৯৭. সূরা ক্বদর -এর তাফসীর
সূরা ক্বদর
(মহিমান্বিত)
সূরা ‘আবাসা-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ৯৭, আয়াত ৫, শব্দ ৩০, বর্ণ ১১২।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) আমরা একে নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে। | إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ |
(২) তুমি কি জানো ক্বদরের রাত্রি কি? | وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ |
(৩) ক্বদরের রাত্রি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম। | لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ |
(৪) এ রাতে অবতরণ করে ফেরেশতাগণ এবং রূহ, তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে বিভিন্ন নির্দেশনা সহকারে। | تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ |
(৫) এ রাতে কেবলই শান্তি বর্ষণ। যা চলতে থাকে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। | سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ |
বিষয়বস্ত্ত :
নুযূলে কুরআনের সময়কাল এবং ক্বদর রজনীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।
গুরুত্ব :
(১) আল্লাহ তা‘আলা এই রাত্রিতে কুরআন নাযিলের সূচনা করেছেন। যা মানবজাতির জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নির্দেশক। (২) এই রাত্রির ইবাদত হাযার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেয় (৩) এই রাত্রিতে রহমতের পশরা নিয়ে হাযার হাযার ফেরেশতা নাযিল হয় ও পৃথিবীতে আল্লাহর রহমত বিতরণ করে (৪) এই রাত্রির মাহাত্ম্য বর্ণনায় এটি পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে নাযিল হয়েছে। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তেলাওয়াত করবে।
তাফসীর :
(১) إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ ‘আমরা একে নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে’।
অর্থ ابتدأنا انزال القرآن على قلب خاتم النبيين ‘শেষনবীর হৃদয়ে আমরা কুরআন নাযিলের সূচনা করেছি’। এখানে ‘আমরা’ বলে বহুবচনের সম্মানজনক ক্রিয়াপদ (صيغة العظمة) আনা হয়েছে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশের জন্য। যেমন তিনি অন্যত্র বলেছেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ ‘আমরা যিকর (কুরআন) নাযিল করেছি এবং আমরা এর হেফাযতকারী’ (হিজর ১৫/৯)। কখনো নিজের একত্ব বর্ণনার জন্য একবচনের ক্রিয়াপদ (صيغة الوحدانية) ব্যবহার করেছেন। যেমন إِنَّنِي أَنَا اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِيْ وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي ‘নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তুমি আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম কর’ (ত্বোয়াহা ২০/১৪)। (هُ) সর্বনাম দ্বারা ‘কুরআন’ বুঝানো হয়েছে। যদিও পূর্বে তার উল্লেখ নেই। তবে বিষয়টি পরিষ্কার। আর পুরা কুরআনই তো একটি সূরার ন্যায় (কুরতুবী)।
‘ক্বদর’ (القدر) অর্থ الشرف، المنزلة সম্মান, মর্যাদা। لَيْلَةُ الْقَدْرِ অর্থ মর্যাদার রাত্রি। অথবাلَيْلَةٌ ذُوْ قَدْرٍ মহিমান্বিত রজনী। অথবা لَيْلَةُ التَّقْدِيْرِ ‘তাক্বদীর নির্ধারণের রাত্রি’। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ- فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْمٍ- أَمْرًا مِنْ عِنْدِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِيْنَ- ‘আমরা একে নাযিল করেছি বরকতময় রাত্রিতে। আর আমরা তো সতর্ককারী’। ‘এ রাত্রে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়’। ‘আমাদের আদেশক্রমে। আর আমরাই তো প্রেরণকারী’ (দুখান ৪৪/৩-৫)।
এ রাতের নেক আমল সমূহের ছওয়াব তুলনাহীন। তাছাড়া এ রাতে সর্বাধিক মর্যাদামন্ডিত কিতাব সর্বাধিক মর্যাদামন্ডিত রাসূলের নিকট অবতীর্ণ হয়েছে। সেকারণেও এ রাতকে লায়লাতুল ক্বদর বা মহিমান্বিত রজনী হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকতে পারে। এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ এলাহী গ্রন্থ আল-কুরআন নাযিলের সূচনা হয়েছে ক্বদরের রাত্রিতে। এ রাত্রিটা কোন্ মাসে? সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ- ‘রামাযান মাস। যে মাসে নাযিল হয়েছে কুরআন, মানবজাতির জন্য হেদায়াত ও হেদায়াতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। অর্থাৎ ক্বদরের রাত্রি হ’ল রামাযান মাসে, কথিত শা‘বান মাসে নয়। ক্বদর রাত্রিকে অন্যত্র ‘মুবারক রাত্রি’ বলা হয়েছে। যেমন, إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ‘আমরা একে নাযিল করেছি বরকতময় রজনীতে’ (দুখান ৪৪/৩)।
ইকরিমা থেকে উক্ত রাত্রি অর্থ ‘শা‘বানের মধ্য রাত্রি’ বলে বর্ণিত হয়েছে। ইবনু কাছীর বলেন, এটি একেবারেই দূরবর্তী কথা (فَقَدْ أَبْعَدَ النَّجْعَةُ)। কেননা কুরআন নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছে ‘রামাযানে নাযিল হয়েছে’ বলে (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। এ প্রসঙ্গে যে হাদীছ বলা হয়ে থাকে تُقْطَع الآجَالُ مِنْ شَعْبَانَ إلَى شَعْبَانَ حَتَّى إنَّ الرَّجُلَ ليَنْكِحُ، ويُولدُ لَهُ، وَلَقْدَ أُخْرِج اسْمُهُ في الْمَوْتَى ‘এই রাতে এক শা‘বান থেকে পরবর্তী শা‘বান পর্যন্ত সবকিছুর তাক্বদীর নির্ধারিত হয়। এমনকি এই সময় কার বিয়ে হবে, সন্তান হবে বা মৃত্যু হবে সবই’।[1] তা ‘মুরসাল’। এরূপ দুর্বল দলীল দিয়ে কুরআনী দলীল সমূহের মুকাবিলা করা যায় না’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা দুখান ৪৪/৩-৪)। অতএব এ আয়াতে বিদ‘আতীদের জন্য কোন দলীল নেই। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, যারা সূরা দুখানে বর্ণিত ‘মুবারক বাত্রি’ অর্থ ‘মধ্য শা‘বান’ বলেন এবং ক্বদরের রাত্রির ন্যায় ঐ রাত্রিতে তাক্বদীর বণ্টন হয় বলেন, তারা গায়েবী বিষয়ে অকাট্য দলীল ব্যতীত কথা বলার দুঃসাহস দেখিয়ে থাকেন। যে বিষয়ে নিষ্পাপ রাসূল (ছাঃ) থেকে কোন ছহীহ মুতাওয়াতির হাদীছ বর্ণিত হয়নি, সে বিষয়ে কোনরূপ ধারণা পোষণ করা আমাদের জন্য সিদ্ধ নয়’।[2]
নুযূলে কুরআনের সূচনা :
বিশুদ্ধ হিসাব মতে নুযূলে কুরআন শুরু হয় হেরা গুহায় ২১ রামাযান সোমবার ক্বদরের রাত্রিতে। প্রথম পাঁচটি আয়াত (সূরা ‘আলাক্ব ১-৫ আয়াত) নাযিল করে জিব্রীল (আঃ) চলে যান। খৃষ্টীয় হিসাবে এ দিনটি ছিল ৬১০ খৃষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বয়স ছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।[3]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নামে যে কথা বলা হয়েছে যে, পুরা কুরআন জিব্রীল (আঃ) একত্রে লওহে মাহফূয থেকে রামাযান মাসের ক্বদর রাত্রিতে নিম্ন আকাশে এনে বায়তুল ইযযাতে রাখেন (ইবনু কাছীর)। অতঃপর সেখান থেকে লেখক ফেরেশতাগণ জিব্রীলকে বিশ রাত্রিতে বারে বারে আবৃত্তি করে শুনান। অতঃপর জিব্রীল সেটা নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে বারে বারে নাযিল করেন, যা বিশ বছরে শেষ হয়’ (মাওয়ার্দী)। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, وهذا باطل، ليس بين جبريل وبين الله واسطة ولا بين جبريل ومحمد عليهما السلام واسطة- ‘এটি বাতিল কথা। কেননা জিব্রীল ও আল্লাহর মধ্যে কোন মাধ্যম নেই। জিব্রীল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যেও কোন মাধ্যম নেই’ (কুরতুবী)। বরং সঠিক কথা এই যে, কুরআন লওহে মাহফূযে সুরক্ষিত ছিল (বুরূজ ৮৫/২১-২২)। সেখান থেকে প্রয়োজন মাফিক আল্লাহ জিব্রীল মারফত তাঁর রাসূলের নিকটে প্রেরণ করেছেন। যা ২৩ বছরে শেষ হয়েছে।
(২) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ‘তুমি কি জানো ক্বদরের রাত্রি কি?’
এর দ্বারা এ রাতের উচ্চ মর্যাদার প্রতি শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ফার্রা বলেন, কুরআনের যেসব স্থানে وَمَا أَدْرَاكَ আসে, তার অর্থ হয় قد أدراه ‘সে জানে’। আর যেখানে وما يُدْرِيْكَ আসে, তার অর্থ হয়, لم يُدْرِه ‘সে জানে না’ । যেমন বলা হয়েছে وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى ‘তুমি কি জানো সে হয়ত পরিশুদ্ধ হ’ত?’ (আবাসা ৮০/৩; কুরতুবী)। এখানে ‘লায়লাতুল ক্বদর’ কি, সেটা আল্লাহ নিজেই পরবর্তী আয়াতে জানিয়ে দিচ্ছেন।
‘লায়লাতুল ক্বদর’ অর্থ আল্লাহ বলেছেন, لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ ‘বরকতময় রাত্রি’ (দুখান ৪৪/৩)। কেন এটি ‘বরকতময়’ তার ব্যাখ্যাও আল্লাহ দিয়েছেন, فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْمٍ ‘এরাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়’ (দুখান ৪৪/৪)। অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে নির্ধারিত তাক্বদীর হ’তে আগামী এক বছরের হায়াত-মউত-রূযী ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের তাক্বদীর ফেরেশতাদের হাতে এ রাতে অর্পণ করা হয় (ইবনু কাছীর, দুখান ৪৪/৪)। এ রাতে কুরআন নাযিলের সূচনা হওয়াটাও ছিল তাক্বদীরের একটা অংশ। আর কুরআন নাযিলের ফলে এ রাতের মর্যাদা শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘তুমি কি জানো ক্বদরের রাত্রি কি’? অতঃপর তিনি বলেন-
(৩) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ ‘ক্বদরের রাত্রি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম’। অর্থাৎ লায়লাতুল ক্বদর যাবতীয় সময়কালের চেয়ে উত্তম (خير من جميع الدهور) , যাতে লায়লাতুল ক্বদর নেই। আরবরা ألف বা ‘হাযার’ শব্দ ব্যবহার করে থাকে ‘কোন বস্ত্তর চূড়ান্তসীমা’ (فى نهاية الأشياء) বুঝানোর জন্য। যেমন অন্য আয়াতে ইহুদীদের চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ ‘তাদের কেউ কামনা করে যেন হাযার বছর আয়ু পায়’ (বাক্বারাহ ২/৯৬)। এখানে ‘হাযার বছর’ অর্থ চিরকাল (جميع الدهر)। একইভাবে أَلْفِ سَنَةٍ বা ‘হাযার বছর’ অর্থ অনন্তকাল (কুরতুবী)।
অর্থাৎ কেবল এক হাযার মাসের নয়, বরং এ রাতের ইবাদত ও নেক আমল হাযার হাযার রাতের ইবাদতের তুলনায় উত্তম। তিনটি আয়াতে পরপর তিনবার ‘লায়লাতুল ক্বদর’ উল্লেখ করার পর বলা হচ্ছে এটি হাযার রাত্রির চেয়ে উত্তম। বারবার বলার মাধ্যমে এ রাতের মর্যাদা আরও উন্নীত হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘হাযার রাত্রির’ ব্যাখ্যায় তাফসীর ইবনু জারীর, কুরতুবী ও ইবনু কাছীরে অনেকগুলি বিস্ময়কর বর্ণনা উল্লেখিত হয়েছে। যার প্রায় সবগুলিই ভিত্তিহীন, যঈফ, মুনকার এবং ইস্রাঈলী বর্ণনা মাত্র (হাশিয়া কুরতুবী)। অনেকে হাযার মাসের ব্যাখ্যা ৮৩ বছর ৪ মাস করেছেন (ইবনু কাছীর)। এগুলি কষ্ট কল্পনা মাত্র। আর এগুলি আরবদের বাকরীতির বিরোধী। বস্ত্ততঃ এখানে ‘হাযার রাত্রি’ বলে অসংখ্য ও অগণিত রাত্রি বুঝানো হয়েছে। শিরক ও বিদ‘আতে পূর্ণ এবং দুনিয়াবী স্বার্থে দুষ্ট হাযার মাস রাত্রি জাগরণের চাইতে স্রেফ আল্লাহর ইবাদতে একটি রাত্রি জাগরণ সর্বোচ্চ মর্যাদামন্ডিত নয় কি?
এ রাতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، متفق عليه-
(ক) ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ছালাতে রত থাকবে, আল্লাহ তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করে দিবেন’।[4] অর্থাৎ ইবাদত হ’তে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এবং তাঁর নিকট থেকে ছওয়াব ও পুরস্কার লাভের আকুল আকাংখা নিয়ে। এখানে ‘সকল গোনাহ’ বলতে সকল ছগীরা অর্থাৎ ছোট গোনাহ বুঝানো হয়েছে। কেননা কবীরা বা বড় গোনাহ তওবা ব্যতীত মাফ হয় না। যেমন আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلاَّ اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ ‘যারা কবীরা গোনাহ ও অশ্লীল কর্মসমূহ হ’তে বিরত থাকে, তবে ছোটখাট গোনাহ ব্যতীত। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা প্রশস্ত ক্ষমার অধিকারী’ (নাজম ৫৩/৩২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ وَالْجُمُعَةُ إِلَى الْجُمُعَةِ وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ- ‘দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুম‘আ হ’তে আরেক জুম‘আ, এক রামাযান হ’তে আরেক রামাযান তার মধ্যবর্তী সকল গুনাহের কাফফারা হয়ে থাকে, যদি সে কবীরা গোনাহ সমূহ হ’তে বিরত থাকে’।[5]
(খ) রামাযানের আগমনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
قَدْ جَاءَكُمْ شَهْرُ رَمَضَانَ شَهْرٌ مُبَارَكٌ افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُُفْتَحُ فِيْهِ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَتُغْلَقُ فِيْهِ أَبْوَابُ الْجَحِيْمِ وَتُغَلُّ فِيْهِ الشَّيَاطِيْنُ، فِيْهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ- ‘তোমাদের নিকটে রামাযান মাস আগমন করেছে। যা বরকতমন্ডিত মাস। আল্লাহ এ মাসের ছিয়াম তোমাদের উপরে ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা থাকে, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ থাকে ও শয়তানগুলি শৃংখলিত থাকে। এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাযার মাসের চাইতে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হ’ল, সে (আল্লাহর বিশেষ রহমত থেকে) বঞ্চিত রইল’।[6]
(৪) تَنَزَّلُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِّنْ كُلِّ أَمْرٍ ‘এ রাতে অবতরণ করে ফেরেশতাগণ এবং রূহ, তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে বিভিন্ন নির্দেশনা সহকারে’।
অর্থাৎ এ রাতে রহমত ও বরকতের ডালি নিয়ে জিব্রীলের নেতৃত্বে অগণিত ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করে আল্লাহর বিশেষ অনুমতিক্রমে। ক্বাতাদাহ ও অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন, تقضى فيها الأمور وتقدر الآجال والأرزاق ‘যাতে বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত থাকে এবং মৃত্যু ও রূযির হিসাব নির্ধারিত থাকে’ (ইবনু কাছীর)। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ِفيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْمٍ ‘এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়’ (দুখান ৪৪/৪)।
এখানে ‘রূহ’ অর্থ জিব্রীল (আঃ)। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوْحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَراً سَوِيًّا- ‘অতঃপর আমরা তার (মরিয়ামের) নিকটে আমাদের রূহকে (জিব্রীলকে) পাঠালাম। অতঃপর সে তার (মরিয়ামের) নিকটে পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’ (মারিয়াম ১৯/১৭)। অমনিভাবে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, نَزَلَ بِهِ الرُّوْحُ الْأَمِيْنُ ‘বিশ্বস্ত ফেরেশতা (জিব্রীল) একে (কুরআনকে) নিয়ে অবতরণ করে’ (শো‘আরা ২৬/১৯৩)। আলোচ্য আয়াতে ‘ফেরেশতাগণ’ বলার পরে পৃথকভাবে ‘রূহ’ বলে ফেরেশতাগণের সর্দার হিসাবে জিব্রীল (আঃ)-এর স্বতন্ত্র মর্যাদা নির্দেশ করা হয়েছে।
بِأِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ اَمْرٍ ‘তাদের প্রতিপালকের অনুমিতক্রমে বিভিন্ন নির্দেশনা সহকারে’।
ফেরেশতাগণ সর্বদা আল্লাহর হুকুম প্রতিপালন করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, لاَ يَعْصُوْنَ اللهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ ‘আল্লাহ তাদেরকে যা আদেশ দেন, তারা তার অবাধ্যতা করে না এবং তাদেরকে যা নির্দেশ দেয়া হয়, তারা তা পালন করে’ (তাহরীম ৬৬/৬)। এরপরেও بِأِذْنِ رَبِّهِمْ ‘তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে’ বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে এ বিষয়ে যে, এরাতে আল্লাহর বিশেষ অনুমতিক্রমে বিশেষ ফেরেশতামন্ডলী বিশেষ নির্দেশসমূহ নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করে।
এখানে بِإِذْنِ رَبِّهِمْ অর্থ بالإذن الكونى ‘তাঁর প্রাকৃতিক নির্দেশক্রমে’। কেননা প্রকৃতির স্রষ্টা আল্লাহ। এর অর্থ الإذن الشرعى ‘বিধানগত নির্দেশ’ নয়। যেমন মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ ‘তাদের কি এমন কোন শরীক আছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধানসমূহ রচনা করে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি’? (শূরা ৪২/২১)।
এখানে مِنْ كُلِّ اَمْرٍ অর্থ بكل أمر مما يأمرهم الله به ‘আল্লাহর বিভিন্ন নির্দেশনা সহকারে’। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَحْفَظُوْنَهُ مِنْ أَمْرِ اللهِ ‘ফেরেশতাগণ তাকে (মানুষকে) হেফাযত করে থাকে আল্লাহর নির্দেশে’ (রা‘দ ১৩/১১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, أى بكل أمر قدَّره الله وقضاه فى تلك السنة إلى قابل ‘আল্লাহর ঐ সকল নির্দেশ সহকারে যা তিনি আগামী এক বছরের জন্য নির্ধারিত করেছেন ও ফায়ছালা করেছেন’ (কুরতুবী)।
ইবনু কাছীর বলেন, এ রাতে ফেরেশতাগণ অধিক সংখ্যায় অবতরণ করে অধিক বরকতের কারণে। অধিকহারে বরকত ও রহমতের অবতরণের সাথে সাথে ফেরেশতাগণও অধিকহারে অবতরণ করে থাকে। যেমন তারা কুরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহকে স্মরণ করার মজলিসসমূহ ঘিরে রাখে। সেখানে প্রশান্তির বিশেষ রহমত নাযিল করে। তারা ইলম অন্বেষণকারীর প্রতি সম্মানের জন্য তাদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেয়’।[7]
কুরতুবী ও তানতাভী বলেন, مِنْ كُلِّ اَمْرٍ -য়ে বাক্য শেষ হয়েছে। পরবর্তী বাক্য سَلاَمٌ থেকে শুরু হয়েছে। একথা নাফে‘ ও অন্যান্য বিদ্বান হ’তে বর্ণিত হয়েছে (কুরতুবী)।
উল্লেখ্য যে, এরাতের বরকত থেকে বঞ্চিত হয় ঐসব গৃহ, যেখানে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। যেমন আবু ত্বালহা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تَدْخُلُ الْمَلاَئِكَةُ بَيْتًا فِيْهِ كَلْبٌ وَلاَ تَصَاوِيْرُ ‘ঐ গৃহে (বা স্থানে) (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না, যেখানে কুকুর বা ছবি থাকে’।[8] এর দ্বারা প্রাণীর ছবি বুঝানো হয়েছে, যা টাঙানো থাকে। ছবি, প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য সবই এর মধ্যে শামিল। ‘কুকুর’ দ্বারা সাধারণ কুকুর বুঝানো হয়েছে, যা বাড়ীর পাহারাদারীর জন্য নয় এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়।
(৫) سَلاَمٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْر ‘এ রাতে কেবলই শান্তি বর্ষণ। যা চলতে থাকে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত’।
ক্বাতাদাহ ও ইবনু যায়েদ বলেন, هى خير كلها ليس فيها شر إلى مطلع الفجر ‘এ রাতে কেবলই মঙ্গল। ফজর পর্যন্ত কোন অমঙ্গল নেই’ (ইবনু কাছীর)। যাহহাক বলেন, لا يقدّر الله فى ةلك الليلة إلا السلامة ‘এ রাতে আল্লাহ শান্তি ব্যতীত অন্য কিছুই নির্ধারণ করেন না’। মুজাহিদ বলেন, هى ليلة سالمة لايستطيع الشيطان أن يعمل فيها سوء ولا أذى ‘এটি নিরাপদ রাত্রি। এ রাতে শয়তান কোন মন্দ বা কষ্টদায়ক কাজ করতে সক্ষম হয় না’। শা‘বী বলেন, এ রাতে মাগরিব হ’তে ফজর পর্যন্ত ফেরেশতাগণ মসজিদের মুছল্লীদের উপরে এবং প্রত্যেক মুমিনের উপরে সালাম করে বলে, السلام عليك ايها المؤمن ‘হে মুমিন আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক!’ (কুরতুবী)।
ক্বদরের রাত্রি কোন্টি :
লায়লাতুল ক্বদর কোন তারিখে হয়ে থাকে, সে বিষয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‘তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলিতে লায়লাতুল ক্বদর সন্ধান কর’।[9]
বিভিন্ন ছহীহ হাদীছে এ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে, যার আলোকে বিদ্বানগণ এক একটির উপরে যোর দিয়েছেন। যেমন উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) ২৭ শে রামাযানের রাত্রির ব্যাপারে দৃঢ় মত প্রকাশ করে বলেছেন যে, রাসূল (ছাঃ) আমাদের খবর দিয়েছেন যে, أَنَّ الشَّمْسَ تَطْلُعُ يَوْمَئِذٍ لاَ شُعَاعَ لَهَا ‘ঐদিন সূর্য উঠবে, কিন্তু আলোকচ্ছটা থাকবে না’।[10] এর উপরে ভিত্তি করে অনেক বিদ্বান ২৭-এর রাত্রিকে লায়লাতুল ক্বদর বলে নির্দিষ্ট করেছেন। অথচ ওবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) প্রমুখাৎ বুখারী বর্ণিত হাদীছে এর ব্যাখ্যা এসেছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে লায়লাতুল ক্বদর সম্পর্কে খবর দেবার জন্য বের হ’লেন। তখন দু’জন মুসলিম তাঁর সামনে এসে গেল। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে ক্বদরের রাত্রি সম্পর্কে খবর দেবার জন্য বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুকের সাথে দেখা হয়ে গেল। ফলে সেটা আমার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হ’ল (অর্থাৎ নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণের কথাটা আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হ’ল)। সম্ভবতঃ এটা তোমাদের জন্য ভাল হ’ল। অতএব তোমরা এটা অনুসন্ধান কর ২৯, ২৭ ও ২৫শের রাতে’।[11] ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, হাদীছের ব্যাখ্যা এটাই হ’তে পারে যে, তিনি বের হয়েছিলেন কেবল ঐ বছরের শবে ক্বদর নির্দিষ্ট করে বলার জন্য’ (তাফসীর ইবনু কাছীর)।
এতদ্ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সমস্ত হাদীছ একত্রিত করলে এ রাত্রিকে নির্দিষ্ট করার কোন উপায় নেই। যদি ২৭-এর রাত্রি নির্দিষ্ট হ’ত, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ কেবল এ রাতেই ইবাদতে রত থাকতেন। কিন্তু তাঁদের আমল ছিল এর বিপরীত। তারা শেষ দশকে ই‘তিকাফে ও ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। অথচ আমরা কেবল ২৭ রাত্রিকেই শবেক্বদর ধরে নিয়েছি এবং এ রাত্রিকে ইবাদতের জন্য এমনকি ওমরাহর জন্য খাছ করে নিয়েছি। অথচ ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (ছাঃ) ১৯ দিন সেখানে অতিবাহিত করেন। কিন্তু তিনি বা তাঁর সঙ্গী ছাহাবীগণের কেউ ২৭শে রামাযানে বিশেষভাবে শবে ক্বদর পালন করেননি বা ওমরা করেননি। বরং এভাবে দিন নির্ধারণ করাটাই বিদ‘আত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরাতটিকে বিশেষভাবে নির্ধারণ করেননি। মানুষ এভাবে বহু কিছুকে নিজেদের কল্পনার ভিত্তিতে দ্বীনের বিধান হিসাবে নির্ধারণ করেছে। যা আদৌ কোন দ্বীন হিসাবে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এর মাধ্যমে আমরা অনুষ্ঠানপ্রিয় হয়ে পড়েছি এবং শর্টকাট রাস্তায় জান্নাত পাওয়ার শয়তানী ধোঁকায় নিপতিত হয়েছি। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন-আমীন!
ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আল্লাহ পাক এ রাত্রিকে গোপন রেখেছেন তার তাৎপর্য এই যে, বান্দা যেন সারা রামাযান ইবাদতে কাটায় এবং শেষ দশকে তার প্রচেষ্টা যোরদার করে’ (ইবনু কাছীর)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমৃত্যু রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করে গেছেন। তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীগণ ই‘তিকাফ করেছেন’।[12] এ মর্মে ইবনু ওমর ও আয়েশা (রাঃ) হ’তে বুখারী ও মুসলিমে হাদীছসমূহ বর্ণিত হয়েছে। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ أَحْيَا اللَّيْلَ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ وَجَدَّ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ- ‘শেষ দশক হাযির হ’লে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সারা রাত জাগতেন, পরিবারের সবাইকে জাগাতেন এবং খুব কষ্ট করতেন ও কোমরে কাপড় শক্ত করে বেঁধে নিতেন’।[13] অন্য বর্ণনায় এসেছে, كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ فِىْ غَيْرِه-ِ ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) রামাযানের শেষ দশকে ইবাদতে যত কষ্ট করতেন, এত কষ্ট অন্য সময় করতেন না’।[14]
ইবনু কাছীর বলেন, সর্বদা বেশী বেশী প্রার্থনা করা মুস্তাহাব। রামাযান মাসে আরও বেশী এবং রামাযানের শেষ দশকে আরও বেশী। তন্মধ্যে শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলিতে সবচাইতে বেশী বেশী দো‘আ করতে হবে। বিশেষভাবে যে দো‘আটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে এ রাত্রিতে পড়ার জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা হ’ল اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল! তুমি ক্ষমা করতে ভালবাসো। অতএব আমাকে ক্ষমা কর’।[15]
উল্লেখ্য যে, নুযূলে কুরআনের এই মাসে রাসূল (ছাঃ) নিয়মিতভাবে জিব্রীল (আঃ)-এর নিকট কুরআন পেশ করতেন। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, জিব্রীল (আঃ) রামাযানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং রাসূল (ছাঃ) তাঁর নিকটে কুরআন পেশ করতেন। এ সময় রাসূল (ছাঃ) দানের হস্ত প্রসারিত করতেন বায়ু প্রবাহের ন্যায়।[16] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর কুরআন প্রতিবছর একবার করে পেশ করা হ’ত। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর বছরে দু’বার পেশ করা হয়। তিনি প্রতিবছর ১০ দিন ই‘তিকাফ করেন। কিন্তু মৃত্যুর বছরে তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফ করেন’।[17] অর্থাৎ নবুঅত লাভের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি রামাযানে তাঁর নিকটে কুরআন পেশ করা হ’ত (মির‘আত ৭/১৪৯)।
সারকথা :
আল্লাহর ভয়ে ভীত ও পরিচ্ছন্ন অন্তরে আল্লাহর নূর প্রক্ষিপ্ত হয়। রামাযানের মাসব্যাপী সাধনা শেষে তাই ক্বদর রজনীতে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। এ রাতের অপরিমেয় ফযীলত ও বরকত লাভের আশায় শেষ দশকে সাধ্যমত চেষ্টা করতে হয়। যাতে মুমিনের অন্তরজগত পরিশুদ্ধ হয় এবং তা আল্লাহর নূর ও হেদায়াত লাভের যোগ্য হয়।
No comments