তাতারদের আদ্যোপান্ত (৪)
পূর্বের অংশ পড়ুন: তাতারদের আদ্যোপান্ত (৩)
বাগদাদে তাতার বাহিনী :
তাতার বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে এবং ধ্বংসলীলা চালাতে থাকে। এরপর তারা জাযীরাহ, দিয়ারে বাকর, ত্বানযাহ, নাছীবীন, সিনজার, ইরবল, আ‘রাবান ও মূছেল অতিক্রম করে মূ‘নেসা গ্রামে প্রবেশ করে সেখানে ধ্বংসলীলা ও লুটতরাজ চালায়। অতঃপর তারা রোমের বিভিন্ন শহর দখল করে।[1] এভাবে একের পর এক শহর-বন্দর, নগর দখল করতে থাকে। অবশেষে থেমে যায় চেঙ্গীস খানের বিশ্ব জয়ের পাগলা ঘোড়া। মৃত্যুই তার দুরন্ত গতিকে রোধ করে দেয়। তিনি হিজরী ৬২৪ মোতাবেক ১২২৩ খৃষ্টাব্দে ৬০ বছর বয়সে অপরাজেয় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[2]
আজতাঈ-এর শাসনকাল :
চেঙ্গীস খানের মৃত্যুর পরে ক্ষমতায় আসে তারই সন্তান আজতাঈ। তার শাসনামলের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে এশিয়া ও ইউরোপে ক্ষমতা বিস্তার, পিতার দখলকৃত এলাকা সমূহে শাসন সুদৃঢ়করণ ও ভারতবর্ষে তাদের রাজ্য বিস্তারে পথের কাঁটা জালালুদ্দীন শাহকে হত্যা করা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে আজতাঈ পুরোপুরি সফল হন। জালালুদ্দীন শাহ তাদের হাতে নিহত না হ’লেও তিনি তাদের ভয়ে আকরাদ পাহাড়ে[3] পলায়ন করলে জনৈক কৃষকের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। আজতাঈ ৬৩৯ হিজরী, ১২৪১ খৃষ্টাব্দে অত্যধিক মদ্যপান করার কারণে মারা যান।[4]
কেউক-এর শাসনকাল :
আজতাঈ মারা গেলে শাসনভার গ্রহণ করে তার পুত্র কেউক। কেউক রাজ্য বিস্তারে তেমন মনোযোগী হননি। তার শাসনামলে তেমন মুসলিম নির্যাতনও হয়নি। একটি ঘটনা থেকে জানা যায় যে, তিনি একবার খৃষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে এক মুনাযারায় উপস্থিত হয়ে মুসলমানদের ছালাত আদায় দেখে খুশি হন এবং তাদেরকে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে সহায়তা করেন। তিনি ৬৪৬ হিজরী মোতাবেক ১২৪৮ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।[5]
মানজু-র শাসনামল :
কেউকের শাসনকালে প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন রাজ্যে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। এমন সময় শাসনভার গ্রহণ করেন মানজু খান। তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেই কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করেন। চীন শাসনের দায়িত্ব দেন তারই ভাই কোবীলাঈ খানকে। মানজু খান মাত্র দু’বছরে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা সুসংহত করেন। তিনি ৬৫৫ হিজরী মোতাবেক ১২৫৭ খৃষ্টাব্দে মারা যান।[6]
কোবীলাঈ খান-এর শাসন ও হালাকু খানের আবির্ভাব :
মানজু খানের মৃত্যুর পর কোবীলাঈ খান শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি ‘মহান খানে’ (الخان الاعظم) পরিণত হন। তিনি পারস্য, শাম ও এশিয়ার শাসনকার্যের দায়িত্ব দেন হালাকু খানকে। তার হাতেই বাগদাদের পতন ঘটে। হালাকু খান অত্র অঞ্চলের দায়িত্ব পেয়ে রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি মুসলমানদের এক অঞ্চল দখলের জন্য সুকৌশলে অন্য মুসলিম এলাকার সহযোগিতা নিতে থাকেন। মুসলিম রাষ্ট্র নেতারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে হালাকু খানকে সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির পর পরবর্তীতে হালাকু খান ঐ মুসলিম নেতাকে আক্রমণ করতে ভুল করেন না। তিনি ইরানের রাষ্ট্র নেতাদের থেকে সহযোগিতা চেয়ে পত্র লিখলেন এ মর্মে যে, ‘আমরা ইসমাঈলীয়দের দুর্গ ধ্বংস করতে, এই দলটিকে হত্যা করতে ও দুনিয়া থেকে তাদের অস্তিত্ব মুছে দিতে মহান নেতার (الخان الاعظم) নির্দেশে এসেছি। যদি তোমরা তোমাদের লোকজন, ধনভান্ডার ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আমাদের কাছে আগমন কর, তাহ’লে আমি তোমাদেরকে নিজ ভূমিতে নিরাপদে বসবাসের, ঘর-বাড়ি ও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার ওয়াদা দিচ্ছি। কিন্তু তোমরা এর বিরোধিতা করলে আমি আল্লাহর সাহায্যে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তোমাদের ভূমিতে গমন করব। এরপর তোমাদের পূর্বের অনুগ্রহের দিকে না তাকিয়ে তোমাদের দেশকে ধ্বংস করে দিব’।[7] এই পত্র পেয়ে মুসলমানরা উপঢৌকন নিয়ে বের হ’ল। ইরাক, খোরাসান, আযারবায়জান, জর্জিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে দূতগণ উপঢেŠকনসহ হালাকু খানকে অভ্যর্থনা জানাল। হালাকু খান আনন্দিত হয়ে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে জায়হূন নদী পাড়ি দিয়ে তূস শহরের একটি বাগানে অবতরণ করলেন। এখান থেকেই তিনি ইসমাঈলীয় শাসকদের দুর্গে হামলা করেন। প্রচন্ড যুদ্ধের পর ইসমাঈলীয় মুসলমানেরা পরাজিত হ’ল তাদের নেতা রোকনুদ্দীন খোরশাহ প্রথমে বন্দি হন এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়।
হালাকু খান ইসমাঈলীয়দের পরাজিত করে তার যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র হামাদানে ফিরে যান। অতঃপর তিনি আববাসীয় খলীফা মুসতা‘ছিম বিল্লাহকে তিরস্কার করে পত্র লিখেন। কারণ তিনি হালাকু খানকে সাহায্য করেননি। এরপর হালাকু খান খলীফার নিকট দু’টি বিষয়ে আবেদন করলেন- ১. বাগদাদের সকল দুর্গ ধ্বংস, শহর রক্ষা পরিখা ভরাট এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা তার ছেলের হাতে অর্পণ করতে হবে।
২. তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেরিয়ে আসা অর্থ বা পত্র নিয়ে মন্ত্রী সোলায়মান শাহ ও দোয়ায়দারকে হালাকু খানের নিকটে পাঠাতে হবে।
হালাকু খান তার পত্রের শেষে লিখেন, খলীফা এই উপদেশ শুনলে তার ঈর্ষা থেকে বিরত থাকবেন। অন্যথা ইরান ও খোয়ারিযমের সৈন্যদের পরাস্তকারী মোগল সৈন্যদের সামনে পরাজয়ের জন্য নিজ সৈন্যদের পেশ করবেন।[8]
খলীফার উত্তর :
পত্র পাওয়ার পর খলীফা মুসতা‘ছিম বিল্লাহ জওয়াব লিখে শারফুদ্দীন ইবনুল জাওযীকে হালাকুর নিকট প্রেরণ করেন। তাতে তিনি লিখেন, ‘আপনি নিজেকে গোটা বিশ্বের নেতা বানিয়ে ফেলেছেন। আর মনে করছেন যে আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কী করে আমার থেকে এমন কিছু কামনা করেন যা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না? আপনার নিকটে কি মনে হয়েছে যে, আপনার মেধা, সৈন্যদের শক্তি ও আপনার বীরত্ব আকাশের তারকারাজিকে বন্দি করে ফেলবে? এরপর তিনি নিজ মর্যাদা বর্ণনা করে বলেন, আমার দু’লক্ষ অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত আছে। তারা আমার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিশোধের সময় আসলে তারা সাগরের পানি শুকিয়ে দিবে। সর্বশেষ তিনি লিখেন, আমার রাষ্ট্রের পরিখা ও দুর্গ নিয়ে চিন্তা কেন? উপত্যকার পথ ধরে চলুন এবং খোরাসানে ফিরে যান। আর আপনি যদি যুদ্ধ চান তাহ’লে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়ার পর আপনি একটি মুহূর্তও আপত্তি জানাতে পারবেন না। যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য আমার হাযার হাযার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য প্রস্ত্তত আছে।[9]
খলীফার দূত সরকারী নিয়ম মাফিক কিছু উপঢেŠকনসহ পত্র নিয়ে হালাকু খানের নিকট গমন করলে তিনি এসবকে কোন গুরুত্ব দিলেন না। বরং এ ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা ভেবে নিয়ে উত্তর লিখলেন। তাতে তিনি খলীফাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে অনেক কথা লিখলেন। শেষে লিখলেন, আপনি আপনার পূর্বপুরুষদের নীতি বর্জন করেছেন। যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন এবং শক্তিশালী সৈন্যদের মুকাবেলা করার অপেক্ষায় থাকুন। শয়তান যদি তার যাবতীয় শক্তি আমার পদধ্বনির সামনে উপস্থাপন করে তবুও আমি আল্লাহর দয়ায় বিজয়ী হব।[10]
খলীফার দূত ফিরে আসলে তিনি আবারো হুমকি দিয়ে পত্র লিখতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর মন্ত্রী ইবনুল আলকামী ইঙ্গিত দিল যে, যুদ্ধে না গিয়ে মাল-সম্পদ দিয়ে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করাই শ্রেয় হবে। সে বলল, ‘ধন-সম্পদ খরচ করে তা প্রতিহত করুন। কারণ ধনভান্ডার ও স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করা হয় ইয্যত রক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আমাদের জন্য আবশ্যক হবে এক হাযার বাহনে মূল্যবান সামগ্রী, এক হাযার মূল্যবান উট, এক হাযার আরাবীয় ঘোড়া, অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রী পাঠিয়ে দেওয়া ও নিজের ওযর পেশ করা।[11] খলীফা প্রথমে এরূপ ভীরুতাপূর্ণ মতের প্রতি ঝুঁকে পড়লেও পরে দোয়ায়দারে ছাগীর মুজাহিদুদ্দীন আয়বেক খলীফাকে এথেকে বাধা দেন। তিনি রাফেযী শী‘আ মন্ত্রী ইবনুল আলকামীর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করতেন। তিনি খলীফাকে লিখে পাঠান যে, ইবনুল আলকামী নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য কেবল এরূপ প্রস্তাব করেছে। এর দ্বারা সে আপনাকে মোগলদের হাতে তুলে দিতে চায়। তিনি খলীফাকে স্বঅবস্থানে থাকারও পরামর্শ দেন।[12]
ঐতিহাসিক বর্ণনা : মোঙ্গল শাসক চেঙ্গীস খানের পৌত্র হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ আক্রমণ ও ধ্বংস ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। তাতাররা চীনের মোঙ্গলিয়া থেকে শুরু করে খোয়ারিযম, বুখারা, সামারকান্দ, মারভ, রায়, হামদান, আযারবায়জান প্রভৃতি এলাকা একের পর এক দখল করে ধ্বংসলীলা চালাতে থাকে। খোরাসান ও খোয়ারিযমের পতন হ’লে তাতাররা ৬৫৬ হিজরী মোতাবেক ১২৫৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে বাগদাদ অবরোধ করে। এ সময় বাগদাদের খলীফা ছিলেন আবু আহমাদ আব্দুল্লাহ আল-মুস্তা‘ছিম বিল্লাহ (৬০৯-৬৫৬ হি.)। শায়খ কুতুবুদ্দীন বলেন, তিনি পিতা ও দাদার মত ধার্মিক এবং কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী ছিলেন। তবে তিনি তাদের মত দৃঢ় প্রত্যয়ী ও সচেতন ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাগদাদের সর্বশেষ খলীফা।[13] তাতারদের হাতে খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহ, তাঁর পরিবারসহ প্রায় দু’লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। নিখোঁজ হয় বহু মানুষ। কিছু মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগার ধ্বংস করে দেওয়া হয়।[14]
বাগদাদ পতনের কারণ :
ক. রাজনৈতিক কারণ :
চেঙ্গীস খানের আমলে তাতার ব্যবসায়ীদের হত্যা করা হয় বলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এরই প্রেক্ষিতে ৬১৪ হিজরী সনে তাতার সৈন্যরা মুহাম্মাদ খোয়ারিযম শাহের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন তাতার নেতা চেঙ্গীস খান। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ পরাজিত হন। তাতাররা বিশ থেকে সত্তর হাযার মুসলমানকে হত্যা করে।[15] এ যুদ্ধে জয় তাদের বিশ্ব জয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ত্বরান্বিত করে। তাছাড়া পরবর্তীতে পারস্যের গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমন করার জন্য খলীফার নিকট সাহায্য চাওয়া হ’লে তিনি তাতে মৌন সম্মতি দিলেও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেননি। ফলে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন।[16]
খ) ধর্মীয় কারণ
১. শী‘আ- সুন্নী দ্বন্দ্ব
ইতিহাস নিন্দিত এ ঘটনার জন্য মূল দায়ী ব্যক্তি ছিল খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহর প্রধান মন্ত্রী গোঁড়া শী‘আ রাফেযী ইবনু আলকামী। সে সর্বাস্থায় সুন্নীদের পতন কামনা করত। সে মুসলমানদের পতন ঘটাতে দীর্ঘ পরিকল্পণা নিয়ে অগ্রসর হ’তে থাকে। খলীফা মুস্তানসিরের আমলে যেখানে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশী ছিল, সেখানে ইবনুল আলকামী সৈন্যের সংখ্যা কমাতে কমাতে দশ হাযারে নামিয়ে আনে। অতঃপর মুসলমানদের দুর্বলতার সার্বিক বিষয়ে লিখে পাঠায় হালাকু খানের কাছে। তাকে আহবান জানায় বাগদাদ আক্রমণের জন্য।[17] ইবনুল আলকামী তার বন্ধু ইরবিলের আমীর ইবনুছ ছালায়াকে এ মর্মে পত্র লিখে পাঠান যে, তিনি যেন হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করেন এবং তার জন্য পথ সুগম করে দেন’।[18]
উল্লেখ্য যে, তাতাররা ৬৩৪ হিজরীতে ইরবিলে হামলা করেছিল এবং মিনজানীক তাক করে শহরের প্রাচীর ভেঙ্গে শহরে প্রবেশ করে হাযার হাযার মুসলমানকে হত্যা ও তাদের সন্তান ও স্ত্রীদের বন্দি করেছিল।[19] ইবনুল আলকামী হালাকুকে এও প্রস্তাব দেয় যে, যদি তিনি তাকে বাগদাদের নায়েব বানিয়ে দেয় তাহ’লে বাগদাদ দখল তাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। মুছেলের শাসনকর্তা তাকে হালাকুর বাগদাদ দখলের ষড়যন্ত্রের কথা জানালেও সে খলীফাকে কিছুই অবহিত করেনি। অবশেষে সে স্বপরিবারে হালাকুর নিকট গিয়ে বাগদাদ আক্রমণের আহবান জানায় এবং নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরে আসে।[20] খলীফা ইবনুল আলকামীকে হালাকুর সাথে চুক্তি করতে পাঠালে সে ফিরে এসে খলীফাকে বলে, হালাকু খান আপনার ছেলে আবুবকরের সাথে তার মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন করতে চান। আর আপনি তার আনুগত্যে থাকবেন যেমন আপনার পূর্ববর্তীরা ছিল। এজন্য মন্ত্রী পরিষদসহ আপনাকে যেতে হবে। ফলে খলীফা মন্ত্রী, আত্মীয় ও আলেম-ওলামাকে সাথে নিয়ে ছেলের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য হালাকু খানের নিকট গমন করেন। এ সুযোগে হালাকু খানের সৈন্যরা খলীফা ও তার সতের জন সঙ্গী ব্যতীত সকলকে হত্যা করে। পর্যায়ক্রমে দলে দলে জ্ঞানী-গুণীরা খলীফার সন্ধানে যেতে থাকে আর হালাকুর সৈন্যরা তাদের হত্যা করতে থাকে। এতে খলীফা মন্ত্রী ও আলেম শূন্য হয়ে একমাত্র ইবনুল আলকামী নির্ভর হয়ে পড়েন।[21] হালাকু খান সুকেŠশলে শী‘আ মতাদর্শী নাছীরুদ্দীন তুসীকে তার মন্ত্রীর পদ প্রদান করে। ইবনুল আলকামী ও নাছীরুদ্দীন তুসী[22] এই দু’মন্ত্রী এক সাথে পরামর্শ করে বাগদাদ ধ্বংসের যাবতীয় পরিকল্পনা
সম্পন্ন করে। ইবনুল আলকামী এত হিংস্র হওয়ার পিছনে কারণ ছিল এই যে, বিগত বছরে শী‘আ, রাফেযী ও আহলে সুন্নাতের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় যাতে রাফেযীদের কেন্দ্র কারাখ, রাফেযীদের অন্যান্য আবাসভূমি ও মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এরপর থেকে মন্ত্রী হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে সুন্নীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হ’তে থাকে।[23] বাগদাদ নগরীতে ৩৯৮ হিজরীতে শী‘আ-সুন্নীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। এতে বহু লোক নিহত হয়।[24] আল্লামা রশীদ রেযা বলেন, বাগদাদের ইতিহাস পাঠ কর। যাতে রয়েছে তাতার অভিযানের বর্ণনা। যার কারণে পৃথিবীতে মুসলিম গৌরবের ভিত্তি বিনষ্ট হয়, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এর অন্যতম কারণ ছিল হানাফী-শাফেঈ মাযহাবের চরম দ্বন্দ্ব এবং খলীফার শী‘আ মন্ত্রী ইবনুল আলকামী। এই মন্ত্রী সুন্নীদের নিধনকল্পে ৬৫৬ হিজরীতে ইসলামী খেলাফতের রাজধানী বাগদাদে তাতারদের ডেকে আনে। কিন্তু তাতাররা বাগদাদ নগরীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর শী‘আ-সুন্নী সকলকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ইবনুল আলকামীকে বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য স্বয়ং হালাকু খান তিরস্কার করেছিলেন। এক সময় ইবনুল আলকামী অভিশপ্ত জীবনের দুশ্চিন্তায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়’।[25]
২. মাযহাবী দ্বন্দ্ব :
বাগদাদ আক্রমণের অন্যতম কারণ ছিল হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের দ্বন্দ্ব।[26] আল্লামা রশীদ রেযা, সূরা বাক্বারার ২০৮নং আয়াতের তাফসীরে রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীছ ‘সাবধান! আমার পর তোমরা বিপথগামী হয়ে একে অন্যের জীবননাশ কর না’[27] এর ব্যাখ্যায় বলেন, অথচ আমরা এ দলীলগুলোকে পশ্চাতে ফেলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি এবং দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছি। দ্বীনের বিষয়ে একে অপরকে সন্দেহ করছি। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন মাযহাব গ্রহণ করেছি। প্রত্যেকে নিজ নিজ মাযহাবের প্রতি অন্ধ ভক্তি করছে। আর এজন্য সকল মুসলিম ভাইদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছে। সে মনে করছে দ্বীনকে সাহায্য করছে অথচ সে বিভেদ সৃষ্টি করে দ্বীনকে অপদস্ত করছে। সুন্নীরা শী‘আদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, শী‘আরা ইবাযিয়াদের সাথে সংঘাত করে। শাফেঈরা হানাফীদের বিরুদ্ধে তাতারদেরকে প্ররোচিত করে, হানাফীরা শাফেঈদের যিম্মী মনে করে, এরা খালাফদের মুক্বাল্লিদ ও সালাফদের অনুসারীদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। ইবনুস সাম‘আনী ৪৬২ হিজরীতে হানাফী মাযহাব ত্যাগ করে শাফেঈ মাযহাব অবলম্বন করলে এই দু’মাযহাবের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এতে খোরাসান ও মারভ নগরী শ্মশানে পরিণত হয়।[28] ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
وَبِلَادُ الشَّرْقِ مِنْ أَسْبَابِ تَسْلِيطِ اللهِ التتر عَلَيْهَا كَثْرَةُ التَّفَرُّقِ وَالْفِتَنِ بَيْنَهُمْ فِي الْمَذَاهِبِ وَغَيْرِهَا-
‘প্রাচ্যে মাযহাব ও অন্যান্য বিষয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে অধিক মতপার্থক্য ও ফিৎনার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাতারদের বিজয় দান করেন’।[29] প্রত্যেক মাযহাব একে অপরকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। তূস শহরে হানাফীরা শাফেঈ মাযহাবের লোকদের প্রতি অতিষ্ট হয়ে হালাকু বাহিনীকে শাফেঈদের হত্যা করার জন্য আহবান করে। নিজেরাই হালাকু বাহিনীর জন্য শহরের দরজা খুলে দেয়। তাতাররা শহরে প্রবেশ করে শাফেঈদের হত্যার পাশাপাশি হানাফীদেরও রেহাই দেয়নি।[30] শায়খ আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী বলেন, হানাফী ও শাফেঈদের মধ্যে যাতে তর্ক-বিতর্ক ও মারামারি করার শারীরিক ক্ষমতা লোপ না পায় এজন্য উভয় মাযহাবের লোকেরা তাদের আলেমদের ফৎওয়া সূত্রে রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করত না।[31]
তাতারদের বাগদাদে প্রবেশ :
খোরাসানের পতনের কারণে হালাকু খানের জন্য বাগদাদ অভিযানের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। হালাকু খান বাগদাদের দিকে দ্রুত ধাবিত হন। এ অভিযানে হালাকু খান সঙ্গে নেন মূছেলের শাসনকর্তা বদরুদ্দীন লুলু ও সাবেক ইসমাঈলী মন্ত্রী দার্শনিক নাছীরুদ্দীন তূসীকে। এদিকে মহিউদ্দীন ইবনুল খোয়ারিযমী খাদ্য, বাহন ও অর্থ দিয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোক পাঠান। আবার মূছেলের সুলতানের পুত্র ছালেহ ইসমাঈলীও হালাকুর সঙ্গে যোগ দেন। সব মিলে দু’লক্ষ সৈন্য সাথে নিয়ে হালাকু খান বাগদাদের পথে রওয়ানা হন।[32] হালাকুর সৈন্যদল পূর্ব-পশ্চিম উভয় দিক দিয়ে বাগদাদের পথে রওয়ানা হয়। বাজুয়ানের নেতৃত্বে আরেক দল সৈন্য পশ্চিম দিক দিয়ে তিকরিতের পথ ধরে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হয়। হালাকু বাহিনীর ভয়ে লোকেরা নারী ও সন্তানদের নিয়ে দুজাইল, ইসহাক, নাহরে মালাক ও নাহরে ঈসা ত্যাগ করে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। তারা নদী পাড়ি দেওয়ার সময় যেন নিজেদেরকে পানিতে নিক্ষেপ করছিল। মাঝিরা লোকদের পারাপার করার সময় ভাড়া হিসাবে স্বর্ণের চুড়ি, বালা ও বহু দীনার লাভ করছিল। যখন হালাকু খানের ত্রিশ হাযার অশ্বারোহী সৈন্য দুজাইল নগরীতে প্রবেশ করল তখন খলীফা মুস্তা‘ছিমের পক্ষ হ’তে তাদের প্রতিরোধের জন্য মুজাহিদুদ্দীন আয়বেক (দোওয়েদায়ে ছগীর নামে পরিচিত) ইযযুদ্দীন সামনে অগ্রসর হন। তিনি অল্প সংখক সৈন্য নিয়ে এক বিশাল বাহিনীর প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। কিন্তু চেŠকস তাতার সৈন্যরা রাতে দজলা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে দিলে মুসলিম সৈন্যরা দিশাহারা হয়ে পড়ে। এই সুযোগে তাতার সৈন্যরা মুসলিম সৈন্যদের কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দি করতে সক্ষম হয়। এ থেকে কেবল তারাই রক্ষা পায় যারা নদীতে ঝাঁপ দেয় বা যারা মরুভূমি হয়ে সিরিয়ায় পলায়ন করে। সেনাপতি ইযযুদ্দীন দোওয়ায়েদার কোন মতে আত্মরক্ষা করে বাগদাদে চলে যান। আর হালাকুর সেনাপতি বাজু তার সৈন্যদের নিয়ে শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবেশ করে মুহাযিত-তাজের সামনে অবস্থান নেয়। তার সৈন্যরা মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করতে থাকে। অপরদিকে তাতার বাহিনী পূর্ব পাশ দিয়ে ৪ঠা মুহাররম ৬৫৬ হিজরী বাগদাদের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান গ্রহণ করে। খলীফার সৈন্যরা ১৯শে মুহাররম ৬৫৬ হিজরী পর্যন্ত প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। অতঃপর তাতাররা বাগদাদের প্রাচীর ভেঙ্গে তীব্র গতিতে শহরে প্রবেশ করে নাগরীকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। লোকেরা ভয়ে বহুতল ভবন ও উঁচু মিনারে আশ্রয় গ্রহণ করে।[33] হালাকু খান খলীফাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। খলীফা এতে কর্ণপাত না করলে তাতাররা বাগদাদ নগরী অবরোধ করে। খলীফা যখন দেখলেন আত্মসমর্পণ ব্যতীত গত্যন্তর নেই তখন তিনি যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য শারফুদ্দীন ইবনুল জাওযীকে হালাকুর নিকটে পাঠান। কিন্তু হালাকু বাহিনী চুক্তির অঙ্গীকার করে মুসলমানদের ধোঁকা দেয়। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ইবনুল আলকামী তার পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হালাকুর নিকট গমন করে। অতঃপর খলীফাকে হালাকুর কাছে যাওয়ার ইঙ্গিত করে এবং তার সাথে সাক্ষাৎ করে সন্ধি করার পরামর্শ দেয়। যাতে বলা হয় অর্ধেক জিযিয়া হালাকুর জন্য হবে ও অর্ধেক হবে খলীফার জন্য।[34]
খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহর পুত্র আহমাদ, আব্দুর রহমান ও মুবারক এবং কাযী, ফক্বীহ, আলেম-ওলামা, ছূফী ও গণ্যমাণ্য ব্যক্তিসহ তিন হাযার অনুচরবর্গ জীবন রক্ষার জন্য আত্মসমর্পণ করতে হালাকু খানের নিকট যান। এই প্রতিনিধি দলটি যখন হালাকুর বাসস্থানের কাছে পৌঁছে তখন সতের জন ব্যক্তি ব্যতীত সকলকে হত্যা করা হয়। খলীফা হালাকুর নিকটে পৌঁছলে সে খলীফাকে বলল, আপনি মেযবান আর আমরা মেহমান। অতএব আপনি আমাদের উপযুক্ত মেহেনদারী করুন। খলীফা তার ধনভান্ডরের তালা খুলে তার মেহমানদারী করার নির্দেশ দিলেন। এতে তার জন্য ত্রিশ হাযার পোশাক, দশ হাযার দীনার এবং অগণিত মুনি-মুক্তা হালাকুর সামনে উপস্থাপন করা হ’ল। কিন্তু হালাকু এগুলোর প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ না করে খলীফাকে বললেন, এগুলো আমার দাস ও সৈন্যদের জন্য। এগুলোতো প্রকাশ্য সম্পদ। কিন্তু গচ্ছিত ও রক্ষিত সম্পদ কোথায়? সেগুলোর সন্ধান দিন। খলীফা লুক্কায়িত সম্পদের কথা বলে দিলে তারা তা খনন করে দেখল যে, হাউয লাল স্বর্ণে পরিপূর্ণ।[35] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হালাকু খান স্বয়ং খলীফার সাথে অতিশয় অপমান সূচক আচরণ করলেন। খলীফা লাঞ্ছিত, ভীত ও অপদস্ত অবস্থায় বাগদাদে ফিরে এলেন। খাজা নাছীরুদ্দীন তূসী ও খলীফার প্রধান মন্ত্রী ইবনুল আলকামীও খলীফার সাথে বাগদাদে ফিরে এলো। তাদের পরামর্শক্রমে খলীফা পুনরায় রাজকোষের সমুদয় স্বর্ণ, হীরক এবং মূল্যবান সামগ্রীসহ হালাকুর নিকট উপস্থিত হ’লেন। শী‘আ মন্ত্রীদ্বয়ের ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনার ফলে খলীফা মুস্তা‘ছিমের শত অনুনয়-বিনয় ও অনুরোধ সত্তেবও হালাকু খান খলীফার সাথে চুক্তি করতে সম্মত হননি। হালাকু খান খলীফার সাথে সন্ধি করতে চাইলে ইবনুল আলকামী হালাকু খানকে বলে, আপনি খলীফার সাথে চুক্তি করবেন না। কারণ তিনি এক বা দু’বছরের মধ্যে চুক্তি ভঙ্গ করবেন। তিনি আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন। এভাবে ইবনুল আলকামী হালাকু খানকে খলীফার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকে।[36] তারপর হালাকুখান খলীফাকে বললেন, বাগদাদবাসীকে নির্দেশ দেন যাতে তারা অস্ত্র রেখে দিয়ে বাগদাদের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। খলীফা তাই করলেন। ফলে লোকেরা নিরাপত্তার আশায় অস্ত্র ফেলে লাইন ধরে রাস্তায় বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু এতেও বাগদাদ নগরী হালাকু খানের প্রমত্ত ধ্বংসযজ্ঞ হ’তে পরিত্রাণ পেল না। এসময় হালাকু তার সৈন্যদেরকে লাইনে থাকা নিরস্ত্র সাধারণ লোকদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। হত্যাকান্ড শেষ হ’লে হালাকু খান বাগদাদ নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খলীফা ও তার আত্মীয়-পরিজনসহ নগরীর অসংখ্য নর-নারীকে হত্যা করে। প্রাণভয়ে ভীত বাগদাদের অগণিত নারী-পুরুষের করুণ আর্তিকে উপেক্ষা করে মোঙ্গলবাহিনী বিভৎস হত্যাকান্ডের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। শুধু জীবননাশের মধ্য দিয়েই মোঙ্গলবাহিনীর অত্যাচার শেষ হয়নি, তাদের হাতে যুগ যুগ লালিত মুসলিম সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতিরও বিলুপ্তি ঘটে।
একদল লোক আত্মরক্ষার জন্য ঘরে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলে তাতারবাহিনী তাদের কারো দরজা ভেঙ্গে এবং কারো দরজায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করে। অতঃপর গৃহবাসীকে পাকড়াও করে উঁচু ছাদের উপর নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। আর তাদের রক্ত ছাদ হ’তে নালার মত হয়ে নীচে গড়িয়ে পড়তে থাকে।[37]
তাদের আক্রমণের প্রচন্ডতায় মুসলিম জাতির গৌরবকীর্তি, মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র বাগদাদ নগরী ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। এভাবে আরব্য রজনীর স্বপ্নপুরী বাগদাদ তার সর্বস্ব হারায়। চল্লিশ দিন ধরে হালাকু বাহিনী তাদের ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখে। তাদের নির্মম হত্যাকান্ড হ’তে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ ও যুবক কেউ রেহাই পায়নি। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা কিছুই তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। কেবল ইহুদী-খৃষ্টান, শী‘আ-রাফেযী ইবনুল আলকামীর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণকারী ও কিছু ব্যবসায়ী যারা অর্থের নিরাপত্তা গ্রহণ করেছিল তারাই রক্ষা পেয়েছিল। তারা বহু অর্থ ব্যয় করে নিজেদের ও সম্পদের নিরাপত্তা লাভ করেছিল।[38]
বাগদাদ ধ্বংসের বর্বরতা সম্পর্কে ব্রাউন বলেন, সম্ভবত কখনোই এত বড় ও সমৃদ্ধশালী একটি সভ্যতা এত দ্রুত অগ্নিশিখায় বিধ্বস্ত ও রক্তধারায় নিশ্চিহ্ন হয়নি’। মোঙ্গলদের নিষ্ঠুর আক্রমণে অসংখ্য মসজিদ, প্রাসাদ, অট্টালিকা প্রভৃতি নিশ্চিহ্ন হ’ল। কেবল মুষ্টিমেয় শিল্পী, চিত্রকর প্রভৃতি এই আক্রমণের কবল থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল।[39]
তাতার বাহিনীর চল্লিশ দিনের ধ্বংসলীলায় এক লাখ ষাট হাযার হ’তে প্রায় দু্’লাখ নারী-পুরুষ নিহত হয়। এই সংখ্যা সলিল সমাধিতে মৃত ও পলায়ন করে নিখোঁজদের ব্যতীত।[40]
খলীফা ও তাঁর সন্তানদের শাহাদত বরণ :
খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহর যেমন মুত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছিল তেমনি তিনি অদূরদর্শিতার পরিচয়ও দিয়েছিলেন। ফলে আল্লাহ তাঁর হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। একদা তাতাররা খলীফার বাসভবন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। তখন খলীফার সামনে এক তরুণী খেলছিল এবং তাঁকে আনন্দ দিচ্ছিল। এসময় তাতার সৈন্যের ছুড়া তীর খলীফার জানালা ভেদ করে উক্ত তরুণীকে বিদ্ধ করে। মেয়েটি খলীফার সামনে ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। এতে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন এবং প্রচন্ড ভয় পান। তার সামনে তীরটি নিয়ে আসা হ’লে তিনি দেখেন যে, তাতে লিখা আছে- إِذَا أَرَادَ اللهُ إِنْفَاذَ قَضَائِهِ وَقَدَرِهِ سَلَبَ ذَوِي الْعُقُولِ عُقُولَهُمْ ‘আল্লাহ যখন তাঁর ফায়ছালা ও নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে চান তখন জ্ঞানীদের বুদ্ধি-বিবেক ছিনিয়ে নেন। এরপর তিনি নিরাপত্তা বাড়াতে বলেন এবং খলীফার বাড়ি সৈন্য দ্বারা বেষ্টন করে রাখার নির্দেশ দেন’।[41]
খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহ বহু চেষ্টা করেও প্রাণ রক্ষা করতে পারেননি। ইসলাম বিদ্বেষী দুই শী‘আ মন্ত্রীর উস্কানীর কারণে শেষ পর্যন্ত হালাকু খান খলীফার প্রাণ ভিক্ষা দিতেও রাযী হ’লেন না। ইসলাম জগতের খলীফাকে ১৪ই ছফর ৬৫৬ হিজরীতে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর চার মাস। তাঁর খেলাফতকাল ছিল ১৫ বছর ৮ মাস।[42]
জামালুদ্দীন সুলায়মান বিন রতলায়ন বলেন, আমার পিতা বর্ণনা করেন যে, খলীফার সাথে হালাকু খানের ইরাকের অর্ধেক রাজ্য প্রদানের শর্তে চুক্তি প্রায় হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় ইবনুল আলকামী হালাকুকে ইশারা করে বলল, বরং তাঁকে হত্যা করার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। অন্যথা পুরো ইরাক আপনার করতলগত হবে না।[43] হিংস্র তাতাররা খলীফাকে বস্তায় ভরে লাথি মারতে মারতে হত্যা করে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তাকে চটের বস্তায় ভরে কুঠার দ্বারা টুকরা টুকরা করে হত্যা করে। তাঁর সাথে তার বড় ছেলে আবুল আববাস আহমাদ ও মেঝো ছেলে আব্দুর রহমানকেও হত্যা করা হয়। আর ছোট ছেলে মুবরারক ও তাদের তিন বোন খাদীজা, মরিয়ম ও ফাতিমাকে বন্দী করে দাসে পরিণত করে। এছাড়া হাযার হাযার কুমারী নারীকে বন্দি করে প্রকাশ্যে তাদের ধর্ষণ করা হয়। এমনকি খলীফার স্ত্রীকেও ধর্ষণ করা হয় বলে বর্ণিত আছে।[44]
খলীফাকে হত্যা সম্পর্কে ইবনু খালদূন (রহঃ) বলেন, তাদের ধারণামতে বস্তায় ভরে হত্যার কারণ হ’ল- যাতে রক্ত মাটিতে না পতিত হয়।[45] কারণ তারা জানত যে, রক্ত মাটিতে পতিত হ’লে তাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হ’তে পারে। হালাকু খান প্রথমে খলীফাকে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিলে তাকে বলা হয়, যদি তাঁর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ে তাহ’লে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে এবং আপনার রাজত্ব ধ্বংসের কারণ হবে। কারণ তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর বংশধর এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর খলীফা। তখন ইসলামের শত্রু মানবরূপী শয়তান নাছীরুদ্দীন তূসী দাঁড়িয়ে বলল, তাঁকে এমনভাবে হত্যা করা হৌক যাতে রক্ত প্রবাহিত না হয়। ফলে তাকে বস্তায় ভরে লাথি মারতে মারতে হত্যা করা হয়। তাঁকে হত্যার জন্য আনা হ’লে তিনি এমন চিৎকার দেন যে বাগদাদের আকাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। খলীফাকে যখন তাতার বাহিনী তাবুতে অবরোধ করে রেখেছিল তখন তিনি মধুর স্বরে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন।[46]
ভয়াবহতা :
হালাকু বাহিনী চল্লিশ দিনে যে ধ্বংসলীলা ও হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল তা বর্ণনাতীত। তারা তাদের সহযোগী মুসলমানদের রেহাই দেয়নি। তাতাররা রামাযান মাসে মুসলমানদেরকে শূকরের গোশত ও মদ্যপান করতে বাধ্য করে।[47]
এরবলের শাসক ইবনুছ ছালায়া যে হালাকুকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিল তাকেও হালাকু হত্যা করে।[48] এছাড়া শায়খ ইবনুল জাওযী, তার তিন সন্তান আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান, আব্দুল করীম, মুজাহিদুদ্দীন দোওয়ায়দায়ে ছগীর আয়বেক, শিহাবুদ্দীন সুলায়মান শাহ, ছাদরুদ্দীন আলী বিন নাইয়ার সহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অসংখ্য আলেম-ওলামা, হাফেযে কুরআন, বক্তা ও ইমামদের হত্যা করা হয়।[49] প্রত্যক্ষদর্শী জামালুদ্দীন সুলায়মান বিন রতলায়ন বলেন, খলীফার সাথে যে ১৭ জন লোককে হালাকুর দরবারে উপস্থিত করা হয় তাদের মধ্যে আমার পিতাও ছিলেন। অন্যান্য সকলকে হত্যা করে। খলীফাকে একটি তাঁবুতে রাখা হয় এবং বাকী ১৭ জনকে অন্য একটি তাঁবুতে রাখা হয়। আমার পিতা বলেন, খলীফা প্রতি রাতে আমাদের কাছে এসে বলতেন, তোমরা আমার জন্য দো‘আ কর। একদিন খলীফার তাঁবুতে একটি পাখি বসলে হালাকু তাঁকে তলব করে জিজ্ঞেস করেন এই পাখি কীসের? এটি আপনাকে কি বলল? অতঃপর তাদের মধ্যে বহুক্ষণ আলাপচারিতা চলল। এরপর তাঁকে ও তাঁর বড় ছেলে আবুবকরকে লাথি মারতে শুরু করল। অবশেষে তারা মারা গেলেন। আর ঐ ১৭ জনকে ছেড়ে দিয়ে তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করা হ’ল, এতে তাদের দু’জন নিহত হ’ল। অন্যরা নিজেদের বাড়ি ফিরে এসে দেখল জনশূন্য বিরানভূমি। আমি আমার সঙ্গাহীন পিতার নিকট এসে দেখলাম, তিনি তার বন্ধুদের মধ্যে পড়ে আছেন। তাদের কেউ আমাকে চিনতে পারল না। তারা আমাকে বলল, আপনি কাকে চান? আমি বললাম, ফখরুদ্দীন বিন রতলায়নকে চাই। আমি তাকে চিনে ফেলেছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তার থেকে কি চাও? আমি বললাম, আমি তার সন্তান। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমাকে চিনতে পেরে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমার নিকট তখন কিছু খাদ্য ছিল তা তাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলাম।[50]
একজন লোক খলীফার প্রাসাদে প্রবেশ করে আববাসের বংশধরগণকে আহবান করে সমবেত করল। অতঃপর তাদের সকলকে কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে ছাগলের মত যবেহ করে হত্যা করল।[51] মাসের পর মাস মসজিদসমূহ বন্ধ থাকে। জুম‘আ ও জামা‘আতে ছালাত আদায় বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে ইবনুল আলকামী বাগদাদের মাদরাসা, মসজিদ ও পাঠশালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে শী‘আ রাফেযীদের দর্শণীয় স্থানগুলো উন্মুক্ত করে দেয়। সে রাফেযী মতাদর্শ প্রচার ও প্রসার করার জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পণা করে। কিন্তু আল্লাহ তার এহেন ঘৃণ্য আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে দেননি। কয়েক মাসের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে।[52]
ছয় শতাব্দী ধরে বাগদাদে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে অমূল্য ভান্ডার সঞ্চিত হয়েছিল নিষ্ঠুর তাতাররা এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্তই দজলার পানিতে ফেলে তা নিঃশেষ করে দেয়। ইবনু কাছীর (রহঃ) ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেন, অদৃষ্টে যা ঘটার ছিল যখন তা ঘটে শেষ হ’ল তখন ইসলাম জগতের কেন্দ্র বাগদাদ নগরী পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। খুব অল্প লোকই সেখানে দেখা যেত। পথে ঘাটে লাশগুলো টিলার মতো পড়েছিল। বৃষ্টির কারণে লাশগুলো পঁচে আকাশ-বাতাশ দুর্গন্ধযুক্ত হয়েছিল। বায়ু দূষিত হয়ে লাশের দুর্গন্ধ সিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বায়ু দূষণের ফলে অসংখ্য প্রাণী মারা যায়। লোকদের মধ্যে প্লেগ ও মহামারীর মতো বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ে।[53]
এই ধ্বংসলীলার পর যখন বাগদাদে নিরাপত্তার ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন আত্মরক্ষার্থে বাঙ্কার, নির্জনভূমি ও কবরের ভিতর যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা বের হয়ে আসে। ক্ষুধার কারণে লোকদের অবস্থা কঙ্কালসার হয়েছিল। যখন তাদেরকে কবর থেকে বের করা হ’ল তখন তারা একে অপরকে অস্বীকার করল। বাবা তার ছেলেকে এবং ভাই তার ভাইকে চিনতে পারছিল না। ভয়াবহ বিপদে ভীতবিহবল হয়ে পড়ল।[54]
ইসলামের ইতিহাসে বাগদাদ ধ্বংসের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। সেই ভয়ংকর ধ্বংসলীলা মুসলিম রাজ্যসমূহ এবং পরোক্ষভাবে সমগ্র দুনিয়ার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
ইবনু খালদূন বলেন, মুসলমানদের ভান্ডারে থাকা জ্ঞান- বিজ্ঞানের বহু কিতাব দজলা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। আর তারা এ ঘটনা এজন্য ঘটায় যে, তাদের ধারণা মতে মুসলমানেরা মাদায়েন বিজয়ের সময় পারসিকদের গ্রন্থসমূহকে এভাবেই নষ্ট করেছিল।[55] তিনদিন ধরে শহরের পথে পথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল এবং টাইগ্রিস নদীর পানি মাইলের পর মাইল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইবনু খালদূনের মতে, তাতারদের আক্রমণের ফলে এক লক্ষ ষাট হাযার লোক প্রাণ হারায়। মতান্তরে দু’লক্ষ অধিবাসীদের মধ্যে এক লক্ষ ষাট হাযার লোক মারা যায়।[56] কারো মতে আশি হাযার বা এক লক্ষ আশি হাযার মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।[57]
এই আক্রমণের ফলে বাগদাদ মোঙ্গলদের অধিকারভুক্ত হয় এবং মুসলিম বিশ্ব তিন বছরের জন্য খলীফা শূন্য হয়ে পড়ে। এই আক্রমণের তান্ডবে অসংখ্য নর-নারী আত্মাহুতি দেয়। পৃথিবীর বিশেষত মুসলমানদের ওপর যেসব বিরাট বিপর্যয় ও ভয়াবহ ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়েছিল তন্মধ্যে তাতারদের আক্রমণ অন্যতম। বাগদাদ পতনের ফলে আববাসীয় শাসনের অবসান ঘটে। অবসান ঘটে ইসলামী খেলাফতের, যার ছায়াতলে ইসলামী বিশ্ব পরিচালিত হয়ে আসছিল।[58]
বাগদাদ আক্রমণের ফলে বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাসাদ ও মসজিদ, মাদরাসা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অসংখ্য বই-পুস্তক বিনষ্ট হয় এবং বহু প্রখ্যাত পন্ডিত ও বৈজ্ঞানিক নিহত হন। এভাবে মুসলিম বিশ্বের স্বপ্নরাজ্য বাগদাদে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির যে দীপশিখা প্রজ্বলিত হয়েছিল তা মুহূর্তে নির্বাপিত হয়। তৎকালীন বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির শীর্ষ কেন্দ্র বাগদাদ ধ্বংসের ফলে শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়, বরং সারাবিশ্বের অগ্রগতিও ব্যাহত হয়েছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে যত ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে, বাগদাদ ধ্বংস তার সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাবে। বাগদাদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে বহু কবিতা ও শোকগাঁথা রচিত হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক স্বতন্ত্র ইতিহাস গ্রন্থ লিখেছেন। কিন্তু এই ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে কেউ পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেননি। বাদশা বখতে নছর বায়তুল মাক্বদাস ধ্বংস ও তার অধিবাসী বানী ইসরাঈলদের হত্যা করেছিল। কিন্তু বাগদাদ ধ্বংসের সাথে তার তুলনা হবে না। দাজ্জাল পৃথিবীতে এসে মানুষ হত্যা করবে। কিন্তু তার অনুসারীদের রেহাই দিবে। পক্ষান্তরে তাতার এমন রক্তপিপাসু জাতি ছিল যারা নারী-পুরুষ, শিশু সবাইকে হত্যা করেছে। এমনকি গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ঘটিয়ে ভ্রূণকেও হত্যা করেছে। বিশ্ব হয়ত ইয়াজূজ-মা‘জূজ ব্যতীত কারো দ্বারা এরূপ হত্যাকান্ড কখনো দেখবে না।[59]
অনেক ঐতিহাসিক তাদের ধ্বংসযজ্ঞকে ইয়াজূজ-মা‘জূজের ধ্বংসলীলার সাথে তুলনা করেছেন। তাতাররা এমন এক জাতি ছিল যারা সূর্যের পূজা করত। তারা কুকুর-শূকরসহ সকল প্রাণীর গোশত খেত। তাদের বৈবাহিক কোন ভিত্তি ছিল না। ফলে নারী-পুরুষ যে যাকে ইচ্ছা ভোগ করত। সন্তানদের কোন পরিচয় ছিল না।[60] এ কারণে হয়ত তারা এত হিংস্র ছিল। তাদের নারী সৈন্যরাও শত শত মানুষকে হত্যা করত। তাদের যুদ্ধ কৌশল দেখে লোকেরা তাদেরকে পুরুষ মনে করত।[61] তাই পরিশেষে বলব, শী‘আ-সুন্নী ও মাযহাবী মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হ’তে হবে। ক্ষমতার মোহে পড়ে দলাদলি না করে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট হ’তে হবে। অন্যথা ইসলাম তথা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বিদ্বেষীরা এমন হামলা করবে যে, হালাকু বাহিনীর মতো হানাফী-শাফেঈ, মালেকী-হাম্বলীসহ হকপন্থী জামা‘আতকেও ধ্বংস করে দিবে। তাই আসুন, আমরা বাগদাদ ধ্বংসের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপন করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন-আমীন!
শেষ অংশ পড়ুন: তাতারদের আদ্যোপান্ত (৫)
– আব্দুর রহীম
[1]. আল-কামিল ১০/৪৪৮-৪৫৪।
[2]. Lane-pool, The Muhammadan Dynasties. p. 206-206; ড. হাসান ইবরাহীম হাসান, তারীখুল ইসলাম ৪/১৪০।
[3]. সিরিয়ার লাযাকিয়া শহরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটি পাহাড়ি অঞ্চল।
[4]. তারীখুল ইসলাম, ৪/১৪৩-১৪৪।
[5]. ঐ, ৪/১৪৫।
[6]. ঐ, ৪/১৪৬।
[7]. D’Ohsson histoire des mongols, Tome 111, p.137-138; তারীখুল ইসলাম ৪/১৪৬।
[8]. রশীদুদ্দীন, জামি‘উত তাওয়ারীখ ২/১/২৬৮; তারীখুল ইসলাম ৪/১৪৭।
[9]. D’Ohsson, histoire des mongols, Tome 111, p.335; তারীখুল ইসলাম ৪/১৪৮।
[10]. জামি‘উত তাওয়ারীখ ২/১/২৬৯-২৭১; তারীখুল ইসলাম ৪/১৪৮।
[11]. ঐ, ২/১/২৭১; তারীখুল ইসলাম ৪/১৪৮।
[12]. জামি‘উত তাওয়ারীখ ২/১/২৬৯-২৭১; তারীখুল ইসলাম ৪/১৪৮।
[13]. সুয়ূতী, তারীখুল খোলাফা ১/৩২৮, ৪০১।
[14]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০২।
[15]. শারহু নাহজিল বালাগাহ ৮/২২-২৪; ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত-তারীখ ১০/৩৪১।
[16]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০১।
[17]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০২; সুয়ূতী, তারীখুল খোলাফা ১/৪০২।
[18]. তারীখে ইবনে খালদূন ৫/৫৪২; আল-বিদায়াহ ১৩/২০২; ইবনুল আমীদ, শাযারাতুয যাহাব ৫/২৭০; সুবকী, তাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৬২।
[19]. আল-বিদায়াহ ১৩/১৪৫।
[20]. আব্দুল হাই, শাযারাতুয যাহাব ৫/২৭০; যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১৬/৩৮৩; তাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৬২।
[21]. শাযারাতুয যাহাব ৫/২৭১; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১৬/৩৮৩; ইয়াফেঈ, মির’আতুল জিনান ৪/১০৫; সুয়ূতী, তারীখুল খোলাফা ১/৪০৩, ১/৩৩২।
[22]. শী‘আ ইমাম নাছীরুদ্দীন তূসী ৫৯৭ হিজরীতে ইরানের খোরাসান যেলার তূস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে নীসাপুরে চলে যান। তিনি তাতারদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। ইসমাঈলীয় মুসলমানরা পরাজিত হ’লে এবং আলমূত দুর্গের পতন ঘটলে তিনি হালাকু খানের সঙ্গী হন। তিনি ইতিপূর্বে আলাউদ্দীন বিন জালালুদ্দীন খোয়ারিযমের মন্ত্রী ছিলেন। তার ইঙ্গিতেই খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহকে বস্তায় ভরে হত্যা করা হয় এবং তারই নির্দেশে বড় বড় আলেম, ফক্বীহ ও ন্যায়পরায়ণ বিচারকদের হত্যা করা হয় (শাযারাতুয যাহাব ৫/৩৪০; আল-বিদায়াহ ১৩/২০১)। তূসী শিরক, কুফর ও নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত (ইবনুল কাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান ২/২৬৩)। তিনি ৬৭২ হিজরীতে মারা যান (আল-বিদায়াহ ১৩/২১৫)।
[23]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০১।
[24]. যাহাবী, দুওয়ালুল ইসলাম ১/১৮৬।
[25]. তাফসীরে মানার ৩/১০; সুয়ূতী, তারীখুল খোলাফা ১/৪০৪।
[26]. রশীদ রেযা, তাফসীরে মানার ৩/১০।
[27]. বুখারী হা/১২১; মিশকাত হা/২৬৫৯।
[28]. তাফসীরে মানার ৩/১৩, ২/২০৭।
[29]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/২৫৪; আল-ফাতাওয়াল কুবরা ২/১০৯।
[30]. ইবনু আবীল হাদীদ, শারহু নাহজিল বালাগাহ ২/৪৯৩, ৮/২৩৭।
[31]. শা‘রানী, কিতাবুল মীযান ১/৪৩।
[32]. শাযারাতুয যাহাব ৭/৪৬৮; আল-বিদায়াহ ১৩/২০০।
[33]. তারীখে ইবনে খালদূন ৫/৬১২-৬১৩; ড. হাসান ইবরাহীম, তারীখুল ইসলাম ৪/১৫০-১৫১।
[34]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০১; তারীখে ইবনে খালদূন ৫/৬১৩; ড. হাসান ইবরাহীম, তারীখুল ইসলাম ৪/১৫০-১৫১।
[35]. রশীদুদ্দীন, জামে‘উত তাওয়ারীখ ২/২৯১-২৯২; আল-বিদায়াহ ১৩/২০১; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৪৮/২৬০; যিরিকলী, আল- ই‘লাম ৪/১৪০; ড. হাসান ইবরাহীম, তারীখুল ইসলাম ৪/১৫০-১৫১।
[36]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০১; দুওয়ালুল ইসলাম ২/১১২; শাযারাতুয যাহাব ৫/২৭১।
[37]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০২।
[38]. ঐ, ১৩/২০২।
[39]. Browne, Literary History of Persia 2/461-462।
[40]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০২; হাসান ইবরাহীম, তারীখুল ইসলাম ৪/১৫৩।
[41]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০০, ১৩/২৩৩।
[42]. ঐ, ১৩/২০২।
[43]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২৩/১৮৩।
[44]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০২; তারীখে ইবনু খালদূন ৫/৫৪৩; তারীখুল খোলাফা ১/৪০৪; শাযারাতুয যাহাব ৭/৪৬৯; তাজউদ্দীন বিন আলী আস-সুবকী, ত্বাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৭১।
[45]. তারীখে ইবনে খালদূন ৫/৬১৩, ৩/৬৬৩।
[46]. ত্বাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৭১; আল-বিদায়াহ ১৩/২০৩।
[47]. ত্বাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৭১।
[48]. ত্বাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৭১।
[49]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০৩।
[50]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২৩/১৮৩।
[51]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০৩।
[52]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২৩/১৮৩।
[53]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০৩; ত্বাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৭১ ইবনুল কূত্বী, আল-হাওয়াদিছুল জামে‘আতু ফী আ‘য়ানিল মিয়াতিস সাবে‘আ, পৃষ্ঠা ৩৩০-৩৩১; তারীখুল ইসলাম ৪/১৫২।
[54]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০৩।
[55]. তারীখে ইবনে খালদূন ৫/৬১৩।
[56]. ত্বাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৭১; তারীখে ইবনে খালদূন ৫/৬১৩।
[57]. আল-বিদায়াহ ১৩/২০২।
[58]. শাযারাতুয যাহাব ৭/৪৭০; তারীখুল ইসলাম ৪/১৫৩।
[59]. ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত-তারীখ ১০/৩৩৩।
[60]. ঐ, ১০/৩৩৫।
[61]. ঐ, ১০/৩৪৮।
No comments