উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর জীবনী

নাম ’উমার, লকব ফারুক এবং কুনিয়াত আবু হাফ্‌স। পিতা খাত্তাব ও মাতা হান্‌তামা। কুরাইশ বংশের আ’দী গোত্রের লোক। ’উমারের অষ্টম উর্ধ পুরুষ কা’ব নামক ব্যক্তির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। পিতা খাত্তাব কুরাইশ বংশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি।

মাতা ‘হানতামা’ কুরাইশ বংশের বিখ্যাত সেনাপতি হিশাম ইবন মুগীরার কন্যা। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ এই মুগীরার পৌত্র। মক্কার ‘জাবালে ’আকিব’- এর পাদদেশে ছিল জাহিলী যুগে বনী ‘আ’দী ইবন কা’বের বসতি। এখানেই ছিল হযরত উমারের বাসস্থান। ইসলামী যুগে ’উমারের নাম অনুসারে পাহাড়টির নাম হয় ‘জাবালে ’উমার’- ’উমারের পাহাড়। (তাবাকাতে ইবন সা’দ ৩/৬৬) ’উমারের চাচাত ভাই, যায়িদ বিন নুফাইল। হযরত রাসূলে কারীমের আবির্ভাবের পূর্বে নিজেদের বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে জাহিলী আরবে যাঁরা তাওহীদবাদী হয়েছিলেন, যায়িদ তাঁদেরই একজন।

রাসূলুল্লাহর সা. জন্মের তের বছর পর তাঁর জন্ম। মৃত্যুকালেও তাঁর বয়স হয়েছিল রাসূলুল্লাহর সা. বয়সের সমান ৬৩ বছর। তবে তাঁর জন্ম ও ইসলাম গ্রহণের সন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, টাক মাথা, গন্ডদেশ মাংসহীন, ঘন দাড়ি, মোঁচের দু’পাশ লম্বা ও পুরু এবং শরীর দীর্ঘাকৃতির। হাজার মানুষের মধ্যেও তাঁকেই সবার থেকে লম্বা দেখা যেত।
তাঁর জন্ম ও বাল্য সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। ইবন আসাকির তাঁর তারীখে ’আমর ইবন ’আস রা. হতে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে জানা যায়, একদিন ’আমর ইবন ’আস কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবসহ বসে আছে, এমন সময় হৈ চৈ শুনতে পেলেন। সংবাদ নিয়ে জানতে পেলেন, খাত্তাবের একটি ছেলে হয়েছে। এ বর্ণনার ভিত্তিতে মনে হয়, হযরত ’উমারের জন্মের সময় বেশ একটা আনন্দোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

তাঁর যৌবনের অবস্থাটাও প্রায় অনেকটা অজ্ঞাত। কে জানতো যে এই সাধারণ একরোখা ধরনের যুবকটি একদিন ‘ফারুকে আযমে’ পরিণত হবেন। কৈশোরে ’উমারের পিতা তাঁকে উটের রাখালী কাজে লাগিয়ে দেন। তিনি মক্কার নিকটবর্তী ‘দাজনান’ নামক স্থানে উট চরাতেন। তিনি তাঁর খিলাফতকালে একবার এই মাঠ অতিক্রমকালে সঙ্গীদের কাছে বাল্যের স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবেঃ ‘এমন এক সময় ছিল যখন আমি পশমী জামা পরে এই মাঠে প্রখন রোদে খাত্তাবের উট চরাতাম। খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নীরস ব্যক্তি। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিলে পিতার হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হতাম। কিন্তু আজ আমার এমন দিন এসেছে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আমার উপর কতৃত্ব করার আর কেউ নেই।’ (তাবাকাতঃ ৩/২৬৬-৬৭)

যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি তৎকালীন অভিজাত আরবদের অবশ্য-শিক্ষণীয় বিষয়গুলি যথাঃ যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা ও বংশ তালিকা শিক্ষা প্রভৃতি আয়ত্ত করেন। বংশ তালিকা বা নসবনামা বিদ্যা তিনি লাভ করেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর পিতা ও পিতামহ উভয়ে ছিলেন এ বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর। আরবের ‘উকায’ মেলায় তিনি কুস্তি লড়তেন। আল্লামা যুবইয়ানী বলেছেনঃ ‘উমার ছিলেন এক মস্তবড় পাহলোয়ান।’ তিনি ছিলেন জাহিলী আরবের এক বিখ্যাত ঘোড় সওয়ার। আল্লামা জাহিয বলেছেনঃ ‘উমার ঘোড়ায় চড়লে মনে হত, ঘোড়ার চামড়ার সাথে তাঁর শরীর মিশে গেছে।’ (আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন) তাঁর মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তৎকালীন খ্যাতনামা কবিদের প্রায় সব কবিতাই তাঁর মুখস্থ ছিল। আরবী কাব্য সমালোচনার বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে তিনিই। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মতামতগুলি পাঠ করলে এ বিষয়ে তাঁর যে কতখানি দখল ছিল তা উপলব্ধি করা যায়। বাগ্মিতা ছিল তাঁর সহজাত গুণ। যৌবনে তিনি কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। বালাজুরী লিখেছেনঃ ‘রাসূলে কারীমের সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় গোটা কুরাইশ বংশে মাত্র সতের জন লেখা-পড়া জানতেন। তাদের মধ্যে ’উমার একজন।
ব্যবসা বাণিজ্য ছিল জাহিলী যুগের আরব জাতির সম্মানজনক পেশা। ’উমারও ব্যবসা শুরু করেন এবং তাতে যথেষ্ট উন্নতিও করেন। ব্যবসা উপলক্ষে অনেক দূরদেশে গমন এবং বহু জ্ঞানী-গুণী সমাজের সাথে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন। মাসউদী বলেনঃ ’উমার রা. জাহিলী যুগে সিরিয়া ও ইরাকে ব্যবসা উপলক্ষে ভ্রমণে যেতেন। ফলে আরব ও আজমের অনেক রাজা-বাদশার সাথে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন।’ শিবলী নু’মানী বলেনঃ ‘জাহিলী যুগেই ’উমারের সুনাম সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে কুরাইশরা সর্বদা তাঁকেই দৌত্যগিরিতে নিয়োগ করতো। অন্যান্য গোত্রের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি হলে নিষ্পত্তির জন্য তাঁকেই দূত হিসেবে পাঠানো হত।’ (আল-ফারুকঃ ১৪)

’উমারের ইসলাম গ্রহণ এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা। তাঁর চাচাত ভাই যায়িদের কল্যাণে তাঁর বংশে তাওহীদের বাণী একেবারে নতুন ছিল না। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম যায়িদের পুত্র সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেন। সাঈদ আবার ’উমারের বোন ফাতিমাকে বিয়ে করেন। স্বামীর সাথে ফাতিমাও ইসলাম গ্রহণ করেন। ’উমারের বংশের আর এক বিশিষ্ট ব্যক্তি নাঈম ইবন আবদুল্লাহও ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত ’উমার ইসলাম সম্পর্কে কোন খবরই রাখতেন না। সর্বপ্রথম যখন ইসলামের কথা শুনলেন, ক্রোধে জ্বলতে লাগলেন। তাঁর বংশে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের তিনি পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন। এর মধ্যে জানতে পেলেন, ‘লাবীনা’ নামে তাঁর এক দাসীও ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যাঁদের ওপর তাঁর ক্ষমতা চলতো, নির্মম উৎপীড়ন চালালেন। এক পর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ইসলামের মূল প্রচারক মুহাম্মাদকেই সা. দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। যে কথা সেই কাজ।

আনাস ইবন মালিক থেকে বির্ণত। ‘তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে ’উমার চলেছেন। পথে বনি যুহরার এক ব্যক্তির (মতান্তরে নাঈম ইবন আবদুল্লাহ) সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কোন দিকে ’উমার? বললেনঃ মুহাম্মাদের একটা দফারফা করতে। লোকটি বললেন, মুহাম্মাদের সা. দফারফা করে বনি হাশিম ও বনি যুহরার হাত থেকে বাঁচবে কিভাবে? একথা শুনে ’উমার বলে উঠলেনঃ মনে হচ্ছে, তুমিও পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছে। লোকটি বললেনঃ ’উমার, একটি বিস্ময়কর খবর শোন, তোমার বোন-ভগ্নিপতি বিধর্মী হয়ে গেছে। তারা তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছে। (আসলে লোকটির উদ্দেশ্য ছিল, ’উমারকে তার লক্ষ্য থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।) একথা শুনে রাগে উন্মত্ত হয়ে ’উমার ছুটলেন তাঁর বোন-ভগ্নিপতির বাড়ীর দিকে। বাড়ীর দরজায় ’উমারের রা. করাঘাত পড়লো। তাঁরা দু’জন তখন খাব্বাব ইবন আল-আরাত-এর কাছে কুরআন শিখছিলেন। ’উমারের আভাস পেয়ে খাব্বাব বাড়ীর অন্য একটি ঘরে আত্মগোপন করলেন। ’উমার বোন-ভগ্নিপতিকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের এখানে গুণগুণ আওয়ায শুনছিলেন, তা কিসের? তাঁরা তখন কুরআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন। তাঁরা উত্তর দিলেনঃ আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম। ’উমার বললেনঃ সম্ভবতঃ তোমরা দু’জন ধর্মত্যাগী হয়েছো। ভগ্নিপতি বললেনঃ তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে ’উমার? ’উমার তাঁর ভগ্নিপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং দু’পায়ে ভীষণভাবে তাঁকে মাড়াতে লাগলেন। বোন তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে এলে ’উমার তাঁকে ধরে এমন মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। বোন রাগে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ সত্য যদি তোমার দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও থেকে থাকে, তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।

এ ঘটনার কিছুদিন আগ থেকে ’উমারের মধ্যে একটা ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছিল। কুরাইশরা মক্কায় মুসলমানদের ওপর নির্মম অত্যাচার-উৎপীড়ন চালিয়ে একজনকে ফেরাতে পারেনি। মুসলমানরা নীরবে সবকিছু মাথা পেতে নিয়েছে। প্রয়োজনে বাড়ী-ঘর ছেড়েছে, ইসলাম ত্যাগ করেনি। এতে ’উমারের মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল। তিনি একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আবর্তে দোল খাচ্ছিলেন। আজ তাঁর প্রিয় সহোদরার চোখ-মুখের রক্ত, তার সত্যের সাক্ষ্য তাঁকে এমন একটি ধাক্কা দিল যে, তাঁর সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কর্পুরের মত উড়ে গেল। মুহূর্তে হৃদয় তাঁর সত্যের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি পাক-সাফ হয়ে বোনের হাত থেকে সূরা ত্বাহার অংশটুকু নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বললেনঃ আমাকে তোমরা মুহাম্মাদের সা. কাছে নিয়ে চল। ’উমারের একথা শুনে এতক্ষণে খাব্বাব ঘরের গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেনঃ ‘সুসংবাদ ’উমার! বৃহস্পতিবার রাতে রাসূলুল্লাহ সা. তোমার জন্য দুআ করেছিলেন। আমি আশা করি তা কবুল হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ ‘আল্লাহ, ’উমার ইবনুল খাত্তাব অথবা ’আমর ইবন হিশামের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী কর।’ খাব্বাব আরো বললেনঃ রাসূল সা. এখন সাফার পাদদেশে ‘দারুল আরকামে’।

’উমার চললেন ‘দারুল আরকামের’ দিকে। হামযা এবং তালহার সাথে আরো কিছু সাহাবী তখন আরকামের বাড়ীর দরজায় পাহারারত। ’উমারকে দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তবে হামযা সান্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ আল্লাহ ’উমারের কল্যাণ চাইলে সে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলের অনুসারী হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য খুবই সহজ হবে। রাসূল সা. বাড়ীর ভেতরে। তাঁর উপর তখন ওহী নাযিল হচ্ছে। একটু পরে তিনি বেরিয়ে ’উমারের কাছে এলেন। ’উমারের কাপড় ও তরবারির হাতল মুট করে ধরে বললেনঃ ’উমার, তুমি কি বিরত হবে না?’ …. তারপর দুআ করলেনঃ হে আল্লাহ, ’উমার আমার সামনে, হে আল্লাহ, ’উমারের দ্বারা দ্বীনকে শক্তিশালী কর।’ ’উমার বলে উঠলেনঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। ইসলাম গ্রহণ করেই তিনি আহ্‌বান জানালেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, ঘর থেকে বের হয়ে পড়ুন।’ (তাবাকুতুল কুবরা/ইবন সা’দ ৩/২৬৭-৬৯) এটা নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরের ঘটনা।

ইমাম যুহরী বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. দারুল আরকামে প্রবেশের পর ’উমার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পূর্বে নারী-পুরুষ সর্বমোট ৪০ অথবা চল্লিশের কিছু বেশী লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ’উমারের ইসলাম গ্রহণের পর জিবরীল আ. এসে বলেনঃ ‘‘মুহাম্মাদ, ’উমারের ইসলাম গ্রহণে আসমানের অধিবাসীরা উৎফুল্ল হয়েছে।’’ (তাবাকাতঃ ৩/২৬৯)

’উমারের ইসলাম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। যদিও তখন পর্যন্ত ৪০/৫০ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে হযরত হামযাও ছিলেন, তথাপি মুসলমানদের পক্ষে কা’বায় গিয়ে নামায পড়া তো দূরের কথা নিজেদেরকে মুসলমান বলে প্রকাশ করাও নিরাপদ ছিল না। হযরত ’উমারের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে এ অবস্থার পরিবর্তন হলো। তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিলেন এবং অন্যদের সংগে নিয়ে কা’বা ঘরে নামায আদায় শুরু করলেন।
’উমার রা. বলেনঃ আমি ইসলাম গ্রহণের পর সেই রাতেই চিন্তা করলাম, মক্কাবাসীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সবচেয়ে কট্টর দুশমন কে আছে। আমি নিজে গিয়ে তাকে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা জানাবো। আমি মনে করলাম, আবু জাহলই সবচেয়ে বড় দুশমন। সকাল হতেই আমি তার দরজায় করাঘাত করলাম। আবু জাহল বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি মনে করে?’ আমি বললামঃ ‘আপনাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের সা. প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান ও বাণীকে মেনে নিয়েছি।’ একথা শোনা মাত্র সে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল এবং বললোঃ ‘আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক এবং যে খবর নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলংকিত করুক।’ (সীরাতু ইবন হিশাম)

এভাবে এই প্রথমবারের মত মক্কার পৌত্তলিক শক্তি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো। সাঈদ ইনবুল মুসায়্যিব বলেনঃ ‘তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্য রূপ নেয়।’ আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেনঃ ’উমার ইসলাম গ্রহণ করেই কুরাইশদের সাথে বিবাদ আরম্ভ করে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ক’বায় নামায পড়ে ছাড়লেন। আমরাও সকলে তাঁর সাথে নামায পড়েছিলাম।’ সুহায়িব ইবন সিনান বলেনঃ তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর আমরা কা’বার পাশে জটলা করে বসতাম, কা’বার তাওয়াফ করতাম, আমাদের সাথে কেউ রূঢ় ব্যবহার করলে তার প্রতিশোধ নিতাম এবং আমাদের ওপর যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করতাম। (তাবকাতঃ ৩/২৬৯)। তাই রাসূল সা. তাঁকে –‘আল-ফারুক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। কারণ, তাঁরই কারণে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে প্রকাশ্য বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। রাসূল  সা. বলেছেনঃ ’উমারের জিহ্বা ও অন্তঃকরণে আল্লাহ তাআলা সত্যকে স্থায়ী করে দিয়েছেন। তাই সে ‘ফারুক’। আল্লাহ তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন। (তাবাকাতঃ ৩/২৭০)

মক্কায় যাঁরা মুশরিকদের অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন, রাসূল সা. তাদেরকে মদীনায় হিজরাতের নির্দেশ দিলেন। আবু সালামা, আবদুল্লাহ বিন আশহাল, বিলাল ও ’আম্মার বিন ইয়াসিরের মদীনায় হিজরাতের পর বিশজন আত্মীয়-বন্ধুসহ ’উমার মদীনার দিকে পা বাড়ালেন। এ বিশজনের মধ্যে তাঁর ভাই যায়িদ, ভাইয়ের ছেলে সাঈদ ও জামাই খুনাইসও ছিলেন। মদীনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে তিনি রিফায়া’ ইবন আবদুল মুনজিরের বাড়ীতে আশ্রয় নেন।

’উমারের হিজরাত ও অন্যদের হিজরাতের মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য ছিল। অন্যদের হিজরাত ছিল চুপে চুপে। সকলের অগোচরে। আর উমারের হিজরাত ছিল প্রকাশ্যে। তার মধ্যে ছিল কুরাইশদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ও বিদ্রোহের সূর। মক্কা থেকে মদীনায় যাত্রার পূর্বে তিনি প্রথমে কা’বা তাওয়াফ করলেন। তারপর কুরাইশদের আড্ডায় গিয়ে ঘোষণা করলেন, আমি মদীনায় চলছি। কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোক দিতে চায়, সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়। এমন একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি সোজা মদীনার পথ ধরলেন। কিন্তু কেউ এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দুঃসাহস করলো না। (তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাহঃ খিদরী বেক, ১/১৯৮)

বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের সাথে ’উমারের দ্বীনী ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। আবু বকর সিদ্দীক, ’উয়াইস ইবন সায়িদা, ইতবান ইবন মালিক ও মুয়াজ ইবন আফরা রা. ছিলেন ’উমারের দ্বীনী ভাই। তবে এটা নিশ্চিত যে, মদীনায় হিজরাতের পর বনী সালেমের সরদার ইতবান ইবন মালিকের সাথে তাঁর দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। (তাবাকাতঃ ৩/২৭২)

হিজরী প্রথম বছর হতে রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকাল পর্যন্ত ’উমারের রা. কর্মজীবন প্রকৃতপক্ষে হযরত রাসূলে কারীমের সা. কর্মময় জীবনেরই একটা অংশবিশেষ। রাসূলকে সা. যত যুদ্ধ করতে হয়েছিল, যত চুক্তি করতে হয়েছিল, কিংবা সময় সময় যত বিধিবিধান প্রবর্তন করতে হয়েছিল এবং ইসলাম প্রচারের জন্য যত পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল তার এমন একটি ঘটনাও নেই, যা ’উমারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত সম্পাদিত হয়েছে। এইজন্য এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে গেলে তা ’উমারের রা. জীবনী না হয়ে হযরত রাসূল কারীমের সা. জীবনীতে পরিণত হয়। তাঁর কর্মবহুল জীবন ছিল রাসূল কারীমের সা. জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।

হযরত ’উমার বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই রাসূলুল্লাহর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া আরো বেশ কিছু ‘সারিয়্যা’ (যে-সব ছোট অভিযানে রাসূলুল্লাহ সা. নিজে উপস্থিত হননি)-তে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বদর যুদ্ধের পরামর্শদান ও সৈন্যচালনা হতে আরম্ভ করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রাসূলে কারীমের সা. সাথে দৃঢ়ভাবে কাজ করেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের সম্পর্কে তাঁর পরামর্শই আল্লাহর পসন্দসই হয়েছিল। এ যুদ্ধে তাঁর বিশেষ ভূমিকা নিম্নরূপঃ

১. এ যুদ্ধে কুরাইশ বংশের প্রত্যেক শাখা হতে লোক যোগদান করে; কিন্তু বণী আ’দী অর্থাৎ ’উমারের খান্দান হতে একটি লোকও যোগদান করেনি। ’উমারের প্রভাবেই এমনটি হয়েছিল।

২. এ যুদ্ধে ইসলামের বিপক্ষে ’উমারের সাথে তাঁর গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ লোকদের থেকে মোট বারো জন লোক যোগদান করেছিল।

৩. এ যুদ্ধে হযরত ’উমার তাঁর আপন মামা আ’সী ইবন হিশামকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এ হত্যার মাধ্যমে তিনিই সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন, সত্যের পথে আত্মীয় প্রিয়জনের প্রভাব প্রাধান্য লাভ করতে পারে না।

উহুদ যুদ্ধেও হযরত ’উমার রা. ছিলেন একজন অগ্রসৈনিক। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম সৈন্যরা যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন এবং রাসূল সা. আহত হয়ে মুষ্টিমেয় কিছু সঙ্গী-সাথীসহ পাহাড়ের এক নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেন, তখন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান নিকটবর্তী হয়ে উচ্চস্বরে মুহাম্মাদ সা., আবু বকর রা., ’উমার রা. প্রমুখের নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা বেঁচে আছ কি? রাসূলের সা. ইঙ্গিতে কেউই আবু সুফিয়ানের জবাব দিল না। কোন সাড়া না পেয়ে আবু সুফিয়ান ঘোষণা করলোঃ ‘নিশ্চয় তারা সকলে নিহত হয়েছে।’ এ কথায় ’উমারের পৌরুষে আঘাত লাগলো। তিনি স্থির থাকতে পারলেন না।’ বলে উঠলেঃ ‘ওরে আল্লাহর দুশমন! আমরা সবাই জীবিত।’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘উ’লু হুবল-হুবলের জয় হোক।’ রাসূলুল্লাহর সা. ইঙ্গিতে ’উমার জবাব দিলেনঃ ‘আল্লাহু আ’লা ও আজাল্লু- আল্লাহ মহান ও সম্মানী।’
খন্দকের যুদ্ধেও ’উমার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। খন্দকের একটি বিশেষ স্থান রক্ষা করার ভার পড়েছিল ’উমারের ওপর। আজও  সেখানে তাঁর নামে একটি মসজিদ বিদ্যমান থেকে তাঁর সেই স্মৃতির ঘোষণা করছে। এ যুদ্ধে একদিন তিনি প্রতিরক্ষায় এত ব্যস্ত ছিলেন যে, তাঁর আসরের নামায ফউত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। রাসূল সা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেনঃ ‘ব্যস্ততার কারণে আমিও এখন পর্যন্ত নামায আদায় করতে পারিনি।’ (আল-ফারুকঃ শিবলী নু’মানীঃ ২৫)

হুদাইবিয়ার শপথের পূর্বেই হযরত ’উমার যুদ্ধের প্রস্তুতি আরম্ভ করে দিলেন। পুত্র আবদুল্লাহকে পাঠালেন কোন এক আনসারীর নিকট থেকে ঘোড়া আনার জন্য। তিনি এসে খবর দিলেন, ‘লোকেরা রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করছেন।’ ’উমার তখন রণসজ্জায় সজ্জিত। এ অবস্থায় দৌড়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তগুলি বাহ্য দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মনে হলো। ’উমার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। প্রথমে আবু বকর, তারপর খোদ রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এ সন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ ‘আমি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কোন কাজ আমি করিনে।’ ’উমার শান্ত হলেন। তিনি অনুতপ্ত হলেন। নফল রোযা রেখে, নামায পড়ে, গোলাম আযাদ করে এবং দান খয়রাত করে তিনি গোস্‌তাখীর কাফ্‌ফারা আদায় করলেন।

খাইবারে ইহুদীদের অনেকগুলি সুরক্ষিত দুর্গ ছিলো। কয়েকটি সহজেই জয় হলো। কিন্তু দু’টি কিছুতেই জয় করা গেল না। রাসূল সা. প্রথম দিন আবু বকর, দ্বিতীয় দিন ’উমারকে পাঠালেন দুর্গ দু’টি জয় করার জন্য। তাঁরা দু’জনই ফিরে এলেন অকৃতকার্য হয়ে। তৃতীয় দিন রাসূল সা. ঘোষণা করলেনঃ ’আগামীকাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ঝাণ্ডা দেব, যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন।’ পর দিন সাহাবায়ে কিরাম অস্ত্র সজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির। প্রত্যেকেরই অন্তরে এই গৌরব অর্জনের বাসনা। ’উমার বলেনঃ ‘আমি খাইবারে এই ঘটনা ব্যতীত কোনদিনই সেনাপতিত্ব বা সরদারীর জন্য লালায়িত হইনি।’ সে দিনের এ গৌরব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শের-ই-খোদা আলী রা.।
খাইবারের বিজিত ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। হযরত ’উমার রা. তাঁর ভাগ্যের অংশটুকু আল্লাহর রাস্তার ওয়াক্‌ফ করে দিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম ওয়াক্‌ফ। (আল-ফারুকঃ ৩০)

মক্কা বিজয়ের সময় হযরত ’উমার রা. ছায়ার মত রাসূলকে সা. সঙ্গ দেন। ইসলামের মহাশত্রু আবু সুফিয়ান আত্মসমর্পণ করতে এলে ’উমার রাসূলুল্লাহকে সা. অনুরোধ করেনঃ ‘অনুমতি দিন এখনই ওর দফা শেষ করে দিই।’ এদিন মক্কার পুরুষরা রাসূলুল্লাহর সা. হাতে এবং মহিলারা রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে ’উমারের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছিলেন।
হুনায়িন অভিযানেও হযরত ’উমার অংশগ্রহণ করে বীরত্ব সহকারে লড়াই করেছিলেন। এ যুদ্ধে কাফিরদের তীব্র আক্রমণে বারো হাজার মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। ইবন ইসহাক বলেনঃ মুহাজির ও আনসারদের মাত্র কয়েকজন বীরই এই বিপদকালে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে দৃঢ়পদ ছিলেন। তাদের মধ্যে আবু বকর, ’উমার ও আব্বাসের রা. নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাবুক অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহর সা. আবেদনে সাড়া দিয়ে হযরত ’উমার রা. তাঁর মোট সম্পদের অর্ধেক রাসূলুল্লাহর সা. হাতে তুলে দেন।

রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের খবর শুনে হযরত ’উমার কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন। তারপর মসজিদে নববীর সামনে যেয়ে তরবারি কোষমুক্ত করে ঘোষণা করেন, ‘যে বলবে রাসূলুল্লাহ সা. ইনতিকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবো।’ এ ঘটনা থেকে রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসার পরিমাণ সহজেই অনুমান করা যায়।

রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর ‘সাকীফা বনী সায়েদায়’ দীর্ঘ আলোচনার পর ’উমার খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে হযরত আবু বকরের হাতে খিলাফতের বাইয়াত গ্রহণ করেন। ফলে খলীফা নির্বাচনের মহা সংকট সহজেই কেটে যায়।

খলীফা হযরত আবু বকর যখন বুঝতে পারলেন তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে, মৃত্যুর পূর্বেই পরবর্তী খলীফা মনোনীত করে যাওয়াকে তিনি কল্যাণকর মনে করলেন। তাঁর দৃষ্টিতে ’উমার রা. ছিলেন খিলাফতের যোগ্যতম ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও উঁচু পর্যায়ের সাহাবীদের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করা সমীচীন মনে করলেন। তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফকে রা. ডেকে বললেন, ’উমার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে জানান।’ তিনি বললেনঃ ‘তিনি তো যে কোন লোক থেকে উত্তম; কিন্তু তাঁর চরিত্রে কিছু কঠোরতা আছে।’ আবু বকর বললেনঃ ‘তার কারণ, আমাকে তিনি কোমল দেখেছেন, খিলাফতের দায়িত্ব কাঁধে পড়লে এ কঠোরতা অনেকটা কমে যাবে।’ তারপর আবু বকর অনুরোধ করলেন, তাঁর সাথে আলোচিত বিষয়টি কারো কাছে ফাঁস না করার জন্য। অতঃপর তিনি ’উসমান ইবন আফ্‌ফানকে ডাকলেন। বললেন, ‘আবু আবদিল্লাহ, ’উমার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে জানান।’ ’উসমান বললেনঃ আমার থেকে আপনিই তাঁকে বেশী জানেন। আবু বকর বললেনঃ তা সত্ত্বেও আপনার মতামত আমাকে জানান। ’উসমান বললেনঃ তাঁকে আমি যতটুকু জানি, তাতে তাঁর বাইরের থেকে ভেতরটা বেশী ভালো। তাঁর মত দ্বিতীয় আর কেউ আমাদের মধ্যে নেই। আবু বকর রা. তাঁদের দু’জনের মধ্যে আলোচিত বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ করে তাঁকে বিদায় দিলেন।

এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মতামত নেওয়া শেষ হলে তিনি উসমান ইবনে আফ্‌ফানকে ডেকে ডিক্‌টেশন দিলেনঃ ‘বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটা আবু বকর ইবন আবী কুহাফার পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি অঙ্গীকার। আম্মা বাদ’- এতটুকু বলার পর তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তারপর ’উসমান ইবন আফ্‌ফান নিজেই সংযোজন করেন- ‘আমি তোমাদের জন্য ’উমার ইবনুল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করলাম এবং এ ব্যাপারে তোমাদের কল্যাণ চেষ্টায় কোন ত্রুটি করি নাই।’ অতঃপর আবু বকর সংজ্ঞা ফিরে পান। লিখিত অংশটুকু তাঁকে পড়ে শোনান হলো।’ সবটুকু শুনে তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ওঠেন এবং বলেনঃ আমার ভয় হচ্ছিল, আমি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মারা গেলে লোকেরা মতভেদ সৃষ্টি করবে। ’উসমানকে লক্ষ্য করে তিনি আরো বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপনাকে কল্যাণ দান করুন।

তাবারী বলেনঃ অতঃপর আবু বকর লোকদের দিকে তাকালেন। তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতু উমাইস তখন তাঁকে ধরে রেখেছিলেন। সমবেত লোকদের তিনি বলেনঃ ‘যে ব্যক্তিকে আমি আপনাদের জন্য মনোনীত করে যাচ্ছি তাঁর প্রতি কি আপনারা সন্তুষ্ট? আল্লাহর কসম, মানুষের মতামত নিতে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আমার কোন নিকট আত্মীয়কে এ পদে বহাল করিনি। আমি ’উমার ইবনুল খাত্তাবকে আপনাদের খলীফা মনোনীত করেছি। আপনারা তাঁর কথা শুনুন, তাঁর আনুগত্য করুন।’ এভাবে ’উমারের রা. খিলাফত শুরু হয় হিঃ ১৩ সনের ২২ জামাদিউস সানী মুতাবিক ১৩ আগস্ট ৬৩৪ খৃঃ।

হযরত ’উমারের রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা সম্ভব নয়। দশ বছরের স্বল্প সময়ে গোটা বাইজান্টাইন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। তাঁর যুগে বিভিন্ন অঞ্চলসহ মোট ১০৩৬ টি শহর বিজিত হয়। ইসলামী হুকুমাতের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা মূলতঃ তাঁর যুগেই হয়। সরকার বা রাষ্ট্রের সকল শাখা তাঁর যুগেই আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর শাসন ও ইনসাফের কথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মত ছড়িয়ে আছে।

হযরত ’উমার প্রথম খলীফা যিনি ‘আমীরুল মুমিনীন’ উপাধি লাভ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন, তারাবীর নামায জামাআতে পড়ার ব্যবস্থা করেন, জন শাসনের জন্য দুর্রা বা ছড়ি ব্যবহার করেন, মদপানে আশিটি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন, বহু রাজ্য জয় করেন, নগর পত্তন করেন, সেনাবাহিনীর স্তরভেদ ও বিভিন্ন ব্যাটালিয়ান নির্দিষ্ট করেন, জাতীয় রেজিষ্টার বা নাগরিক তালিকা তৈরী করেন, কাযী নিয়োগ করেন এবং রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।

’উমার রা. ছিলেন রাসূলুল্লাহর অন্যতম কাতিব। নিজ কন্যা হযরত হাফসাকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে দেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা. ও আবু বকরের রা. মন্ত্রী উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ও পরে ব্যবসা ছিল তাঁর জীবিকার উপায়। খিলাফতের গুরুদায়িত্ব কাঁধে পড়ার পরও কয়েক বছর পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যান। কিন্তু পরে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালে হযরত আলী রা. সহ উঁচু পর্যায়ের সাহাবীরা পরামর্শ করে বাইতুল মাল থেকে বাৎসরিক মাত্র আট শ’ দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করেন। হিজরী ১৫ সনে বাইতুল মাল থেকে অন্য লোকদের ভাতা নির্ধারিত হলে বিশিষ্ট সাহাবীদের ভাতার সমান তাঁরও ভাতা ধার্য করা হয় পাঁচ হাজার দিরহাম।

বাইতুল মালের অর্থের ব্যাপারে হযরত ’উমারের রা. দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইয়াতিমের অর্থের মত। ইয়াতিমের অভিভাবক যেমন ইয়াতিমের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইয়াতীমের ও নিজের জন্য প্রয়োজন মত খরচ করতে পারে কিন্তু অপচয় করতে পারে না। প্রয়োজন না হলে ইয়াতিমের সম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে শুধু হিফাজত করে এবং ইয়াতিম বড় হলে তাকে তার সম্পদ ফিরিয়ে দেয়। বাইতুল মালের প্রতি ’উমারের রা. এ দৃষ্টিভঙ্গিই সর্বদা তাঁর কর্ম ও আচরণে ফুটে উঠেছে।

হযরত ’উমার সব সময় একটি দুর্রা বা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতেন। শয়তানও তাঁকে দেখে পালাতো। (তাজকিরাতুল হুফফাজ) তাই বলে তিনি অত্যাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কঠোর ন্যায় বিচারক। মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন, মানুষও তাঁকে ভালোবাসতো। তাঁর প্রজাপালনের বহু কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায়।

হযরত ফারুকে আযমের ফজীলাত ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে এত বেশী ইঙ্গিত ও প্রকাশ্য বাণী রয়েছে যে, সংক্ষিপ্ত কোন প্রবন্ধে তা প্রকাশ করা যাবে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. নিকট তাঁর স্থান অতি উচ্চে। এজন্য বলা হয়েছে, ’উমারের সব মতের সমর্থনেই সর্বদা কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে।’ হযরত আলী রা. মন্তব্য করেছেনঃ ‘খাইরুল উম্মাতি বা’দা নাবিয়্যিহা আবু বকর সুম্মা ’উমার- নবীর সা. পর উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি আবু বকর, তারপর ’উমার।’ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেনঃ ’উমারের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়। তাঁর হিজরাত আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর খিলাফত আল্লাহর রহমত।’ ’উমারের যাবতীয় গুণাবলী লক্ষ্য করেই রাসূলে করীম সা. বলেছিলেনঃ ‘লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লাকানা ’উমার- আমার পরে কেউ নবী হলে ’উমারই হতো।’ কারণ তাঁর মধ্যে ছিল নবীদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য।
জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে ’উমারের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি আরবী কবিতা পঠন-পাঠন ও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। আরবী ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ; তাঁর সামনে ভাষার ব্যাপারে কেউ ভুল করলে শাসিয়ে দিতেন। বিশুদ্ধভাবে আরবী ভাষা শিক্ষা করাকে তিনি দ্বীনের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করতেন। আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফ্‌ফাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ’উমার ছিলেন অত্যন্ত কঠোর, একই হাদীস বিভিন্ন সনদের মাধ্যমে বর্ণনার প্রতি তিনি তাকিদ দেন।

প্রখ্যাত সাহাবী মুগীরা ইবন শু’বার রা. অগ্নি উপাসক দাস আবু লু’লু ফিরোজ ফজরের নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় এই মহান খলীফাকে ছুরিকাঘাত করে। আহত হওয়ার তৃতীয় দিনে হিজরী ২৩ সনের ২৭ জিলহজ্জ বুধবার তিনি ইনতিকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে আলী, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ, সা’দ, যুবাইর ও তালহা রা.- এ ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর ওপর তাদের মধ্য থেকে কোন একজনকে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করে যান। হযরত সুহায়িব রা. জানাযার নামায পড়ান। রওজায়ে নববীর মধ্যে হযরত সিদ্দীকে আকবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তাঁর খিলাফতকাল দশ বছর ছয় মাস চার দিন।

————–
সংকলন: এম.এ. ইমরান
উৎস: আসহাবে রাসূলের জীবনকথা

No comments

Powered by Blogger.