত দাঁড়িয়ে ছিল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাই মূসার যামানায় সাগর বিদীর্ণ হয়ে তলদেশ থেকে দুপাশে পানি দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই বিচিত্র নয়। আল্লাহর হুকুমে সবকিছুই হওয়া সম্ভব

মূসা বনু ইস্রাঈলকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে দেখে ফেরাঊন সরোষে ঘোড়া দাবড়িয়ে সর্বাগ্রে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দুদিক থেকে বিপুল পানি রাশি ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল। আল্লাহ বলেনفَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ بِجُنُودِهِ فَغَشِيَهُم مِّنَ الْيَمِّ مَا غَشِيَهُمْ- (طه ৭৮)- ‘অতঃপর ফেরাঊন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (ত্বোয়াহা ২০/৭৮)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْياً وَعَدْواً حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنتُ أَنَّهُ لآ إِلَهَ إِلاَّ الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ- (يونس ৯০)-

আর বনু ইস্রাঈলকে আমরা সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাঊন তার সেনাবাহিনী বাড়াবাড়ি শত্রুতা বশতঃ। অতঃপর যখন সে (ফেরাঊন) ডুবতে লাগল, তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনছি বিষয়ে যে, সেই সত্তা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যার উপরে ঈমান এনেছে বনু ইস্রাঈলগণ এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন’ (ইউনুস ১০/৯০) আল্লাহ বললেন,

آلآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ- فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيراً مِّنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُونَ- (يونس ৯১-৯২)-

آلآن ‘এখন একথা বলছ? অথচ তুমি ইতিপূর্বে না-ফরমানী করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেঅতএব আজ আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে দিচ্ছি। যাতে তোমার পশ্চাদ্বর্তীদের জন্য তুমি নিদর্শন তে পার। বস্ত্ততঃ বহু লোক এমন রয়েছে যারা আমাদের নিদর্শনাবলীর বিষয়ে বেখবর’ (ইউনুস ১০/৯১-৯২)

স্মর্তব্য যে, সাগরডুবির দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার পরেও ভীত-সন্ত্রস্ত বনু ইস্রাঈলীরা ফেরাঊন মরেছে কি-না বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফলে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দো করলেন। তখন আল্লাহ তার প্রাণহীন দেহ বের করে দিলেন। অতঃপর মূসার সাথীরা নিশ্চিন্ত [34]

উল্লেখ্য যে, ফেরাঊনের মমিকৃত দেহ অক্ষতভাবে পাওয়া যায় ১৯০৭ সালে এবং বর্তমানে তা মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে

এতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ফেরাঊনের সময় মিসরীয় সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাদের সময়ে লাশমমিকরার মত বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়। পিরামিড, স্ফিংক্স হাযার হাযার বছর ধরে আজও সেই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি ধারণ করে আছে, যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আজকের যুগের কোন কারিগর প্রাচীন এসব কারিগরী কলা-কৌশলের ধারে-কাছেও যেতে পারবে কি-না সন্দেহ

আশূরার ছিয়াম :

ফেরাঊনের সাগরডুবি মূসার মুক্তি লাভের অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছিল ১০ই মুহাররম আশূরার দিন। দিনের স্মরণে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলগণ প্রতি বছর দিন একটি নফল ছিয়াম পালন করেন। এই ছিয়াম যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। জাহেলী আরবেও ছিয়াম চালু ছিল। নবুঅত-পূর্ব কালে পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আশূরার ছিয়াম রাখতেন। ২রা হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশূরার ছিয়াম মুসলমানদের জন্যফরযছিল। এরপরে এটি নফল ছিয়ামে পরিণত হয়[35] হিজরতের পর মদীনায় ইহুদীদের ছিয়াম পালন করতে দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমরাই মূসা (আঃ)-এর নাজাতে শুকরিয়া আদায় করার অধিক হকদার। আগামী বছর বেঁচে থাকলে আমি তারিখে (অর্থাৎ ১০ দুদিন) ছিয়াম পালন করব[36] অন্য হাদীছে ১০ ১১ দুদিন ছিয়াম পালনের কথাও এসেছে[37] অতএব নাজাতে মূসার শুকরিয়া আদায়ের নিয়তে নফল ছিয়াম হিসাবে ১০ তারিখ সহ উক্ত দুদিন অথবা কেবল ১০ই মুহাররম তারিখে আশূরার ছিয়াম পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কর্তব্য। ছিয়ামের ফলে মুমিনের বিগত এক বছরের সকল ছগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যাবার কথা হাদীছে এসেছে[38]

উল্লেখ্য যে, ১০ই মুহাররম তারিখে পৃথিবীতে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ন্যায় ৬১ হিজরী সনে হযরত হোসায়েন (রাঃ)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সেজন্য নফল ছিয়াম পালনের বা কোন অনুষ্ঠান বা দিবস পালনের বিধান ইসলামে নেই। অতএব আশূরার ছিয়াম পালনের নিয়ত হবেনাজাতে মূসার শুকরিয়াহিসাবে, ‘শাহাদাতে হোসায়েন-এর শোকহিসাবে নয়। এরূপ নিয়ত করলে নেকীর বদলে গোনাহ হবে

বনু ইস্রাঈলের পরবর্তী গন্তব্য :

আল্লাহ বলেন,

فَانتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا وَكَانُوْا عَنْهَا غَافِلِيْنَ- وَأَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِيْنَ كَانُوْا يُسْتَضْعَفُوْنَ مَشَارِقَ الأَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِيْ بَارَكْنَا فِيهَا وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ الْحُسْنَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ بِمَا صَبَرُوْا وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُوْا يَعْرِشُوْنَ- (الأعراف ১৩৬-১৩৭)-

ফলে আমরা তাদের কাছ থেকে (অর্থাৎ ফেরাঊনীদের কাছ থেকে) বদলা নিলাম তাদেরকে সাগরে ডুবিয়ে মারলাম। কারণ তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল আমাদের নিদর্শন সমূহকে তার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করেছিলআর যাদেরকে দুর্বল মনে করা , তাদেরকে আমরা উত্তরাধিকার দান করলাম সেই ভূখন্ডের পূর্বের পশ্চিমের, যাতে আমরা বরকত নিহিত রেখেছি এবং এভাবে পূর্ণ হয়ে গেল তোমার প্রভুর (প্রতিশ্রুত) কল্যাণময় বাণীসমূহ বনু ইস্রাঈলীদের জন্য তাদের ধৈর্যধারণের কারণে। আর ধ্বংস করে দিলাম সে সবকিছু, যা তৈরী করেছিল ফেরাঊন তার সম্প্রদায় এবং যা কিছু তারা নির্মাণ করেছিল’ (রাফ /১৩৬-১৩৭)

উপরোক্ত আয়াত দুটিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি পরিস্ফূট হয়। () অহংকার সীমালংঘনের কারণে ফেরাঊন তার সাথীদেরকে ডুবিয়ে মারা হয় এবং তাদের সভ্যতার সুউচ্চ নির্মাণাদি ধ্বংস হয় () আল্লাহর উপরে পূর্ণ আস্থা ফেরাউনের যুলুমে ধৈর্যধারণের পুরস্কার হিসাবে বনু ইস্রাঈলগণকে উদয়াচল অস্তাচল সমূহের উপরে কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। () এখানে الَّذِينَ كَانُوْا يُسْتَضْعَفُونَ ‘যাদেরকে হীন মনে করা হয়েছিলবলা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা যে জাতির বা যে ব্যক্তির সহায় থাকেন, বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে লোকেরা তাদের দুর্বল ভেবে বসে। কিন্তু আসলে তারা মোটেই হীন দুর্বল নয়। কারণ প্রকৃত শক্তি মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। এখানে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ফেরাঊন সবল লেও আল্লাহর সাহায্য পাওয়ায় বনু ইস্রাঈলগণ অবশেষে বিজয়ী হয়েছে। কারণে হযরত হাসান বছরী বলেন, অত্র আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে বিষয়ে যে, মানুষ যদি এমন কোন লোক বা দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়, যাকে প্রতিহত করা তার ক্ষমতার বাইরে, তবে সে ক্ষেত্রে কৃতকার্যতা কল্যাণের সঠিক পথ তার মুকাবিলা না করে ছবর করা। কেননা যখন সে যুলুমের পাল্টা যুলুমের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেবার চিন্তা করে, আল্লাহ তখন তাকে তার শক্তি-সামর্থ্যের উপরে ছেড়ে দেন। পক্ষান্তরে যখন সে তার মুকাবিলায় ছবর করে এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ স্বয়ং তার জন্য রাস্তা খুলে দেন

বনু ইস্রাঈলগণ মূসা (আঃ)-এর পরামর্শে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলرَبَّنَا لاَ تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِّلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ، وَنَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে যালেম কওমের ফেৎনায় নিক্ষেপ করো নাএবং আমাদেরকে অনুগ্রহ করে কাফের সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (ইউনুস ১০/৮৫-৮৬) বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদের প্রার্থনা কবুল করেছিলেন এবং যথাসময়ে তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন

এক্ষণে প্রশ্ন , সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়েই কি বনু ইস্রাঈলগণ মিসরে প্রত্যাবর্তন করল এবং ফেরাঊনের অট্টালিকা সমূহ ধ্বংস করে ফেরাঊনী রাজত্বের মালিক বনে গেল? ব্যাপারে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত এতদসংক্রান্ত আয়াত সমূহে প্রমাণিত হয় যে, মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলগণ ঐসময় মিসরে ফিরে যাননি। বরং তাঁরা আদি বাসস্থান কেনআনের উদ্দেশ্যে শাম-এর দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন। অতঃপর পথিমধ্যে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় জিহাদ করে তাদের আদি বাসস্থান কেনআন দখল করার জন্য। সেখানে তখন আমালেক্বাদের রাজত্ব ছিল। যারা ছিল বিগতআদ বংশের লোক এবং বিশালদেহী দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। নবী মূসার মাধ্যমে আল্লাহ তাদের আগাম বিজয়ের সুসংবাদ দেন। তথাপি তারা ভীত হয় এবং জিহাদে যেতে অস্বীকার করে। শক্তিশালী ফেরাঊন তার বিশাল বাহিনীর চাক্ষুস ধ্বংস দেখেও তারা আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করতে পারেনি। ফলে আল্লাহর অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ মিসর শামের মধ্যবর্তী তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত জেলখানায় তারা ৪০ বছর অবরুদ্ধ জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয় এবং সেখানে থাকা অবস্থাতেই হারূণ মূসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে মূসা (আঃ)-এর শিষ্য পরবর্তী নবী ইউশাবিন নূন-এর নেতৃত্বে তারা জিহাদে অগ্রসর হয় এবং তার মাধ্যমে আমালেক্বাদের হারিয়ে কেনআন দখল করে তারা তাদের আদি বাসস্থানে ফিরে আসে। এভাবে আল্লাহর ওয়াদা সত্যে পরিণত হয়

উল্লেখ্য যে, আলোচ্য সূরা রাফ ১৩৬-৩৭ আয়াত ছাড়াও শোআরা ৫৯, ক্বাছাছ দুখান ২৫-২৮ আয়াত সমূহে বাহ্যতঃ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বনু ইস্রাঈলগণকে ফেরাঊনীদের পরিত্যক্ত সম্পদ সমূহের মালিক করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে বিষয়েরও সুস্পষ্ট অবকাশ বিদ্যমান রয়েছে যে, বনু ইস্রাঈলগণকে ফেরাঊনীদের ন্যায় বাগ-বাগিচা ধন-সম্পদের মালিক করা হয়েছিল। এর জন্য তাদের মিসরে প্রত্যাবর্তন করা যরূরী নয়। বরং অনুরূপ বাগ-বাগিচা শাম দেশেও অর্জিত তে পারে। সূরা রাফের আলোচ্য ১৩৭ আয়াতেযাতে আমরা বরকত নিহিত রেখেছিবলে শাম দেশকে বুঝানো হয়েছে। একই বাক্য সূরা বনু ইস্রাঈলের ১ম আয়াতেও বলা হয়েছে। সেকারণ ক্বাতাদাহ বলেন, উপরোক্ত মর্মের সকল আয়াতে শাম দেশকে বুঝানো হয়েছে যেখানে গিয়ে বনু ইস্রাঈলগণ দুনিয়াবী শান-শওকতের মালিক হয়। পূর্বের পশ্চিমের বলে শামের চারপাশ বুঝানো হয়েছে।  তে পারে সময় মাশারেক্ব মাগারেব (পূর্ব পশ্চিম) তথা শাম মিসর উভয় ভূখন্ডের উপরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়[39]

প্রশ্ন হয়, ফেরাঊন তার সেনাবাহিনী সমূলে ধ্বংস হওয়ার পরও হযরত মূসা (আঃ) কেন মিসরে ফিরে গিয়ে তার সিংহাসন দখল করে বনু ইস্রাঈলের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেন না? এর জবাব প্রথমতঃ এটাই যে, ব্যাপারে তিনি আল্লাহর নির্দেশ পাননি। দ্বিতীয়তঃ তাঁর দূরদর্শিতায় হয়ত এটাই প্রতীয়মান হয়েছিল যে, রাজনৈতিক বিজয়ের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে দ্বীনের বিজয় সম্ভব নয়। তাছাড়া দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য রাজনৈতিক সীমানা শর্ত নয়; বরং তা অঞ্চলগত সীমানা পেরিয়ে সর্বত্র প্রচার আবশ্যক। তাই তিনি মিসর এলাকায় দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন শেষে এবার শাম এলাকায় দ্বীন প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তৃতীয়তঃ এটা তে পারে যে, নবীগণের পিতা ইবরাহীম (আঃ) সহ বনু ইস্রাঈলের মূল ব্যক্তি হযরত ইয়াকূব (আঃ) অন্যান্য নবীগণের জন্মস্থান শাম এলাকার বরকতমন্ডিত অঞ্চলে জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো ব্যয় করার সুপ্ত বাসনা তাঁর মধ্যে কাজ করে থাকতে পারে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পাক তাঁর মৃত্যুর জন্য কেনআনের মাটিকেই নির্ধারিত করেছিলেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে একটি লাল ঢিবি দেখিয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর কবর নির্দেশ করেছিলেন[40]

উপরোক্ত আলোচনার উপসংহারে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, সাগরডুবি থেকে নাজাত পাবার পর মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলগণ তখনই মিসরে ফিরে যাননি। বরং তারা কেনআনের উদ্দেশ্যে শাম অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন। শামে যাত্রাপথে এবং সেখানে পৌঁছে তাদেরকে নানাবিধ পরীক্ষার সম্মুখীন তে হয়। এক্ষণে আমরা সেদিকে মনোনিবেশ করব

বনু ইস্রাঈলের অবাধ্যতা তাদের উপরে আপতিত পরীক্ষা সমূহের বিবরণ:

. মূর্তি পূজার আবদার

বনু ইস্রাঈল কওম মূসা (আঃ)-এর মুজেযার বলে লোহিত সাগরে নির্ঘাত ডুবে মরা থেকে সদ্য নাজাত পেয়ে এসেছিল এবং গোটা ফেরাঊনী গোষ্ঠীকে সাগরে ডুবে মরার মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরিয়া আসার পথে কিছুদূর অগ্রসর তেই তারা এমন এক জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করল, যারা বিভিন্ন মূর্তির পূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের পূজা-অর্চনার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে তাদের মন সেদিকে আকৃষ্ট এবং মূসা (আঃ)-এর কাছে গিয়ে আবেদন করলاجْعَل لَّنَا إِلَـهاً كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ‘তাদের মূর্তিসমূহের ন্যায় আমাদের জন্যও একটা মূর্তি বানিয়ে দিন মূসা বললেনإِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ ‘তোমরা দেখছি মূর্খতায় লিপ্ত জাতি তিনি বলেনإِنَّ هَـؤُلاء مُتَبَّرٌ مَّا هُمْ فِيهِ وَبَاطِلٌ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُونَ ‘এরা যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তা ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তারা করছে, তা সব বাতিলতিনি আরও বললেনأَغَيْرَ اللهِ أَبْغِيْكُمْ إِلَـهاً ‘আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য সন্ধান করব? অথচ তিনি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (রাফ /১৩৮-১৪০)

বস্ত্ততঃ মানুষ সর্বদা আনুষ্ঠানিকতা প্রিয় এবং অদৃশ্য সত্তার চেয়ে দৃশ্যমান বস্ত্তর প্রতি অধিকতর আসক্ত। ফলে নূহ (আঃ)-এর যুগ থেকেই অদৃশ্য আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা কল্পনা করে নিজেদের হাতে গড়া দৃশ্যমান মূর্তি সমূহের পূজা-অর্চনা চলে আসছে। অবশেষে আল্লাহ্কে তাঁর বিধানকে ভুলে গিয়ে মানুষ মূর্তিকে নিজেদের মনগড়া বিধানকে মুখ্য গণ্য করেছে। মক্কার মুশরিকরাও শেষনবীর কাছে তাদের মূর্তিপূজাকে আল্লাহর নৈকট্যের অসীলা বলে অজুহাত দিয়েছিল’ (যুমার ৩৯/) তাদের এই অজুহাত অগ্রাহ্য হয় এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়। বদর, ওহোদ, খন্দক প্রভৃতি যুদ্ধসহ পরবর্তীকালের সকল জিহাদ মূলতঃ এই শিরকের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে মূর্তি ভেঙ্গে অতঃপর পানি দিয়ে ধুয়ে কাবা গৃহ ছাফ করেন এবং আয়াত পাঠ করেনجَاء الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ‘সত্য এসে গেল, মিথ্যা বিদূরিত ’ (ইসরা ১৭/৮১)

কিন্তু দুর্ভাগ্য! মূর্তিপূজার সে স্থান আজ দখল করেছে মুসলমানদের মধ্যে কবর পূজা, ছবি-মূর্তি প্রতিকৃতি পূজা, স্মৃতিসৌধ, স্থানপূজা, শহীদ মিনার বেদী পূজা, শিখা আগুন পূজা ইত্যাদি। বস্ত্ততঃ এগুলি স্পষ্ট শিরক, যা থেকে নবীগণ যুগে যুগে মানুষকে সাবধান করেছেন। মূসা (আঃ) স্বীয় কওমকে তাদের মূর্খতাসূলভ আচরণের জন্য ধমকানোর পর তাদের হুঁশ ফিরলো এবং তারা বিরত

তওরাত লাভ :

অতঃপর আল্লাহ মূসাকে অহীর মাধ্যমে ওয়াদা করলেন যে, তাকে সত্বরকিতাব’ (তওরাত) প্রদান করা হবে এবং এজন্য তিনি বনু ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে তাকেতূর পাহাড়ের দক্ষিণ পার্শ্বেচলে আসতে বললেন (ত্বোয়াহা ২০/৮৩-৮৪) অতঃপর মূসা (আঃ) আগে এসে আল্লাহর হুকুমে প্রথমে ত্রিশ দিন ছিয়াম তেকাফে মগ্ন থাকেন। এরপর আল্লাহ আরও দশদিন মেয়াদ বাড়িয়ে দেন (রাফ /১৪২) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,& এই দশদিন ছিল যিলহজ্জের প্রথম দশদিন, যা অতীব বরকতময়। ইবনু কাছীর বলেন, ১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন মূসার মেয়াদ শেষ হয় আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ হয়। একই দিন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর দ্বীন পরিপূর্ণতার আয়াত নাযিল হয় (মায়েদাহ )=ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা রাফ ১৪২)

যথাসময়ে আল্লাহ মূসার সঙ্গে কথা বললেন (রাফ /১৪৩) অতঃপর তাঁকে তওরাত প্রদান করলেন, যা ছিল সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী সরল পথ প্রদর্শনকারী (বাক্বারাহ /৫৩) দীর্ঘ বিশ বছরের অধিককাল পূর্বে মিসর যাওয়ার পথে এই স্থানেই মূসা প্রথম আল্লাহর সাথে কথোপকথনের নবুঅত লাভের মহা সৌভাগ্য লাভ করেন। আজ আবার সেখানেই বাক্যালাপ ছাড়াও এলাহী গ্রন্থ তওরাত পেয়ে খুশীতে অধিকতর সাহসী হয়ে তিনি আল্লাহর নিকটে দাবী করে বসলেন,

رَبِّ أَرِنِي أَنظُرْ إِلَيْكَ قَالَ لَنْ تَرَانِي وَلَـكِنِ انظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي، فَلَمَّا تَجَلَّى رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وََّخَرَّ مُوسَى صَعِقًا- فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ- (الأعراف ১৪৩)-

হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখা দাও। আমি তোমাকে স্বচক্ষে দেখব। আল্লাহ বললেন, তুমি আমাকে ( দুনিয়াতে) কখনোই দেখতে পাবে না। তবে তুমি (তূর) পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক। সেটি যদি স্বস্থানে স্থির থাকে, তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তার প্রভু উক্ত পাহাড়ের উপরে স্বীয় জ্যোতির বিকীরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন তার জ্ঞান ফিরে এল, তখন বলল, হে প্রভু! মহা পবিত্র তোমার সত্তা! আমি তোমার নিকটে তওবা করছি এবং আমি বিশ্বাসীদের মধ্যে অগ্রণী’ (রাফ /১৪৩)

আল্লাহ বললেন,

قَالَ يَا مُوسَى إِنِّي اصْطَفَيْتُكَ عَلَى النَّاسِ بِرِسَالاَتِي وَبِكَلاَمِيْ فَخُذْ مَا آتَيْتُكَ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِيْنَ (144) وَكَتَبْنَا لَهُ فِي الْأَلْوَاحِ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَوْعِظَةً وَتَفْصِيْلاً لِكُلِّ شَيْءٍ فَخُذْهَا بِقُوَّةٍ وَأْمُرْ قَوْمَكَ يَأْخُذُوا بِأَحْسَنِهَا سَأُرِيْكُمْ دَارَ الْفَاسِقِيْنَ (الأعراف 144-145)- হে মূসা! আমি আমাররিসালাততথা বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং বাক্যালাপের মাধ্যমে লোকদের (নবীগণের) উপরে তোমাকে বিশিষ্টতা দান করেছি। সুতরাং যা কিছু আমি তোমাকে দান করলাম তা গ্রহণ কর কৃতজ্ঞ থাকআর আমরা তার জন্য ফলক সমূহে লিখে দিয়েছিলাম সর্বপ্রকার উপদেশ সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে। অতএব তুমি এগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং স্বজাতিকে এর কল্যাণকর বিষয়সমূহ দৃঢ়তার সাথে পালনের নির্দেশ দাও। শীঘ্রই আমি তোমাদেরকে দেখাব পাপাচারীদের বাসস্থান’ (রাফ /১৪৪-১৪৫)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তখতী বা ফলকে লিখিত অবস্থায় তাঁকে কিতাব প্রদান করা হয়েছিল। আর এই তখতীগুলোর নামই তওরাত

() গো-বৎস পূজা :

মূসা যখন বনী ইস্রাঈলকে নিয়ে তূর পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তখন তিনি হারূণ (আঃ)-কে কওমের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে পশ্চাতে আসার নির্দেশ দিয়ে নিজে আগে চলে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে ৪০ দিন ছিয়াম তেকাফে কাটানোর পরে তওরাত লাভ করলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, তার কওম নিশ্চয়ই তার পিছে পিছে তূর পাহাড়ের সন্নিকটে এসে শিবির স্থাপন করেছে। কিন্তু তাঁর ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল

আল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনوَمَا أَعْجَلَكَ عَنْ قَوْمِكَ يَا مُوْسَى- قَالَ هُمْ أُولاَءِ عَلَى أَثَرِي وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَى- قَالَ فَإِنَّا قَدْ فَتَنَّا قَوْمَكَ مِنْ بَعْدِكَ وَأَضَلَّهُمُ السَّامِرِيُّ- (طه 83-85)- ‘হে মূসা! তোমার সম্প্রদায়কে পিছনে ফেলে তুমি দ্রুত চলে এলে কেন?’ ‘তিনি বললেন, তারা তো আমার পিছে পিছেই আসছে এবং হে প্রভু! আমি তাড়াতাড়ি তোমার কাছে এলাম, যাতে তুমি খুশী হও আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি তোমার পর এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৩-৮৫)

একথা জেনে মূসা (আঃ) হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং দুঃখে ক্ষোভে অস্থির হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَرَجَعَ مُوْسَى إِلَى قَوْمِهِ غَضْبَانَ أَسِفًا قَالَ يَا قَوْمِ أَلَمْ يَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا أَفَطَالَ عَلَيْكُمُ الْعَهْدُ أَمْ أَرَدْتُمْ أَنْ يَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَأَخْلَفْتُمْ مَوْعِدِي- قَالُوا مَا أَخْلَفْنَا مَوْعِدَكَ بِمَلْكِنَا وَلَكِنَّا حُمِّلْنَا أَوْزَارًا مِّنْ زِيْنَةِ الْقَوْمِ فَقَذَفْنَاهَا فَكَذَلِكَ أَلْقَى السَّامِرِيُّ- فَأَخْرَجَ لَهُمْ عِجْلاً جَسَدًا لَهُ خُوَارٌ فَقَالُوا هَذَا إِلَهُكُمْ وَإِلَهُ مُوسَى فَنَسِيَ- (طه 86-88)- ‘অতঃপর মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন ক্রুদ্ধ অনুতপ্ত অবস্থায়। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের একটি উত্তম প্রতিশ্রুতি (অর্থাৎ তওরাৎ দানের প্রতিশ্রুতি) দেননি? তবে কি প্রতিশ্রুতির সময়কাল (৪০ দিন) তোমাদের কাছে দীর্ঘ হয়েছে? না-কি তোমরা চেয়েছ যে তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার ক্রোধ নেমে আসুক, যে কারণে তোমরা আমার সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করলে’? (৮৬) ‘তারা বলল, আমরা আপনার সাথে কৃত ওয়াদা স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি। কিন্তু আমাদের উপরে ফেরাঊনীদের অলংকারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর আমরা তা নিক্ষেপ করে দিয়েছি এমনিভাবে সামেরীও নিক্ষেপ করেছে(৮৭)অতঃপর সে তাদের জন্য (সেখান থেকে) বের করে আনলো একটা গো-বৎসের অবয়ব, যার মধ্যে হাম্বা হাম্বা রব ছিল। অতঃপর (সামেরী তার লোকেরা) বলল, এটাই তোমাদের উপাস্য এবং মূসারও উপাস্য, যা পরে মূসা ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৬-৮৮)

ঘটনা ছিল এই যে, মিসর থেকে বিদায়ের দিন যাতে ফেরাঊনীরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন না করে এবং তারা কোনরূপ সন্দেহ না করে, সেজন্য (মূসাকে লুকিয়ে) বনু ইস্রাঈলরা প্রতিবেশী ক্বিবতীদের কাছ থেকে অলংকারাদি ধার নেয় এই কথা বলে যে, আমরা সবাই ঈদ উৎসব পালনের জন্য যাচ্ছি। দুএকদিনের মধ্যে ফিরে এসেই তোমাদের সব অলংকার ফেরৎ দিব। কিন্তু সাগর পার হওয়ার পর যখন আর ফিরে যাওয়া না, তখন কুটবুদ্ধি মূসার প্রতি কপট বিশ্বাসী সামেরী মনে মনে এক ফন্দি আটলো যে, এর দ্বারা সে বনু ইস্রাঈলদের পথভ্রষ্ট করবে। অতঃপর মূসা (আঃ) যখন তার সম্প্রদায়কে হারূণের দায়িত্বে দিয়ে নিজে আগেভাগে তূর পাহাড়ে চলে যান, তখন সামেরী সুযোগ বুঝে তার ফন্দি কাজে লাগায়। সে ছিল অত্যন্ত চতুর। সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার সময় সে জিব্রীলের অবতরণ তার ঘোড়ার প্রতি লক্ষ্য করেছিল। সে দেখেছিল যে, জিব্রীলের ঘোড়ার পা যে মাটিতে পড়ছে, সে স্থানের মাটি সজীব হয়ে উঠছে তাতে জীবনের স্পন্দন জেগে উঠছে। তাই সবার অলক্ষ্যে পদচিহ্নের এক মুঠো মাটি সে তুলে সযতনে রেখে দেয়

মূসা (আঃ) চলে যাবার পর সে লোকদের বলে যে, ‘তোমরা ফেরাঊনীদের যেসব অলংকারাদি নিয়ে এসেছ এবং তা ফেরত দিতে পারছ না, সেগুলি ভোগ-ব্যবহার করা তোমাদের জন্য হালাল হবে না। অতএব এগুলি একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দাও কথাটি অবশেষে হারূণ (আঃ)-এর কর্ণগোচর হয়। নাসাঈ-তে বর্ণিতহাদীছুল ফুতূনেহযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, হযরত হারূণ (আঃ) সব অলংকার একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দেন, যাতে সেগুলি একটি অবয়বে পরিণত হয় এবং মূসা (আঃ)-এর ফিরে আসার পর সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণ করা যায়। হযরত হারূণ (আঃ)-এর নির্দেশ মতে সবাই যখন অলংকার গর্তে নিক্ষেপ করছে, তখন সামেরীও হাতের মুঠি বন্ধ করে সেখানে পৌঁছল এবং হযরত হারূণ (আঃ)-কে বলল, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হৌক- এই মর্মে আপনি দো করলে আমি নিক্ষেপ করব, নইলে নয়।হযরত হারূণ তার কপটতা বুঝতে না পেরে সরল মনে দো করলেন। আসলে তার মুঠিতে ছিল জিব্রীলের ঘোড়ার পায়ের সেই অলৌকিক মাটি। ফলে উক্ত মাটির প্রতিক্রিয়ায় হৌক কিংবা হযরত হারূণের দোআর ফলে হৌক- সামেরীর উক্ত মাটি নিক্ষেপের পরপরই গলিত অলংকারাদির অবয়বটি একটি গো-বৎসের রূপ ধারণ করে হাম্বা হাম্বা রব করতে থাকে। মুনাফিক সামেরী তার সঙ্গী-সাথীরা এতে উল্লসিত হয়ে বলে উঠলهَذَا إِلَهُكُمْ وَإِلَهُ مُوسَى فَنَسِيَ ‘এটাই তোমাদের উপাস্য মূসার উপাস্য। যা সে পরে ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৮)

মূসা (আঃ)-এর তূর পাহাড়ে গমনকে সে অপব্যাখ্যা দিয়ে বলল, মূসা বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে। এখন তোমরা সবাই গো-বৎসের পূজা কর কিছু লোক তার অনুসরণ করল। বলা হয়ে থাকে যে, বনু ইস্রাঈল এই ফিৎনায় পড়ে তিন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে মূসা (আঃ)-এর পিছে পিছে তূর পাহাড়ে গমনের প্রক্রিয়া পথিমধ্যেই বানচাল হয়ে গেল

হারূণ (আঃ) তাদেরকে বললেনوَلَقَدْ قَالَ لَهُمْ هَارُونُ مِنْ قَبْلُ يَا قَوْمِ إِنَّمَا فُتِنْتُمْ بِهِ وَإِنَّ رَبَّكُمُ الرَّحْمَنُ فَاتَّبِعُونِي وَأَطِيعُوا أَمْرِي- قَالُوا لَنْ نَبْرَحَ عَلَيْهِ عَاكِفِينَ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَيْنَا مُوسَى- (طه 90-91)- কওম! তোমরা এই   গো-বৎস দ্বারা পরীক্ষায় পতিত হয়েছ। তোমাদের পালনকর্তা অতীব দয়ালু। অতএব তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল(৯০) কিন্তু সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল, ‘মূসা আমাদের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজায় রত থাকব’ (ত্বোয়াহা ২০/৯০-৯১)

অতঃপর মূসা (আঃ) এলেন এবং সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে সব কথা শুনলেন। হারূণ (আঃ) তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। সামেরীও তার কপটতার কথা অকপটে স্বীকার করল। অতঃপর মূসা (আঃ) আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী শাস্তি ঘোষণা করলেন

গো-বৎস পূজার শাস্তি :

মূসা (আঃ) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বললوَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ… হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করে নিজেদের উপরে যুলুম করেছ। অতএব এখন তোমাদের প্রভুর নিকটে তওবা কর এবং নিজেদেরকে পরস্পরে হত্যা কর। এটাই তোমাদের জন্য তোমাদের স্রষ্টার নিকটে কল্যাণকর’… (বাক্বারাহ /৫৪) এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়

তূর পাহাড় তুলে ধরা :

এরপরেও কপট বিশ্বাসী হঠকারী কিছু লোক থাকে, যারা তওরাতকে মানতে অস্বীকার করে। ফলে তাদের মাথার উপরে আল্লাহ তূর পাহাড়ের একাংশ উঁচু করে ঝুলিয়ে ধরেন এবং অবশেষে নিরুপায় হয়ে তারা সবাই আনুগত্য করতে স্বীকৃত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَإِذْ أَخَذْنَا مِيْثَاقَكُمْ وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّوْرَ خُذُوْا مَا آتَيْنَاكُم بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوْا مَا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ- (البقرة ৬৩)-

আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের মাথার উপরে তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদের যে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তা মযবুতভাবে ধারণ কর এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা স্মরণে রাখ, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু তে পার’ (বাক্বারাহ /৬৩) কিন্তু গো-বৎসের মহববত এদের হৃদয়ে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, এতকিছুর পরেও তারা শিরক ছাড়তে পারেনি। আল্লাহ বলেনوَأُشْرِبُواْ فِي قُلُوبِهِمُ الْعِجْلَ بِكُفْرِهِمْ ‘কুফরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস প্রীতি পান করানো হয়েছিল’ (বাক্বারাহ /৯৩) যেমন কেউ সরাসরি শিরকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কেউবা মুখে তওবা করলেও অন্তরে পুরোপুরি তওবা করেনি। কেউবা শিরককে ঘৃণা করতে পারেনি। কেউ বা মনে মনে ঘৃণা করলেও বাহ্যিকভাবে মেনে নিয়েছিল এবং বাধা দেওয়ার কোন চেষ্টা করেনি। আল্লাহ যখন তূর পাহাড় তুলে ধরে ভয় দেখিয়ে তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেন, তখনও তাদের কেউ কেউ (পরবর্তীতে) বলেছিলسَمِعْنَا وَعَصَيْنَا ‘আমরা শুনলাম অমান্য করলাম’ (বাক্বারাহ /৯৩) যদিও অমান্য করলাম কথাটি ছিল পরের এবং তা প্রমাণিত হয়েছিল তাদের বাস্তব ক্রিয়াকর্মে। যেমন আল্লাহ এইসব প্রতিশ্রুতি দানকারীদের পরবর্তী আচরণ সম্বন্ধে বলেন,

 ثُمَّ تَوَلَّيْتُم مِّن بَعْدِ ذَلِكَ فَلَوْلاَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَكُنتُم مِنَ الْخَاسِرِينَ- (البقرة ৬৪)-

অতঃপর তোমরা উক্ত ঘটনার পরে (তোমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে) ফিরে গেছ। যদি আল্লাহর বিশেষ করুণা অনুগ্রহ তোমাদের উপরে না থাকত, তাহলে অবশ্যই তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে’ (বাক্বারাহ /৬৪)

সামেরীর কৈফিয়ত :

সম্প্রদায়ের লোকদের শাস্তি দানের পর মূসা (আঃ) এবার সামেরীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সামেরী! তোমার ব্যাপার কি?’ ‘সে বলল, আমি দেখলাম, যা অন্যেরা দেখেনি। অতঃপর আমি সেই প্রেরিত ব্যক্তির (অর্থাৎ জিব্রীলের) পদচিহ্নের নীচ থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে নিলাম। অতঃপর আমি তা (আগুনে গলিত অলংকারের অবয়বের প্রতি) নিক্ষেপ করলাম। আমার মন এটা করতে প্ররোচিত করেছিল (অর্থাৎ কারু পরামর্শে নয় বরং নিজস্ব চিন্তায় শয়তানী কুমন্ত্রণায় আমি একাজ করেছি)’মূসা বললেন, দূর , তোর জন্য সারা জীবন এই শাস্তিই রইল যে, তুই বলবি, ‘আমাকে কেউ স্পর্শ করো নাএবং তোর জন্য (আখেরাতে) একটা নির্দিষ্ট ওয়াদা রয়েছে (অর্থাৎ জাহান্নাম), যার ব্যতিক্রম হবে না। এক্ষণে তুই তোর সেই ইলাহের প্রতি লক্ষ্য কর, যাকে তুই সর্বদা পূজা দিয়ে ঘিরে থাকতিস। আমরা ওটাকে (অর্থাৎ কৃত্রিম গো-বৎসটাকে) অবশ্যই জ্বালিয়ে দেব এবং অবশ্যই ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে ছিটিয়ে দেব’ (ত্বোয়াহা ৯৫-৯৭)

সামেরী তার শাস্তি :

পারস্য অথবা ভারতবর্ষের অধিবাসী সামেরী গো-পূজারী সম্প্রদায়ের লোক ছিল। পরে মিসরে পৌঁছে সে মূসা (আঃ)-এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে। অত্যন্ত চতুর এই ব্যক্তিটি পরে কপট বিশ্বাসী মুনাফিক হয়ে যায়। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না পাওয়ায় সে বনু ইস্রাঈলদের সাথে সাগর পার হওয়ার সুযোগ পায়। মূসা (আঃ)-এর বিপুল নাম-যশ অলৌকিক ক্ষমতায় সে তার প্রতি মনে মনে ঈর্ষা পরায়ণ ছিল। মূসার সান্নিধ্য নিজস্ব সুক্ষ্মদর্শিতার কারণে সে জিব্রাঈল ফেরেশতা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেই আগ্রহের কারণেই সাগর পার হওয়ার সময় সে জিব্রীলকে চিনতে পারে তার ঘোড়ার পদচিহ্নের মাটি সংগ্রহ করে। তার ধারণা ছিল যে, মূসার যাবতীয় ক্ষমতার উৎস এই ফেরেশতা। অতএব তার স্পর্শিত মাটি দিয়ে সেও এখন মূসার ন্যায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে

মূসা (আঃ) সামেরীর জন্য পার্থিব জীবনে এই শাস্তি নির্ধারণ করেন যে, সবাই তাকে বর্জন করবে এবং কেউ তার কাছে ঘেঁষবে না। তিনি তাকেও নির্দেশ দেন যে, সে কারও গায়ে হাত লাগাবে না। সারা জীবন এভাবেই সে বন্য জন্তুর ন্যায় সবার কাছ থেকে আলাদা থাকবে। এটাও সম্ভবপর যে, পার্থিব আইনগত শাস্তির ঊর্ধ্বে খোদ তার সত্তায় আল্লাহর হুকুমে এমন বিষয় সৃষ্টি হয়েছিল, যদ্দরুন সে নিজেও অন্যকে স্পর্শ করতে পারত না এবং অন্যেরাও তাকে স্পর্শ করতে পারত না। যেমন এক বর্ণনায় এসেছে যে, মূসা (আঃ)-এর বদদোআয় তার মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সে কাউকে হাত লাগালে বা কেউ তাকে হাত লাগালে উভয়েই জ্বরাক্রান্ত হয়ে যেত’ (কুরতুবী, ত্বোয়াহা ৯৫) এই ভয়ে সে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ঘোরাফেরা করত। কাউকে নিকটে আসতে দেখলেই সে চীৎকার করে বলে উঠতো لامِسَاسَ ‘আমাকে কেউ স্পর্শ করো না বস্ত্ততঃ মৃত্যুদন্ডের চাইতে এটিই ছিল কঠিন শাস্তি। যা দেখে অপরের শিক্ষা হয়। বলা বাহুল্য, আজও ভারতবর্ষের হিন্দুদের মধ্যে গো-মাতার পূজা অব্যাহত রয়েছে। যদিও উদারমনা উচ্চ শিক্ষিত হিন্দুগণ ক্রমেই অলীক বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং গাভীকে দেবী নয় বরং মানুষের ব্যবহারযোগ্য খাদ্যযোগ্য প্রাণী হিসাবে বিশ্বাস করেন

কুরতুবী বলেন, এর মধ্যে দলীল রয়েছে বিষয়ে যে, বিদআতী পাপাচারী ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা যরূরী। তাদের সঙ্গে কোনরূপ মেলামেশা আদান-প্রদান না করাই কর্তব্য। যেমন আচরণ শেষনবী (ছাঃ) জিহাদ থেকে পিছু হটা মদীনার তিনজন ধনীলোকের সাথে (তাদের তওবা কবুলের আগ পর্যন্ত) করেছিলেন (কুরতুবী)

() আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার যিদ তার পরিণতি :

মূসা (আঃ) তূর পাহাড়ে তওরাৎ প্রাপ্ত হয়ে বনু ইস্রাঈলের কাছে ফিরে এসে তা পেশ করলেন এবং বললেন যে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব। তোমরা এর অনুসরণ কর। তখন কিছু সংখ্যক উদ্ধত লোক বলে উঠলো, যদি আল্লাহ স্বয়ং আমাদের বলে দেন যে, এটি তাঁর প্রদত্ত কিতাব, তাহলেই কেবল আমরা বিশ্বাস করব, নইলে নয়। হতে পারে তুমি সেখানে চল্লিশ দিন বসে বসে এটা নিজে লিখে এনেছ। তখন মূসা (আঃ) আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে তাঁর সাথে তূর পাহাড়ে যেতে বললেন। বনু ইস্রাঈলরা তাদের মধ্যে বাছাই করা সত্তর জনকে মনোনীত করে মূসা (আঃ)-এর সাথে তূর পাহাড়ে প্রেরণ করল। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহর বাণী স্বকর্ণে শুনতে পেল। এরপরেও তাদের অবাধ্য মন শান্ত না। শয়তানী ধোঁকায় পড়ে তারা নতুন এক অজুহাত তুলে বলল, এগুলো আল্লাহর কথা না অন্য কারু কথা, আমরা বুঝবো কিভাবে? অতএব যতক্ষণ আমরা তাঁকে সশরীরে প্রকাশ্যে আমাদের সম্মুখে না দেখব, ততক্ষণ আমরা বিশ্বাস করব না যে, এসব আল্লাহর বাণী। কিন্তু যেহেতু পার্থিব জগতে চর্মচক্ষুতে আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা কারু নেই, তাই তাদের এই চরম ধৃষ্টতার জবাবে আসমান থেকে ভীষণ এক নিনাদ এল, যাতে সব নেতাগুলোই চোখের পলকে অক্কা পেল

অকস্মাৎ এমন ঘটনায় মূসা (আঃ) বিস্মিত ভীত-বিহবল হয়ে পড়লেন। তিনি প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! এমনিতেই ওরা হঠকারী। এরপরে এদের এই মৃত্যুতে লোকেরা আমাকেই দায়ী করবে। কেননা মূল ঘটনার সাক্ষী কেউ থাকল না আমি ছাড়া। অতএব হে আল্লাহ! ওদেরকে পুনর্জীবন দান কর। যাতে আমি দায়মুক্ত তে পারি এবং ওরাও গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। আল্লাহ মূসার দো কবুল করলেন এবং ওদের জীবিত করলেন। ঘটনা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে-

وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَى لَن نُّؤْمِنَ لَكَ حَتَّى نَرَى اللهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنتُمْ تَنظُرُونَ- ثُمَّ بَعَثْنَاكُم مِّن بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ- (البقرة ৫৫-৫৬)-

আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা! কখনোই আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তখন তোমাদেরকে পাকড়াও করল এক ভীষণ নিনাদ (বজ্রপাত), যা তোমাদের চোখের সামনেই ঘটেছিলঅতঃপর তোমাদের মৃত্যুর পর আমরা তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (বাক্বারাহ /৫৫-৫৬)

() বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের নির্দেশ :

সাগরডুবি থেকে মুক্তি পাবার পর তে সিনাই উপত্যকা পেরিয়ে তূর পাহাড়ে পৌঁছা পর্যন্ত সময়কালে মূর্তিপূজার আবদার, গো-বৎস পূজা তার শাস্তি, তওরাৎ লাভ তা মানতে অস্বীকার এবং তূর পাহাড় উঠিয়ে ভয় প্রদর্শন, আল্লাহ্কে স্বচক্ষে দেখার যিদ তার পরিণতি প্রভৃতি ঘটনা সমূহের পর এবার তাদের মূল গন্তব্যে যাত্রার জন্য আদেশ করা

অবাধ্য জাতিকে তাদের আদি বাসস্থানে রওয়ানার প্রাক্কালে মূসা (আঃ) তাদেরকে দূরদর্শিতাপূর্ণ উপদেশবাণী শুনান এবং যেকোন বাধা সাহসের সাথে অতিক্রম করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। সাথে সাথে তিনি তাদেরকে বিগত দিনে আল্লাহর অলৌকিক সাহায্য লাভের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অভয়বাণী শুনান। যেমন আল্লাহর ভাষায়,

وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ اذْكُرُوْا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَعَلَ فِيْكُمْ أَنبِيَاءَ وَجَعَلَكُمْ مُلُوْكاً وَآتَاكُمْ مَّا لَمْ يُؤْتِ أَحَداً مِّنَ الْعَالَمِيْنَ- يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِيْ كَتَبَ اللهُ لَكُمْ وَلاَ تَرْتَدُّوْا عَلَى أَدْبَارِكُمْ فَتَنْقَلِبُوْا خَاسِرِيْنَ- (المائدة ২০-২১)-

আর যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহরাজি স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে নবীগণকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে এমন সব বস্ত্ত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননিহে আমার সম্প্রদায়! পবিত্র ভূমিতে (বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরে) প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর তোমরা পশ্চাদদিকে প্রত্যাবর্তন করবে না। তাতে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (মায়েদাহ /২০-২১)

পরবর্তী অংশ পড়ুন: হযরত মূসা হারূণ (:) –

No comments

Powered by Blogger.