রমজানের ইতিকাফে অফুরন্ত সওয়াব
মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। ফরজে কিফায়া ও ওয়াজিবে কিফায়ার যে বিধান, ঠিক তেমনি সুন্নতে কিফায়ার বিধানও। যদি কেউই এ সুন্নাতে কিফায়া আদায় না করে তাহলে সবাই গুনাহগার হবে। আর যদি শহর বা মহল্লার কোনো একজন তা আদায় করে, তাহলে সবার পক্ষে আদায় হয়ে যাবে।
ইতিকাফ আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো অবস্থান করা, স্থির থাকা বা আবদ্ধ হয়ে থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় রমজানের শেষ ১০ দিন অথবা অন্য কোনো দিন জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদতের নিয়তে মসজিদে বা ঘরে নামাজের স্থানে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয়। ইতিকাফের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়ার সব রকম ঝামেলা থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে একমাত্র তাঁরই ইবাদতে মশগুল থাকা। ইতিকাফকারী পুরুষ ও নারী বহু ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে এবং লাইলাতুল কদর লাভের আশা করতে পারে।
ইতিকাফ শুধু রাসুল (সা.)-এর যুগেই ছিল না, পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের উম্মতদের মধ্যেও পালিত হতো। কিন্তু আগের নবীদের ইতিকাফের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে দাউদ (আ.) ও মুসা (আ.)সহ আরো কিছু নবী এবং তাঁদের উম্মতদের জীবনী থেকে ইতিকাফের মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, বিধর্মীদের মধ্যেও ইতিকাফের নিয়ম ছিল বলে হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়। উমর (রা.) একদিন রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি জাহেলি যুগে মসজিদুল হারামে এক রাত ইতিকাফের মানত করেছিলাম। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার মানত পুরো করে নাও।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৩২)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, উমর (রা.) অমুসলিম থাকা অবস্থায় ইতিকাফের মানত করেছিলেন। সুতরাং ইতিকাফের এ নিয়ম তাঁদের মধ্যেও চালু ছিল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকুকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৫)
এ আয়াতের দ্বারাও ইতিকাফের সন্ধান পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগের আগের ইতিকাফ ছিল অন্য ধরনের এবং অন্য উদ্দেশ্যে। কিন্তু ইসলাম ইতিকাফকে প্রথাগত চালু না রেখে বিশুদ্ধ ইবাদতে পরিণত করেছে এবং অন্য ইবাদতের মতোই ইতিকাফের জন্য বিভিন্ন ধরনের শর্ত আরোপ করেছে।
ইতিকাফ একটি পবিত্র এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বলেই রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও আগ্রহের সঙ্গে ইতিকাফ করতেন এবং সাহাবিদের ইতিকাফ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত এ আমল অব্যাহত ছিল। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর পবিত্র বিবিরা ইতিকাফ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৬)
উবাই ইবনে কাব (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন; কিন্তু এক বছর তিনি ইতিকাফ করেননি।
এ জন্য পরের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৬৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইতিকাফকারী ব্যক্তি যাবতীয় গুনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে এবং তার জন্য পুণ্যসমূহ জারি রাখা হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৮১)
অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় এক দিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তার এবং জাহান্নামের মধ্যে তিনটি গহ্বর সৃষ্টি করবেন। যার দূরত্ব আসমান ও জমিনের দূরত্ব অপেক্ষা অধিক হবে।’ (আল-মুজামুল আউসাত, হাদিস : ৭৩২৬)
ইতিকাফের কয়েকটি শর্ত রয়েছে। ১. নিয়ত করা। নিয়ত ছাড়া ইতিকাফ করলে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না। ২. পুরুষদের জন্য এ ধরনের মসজিদ হতে হবে, যেখানে জামায়াতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা হয়। তবে নফল ইতিকাফ যেকোনো মসজিদেই হতে পারে। নারীরা নিজেদের ঘরের নামাজের স্থানে ইতিকাফ করবেন। তারা প্রয়োজন ছাড়া এ স্থান থেকে বের হবেন না। ৩. রোজা রাখা। তবে নফল ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত নয়। ৪. মুসলিম হওয়া। কেননা কোনো অমুসলিম ব্যক্তি ইবাদতের যোগ্যতা রাখে না। ৫. জ্ঞানবান হওয়া। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়। এ জন্য জ্ঞানবান অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকার ইতিকাফও শুদ্ধ হবে; যেমনিভাবে তাদের নামাজ ও রোজা দুরস্ত হয়। ৬. নারী-পুরুষ সবাই গোসল ফরজ হয় এমন অপবিত্রতা থেকে এবং নারীদের পিরিয়ড থেকে পবিত্র হওয়া। ৭. বিবাহিত নারীদের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। (আল-ওয়াজিজ ফিল ফিকহিল ইসলামি, পৃষ্ঠা ৩৪৯)
ইতিকাফ তিন প্রকার : ১. ওয়াজিব ২. সুন্নত ৩. নফল ইতিকাফ।
ইতিকাফ ওয়াজিব হয় মানত করলেই। কোনো কিছুর জন্য মানত করলে উক্ত মানত শর্তবিশিষ্ট হোক অথবা শর্তবিহীন হোক ইতিকাফ করা ওয়াজিব। মানতের ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য রোজা শর্ত।
সুন্নত ইতিকাফ হলো, রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। শহর বা মহল্লার কোনো একজন তা আদায় করলেই বাকিরা দায়মুক্ত হয়ে যাবে।
নফল ইতিকাফের জন্য কোনো সময় নির্ধারিত নেই। যেকোনো সময় করা যেতে পারে। রোজারও প্রয়োজন নেই। আর সময়ের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। এক মিনিটের জন্যও ইতিকাফ করা যায়। দিনে বা রাতে যে পরিমাণ সময়ের জন্য ইচ্ছা নিয়ত করে ইতিকাফ করা যাবে। যদি কেউ মসজিদে প্রবেশ করে ইতিকাফের নিয়তে, তাহলে সে যতক্ষণ মসজিদে অবস্থান করবে ততক্ষণ ইতিকাফের সওয়াব পাবে। আর এ অবস্থায় মসজিদে পানাহার ও নিদ্রা জায়েজ হয়ে যাবে।
ইতিকাফকারী ব্যক্তি শরয়ি প্রয়োজন এবং মানবীয় প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে মসজিদের বাইরে গেলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। শরয়ি প্রয়োজন যেমন—জুমার নামাজের জন্য বের হওয়া। মানবীয় প্রয়োজন যেমন—মলমূত্র ত্যাগ করার জন্য যাওয়া। কিন্তু প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পর অল্প সময় মসজিদের বাইরে থাকলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। ইচ্ছাকৃত বের হলেও এ বিধান প্রযোজ্য হবে। (আল-বাহরুর রায়েক, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৪)
ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম বা এর আনুষঙ্গিক কার্যাবলি হারাম। এ কাজসমূহের দ্বারা ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা পরবর্তীতে যথানিয়মে কাজা করে দিতে হবে।
ইতিকাফ অবস্থায় অধিক ইবাদত করা প্রয়োজন। সব সময় কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, হাদিস, তাফসির অধ্যয়ন, নফল নামাজের জন্যও ইতিকাফ একটি উত্তম সময়। এটি লায়লাতুল কদর তালাশেরও উত্তম সুযোগ।
আসুন, আমরা ১০ দিন সঠিকভাবে ইতিকাফ করে লাইলাতুল কদর বা হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনী লাভের সৌভাগ্য অর্জন করি এবং অফুরন্ত পুণ্য লাভ করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দিন।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments