হযরত লূত (আঃ) এর জীবনী

হযরত লূত (আঃ) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ভাতিজা চাচার সাথে তিনিও জন্মভূমিবাবেলশহর থেকে হিজরত করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেনআনে চলে আসেন আল্লাহ লূত (আঃ)-কে নবুঅত দান করেন এবং কেনআন থেকে অল্প দূরে জর্ডান বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তীসাদূমঅঞ্চলের অধিবাসীদের পথ প্রদর্শনের জন্য প্রেরণ করেন এলাকায় সাদূম, আমূরা, দূমা, ছাবাহ ছাওয়াহ [1] নামে বড় বড় পাঁচটি শহর ছিল কুরআন মজীদ বিভিন্ন স্থানে এদের সমষ্টিকেমুতাফেকাহ’ (নাজম ৫৩/৫৩) বামুতাফেকাত’ (তওবাহ /৭০, হাক্বক্বাহ ৬৯/) শব্দে বর্ণনা করেছে যার অর্থজনপদ উল্টানো শহরগুলি পাঁচটি শহরের মধ্যে সাদূম (سدوم)  ছিল সবচেয়ে বড় এবং সাদূমকেই রাজধানী মনে করা হযরত লূত (আঃ) এখানেই অবস্থান করতেন এখানকার ভূমি ছিল উর্বর শস্য-শ্যামল এখানে সর্বপ্রকার শস্য ফলের প্রাচুর্য ছিল এসব ঐতিহাসিক তথ্য বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছেসাদূমসম্পর্কে সকলে একমত বাকী শহরগুলির নাম কি, সেগুলির সংখ্যা তিনটি, চারটি না ছয়টি, সেগুলিতে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা কয়শত, কয় হাযার বা কয় লাখ ছিল, সেসব বিষয়ে মতভেদ রয়েছে এগুলি ইস্রাঈলী বর্ণনা, যা কেবল ইতিহাসের বস্ত্ত হিসাবে গ্রহণ করা যায় কুরআন হাদীছে শুধু মূল বিষয়বস্ত্তর বর্ণনা এসেছে, যা মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়

উল্লেখ্য যে, লূত (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৫টি সূরায় ৮৭টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[2]

লূত (আঃ)-এর দাওয়াত :

লূত (আঃ)-এর কওম আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে শিরক কুফরীতে লিপ্ত হয়েছিল। দুনিয়াবী উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হওয়ার কারণে তারা সীমা লঙ্ঘনকারী জাতিতে পরিণত হয়েছিল। পূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ন্যায় তারা চূড়ান্ত বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। অন্যায়-অনাচার নানাবিধ দুষ্কর্ম তাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি পুংমৈথুন বা সমকামিতার মত নোংরামিতে তারা লিপ্ত হয়েছিল, যা ইতিপূর্বেকার কোন জাতির মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়নি। জন্তু-জানোয়ারের চেয়ে নিকৃষ্ট হঠকারী এই কওমের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ লূত (আঃ)-কে প্রেরণ করলেন। কুরআনে লূতকেতাদের ভাই’ (শোআরা ২৬/১৬১) বলা লেও তিনি ছিলেন সেখানে মুহাজির। নবী উম্মতের সম্পর্কের কারণে তাঁকেতাদের ভাইবলা হয়েছে। তিনি এসে পূর্বেকার নবীগণের ন্যায় প্রথমে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে বললেন,

إِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ أَمِيْنٌ، فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيْعُوْنِ، وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، (الشعراء ১৬২-১৬৪)-

আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি এর জন্য তোমাদের নিকটে কোনরূপ প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো বিশ্বপ্রভু আল্লাহ দিবেন’ (শোআরা ২৬/১৬২-১৬৫) অতঃপর তিনি তাদের বদভ্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেনأَتَأْتُوْنَ الذُّكْرَانَ مِنَ الْعَالَمِيْنَ- ‘বিশ্ববাসীর মধ্যে কেন তোমরাই কেবল পুরুষদের নিকটে (কুকর্মের উদ্দেশ্যে- রাফ /৮১) এসে থাক’? ‘আর তোমাদের স্ত্রীগণকে বর্জন কর, যাদেরকে তোমাদের জন্য তোমাদের পালনকর্তা সৃষ্টি করেছেন? নিঃসন্দেহে তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়’ (শোআরা ২৬/১৬৫-১৬৬) জবাবে কওমের নেতারা বলল,

لَئِن لَّمْ تَنتَهِ يَا لُوْطُ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُخْرَجِيْنَ، قَالَ إِنِّيْ لِعَمَلِكُم مِّنَ الْقَالِيْنَ- (الشعراء ১৬৭-১৬৮)-

হে লূত! যদি তুমি (এসব কথাবার্তা থেকে) বিরত না হও, তাহলে তুমি অবশ্যই বহিষ্কৃত হবে তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের এইসব কাজকে ঘৃণা করি’ (শোআরা ২৬/১৬৭-১৬৮) তিনি তাদের তিনটি প্রধান নোংরামির কথা উল্লেখ করে বলেন,

وَلُوْطاً إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ إِنَّكُمْ لَتَأْتُوْنَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ الْعَالَمِينَ، أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُوْنَ الرِّجَالَ وَتَقْطَعُوْنَ السَّبِيْلَ وَتَأْتُوْنَ فِيْ نَادِيْكُمُ الْمُنْكَرَ فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلاَّ أَنْ قَالُوا ائْتِنَا بِعَذَابِ اللَّهِ إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ، قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِيْنَ- (العنكبوت ২৮-৩০)-

তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ কখনো করেনিতোমরা কি পুংমৈথুনে লিপ্ত আছ, রাহাজানি করছ এবং নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে গর্হিত কর্ম করছ’? জবাবে তাঁর সম্প্রদায় কেবল একথা বলল যে, আমাদের উপরে আল্লাহর গযব নিয়ে এসো, যদি তুমি সত্যবাদী হও তিনি তখন বললেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! এই দুষ্কৃতিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তুমি আমাকে সাহায্য কর’ (আনকাবূত ২৯/২৮-৩০; রাফ /৮০)

লূত (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :

নিজ কওমের প্রতি হযরত লূত (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি মর্মান্তিক রূপে প্রতিভাত হয়। তারা এতই হঠকারী নিজেদের পাপকর্মে অন্ধ নির্লজ্জ ছিল যে, তাদের কেবল একটাই জবাব ছিল, তুমি যে গযবের ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি? কিন্তু কোন নবীই স্বীয় কওমের ধ্বংস চান না। তাই তিনি ছবর করেন তাদেরকে বারবার উপদেশ দিতে থাকেন। তখন তারা অধৈর্য হয়ে বলে যে,أَخْرِجُوْهُم مِّنْ قَرْيَتِكُمْ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَّتَطَهَّرُوْنَ- ‘এদেরকে তোমাদের শহর থেকে বের করে দাও। এই লোকগুলি সর্বদা পবিত্র থাকতে চায়’ (রাফ /৮২; নমল ২৭/৫৬) তারা আল্লাহভীতি থেকে বেপরওয়া হয়ে অসংখ্য পাপকর্মে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। কুরআন তাদের তিনটি প্রধান পাপ কর্মের উল্লেখ করেছে। () পুংমৈথুন () রাহাজানি এবং () প্রকাশ্য মজলিসে কুকর্ম করা (আনকাবূত ২৯/২৯)

বলা বাহুল্য, সাদূমবাসীদের পূর্বে পৃথিবীতে কখনো এরূপ কুকর্ম কেউ করেছে বলে শোনা যায়নি। এমনকি অতি বড় মন্দ নোংরা লোকদের মধ্যেও কখনো এরূপ নিকৃষ্টতম চিন্তার উদ্রেক হয়নি। উমাইয়া খলীফা অলীদ ইবনে আবদুল মালেক (৮৬-৯৭/৭০৫-৭১৬ খৃঃ) বলেন, কুরআনে লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের ঘটনা উল্লেখ না থাকলে আমি কল্পনাও করতে পারতাম না যে, কোন মানুষ এরূপ নোংরা কাজ করতে পারে[3] তাদের এই দুষ্কর্মের বিষয়টি দুটি কারণে ছিল তুলনাহীন। এক- কুকর্মের কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না এবং একাজ সম্পূর্ণ নতুনভাবে তারা চালু করেছিল। দুই- কুকর্ম তারা প্রকাশ্য মজলিসে করত, যা ছিল বেহায়াপনার চূড়ান্ত রূপ

বস্ত্ততঃ মানুষ যখন দেখে যে, সে কারু মুখাপেক্ষী নয়, তখন সে বেপরওয়া হয়’ (আলাক্ব ৯৬/-) সাদূমবাসীদের জন্য আল্লাহ স্বীয় নেমত সমূহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তার শুকরিয়া আদায় না করে কুফরী করে এবং ধনৈশ্বর্যের নেশায় মত্ত হয়ে বিলাস-ব্যসন, কাম-প্রবৃত্তি লোভ-লালসার জালে এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ে যে, লজ্জা-শরম ভাল-মন্দের স্বভাবজাত পার্থক্যবোধটুকুও তারা হারিয়ে ফেলে। তারা এমন প্রকৃতি বিরুদ্ধ নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়, যা হারাম কবীরা গোনাহ তো বটেই, কুকুর-শূকরের মত নিকৃষ্ট জন্তু-জানোয়ারও এর নিকটবর্তী হয় না। তারা এমন বদ্ধ নেশায় মত্ত হয় যে, লূত (আঃ)-এর উপদেশবাণী আল্লাহর গযবের ভীতি প্রদর্শন তাদের হৃদয়ে কোন রেখাপাত করেনি। উল্টা তারা তাদের নবীকেই শহর থেকে বের করে দেবার হুমকি দেয় এবং বলে যে, ‘তোমার  প্রতিশ্রুত আযাব এনে দেখাও, যদি তুমি সত্যবাদী হও’ (&আনকাবূত ২৯/২৯) তখন লূত (আঃ) বিফল মনোরথ হয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করলেন। ফলে যথারীতি গযব নেমে এল। উল্লেখ্য যে, বর্তমান বিশ্বে মহামারী আকারে যে মরণ ব্যাধি এইড্সের বিস্তৃতি ঘটেছে, তার মূল কারণ পুংমৈথুন, পায়ু মৈথুন সমকামিতা। ইসলামী শরীআতে এই কুকর্মের একমাত্র শাস্তি উভয়ের মৃত্যুদন্ড (যদি উভয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে একাজ করে)[4]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেনملعونٌ منْ عَمِلَ عَمَلَ قومِ لوط অভিশপ্ত ব্যক্তি, যে লূতের কওমের মত কুকর্ম করে।[5] অন্যত্র তিনি বলেনلاينظرُ اللهُ عزَّ وجلَّ إِلى رجلٍ أتى رجُلاً أو امرأةً فى دُبرها আল্লাহ তাআলা ব্যক্তির প্রতি ফিরে তাকাবেন না, যে ব্যক্তি কোন পুরুষ বা নারীর মলদ্বারে মৈথুন করে[6] তিনি বলেনإِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِى عَمَلُ قَوْمِ لُوطٍ আমি আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে (ক্ষতিকর হিসাবে) ভয় পাই লূত জাতির কুকর্মের[7] এইড্সের আতংকে ভয়ার্ত মানবজাতি শেষনবীর উক্ত বাণীগুলির প্রতি দৃষ্টি দিবে কি?

গযবের বিবরণ :

আল্লাহর হুকুমে কয়েকজন ফেরেশতা মানুষের রূপ ধারণ করে প্রথমে হযরত ইবরাহীমের বাড়ীতে পদার্পণ করলেন। তিনি তাদেরকে মেহমানদারীর জন্য একটা আস্ত বাছুর গরু যবেহ করে ভুনা করে তাদের সামনে পরিবেশন করলেন। কিন্তু তারা তাতে হাত দিলেন না। এতে ইবরাহীম (আঃ) ভয় পেয়ে গেলেন (হূদ ১১/৬৯-৭০) কেননা এটা সময়কার দস্যু-ডাকাতদেরই স্বভাব ছিল যে, তারা যে বাড়ীতে ডাকাতি করত বা যাকে খুন করতে চাইত, তার বাড়ীতে খেত না। ফেরেশতাগণ নবীকে অভয় দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমরা এসেছি অমুক শহরগুলি ধ্বংস করে দিতে। ইবরাহীম একথা শুনে তাদের সাথেতর্ক জুড়ে দিলেন’ (হূদ ১১/৭৪) এবং বললেন, ‘সেখানে যে লূত আছে। তারা বললেন, সেখানে কারা আছে, আমরা তা ভালভাবেই জানি। আমরা অবশ্যই তাকে তার  পরিবারকে রক্ষা করব, তবে তাঁর স্ত্রী ব্যতীত। সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আনকাবূত ২৯/৩১-৩২) অতঃপর তারা ইবরাহীম দম্পতিকে ইসহাক-এর জন্মের সুসংবাদ শুনালেন

বিবি সারা ছিলেন নিঃসন্তান। অতি বৃদ্ধ বয়সে এই সময় তাঁকে হযরত ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় ইসহাকের পরে তার ঔরসে যে ইয়াকূবের জন্ম হবে সেটাও জানিয়ে দেওয়া  (হূদ ১১/৭১-৭২) উল্লেখ্য যে, ইয়াকূবের অপর নাম ছিলইস্রাঈলএবং তাঁর বংশধরগণকে বনু ইস্রাঈল বলা হয়। যে বংশে হাযার হাযার নবীর আগমন ঘটে

কেনআনে ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট থেকে বিদায় হয়ে ফেরেশতাগণ সাদূম নগরীতেলূত (আঃ)-এর গৃহে উপস্থিত লেন’ (হিজর ১৫/৬১) সময় তাঁরা অনিন্দ্য সুন্দর নওজোয়ান রূপে আবির্ভূত হন। কেননা আল্লাহ তাআলা যখন কোন জাতিকে ধ্বংস করেন, তখন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের পরীক্ষা নেন। সাদূম জাতি তাদের এই চূড়ান্ত পরীক্ষায় ব্যর্থকাম ল। তারা যখন জানতে পারল যে, লূত-এর বাড়ীতে অতীব সুদর্শন কয়েকজন নওজোয়ান এসেছে, ‘তখন তারা খুশীতে  আত্মহারা হয়ে সেদিকে ছুটে এল’ (হূদ ১১/৭৮) দৃশ্য দেখে লূত (আঃ) তাদেরকে অনুরোধ করে বললেনفَاتَّقُوا اللهَ وَلاَ تُخْزُوْنِ فِيْ ضَيْفِي أَلَيْسَ مِنْكُمْ رَجُلٌ رَشِيْدٌ-   ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। অতিথিদের ব্যাপারে তোমরা আমাকে লজ্জিত করো না। তোমাদের মধ্যে কি একজনও ভাল মানুষ নেই’? (হূদ ১১/৭৮) কিন্তু তারা কোন কথাই শুনলো না। তারা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢোকার উপক্রম করল। লূত (আঃ) বললেন, হায়وَقَالَ هَـذَا يَوْمٌ عَصِيْبٌ- ‘আজকে আমার জন্য বড়ই সংকটময় দিন’ (হূদ ১১/৭৭) তিনি বললেনلَوْ أَنَّ لِيْ بِكُمْ قُوَّةً أَوْ آوِي إِلَى رُكْنٍ شَدِيْدٍ- ‘হায়! যদি তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন শক্তি থাকত, অথবা আমি কোন সুদৃঢ় আশ্রয় পেতাম’ (হূদ ১১/৮০) এবার ফেরেশতাগণ আত্মপরিচয় দিলেন এবং লূতকে অভয় দিয়ে বললেনيَا لُوْطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَنْ يَّصِلُوْا إِلَيْكَ ‘হে লূত! আমরা আপনার প্রভুর প্রেরিত ফেরেশতা। ওরা কখনোই আপনার নিকটে পৌঁছতে পারবে না’ (হূদ ১১/৮১)

এজন্যেই আমাদের রাসূল (ছাঃ) বলেনيَرْحَمُ اللَّهُ لُوطًا ، لَقَدْ كَانَ يَأْوِى إِلَى رُكْنٍ شَدِيدٍ ‘আল্লাহ রহম করুন লূতের উপরে, তিনি সুদৃঢ় আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন’ (অর্থাৎ আল্লাহর আশ্রয়)[8] অতঃপর জিবরীল তাদের দিকে পাখার ঝাপটা মারতেই বীর পুঙ্গরেরা সব অন্ধ হয়ে ভেগে গেল। আল্লাহ বলেনوَلَقَدْ رَاوَدُوْهُ عَنْ ضَيْفِهِ فَطَمَسْنَا أَعْيُنَهُمْ فَذُوقُوا عَذَابِيْ وَنُذُرِ، ‘ওরা লূতের কাছে তার মেহমানদের দাবী করেছিল। তখন আমি তাদের দৃষ্টি বিলুপ্ত করে দিলাম। অতএব আস্বাদন কর আমার শাস্তি হুঁশিয়ারী’ (ক্বামার ৫৪/৩৭)

অতঃপর ফেরেশতাগণ হযরত লূত (আঃ)-কে স্বীয় পরিবারবর্গসহ (ক্বামার ৫৪/৩৪) ‘কিছু রাত থাকতেইএলাকা ত্যাগ করতে বললেন এবং বলে দিলেন যেনকেউ পিছন ফিরে না দেখে। তবে আপনার বৃদ্ধা স্ত্রী ব্যতীত নিশ্চয়ই তার উপর গযব আপতিত হবে, যা ওদের উপরে হবে। ভোর পর্যন্তই ওদের মেয়াদ। ভোর কি খুব নিকটে নয়’? (হূদ ১১/৮১; শোআরা ২৬/১৭১) লূত (আঃ)-এর স্ত্রী ঈমান আনেননি এবং হয়তবা স্বামীর সঙ্গে রওয়ানাই হননি। তারা আরও বললেনوَاتَّبِعْ أَدْبَارَهُمْ وَلاَ يَلْتَفِتْ مِنْكُمْ أَحَدٌ وَامْضُوْا حَيْثُ تُؤْمَرُونَ- ‘আপনি তাদের পিছে অনুসরণ করুন। আর কেউ যেন পিছন ফিরে না তাকায়। আপনারা আপনাদের নির্দেশিত স্থানে চলে যান’ (হিজর ১৫/৬৫) এখানে আল্লাহ লূতকে হিজরতকারী দলের পিছনে থাকতে বলা হয়েছে। বস্ত্ততঃ এটাই নেতার কর্তব্য

অতঃপর আল্লাহর হুকুমে অতি প্রত্যুষে গযব কার্যকর হয়। লূত তাঁর সাথীগণ যখন নিরাপদ দূরত্বে পৌছেন, তখন জিবরীল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ছুবহে ছাদিক-এর সময় একটি প্রচন্ড নিনাদের মাধ্যমে তাদের শহরগুলিকে উপরে উঠিয়ে উপুড় করে ফেলে দিলেন এবং সাথে সাথে প্রবল বেগে ঘুর্ণিবায়ুর সাথে প্রস্তর বর্ষণ শুরু হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا جَاء أَمْرُنَا جَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهَا حِجَارَةً مِّن سِجِّيلٍ مَّنضُودٍ، مُّسَوَّمَةً عِندَ رَبِّكَ وَمَا هِيَ مِنَ الظَّالِمِيْنَ بِبَعِيدٍ- (هود ৮২-৮৩)-

অবশেষে যখন আমাদের হুকুম এসে পৌঁছল, তখন আমরা উক্ত জনপদের উপরকে নীচে করে দিলাম এবং তার উপরে ক্রমাগত ধারায় মেটেল প্রস্তর বর্ষণ করলামযার প্রতিটি তোমার প্রভুর নিকটে চিহ্নিত ছিল। আর ধ্বংসস্থলটি (বর্তমান আরবীয়) যালেমদের থেকে বেশী দূরে নয়’           (হূদ ১১/৮২-৮৩)

এটা ছিল তাদের কুকর্মের সাথে সামঞ্জস্যশীল শাস্তি। কেননা তারা যেমন আল্লাহর আইন প্রাকৃতিক বিধানকে উল্টিয়েছিল অর্থাৎ স্ত্রীসঙ্গ বাদ দিয়ে মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে পুংমৈথুনে সমকামিতায় লিপ্ত হয়েছিল, ঠিক তেমনি তাদেরকে মাটি উল্টিয়ে উপুড় করে শাস্তি দেওয়া

ডঃ জামু বলেন, তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন আকারের এক হাযার উল্কাপিন্ড সংগ্রহ করেন। তন্মধ্যে  সবচেয়ে বড়টির ওযন ছিল ৩৬ টন। এর মধ্যে অনেকগুলি আছে নুড়ি পাথর, যাতে গ্রানাইট কাঁচা অক্সাইড লৌহ মিশ্রিত। তাতে লাল বর্ণের চিহ্ন অংকিত ছিল এবং ছিল তীব্র মর্মভেদী। বিস্তর গবেষণার পরে স্থির হয় যে, এগুলি সেই প্রস্তর, যা লূত জাতির উপরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল’ (সংক্ষেপায়িত)[9] ইতিহাস-বিজ্ঞান বলে, সাদূম আমুরার উপরে গন্ধক (Sulpher)-এর আগুন বর্ষিত হয়েছিল।[10]

হযরত লূত (আঃ)-এর নাফরমান কওমের শোচনীয় পরিণতি বর্ণনা করার পর দুনিয়ার অপরাপর জাতিকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ পাক এরশাদ করেনوَمَا هِىَ مِنَ الظَّلِمِيْنَ بِبَعِيْدٍ، ‘(জনপদ উল্টানো প্রস্তর বর্ষণে নিশ্চিহ্ন ধ্বংসস্থলটি) বর্তমান কালের যালেমদের থেকে খুব বেশী দূরে নয়’ (হূদ ১১/৮৩) মক্কার কাফেরদের জন্য উক্ত ঘটনাস্থল ঘটনার সময়কাল খুব বেশী দূরের ছিল না। মক্কা থেকে ব্যবসায়িক সফরে সিরিয়া যাতায়াতের পথে সর্বদা সেগুলো তাদের চোখে পড়ত। কিন্তু তা থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করতো না। বরং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে অবিশ্বাস করত তাঁকে অমানুষিক কষ্ট দিত। আনাস (রাঃ) তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

إذا استحلت أمتي خمسا فعليهم الدمار: إذا ظهر التلاعن وشربوا الخمور ولبسوا الحرير واتخذوا القيان واكتفى الرجال بالرجال والنساء بالنساء، رواه البيهقي-

যখন আমার উম্মত পাঁচটি বিষয়কে হালাল করে নেবে, তখন তাদের উপর ধ্বংস নেমে আসবে। () যখন পরস্পরে অভিসম্পাৎ ব্যাপক হবে () যখন তারা মদ্যপান করবে () রেশমের কাপড় পরিধান করবে () গায়িকা-নর্তকী গ্রহণ করবে () পুরুষ-পুরুষে নারী-নারীতে সমকামিতা করবে[11]

ধ্বংসস্থলের বিবরণ :

কওমে লূত-এর বর্ণিত ধ্বংসস্থলটি বর্তমানেবাহরে মাইয়েতবাবাহরে লূতঅর্থাৎমৃত সাগরবালূত সাগরনামে খ্যাত। যা ফিলিস্তীন জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিশাল অঞ্চল জুড়ে নদীর রূপ ধারণ করে আছে।[12] যেটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ নীচু। এর পানিতে তৈলজাতীয় পদার্থ বেশী। এতে কোন মাছ, ব্যাঙ এমনকি  কোন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। কারণেই একেমৃত সাগরবামরু সাগরবলা হয়েছে। সাদূম উপসাগর বেষ্টক এলাকায় এক প্রকার অপরিচিত বৃক্ষ উদ্ভিদের বীজ পাওয়া যায়, সেগুলো মাটির স্তরে স্তরে সমাধিস্থ হয়ে আছে। সেখানে শ্যামল-তাজা উদ্ভিদ পাওয়া যায়, যার ফল কাটলে তার মধ্যে পাওয়া যায় ধূলি-বালি ছাই। এখানকার মাটিতে প্রচুর পরিমাণে গন্ধক পাওয়া যায়। Natron পেট্রোল তো আছেই। এই গন্ধক উল্কা পতনের অকাট্য প্রমাণ।[13] আজকাল সেখানে সরকারী প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ তে পর্যটকদের জন্য আশপাশে কিছু হোটেল-রেস্তোঁরা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা থেকে শিক্ষা হাছিলের জন্য কুরআনী তথ্যাদি উপস্থাপন করে বিভিন্ন ভাষায় উক্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করে তা থেকে উপদেশ গ্রহণের জন্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই সবচাইতে যরূরী বিষয়। আজকের এইড্স আক্রান্ত বিশ্বের নাফরমান রাষ্ট্রনেতা, সমাজপতি বিলাসী ধনিক শ্রেণী তা থেকে শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম ত। কেননা এগুলি মূলতঃ মানুষের জন্য শিক্ষাস্থল হিসাবে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 إِنَّ فِىْ ذَالِكَ لَآيَاتٍ لِّلْمُتَوَسِّمِيْنَ، … إِنَّ فِىْ ذَلِكَ لَاَيَةً لِّلْمُؤْمِنِيْنَ-

নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন সমূহ রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য’ … এবং বিশ্বাসীদের জন্য’ (হিজর ১৫/৭৫, ৭৭) একই ঘটনা বর্ণনা শেষে অন্যত্র তিনি বলেনوَلَقَدْ تَّرَكْنَا مِنْهَآ آيَةً بَيِّنَةً لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ- ‘জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আমরা অত্র ঘটনার মধ্যে স্পষ্ট নিদর্শন রেখে দিয়েছি’ (আনকাবূত ২৯/৩৫)

মুক্তিপ্রাপ্ত লোকদের সংখ্যা :

তখন উক্ত জনপদে লূত-এর পরিবারটি ব্যতীত মুসলমান ছিল না। আল্লাহ বলেনفَمَا وَجَدْنَا فِيْهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِّنَ الْمُسْلِمِيْنَ- ‘আমরা সেখানে একটি বাড়ী ব্যতীত কোন মুসলমান পাইনি’ (যারিয়াত ৫১/৩৬) কুরআনী বর্ণনা অনুযায়ী উক্ত গযব তে মাত্র লূত-এর পরিবারটি নাজাত পেয়েছিল। তাঁর স্ত্রী ব্যতীত’ (রাফ /৮৩) তাফসীরবিদগণ বলেন, লূত-এর পরিবারের মধ্যে কেবল তাঁর দুমেয়ে মুসলমান হয়েছিল। তবে লূত-এর কওমের  নেতারা লূত-কে সমাজ থেকে বের করে দেবার যে হুমকি দেয়, সেখানে তারা বহুবচন ব্যবহার করে বলেছিল أَخْرِجُوْهُم مِّن قَرْيَتِكُمْ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَّتَطَهَّرُونَ. ‘এদেরকে তোমাদের শহর থেকে বের করে দাও। কেননা এই লোকগুলি সর্বদা পবিত্র থাকতে চায়’ (রাফ /৮২; নমল ২৭/৫৬) এতদ্ব্যতীত শহর থেকে বের হবার সময় আল্লাহ লূতকেসবার পিছনেথাকতে বলেন (হিজর ১৫/৬৫) অন্যত্র বলা হয়েছে  فَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ أَجْمَعِينَ ‘অতঃপর আমরা তাকে তার পরিবার সবাইকে নাজাত দিলাম’ (শোআরা ২৬/১৭০) এখানে أجمعين বাসবাইকেশব্দের মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ঈমানদারগণের সংখ্যা বেশ কিছু ছিল। অতএব এখানে লূত-এর  ‘আহ্ল’ (রাফ ৮৩; হূদ ৮১; নমল ৫৭; ক্বামার ৩৪) বা পরিবার বলতে লূত-এর দাওয়াত কবুলকারী ঈমানদারগণকে সম্মিলিতভাবেআহলে ঈমানবাএকটি ঈমানদার পরিবারগণ্য করা যেতে পারে। তবে প্রকৃত ঘটনা যেটাই হৌক না কেন, কেবলমাত্র নবীর অবাধ্যতা করলেই আল্লাহর গযব আসাটা অবশ্যম্ভাবী। তার উপরে কেউ ঈমান  আনুক বা না আনুক। হাদীছে এসেছে, ‘ক্বিয়ামতের দিন অনেক  নবীর একজন উম্মতও থাকবে না[14] এখানে লক্ষণীয় যে, নবীপত্নী হয়েও  লূতের স্ত্রী গযব থেকে রেহাই পাননি। আল্লাহ নূহ পত্নী লূত পত্নীকে ক্বিয়ামতের দিন বলবেনوَقِيلَ ادْخُلاَ النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ، ‘যাও জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে চলে যাও’ (তাহরীম ৬৬/১০)

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

বান্দার প্রতিটি ভাল কিংবা মন্দ কর্ম আল্লাহর সরাসরি দৃষ্টিতে রয়েছে। বান্দার সৎকর্মে তিনি খুশী হন মন্দ কর্মে নাখোশ  হন

. নবী কিংবা সংস্কারক পাঠিয়ে উপদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আল্লাহ কোন অবাধ্য কওমকে ধ্বংসকারী আযাবে গ্রেফতার করেন না

. কওমের  নেতারা ধনিক শ্রেণী প্রথমে পথভ্রষ্ট হয় সমাজকে বিপথে নিয়ে যায়। তারা সর্বদা পূর্বেকার রীতি-নীতির দোহাই দেয় এবং তাদের হঠকারিতা অহংকারী কার্যকলাপের ফলেই আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে (ইসরা ১৭/১৬; যুখরুফ ৪৩/২৩) অতএব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সর্বদা দূরদর্শী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা আবশ্যক

. পুংমৈথুন বা পায়ুমৈথুন এমন একটি নিকৃষ্টতম স্বভাব, যা আল্লাহর ক্রোধকে  ত্বরান্বিত করে। ব্যক্তিগত এই কুকর্ম কেবল ব্যক্তিকেই ধ্বংস করে না, তা সমাজকে বিধ্বস্ত করে। বর্তমান এইড্স আক্রান্ত বিশ্ব তার বাস্তব প্রমাণ

. ঈমান না থাকলে কেবল বংশ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক মানুষকে আল্লাহর গযব থেকে মুক্তি দিতে পারে না। যেমন লূত (আঃ)-এর স্ত্রী গযব থেকে রক্ষা পাননি

লেখক: প্রফেসর . মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

No comments

Powered by Blogger.