সা’দ ইবন মু’য়াজ (রা) এর জীবনী


আসল নাম সা’দ, ডাকনাম আবু ’আমর, লকব বা উপাধি সায়্যিদুল আউস। মদীনার বিখ্যাত আউস গোত্রের আবদুল আশহাল শাখার সন্তান। পিতার নাম মু’য়াজ ইবন নু’মান, মাতা কাবশা মতান্তরে কুবাইশা ‘বিনতু রাফি’।

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ সা’ঈদ আল খুদরীর চাচাতো বোন। জাহিলী যুগেই পিতা মু’য়াজ্জের মৃত্যু হয়। তবে মাতা কাবশা হিজরাতের পরে ঈমান আনেন এবং সা’দের ইনতিকালের পরেও বহু দিন জীবিত ছিলেন। গোটা আউস গোত্রের মধ্যে আবদুল আশহাল শাখাটি ছিল সর্বাধিক অভিজাত এবং বংশানুক্রমে নেতৃত্ব ছিল তাদেরই হাতে। সা’দ ছিলেন তাঁর সময়ে একজন বড় মাপের নেতা। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২, উসুদুল গাবা- ২/২৯৬, তাবাকাত- ৩/৪২০, তাহজীবুত তাহজীর- ৩/৪৮১) তাঁর জন্ম সন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

আকাবার প্রথম বাইয়াতের পর থেকে যদিও মদীনায় ইসলামের প্রভাব পড়তে থাকে তবে তা প্রকৃতপক্ষে হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইরের ব্যক্তিত্বের সাথে জড়িত ছিল। আকাবার শপথের পর মদীনাবাসীদের অনুরোধে হযরত রাসূলে কারীম সা. মুস’য়াবকে দা’ঈ-ই-ইসলামের (আহবানকারী) দায়িত্ব দিয়ে মদীনায় পাঠান। ইসলামের ইতিহাসে তিনি একজন সফল দা’ঈ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তিনি নিরলস চেষ্টার মা্ধ্যমে মদীনার প্রতিটি লোকের কানে ইসলামের দা’ওয়াত পৌঁছে দেন। হযরত মুস’য়াব মদীনায় এসে যখন ইসলামের দা’ওয়াত দিতে শুরু করলেন তখন সা’দ ইবন মু’য়াজ একজন চরম অস্বীকারকারী। তাঁর এ অবস্থা বেশী দিন থাকেনি। অনতিবিলম্বে তিনিও মুস’য়াবের দা’ওয়াতে সাড়া দেন। ইবন ইসহাক তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ

একদিন আস’য়াদ ইবন যুরারা রাসূলুল্লাহর সা. প্রেরিত দা’ঈ (আহবানকারী) মুস’য়াব ইবন ’উমাইরকে সংগে করে দা’ওয়াতী কাজে বনী আবদুল আশহাল ও বনী জাফার গোত্রে গেলেন। তাঁরা ‘মারাক’ নামক একটি কুয়োর ধারে দেওয়ালের ওপর বসলেন। আর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এমন কিছু লোক তাঁদের পাশে জড় হলেন। সা’দ ইবন মুয়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর উভয়ই তখন বনী আবদুল আশহাল গোত্রের নেতা। তখনও তাঁরা মুশ্রিক বা পৌত্তলিক। উল্লেখ্য যে, সা’দ ছিলেন আস’য়াদ ইবন যুরারার খালাতো ভাই। যাই হোক, খবরটি সা’দ ও উসাইদের কানে গেল। সাথে সাথে সা’দ উসাইদকে বললেনঃ ‘তোমার বাপের সর্বনাশ হোক। তুমি এখনই এ দু’জন লোকের কাছে যাও। তারা আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে আমাদের বাড়ীর ওপর চড়াও হয়েছে। তাদের তাড়িয়ে দাও, এ পথ মাড়াতে নিষেধ কর। যদি ঐ দ্বিতীয় লোকটির সাথে আমার খালাতো ভাই আস’য়াদ ইবন যুরারা না থাকতো তাহলে তোমাকে পাঠাতাম না, আমি নিজেই যেতাম। তার সামনে আমার যাওয়া শোভন হবে না। ’উসাইদ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তাঁদের নিকট গেলেন। উল্টো ফল ফললো। তাড়াতে গিয়ে নিজেই তাঁদের কথায় প্রভাবিত হলেন এবং ইসলাম কবুল করলেন। তিনি মুস’য়াব ও আস’য়াদকে বললেনঃ ‘আমি পিছনে এমন এক ব্যক্তিকে রেখে এসেছি, যদি তিনি তোমাদের কথা শোনেন তাহলে গোত্রের একটি লোকও তোমাদের থেকে দূরে থাকবে না। আমি এখনই সা’দ ইবন মু’য়াজকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এই বলে তিনি নিজ গোত্রের দিকে ফিরে চললেন। সা’দ তখন গোত্রীয় এক আড্ডায় বসা। উসাইদকে ফিরে আসতে দেখে তিনি মন্তব্য করলেনঃ ‘আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, উসাইদ যে চেহারায় গিয়েছিল তার থেকে ভিন্ন এক চেহারা নিয়ে তোমাদের কাছে ফিরছে।’ উসাইদ কাছাকাছি এসে পৌঁছালে সা’দ জিজ্ঞেস করলেনঃ কী করেছ? উসাইদ জবাব দিলেনঃ
আমি তাদের দু’জনের সাথে কথা বলেছি, তাদের মধ্যে তেমন খারাপ কিছু দেখিনি। তবুও তাদেরকে এখানে আসতে নিষেধ করে দিয়েছি। তারাও বলেছে, তোমরা যা ভালো মনে কর, তাই হবে। তবে আমি শুনেছি, বনী হারিছার লোকেরা আস’য়াদ ইবন যুরারাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তারা তো একথা জানে, আস’য়াদ তোমার খালাতো ভাই।’

সা’দ সাথে সাথে উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন এবং বর্শাটি হাতে তুলে নিয়ে তাঁদের দুজনের দিকে ছুটলেন। নিকটে পৌঁছে যখন তিনি দেখলেন, তাঁরা অত্যন্ত শান্ত ও স্থিরভাবে বসে আছেন তখন তিনি বুঝলেন, উসাইদ তাঁকে ঘোকা দিয়ে তাঁদের কথা শুনাতে চেয়েছে। তিনি তাঁদের দু’জনকে গালাগালি করতে করতে আস’য়াদকে বললেনঃ ‘শোন আবু উসামা! তোমার ও আমার মধ্যে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকতো তাহলে আমি এত কথা বলতাম না। আমরা যা পছন্দ করিনে তাই তুমি আমাদের বাড়ীর ওপর এসে করে যাচ্ছ।’ এ দিকে সা’দকে আসতে দেখে আস’য়াদ, মুসয়াবকে বলেছিলেনঃ ‘মুস’য়াব! আপনার নিকট একজন গোত্র নেতা আসছেন। এ ব্যক্তি যদি আপনার কথা মেনে নেন তাহলে গোত্রের দু’ব্যক্তিও আপনার থেকে দূরে থাকতে পারবে না।’
মুস’য়াব অত্যন্ত নরম মিযাজে সা’দকে বললেনঃ ‘আপনি কি একটু বসে আমার কথা শুনবেন? আমার কথা পসন্দ হলে, ভালো লাগলে, মানবে। আর পসন্দ না হলে, খারাপ লাগলে আমরা চলে যাব।’ সা’দ বললেনঃ ‘এ তো খুব ইনসাফের কথা।’ তিনি মাটিতে বর্শাটি গেঁড়ে বসে পড়লেন। মুস’য়াব অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে তাঁর সামনে ইসলামের দা’ওয়াত পেশ করলেন, তাঁকে কুরআন পাঠ করে শোনালেন। মুস’য়াব ও আস’য়াদ দু’জনেই বর্ণনা করেছেনঃ ইসলামের দাওয়াত পেশ করার পর সা’দ কোন কথা বলার পূর্বেই আমরা তাঁর চেহারায় ইসলামের দীপ্তি লক্ষ্য করেছিলাম। ইসলামের দা’ওয়াত শোনার পর সা’দ তাঁদের কাছে জানতে চান? ‘তোমাদের এই ইসলাম, এই দ্বীনে প্রবেশ করতে হলে কি কি কাজ করতে হয়?’ তাঁরা বললেন, ‘গোসল করে পবিত্র হতে হয়, পোশাক পরিচ্ছদ করতে হয়, তারপর কালিমা শাহাদাত উচ্চারণ করে দু’রাকা’য়াত সালাত আদায় করতে হয়।’ সা’দ তাই করলেন। তারপর বর্শাটি হাতে তুলে নিয়ে উসাইদের সাথে গোত্রীয় আড্ডার দিকে রওয়ানা দিলেন।

তাঁদেরকে ফিরতে দেখে গোত্রীয় লোকেরা বলাবলি করতে লাগলোঃ ‘সা’দ যে চেহারা নিয়ে গিয়েীছলেন এখন তাঁর সেই চেহারা নেই। তাঁকে ভিন্ন এক চেহারায় দেখা যাচ্ছে।’ সা’দ নিকটে এসে গোত্রীয় লোকদের বললেনঃ ‘ওহে আবদুল আশহাল গোত্রের লোকেরা! বিভিন্ন ব্যাপারে তোমরা আমার কাজ-কর্ম কেমন দেখে থাক?’ তাঁরা সমস্বরে জবাব দিলঃ ‘আপনি আমাদের নেতা, আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম মতামতের অধিকারী ব্যক্তি এবং আমারে বিশ্বস্ত নাকীব বা দায়িত্বশীল।’ সা’দ বললেনঃ তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. প্রতি ঈমান আনবে তোমাদের কোন নারী-পুরুষের সাথে কথা বলা আমার জন্য হারাম।’

আস’য়াদ ও মুস’য়াব বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম! সা’দের এই ঘোষনার পর সন্ধ্যা হতে না হতে বনী আবদুল আশহালের সকল নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করে। সা’দের ইসলাম গ্রহণের পর আস’য়াদ ও মুস’য়াব তাঁর বাড়ীতে অবস্থান করে ইসলামের দা’ওয়াত দিতে থাকেন। ফলে রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের পূর্বে সেখানে এমন কোন বাড়ী বা গোত্র ছিল না যেখানে দুই-একজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি। এরপর সা’দ ইবন মু’য়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর দুইজন মিলে বনী আবদুল আশহালের মূর্তিগুলি ভাংতে শুরু করেন। (দ্রঃ তাবাকাত- ৩/৪২০, ৪২১; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৩৫, ৪৩৭, ৪৭৯; আল-বিদায়া- ৩/১৫২; উসুদুল গাবা- ৩/২৯৬; হায়াতুস সাহাবা- ১/১৮৭-১৯০)

মদীনায় ইসলামের দা’ওযাত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে হযরত সা’দের অবদান ছিল অনন্য। এই গৌরবে অন্য কোন সাহাবী তাঁর জুড়ি নেই। কারণ, একজন মানুষের ইসলাম গ্রহণের প্রভাবে গোটা গোত্রের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা শুধু তাঁর ক্ষেত্রে ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। এই কারণে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘আনসারদের সর্বোত্তম গৃহ বনু নাজ্জার। তারপর আবদুল আশহালের স্থান।’ হযরত সা’দ ও তাঁর গোত্রের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় আকাবার মধ্যবর্তী সময়ে।

ইবন ’আসাকির বুখারী ও কালবী থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রাসূল সা. মক্কা থেকে হিজরাত করার পর কুরাইশরা তাঁর কোন খোঁজ-খবর পাচ্ছে না। তাঁরা কা’বার পাশে তাদের পরামর্শ গৃহে বসে আছে। এমন সময় তারা জাবালে আবূ কুবায়সের দিক থেকে একটি কবিতা আবৃত্তির কণ্ঠ শুনতে পেল। তার কিয়দাংশ নিম্নরূপঃ
‘দুই সা’দ যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে বিরুদ্ধবাদীদের ভয় থেকে মুহাম্মাদ নিরাপদ হয়ে যাবে। ওহে আউসের সা’দ, ওহে খাযরাজের সা’দ! তোমরা মুহাম্মাদের রক্ষক হয়ে যাও।’- এরূপ আরো কয়েকটি পংক্তি।

এই কবিতা শুনে কুরাইশরা বুঝতে পারে, আউস ও খাযরাজ গোত্রে রাসূলুল্লাহর সা. সাহায্যকারী দু’সা’দ হলেন- সা’দ ইবন মু’য়াজ ও সা’দ ইবন ’উবাদা। (তাহজীবে ইবন ’আসাকির- ৬/৮৯)

ইসলাম গ্রহণের কিছু দিন পর সা’দ ’উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলেন। মক্কার বিশিষ্ট কুরাইশ নেতা উমায়্যা ইবন ইবন খালাফ ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সা’দ তার বাড়ীতে উঠলেন। উমাইয়্যা মদীনায় এলে সা’দের বাড়ীতে উঠতো। তিনি উমায়্যাকে বললেন, হারাম শরীফ (কা’বার আশপাশ) যখন জনশূণ্য হয় তখন আমাকে বলবে। দুপুর বেলা উমায়্যা তাঁকে সংগে করে হারামের উদ্দেশ্যে বের হলো। পথে আবূ জাহলের সাথে দেখা। সে উমায়্যাকে জিজ্ঞেস করলোঃ এ ব্যক্তি কে?
উমায়্যাঃ সা’দ ইবন মু’য়াজ।
আবূ জাহলঃ এ তো খুবই আশ্চর্য্যের বিষয় যে, তুমি একজন ধর্মত্যাগীকে আশ্রয় দিয়েছ এবং তার সাহায্যকারী হিসেবে মক্কায় দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছ। তুমি তাঁর সাথে না থাকলে তাঁর বাড়ী ফেরা কঠিন হতো।

উল্লেখ্য যে, যারা ইসলাম গ্রহণ করতো কাফিররা ধর্মত্যাগী বলতো। হযরত সা’দ সাথে সাথে আবু জাহলের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। বললেনঃ তুমি আমাকে বাধা দিয়েই দেখনা কেমন হয়। আমি তোমার মদীনার রাস্তা বন্ধ করে দেব।

উমায়্যা বললেনঃ সা’দ। আবুল হাকাম (আবূ জাহল) মক্কার একজন বিশিষ্ট নেতা। তার সামনে নিচু স্বরে কথা বল।
সা’দ বললেনঃ চলো যাই। আমি রাসূলের সা. নিকট শুনেছি, মুসলমানরা তোমাদেরকে হত্যা করবে। আবূ জাহল প্রশ্ন করলোঃ তারা কি মক্কায় এসে হত্যা করবে? সা’দ বললেনঃ তা আমার জানা নেই।
হিজরী ২য় সনের রাবীউল আওয়াল মাসে রাসূল সা. কুরাইশ নেতা উমায়্যা ইবন খালাফের নেতৃত্বাধীন এক’শ লোকের একটি কাফিলার সন্ধানে বের হন। ইতিহাসে এটা ‘বাওয়াত’ অভিযান নামে খ্যাত। একটি বর্ণনা মতে রাসূল সা. স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সা’দ ইবন মু’য়াজকে মদীনায় রেখে যান। (আনসাবূল আশরাফ- ১/২৮৭)
হযরত রাসূলে কারীম সা., আবূ ’উবাইদা ইবনুল জাররাহ মতান্তরে সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসের সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। (তাবাকাত- ৩/৪২১; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫০৫)

হিজরী ২য় সনে ‘বাওয়াত’ অভিযানের পর ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ আসন্ন। হযরত সা’দের ভবিষ্যদ্বানী সত্যে পরিণত হওয়ার সময় সমাগত। মক্কার কুরাইশরা মদীনা আক্রমণের জন্য তোড়জোড় শুরু করলো। খবর পেয়ে হযরত রাসূলে কারীম সা. বদরের দিকে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে কুরাইশ বাহিনীর সর্বশেষ গতিবিধি অবগত হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মুহাজির ও আনসারদের সাথে পরামর্শে বসেন। মুহাজিরদের মধ্য থেকে আবু বকর, ’উমার, মিকদাদ রা. প্রমুখ সাহাবী নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করেন। অতঃপর রাসূল সা. আনসারদের লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘ওহে লোকেরা, আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন।’ সাথে সাথে সা’দ ইবন মু’য়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! সম্ভবতঃ আপনি আমাদেরকে উদ্দেশ্য করেছেন?’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘হা। সা’দ বললেনঃ ‘আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি, আপনাকে সত্যবাদী বলে জেনেছি, আর আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি যে, যা কিছু আপনি নিয়ে এসেছেন তা সবই সত্য। আপনার কথা শোনার ও আপনার আনুগত্য করার আমরা অঙ্গীকার করেছি। ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার যা ইচ্ছা করুন, আমরা আপনার সাথে আছি। সেই সত্তার নামে শপথ যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন। যদি আপনি আমাদেরকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পিছনে থাকবে না। আগামী কালই আপনি আমাদেরকে নিয়ে শত্রুর সম্মুখীন হোন, আমরা তাতে ক্ষুণ্ন হবো না। যুদ্ধে আমরা দুরুন ধৈর্যশীল, শত্রুর মুকাবিলায় পরম সত্যনিষ্ঠ। আল্লাহ আমাদের থেকে আপনাকে এমন আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন যাতে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমাদের সাথে নিয়ে আপনি অগ্রসর হোন।’ তিনি আরও বলেনঃ ‘আমরা তাদের মত হবো না যারা মূসাকে আ. বলেছিল, আপনিও আপনার রব যান এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধ করুন। আর আমরা এখানে বসে থাকি। বরং আমরা বলি, আপনি ও আপনার রব যান, আমরা আপনাদের অনুসরণ করবো। হতে পারে এক উদ্দেশ্যে আপনি বেরিয়েছেন; কিন্তু আল্লাহ আর একটি করলেন। দেখুন, আল্লাহ আপনার দ্বারা কি করান।’ ঐতিহাসিকরা বলেছেন, আল্লাহ সা’দের এই কথার সমর্থনে সূরা আনফালের ৫ নং আয়াতটি নাযিল করেন। সা’দের উপরোক্ত ভাষণে রাসূল সা. ভীষণ খুশী হন। সৈন্য মোতায়েনের সময় তিনি আউস গোত্রের ঝান্ডাটি সা’দের হাতে তুলে দেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে এ যুদ্ধে গোটা আনসার সম্প্রদায়ের পতাকা ছিল সা’দের হাতে। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬১৩, ৬১৫; উসুদুল গাবা- ২/২৯৯; তাবাকাত- ৩/৪২১; আল-বিদায়া- ৩/২৬২; হায়াতুস সাহাবা- ১/৪১৫)

ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, বদর যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সা’দ ইবন মু’য়াজ বললেনঃ ‘ইয়া নাবীয়াল্লাহ! আমরা আপনার জন্য একটি ‘আরীশ’ বা তাঁবু স্থাপন করে একটি বাহিনী মোতায়েন রাখিনা কেন? আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাব। তাতে যদি আল্লাহ আমাদের সম্মান দান করেন, আমরা বিজয়ী হই, তাহলে তো আমাদের আশা পূর্ণ হলো। আর যদি এর বিপরীত কিছু ঘটে তাহলে আপনি এই বাহিনী সহ আমাদের পিছনে ছেড়ে আসা লোকদের সাথে গিয়ে মিলিত হবেন। হে আল্লাহর নবী! আমাদের যে সব লোক মদীনায় পিছনে রয়ে গেছে, আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা তাদের থেকে একটুও বেশী নয়। যদি তারা বুঝতে পারতো আপনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন, তবে তারা এভাবে পিছনে পড়ে থাকতো না। আল্লাহ তাদের দ্বারা আপনার হিফাজত করবেন। তারা আপনাকে সৎ উপদেশ দান করবে এবং আপনার সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করবে।’ এই বক্তব্যের জন্য রাসূল সা. সা’দের প্রশংসা করে তাঁর জন্য দু’আ করলেন। এভাবে রাসূলুল্লাহর সা. জন্য রণক্ষেত্রের অদূরে একটি ‘আরীশ’ নির্মিত হয় এবং তিনি সেখান থেকে বদর যুদ্ধ পরিচালনা করেন। (আল-বিদায়া- ৩/২৬৮; সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬২০)

এই বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী যখন পরাজিত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে তখন মুসলিম মুজাহিদরা তাদের ধাওয়া করে ধরে ধরে বন্দী করতে শুরু করে। হযরত রাসূলে কারীম সা. তখন ‘আরীশে’ অবস্থান করছেন। তাঁর ওপর অকস্মাৎ পাল্টা আক্রমণ হতে পারে, এমন এক আশঙ্কায় সা’দ ইবন মু’য়াজ আরো কিছু আনসারী মুজাহিদকে সংগে নিয়ে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ‘আরীশের’ দরযায় পাহারায় নিয়োজিত হন। রাসূল সা. সা’দের চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ লক্ষ্য করে বলেনঃ সা’দ! মনে হচ্ছে লোকদের কাজ তোমার পছন্দ হচ্ছে না। সা’দ বললেনঃ হাঁ। পৌত্তলিকদের সাথে এটা আমাদের প্রথম সংঘাত। তাদের পুরুষদের জীবিত রাখার চেয়ে হত্যা করাই আমার পছন্দ। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬২৮) একটি বর্ণনা মতে, এ যুদ্ধে তিনি ’আমর ইবন ’উবাইদুল্লাহকে হত্যা করেন। এতে তাঁর একটি দাসও যোগদান করে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৯৭, ৪৭৯)

উহুদ যুদ্ধেও তিনি যোগদান করেন। এ যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অবস্থান স্থলের পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন। সূচনাতেই রাসূলুল্লাহর সা. ইচ্ছা ছিল মদীনার ভেতর থেকেই কাফিরদের প্রতিরোধ করার। মুনাফিক ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সুলূলেরও ছিল একই ইচ্ছা। কিন্তু কিছু নওজোয়ান মুজাহিদ যাঁরা ছিলেন শাহাদাত লাভের চরম অভিলাষী, তাঁরা মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার জন্য জিদ ধরে বসেন। যেহেতু তাঁরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই রাসূল সা. তাঁদের মতামত মেনে নেন এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হওয়ার জন্য অন্দর মহলে প্রবেশ করেন। সা’দ ইবন মু’য়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর তখন বললেনঃ তোমরা রাসূলকে সা. মদীনার বাইরে যাওয়ার জন্য বাধ্য করেছ; অথচ তাঁর ওপর আসমান থেকে ওহী নাযিল হয়। তোমাদের উচিত, তোমাদের মতামত প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে রাসূলুল্লাহর সা. ওপর ছেড়ে দেওয়া। এদিকে রাসূল সা. যখন তরবারি, ঢাল, বর্ম ইত্যাদি যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তখন সবাই অনুতপ্ত হলেন। একযোগে তাঁরা বললেন, আপনার বিরুদ্ধাচারণ আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আপনার নির্দেশ আমাদের শিরোধার্য। রাসূল সা. বললেনঃ এখন আমার করার কিছুই নেই। কারণ একজন নবী অস্ত্র সজ্জিত হলে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার কোন অবকাশ থাকে না। (তাবাকাত- ২/২৬)

উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথম দিকে মুসলিম বাহিনীর বিজয় হলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটে গেল। দারুন একটা বিপর্যয় ঘটে গেল। এ সময় হযরত রাসূলে কারীম সা. অটল ও দৃঢ় থাকেন। অন্য যে পনেরো ব্যক্তি রাসূলে সা. পাশে অটল থাকেন তাঁদের একজন সা’দ ইবন মু’য়াজ। এই উহুদে তাঁর ভাই ’আমর ইবন মু’য়াজ শাহাদাত বরণ করেন। (তাবাকাত- ২/৩০; আনসাবুল আশরাফ- ১/৩১৮, ৩২৯)।

উহুদ যুদ্ধের পর হযরত রাসূলে কারীম সা. একদিন আনসারদের বনী আবদুল আশহাল ও জুফার গোত্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন, ঐ গোত্রদ্বয়ের মেয়েরা উহুদে শাহাদাত প্রাপ্ত তাদের লোকদের জন্য কান্নাকাটি ও মাতম করছে। দয়ার নবীর দু’টি চোখ পানিতে ভরে গেল। তিনিও কাঁদলেন। তারপর বললেনঃ ‘কিন্তু ‘হামযার’ জন্য কাঁদার তো কেউ নেই।’ সা’দ ইবন মু’য়াজ ও উসাইদ ইবন হুদাইর নিজ গোত্র বনী আবদুল আশহালে ফিরে যখন একথা শুনলেন তখন তাঁরা তাঁদের গোত্রের মহিলাদের নির্দেশ দিলেনঃ ‘তোমরা রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ীতে যাও এবং তাঁর চাচা হামযার জন্য শোক ও মাতম কর।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৯৯)

মদীনার ইহুদী গোত্র বনী কুরায়জার নেতা কা’ব ইবন আসাদ তার গোত্রের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেছিল। খন্দক যুদ্ধের সময় সে বনী নাদার গোত্রের নেতা হুয়ায় ইবন আখতাবের কুপরামর্শ ও উস্কানিতে সেই চুক্তি ভেঙ্গে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। একথা রাসূলুল্লাহ সা. সহ মুসলমানদের কানে গেল। রাসূল সা. ঘটনার যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য আউস গোত্রের পক্ষ থেকে সা’দ ইবন মু’য়াজ ও খাযরাজ গোত্রের পক্ষ থেকে সা’দ ইবন ’উবাদাকে পাঠান। তাদের সাথে আরও যান আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ও খাওয়াত ইবন জুবায়র। তাঁরা বনী কুরায়জায় যান এবং তাদের সাথে আলোচনা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে, বিষয়টি সত্য। তাঁরা ফিরে এসে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তাঁদের তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ বিপোর্ট পেশ করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২২১)

হযরত সা’দের দৃঢ়তার বহু কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এমন একটি ঘটনা বালাজুরী ও ইবনুল আসীর বর্ণনা করেছেন। গাতফান গোত্রের নেতা আল-হারেস ইবন আউফ ও ’উয়ায়না ইবন হিসনের সাথে রাসূল সা. এ শর্তে সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা করলেন যে, তাদের পক্ষ থেকে মদীনার প্রতি কোন প্রকার হুমকী থাকবে না এবং বিনিময়ে তারা মদীনায় উৎপন্ন শস্যের এক তৃতীয়াংশ লাভ করবে। এর মধ্যে হিঃ ৫ম সনে খন্দক যুদ্ধের ডামাডোলে মদীনায় দারুণ অভাব দেখা দিল। রাসূলে কারীম সা. এ সন্ধির ব্যাপারে সা’দ ইবন মু’য়াজ ও সা’দ ইবন ’উবাদার সাথে পরামর্শ করলেন। তাঁরা দু’জন বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল। এ যদি আপনার পসন্দ হয়, আমরা তা পালন করবো। যদি আল্লাহর নির্দেশ হয় তা হলে তো অবশ্যই পালনীয়। তবে কি এটা আমাদের কথা চিন্তা করে করছেন?’ তিনি বললেনঃ ‘হ্যা, তোমাদের কথা চিন্তা করেই করছি। আমি দেখেছি, গোটা আরব এখন তোমাদের বিরুদ্ধে। আমি চেয়েছি, অন্ততঃ এর বিনিময়ে তাদের শত্রুতা কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকুক।’ একথা শুনে সা’দ ইবন মু’য়াজ বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! তারা ও আমরা ছিলাম এক সাথে পৌত্তলিক।

আমরা কেউ আল্লাহর ইবাদাত করতাম না, তাঁকে জানতামও না। তখনও তারা ব্যবসা উপলক্ষে এবং অতিথি হিসেবে ছাড়া আমাদের একটি খেজুরও খাওয়ার আশা করেনি। আজ আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আল্লাহ ইসলাম ও আপনার দ্বারা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। আর এখন কিনা আমাদের সম্পদের একটি অংশ তাদেরকে দিতে হবে? এমন সন্ধির প্রয়োজন আমাদের নেই। আল্লাহ আমাদের ও তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত শুধু তরবারি ছাড়া আর কিছুই আমরা তাদেরকে দিব না।’ রাসূল সা. তাঁর কথা মেনে নিলেন। (আল-বিদায়া- ৪/১০৪; আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৪৬, ৩৪৭)
যুদ্ধ শুরুর সময় প্রায় কাছাকাছি। সা’দ বর্ম পরে হাতে বর্শা নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছেন। পথে বনী হারেছার দূর্গে তাঁর মা উম্মুল মুমিনীন হযরত ’আয়িশার রা. পাশে বসে ছিলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর ছেলে একটি কবিতার চরণ আবৃত্তি করতে করতে চলেছে। তার একটি পংক্তি এমনঃ ‘যখন আজল এসে যায় তখন আর মৃত্যুর জন্য আপত্তি কিসের।’

মা চেঁচিয়ে বললেনঃ ‘ছেলে! তুমি তো পিছনে পড়ে গেছ, তাড়াতাড়ি যাও।’ সা’দের যে হাতে বর্শা ছিল সেই হাতটি বর্মের বাইরে বেরিয়ে ছিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে হযরত আয়িশা বললেনঃ ‘সা’দের মা! দেখ, তার বর্মটি কত ছোট।’ যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছার সাথে সাথে তাঁকে লক্ষ্য করে হিববান ইবন ’আবদি মান্নাফ একটি তীর ছোঁড়ে। কোন কোন বর্ণনায় হিববানের পরিবর্তে আবু উসামা অথবা খাফাজা ইবন ’আসিমের নাম এসেছে। তীরটি তাঁর হাতে লেগে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে। খুশীর চোটে হিব্বান বলে ওঠে ‘আমি ’আরিকার পুত্র।’ একথা শুনে রাসূল সা., মতান্তরে সা’দ বলে ওঠেনঃ ‘দোযখের মধ্যে আল্লাহ তোমার মুখমণ্ডল ঘামে নিমজ্জিত করুন।’ উল্লেখ্য যে, ’আরাকার অর্থ ঘাম। (দ্রঃ সীরাতু ইবন হিশামঃ ২/২২৬-২২৮; উসুদুল গাবা- ২/২৯৬)
সেকালে মসজিদে নববীতে যুদ্ধে আহতদের সেবা ও চিকিৎসার জন্য একটি শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। সম্ভবতঃ এই শিবিরের প্রতিষ্ঠা হয় উহুদ যুদ্ধের পর এবং তা ছিল রাসূলুল্লাহর সা. হুজরার নিকটে। আসলাম গোত্রের ’উফাইদা’ নাম্নী এক সেবা পরায়না সৎকর্মশীলা মহিলা ছিলেন এই শিবিরের একজন সেবিকা। তিনি আহতদের সেবা ও চিকিৎসা করতেন। রোগীর সেবা ও ক্ষত চিকিৎসায় তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ। খন্দক যুদ্ধে সা’দ ইবন মু’য়াজ আহত হলে রাসূল সা. নির্দেশ দেনঃ ‘তোমরা সা’দকে রুফাইদার তাঁবুতে রাখ। তাহলে আমি নিকট থেকেই তার দেখাশুনা করতে পারবো।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৩৯; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭; দায়িরা-ই-মা’রিফ-ইসলামিয়্যা, উর্দু- ১১/৩৩)

হযরত রাসূলে কারীম সা. প্রতিদিন এই শিবিরে এসে অসুস্থ সা’দের দেখাশুনা করতেন। তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন, তাই আল্লাহর দরবারে দু’আ করেনঃ ‘হে আল্লাহ! কুরাইশদের সাথে এ সংঘাত যদি এখনও অবশিষ্ট থাকে তবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। তাদের সাথে লড়াই করার আমার খুব সাধ। কারণ, আপনার রাসূলকে তারা কষ্ট দিয়েছে, তাঁকে অস্বীকার করেছে এবং মাতৃভূমি মক্কা থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর যদি সংঘাত শেষ হওয়ার সময় হয়ে থাকে তাহলে এই ক্ষতের দ্বারাই আমাকে শাহাদাত দান করুন। আর বনী কুরায়জার ব্যাপারে আমার চোখে প্রশান্তি না আসা পর্যন্ত আমার মরণ দিও না।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২২৭; উসুদুল গাবা- ২/২৯৬; বুখারী- ২/৫৯১) আল্লাহ পাক তাঁর দু’আর শেষ কথাটি কবুল করেন।

খন্দক যুদ্ধে কুরাইশ ও তাদের মিত্র বাহিনীর পশ্চাদপসরণের পর রাসূল সা. মদীনার যাবতীয় ফাসাদের উৎস ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জাকে শাস্তি দানের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তারা চুক্তি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এই বনী কুরায়জার সাথে প্রাচীনকাল থেকে মদীনার আউস গোত্রের মৈত্রী চুক্তি ছিল। রাসূল সা. যখন তাদেরকে শাস্তি দানের সিদ্ধান্ত নিলেন তখন আউস গোত্রের লোকেরা বললোঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের প্রতিপক্ষ খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে তারা ছিল আমাদের মিত্র। এর আগে আপনি আমাদের ভাই খাযরাজীদের মিত্র গোত্র বনী কায়নুকা’র বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা তো আপনার জানা আছে।’ মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সুলুলও একই রকম কথা বললো। আসলে তারা রাসূলুল্লাহর সা. পক্ষ থেকে বনী কুরায়জার ব্যাপারে কোন কঠিন দন্ডের আশংকা করছিল। রাসূল সা. বললেনঃ ‘ওহে আউস গোত্রের লোকেরা! তোমাদের গোত্রের কেউ একজন তাদের ব্যাপারে ফায়সালা দিলে তোমরা কি তাতে খুশী হবে?’ তারা বললোঃ হ্যাঁ, খুশী হবো।’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘তাদের ব্যাপারে সা’দ ইবন মু’য়াজ রায় দেবে।’

বনী কুরায়জার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য রাসূল সা. এভাবে সা’দ ইবন মু’য়াজকে বিচারক নিয়োগ করলেন। সা’দ তো তখন আহত অবস্থায় দারুণ অসুস্থ। আউস গোত্রের লোকেরা উটের পিঠে গদি বসিয়ে তার ওপর সা’দকে উঠিয়ে রাসূলের সা. নিকট নিয়ে গেল। তারা সা’দকে বললোঃ ‘আবু ’আমর! আপনার মিত্রদের সাথে একটু ভালো আচরণ করবেন। সম্ভবতঃ এ জন্যই রাসূল সা. আপনাকে বিচারক মনোনীত করেছেন।’ তারা বেশী বাড়াবাড়ি শুরু করলে সা’দ বললেনঃ ‘আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নিন্দুকের নিন্দার বিন্দুমাত্র পরোয়া সা’দের নেই।’ সা’দ যখন রাসূলের সা. নিকট পৌঁছুলেন তখন রাসূল সা. আশেপাশে বসা আনসার ও মুহাজিরদের লক্ষ্য করে বললেনঃ ‘কু মু ইলা সায়্যিদিকুম- তোমাদের নেতার সম্মানার্থে তোমরা উঠে দাঁড়াও।’ সা’দের গোত্রের লোকেরা বিচারের ক্ষেত্রে একটু নমনীয় হওয়ার জন্য যখন আবারও পীড়াপীড়ি শুরু করলো তখন তিনি বললেনঃ ‘এ ব্যাপারে তোমাদের আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি অনুসরণ করা উচিত।’ তারপর রাসূল সা. সা’দকে লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘এই লোকেরা তোমার রায়ের অপেক্ষায় আছে।’ সা’দ বললেন, ‘আমি আমার রায় ঘোষণা করছিঃ তাদের মধ্যে যারা যুদ্ধ করার উপযুক্ত তাদেরকে হত্যা করা, তাদের নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসীকে পরিণত করা এবং তাদের ধন-সম্পদ বন্টন করে দেওয়া হোক।’ তাঁর এই রায় শুনে রাসূল সা. বলেনঃ ‘সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহ যে ফায়সালা দিয়েছেন তুমিও ঠিক একই ফায়সালা দিয়েছ।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৩৯, ২৪০; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭; আল-ইসাবা- ২/৩৮)

বনী কুরায়জার ব্যাপারে সা’দের রায় বাস্তবায়িত হওয়ার পর অল্প কিছু দিন তিনি জীবিত ছিলেন। একদিন রাসূল সা. নিজ হাতে তাঁর ক্ষতে সেঁক দেন। তাতে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে ফুলে যায়। হঠাৎ একদিন ক্ষতটি ফেটে তীব্র বেগে রক্ত ঝরতে থাকে। ইবন ‘আব্বাস বলেনঃ যখন সা’দের ক্ষত থেকে রক্ত প্রবাহ শুরু হয় তখন রাসূল সা. দৌড়ে এসে তাঁর মাথাটি কোলের ওপর উঠিয়ে নেন। সা’দের রক্তে রাসূলের সা. চেহারা ও দাড়ি ভিজে যায়। রাসূল সা. একটি সাদা চাদর দিয়ে তাঁর দেহটি ঢেকে দেন। চাদরটি এত ছোট ছিল যে, মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। সা’দ ছিলেন ফর্সা মোটা মানুষ। রাসূল সা. তখন সা’দের জন্য দু’আ করেন এই বলেনঃ ‘হে আল্লাহ! সা’দ তোমার রাস্তায় জিহাদ করেছেন, তোমার নবীকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে এবং তাঁর পথে চলেছে। তুমি তাঁর রূহকে সর্বোত্তমভাবে কবুল কর।’ রাসূলের সা. এই দু’আ শুনে সা’দ চোখ খোলেন এবং বলেনঃ ‘আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল। (তাবাকাত- ৩/৪২৬; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৫৭)
হযরত সা’দ ইনতিকাল করলেন। ইবন ইসহাক বলেনঃ ‘সা’দ ইবন মু’য়াজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর রাতের বেলা একটি রেশমী পাগড়ী মাথায় বেঁধে জিবরীল আ. রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এসে বলেনঃ ‘ইয়া মুহাম্মদ! এ মৃত ব্যক্তিটি কে, যার জন্য আসমানের সবগুলি দরযা খুলে গেছে এবং ’আরশ কেঁপে উঠেছে?’ রাসূল সা. কাপড় টানতে টানতে খুব দ্রুত সা’দের নিকট গিয়ে দেখলেন, তিনি ইনতিকাল করেছেন। (তাবাকাত- ৩/৪৩২; সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫০, ২৫১)

রাসূল সা. সা’দের মাথাটি কোলের মধ্যে নিয়ে বসে থাকলেন। তখনও তাঁর হাত থেকে রক্ত ঝরছিল। চতুর্দিক থেকে মানুষ ছুটে আসতে লাগলো। আবু বকর রা. দৌড়ে এসে লাশ দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। রাসূল সা. তাঁকে এমনটি করতে নিষেধ করলেন। ’উমার রা. কাঁদতে কাঁদতে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করলেন। গোটা তাঁবুতে একটি কান্নার রোল পড়ে গেল। সা’দের দুখিনী মা কাঁদতে কাঁদতে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। ’উমার রা. তাঁকে কবিতা পড়তে নিষেধ করলেন; কিন্তু রাসূল সা. বললেনঃ থাক, তাকে পড়তে দাও। অন্য বিলাপ কারিনীরা মিথ্যা বলে থাকে; কিন্তু সা’দের মা সত্য বলছে।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২; তাবাকাত- ৩/২২৮, ২২৯)

হযরত রাসূলে কারীম সা. সা’দের মৃত্যুর পর তাঁর বাড়ীতে যাচ্ছিলেন। সাহাবীরাও সংগে ছিলেন। তিনি এত দ্রুত চলছিলেন যে, সাহাবীরা তাঁর অনুসরণ করতে গিয়ে অক্ষম হয়ে পড়ছিলেন। একজন তো বলেই বসলেন; ‘আপনি এত দ্রুত চলছেন কেন? আমরা তো রীতিমত ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘আমার ভয় হচ্ছে, আমাদের আগেই ফিরিশ্তারা তাকে গোসল না দিয়ে ফেলে, যেমন দিয়েছিল হানজালাকে।’ (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪৫)
রাসূল সা. সা’দের জানাযার সাথে গোরস্তানে গিয়েছিলেন। মুনাফিকরাও গিয়েছিল। তাঁর লাশ হালকা বোধ হচ্ছিলো। এজন্য মুনাফিকরা বলাবলি করছিল, এমন হালকা লাশ তো আমরা আর কখনও দেখিনি। সম্ভবতঃ বনী কুরায়জার ব্যাপারে সে যে রায় দিয়েছিল, এটা তারই কুফল। কথাটি রাসূলুল্লাহর সা. কানে গেলে তিনি বললেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর নামে শপথ! ফিরিশতাকুল তাঁর খাটিয়া বহন কেরছে।’ ইবন ’উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. আরও বললেনঃ ‘নিশ্চয় এই সা’দ অতি নেক্কার বান্দা। তার জন্য আল্লাহর ’আরশ দুলে উঠেছে, আসমানের দরযাসমূহ খুলে গেছে এবং তাঁর জানাযায় এমন ৭০ হাজার ফিরিশতা যোগদান করেছে যারা এর আগে আর কখনও পৃথিবীতে আসেনি।’ (তাবাকাত- ৩/৪৩০; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫১)

ইবন ইসহাক জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ ‘সা’দকে দাফনের সময় আমরা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে ছিলাম। তিনি প্রথমে, একবার জোরে ‘সুবহানাল্লাহ’ উচ্চারণ করলেন। লোকেরাও তাঁর সাথে ‘সুবহানাল্লাহ’ পড়লেন। তারপর তিনি ‘তাকবীর’ ধ্বনি দিলেন, লোকেরাও ‘তাকবীর’ দিল। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এভাবে ‘তাসবীহ’ পড়লেন কেন? বললেনঃ এ নেক্কার লোকটির কবর বড় সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ পাক প্রশস্ত করে দিয়েছেন।’ (তাবাকাত- ৩/৪৩২; সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫১, ২৫২)

হযরত সা’দকে দাফনের পর রাসূলে কারীমকে সা. দারুণ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। চোখ দিয়ে ক্রমাগতভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আল-ইস্তীয়াব গ্রন্থকার বলেছেনঃ ‘খন্দক যুদ্ধের একমাস এবং বনী কুরায়জার ঘটনার কয়েক রাত্রি পর হিজরী পঞ্চম সনে সা’দের ওফাত হয়।’ (টীকাঃ আল-ইসাবা- ২/২৮)
মদীনার বাকী গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। (আল-আ’লাম- ৩/১৩৯) ইবন ইসহাক তাঁকে খন্দক যুদ্ধে বনী ’আবদিল আশহালের শাহাদাত প্রাপ্তদের মধ্যে গণ্য করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২)

হযরত সা’দের ওফাতের ঘটনাটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক অসাধারণ ঘটনা। তিনি ইসলামের খিদমতে যে অবদান রাখেন এবং তাঁর মধ্যে যে ঈমানী চেতনা বিদ্যমান ছিল, তার জন্য তাঁকে আনসারদের ‘আবু বকর’ বলে গণ্য করা হতো। ‘ইফক’ বা হযরত আয়িশার প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একদিন রাসূল সা. ক্ষোভের সাথে বললেনঃ ‘এ আল্লাহর দুশমন (আবদুল্লাহ ইবন উবাই, মুনাফিক সর্দার) আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে এর প্রতিবিধান করতে পারে? ’সাথে সাথে সা’দ উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেনঃ ’আউস গোত্রের কেউ থাকলে আমাকে বলুন, আমরা তার গর্দান উড়িয়ে দিচ্ছি। আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজীদের কেউ হয়, আমাদেরকে নির্দেশ দিন, আমরা আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবো।’ (শাহীরাতুন নিসা ফিল ’আলম আল-ইসলামী- ৫৯) তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বুঝা যায় তাঁর জানাযায় ফিরিশতাদের অংশগ্রহণ এবং আল্লাহর ’আরশ কেঁপে উঠার মাধ্যমে। তাই একজন আনসারী কবি গর্ব করে বলেছিলেনঃ ‘একমাত্র সা’দ আবু ’আমরের মৃত্যু ছাড়া আর কোন মরণশীলের মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে, এমন কথা আমরা কখনও শুনিনি।’ এমনিভাবে রাসূলুল্লাহর সা. দরবারী কবি হাস্সান ইবন সাবিতও তাঁর অনেক কবিতায় সা’দের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২, ২৬৯, ২৭০, ২৭২)
হযরত সা’দ ছিলেন ফর্সা, দীর্ঘদেহী, সুদর্শন পুরুষ। মৃত্যুকালে ’আমর ও আবদুল্লাহ নামে দুই ছেলে রেখে যান। তাঁরা দু’জনই বাই’য়াতে রিদওয়ানে শরীক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তাঁদের মা হিন্দা বিনতু সাম্মাকও ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. সম্মানিত সাহাবিয়্যা। (তাবাকাত- ৪২০, ৪৩৩)
মদীনায় ইসলামের প্রথম ভাগেই হযরত সা’দের ওফাত হয়। জীবনের মাত্র পাঁচটি বছর রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। এ অল্প সময়ে তিনি হয়তো বহু হাদীস শুনে থাকবেন; কিন্তু হাদীস বর্ণনার সিলসিলা যেহেতু রাসূলুল্লাহর সা. দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর শুরু হয়, এ কারণে তাঁর বর্ণনা প্রচারিত হয়নি। তবে সহীহ বুখারীতে ’আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদের একটি বর্ণনা এসেছে যাতে সা’দের ’উমরার কথা আছে এবং উহুদে সা’দ ইবন রাবী’র শাহাদাতের ঘটনা প্রসঙ্গে আনাস রা. তাঁর থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এটাও বুখারীতে এসেছে। (তাহজীব আত-তাহজীব- ৩/৪৮২)

নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে হযরত সা’দ ইবন মু’য়াজ ছিলেন অতি উঁচুমানের লোক। ’আয়িশা রা. বলেনঃ ‘রাসূলুল্লাহর সা. পরে বনী ’আবদুল আশহালে তিন ব্যক্তি থেকে উত্তম আর কেউ নেই। তাঁরা হলেনঃ সা’দ ইবন মু’য়াজ, উসাইদ ইবন হুদাইর ও ’আব্বাদ ইবন বিশর।’ (আল-ইসাবা- ২/৯৭) সা’দ নিজেই বলতেনঃ আমি একজন সাধারণ মানুষ, তবে তিনটি বিষয়ে যে পর্যন্ত পৌঁছানো উচিত, আমি সেখানে পৌঁছেছি। ১. রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে যে বাণী আমি শুনি তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে বিশ্বাস করি। ২. নামাযের মধ্যে অন্য কোন চিন্তা আমার মনে জাগে না। ৩. মৃত ব্যক্তির জানাযার কাছে থাকলে মুনকির- নাকীরের প্রশ্নের চিন্তা ছাড়া আমার মধ্যে আর কিছু থাকে না। (টীকাঃ আল ইসতীয়াব; আল ইসাবা- ২/৩৩; তাহজীব আত তাহজীব- ৩/৪৮২)

হযরত সা’দের ’আমলের ওপর হযরত রাসূলে কারীমের সা. যে দারুণ আস্থা ছিল সে কথা একটি হাদীসে জানা যায়। হযরত ’আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘কবরের একটি চাপ অবশ্যই আছে। যদি কেউ এই চাপ থেকে রেহাই পেয়ে থাকে, তাহলে সে সা’দ ইবন মু’য়াজ।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৫২; তাবাকাত- ৩/২৫২; তাবাকাত- ৩/৪৩২। তাছাড়া ইমাম আহমাদ ও বায়হাকীও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
কিন্দার রাজা উকাযদারকে খালিদ ইবন ওয়ালীদ বন্দী করে মদীনায় নিয়ে এলেন। তার মূল্যবান পোশক দেখে, মতান্তরে রাসূলকে সা. উপহার দেওয়া একখানা কাপড় দেখে সাহাবীরা অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁদের এ অবস্থা দেখে রাসূল সা. বললেনঃ ‘তোমরা এই দেখে অবাক হচ্ছো? জান্নাতে সা’দ ইবন মু’য়াজের রুমালগুলিও এর থেকে সুন্দর হবে।’ (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৮৩; তাবাকাত- ৩/৪৩৬; উসুদুল গাবা- ২/২৯৭; উবন হিশাম- ২/৫২৬; সহীহ বুখারী- ১/৫৩৬)

আবু সা’ঈদ আল-খুদরী রা. বলেনঃ ‘যাঁরা বাকী গোরস্তানে সা’দের কবর খুঁড়েছিল আমি তাঁদের একজন। আমরা কবরের মাটি খোঁড়ার সময় মিশকের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। শুরাহবীল ইবন হাসানা বলেনঃ এক ব্যক্তি সা’দের কবরের মাটি থেকে এক মুঠ মাটি নিয়ে ঘরে রেখে দেয়। কিছুদিন পরে সে দেখে, তা মাটি নয়; বরং মিশ্ক। (তাবাকাত- ৩/৪৩১; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৯৫)

No comments

Powered by Blogger.