চাল দিয়েও কি ফিতরা আদায় করা যাবে?
এর ভেতর একটি হচ্ছে এই যে, এ পাঁচটি খাদ্য দ্রব্যের বাইরে অন্য কোনো খাদ্য দ্রব্য দিয়ে ফিতরা দেয়া যাবে কি না? এবং এর মূল্য পরিশোধ করলে হবে কি না?
মূলত মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুল (সা.) এর সময়ে মুদ্রার ব্যবহার ছিল সীমিত। রোম, পারস্য থেকে যে দিরহাম দিনার আসত সেগুলোই মদিনার বাজারে চলত।
শুধু মদিনা কেন, পুরো আরবেই অন্য দেশের স্বর্ণ রৌপ্য মুদ্রার উপর নির্ভর করতে হতো। এজন্য পণ্য আদান প্রদানে মুদ্রা খুব কমই ব্যবহার করা হতো। সাধারণত পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বিক্রয়ের রেওয়াজ ছিল তৎকালীন আরবে। এজন্য সেসময় বর্তমানের মত ফিতরা হিসেবে টাকা নির্ধারণ করা হয়নি।
হজরত উমর (রা.) এর সময়ে মদিনায় মুদ্রা বানানো হয়। মুসলিম সাম্রাজ্যের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরি হলেও সেসময়েও পণ্যের বিনিময়ে পণ্য আদান প্রদানের ধারা ব্যাহত হয়নি।
এত আগের কথা কেন, এই কিছুদিন পূর্বেও আমাদের মফস্বলগুলোয় নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ চাল ডাল তরি-তরকারি নিয়ে বাজারে গিয়ে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কিনে আনত। এই বিষয়টি মাথায় রাখলে ফিতরার মাসআলা বুঝতে সহজ হবে।
হানাফি মাজহাবের কিতাবসমূহে বলা হয়েছে যে, গম, জব, কিসমিস, পনির ও খেজুর না দিয়ে এসব খাবারের মূল্য ফিতরা হিসেবে দেয়া উত্তম। এ ফতোয়ার কারণ খুবই স্পষ্ট।
আর তা হচ্ছে এই যে, গরিব দুস্থ মানুষদের এক কেজি ৭০০ গ্রাম গম দিয়ে আসলে তাতে তাদের কোনো লাভ হবে না। বিশেষত আমাদের দেশে গম নিয়ে কোনো দোকানে বিক্রি করাও হবে যথেষ্ট কষ্টকর। গরিবের উপকারে আসে সেভাবেই দান করা উচিত। গম না দিয়ে গমের সমমূল্য পরিমাণ টাকা দিলে গরিব মানুষ প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে।
রাসুল (সা.) তার যুগে মূল্য ঘোষণা করেননি কেন তার কারণ আগেই স্পষ্ট করেছি। কাজেই যারা হাদিসের ওপর আমল করার কথা বলে টাকা দেয়ার সুযোগ রাখছেন না, এটা তাদের একান্ত নিজস্ব চিন্তা।
হানাফি ফিকাহবিদ ছাড়া অন্য ফকীহরা আরও একধাপ অগ্রসর হয়ে বলছেন, এই পাঁচটি বস্তুতেই সীমাবদ্ধ নয়। যদি কেউ তাদের অঞ্চলে প্রচলিত খাবারের এক সা ফিতরা দিতে চায় তা-ও দিতে পারবে।
অর্থাৎ যেখানের মানুষ ভাত খায় তারা চাল দিয়ে ফিতরা দিবে। যেখানের মূল খাদ্য ভুট্টা তারা ভুট্টা দিবে ফিতরা হিসেবে। যেখানে আলু প্রধান খাদ্য সেখানে আলু দিয়েও ফিতরা দেওয়া যাবে।
দেখা যাচ্ছে অন্য ফিকহের ইমামগণ হাদিস থেকে বুঝছেন, রাসুল (সা.) পাঁচটির নাম উল্লেখ করেছেন উদহারণ হিসেবে। তা না হলে প্রত্যেক অঞ্চলের প্রধান খাদ্য পণ্যও ফিতরা হতে পারে।
মজার একটি বিষয় বলব, হানাফিদের দুর্নাম করা হয় যে, তারা হাদিসের ওপর কিয়াস করে। হাদিসের ওপর তারা আমল করে না।
এই ফিতরার হাদিসের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অন্য মাজহাবের ইমামরা বরং বেশি কিয়াস করছেন। তারা হাদিসে বর্ণিত পাঁচটি পণ্যের সঙ্গে অসংখ্য পণ্যকে তুলনা করছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে হানাফি মাজহাবে কেন এই তুলনা করা হয়নি। অন্য ইমামদের মতামত গ্রহণ করলে আমরা বাঙালিরা চাল মেপে ফিতরা দিতে পারতাম। যুক্তির বিচারে বাহ্যত এটা সুন্দর মনে হয়।
কিন্তু হানাফি মাজহাবের এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। নিছক যুক্তি তারা গ্রহণ করে না। হাদিস-কোরআন থেকে তারা বোঝার চেষ্টা করেন এখানে কিয়াসের পথ খোলা রাখা হয়েছে কি না।
যদি বুঝে আসে যে কিয়াসের পথ এখানে খোলা রাখা হয়েছে তাহলে সেখানেই কেবল কিয়াস করেন। ইচ্ছে হলেই তারা কিয়াস করেন না।
মূলত রাসুল (সা.) এর উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এ পাঁচটি খাদ্য পণ্যের সঙ্গে তুলনা করে যে কোনো খাদ্য মেপেও ফিতরা দেয়া যাবে। কারণ এমন উদ্দেশ্য হলে রাসুল (সা.) স্পষ্টই বলতেন, প্রত্যেক এলাকার খাদ্যদ্রব্য থেকে ফিতরা দিয়ে দিবে।
রাসুল (সা.) তা বলেননি। ইমাম মালিক বা অন্যরা বলছেন, তৎকালীন মদিনা মুনাওয়ারার খাদ্য ছিল এ পাঁচটি। কাজেই অন্য স্থানে যে প্রধান খাদ্য আছে তা দিয়েও ফিতরা দিলে তা আদায় হয়ে যাবে।
এ যুক্তিটি আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে শক্তিশালি মনে হয় না। কারণ মদিনার প্রধান খাদ্য কী ছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। হাজার মতামত থাক, মদিনার প্রধান খাদ্য একটিই হবে, পাঁচটিই প্রধান খাদ্য হতে পারে না।
মনে করুন কেউ কেবল পনির খেয়েই বেঁচে থাকত না। ভাতের মত করে পনির কখনও কোথাও খাওয়া হয়েছে বলে কেউ বলতে পারবে না।
হাদিসে পনিরের কথাটিও এসেছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে রাসুল (সা.) উদহারণ দেয়ার জন্য এ পাঁচটি খাদ্যের কথা বলেননি। বরং ফিতরার জন্য এ পাঁচটিকেই নির্ধারণ করেছেন।
তার কারণ এ পাঁচটি খাদ্যই এমন যা পৃথিবীর সবখানেই সেই প্রাচীন কাল থেকেই পাওয়া যায়। সেসময় আরবে চাল পাওয়া যেত না। কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষে গম ঠিকই চাষ হতো।
আরবের খেজুরও আমদানি রপ্তানির ইতিহাস সুপ্রাচীন কাল থেকেই আছে। দুধ থেকে তৈরি হয় পনির। দুধ, খেজুর, আটা ও কিসমিস সর্বজনীন খাবার বলা চলে।
ইসলাম সারা বিশ্বের মানুষের জন্য। তাই এর বিধান দেয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও লক্ষ্য রাখতে হয়, যেন বিশ্বের সব অঞ্চলের মানুষ তা সহজে পালন করতে পারে।
মূল আলোচনায় আসি। চাল দিয়ে ফিতরা দেয়ার কোনো সুরত কি নেই? হ্যা অবশ্যই আছে। এই করোনার সময় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ঘরে চাল নেই। এখন কয়েক কেজি চালের কদর কি তা বুঝিয়ে বলতে হবে না।
এ সময় অবশ্যই আপনি চাল বণ্টন করতে পারেন ফিতরা হিসেবে। তবে অবশ্যই আটা খেজুর পনির কিসমিস ও জবের ফিতরার সমমূল্যের চাল হিসেব করে ফিতরা আদায় করা যাবে।
সহজ করে বললে সরাসরি চাল নয়। মনে করুন, খেজুর দিয়ে ফিতরা আদায়ের সামর্থ আছে আপনার, তাহলে আপনাকে তিন কেজি তিনশ গ্রাম খেজুরের মূল্য হিসেব করতে হবে।
সে হিসেবে উদহারণত প্রতি কেজি খেজুরের দাম যদি হয় ১২০০ টাকা। তাহলে প্রায় চার হাজার টাকার চাল কিনে আপনি আপনার ফিতরা হিসেবে কোনো পরিবারকে চার হাজার টাকা মূল্যের চাল ডাল দিতে পারেন।
গমের হিসেবে এবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনে নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ টাকা। সে হিসেবে আপনি ৭০ টাকার চাল খরিদ করে কোনো পরিবারে দিতে পারেন।
অবশ্যই এ ক্ষেত্রে গরিবের উপকারের দিকটি লক্ষ্য রেখেই মাসআলার সমাধান বের করতে হবে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, কোরআন হাদিস মানুষের জন্যই। মানুষের কল্যাণ হয় যাতে সেভাবেই ব্যাখ্যা বুঝতে হবে। একাধিক ব্যাখ্যা থাকলে মানুষের জন্য যে ব্যাখ্যায় অধিক কল্যাণ হয় সে ব্যাখ্যাটিই গ্রহণ করা উচিৎ।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই করোনা মহামারির বিপর্যয়কালে গরিব দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দিন। আমীন।
No comments