আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) এর জীবনী
ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে সরাসরি অনেক কল্যাণকর বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কোন বিষয়ে তাঁদের ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে রাসূল (ছাঃ) তাদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিয়ে সঠিক পথ নির্দেশ করতেন, তাদের নিকটে বর্ণনা করতেন আমলের যথার্থ পদ্ধতি। আল্লাহর ভালবাসা অর্জনের মাধ্যমে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশের পথ দেখাতেন। সে যুগে ছাহাবায়ে কেরাম রাসূলের মুখ থেকে সরাসরি অহি-র বাণী শুনতে পেতেন।
বর্তমান যুগে আমরা মসির অাঁচড়ে কালো হরফে লিখিত গ্রন্থ অধ্যয়ন করে ছাহাবায়ে কেরামের জ্ঞানের কথা জানতে পারছি। অথচ তাঁদের সবাই রাসূলের নিকটে সার্বক্ষণিক অবস্থান করতেন না। কিন্তু যিনি রাসূলের সান্নিধ্যে অবস্থান করে তাঁর দশটি বছর খেদমতে অতিবাহিত করেছেন, তিনি কতটা জ্ঞান অর্জন করেছেন! জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি রাসূলের সাহচর্যে কাটিয়েছেন। ফলে তাঁর কর্মকান্ড নিকট থেকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁর থেকে জ্ঞান, শিষ্টাচার ও উপদেশমালা সরাসরি লাভ করেছেন জীবনের পরতে পরতে। দশটি বছর যিনি রাসূলের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন তিনি হ’লেন প্রখ্যাত ছাহাবী আনাস বিন মালিক (রাঃ)। এ নিবন্ধে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত আলোচনা করা হলো।-
নাম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর প্রকৃত নাম আনাস, কুনিয়াত বা উপনাম আবু হামযাহ মতান্তরে আবু ছুমামাহ। উপাধি হচ্ছে ‘খাদেমুর রাসূল’ (রাসূলের সেবক), ইমাম, মুফতী, ক্বারী, মুহাদ্দিছ প্রভৃতি।[1] তাঁর পিতার নাম মালেক ইবনুন নাযর এবং মাতার নাম উম্মু সুলাইম আল-গুমাইছা বিনতু মিলহান।[2] হাফেয ইবনু কাছীর তাঁর মাতার নাম বলেছেন, উম্মু হারাম মুলাইকা বিনতু মিলহান।[3] তিনি মদীনার প্রসিদ্ধ খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে আনাস ইবনু মালেক ইবনিন নাযর ইবনে যামযাম ইবনে যায়েদ ইবনে হারাম ইবনে জুনদুব ইবনে আমের ইবনে গানাম ইবনে আদী ইবনিন নাজ্জার।[4]
জন্ম ও শৈশব :
আনাস (রাঃ)-এর নির্দিষ্ট জন্ম তারিখ জানা যায় না। তবে তিনি বলেন, قَدِمَ النَّبِىُّ صـ الْمَدِينَةَ وَأَنَا ابْنُ عَشْرٍ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় আগমন করলেন তখন আমি দশ বছরের বালক’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, قَدِمَ
رَسُوْلُ اللهِ صـ الْمَدِينَةَ وَأَنَا ابْنُ ثَمَانِ سِنِيْنَ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় আগমনকালে আমি ছিলাম ৮ বছরের বালক’।[6] এ হিসাবে তিনি ৩ নববী বর্ষ মুতাবিক ৬১২ খ্রীষ্টাব্দে মতান্তরে ৫ নববী বর্ষ মুতাবিক ৬১৪ খ্রীষ্টাব্দে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমোক্ত মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ রাসূলের মদীনা আগমনকালে আনাস (রাঃ)-এর বয়স ছিল ১০ বছর।[7]
শৈশবেই তাঁর পিতা মালেক শত্রুর অতর্কিত আক্রমণে নিহত হন। ফলে আনাস (রাঃ) ইয়াতীম হয়ে যান।[8] অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় আসেন, তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে নীত হন। এরপর থেকে রাসূলের সান্নিধ্যে ও তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে আনাসের শৈশব অতিবাহিত হয়। তিনি রাসূলের দৃষ্টির সামনেই বেড়ে ওঠেন।
ইসলাম গ্রহণ :
ইসলাম আগমনের প্রাথমিক দিকেই আনাস (রাঃ)-এর মাতা উম্মু সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু তার স্বামী মালেক ছিলেন স্বীয় বাপ-দাদার ধর্মে। সে উম্মু সুলাইমের পূর্বের ধর্মে ফিরে আসা কামনা করত। উম্মু সুলাইম সচেতন ও জ্ঞানী মহিলা ছিলেন। তিনি ইসলামের উপরই অটল থাকেন এবং স্বীয় ইয়াতীম পুত্র আনাসকে ইসলামের শিক্ষা দেন। তাওহীদের দীক্ষা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অপরিসীম ভালবাসার বীজ আনাসের হৃদয়ে প্রোথিত করেন। ফলে তিনি রাসূলকে দেখার পূর্বেই তাঁর প্রতি অসীম মহববত পোষণ করতেন। ভাবতেন বড় হ’লে রাসূলের সাথে সাক্ষাতের জন্য মক্কায় গমন করবেন এবং তাঁর নিকটেই অবস্থান করবেন।[9]
রাসূলের খাদেম হিসাবে আনাস (রাঃ) :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় আগমন করলে আনাসের মাতা উম্মু সুলাইম মতান্তরে তার চাচা ও উম্মু সুলাইমের (২য়) স্বামী আবু ত্বালহা তাকে নিয়ে এসে বলেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ أَنَسًا غُلاَمٌ كَيِّسٌ، فَلْيَخْدُمْكَ ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আনাস চালাক-চতুর, বুদ্ধিমান ছেলে। সে আপনার খেদমত করবে’।[10] আনাস (রাঃ) বলেন, فَخَدَمْتُهُ فِى السَّفَرِ وَالْحَضَرِ ‘অতঃপর বাড়ীতে ও সফরে আমি তাঁর খেদমত করেছি’। আনাস (রাঃ)-কে তাঁর মা-খালাগণ রাসূলের খেদমত করার জন্য উৎসাহিত করতেন। যেমন তিনি বলেন, وَكُنَّ أُمَّهَاتِىْ يَحْثُثْنَنِى عَلَى خِدْمَتِهِ ‘আমার মা-খালাগণ আমাকে তাঁর সেবা করার জন্য প্রেরণা দিতেন’।[11] অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَكَانَ أُمَّهَاتِى يُوَاظِبْنَنِى عَلَى خِدْمَةِ النَّبِىِّ صـ ‘আমার মা-খালাগণ অবিরতভাবে আমাকে নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমত করার নির্দেশ দিতেন’।[12] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় আগমনের পর থেকে মৃত্যু অবধি আনাস (রাঃ) তাঁর খেদমত করেন। তিনি পূর্ণাঙ্গরূপে রাসূলের সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভ করেছেন।[13]
শিক্ষা-দীক্ষা :
আনাস (রাঃ) ১০ বছর বয়স থেকে ২০ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ তাঁর জীবনের কৈশোর থেকে যৌবনেরও একটি অংশ রাসূলের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। ফলে তিনি রাসূলের নিকট থেকে অশেষ জ্ঞানার্জন করেন।[14] তিনি রাসূলের নিকট থেকে হাদীছ শুনে তা লিখে রাখতেন এবং তাঁকে পুনরায় শুনাতেন।[15]
আনাসের জন্য রাসূলের দো‘আ :
মদীনায় হিজরত করার পর আনাস (রাঃ) মহানবী (ছাঃ)-এর নিকটে নীত হ’লেন। রাসূল (ছাঃ) তার জন্য দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ وَأَطِلْ حَيَاتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করে দাও এবং তার হায়াত বাড়িয়ে দাও’।[16]
অন্য বর্ণনায় আছে, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করে দাও’।[17] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) আনাসের জন্য এ দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ
ارْزُقْهُ مَالاً وَوَلَدًا وَبَارِكْ لَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে সম্পদ ও সন্তান দান কর এবং তাতে বরকত দান কর’।[18] অন্য হাদীছে এসেছে,اللَّهُمَّ
أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ، وَبَارِكْ لَهُ فِيْمَا أَعْطَيْتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দাও এবং তুমি তাকে যা দান করেছ তাতে বরকত দাও’।[19]
রাসূলের দো‘আর বরকত :
রাসূলের দো‘আ আনাস (রাঃ)-এর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার জন্য তিনটি দো‘আ করেছেন। এর মধ্যে দু’টির ফলাফল আমি দুনিয়াতেই পেয়েছি এবং আখিরাতে তৃতীয়টি পাওয়ার দৃঢ় প্রত্যাশা করি।[20]
অন্যত্র আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিকটে আসতেন। একদা তিনি আমাদের ঘরে আসলেন এবং আমাদের পরিবারের সকলের জন্য দো‘আ করলেন। তখন (আমার মা) উম্মু সুলাইম বললেন, আপনার এই ছোট্ট খাদেমটির জন্য দো‘আ করছেন না কেন? তখন তিনি এভাবে দো‘আ করলেন, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ وَأَطِلْ حَيَاتَهُ وَاغْفِرْ
لَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি করে দাও, তার হায়াত বাড়িয়ে দাও এবং তাকে ক্ষমা করে দাও’। তাঁর তিনটি দো‘আর ফল এভাবে প্রত্যক্ষ করেছি যে, একশত তিনটি সন্তানকে নিজ হাতে দাফন করেছি। আমার বাগানের ফসল বছরে দু’বার উঠানো হয় এবং আমার আয়ু এতই দীর্ঘ হয়েছে যে, অধিক বয়সের কারণে আমি রীতিমত লজ্জাবোধ করি। এখন (চতুর্থটি) মাগফিরাত আশা করছি’।[21]
অপর একটি হাদীছে এসেছে,আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিকটে আসলেন। এ সময় আমি, আমার মা ও আমার খালা উম্মু হারাম ব্যতীত কেউ ছিল না। আমার মা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার ছোট খাদেমের জন্য দো‘আ করুন। তখন রাসূল (ছাঃ) আমার জন্য সব ধরনের রকতের দো‘আ করলেন। তিনি আমার জন্য যে দো‘আ করেছিলেন, তার শেষে ছিল, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ وَبَارِكْ لَهُ فِيْهِ ‘হে আল্লাহ! তার সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দিন এবং তাতে বরকত দান করুন’।[22] আনাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! সে যুগে আমার সম্পদ ছিল প্রচুর এবং সন্তান ও নাতী-পোতার সংখ্যা ছিল একশ’র মত।[23]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল প্রকার কল্যাণের জন্য দো‘আ করলেন। তিনি বলেন, فَإِنِّىْ لَمِنْ أَكْثَرِ الأَنْصَارِ مَالاً ‘ফলে আমি আনছারদের মধ্যে ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলাম’।[24]
আনাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহ আমার সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি আমার আঙ্গুর গাছে বছরে দু’বার ফল আসত এবং আমার ঔরসজাত সন্তান হয়েছিল ১০৬ জন’।[25] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রাঃ)-এর একটি বাগান ছিল যাতে বছরে দু’বার ফল আসত। আর তাঁর বাগানে এমন ফুল ছিল যা থেকে মিশক আম্বরের সুগন্ধি ছড়াত।[26]
ইস্তি‘আব গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, আনাস (রাঃ)-এর ৮০ জন সন্তান ছিল। তন্মধ্যে ৭৮ জন ছেলে এবং হাফছাহ ও উম্মু আমর নামক ২ জন মেয়ে।[27] আবুল ইয়াকযান বলেন, প্লেগে আনাস (রাঃ)-এর ৮০ জন মতান্তরে ৭০ জন সন্তান মারা গিয়েছিল।[28] রাসূলের দো‘আর বরকতে আনাস (রাঃ) দীর্ঘ বয়স পেয়েছিলেন। তিনি ৯৬/৯৭ মতান্তরে ১০৩ বা ১০৭ বছরের দীর্ঘ জীবন লাভ করেন।[29]
রাসূল (ছাঃ)-এর গোপনীয় বিষয়ের হেফাযত :
মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কোন গোপনীয় কথা আনাস (রাঃ)-কে বললে তিনি তা প্রকাশ করতেন না; বরং গোপনই রাখতেন। যেমন তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার নিকটে আসলেন। আমি তখন বালকদের সাথে খেলায় লিপ্ত ছিলাম। তিনি আমাদেরকে সালাম দিলেন। অতঃপর আমাকে একটি বিশেষ প্রয়োজনে পাঠালেন। আমি আমার মায়ের নিকটে বিলম্বে ফিরে আসলাম। আমি মায়ের নিকটে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে একটি প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন, প্রয়োজনটি কি? আমি বললাম, সেটা গোপনীয়। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গোপনীয় বিষয় কখনও কাউকে বলবে না। আনাস বলেন, হে ছাবিত! সে গোপনীয় ব্যাপার কারও নিকট বললে তা তোমাকে অবশ্যই বলতাম।[30] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে আমার নিকট বলেছিলেন। তারপর আমি কারো নিকটে তা প্রকাশ করিনি। এমনকি (আমার মা) উম্মু সুলাইম (রাঃ) সে ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁকেও তা জানাইনি।[31]
জিহাদে অংশগ্রহণ :
আনাস (রাঃ) অনেক জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ৮টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।[32] তন্মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়, হুনায়েন ও তায়েফ উল্লেখযোগ্য।[33] তিনি রাসূলের সাথে বিদায় হজ্জ, ওমরা ও বায়‘আতে রিযওয়ানে শরীক হন।[34] তিনি বদর যুদ্ধে রাসূলের খাদেম হিসাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ইরানের প্রসিদ্ধ শহর তুসতার বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন।[35] তখন তিনি হুরমুযানকে নিয়ে ওমর (রাঃ)-এর নিকটে আসেন। অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ করে।[36]
পোশাক-পরিচ্ছদ :
আনাস (রাঃ) স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করতেন। তিনি জুববা ও নকশা করা চাদর ব্যবহার করতেন।[37] তিনি মাথায় কালো পাগড়ি ও হাতে আংটি পরতেন। পাগড়ির প্রান্ত পিছনের দিকে ঝুলিয়ে দিতেন।[38] তাঁর আংটিতে ‘মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ খোদাই করা ছিল। যখন তিনি পেশাব-পায়খানায় যেতেন, তখন তা খুলে রাখতেন।[39]
আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূল (ছাঃ)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও দৈহিক গুণাবলী :
ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আনাস (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একান্ত কাছের মানুষ। তিনি নিকট থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর বর্ণনায় রাসূলের অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। যেমন তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন, সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের মানুষ। একদা কোন এক কাজে আমাকে পাঠাতে চাইলেন। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি যাব না। কিন্তু আমার মনের মধ্যে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যে কাজের জন্য আমাকে আদেশ করেছেন, আমি সে কাজে অবশ্যই যাব। অতঃপর আমি বের হ’লাম এবং এমন কতিপয় বালকের নিকট এসে পৌঁছলাম যারা বাজারের মধ্যে খেলাধুলা করছিল। এমন সময় হঠাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পিছন হ’তে আমার ঘাড় চেপে ধরলেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি হাসছেন। তখন তিনি স্নেহের সুরে বললেন, হে উনাইস! আমি তোমাকে যে কাজের জন্য আদেশ করেছিলাম সেখানে কি তুমি গিয়েছিলে? আমি বললাম, ইয়া রাসূল্লাল্লাহ (ছাঃ)! এইতো আমি এক্ষণি যাচ্ছি।[40]
আনাস (রাঃ) বলেন, আমি একাধারে দশ বছর নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমত করেছি। কিন্তু তিনি কোন দিন ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত আমাকে বলেননি। এমনকি একাজটি কেন করেছ এবং তা কেন করনি- এমন কথাও কোন দিন বলেননি।[41]
তিনি আরো বলেন, আমার বয়স যখন আট বছর তখন রাসূল (ছাঃ)-এর খেদমতে যোগ দেই এবং দশ বছর যাবৎ তাঁর খেদমত করেছি। কোন সময় কোন জিনিস নষ্ট হয়ে গেলেও তিনি আমাকে কখনো তিরস্কার করেননি। যদি পরিবারবর্গের কেউ আমাকে তিরস্কার করতেন, তখন তিনি বলতেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা যা হওয়ার ছিল তা তো হবেই।[42]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন অসীম ধৈর্যের অধিকারী। যেমন আনাস (রাঃ) বলেন, একদা নবী করীম (ছাঃ) একটি নাজরানী চাদর গায়ে জড়িয়ে পথ চলছিলেন। পথিমধ্যে এক বেদুইন তার চাদর ধরে হেঁচকা টান দেয় ফলে তাঁর গলায় চাদরের টানের দাগ পড়ে যায়। এরপর ঐ বেদুইন বলল, হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! আল্লাহ তা‘আলার যে সকল সম্পদ আপনার হাতে আছে, তা হ’তে আমাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দিন। তখন নবী করীম (ছাঃ) তার দিকে ফিরে তাকালেন এবং হেসে ফেললেন। অতঃপর তাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দিলেন।[43]
রাসূলের চলাফেরা, শারীরিক বৈশিষ্ট্যও আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় উঠে এসেছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর (দেহের) চেয়ে অধিক সুগন্ধময় কোন মিসক আম্বর বা ভিন্ন কোন বস্ত্তর ঘ্রাণ আমি গ্রহণ করিনি এবং তাঁর (দেহের চেয়ে কোমল রেশম বা নরম বস্ত্র আমি স্পর্শ করিনি।[44] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন শুভ্র উজ্জ্বল বর্ণের। তাঁর ঘাম যেন মুক্তার ন্যায়। তিনি চলার সময় সম্মুখপানে ঝুঁকে চলতেন। আমি নরম কাপড় বা রেশমকেও তাঁর হাতের তালুর মত নরম পাইনি এবং মিসক আম্বরের মাঝেও তাঁর শরীরের চেয়ে অধিক সুগন্ধি পাইনি।[45]
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের গৃহে আসলেন এবং আরাম করলেন। তিনি ঘর্মাক্ত হ’লেন, আর আমার মা একটি ছোট বোতল নিয়ে রাসূলের ঘাম মুছে তাতে ভরতে লাগলেন। নবী করীম (ছাঃ) জাগ্রত হ’লেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, হে উম্মু সুলাইম! একি করছ? আমার মা বললেন, এ হচ্ছে আপনার ঘাম, যা আমরা সুগন্ধির সঙ্গে মেশাই, আর এতো সব সুগন্ধির সেরা সুগিন্ধ।[46]
অন্যত্র তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) উম্মু সুলাইমের গৃহে যেতেন এবং তার বিছানায় আরাম করতেন। আর উম্মু সুলাইমকে বলা হ’ল, নবী করীম (ছাঃ) তোমার গৃহে তোমার বিছানায় ঘুমিয়ে গেছেন। আনাস (রাঃ) বলেন, উম্মু সুলাইম গৃহে প্রবেশ করলেন, নবী করীম (ছাঃ) তখন ঘর্মাক্ত হয়েছেন, আর তাঁর ঘাম চামড়ার বিছানার উপর জমে গেছে, উম্মু সুলাইম তার কৌটা খুললেন এবং সে ঘাম মুছে মুছে ছোট একটি বোতলে ভরতে লাগলেন। নবী করীম (ছাঃ) হঠাৎ উঠে গেলেন এবং বললেন, হে উম্মু সুলাইম! তুমি কি করছ? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের শিশুদের জন্য তার বরকত নিচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ভাল করেছ।[47]
রাসূল (ছাঃ) হাসি-ঠাট্টাও করতেন। যেমন আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী করীম (ছাঃ) সবচেয়ে অধিক সদাচারী ছিলেন। আমার এক ভাই ছিল; তাকে আবূ ‘উমায়ের’ বলে ডাকা হ’ত। আমার ধারণা যে, সে তখন মায়ের দুধ খেতো না। যখনই সে তাঁর নিকট আসতো, তিনি বলতেন, হে আবূ ‘উমায়ের! কী করছে তোমার নুগায়ের? সে নুগায়র পাখিটা নিয়ে খেলতো। আর প্রায়ই যখন ছালাতের সময় হ’ত এবং তিনি আমার ঘরে থাকতেন, তখন তাঁর নীচে যে বিছানা থাকতো, একটু পানি ছিটিয়ে ঝেড়ে দেয়ার জন্য আমাদের আদেশ করতেন। তারপর তিনি ছালাতের জন্য দাঁড়াতেন এবং আমরাও তাঁর পেছনে দাঁড়াতাম। আর তিনি আমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করতেন।[48]
ছোট বড় কোন মানুষের সাথে মিশতে তিনি কুণ্ঠিত হ’তেন না। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, মদীনাবাসীদের কোন এক দাসীও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাত ধরে যেখানে চাইত নিয়ে যেত। আর তিনিও তার সাথে চলে যেতেন।[49]
ইবাদত-বন্দেগী :
আনাস (রাঃ) ইবাদত-বন্দেগীতে রাসূলের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করতেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ما رأيت أحدا أشبه بصلاة رسول الله صـ من ابن أم سليم يعني أنسًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছালাত ইবনু উম্মে সুলাইম তথা আনাস ব্যতীত অন্য কাউকে দেখিনি’।[50] আনাস ইবনু সীরীন বলেন, كان
أنس بن مالك أحسن الناس صلاة في الحضر والسفر ‘আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) ছিলেন মুক্বীম (বাড়ীতে থাকা) অবস্থায় ও সফরে সর্বোত্তম ছালাত আদায়কারী ব্যক্তি’।[51]
তিনি ইবাদতের প্রতি সজাগ ও সচেতন থাকতেন। ছালেহ ইবনু ইবরাহীম বলেন, আমরা জুম‘আর দিনে রাসূলের কোন এক স্ত্রীর বাড়ীতে বসে কথা-বার্তা বলছিলাম। তখন আনাস (রাঃ) এসে বললেন, তোমরা থাম। এরপর ছালাতের আযান হ’লে তিনি বললেন, আমি আশংকা করছি যে, তোমাদের সাথে কথা বলতে থাকলে আমার জুম‘আর ছালাত ছুটে যাবে বা বাতিল হয়ে যাবে।[52]
আনাস (রাঃ) ধীর-স্থিরভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রাতের নফল ছালাত আদায় করতেন। আর এই দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করার কারণে তাঁর দু’পায়ের গোড়ালী ফেটে রক্ত বের হয়ে যেত।[53]
তিনি বৃদ্ধ বয়সে অতি দুর্বল হয়ে যান। ফলে ছিয়াম পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তিনি প্রতি দিনের ছিয়ামের জন্য একজন মিসকীনকে রুটি-গোশত খাওয়াতেন এবং নিজে ছিয়াম ভঙ্গ করতেন। দু’বছর তিনি এরূপ করেছেন।[54] অন্য বর্ণনায় আছে, মৃত্যুর বছর আনাস (রাঃ) ছিয়াম পালনে অপারগ হয়ে পড়লেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর পক্ষে কাযা আদায় করা সম্ভব নয়, তখন তিনি এক গামলা রুটি ও গোশত রান্না করে কয়েকজনকে খাওয়ালেন।[55] অপর বর্ণনায় আছে, তিনি এক গামলা ছারীদ (খাদ্য বিশেষ) তৈরী করে ৩০ জন মিসকীনকে খাওয়ালেন।[56]
তিনি কুরআন খতম করলে পরিবার-পরিজন সকলের জন্য দো‘আ করতেন।[57] তিনি ইহরাম বাঁধলে (হজ্জ ও ওমরা শেষে) ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সাথে কোন কথা বলা যেত না। এ সময় তিনি কেবল আল্লাহর যিকর করতেন। যিকর ব্যতীত অন্য কোন কথা বলতেন না।[58] তিনি উভয় ক্বিবলার দিকেই ছালাত আদায় করেছেন। তিনি বলেন, لَمْ
يَبْقَ مِمَّنْ صَلَّى الْقِبْلَتَيْنِ غَيْرِىْ ‘দুই ক্বিবলার দিকে ফিরে ছালাত আদায়কারী আমি ব্যতীত আর কেউ নেই’।[59]
রাসূলের প্রতি আনাসের ভালবাসা :
তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে মনে-প্রাণে ভালবাসতেন। রাসূলের কথা-কর্মের অনুসরণের প্রতি তিনি ছিলেন সদা উদগ্রীব। রাসূল (ছাঃ) যা ভালবাসতেন আনাস (রাঃ)ও তাই ভালবাসতেন; যা তিনি অপসন্দ করতেন আনাস (রাঃ)ও তা অপসন্দ করতেন। তিনি রাসূলের সাথে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্ত এবং বিদায়ের সময়কে অধিক স্মরণ করতেন। রাসূলের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসার কথা সুস্পষ্ট হয় তার এ উক্তিতে, ما من ليلة إلا وأنا أرى فيها حبيبي ثم يبكي ‘এমন কোন রাত নেই যে, আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে (স্বপ্নে) দেখিনি। অতঃপর তিনি কাঁদলেন’।[60] রাসূলের প্রতি তার মহববতের বিষয়টি আরো প্রতিভাত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীছে। আনাস (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল ক্বিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেন, তার জন্য তুমি কি প্রস্ত্তত করেছ? লোকটি বলল, আমি তার জন্য অধিক ছালাত, ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বা করতে পারিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসি। রাসূল (ছাঃ) وَأَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ‘তুমি তার সাথে থাকবে, যাকে তুমি ভালবাস’। আনাস (রাঃ) বলেন, কোন কিছুতে আমি কখনও এত খুশি হইনি, যত খুশি হয়েছি রাসূলের একথা وَأَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ শুনে। কেননা আমি নবী করীম (ছাঃ), আবূবকর ও ওমরকে ভালবাসি। আর আমি আশা করি তাঁদের ভালবাসার কারণে আমি তাঁদের সাথেই জান্নাতে থাকব। যদিও আমি তাঁদের ন্যায় আমল করতে পারিনি’।[61]
ইলমে হাদীছে অবদান :
রাসূল (ছাঃ)-এর সান্নিধ্যে থেকে আনাস (রাঃ) অহি-র অফুরন্ত জ্ঞান লাভে ধন্য হয়েছিলেন। রাসূলের নিকট থেকে লাভ করেছিলেন ইলমের সঠিক বুঝ, প্রজ্ঞা ও প্রয়োগপদ্ধতি। তিনি তা ছাহাবী, তাবেঈ ও অন্যান্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবূবকর, ওমর, ওছমান, আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা, মু‘আয ইবনু জাবাল, উসাইদ ইবনুল হুযাইর, আবু ত্বালহা, ছাবেত ইবনু কায়েস, আব্দুর রহমান ইবনু আওফ, ইবনু মাসঊদ, মালেক ইবনু ছা‘ছা‘আহ, আবু যর, উবাদাহ ইবনুছ ছামেত, আবু হুরায়রাহ, উম্মু সুলাইম বিনতু মিলহান (তাঁর মাতা), তাঁর খালা উম্মু হারাম, উম্মুল ফাযল (আববাসের স্ত্রী), ফাতেমাতুয যাহরা প্রমুখ থেকে হাদীছ শ্রবণ ও বর্ণনা করেন।
তাঁর থেকে হাসান, সুলাইমান আত-তাইমী, আবু ক্বিলাবাহ, ইবনু সীরীন, শা‘বী, আবু মিজলায, মাকহূল, ওমর ইবনু আব্দুল আযীয, ছাবিত আল-বুনানী, আবূবকর ইবনু আব্দুল্লাহ আল-মুযনী, ইবনু শিহাব আয-যুহরী, ক্বাতাদাহ, ইবনুল মুনকাদির, ইসহাক ইবনু আব্দুল্লাহ আবু ত্বালহা, আব্দুল আযীয ইবনু ছুহাইব, শু‘আইব আল-হাবহাব, আমর ইবনু আমের আল-কূফী, হুমায়েদ আত-ত্বাবীল, ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-আনছারী, কাছীর ইবনু সুলাইম, ঈসা ইবনু তাহমান, ওমর ইবনু শাকির, ছুমামাহ, আল-জা‘দ আবু ওছমান, আনাস ইবনু সীরীন, আবু উমামা ইবনু সাহল ইবনু হুনাইফ, ইবরাহীম ইবনু মায়সারা, বুরাইদ ইবনু আবী মারিয়াম, বয়ান ইবনু বিশর, রবী‘আহ ইবনু আবু আব্দুর রহমান, সাঈদ ইবনু জুবাইর, সালমা ইবনু ওয়ারদান প্রমুখ হাদীছ শুনেছেন ও বর্ণনা করেছেন।[62]
১৫০ হিজরী পর্যন্ত তাঁর নির্ভরযোগ্য শিষ্য-সাথীগণ এবং ১৯০ হিজরী পর্যন্ত দুর্বল শিষ্যগণ বেঁচেছিলেন। তাঁর ছাত্রদের নিকট থেকে যারা হাদীছ শুনেছেন তন্মধ্যে নির্ভরযোগ্য অনেকে ২০০ হিজরীর পরেও জীবিত ছিলেন।[63]
তাঁর নিকট থেকে প্রায় ২০০ জন রাবী হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[64] তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা ২২৮৬টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম ঐক্যমতে ১৮০টি, বুখারী এককভাবে ৮০টি এবং মুসলিম এককভাবে ৯০টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[65] কেউ বলেন, মুসলিম এককভাবে ৭০টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[66]
আনাস (রাঃ) হাদীছ বর্ণনায় সতর্ক ও সচেতন ছিলেন। মুহাম্মাদ বলেন, আনাস (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনার সময় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং বলতেন, او كما قال رسول الله صـ ‘অথবা রাসূল (ছাঃ) এরূপ বলেছেন’।[67] তিনি বলতেন,خُذْ مِنِّى
فَأَنَا أَخَذْتُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صـ عَنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَلَسْتَ
تَجِدُ أَوْثَقَ مِنِّيْ ‘আমার নিকট থেকে (ইলম) গ্রহণ কর। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে গ্রহণ করেছি, তিনি আল্লাহ থেকে। আর তুমি আমার চেয়ে নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না’।[68]
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন :
আবূবকর (রাঃ) খলীফা হওয়ার পর আনাস (রাঃ)-কে বাহরাইনে যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত করেন। তাঁর মৃত্যু হ’লে তিনি ওমরের নিকটে আসেন। তখন ওমর বলেন, কি নিয়ে এসেছেন, দিন। আনাস বললেন, আগে বায়‘আত নিন। তখন ওমর (রাঃ) হাত বাড়িয়ে দিলেন। অতঃপর আনাস বললেন, এই যে, সব সম্পদ, আমরা যা নিয়ে এসেছি। তখন ওমর বললেন, এসব আপনার। যার পরিমাণ ছিল ৪ হাযার।[69]
ওমর (রাঃ)ও তাকে বাহরাইনে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন।[70] ইয়াযীদের মৃত্যুর পর ইবনু যুবায়ের আনাস (রাঃ)-এর নিকট পত্র লেখেন। তখন তিনি ৪০ দিন বছরার মসজিদে ইমামতি করেন।[71]
রাসূলের মৃত্যুতে আনাসের শোক :
রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের প্রথম দিনে আনাসের চেহারা ছিল দীপ্তিময় এবং রাসূলের বিচ্ছেদের দিনে তার চেহারা ছিল বিষাদময়, চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। রাসূলের কথা তিনি বার বার উল্লেখ করতেন। তিনি জীবনের ১০টি বছর রাসূলের সন্নিধ্যে কাটানোতে তাঁর প্রতি ছিল অপরিসীম ভালবাসা। যখন রাসূল (ছাঃ) ইন্তেকাল করেন, তখন আনাস শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তিনি অনুভব করলেন তাঁর চারিদিক যেন পরিবর্তিত হয়ে গেল; দুনিয়া যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। এর প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বক্তব্যে, তিনি বলেন, যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিজরত করে মদীনায় প্রবেশ করেন সেদিন সেখানকার প্রতিটি জিনিস জ্যোতির্ময় হয়ে যায়। অতঃপর যেদিন তিনি ইন্তিকাল করেন সেদিন আবার তথাকার প্রতিটি জিনিস অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আমরা তাঁর দাফনকার্য শেষ করে হাত থেকে ধুলা না ঝাড়তেই আমাদের অন্তরে পরিবর্তন এসে গেল (ঈমানের জোর কমে গেল)।[72]
ইবনু রজব বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করলে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দিল। কেউ কেউ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল, কি করবে তা বুঝতে পারল না; কেউ বসে পড়ল উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেল না, কারো বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, কথা বলার শক্তি পেল না। কেউ তাঁর মৃত্যুকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন যে, তিনি প্রেরিত হয়েছেন।[73] ছাহাবীগণের অনেকেরই এ অবস্থা হয়েছিল, যার প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদীছ। আনাস (রাঃ) বলেন, যখন নবী করীম (ছাঃ)-এর রোগ প্রকটরূপ ধারণ করে তখন তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ফাতেমা (রাঃ) বললেন, ওহ! আমার পিতার উপর কত কষ্ট! তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আজকের পরে তোমার পিতার উপর আর কোন কষ্ট নেই। যখন তিনি ইন্তিকাল করলেন, তখন ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হায় আমার পিতা! আমার পিতা, রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আমার পিতা! জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর বাসস্থান। হায় আমার পিতা! জিবরীল (আঃ)-কে তাঁর ইন্তিকালের খবর শুনাই। যখন নবী করীম (ছাঃ)-কে সমাহিত করা হ’ল, তখন ফাতিমা (রাঃ) বললেন, হে আনাস! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মাটি চাপা দিয়ে আসা তোমরা কিভাবে বরদাশত করলে?[74]
হাজ্জাজ কর্তৃক আনাস (রাঃ)-কে অপমান :
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বহু ছাহাবী ও তাবেঈর উপরে নির্যাতন করেছিল। তার হাত থেকে আনাস (রাঃ)ও রেহাই পাননি। আলী ইবনু যায়েদ বলেন, আমি গভর্নরের প্রাসাদে ছিলাম। ইবনুল আশ‘আছের (বিদ্রোহের) রাত্রে হাজ্জাজ লোকদেরকে ঠিক করছিল। তখন আনাস (রাঃ) আসলেন। এ সময় হাজ্জাজ বলল, হে খবীছ! ফেতনার মধ্যে ঘোরাফিরা করা লোক! একবার আলীর সাথে, একবার ইবনুয যুবায়েরের সাথে, আবার ইবনুল আশ-আছের সাথে থাকছ। যার হাতে আমার প্রাণ, সে সত্তার কসম করে বলছি, আমি তোমার মূল উচ্ছেদ করে দেব, যেমন আঠা তুলে ফেলা হয়। আমি তোমার চামড়া তুলে ফেলব, যেভাবে যবের (গুই সাপের) চামড়া ছাড়ানো হয়। তখন আনাস (রাঃ) বললেন, আমীরকে (গভর্ণরকে) কে সাহায্য করবে? হাজ্জাজ বলল, তুমি একাই কি তাকে সাহায্য কর? আল্লাহ তোমার কানকে বধির করে দিন। তখন আনাস (রাঃ) ইন্নালিল্লাহ পড়লেন। এরপর হাজ্জাজ অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে আনাস (রাঃ) বের হয়ে আসলেন। আমরাও তাঁর পিছনে পিছনে খোলা জায়গায় আসলাম। তখন তিনি বললেন, আমার পরে যদি আমার সন্তানদের উপর এর অনিষ্টের আশংকা না করতাম, তাহ’লে আমি তাকে এমন কথা বলতাম যে, এরপরে আর কখনও সে আমাকে লজ্জিত করত না।[75]
আ‘মাশ বলেন, হাজ্জাজ যখন আনাস (রাঃ)-কে কষ্ট দেয় তখন তিনি খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের কাছে পত্র লিখলেন, আমি ৯/১০ বছর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমত করেছি। আল্লাহর কসম! যদি নাছারারা এমন কোন লোককে পেত যে তাদের নবীর সেবা করেছে, তাহ’লে অবশ্যই তারা তাকে সম্মান করত।[76] তখন তিনি বললেন, হে বৎস! তুমি হাজ্জাজের নিকটে লেখ, ‘তোমার ধ্বংস হোক! আমি আশংকা করছি যে, তোমার হাতে কেউ কল্যাণ লাভ করবে না। আমার পত্র তোমার কাছে পেঁŠছলে, তুমি আনাস (রাঃ)-এর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে’। আনাসের নিকটে লিখলেন, আমি ব্যতীত আপনার উপরে কারো কোন কর্তৃত্ব নেই।
অতঃপর হাজ্জাজের নিকটে যখন পত্র আসল, সে আমীরুল মুমিনীনের দূতকে বলল, পত্রে যা আছে, এটা কি তিনি লিখেছেন? দূত বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। এতে তার মুখাবয়ব কঠিন হয়ে গেল। সে বলল, আমি নির্দেশ শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর সে উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছা করল। আমি বললাম, আপনি চাইলে আমি তাঁকে খবর দেই। এরপর আমি আনাস ইবনে মালিকের নিকটে এসে বললাম, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে, সে (হাজ্জাজ) আপনাকে ভয় করছে? সে আপনার নিকটে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আপনিই চলুন তার নিকটে। তখন আনাস (রাঃ) তার নিকটে আসলেন। এ সময় হাজ্জাজ বলল, হে আবু হামযাহ! আপনি কি রাগ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ? তুমি বছরার কেন্দ্রস্থলে জনসমক্ষে আমাকে লাঞ্ছিত করেছ। সে বলল, আপনার ও আমার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ লোকের মত যে বলে, হে প্রতিবেশী! তুমিই আমাকে সাহায্য কর এবং আমার কথা শ্রবণ কর। আমি আশা করি যে, আমার (বলা ঐ) কথা কাউকে বলবেন না।[77]
আনাস (রাঃ)-এর কারামাত :
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কিছু অলৌকিক ক্ষমতা দান করেন, যেগুলোকে কারামত বলে। আনাস (রাঃ)-এর জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল। যেমন ছাবেত আল-বুনানী বলেন, আনাস (রাঃ)-এর জমির তত্ত্বাবধায়ক এসে বললেন, আপনার জমিগুলো শুকিয়ে গেছে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। তখন আনাস (রাঃ) চাদর পরলেন এবং উন্মুক্ত মাঠে বেরিয়ে এসে দু’রাক‘আত ছালাত পড়ে দো‘আ করলেন। এতে আকাশে মেঘ দেখা গেল এবং আকাশ ছেয়ে গেল ও বৃষ্টি হ’ল। এমনকি শুষ্কভূমি সিক্ত হয়ে গেল। এটা ছিল গ্রীষ্মকাল। তখন তিনি পরিবারের কাউকে পাঠালেন, পানি কতদূর পৌঁছেছে, তা দেখার জন্য। সে দেখল যে, তাঁর সব জমিই সিক্ত হয়েছে, সামান্য অংশ ব্যতীত।[78]
আনাস (রাঃ) বলেন, রুবায়ি‘ নামক তাঁর এক বোন জনৈক মহিলার সামনের দাঁত ভেঙ্গে দিলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার কিছাছের নির্দেশ দিলেন। আনাস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য পাঠিয়েছেন, তার দাঁত ভাঙ্গা হবে না। পরবর্তীতে বাদীপক্ষ কিছাছের পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ নিতে রাযী হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে, যে আল্লাহর নামে শপথ করলে তিনি তার শপথ রক্ষা করেন। সে কারণ তাকে আর শপথ ভঙ্গ করতে হয় না’।[79]
ইন্তেকাল :
ছাহাবীগণের মধ্যে আনাস (রাঃ) সর্বশেষে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বলেন, قَدْ
بَقِيَ قَوْمٌ مِنَ الْأَعْرَابِ، فَأَمَّا مِنْ أَصْحَابِهِ فَأَنَا آخِرُ مَنْ
بَقِيَ ‘আরবের অনেকেই বেঁচে আছে। আর রাসূলের ছাহাবীগণের মধ্যে আমিই সর্বশেষ যে বেঁচে আছি’। তাঁর অসুস্থতায় ডাক্তার ডাকার কথা বললে, তিনি বলেন, ডাক্তার আমাকে অসুস্থ করে দেবে। বরং তোমরা আমাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’- এ বাক্যের তালক্বীন দাও। মৃত্যু অবধি তিনি একথাই বলছিলেন।[80]
আনাস (রাঃ)-এর মৃত্যুকাল নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। হুমায়েদ, কাতাদাহ, হায়ছাম ইবনু আদী, সাঈদ ইবনু উফাইর ও আবু উবাইদ বলেন, তিনি ৯১ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। মা‘ন ইবনু ঈসা ও ওয়াকেদী বলেন, তিনি ৯২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইবনু উলাইয়্যাহ, সাঈদ ইবনু আমের, আল-মাদায়েনী, আবু নু‘আইম, খলীফা, আল-ফাল্লাস বলেন, তিনি ৯৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। এটাই বিশুদ্ধ মত। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর, মতান্তরে ১০৭ বছর।[81] তিনি বছরায় ইন্তিকাল করেন।[82]
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) মৃত্যুবরণ করলে মুরেক্ব আল-‘আজলী বললেন, আজ অর্ধেক ইলম চলে গেল। তাকে বলা হ’ল, হে আবুল মু‘তামার সেটা কিভাবে? তিনি বললেন, প্রবৃত্তির অনুসারী কোন লোক রাসূলের হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে আমাদের বিরোধিতা করলে আমরা বলতাম, ঐ ব্যক্তির কাছে চল যিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে শুনেছেন।[83]
উপসংহার :
আনাস (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সার্বক্ষণিক সহচর। তিনি রাসূলের নিকট থেকে অহি-র জ্ঞান লাভ করে নিজে সে অনুযায়ী আমল করে ধন্য হয়েছিলেন। আর তাঁর জ্ঞানের আলোকছটায় মুসলিম জাহান আলোকিত করে গেছেন। রাসূলের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করে তিনি ইত্তেবায়ে সুন্নাতের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন মুসলিম উম্মাহর জন্য। সুতরাং রাসূলের এই ছাহাবীর জীবনীতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দিন।-আমীন!
No comments