যারা নেওয়ার সময় ঠিকই কানাকড়ি বুঝে নেয় — আল-মুতাফফিফিন
ঠকবাজেরা সব শেষ হয়ে যাক। যারা নেওয়ার সময় ঠিকই কানাকড়ি পর্যন্ত বুঝে নেয়, কিন্তু যখন অন্যকে পরিমাপ বা ওজন করে দেয়, তখন ফাঁকি দিয়ে কম দেয়। এরা কি মনে করে যে, এদেরকে আর ওঠানো হবে না? এক কঠিন দিনে? যেদিন সব মানুষ দাঁড়াবে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সামনে? — আল-মুতাফফিফিন ১-৬
মুতাফ্ফিফিন হচ্ছে যারা অন্যকে কিছু দেওয়ার সময় এদিক-ওদিক একটু কম দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু নিজে নেওয়ার সময় ঠিকই কানাকড়ি পর্যন্ত বুঝে নেয়। কিছু উদাহরণ দেই—
চৌধুরী সাহেব ফল দামাদামি করছেন। বিক্রেতা দামে রাজি হয়ে তাকে প্যাকেট করে দিতে যাচ্ছেন। কিন্তু দেখা গেলো একটা ফল একটু বেশি-পাকা, একটু দাগ বেশি। তিনি নাছোড় বান্দা। তাকে সবগুলো তরতাজা ফল দিতে হবে, একটাও বেশি-পাকা হওয়া যাবে না। চৌধুরী সাহেবের হম্বিতম্বি শুনে বিক্রেতা জলদি পাশের বিক্রেতার কাছ থেকে তরতাজা একটা ফল এনে দিলেন। তারপরও চৌধুরী সাহেব দাম পরিশোধ করার সময় কিছু কম দিলেন। ফলবিক্রেতা পুরো দাম দিতে অনুরোধ করলে তিনি—“পরে দিবো নে, এখন ভাংতি নাই”—বলে হাটা দিলেন। তার পরবর্তী শিকার সবজি বিক্রেতা… —এই হচ্ছে একজন মুতাফ্ফিফ। নিজে নেওয়ার সময় কোনো ছাড় দেবে না, কিন্তু কাউকে দেওয়ার সময় একটু হলেও ফাঁকি দেবেই।
হাসান সাহেব ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে প্রতিদিন বাসা থেকে দেরি করে বের হন। তারপর অফিসে নয়টার পরিবর্তে সাড়ে নয়টায় পৌঁছে ক্লান্ত চেহারা বানিয়ে বলেন, “দেশটা আর বসবাসের যোগ্য নেই। জ্যামে পড়ে জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।…” —অফিসে দুপুরে আধা ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়। দেড়টার সময় তার ডেস্কে ফিরে আসার কথা। কিন্তু তিনি সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে আগে-পিছে সুন্নত, নফলসহ যুহরের নামাজ পড়ে, তারপর আরও আধাঘণ্টা ধরে আয়েশ করে দুপুরের খাবার এবং চা খেয়ে, ধীরে সুস্থে দুইটার দিকে ডেস্কে ফিরে যান। প্রতিদিন তিনি ঘণ্টাখানেক কম্পিউটারে এবং মোবাইলে বিনোদন করেন, ব্যক্তিগত কাজ করেন। তারপর ঘড়িতে পাঁচটা বাজলেই তিনি ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি। —এই হচ্ছেন আরেকজন মুতাফ্ফিফ। কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে যতটুকু ফাঁকি দেওয়া যায়, তা দেবে, কিন্তু মাস শেষে নিজের পাওনা বুঝে নেওয়ার সময় কখনো গিয়ে বলবে না যে, তাকে বেতন কিছু কম দেওয়া হোক, কারণ সে চুক্তি অনুসারে পুরোপুরি কাজ করেনি।
দরজায় কড়া নাড়ছে। দরজা খুলে দেখলেন প্রতিবেশী ভাবি একটি বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি লজ্জিত মুখে বললেন, “ভাবি, কিছু মনে করবেন না। আমার লবণ শেষ হয়ে গেছে। রান্না করতে পারছি না। আমাকে এই বাটিতে একটু লবণ ভরে দেবেন? আমি কালকেই আপনাকে ফেরত দেবো।” আপনি তাকে বাটি ভরে লবণ দিলেন। তারপর, পরের সপ্তাহে প্রতিবেশী ভাবি লবণ কিনে এনে সেই বাটিতে ভরছেন আপনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য। কিন্তু ভরার পর তিনি দেখলেন যে, তার লবণের প্যাকেট প্রায় অর্ধেক শেষ। তার ভেতরটা কেমন খচ্ করে উঠল। এতগুলো লবণ চলে যাচ্ছে! আগামী সপ্তাহেই আবার লবণ কিনতে হবে। তখন তিনি কয়েক চামচ লবণ তুলে রেখে আপনাকে ফেরত দিয়ে গেলেন। আপনি ধরতে পারলেন না, কিন্তু আপনার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ হলো যে, গত মাসে তেল ফেরত দেওয়ার সময় বোতলটা সম্ভবত অর্ধেক ভরা ছিল, তার আগের মাসে মসলার কৌটাটাও মনে হয় অর্ধেক ভরা ছিল, তার আগের মাসে ঝাড়ুটা … —এই প্রতিবেশী ভাবি হচ্ছেন একজন মুতাফফিফ। দেওয়ার সময় ন্যায্য পরিমাণ দিতে গেলেই তার মন খচ্খচ্ শুরু হয়ে যায়।
মুতাফফিফিন এসেছে تطفيف তাত্ফিফ থেকে, যার অর্থ পরিমাণে কম দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া। এই কাজ একবার দুইবার নয় বরং এরকম ঠকবাজি করাই যার স্বভাব, সে হচ্ছে মুতাফ্ফিফ। কুরআনে পরিমাপ এবং ওজন দুটোই বিশেষ করে বলা হয়েছে, কারণ যাবতীয় লেনদেন হয় পরিমাপ অথবা ওজনের ভিত্তিতে। এখানে মূলনীতি হলো, যার যা প্রাপ্য, তা তাকে পুরোপুরি দেওয়া। একারণে এটা শুধু কেনাবেচা, চাকরি-ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেই নয়, একই সাথে কারো অধিকার পুরোপুরি আদায় না করাও তাত্ফিফ।[৪][১৪][১৮] এমনকি নামাজে তাড়াহুড়ো করে রুকু, সিজদা করাও তাতফিফ, কারণ এখানে আমরা আল্লাহর تعالى অধিকার ঠিকমত আদায় করছি না।[৪][১৪][১৮]
আবার অনেক মেরুদণ্ডহীন সুবিধাবাদী আছেন, যারা নিজেরা সরাসরি ফাঁকি দেওয়ার ঝুঁকি নিতে সাহস করেন না। এরা চাকরি বা ব্যবসাতে এমন কাউকে নিয়োগ করেন, যে এই ধরনের ঠকবাজিতে দক্ষ। অথবা তারা কাজের লোককে দিয়ে ঠকবাজি করান, যেন ধরা পড়লে সব দোষ কাজের লোকের বলে চালানো যায়। —এই ধরনের পরোক্ষ ঠকবাজরাও মুতাফ্ফিফিন।[১৪]
এমন নয় যে, মুতাফফিফিনদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম এবং এরা শুধুই প্রবৃত্তির তাড়নায় দেওয়ার সময় কম দেয়, কারণ মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর। বরং এরা ভালো করে জানে নেওয়ার সময় কম পেলে কেমন লাগে। এজন্য এরা নেওয়ার সময় ঠিকই কড়ায়-গণ্ডায় নেয়। কিন্তু তারপর দেওয়ার সময় হলে, এদের ভেতরের পশুটা জেগে ওঠে।
এদের সাথে আল্লাহ تعالى কী করবেন, তার ভয়ংকর বর্ণনা সামনে আসছে। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى এদেরকে অভিশাপ দিচ্ছেন যে, এরা ধ্বংস হয়ে যাক। মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে অভিশাপ পাওয়া এক ভয়ংকর ব্যাপার। এর পরিণাম দুনিয়াতে কষ্ট-অপমান, তারপর আখিরাতে নিশ্চিত ধ্বংস এবং অনন্তকালের জন্য প্রচণ্ড কষ্ট। এমন কষ্ট যা কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না।
এরা কি মনে করে যে, এদেরকে আর ওঠানো হবে না?
—এই হচ্ছে মানুষের পাপের মূল কারণ। মানুষ মনে করে যে, সে যখন টেবিলের তলা দিয়ে ঘুষ নিচ্ছে, চুপচাপ ফোনে আলাপ করে প্রজেক্ট থেকে কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে, গোপনে মিটিং করে গরিবের হক, দেশের সম্পদ বিদেশে নিজের ব্যাংক একাউন্টে পাচার করে দিচ্ছে —এগুলো কেউ দেখছে না। তার মনে ঠিকই পুলিশ, ডিজিএফআই, দুদকের ভয় আছে; কিন্তু আল্লাহর تعالى সামনে দাঁড়ানোর ভয় নেই।
“এরা কি মনে করে যে, এদেরকে আর ওঠানো হবে না?”
—এটাই হচ্ছে তাকওয়ার অভাব। তাকওয়া মানেই হচ্ছে, আল্লাহ تعالى তাকে সবসময় দেখছেন এবং তাকে তার সব কাজের জন্য একদিন আল্লাহর تعالى কাছে জবাব দিতে হবে। এই তাকওয়া না থাকলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তখন সে পশুর থেকেও অধম হয়ে যায়। একারণেই কুর‘আনে তাকওয়ার প্রতি এত জোর দেওয়া হয়েছে। মানুষের যতই জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভা থাকুক না কেন, তাকওয়া না থাকলে সে সৃষ্টিজগতের অন্যতম ভয়ংকর প্রাণীতে পরিণত হয়।
মুতাফফিফিনদের শাস্তি এত ভয়ংকর কেন?
এরা তো চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ করছে না? একটু মাপে কম দিলে কার কী এমন বড় ক্ষতি হচ্ছে যে, এই অপরাধের জন্য আল্লাহ تعالى নিজে তাদেরকে অভিশাপ দিচ্ছেন?
মাপে কম দেওয়া আসলে একটি বড় সমস্যার উপসর্গ মাত্র— এদের মূল সমস্যা হচ্ছে যে, এদের নীতিবোধ দুর্বল। একটা মানুষ কখন মাপে বা ওজনে কম দেয়? যখন সে মনে করে যে, আল্লাহ تعالى তাকে দেখছেন না এবং তাকে এর জন্য কোনো জবাব দিতে হবে না। এভাবে বারবার এধরনের অপরাধ করতে থাকলে, সে খুব সহজেই আল্লাহর تعالى উপস্থিতিকে তার মন থেকে যখন ইচ্ছা দূর করে দিতে পারে। তখন তার অপরাধগুলো আর এই সব ছোটখাটো মাপে-কম দেওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে না, সে তখন বড় বড় অপরাধ অনুশোচনা ছাড়াই করতে পারে।
এছাড়াও এই অন্যায়গুলোর মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। যারা এরকম ফাঁকি দেয়, তাদেরকে আর মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না। যখন কোনো লোকালয় বা জাতির উপর এই ধরনের ‘ঠকবাজ’ লেবেল লেগে যায়, তখন সেই লোকালয় বা জাতিকে আর মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য দিতে ভরসা পায় না। তখন তাদের উপার্জনের উৎস কমে যায়, তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়।
হাদিসে এসেছে, যে এলাকার লোকেরা মাপে, ওজনে কম দেয়, সে এলাকায় فقر ফাক্র অর্থাৎ দারিদ্রতা দেখা দেবে। ফাক্র-এর মূল অর্থ— অভাবে থাকা বা পরনির্ভরশীল হয়ে যাওয়া। ব্যবসা-বাণিজ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া। মানুষের তখন হয়ত সম্পদ থাকতে পারে, কিন্তু সেই সম্পদ ব্যবহারের স্বাধীনতা আর থাকে না। তাকে তখন অন্যের কথায় উঠবস করতে হয়। ন্যায্য অধিকার আদায় করতেও মানুষকে ঘুষ খাওয়াতে হয়।[৪]
আর ধর্মীয় বেশভূষায় করা এই অপরাধগুলো ইসলামের নামকেই কলঙ্কিত করে দেয়। মানুষ যখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় যে, দাড়ি-টুপিওয়ালা লোকেরা কমাগত ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে, অঙ্গীকার অনুসারে ঠিকমতো কাজ করছে না, তখন ইসলাম-এর ব্যাপক বদনাম হয়ে যায়।
কখনোই না! জঘন্য অপরাধীদের তালিকা অবশ্যই থাকবে সিজ্জিনে। জানো, সিজ্জিন কী? এক লিখিত রেকর্ড। ধ্বংস হয়ে যাবে সেদিন মিথ্যাবাদীরা। যারা বিচারের দিনকে মিথ্যা বলে। পাপে ডুবে থাকা ঘোরতর পাপীরাই শুধু তাকে মিথ্যা বলতে পারে। যখন তাকে আয়াত পড়ে শোনানো হয়, সে বলে যে, এগুলো সব প্রাচীনকালের গালগপ্প। কখনোই না! বরং সে যা করছিল, তা তার অন্তরের উপর মরিচা ফেলে দিয়েছে।
কখনোই না! সেদিন তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের থেকে আড়াল করে রাখা হবে। তারপর তারা জাহান্নামের আগুনে ঝলসাবে। তখন তাদেরকে বলা হবে, এই হচ্ছে সেই জিনিস, যাকে তোমরা মিথ্যা বলেছিলে। — আল-মুতাফ্ফিফিন ৭-১৭
ফুজ্জার অর্থাৎ জঘন্যতম অপরাধীরা, যারা শুধু অপরাধই করে না, বরং, “কার বাপের ক্ষমতা আছে আমাকে ধরার?” — এধরনের ঔদ্ধত্যের সাথে অপরাধ করে বেড়ায়। এইসব জঘন্য অপরাধীদের তালিকা থাকবে সিজ্জিনে। সিজ্জিন এসেছে সিজ্নুন থেকে, যার অর্থ কারাগার। সিজ্জিন হচ্ছে চরম পর্যায়ের কারাগার, যেন কোনো সুরক্ষিত দুর্গের নিচে ব্যাপক পাহারা দেওয়া দুর্গম কারাগার।[১][৪]
ঘাঘু অপরাধীদের অপরাধ যখন কোনোভাবে ধরা পড়ে যায়, তখন তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। এরা তখন দিনরাত দুশ্চিন্তা করতে থাকে কীভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ গোপন করে ফেলা যায়। আইনজীবীদের টাকা খাইয়ে, সরকারের ক্ষমতাধর কাউকে হাত করে আদালতের গোপন কক্ষে সংরক্ষণ করা সাক্ষ্য-প্রমাণ গায়েব করে ফেলে, যেন আদালতে তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা না যায়। এইসব ঘাঘু অপরাধীরা বার বার এই কাজ করে অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। এরা এখন নিশ্চিত মনে ব্যাপক দুর্নীতি করে বেড়ায়, কারণ সাক্ষ্য-প্রমাণ গায়েব করার পদ্ধতি তাদের হাতে আছে।
আল্লাহ تعالى এইসব ঘাঘু অপরাধীদের তালিকা, সাক্ষ্য-প্রমাণ সব সিজ্জিনে এক বিশেষ প্রযুক্তিতে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। কোনো মানুষ তো দূরের কথা, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তিরও সামর্থ্য নেই সেই সিজ্জিন ভেদ করে তাদের কুকীর্তির প্রমাণ নষ্ট করে ফেলার। শীঘ্রই আল্লাহর تعالى আদালতে এইসব প্রমাণ হাজির করা হবে। তখন তারা যাবে কোথায়?
কখনোই নয়! ভালো মানুষদের তালিকা অবশ্যই থাকবে ইল্লিয়িনে। জানো, ইল্লিয়িন কী? এক লিখিত রেকর্ড। যারা আল্লাহর কাছের, তারা একে দেখে রাখে। অবশ্যই ভালো মানুষেরা থাকবে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে। উঁচু আসনে বসে তারা চারিদিক দেখতে থাকবে। দেখবে, তাদের চেহারা আনন্দে ঝকমক করছে। তাদেরকে পান করতে দেওয়া হবে এক সিল করা সুধা, মনমুগ্ধকর সুগন্ধির এক সিল —তাহলে শুরু হয়ে যাক একে পাওয়ার প্রতিযোগিতা! আর তার মধ্যে মেশানো থাকবে তাসনিম-এর অমৃত সুধা। সে এক ঝর্ণা, তারাই সেখানে পান করবে, যাদেরকে আল্লাহর কাছে নিয়ে আসা হবে। — আল-মুতাফফিফিন ১৮-২৮
সুপেয় পানীয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। আজকে পৃথিবীতে অন্যতম বড় বাণিজ্য হচ্ছে পানীয় বাণিজ্য। এক ইউরোপেই প্রতি বছর পানীয় সঙ্ক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রায় ১.১ ট্রিলিয়ন ইউরো টার্নওভার হয়। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে পৃথিবীতে পানীয়ের স্বাদ কিছুটা চেখে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। সেই স্বাদ এতটাই আকর্ষণীয় যে, কিছু পানীয় আছে যা মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করলে এক তীব্র আনন্দে সারা শরীর ঝনঝন করতে থাকে। মুখে রেখে দিতে ইচ্ছে করে, গিলে ফেললেই যে মজা শেষ! যারা এধরনের পানীয় পান করার সুযোগ পেয়েছেন, তারা বুঝতে পারবেন, কেন কুরআনে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জান্নাতের আনন্দগুলো বলার সময় বার বার পানীয়ের উদাহরণ দেন।
জান্নাতে অসংখ্য আনন্দ উৎসবের মধ্যে একটি হলো, এক বিশেষ সুগন্ধিযুক্ত সিল লাগানো পাত্রে করে এক অমৃত পানীয় এনে দেওয়া হবে। সেই পানীয় পান করার আনন্দ এতটাই তীব্র যে, জান্নাতিরা এই উৎসবের জন্য মুখর হয়ে থাকবেন। সেই পানীয়ের স্বর্গীয় স্বাদ-এর রহস্য: তাতে মেশানো থাকবে তাসনিম নামের এক ঝর্ণার অমৃত সুধা। সেটা পান করে জান্নাতিরা এতটাই আনন্দিত হবেন যে, আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন, আর কিছু না হোক, অন্তত সেই পানীয় পান করার সুযোগ পাওয়ার জন্য হলেও আমরা যেন প্রতিযোগিতা শুরু করি। সেটা হবে এমন এক পুরস্কার, যা পাওয়ার সুখ আমরা কল্পনাও করতে পারবো না।
এই হলো তাসনিমের সুধা মেশানো এক পানীয়ের স্বাদ। সরাসরি সেই ঝর্ণার স্বাদ কী হবে, সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। সৃষ্টিজগতের অন্যতম সুখকর এই অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন বিশেষ কিছু মানুষ। যারা এই জীবনে এমন কিছু অর্জন করেন, যার জন্য তাদেরকে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে বড় সম্মান দেওয়া হয়— তাদেরকে আল্লাহর تعالى একদম কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এই মহা-সৌভাগ্যবানরা একদম তাসনিম ঝর্ণার মধ্য থেকেই অমৃত সুধা পান করবেন। তারা উপভোগ করবেন সৃষ্টিজগতের তীব্রতম আনন্দের অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি।
অন্যায়কারীরা বিশ্বাসীদের নিয়ে হাঁসি-ঠাট্টা করতো। তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একে অন্যকে চোখ টিপে ইশারা করতো। দলের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের নিয়ে কৌতুক করতো। যখন তাদেরকে দেখত, বলত “এরা সব একেবারেই পথভ্রষ্ট”। ওদেরকে তো তাদের তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি? অতএব, আজ হচ্ছে সেই দিন, যেদিন বিশ্বাসীরাই অবিশ্বাসীদের দেখে হাঁসি-ঠাট্টা করবে। — আল-মুতাফফিফিন ২৯-৩৪
বিশ্বাসীদের নিয়ে মানুষ যখন ঠাট্টা-তামাসা করে, তা আল্লাহকে تعالى এতটাই রাগিয়ে দেয় যে, কুরআনে তিনি تعالى তিন-তিনটি আয়াতে কীভাবে ঠাট্টা-তামাসা করা হতো, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। আয়াতগুলো পড়লে দেখা যায় যে, তিনি تعالى কতোটা রাগ করে বিশ্বাসীদের সাথে করা আচরণগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন।
কিছু মানুষ আছে যাদের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নাচ, গান, পার্টি, ভিডিও গেম, মুভি, প্রেম, ড্রিঙ্ক —এসব করে জীবনটা উপভোগ করা। এরা দিনরাত পরিকল্পনা করে: কোথায় ঘুরতে যাবে, কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বন্ধুদের সাথে খাবে, কোথায় গিয়ে আড্ডা দিবে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কোথায় গিয়ে ফুর্তি করবে, সন্ধ্যায় কী সিরিয়াল দেখবে, রাতে কী মুভি দেখবে, সারারাত কী ভিডিও গেম খেলবে, কখন কোথায় দাঁড়িয়ে কী পোজ্ নিয়ে সেলফি তুলবে ইত্যাদি।
এরা এই সব আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা সবসময় ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে, যা করা দরকার, তা-ই করে। এর জন্য সমাজ, সংস্কৃতি, সততা, আদর্শ, বিবেক বিক্রি করে দিতে হলেও, তা দেবে। তবে সবার আগে তারা যা বিক্রি করে দেয়, তা হলো ইসলাম।
এরা যখন কোনো মুসলিম ভাই বা বোনকে দেখে, যারা তাদের মতো চিপা, খোলা জামা পরে ‘জীবনটা উপভোগ’ করে না, ভিডিও গেম, হিন্দি সিরিয়াল, মুভিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকে না, রেস্টুরেন্টে গিয়ে বাবা-মার কষ্টের অর্জন মুহূর্তের মধ্যে উড়িয়ে দিয়ে আসে না — তখন ভাবে, “ইস! জীবনটা কীভাবে এরা নষ্ট কর্তেসে? মোল্লাগুলো এদের ব্রেইন এমন ওয়াশ করে দিসে! মাথা এক্কেবারে গেসে। এরা কী আনস্মার্ট, ব্যাকডেটেড! হাজার বছর আগের গেঁয়ো আরবদের মতো লাইফস্টাইল এখনো এরা ফলো কর্তেসে।”
কিন্তু এরপরেও কিছু মানুষ আছেন যারা সমাজ, সংস্কৃতি, সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা, স্ট্যাটাস, ‘লোকে কী বলবে’ এসবের থেকে আল্লাহকে تعالى বেশি ভালবাসতে পেরেছেন। তাদের কথার ধরণ, পোশাকের ধরণ, বন্ধু-বান্ধবদের প্রকৃতি, ঘরের আসবাবপত্র, লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখা বইগুলো, ফেইসবুকের স্ট্যাটাস, মোবাইল ফোনের অ্যাপসগুলো—এই সবকিছু দেখলে বোঝা যায় যে: এদের জীবনে কোনো একটা বিরাট উদ্দেশ্য আছে এবং এরা সেই ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। এরা শপিং মলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুদা ঘুরে বেড়ান না। প্রতিদিন ফোনে দুই ঘণ্টা গল্প করেন না। দিনে তিনটা হিন্দি সিরিয়াল দেখেন না। ফেইসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন না। রাস্তা ঘাটে বসে পুরো সময়টা মোবাইল ফোনে গেম খেলেন না। —এদের ভাবসাব পুরোই আলাদা। একদল মানুষ এদেরকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে, এদেরকে নানা ধরনের নাম দেয়: মোল্লা, নিনজা, তালেবান, হুজুর। কিন্তু একদিন আসবে যখন পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াবে। এরাই সেদিন অনন্ত সুখ, শান্তি এবং বিনোদনে ডুবে থেকে হাসি-ঠাট্টা করবেন দুনিয়ায় সেই মূর্খের দলগুলোকে নিয়ে।
অতএব, আজ হচ্ছে সেই দিন, যেদিন বিশ্বাসীরাই অবিশ্বাসীদের দেখে হাসি-ঠাট্টা করবে।
– ওমর আল জাবির
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ।
No comments