উসাইদ ইবনে হুযাইর (রাঃ) এর জীবনী
প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী উসাইদ মদীনার ঐতিহ্যবাহী আউস গোত্রের বনী ’আবদুল আশহাল শাখার সন্তান। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪০) সীরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর একাধিক কুনিয়াত বা ডাকনাম দেখতে পাওয়া যায়। যেমনঃ পুত্র ইয়াহইয়ার নাম অনুসারে আবু ইয়াহইয়া, আবু ঈসা-এ নামে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে ডেকেছেন বলে বর্ণিত আছে। (উসুদুল গাবা- ১/৯২) তাছাড়া আবু ’আতীক, আবু হুদাইর, আবু ’আমর ইত্যাদি নামের কথাও জানা যায়। (দ্রঃ সীয়ারে আনসার- ১/২২৮), উসুদুল গাবা- ১/৯২, আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪০, আল-আলাম- ১/৩৩০)
তাঁর পিতার নাম হুদাইর ইবন সিমাক এবং মাতার নাম উম্মু উসাইদ বিনতু উসকুন। হুদাইর ছিলেন আউস গোত্রের একজন রয়িস বা নেতা। ইসলামপূর্ব যুগে মদীনার চির বৈরী আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে যতগুলি যুদ্ধ হয়েছে তার সবগুলির নেতৃত্ব দেন হুদাইর। তিনি ছিলেন আউস গোত্রের প্রধান ঘোড় সাওয়ার। তাঁর নিজস্ব একটি মজবুত দুর্গও ছিল। (উসুদুল গাবা- ১/৯২) আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সংঘটিত সর্বশেষ ও সর্ববৃহৎ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটি ছিল ‘বু’য়াসের’ যুদ্ধ। এ যুদ্ধেরও সিপাহসালার ছিলেন হুদাইর, আর প্রতিপক্ষ খাযরাজ গোত্রের সেনাপতি ছিলেন ’আমর ইবন নু’মান রুজাইলা। উভয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সৈন্য পরিচালনা করেন। এক পর্যায়ে আউস গোত্র পরাজয়ের কাছাকাছি পৌছে যায়। এ অবস্থায় হুদাইর নিজেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। খাযরাজ সেনাপতি ’আমর নিহত হন এবং আউস গোত্র বিজয়ী হয়। রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় হিজরাতের পাঁচ বছর পূর্বে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। (সীয়ারে আনসার- ১/২২৮)
উপরোক্ত ‘বুয়াস’ যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর মক্কায় ‘আকাবায় বাই’য়াত অনুষ্ঠিত হয় এবং মদীনাবাসী নওমুসলিমদের অনুরোধে হযরত রাসূলে কারীম সা. মুসয়াব েইবন ’উমাইরকে তাবলীগে ইসলামের উদ্দেশ্যে মদীনায় পাঠান। উসাইদ তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন মদীনায় হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইরের হাতে এবং হযরত মু’য়াজ ইবন জাবালের পূর্বে। কারো কারো মতে তিনি শেষ আকাবার পরে অর্থাৎ যে বার ৭৩/৭৫ জন মদীনাবাসী মক্কার আকাবা নামক স্থানে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করেন, তারও পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে একথা সঠিক নয়। কারণ, তিনি যে এই শেষ আকাবায় শরীক হন এবং রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক বনী আবদুল আশহালের ‘নাকীব’ বা দায়িত্বশীল নিযুক্ত হন তা সীরাত গ্রন্থসমূহে বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। (উসুদুল গাবা- ১/৯২, তারীখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাতুল মাশাহীর ওয়াল আ’লাম- ১/১৮১, আল-আ’লাম- ১/৩১০, আল-ইসাবা- ১/৪৯)
হযরত উসাইদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে সীরাত গ্রন্থসমূহে চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইর মদীনায় হযরত আস’য়াদ ইবন যুরারা গৃহে অতিথি হন এবং বনী জাফার গোত্রে বসে মানুষকে কুরআনের তা’লীম দিতে থাকেন। বনী জাফারের বসতি ছিল ’আবদুল আশহাল গোত্রের কাছাকাছি। একদিন মুস’য়াব রা. একটি বাগানে বসে মুসলমানদের কুরআনের তা’লীম দিচ্ছেন, একথা সা’দ ইবন মু’য়াজ এবং উসাইদ ইবন হুদাইর জেনে ফেলেন। সা’দ উসাইদকে বললেন, তুমি সেখানে যাও এবং তাকে বল, সে যেন ভবিষ্যতে আর কখনও আমাদের এ মহল্লার চৌহদ্দিতে না আসে। যদিও আস’য়াদ ছিলেন সা’দের খালাতো বা মামাতো ভাই। সা’দের কথামত উসাইদ নিজ হাতে ইসলামের মূলোৎপাটনের জন্য বাগিচার দিকে চললেন। আস’য়াদ তাঁকে আসতে দেখে মুস’য়াবকে বললেন, ‘দেখুন একটি লোক আপনার কাছে আসছে। সে তার গোত্রের সরদার, আপনি তাঁকে মুসলমান বানিয়ে দিন।’
উসাইদ অত্যন্ত গরম মেজাজে বললেন, ‘এভাবে তোমরা আমাদের দুর্বল লোকগুলিকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছ কেন? যদি ভালো চাও, এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাও।’ রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দা’ঈ (আহবানকারী) মুস’য়াব হাসিমুখে অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে বললেন, ‘আপনি বসুন, আমার কথা একটু শুনুন। পছন্দ হলে কবুল করবেন, আর না হলে আমি বন্ধ করে চলে যাব।’ উসাইদ বললেন, এ তো বড় বুদ্ধিমত্তা ও ইনসাফের কথা।’
হযরত মুস’য়াবের এমন বিনীত আচরণে উসাইদের রাগ পড়ে গেল। তিনি বসে পড়লেন। মুস’য়াব তাঁর সামনে ইসলামের মর্মকথা তুলে ধরে কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে শোনান। মুস’য়াব কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে যাচ্ছেন, আর এ দিকে উসাইদের চেহারা একটু একটু পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে তিনি দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। অবলীলাক্রমে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘এই দ্বীনে দাখিল হওয়া যায় কিভাবে? মুস’য়াব বললেন, প্রথমে গোসল ও পাক-সাফ কাপড় পরে কালিমা উচ্চারণ করতে হবে। তারপর সালাত আদায় করতে হবে।’ মুস’য়াবের কথা শেষ না হতে উসাইদ স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন। অল্পক্ষণ পর আবার যখন ফিরে আসলেন তখন তাঁর মাথার চুল ভিজা এবং পরনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়।
তারপর মুস’যাবের হাতে হাত রেখে উচ্চারণ করলেন, ‘আশহাদু আন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু- আমি সাক্ষ দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তারপর তিনি মজলিস থেকে উঠে যেতে যেতে বললেন, ‘আমি যাচ্ছি এবং অন্য নেতাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি, তাদেরকেও মুসলমান বানিয়ে ছাড়বেন।’ (হায়াতুস সাহাবা- ১/১৮৮-১৮৯, সীয়ারে আনসার- ১/২২৯)
উসাইদ উঠে সোজা সা’দ ইবন মুয়াজের দিকে চলে গেলেন। তাঁকে যেতে দেখে সা’দের কাছে বসা লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, সে আসছে, কিন্তু যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিলো তাতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যাওয়ার সময় ছিল দারুণ উত্তেজিত আর এখন দেখা যাচ্ছে শান্ত-শিষ্ট ও হাসিখুশি।
এ ক্ষেত্রে উসাইদ তাঁর বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর একান্ত ইচ্ছা, মুস’য়াবের মুখ থেকে তিনি যা শুনেছেন, সা’দও তা শুনুক। কিন্তু তিনি যদি সরাসরি ঘোষণা দেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, তুমিও আমার অনুসরণ কর, তাহলে সে হয়তো উসাইদের ওপর ঝাপিয়ে পড়তো। তিনি তা না করে সা’দকেও মুস’য়াবের সামনে হাজির করতে চাইলেন।
মুস’য়াব ছিলেন আস’য়াদ ইবন যুরারা অতিথি। তাই সা’দকে ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে উসাইদ বললেন, ‘আমি শুনেছি, বনী হারেসার লোকেরা আস’য়াদ ইবন যুরারাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তারা তো একথা ভালো করেই জানে সে তোমার মামাতো ভাই।’
সা’দ রাগে ফুঁসে উঠলেন। সাথে সাথে তিনি তীর হাতে নিয়ে মুস’য়াব ও আস’য়াদের কাছে পৌঁছেলেন। সেখানে কোন শোরগোল বা ঝগড়া-বিবাদের চিহ্ন দেখতে পেলেন না; বরং তার বিপরীত এক শান্ত পরিবেশে মুস’য়াব মানুষকে কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছেন আর লোকেরা মনোযোগ সহকারে তা শুনছে। সা’দ তার বন্ধু উসাইদের ধোঁকা বুঝতে পারলেন। তিনিও মুসয়াবের কথা মন দিয়ে শুনলেন এবং সেখানেই ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৩৬-৪৩৭, রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪৬০-৪৬১)
হযরত উসাইদের ইসলাম গ্রহণের কিছু দিন পর হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনায় হিজরাত করেন। তিনি প্রখ্যাত মুহাজির সাহাবী হযরত যায়িদ ইবন হারিসার রা. সাতে উসাইদের ‘মুওয়াখাত’ বা দ্বীনি ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। (উসুদুল গাবা- ১/৯২, আল ইসাবা- ১/৪৯)
উহুদ থেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় সংঘটিত সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। (আল-আ’লাম-১/৩৩০) বদর যুদ্ধে তাঁর যোগদানের ব্যাপারে মতভেদ আছে। ওয়াকিদী, ইবন ইসহাক ও ইবনুল কালবীর মতে তিনি বদরে অংশগ্রহণ করেননি। তবে কোন কোন সীরাত বিশেষজ্ঞ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। (উসুদুল গাবা- ১/৯২, আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪০, তাবাকাত- ৩/৬০৫) ইবন সা’দ বলেন, উসাইদের মত আরও কয়েকজন নাকীব সাহাবীসহ কিছু বিশিষ্ট সাহাবী বদর যুদ্ধে যোগদান করেননি। বালাজুরী বলেন, হযরত রাসূলে কারীম সা. বদরের দিকে যাত্রা করলেন; কিন্তু তাঁর কিছু সাহাবী পিছনে থেকে গেলেন। তাঁরা ধারণা করতে পারেননি যে, কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হবে। এই পিছনে থেকে যাওয়া সাহাবীদের একজন হলেন উসাইদ। রাসূলুল্লাহ সা. বদর যুদ্ধ শেষ করে যখন মদীনায় ফিরলেন, উসাইদ দ্রুত রাসূলুল্লাহর সা. নিকট ছুটে গেলেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে আল্লাহ বিজয় দান করায় তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। নিজে যোগদান করতে না পারার জন্য দুঃখ ও অনুশোচনা প্রকাশ করলেন। কৈফিয়াত হিসাবে বললেনঃ আমি ধারণা করেছিলাম, ওটা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফিলা। তাঁদের সাথে আপনি যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না। আমি যদি বুঝতাম, তারা শত্রু এবং তাদের সাথে আপনার সংঘর্ষ হবে তাহলে কক্ষণো পিছনে পড়ে থাকতাম না। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁর কথা বিশ্বাস করেন। ইবন সা’দ ও একই কথা বর্ণনা করেছেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৮৮, তাবাকাত- ৩/৬০৫)
তিনি উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধের প্রাক্কালে মদীনায় সা’দ ইবন মু’য়াজ’, উসাইদ ইবন হুদাইর ও সা’দ ইবন উবাদার নেতৃত্বে একদল লোক রাসূলুল্লাহর সা. পাহারায় নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা সারারাত রাসূলুল্লাহর সা. দরজায় পাহারা দিতেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩১৪)। যুদ্ধের চরম মুহূর্তে এক পর্যায়ে যখন প্রায় সকল সাহাবী বিক্ষিপ্তভাবে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে দূরে ছিটকে পড়েন, তখনও তিনি মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবীর সাথে অটল থাকেন। এই যুদ্ধে তাঁর দেহের সাতটি স্থান দারুণভাবে আহত হয়। (আল ইসাবা- ১/৪৯), আল-আ’লাম- ১/৩৩০) উহুদ যুদ্ধে শহীদদের জন্য তাঁদের আত্মীয়-পরিজন কান্নাকাটি করতে থাকে। তা দেখে হযরত রাসূলে কারীম সা. বলেন, আজ হামযার জন্য কাঁদার কেউ নেই। সা’দ ও উসাইদ একথা শুনে নিজ গোত্রে ফিরে এসে তাঁদের নারীদের হামযার স্মরণে বিলাপের নির্দেশ দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৯৯) উহুদের দিনে বনী আউসের পতাকা ছিল উসাইদের হাতে। প্রচন্ড যুদ্ধের সময় মুসলিম সৈনিকদের কউ কেউ ভুলবশতঃ নিজেগের সৈনিকদের কাফির সৈনিক মনে করে আঘাত করে বসে।
উসাইদ ভুলক্রমে আবু বারদাহ ইবন নায়ারের হাতে আহত হন। তেমনিভাবে আবু যা’না না চিনতে পেরে আবু বারদাহকে তরবারির দুটি আঘাত করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁদের সম্পর্কে বলেন, সে তোমাদের কেউ এভাবে নিহত হলেও শহীদ হবে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩১৮, ৩২২)
তিনি খন্দক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও দশ দিন পর্যন্ত মুসলমানরা মদীনায় ঘেরা অবস্থায় ছিল। মক্কার পৌত্তলিক বাহিনী মুসলিম নেতৃবৃন্দের খোঁজে রাতে ঘুরা-ফিরা করতো। উসাইদ তখন দুই শো লোক নিয়ে খন্দক রক্ষা করেন। খন্দক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাতফান গোত্রের লোকেরা খুব লুটতরাজ শুরু করে দিল। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁদের নেতা আমের ইবন তুফাইল ও যায়িদকে মদীনায় ডেকে পাঠালেন। তারা মদীনায় উপস্থিত হয়ে সম্মিলিতভাবে বলল, যদি মদীনায় উৎপাদিত ফলের একটি অংশ তাঁদের দেওয়া হয় তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
উসাইদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হাতের নিযা দিয়ে দুইজনের মাথায় টোকা দিয়ে বলে উঠলেনঃ খেঁকশিয়াল, দূর হ এখান থেকে। একথায় আমের দারুণ ক্ষুব্ধ হয়। সে জিজ্ঞেস করে- তুমি কে?
– উসাইদ ইবন হুদাইর।
– কাতাইবের পুত্র? (উল্লেখ্য যে, কাতাইব উসাইদের পিতা হুদাইরের উপাধি)
– হ্যাঁ
– তোমার পিতা তোমার চেয়ে ভালো।
সংগে সংগে উসাইদ গর্জে উঠে বললেন, ‘কক্ষণও না। আমি তোমাদের সকলের চেয়ে এবং আমার পিতার চেয়ে ঢের ভালো। কারণ তিনি কাফির ছিলেন।’ (সীয়ারে আনসার- ১/২৩০)
সম্ভবতঃ উপরোক্ত ঘটনাটিই ইবন আব্বাস থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন। আমির ইবন তুফাইল ও আরবাদ ইবন কায়েস নামক দুই ব্যক্তি মদীনায় রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হলো। আমির রাসূলুল্লাহকে সা. সম্বোধন করে বলল, ‘মুহাম্মাদ, আমি ইসলাম গ্রহণ করলে আমাকে কী দেবেন?’ রাসূল সা. বললেনঃ সকল মুসলমানের জন্য যা হবে তোমার জন্য তাই হবে। তাদের মত তোমার ওপরও একই দায়িত্ব বর্তাবে। আমি বলল, ‘আমি মুসলমান হলে আপনার পরে কি আমাকে শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন? রাসূল সা. বললেন, ‘তুমি বা তোমার গোত্রের কেউ তা পাবে না। তবে তুমি অশ্বারোহী বাহিনীর একজন নেতা হতে পারবে।’ এভাবে তাদের সাথে আরও কিছু কথাবার্তা হওয়ার পর তারা উঠে গেলো। তারপর তারা রাসূলুল্লাহকে সা. হত্যার ষড়যন্ত্র আটলো। রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তাদের সে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেল। তারা পালিয়ে গেল। মু’য়াজ ও উসাইদ তাদের ধাওযা করেন। এক পর্যায়ে উসাইদ তাদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘ওরে আল্লাহর দুশমনরা তোদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ পথিম্যে দুইজনেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪৮-৪৯)
হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফইয়ান রাসূলুল্লাহকে সা. হত্যার উদ্দেশ্যে এক ব্যক্তিকে মদীনায় পাঠায়। সে ছোট্ট একটি খঞ্জর কোমরে লুকিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. কথা জিজ্ঞেস করতে করতে বনী আবদিল আশহালের মসজিদে উপস্থিত হয়। হযরত রাসূলে কারীম সা. তার চেহারা দেখেই বলে ওঠেন, ‘এ ব্যক্তি ধোঁকা দিতে এসেছে।’ সে হত্যার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহর সা. দিকে এগুতেই উসাইদ তার লুঙ্গি ধরে টান দেন। সাথে সাথে তার কোমর থেকে খঞ্জরটি ছিটকে পড়ে। সে বুঝতে পারে এখন আর রেহাই নেই। সে যাতে পালানোর চেষ্টা করতে না পারে, সেই জন্য উসাইদ তার গলার কাছে জামা খুব শক্ত করে ধরে রাখেন। (সীয়ারে আনসার- ১/২৩০)
হিজরী ষষ্ঠ সনে বনী মুসতালিকের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে সেখানে একটি কূপে উট-ঘোড়ার পানি পান করানোর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন মুহাজির ও আনসারের মধ্যে সামান্য ঝগড়া হয়। এই সামান্য ঝগড়া মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবন উবাই আরও উসকে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। সে আনসারদের লক্ষ্য করে বলে ফেলেঃ ‘তোমরা তাদেরকে নিজ দেশে থাকার অনুমতি দিয়েছ, তোমাদের ধন-সম্পদ তাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়েছ।
আল্লাহর কসম, তোমরা যদি তা না করতে তাহলে তারা অন্য কোথাও চলে যেত। যদি মদীনায় ফিরতে পারি তাহলে আমরা অভিজাতরা (মদীনাবাসীরা) এই নীচদের তাড়িয়ে ছাড়বো।’ তার এসব কথা হযরত যায়িদ ইবন আরকাম শুনে ফেলেন এবং তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. অবহিত করেন। হযরত রাসূলে কারীম খুবই মনঃক্ষুণ্ন হন।
এই ঘটনার পর হযরত উসাইদ আসলেন রাসূলুল্লাহর সা. সাথে দেখা করতে। রাসূল সা. তাঁকে বললেনঃ
– তোমাদের বন্ধু যা বলেছে, তা কি তুমি শুনেছ?
– ইয়া রাসূলুল্লাহ, কোন্ বন্ধু?
– আবদুল্লাহ ইবন উবাই।
– কী বলে?
– সে বলেছে, মদীনায় ফিরতে পারলে তারা অভিজাতরা নীচদেরকে বের করে দেবে।
উসাইদ বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ সা., আল্লাহর কসম, ইনশাআল্লাহ আপনিই তাকে তাড়িয়ে দিবেন। আল্লাহর কসম সে-ই নীচ, আর আপনি অতি সম্মানিত ও বিজয়ী। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/১২৯২)
উসাইদ আরও বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহঃ আপনি তার প্রতি একটু সদয় হোন। আল্লাহ তা’য়ালা আপনার সাথে আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন। আর তার স্বগোত্রীয় লোকেরা তার জন্য মুকুট তৈরী করছিল, তাকে মদীনার বাদশাহ বানিয়ে তার মাথায় পরাবে বলে। সে স্বচক্ষে দেখতে পারবে তার সে সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪৬৩)
একটি বর্ণনায় এসেছেঃ আবদুল্লাহ ইবন উবাইর উপরোক্ত মন্তব্যের কথা অবগত হয়ে উসাইদ বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, যে লোকটি মানুষের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করছে, তাকে হত্যার অনুমতি আমাকে দিন। রাসূল সা. বললেন, আমি নির্দেশ দিলে তুমি তাকে হত্যা করবে? উসাইদ বললেনঃ হ্যাঁ, আপনার অনুমতি পেলে তরবারি দিয়ে তার গর্দানটি উড়িয়ে দেব। রাসূল সা. তাকে বসিয়ে শান্ত করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৭৪)
এই বনী মুসতালিক যুদ্ধের সফরে হযরত ’আয়িশা রা. রাসূলুল্লাহর সা. সফর সঙ্গিনী ছিলেন। সফর থেকে মদীনায় ফেরার পথে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুনাফিকরা হযরত ’আয়িশার রা. চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করে। সীরাত গ্রন্থ সমূহে যা ‘ইফ্ক’ বা বানোয়াট কাহিনী বলে পরিচিত। কিছু সরলপ্রাণ মুসলমানও মুনাফিকদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। পরিশেষে আল্লাহ পাক কুরআনের আয়াত নাযিল করে আসল রহস্য ফাঁস করে দেন। বিষয়টি যখন তুঙ্গে তখন একদিন উসাইদ রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হয়ে আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহঃ আউস গোত্রের লোকেরা আপনাকে কষ্ট দিলে আমরা তা বন্ধ করে দেব। আর আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের লোকেরা যদি কষ্ট দেয়, আমাদের নির্দেশ দিন। আল্লাহর কসম, তারা হত্যার উপযুক্ত।’ ‘খাযরাজ নেতা সা’দ ইবন ’উবাদা সংগে সংগে প্রতিবাদ করে বলে ওঠেন, ‘খাযরাজ গোত্রের লোক বলে তুমি এমন কথা বলতে পারছো, তোমার নিজের গোত্রের লোক হলে এমন কথা বলতে পারতে না।’ ‘উসাইদও সংগে সংগে গর্জে উঠে বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমি মিথ্যা বলেছ।’ তুমি এক মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে ঝগড়া করছো।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৩০০)
খাইবার যুদ্ধে সালামা ইবন আকও’য়ার চাচা ’আমির এক ইয়াহুদীর ওপর আক্রমণ চালাম; কিন্তু তাঁর তরবারীর আঘাত ফসকে গিয়ে নিজেই আহত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। হযরত উসাইদসহ অনেকে ধারণা করলেন, যেহেতু তিনি নিজের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন, যা এক ধরণের আত্মহত্যা- এ কারণে তাঁর সকল নেক ’আমল ব্যর্থ হয়ে গেছে। সালামা বিষয়টি রাসূলুল্লাহর সা. কানে দিলেন। রাসূল সা. বললেনঃ যারা এমন কথা বলেছে তাদের কথা ঠিক নয়। সে দ্বিগুণ সাওয়াবের অধিকারী হবে। (মুসলিম- ২/৯৬)
মক্কা বিজয় অভিযানে হযরত রাসূলে কারীম সা. মুহাজির ও আনসারদের সাথে ছিলেন। তাঁর দলটি ছিল সকলের পিছনে। তিনি ছিলেন আবু বকর রা. ও উসাইদের মাঝখানে। হুনাইন ও তাবুক অভিযানের সময় আউস গোত্রের ঝান্ডাটি ছিল উসাইদের হাতে।
সাকীফা-ই-বনী সা’য়িদার দিনটি- যেদিন হযরত রাসূলে কারীমের সা. ওফাতের পর আনসারদের একটি দল, যার পুরোভাগে ছিলেন হযরত সা’দ ইবন ’উবাদা- দাবী করলেন, খিলাফতের অগ্রাধিকার আনসারদের। একথা মদীনায় ছড়িয়ে পড়লো। তর্ক-বিতর্ক শুরু হল। উসাইদ ছিলেন আনসার গোত্র আউসের অন্যতম নেতা। সেই জটিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। (উসুদুল গাবা- ১/৯২) তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আনসারদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘তোমরা জান, রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন মুহাজিরদের একজন। তাঁর খলীফাও মুহাজিরদের মধ্য থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা ছিলাম রাসূলুল্লাহর সা. আনসার বা সাহায্যকারী।’’ সা’দ ইবন মু’য়াজকে লক্ষ্য করে তিনি বলেনঃ ‘‘আজও আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহর সা. খলীফার আনসার হিসাবে থাকা।’’ (রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪৬২)। এক পর্যায়ে তিনি নিজ গোত্র আউসের লোকদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘খাযরাজ গোত্র সা’দ ইবন ’উবাদাকে খলীফা বানিয়ে নেতৃত্ব কুক্ষিগত করতে চায়। আজ যদি তারা সফল হয় তাহলে চিরদিনের জন্য তারা তোমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ফেলবে এবং খিলাফতে তোমাদের কোন অংশ তারা আর কোন দিন দেবে না। আমার মতে আবু বকরের হাতে বাইয়াত করা উচিত।’ এরপর তিনি সকলকে আবু বকরের হাতে বাই’য়াত করার নির্দেশ দেন। এভাবে আউস গোত্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে হযরত সা’দ ইবন উবাদার সমর্থকদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। (সীয়ারে আনসার- ২৩১)
হযরত আবু বকরের রা. মরণ সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এল, তিনি খিলাফতের দায়িত্ব কার ওপর ন্যস্ত করে যাবেন- এ বিষয়ে মুহাজির-আনসার নির্বিশেষে যে সকল বিশিষ্ট সাহাবীর মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে উসাইদও রা. ছিলেন। আবু বকর রা. যখন উমার রা. সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাইলেন, তিনি বললেনঃ ‘আপনার পরে খিলাফতের দায়িত্ব লাভের ব্যাপারে আমি তাঁকে ভালোই দেখতে পাই। ….তাঁর ভেতরটা বাইরের থেকে উত্তম। এই দায়িত্ব লাভের জন্য তাঁর চেয়ে অধিকতর সক্ষম ব্যক্তি আর কেউ নেই। (হায়াতুস সাহাবা- ২/২৬) হিজরী ১৬ সনে তিনি খলীফা ’উমারের রা. সাথে মদীনা থেকে বায়তুল মাকদাসে যান। (উসুদুল গাবা- ১/৯২)
হিজরী ২০ সনের শা’বান মাসে, মতান্তরে হিজরী ২১ সনে তিনি মদীনায় ইন্তিকাল করেন। খলীফা হযরত উমার রা. কাঁধে করে তাঁর লাশ বহন করেন, জানাযার নামায পড়ান এবং বাকী গোরস্থানে দাফন করেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪০), তাবাকাত- ৩/৫০৬, শাজারাতুজ জাহাব ফী আখবারি মান জাহাব- ১/৩১)
মৃত্যুর পূর্বে তিনি খলীফা ’উমারকে অসীয়াত করে যান, তিনি যেন তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিজ হাতে নিয়ে তাঁর সকল দায়-দেনা পরিশোধ করে দেন। তাঁর মৃত্যুর পর হযরত ’উমার রা. পাওনাদারদের ডেকে তাদেরকে এই শর্তে রাজী করান যে, তারা বছরে এক হাজার দিরহাম গ্রহণ করবেন। এভাবে চার বছরে বাগানের ফল বিক্রী করে সকল দেনা পরিশোধ করা হয়। এভাবে তাঁর সকল সম্পত্তি রক্ষা পায়। ’উমার রা. বলতেন, ‘আমার ভাইয়ের সন্তানদের আমি অভাবী দেখতে চাই না।’ (তাবাকাত- ৩/৬০৬, উসুদুল গাবা- ১/৯৩)
হযরত উসাইদের স্ত্রী রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় ইন্তিকাল করেন। (সীয়ারে আনসার- ১/২৩১) হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘একবার আমরা হজ্জ অথবা ’উমরা থেকে মদীনায় ফিরলাম। আমাদেরকে জুল হুলায়ফায় অভ্যর্থনা জানানো হল। আনসারদের পরিবারবর্গের লোকেরা আপন আপন পরিবারের লোকদের সাথে মিলিত হল। এখানে উসাইদকে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর খবর দেওযা হল। তিনি মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি বললাম, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী, প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী, আর আপনি কিনা একজন মহিলার জন্য এভাবে কাঁদছেন? আয়িশা রা. বলেন, একথা শুনে তিনি মাথা থেকে কাপড় ফেলে দিলেন। এবং বললেনঃ আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। ‘সা’দ ইবন মু’য়াজের পর আর কারও জন্য আমাদের কাঁদা উচিত নয়।’ (হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৯৫, মুসনাদে আহমদ- ২/৩৫২)
সম্ভবতঃ ইয়াহইয়া নামে উসাইদের একটি মাত্র ছেলে ছিল। সহীহ বুখারীর ‘বাবু নুযুলিস সাকীনা ওয়াল মালায়িকা ইনদা কিরায়াতিল কুরআন’’ (কুরআন পাঠের সময় প্রশান্তি ও ফিরিশতার অবতরণ) অধ্যায়ে তাঁর আলোচনা এসেছে।
কুরআন ও হাদীসের প্রচার-প্রসারে তাঁর বিরাট অবদান আছে। তিনি সরাসরি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। হযরত ’আয়িশা, আবু সা’ঈদ আল খুদরী, আনাস বিন মালিক, আবু লাইল আনসারী, ও কা’ব ইবন মালিকের মত অতি সম্মানিত সাহাবায়ে কিরাম তাঁর নিকট থেকে শ্রুত হাদীস বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে তাঁর সর্বমোট ১৮ (আঠারো) টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (আল-আলাম- ১/৩৩০, আল-ইসাবা- ১/৪৯)
হযরত উসাইদের পিতা ছিলেন তাঁর গোত্রের অতি সম্মানিত ব্যক্তি। ইবন সা’দ বলেনঃ ‘‘তাঁর পিতার পর ইসলাম ও জাহিলী উভয় যুগে তিনিও অত্যন্ত ভদ্র ও সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। গোত্রের বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরূপে গণ্য হন। এই গুণগুলির সমন্বয় ঘটেছিল উসাইদের মধ্যে।’’ তাছাড়া তিনি ছিলেন দক্ষ তীরন্দাজ ও দৌড়বিদ। আর সে যুগে আরবে এই তিনটি গুণে গুণান্বিত ব্যীক্তকে ‘কামিল’ উপাধিতে ভূষিত করা হত। (তাবাকাত- ৩/৬০৪, আল আলাম- ১/৩৩০, উসুদুল গাবা- ১/৯২)
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি আধ্যাত্ম সাধনায় এত উন্নতি সাধন করেন যে, তাঁর চোখের সকল পর্দা দূর হয়ে যায়। আর তিলাওয়াতও করতে পারতেন সুমধুর কণ্ঠে। (উসুদুল গাবা- ১/৯২) একদিন রাতে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করছেন। নিকটেই বাঁধা একটি ঘোড়া। ঘোড়াটি লাফাতে থাকে। তিলাওয়াত বন্ধ করলে ঘোড়াটিও থেমে যায়। আবার তিলাওয়াত শুরু করলে ঘোড়াটি লাফাতে শুরু করে। তাঁর ছেলে ইয়াহইয়া নিকটেই শুয়ে ছিল। তিনি ভীত হয়ে পড়রেন এই কথঅ চিন্তা করে যে, এমনটি চলতে থাকলে ছেলেটি ঘোড়ার পায়ে পিষে যাবে। তৃতীয়বারের মাথায় তিনি বাইরে এসে দেখেন, আকাশে একটি ছায়ার মত আচ্ছাদন এবং মধ্যে যেন বাতির আলো জ্বলছে। তিলাওয়াত শেষ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতেই আলোটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সকালে ঘটনাটি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বর্ণনা করলে তিনি বলেন, ফিরিশতারা কুরআন তিলাওয়াত শুনতে এসেছিল। তুমি যদি সকাল পর্যন্ত তিলাওয়াত করতে তাহলে লোকেরা তাদেরকে দিনের আলোতে দেখতে পেত। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪৩, উসুদুল গাবা- ১/৯৩, বুখারী শরীফ- ২/৭৫০)
তিনি দিব্য চোখে ‘সাকীনা’ বা প্রশান্তির বাস্তব রূপ প্রত্যক্ষ করেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি যার চলার সময় আগে আগে একটি ‘নূর’ বা জ্যেতি চলতো। বুখারী বর্ণনা করেছেন, এক অন্ধকার রাতে আববাদ ইবন বিশর ও উসাইদ ইবন হুদাইর রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে বের হলেন। তাঁদের হাতে লাঠি থেকে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়ে তাদের চলার পথ আলোকিত করে তুলেছিল। তাঁরা যখন দু’জন দুই দিকে চলে গেলেন, জ্যোতিও তাঁদের সাথে ভাগ হয়ে গেল। (শাজারাতুজ জাহাব- ১/৩১, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬১১)
হযরত উসাইদ বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে একটি দুস্থ আনসার পরিবারের কথা তুলে ধরলাম। তারা অত্যন্ত অভাবী এবং পরিবারের অধিকাংশ সদস্য মহিলা। আমার কথা শুনে রাসূল সা. বললেন, ‘তুমি এমন এক সময় এসেছ যখন আমার হাতে যা কিছু ছিল সবই মানুষকে দেওয়া হয়ে গেছে। তুমি যখন শুনবে আমার হাতে আবার কিছু এসেছে এই পরিবারটির কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিবে।’ কিছুদিনের মধ্যে খাইবার থেকে কিছু জিনিস আসলো। তিনি আনসারদেরকে বেশী করে দিলেন। বিশেষ করে সেই পরিবারটিকে দিলেন প্রচুর পরিমাণে। আমি বললাম, ‘হে আল্লার নবী, আল্লাহ আপনাকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন।’ রাসূল সা. বললেন, ওহে আনসারগণ, আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন। তোমাদের সম্পর্কে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তোমরা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও ধৈর্যধারণকারী। আমার মৃত্যুর পর লোকেরা তোমাদের উপেক্ষা করে নিজেদেরকে অগ্রাধিকার দেবে। আমার সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা ‘সবর’ (ধৈর্য) অবলম্বন করবে। আমাদের সেই মিলন স্থল হবে ‘হাউজ’।’
উসাইদ বলেন, ‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. ইন্তিকাল কররেন, আবু বকরের পর ’উমার রা. খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। একবার তিনি মদীনাবাসীদের মধ্যে কিছু গনীমতের মাল বন্টন করলেন। আমার জন্য তিনি একটি জামা পাঠালেন। কিন্তু তা ছোট হয়ে গেল। আমি মসজিদে বসে আছি, এমন সময় এক কুরাইশ যুবককে দেখলাম ঠিক আমার জামার মত একটি লম্বা জামা সে পরে আছে। সেটা এত লম্বা যে, মাটি দিয়ে টেনে যাচ্ছে। তখন আমি আমার সংগের লোকটিকে রাসূলুল্লাহর সা. উপরোক্ত বাণী শুনিয়ে বললাম, রাসূলুল্লাহ সা. সত্যই বলেছেন। লোকটি দৌড়ে ’উমারের কাছে গেল এবং আমি যা বলেছি তাই তাঁকে গিয়ে বলল। ’উমার ছুটে আসলেন। আমি তখন নামাযে। ’উমার বললেন, উসাইদ নামায শেষ কর। নামায শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কী বলেছেন?
আমি যা দেখেছি এবং যা বলেছি, তাঁকে বললাম। তিনি বললেন, আল্লাহ আপনাকে মাফ করুন। সেই জামাটি আমি অমুকের জন্য পাঠিয়েছিলাম। আর সে তো একজন আনসারী, আকাবায় শপথ গ্রহণকারী এবং বদর ও উহুদের মুজাহিদ। তাঁর কাছ থেকেই এই কুরাইশ যুবক জামাটি খরীদ করেছে। আপনি কি মনে করেন আনসারদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. সেই বাণী আমার যুগেই সত্যে পরিণত হবে? উসাইদ বললেন, আল্লাহর কসম, হে আমীরুল মুমিনীন, আমার বিশ্বাস আপনার যুগে তা হতে পারবে না।’ (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪০২-৪০৩, সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা- ৩/৩৬-৩৯)
উম্মুল মুমিনীন হযরত ’আয়িশা রা. বলেন, উসাইদ একজন উত্তম মানুষ। তিনি বলতেন, যদি আমি এই তিনটি অবস্থার যে কোন একিট অবস্থায় সর্বদা থাকতে পারতাম তাহলে নিশ্চিত জান্নাতের অধিবাসী হতাম। এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ থাকতো না। সেই অবস্থা তিনটি হলঃ ১. আমি নিজে যখন কুরআন পাঠ করি অথবা অন্যকে পাঠ করতে শুনি। ২. যখন রাসূলুল্লাহর সা. ভাষণ শুনি ৩. যখন কোন জানাযায় অংশগ্রহণ করি। আমি যখন জানাযায় যোগদান করি, আমার নাফ্সকে প্রশ্ন করিঃ আমি তাকে দিয়ে কী করিয়েছি এবং তার শেষ পরিণতি কী হবে? (আল-ইসাবা- ১/৪৯, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৪১-৪২)
হাকেম আবু লায়লার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, উসাইদ ছিলেন একজন নেককার, হাসি-খুশী মেজাজের ও রসিক প্রকৃতির মানুষ। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহর সা. মজলিসে নানা রকম কথা বলে লোকদের হাসাচ্ছেন। রাসূলুল্লাহ সা. একটু কৌতুক করে তাঁর কোমরে একটু আঘাত করেন। সাথে সাথে উসাইদ বলে উঠেনঃ আপনি আমাকে ব্যথা দিয়েছেন। রাসূল সা. বললেনঃ ‘তুমি এর প্রতিশোধ নিয়ে নাও। উসাইদ বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার গায়ে জামা ছিল না; কিন্তু আপনার গায়ে তো জামা। রাসূল সা. জামা খুলে ফেললেন, আর সাথে সাথে উসাইদ রাসূলুল্লাহকে সা. জড়িয়ে ধরে তাঁর পাজরে চুমুর পর চুমু দিতে লাগরেন। পরে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কুরবান হোক। আমি এই ইচ্ছা.. করেছিলাম। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৩৩০-৩১)
হযরত রাসূলে কারীম সা. বলেছেন, আবু ইবাইদাহ ইবনুল জাররাহ, মু’য়াজ ইবন জাবাল, উসাইদ ইবন হযদাইর ও মু’য়াজ ইবন ’আমর- এরা কতই না উত্তম মানুষ। (আল-ইসাবা- ১/৯২) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। রাসূল সা. বলেছেন, নি’মার রাজুলু উসাইদ০উসাইদ কত ভালো মানুষ। (তাবাকাত- ৩/৬০৩) হযরত আয়িশা রা. বলেনঃ আনসারদের তিন ব্যক্তিকে কেউ মর্যাদার দিক দিয়ে নাগাল পায়নি। তাঁরা সবাই বনী আবদিল আশহালের লোক। তাঁরা হলেনঃ মু’য়াজ ইবন জাবাল, উসাইদ ইবন হুদাইর ও আব্বাদ ইবন বিশর। (আল-ইসাবা- ১/৪৯) এই সব কারণে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাতে তাঁকে খুবই সম্মান করতেন। তাঁর ওপর অন্য কাউকে তিনি প্রাধান্য দিতেন না। (উসুদুল গাবা- ১/৯২)
No comments