১০৩. সূরা আছর -এর তাফসীর
সূরা আছর
(কাল)
সূরা শারহ-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ১০৩, আয়াত ৩, শব্দ ১৪, বর্ণ ৭০।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
(১) কালের শপথ! | وَالْعَصْرِ |
(২) নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। | إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ |
(৩) তারা ব্যতীত যারা (জেনে-বুঝে) ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে এবং পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্য্যের উপদেশ দিয়েছে। | إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ |
বিষয়বস্ত্ত :
কালের শপথ করে বলা হয়েছে যে, সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, চারটি গুণবিশিষ্ট মানুষ ব্যতীত (১-৩ আয়াত)। যা হ’ল, ঈমান, আমল, দাওয়াত ও ছবর।[1]
গুরুত্ব :
(১) হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাফ্ছ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে এমন দু’জন ছাহাবী ছিলেন, যারা মিলিত হ’লে একে অপরকে সূরা আছর না শুনিয়ে পৃথক হ’তেন না।[2]
(২) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস আশ-শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ) বলেন, لَوْ تَدَبَّرَ النَّاسُ هَذِهِ السُّوْرَةَ لَوَسِعَتْهُمْ- ‘যদি মানুষ এই সূরাটি গবেষণা করত, তাহ’লে এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট হ’ত’ (ইবনু কাছীর)।
(৩) জীবনীকারগণ বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আমর ইবনুল আছ (রাঃ) মুসলমান হওয়ার পূর্বে একবার ভন্ডনবী মুসায়লামা কাযযাবের কাছে গিয়েছিলেন। তখন মুসায়লামা তাকে বলেন, তোমাদের নবীর উপর সম্প্রতি কি নাযিল হয়েছে? তিনি বললেন, তাঁর উপরে অতি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ (وجيزة بليغة) একটি সূরা নাযিল হয়েছে। মুসায়লামা কাযযাব বলল, সেটা কি? তখন আমর ইবনুল আছ তাকে সূরা আছর শুনিয়ে দিলেন।
অতঃপর ভন্ডনবী কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, আমার উপরেও অনুরূপ একটা সূরা নাযিল হয়েছে। আমর ইবনুল আছ বললেন, সেটা কি? তখন মুসায়লামা বলল, يَا وَبْرُ يَا وَبْرُ، إِنَّمَا أَنْتَ أُذْنَانِ وَصَدْر، وَسَائِرُكَ حَقْر و فَقْرُ– ‘হে ওয়াব্র হে ওয়াব্র (বিড়াল জাতীয় ছোট প্রাণী)! তোমার আছে কেবল দু’টি বড় কান ও সীনা। আর তোমার বাকী সবই ফালতু’। অতঃপর মুসায়লামা জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগল? জবাবে আমর ইবনুল আছ বললেন, وَاللهِ إِنَّكَ لَتَعْلَمُ أَنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ تَكْذِبُ ‘আল্লাহর কসম! তুমি ভালভাবেই জানো যে, আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ’ (ইবনু কাছীর)।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উভয়ে কুফরী অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও কুরআনী সত্যকে আমর ইবনুল আছ দ্বিধাহীনচিত্তে স্বীকার করেন। এই সত্যপ্রিয়তাই তাঁকে পরে ইসলামের পথে উদ্বুদ্ধ করে এবং তিনি ও খালেদ ইবনু ওয়ালীদ এবং কা‘বা গৃহের চাবি রক্ষক ওছমান বিন তালহা ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৩৪৭)। বস্ত্ততঃ বড় হৌক বা ছোট হৌক কুরআনের প্রতিটি সূরা, আয়াত ও বর্ণই হতবুদ্ধিকর (مُعْجِزٌ)। যার মুকাবিলা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
তাফসীর :
(১) وَالْعَصْرِ ‘কালের শপথ’।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, العصر أى الدهر ‘আছর’ অর্থ ‘কাল’ (কুরতুবী)। ওয়াও (واو) হ’ল শপথের অব্যয়। অর্থাৎ কালের শপথ। যার মধ্যে আদম সন্তানের ভাল-মন্দ সকল কাজ সম্পাদিত হয় (ইবনু কাছীর)। তাছাড়া কালের মধ্যে বিস্ময়কর ঘটনা সমূহ ঘটার কারণে একে ‘বিস্ময়ের কেন্দ্র’ (ابو العجب) বলা হয় (ক্বাসেমী)।
কালের শপথ আল্লাহ সম্ভবতঃ এজন্য করেছেন যে, বান্দা ভাল-মন্দ যে কাজই করুক না কেন তা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিনকালের মধ্যেই তাকে করতে হয়। এর বাইরে গিয়ে সে কিছুই করতে পারে না। অতএব তাকে সবসময় আল্লাহর দৃষ্টির সামনেই থাকতে হয়। কেননা বান্দার হিসাবে কাল তিনটি হ’লেও আল্লাহর নিকটে সবই বর্তমান কাল।
দ্বিতীয় কারণ এটা হ’তে পারে যে, সামনে যে কথা বলা হবে মহাকাল তার সাক্ষী। বর্তমানের অবিশ্বাসীরা বিগত যুগের অবিশ্বাসী ও অহংকারীদের পতন ও ধ্বংসের কারণ সন্ধান করলে তার প্রমাণ পাবে। বিগত যুগে নূহের কওম, আদ, ছামূদ, লূত, শু‘আয়েব, ফেরাঊন প্রমুখ বিশ্বের সেরা শক্তিশালী সম্প্রদায়গুলি আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে কেবল বর্ণিত চারটি গুণ তাদের মধ্যে না থাকার কারণে। যেকোন জ্ঞানী ও চক্ষুষ্মান ব্যক্তি তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
তৃতীয় কারণ আছরের ওয়াক্ত হ’তে পারে। কেননা সাধারণতঃ এই সময় কুরায়েশ নেতারা ‘দারুন নাদওয়াতে’ পরামর্শসভায় বসত এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে ভাল-মন্দ সিদ্ধান্ত নিত। মন্দ সিদ্ধান্তের কারণে লোকেরা এই সময়টাকে ‘মন্দ সময়’ (زمان سوء) বলত’ (ক্বাসেমী)। এখানে আছর-এর শপথ করে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, কালের কোন দোষ নেই। দোষী হ’ল মানুষ।
শায়েখ তানতাভী জাওহারী বলেন, পবিত্র কুরআনে ৪০টি বিষয়ের শপথ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ২০টি ভূমন্ডলীয় ও ২০টি নভোমন্ডলীয়। ভূমন্ডলীয় ২০টি হ’ল যেমন, ঝঞ্ঝাবায়ু (وَالذَّارِيَاتِ ذَرْوًا) , মেঘ বহনকারী বায়ু (فَالْحَامِلاَتِ وِقْرًا) , পৃথিবী ও তার বিস্তৃতি (وَالْأَرْضِ وَمَا طَحَاهَا) , তীন (وَالتِّيْنِ) , যায়তূন (وَالزَّيْتُوْنِ) , তূর পাহাড় (وَطُورِ سِيْنِيْنَ) , মক্কা নগরী (لاَ أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ) , ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান অশ্ব (وَالْعَادِيَاتِ ضَبْحًا) , সাক্ষ্যদাতা (وَشَاهِدٍ) , উপস্থিতগণ (وَمَشْهُوْدٍ) , ক্বিয়ামতের দিন (لاَ أُقْسِمُ بِيَوْمِ الْقِيَامَةِ) , জোড় (وَالشَّفْعِ) , বেজোড় (وَالْوَتْرِ) , উত্তাল সমুদ্র وَالْبَحْرِ الْمَسْجُورِ) ), নর ও মাদী সকল সৃষ্টি (وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى) , দৃশ্যমান ও অদৃশ্য (مَا تُبْصِرُونَ وَمَا لاَ تُبْصِرُوْنَ) , পিতা ও সন্তান (وَوَالِدٍ وَمَا وَلَدَ) , প্রাণ ও তার বিন্যস্তকরণ (وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا)।
অতঃপর নভোমন্ডলীয় ২০টি হ’ল : ফজর (وَالْفَجْرِ) , দশ রাত্রি (وَلَيَالٍ عَشْرٍ) , লুকোচুরি নক্ষত্ররাজি (بِالْخُنَّسِ) , প্রভাতকাল (وَالصُّبْحِ) , পূর্বাহ্ন (وَالضُّحَى) , সূর্য وَالشَّمْسِ) ), চন্দ্র (وَالْقَمَرِ) , নক্ষত্র (وَالنَّجْمِ) , দিবস (وَالنَّهَارِ) , রাত্রি (وَاللَّيْلِ) , নক্ষত্রসমূহের অস্তাচল (مَوَاقِعِ النُّجُومِ) , পূর্ব ও পশ্চিমের রব (رَبِّ الْمَشَارِقِ وَالْمَغَارِبِ) , সান্ধ্য-লালিমা (بالشَّفَقِ) , গ্রহ-নক্ষত্র শোভিত আকাশ (وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الْبُرُوجِ) , ফেরেশতাগণ যারা ডুব দিয়ে আত্মা উৎপাটন করে (وَالنَّازِعَاتِ غَرْقًا) , ফেরেশতাগণ যারা আত্মার বাঁধন খুলে দেয় মৃদুভাবে (وَالنَّاشِطَاتِ نَشْطًا) , ফেরেশতাগণ যারা অগ্রসর হয় দ্রুতগতিতে (فَالسَّابِقَاتِ سَبْقًا) , ফেরেশতাগণ যারা সন্তরণ করে দ্রুতগতিতে (وَالسَّابِحَاتِ سَبْحًا) , ফেরেশতাগণ যারা সকল কর্ম নির্বাহ করে فَالْمُدَبِّرَاتِ أَمْرًا) ), আছর (وَالْعَصْرِ)।[3]
উপরোক্ত চল্লিশটি সৃষ্ট বস্ত্তর শপথের মধ্যে আলোচ্য সূরা আছর অর্থাৎ কালের শপথ হ’ল কুরআনের তারতীব অনুযায়ী সর্বশেষ শপথ। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, পৃথিবীতে মনুষ্যজাতির আগমনের পর থেকে এযাবৎকাল সংঘটিত মানবেতিহাসের উত্থান-পতনের ঘটনাবলী আমাদের পরবর্তী বক্তব্যের জীবন্ত সাক্ষী। যুগে যুগে বিজ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ যা থেকে উপদেশ হাছিল করবেন।
খ্যাতনামা মুফাসসির ইমাম রাযী (৫৪৪-৬০৬ হি:) আছর-এর সঠিক তাৎপর্য কি হবে, সেবিষয়ে জনৈক বিগত মনীষীর (بعض السلف) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তিনি এটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক বরফ বিক্রেতার আওয়ায তাঁর কানে এল। সে চিৎকার দিয়ে ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে বলছে, اِرْحَمُوْا مَنْ يَّذُوْبُ رَأْسُ مَالِهِ ‘তোমরা রহম কর ঐ ব্যক্তির প্রতি, যার পুঁজি প্রতি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে’। একথা শুনেই তিনি বলে উঠলেন, هَذَا مَعْنَى سُوْرَةِ الْعَصْرِ… ‘এটাই তো সূরা আছরের তাৎপর্য। যার বয়স চলে যাচ্ছে। অথচ কোন সৎকর্ম করছে না। সে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত’ (তাফসীর রাযী)। বস্ত্ততঃ ‘কাল’ প্রতি সেকেন্ডে সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। অতএব প্রত্যেক মানুষকে তার সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালের মধ্যেই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। কেননা সে প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাযার মাইল (৩ লক্ষ কি: মি:) গতিবেগে তার মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। বরফ গলার ন্যায় প্রতি সেকেন্ডে তার আয়ু শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে কালের স্মৃতিপটে তার প্রতিটি কথা ও কর্ম লিপিবদ্ধ হচ্ছে। এ কারণেই আল্লাহ কালের শপথ করেছেন।
(২) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ ‘নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে’। অর্থাৎ পরিণতিতে তারা ক্ষতির মধ্যে আছে। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَذَاقَتْ وَبَالَ أَمْرِهَا وَكَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهَا خُسْرًا ‘অতঃপর তারা তাদের কৃতকর্মের আযাব আস্বাদন করল। বস্ত্ততঃ ক্ষতিই ছিল তাদের কর্মের পরিণতি’ (তালাক ৬৫/৯)। এটি হ’ল পূর্ববর্তী শপথের জওয়াব।
এখানে إِنَّ الْإِنْسَانَ لَخَاسِرٌ (নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত) না বলে لَفِيْ خُسْرٍ (অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে) বলার মাধ্যমে একথা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, إن الانسان منغمس فى الخسر من كل جانب ‘নিশ্চয়ই মানুষ চারদিক থেকে ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছে’। فِيْ এখানে ظرفية হয়েছে।
الْإِنْسَانَ -এর اَلْ অর্থ كُلٌّ ‘সকল মানুষ’। اَلْ দ্বারা جنس বা জাতি বুঝানো হয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষের স্বভাবগত ক্ষতিপ্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অতঃপর মানুষ যে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রতিনিয়ত ক্ষতির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে কথাটা জোরালোভাবে ব্যক্ত করার জন্য সূরার শুরুতে وَالْعَصْرِ -এর واو দ্বারা শপথ, অতঃপর অত্র বাক্যের শুরুতে إِنَّ এবং শেষে لَ (لَفِيْ خُسْرٍ ) সহ মোট তিনিট নিশ্চয়তাবোধক অব্যয় আনা হয়েছে। বিগত যুগের বিধ্বস্ত সভ্যতাসমূহ এবং বর্তমান যুগের ধর্মনিরেপক্ষ বস্ত্তবাদী সভ্যতাসমূহ যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে, এগুলি হ’ল আল্লাহর উপরোক্ত সাবধানবাণীর বাস্তব প্রমাণ।
পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানগর্বী রাষ্ট্রনেতাদের অমানবিক কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এন্থনী ইডেন ১৯৩৮ সালে বলেছিলেন, ‘যদি কিছু না করা হয়, তাহ’লে এই পৃথিবীর অধিবাসীরা এই শতাব্দীর শেষভাগে আদিম গুহাবাসী ও বন্য লোকদের জীবন ধারায় ফিরে যাবে। কী আশ্চর্য! পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো এমন এক অস্ত্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, যার ভয়ে সবাই ভীত। কিন্তু তা আয়ত্তে আনতে ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেউ রাযী নয়। কোন কোন সময় আমি বিস্ময়ের সাথে ভাবি, যদি অন্য কোন গ্রহ থেকে কোন পর্যটক আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহে নেমে আসেন, তাহ’লে তিনি পৃথিবীকে দেখে কি বলবেন? তিনি দেখবেন, আমরা সকলে মিলে আমাদেরই ধ্বংসের উপকরণ তৈরী করছি। এমনকি আমরা একে অপরকে তার ব্যবহার পদ্ধতিও বাৎলে দিচ্ছি’।[4]
মিঃ ইডেনের উক্ত সতর্কবাণীর মাত্র তিন বছর পরেই শুরু হয়ে যায় পাঁচ বছরব্যাপী ২য় বিশ্বযুদ্ধ। যাতে প্রায় ৩ কোটি মানুষ নিহত হয়। যে মারণাস্ত্রের বিষয়ে তিনি হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন, আমেরিকার সেই এটমবোমার আঘাতে ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট সকাল সোয়া আট ঘটিকায় জাপানের হিরোশিমা মহানগরীর ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চোখের পলকে দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় ২ লক্ষ ১০ হাযার থেকে ৪০ হাযার বনু আদম’।[5] এর তিনদিন পরে ৯ই আগষ্ট বুধবার দ্বিতীয় বোমাটি নিক্ষিপ্ত হয় জাপানের নাগাসাকি শহরে। যাতে মৃত্যুবরণ করে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। উভয় বোমার তেজষ্ক্রিয়তার ফলে ক্যান্সার ইত্যাদির মত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আজও সেখানকার মানুষ মরছে। বংশপরম্পরায় জাপানীরা বহন করে চলেছে এসব দুরারোগ্য ব্যাধি।[6]
সেদিনকার সেই ‘লিটলবয়’ নামক ছোট্ট এটমবোমার চাইতে অনেক বড় ও বহু শক্তিশালী আণবিক বোমা এখন পাশ্চাত্য দেশগুলির হাতে রয়েছে। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কিংবা স্রেফ আত্মরক্ষার দোহাই দিয়ে অন্যান্য দেশগুলি এখন আণবিক বোমা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমনকি ভারত, চীন ও পাকিস্তানের মত দরিদ্র রাষ্ট্রগুলি, যাদের জনগণ ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যা করছে, তারাও এখন আণবিক বোমার মালিক হয়েছে। অথচ এই বোমা নিক্ষেপ করলে কেবল শত্রুপক্ষই মরবে না, নিজেদের লোকেরাও তার তেজষ্ক্রিয়ায় ধ্বংস হবে। সব কিছু জেনেও নেতারা ছুটছেন ধ্বংসের পিছনে। চলছে বোমা মারা ও নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী ও পরীক্ষার প্রতিযোগিতা। ঠিক যেন আগুনে পুড়ে মরার জন্য পতংগ তার নিজের ধ্বংসের দিকে ছুটে চলেছে।
মানবদরদী রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাই উদাত্ত কণ্ঠ বলেছিলেন, أَنَا آخِذٌ بِحُجَزِكُمْ عَنِ النَّارِ هَلُمَّ عَنِ النَّارِ هَلُمَّ عَنِ النَّارِ فَتَغْلِبُونِى تَقَحَّمُونَ فِيهَا– ‘হে লোকসকল! জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য আমি তোমাদের কোমর ধরে আকর্ষণকারী। তোমরা জাহান্নাম থেকে আমার দিকে ফিরে এসো! তোমরা জাহান্নাম থেকে আমার দিকে ফিরে এসো! কিন্তু তোমরা আমাকে পরাস্ত করে জাহান্নামে ঢুকে পড়ছ’।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে শত্রুবাহিনী থেকে ভয় প্রদর্শনকারী নগ্ন সতর্ককারীর ন্যায় (وَإِنِّى أَنَا النَّذِيرُ الْعُرْيَانُ)। অতএব তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো! তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো’! (فَالنَّجَاءُ ثُمَّ النَّجَاءُ)।[8]কিন্তু এটাই বাস্তব সত্য যে, মানুষ জেনে-বুঝে নিজের ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। এজন্যই আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ ‘নিশ্চয় মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রযেছে’।
(৩) إِلاَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ‘তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে এবং পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে’।
অর্থাৎ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারে কেবল চারটি গুণবিশিষ্ট মানুষ। যার মধ্যে প্রথম দু’টি হ’ল ব্যক্তিগত ও পরের দু’টি হ’ল সমাজগত। প্রথম দু’টির প্রথমটি হ’ল ঈমান এবং দ্বিতীয়টি হ’ল আমল। এর দ্বারা মানুষের মধ্যে লুক্কায়িত জ্ঞানশক্তি ও কর্মশক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। জ্ঞান যদি তাওহীদ বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল হয়, তবে তার কর্ম হবে মঙ্গলময়। আর যদি তা না হয়, তবে তার কর্ম হবে অকল্যাণময়। মানুষের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনে এদু’য়ের ফলাফল সুস্পষ্ট। যে জাতি ইলমী ও আমলী শক্তিতে উন্নত, সে জাতিই পৃথিবীতে উন্নত হয়। মুসলমানদের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস তার বাস্তব সাক্ষী। অতএব ক্ষতি থেকে বাঁচতে হ’লে মানুষকে নিম্নোক্ত চারটি গুণ অর্জন করতে হবে-
(১) ঈমান (الإيمان بالله) : পৃথিবীতে মানুষে মানুষে পার্থক্যের মানদন্ড হ’ল ঈমান। যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে সফলকাম। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহতে অবিশ্বাসী, তারা ইহকাল ও পরকালে ব্যর্থকাম। ঈমানদারের সকল কাজ হয় আখেরাতমুখী। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের সকল কাজ হয় প্রবৃত্তিমুখী। দু’জনের জীবনধারা হয় সম্পূর্ণ পৃথক। আল্লাহ বলেন, وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلاَّ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ فَمَنْ آمَنَ وَأَصْلَحَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ – وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا يَمَسُّهُمُ الْعَذَابُ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ ‘আমরা রাসূলদের পাঠিয়ে থাকি এজন্য যে, তারা মানুষকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করবে। এক্ষণে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও নিজেকে সংশোধন করে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা কোনরূপ চিন্তান্বিত হবে না’। ‘পক্ষান্তরে যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, তাদের পাপাচারের কারণে তাদের উপর শাস্তি আপতিত হবে’ (আন‘আম ৬/৪৮-৪৯)।
الإيمان من الأمن ضد الخوف والشك ঈমান অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, যা ভীতি ও সন্দেহের বিপরীত। সন্তান যেমন পিতা-মাতার কোলে নিশ্চিন্ত হয়, মুমিন তেমনি আল্লাহর উপরে ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়।
মুমিনের বিশ্বাসের ভিত্তি হ’ল ছয়টি : أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ (১) আল্লাহর উপরে বিশ্বাস, (২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপর বিশ্বাস, (৩) তাঁর প্রেরিত কিতাব সমূহের উপর বিশ্বাস, (৪) তাঁর প্রেরিত রাসূলগণের উপর বিশ্বাস, (৫) বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস এবং (৬) আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস। যা হাদীছে জিব্রীলে বর্ণিত হয়েছে।[9] যাকে ঈমানে মুফাছছাল বলা হয়। অতঃপর মুমিনের বিশ্বাসের সারকথা বা ঈমানে মুজমাল হ’ল, آمَنْتُ بِاللهِ كَمَا هُوَ بِأَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ وَقَبِلْتُ جَمِيْعَ أَحْكَامِهِ وَأَرْكَانِهِ আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম আল্লাহর উপরে যেমন তিনি, তাঁর যাবতীয় নাম ও গুণাবলী সহকারে এবং আমি কবুল করলাম তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও ফরয-ওয়াজিব সমূহকে’। অতঃপর ঈমানের সংজ্ঞা হ’ল,اَلتَّصْدِيْقُ بِالْجِنَانِ وَالْإِقْرَارُ بِالْلِسَانِ وَالْعَمَلُ بِالْأَرْكَانِ يَزِيْدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَةِ، اَلْإِيْمَانُ هُوَ الْاَصْلُ وَالْعَمَلُ هُوَ الْفَرْعُ- ‘হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের নাম হ’ল ঈমান, যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং গোনাহে হরাসপ্রাপ্ত হয়। ঈমান হ’ল মূল এবং আমল হ’ল শাখা’। যা না থাকলে পূর্ণ মুমিন বা ইনসানে কামেল হওয়া যায় না। অতএব জনগণের ঈমান যাতে সর্বদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, পরিবার, সমাজ ও সরকারকে সর্বদা সেই পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। নইলে ঈমান হরাসপ্রাপ্ত হ’লে সমাজ অকল্যাণে ভরে যাবে।
উল্লেখ্য যে, খারেজীগণ বিশ্বাস, স্বীকৃতি ও কর্ম তিনটিকেই ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। ফলে তাদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তাদের রক্ত হালাল’। যুগে যুগে সকল চরমপন্থী ভ্রান্ত মুসলমান এই মতের অনুসারী। পক্ষান্তরে মুরজিয়াগণ কেবল বিশ্বাস অথবা স্বীকৃতিকে ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। যার কোন হরাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের মতে আমল ঈমানের অংশ নয়। ফলে তাদের নিকট কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন। আবুবকর (রাঃ) ও অন্যদের ঈমান সমান’। আমলের ব্যাপারে সকল যুগের শৈথিল্যবাদী ভ্রান্ত মুসলমানরা এই মতের অনুসারী।
খারেজী ও মুরজিয়া দুই চরমপন্থী ও শৈথিল্যবাদী মতবাদের মধ্যবর্তী হ’ল আহলেহাদীছের ঈমান। যাদের নিকট বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা। অতএব কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের নিকট কাফের নয় কিংবা পূর্ণ মুমিন নয়, বরং ফাসেক। সে তওবা না করে মারা গেলেও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে।
ঈমানের ব্যাপারে মানুষ তিনভাগে বিভক্ত। (১) খালেছ বিশ্বাসী মুমিন (২) অবিশ্বাসী কাফের (৩) দোদুল্যমান কপট বিশ্বাসী। এদের মধ্যে জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে কেবলমাত্র প্রথম দল। শেষোক্ত দু’টি দল চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।
বস্ত্ততঃ প্রত্যেক মুসলমানকে সর্বাগ্রে ঈমান সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইমাম বুখারী (রহঃ) ছহীহ বুখারীতে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, باب العلم قبل القول والعمل ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান অর্জন’। তিনি দলীল এনেছেন আল্লাহর নির্দেশ থেকে فَاعْلَمْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ- ‘তুমি জ্ঞান অর্জন কর এ বিষয়ে যে, কোন উপাস্য নেই আল্লাহ ব্যতীত এবং তোমার গোনাহের জন্য ক্ষমা চাও’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। এখানে কথা ও কাজের পূর্বেই ইল্মের কথা বলা হয়েছে।
অতএব আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত ‘ঈমান এনেছে’ অর্থ ‘জেনে-বুঝে ঈমান এনেছে’। মনে রাখা আবশ্যক যে, পৃথিবীতে এইরূপ একজন ঈমানদার বেঁচে থাকতে ক্বিয়ামত হবে না। আল্লাহর নিকটে পৃথিবীর সকল মানুষের চাইতে একজন তাওহীদবাদী প্রকৃত মুমিনের গুরুত্ব অনেক বেশী। কেবল তার জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُقَالَ فِى الأَرْضِ اللهُ اللهُ ‘অতদিন পর্যন্ত ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে আল্লাহ আল্লাহ বলার মত একজন লোক বেঁচে থাকবে’।[10] অন্য বর্ণনায় এসেছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার মত লোক থাকবে’।[11] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ, তাওহীদের স্বীকৃতি দানকারী। এর অর্থ ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ যিকর করা নয়। যেমন কিছু ছূফীবাদী লোক ধারণা করে থাকে। কেননা এটি একটি বিদ‘আতী যিকর, শরী‘আতে যার কোন ভিত্তি নেই। যদি সকল মুসলমান এই ধরনের যিকর পরিত্যাগ করে, তথাপি ক্বিয়ামত হবে না যদি নাকি তারা তাওহীদপন্থী থাকে’ (মিশকাত ৫৫১৬ নং হাদীছের টীকা দ্রঃ)।
(২) সৎকর্ম (العمل الصالح) : আল্লাহ বলেন, أَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلاً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘আর যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ তাদের আপ্যায়নের জন্য জান্নাত হবে তাদের বাসস্থান’ (সাজদাহ ৩২/১৯)। তিনি বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ، جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা’। ‘তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার পালনকর্তাকে ভয় করে’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৭-৮)।
শরী‘আত অনুমোদিত নেক আমলকেই ‘সৎকর্ম’ বলা হয়। যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার, মানুষের প্রতি দয়া, ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি সম্মান ইত্যাদি। কোন কাজ ‘সৎকর্ম’ হিসাবে গণ্য হবার জন্য শর্ত হ’ল তিনটি : (১) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী হওয়া (২) কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের বুঝ অনুযায়ী হওয়া। (৩) বিদ‘আত মুক্ত হওয়া। বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে যা দ্বীন বলে গৃহীত ছিল, সেটাই মাত্র দ্বীন। পরবর্তীকালে ধর্মের নামে আবিষ্কৃত কোন রীতি-নীতিকে দ্বীন বলা হবে না। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে। তাতে কম-বেশী করার এখতিয়ার কারু নেই। আল্লাহ বলেন, وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُبِيْنًا ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে সে ব্যাপারে মুমিন পুরুষ ও নারীর নিজস্ব কোন এখতিয়ার থাকবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)। তিনি আরও বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘যারা রাসূলের নির্দেশের বিরোধিতা করে তারা এব্যাপারে সতর্ক হৌক যে, তাদের গ্রেফতার করবে (দুনিয়াতে) বিভিন্ন ফিৎনা-ফাসাদ অথবা (পরকালে) মর্মান্তিক আযাব’ (নূর ২৪/৬৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে নতুন কিছু সৃষ্টি করল, যা তাতে নেই, তা প্রত্যাখ্যত’।[12] তিনি বলেন, مُحَمَّدٌ فَرَقٌ بَيْنَ النَّاسِ ‘মুহাম্মাদ হ’লেন মানুষের মাঝে সত্য ও মিথ্যার মানদন্ড’।[13] ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন,إِنَّ كُلَّ مالم يَكُنْ على عهد رسولِ اللهِ صلي الله عليه وسلم وأصحابِه دِينًا لم يَكُنِ اليومَ دينًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের সময়ে যেসব বিষয় ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত ছিল না, বর্তমানকালেও তা ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত হবে না (আল-ইনছাফ, পৃঃ ৩২)।
অতঃপর আমল কবুল হওয়ার শর্ত হ’ল তিনটি : (১) আক্বীদা বিশুদ্ধ (عقيدة صحيحة) হওয়া (২) তরীকা সঠিক (طريقة صحيحة) হওয়া এবং (৩) ইখলাছে আমল (إخلاص عمل)। অর্থাৎ কাজটি নিঃস্বার্থভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে হওয়া (যুমার ৩৯/২)। মোটকথা শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস, ছহীহ সুন্নাহর অনুসরণ এবং শ্রুতি ও প্রদর্শনীমুক্ত ইখলাছ, এই তিনটির সমন্বয় ব্যতীত আল্লাহর নিকটে বান্দার কোন সৎকর্মই কবুল হবে না এবং তাতে কোন ছওয়াবও সে পাবে না।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا لَبِسَتْكُمْ فِتْنَةٌ يَهْرَمُ فِيهَا الْكَبِيرُ وَيَرْبُو فِيهَا الصَّغِيرُ ، يَجْرِي عَلَيْهَا النَّاسُ يَتَّخِذُونَهَا سُنَّةً ، قَالُوا : وَمَتَى ذَاكَ؟ قَالَ : إِذَا ذَهَبَتْ عُلَمَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ جُهَلاَؤُكُمْ ، وَكَثُرَتْ قُرَّاؤُكُمْ وَقَلَّتْ فُقَهَاؤُكُمْ ، وَكَثُرَتْ أُمَرَاؤُكُمْ وَقَلَّتْ أُمَنَاؤُكُمْ ، وَالْتُمِسَتِ الدُّنْيَا بِعَمَلِ الآخِرَةِ وَتُفُقِّهَ لِغَيْرِ الدِّينِ–
‘তোমাদের অবস্থা তখন কেমন হবে যখন ফিৎনা (বিদ‘আত) তোমাদেরকে এমনভাবে ঘিরে নিবে যে, এই ফিৎনার মধ্যেই তোমাদের বড়রা বৃদ্ধ হবে এবং ছোটরা বড় হবে। মানুষ বিদ‘আতের উপরেই চলতে থাকবে। এমতাবস্থায় তারা সেটাকেই ‘সুন্নাত’ হিসাবে গ্রহণ করবে। লোকেরা বলল, এটা কখন হবে? তিনি বললেন, (ক) যখন তোমাদের আলেমগণ মৃত্যুবরণ করবেন ও মূর্খদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। (খ) যখন সাধারণ আলেমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু জ্ঞানী আলেমের সংখ্যা কমে যাবে। (গ) যখন নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু আমানতদারের সংখ্যা কমে যাবে। (ঘ) যখন আখেরাতের কাজের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া তালাশ করবে এবং দ্বীন ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জন করবে’।[14]
আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً- الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ‘তুমি বলে দাও, আমরা কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব?’ ‘পার্থিব জীবনে যাদের সকল প্রচেষ্টা বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ধারণা করেছে যে, তারা সৎকর্ম করেছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)।
(৩) দাওয়াত (الدعوة الى الله) : আয়াতে বর্ণিত দু’টি সমাজগত গুণের প্রথমটি হ’ল ‘পরস্পরকে হক-এর উপদেশ দেওয়া’ (وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ)। এটি হ’তে হবে আল্লাহর পথে পরকালীন স্বার্থে এবং আল্লাহ প্রেরিত হক-এর দিকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِّمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صالِحاً ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা কার আছে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে… (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৩)। আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلاَ تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে মানুষকে আহবান কর এবং অবশ্যই তুমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الدِّينُ النَّصِيحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’।[15] প্রত্যেক মুমিন পরস্পরকে হক-এর উপদেশ দিবে। যেমন কাউকে শিরক কিংবা বিদ‘আত করতে দেখলে বা কোন ফরয কাজে গাফলতি দেখলে তাকে বলবে, হে ভাই! শিরক বর্জন কর। ফরয কাজটি আগে সম্পন্ন কর। অনুরূপভাবে কাউকে কোন অন্যায় করতে দেখলে বলবে, হে ভাই! আল্লাহকে ভয় কর! অন্যায় থেকে বিরত হও।
الحق هو الشرع ‘হক’ হ’ল আল্লাহর বিধান। আল্লাহ বলেন, وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا ‘আর তুমি বল, হক আসে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে। অতঃপর যার ইচ্ছা তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করুক, যার ইচ্ছা তাতে অবিশ্বাস করুক। আমরা সীমালংঘনকারীদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত করে রেখেছি…’ (কাহফ ১৮/২৯)।
মানুষের সীমিত জ্ঞান কখনো চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছতে পারে না। তাই তাকে অহি-র বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। যা আল্লাহর পক্ষ হ’তে নবীগণের মাধ্যমে নাযিল হয়। ইসলামী শরী‘আতে যা পূর্ণাঙ্গরূপ পরিগ্রহ করেছে। স্বার্থান্ধ ব্যক্তিরা যা পসন্দ করে না। তাই দুনিয়াবী জৌলুসে মোহমুগ্ধ এবং চটকদার যুক্তি ও সন্দেহবাদে আচ্ছন্ন ব্যক্তিদের ধিক্কার দিয়ে আল্লাহ বলেন, اَلْحَقُّ مِنْ رَّبِّكَ فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِيْنَ- ‘সত্য তোমার প্রভুর কাছ থেকে এসেছে। অতএব তুমি সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/১৪৭; আলে ইমরান ৩/৬০; ইউনুস ১০/৯৪)। তিনি বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقاً وَّعَدْلاً لاَ مُبَدِّلِ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- ‘তোমার প্রভুর বাক্য সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর বাক্যের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১১৫)।
সংখ্যা কখনোই সত্যের মাপকাঠি নয়। সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে পরের আয়াতেই আল্লাহ বলেন,وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَن سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ- ‘আর যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ হ’তে বিপদগামী করে দেবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমানভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।
রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে মানবজাতির কাছে দু’টি আমানত রেখে গেছেন। তিনি বলেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا مَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ– ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দু’টি বস্ত্তকে শক্তভাবে অাঁকড়ে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’।[16]
অতএব ‘হক’-এর ব্যাখ্যা রাসূল (ছাঃ) নিজেই দিয়ে গেছেন এবং নিজের নবুঅতী জীবনে সেই হক-এর প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দান করে গেছেন। যদি বিশ্বকে অন্যায়-অনাচার ও অশান্তির দাবানল থেকে বাঁচাতে হয়, তাহ’লে পরস্পরকে আল্লাহ প্রেরিত ‘হক’ তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরার উপদেশ দিতে হবে, অন্য কিছুকে নয় বা তাতে কোনরূপ যোগ-বিয়োগ নয়।
দাওয়াতের ফযীলত : মানুষের নিকট হক-এর এই দাওয়াত দেওয়া ফরয। রাসূল (ছাঃ) এসেছিলেন ‘আল্লাহর পথের দাঈ’ হিসাবে (আহযাব ৩৩/৪৬)। তিনি বলেন, (১) بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً- ‘একটিমাত্র আয়াত হলেও তা আমার পক্ষ থেকে মানুষের নিকট পৌঁছে দাও…।’[17] (২) তিনি আরো বলেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ ‘কেউ যদি কোন নেক কাজের পথনির্দেশ দেয়, সে ঐ নেক কাজ সম্পাদনকারীর সমতুল্য ছওয়াব পায়’।[18]
(৩) রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَنْ يَّهْدِىَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُوْنَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ- ‘যদি তোমার দাওয়াতের মাধ্যমে একজন লোককেও আল্লাহ সুপথ প্রদর্শন করেন, তবে সেটা তোমার জন্য সর্বোত্তম লাল উট কুরবানীর চাইতে উত্তম হবে’।[19]
(৪) দাওয়াত এককভাবে বা সংঘবদ্ধভাবে দিতে হবে। আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, قُلْ هَذِهِ سَبِيْلِيْ أَدْعُوْا إِلَى اللهِ عَلى بَصِيْرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ وَسُبْحانَ اللهِ وَما أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ– ‘বল! এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে, জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।
(৫) দাওয়াত সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে দিতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوُا الْمُنْكَرَ فَلَمْ يُغَيِّرُوهُ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابِهِ ‘যখন মানুষ অন্যায়কর্ম হ’তে দেখে, অথচ তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে না। আল্লাহ সত্বর তাদের সকলের উপর তার বদলা নিবেন।’ তিনি বলেন, কোন সম্প্রদায়ে যখন পাপ ছড়িয়ে পড়বে এবং সেই সমাজে ভাল লোকের সংখ্যা বেশী হওয়া সত্ত্বেও তারা তা প্রতিরোধের কোন চেষ্টা নিবে না, তখন তাদের সকলের উপর আল্লাহ ব্যাপক গযব নামিয়ে দিবেন’।[20]
(৬) তিনি বলেন, مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا ‘যে ব্যক্তি কাউকে হেদায়াতের পথে ডাকে, তার জন্য সেই পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে, যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে। অথচ এটি তাদের ছওয়াব থেকে কোন অংশ কমাবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানুষকে ভ্রান্ত পথের দিকে ডাকে, তার জন্য সেই পরিমাণ গোনাহ রয়েছে, যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে। অথচ এটি তাদের গোনাহ থেকে কোন অংশ কমাবে না’।[21]
(৭) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) সফরে বের হয়েছেন। এমন সময় তাঁকে তাঁর ছোট ভাই কুছাম (মৃ: ৫৭ হিঃ) অথবা কন্যার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হ’ল। তিনি ইন্না লিল্লাহ পাঠ করলেন এবং বললেন, আল্লাহ লজ্জা নিবারণ করেছেন। খাদ্য ও পোষাক দান করেছেন। ছওয়াবও আল্লাহ দিবেন। অতঃপর রাস্তার একপাশে গিয়ে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন এবং অনেকক্ষণ বসে রইলেন। অতঃপর সওয়ারীর দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় সূরা বাক্বারাহ ৪৫ আয়াতটি পাঠ করলেন। যার অর্থ ‘তোমরা ছবর ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর’ (ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর; বাক্বারাহ ২/৪৫)। এই ঘটনার মধ্যে আল্লাহর পথে দাওয়াতের ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরামের গভীর নিষ্ঠা ও নিঃস্বার্থ আন্তরিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্ত্ততঃ দাওয়াতের মাধ্যমেই দ্বীন বেঁচে থাকে।
(৮) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার অথবা সপ্তাহে বেশীর বেশী দুই বা তিনদিন মানুষকে ডেকে মজলিস করে দাওয়াত দিতে বলতেন।[22] অনুরূপভাবে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) প্রতি বৃহস্পতিবারে দাওয়াত দিতেন।[23]
(৪) ছবর (الصبر) : সমাজগত গুণের দ্বিতীয়টি হ’ল, ‘পরস্পরকে ছবরের উপদেশ দেওয়া’ (وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ)। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘ধৈর্য্যশীল বান্দাদের বেহিসাব পুরস্কার দান করা হবে’ (যুমার ৩৯/১০)।
‘ছবর’ অর্থ حبس النفس عما لا ينبغى فعله ‘যে কাজ করা উচিৎ নয়, সে কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা’। যেমন কোন রোগ-পীড়া বা বিপদাপদ হ’লে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া, হে ভাই! ছবর কর। এটি তাক্বদীর, যা পূর্বেই লিপিবদ্ধ ছিল। দিশেহারা হয়ো না। আল্লাহর নিকটে এর উত্তম বদলা প্রার্থনা কর। যেমন মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের সান্ত্বনা দিয়ে রাসূল (ছাঃ) নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়তে বলেন, اَللَّهُمَّ أَجِرْنِي فِيْ مُصِيْبَتِيْ وَأَخْلِفْ لِيْ خَيْرًا مِّنْهَا ‘হে আল্লাহ! আমাকে বিপদে ধৈর্য ধারণের পারিতোষিক দান কর এবং আমাকে এর উত্তম প্রতিদান দাও’।[24] এমনিভাবে ছালাতে জামা‘আত থেকে গাফেল ব্যক্তিকে জামা‘আতে উদ্বুদ্ধ করা, কৃপণ ব্যক্তিকে দানে উদ্বুদ্ধ করা, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে নাজী ফের্কাভুক্ত হবার ও সেকারণে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের উপদেশ দেওয়া, হারামে লিপ্ত ব্যক্তিকে হারাম থেকে বাধা দেওয়া ও হালাল-এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাদি।
বস্ত্ততঃ হক-এর উপদেশ দিলে বা হক-এর পথে দাওয়াত দিলে বাতিল ক্ষেপে যাবে। তারা হকপন্থীদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টা করবে। তাদের উপরে নানাবিধ অত্যাচার চালাবে। এমতাবস্থায় হকপন্থী ব্যক্তিকে হক-এর উপরে দৃঢ় থেকে উপদেশ দান করতে হবে। কোন অবস্থাতেই হক থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না বা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বাতিলের সঙ্গে আপোষ করা যাবে না।
হক-এর অনুসারী হওয়ার অপরাধে বাতিলের পূজারী আবু জাহলদের অত্যাচারে নিগৃহীত বেলাল, খাববাব, খোবায়েব, আছেম, ইয়াসির পরিবার প্রমুখ সত্যসেবীগণ ছবর ও দৃঢ়তার যে অতুল্য নমুনা রেখে গেছেন, যুগে যুগে তা সকল হকপন্থীর জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে। ইয়াসির পরিবারের উপরে অমানুষিক নির্যাতনের মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ব্যথাহত রাসূল (ছাঃ) সেদিন তাদের সান্ত্বনা দিয়ে ছোট্ট একটি বাক্য উচ্চারণ করে বলেছিলেন, صَبْرًا يَا آلَ يَاسِرْ فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ ‘ছবর কর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’।[25] তপ্ত মরুর বুকে নির্যাতিত ইয়াসির পরিবারের ব্যথিত হৃদয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর এই সান্ত্বনাবাক্য সেদিন যে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিয়েছিল, আজও তা হ’তে পারে যেকোন হকপন্থীর জন্য শক্তির আবেহায়াত। তবে এই ছবর সর্বাবস্থায় নয়। বরং শক্তি থাকলে যালেমের যুলুম প্রতিরোধ করতে হবে এবং এজন্য সাধ্যমত শক্তি অর্জনের নির্দেশ এসেছে রাসূল (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনে (আনফাল ৮/৬০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيْفِ ‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট উত্তম ও অধিক প্রিয় দুর্বল মুমিনের চাইতে’।[26]
‘ছবর’ তিন প্রকার : (১) বিপদে ছবর করা (الصبر فى المصيبة) (২) পাপ থেকে ছবর করা অর্থাৎ বিরত থাকা (الصبر عن المعصية) (৩) আল্লাহর আনুগত্যে ছবর করা অর্থাৎ দৃঢ় থাকা (الصبر على الطاعة)। প্রথমটি ‘আম’ বা সাধারণ। দ্বিতীয়টি ‘হাসান’ বা সুন্দর এবং তৃতীয়টি ‘আহসান’ বা সবচেয়ে সুন্দর। যদি নাকি সবগুলি কেবল আল্লাহর ওয়াস্তে হয়। আল্লাহ যেন আমাদেরকে সত্যের পথে উক্ত তিন প্রকার ছবর এখতিয়ার করার তাওফীক দান করেন- আমীন!
ছবরের ফযীলত :
(১) আল্লাহ বলেন, وَجَزَاهُمْ بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً وَحَرِيْرًا- مُتَّكِئِيْنَ فِيْهَا عَلَى الْأَرَائِكِ لاَ يَرَوْنَ فِيْهَا شَمْسًا وَلاَ زَمْهَرِيْرًا ‘আর তাদের ছবরের পুরস্কার স্বরূপ তিনি তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী পোষাক দান করবেন’। ‘তারা সেখানে সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে তারা অতিশয় গরম বা অতিশয় শীত কোনটাই দেখবে না’ (দাহর ৭৬/১২-১৩)।
(২) তিনি বলেন, وَبَشِّرِ الصَّابِرِيْنَ- الَّذِيْنَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ ‘তুমি ধৈর্য্যশীলদের সুসংবাদ দাও’। ‘যাদের উপর কোন বিপদ আসলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫-৫৬)।
(৩) ছুহায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ‘মুমিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর। তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণময়। মুমিন ব্যতীত আর কারু জন্য এরূপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে শুকরিয়া আদায় করে। আর এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ছবর করে। আর এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়’।[27]
(৪) আল্লাহ বলেন, أُولَئِكَ يُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوا وَيُلَقَّوْنَ فِيهَا تَحِيَّةً وَسَلاَمًا ، خَالِدِينَ فِيهَا حَسُنَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا ‘তাদেরকে প্রতিদানস্বরূপ দেওয়া হবে জান্নাতের সর্বোচ্চ কক্ষ এজন্য যে, তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা দেওয়া হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে’। ‘সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আশ্রয়স্থল ও আবাসস্থল হিসাবে কতইনা উৎকৃষ্ট সেটি! (ফুরক্বান ২৫/৭৫-৭৬)।
(৫) আল্লাহ সর্বদা ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন। যেমন তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ছবর ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩)। আর এটাই হ’ল সবচেয়ে বড় কথা। আল্লাহ আমাদের ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!
সর্বোত্তম জাতির বৈশিষ্ট্য :
অত্র সূরায় বর্ণিত চারটি গুণের মধ্যে শেষোক্ত দু’টি গুণ হ’ল মুসলমানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেটি আল্লাহ অন্যত্র ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকার’ বলে অভিহিত করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ- ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে এ জন্যে যে, তোমরা মানুষকে ন্যায়ের আদেশ দিবে ও অন্যায়ের নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)।
মূলতঃ এ কাজটিই হ’ল সর্বোত্তম জাতি হওয়ার মাপকাঠি। সৎকাজের আদেশ বা উপদেশ দেওয়া তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ হ’লেও অসৎকাজে নিষেধ ও বাধা দানের কাজটা সর্বদা কঠিন। আর সেজন্যেই সেখানে ছবরের কথা এসেছে। মুসলমানকে তার চিন্তায়-চেতনায়, কথায়-কর্মে, ব্যবহারে-আচরণে সর্বদা সর্বাবস্থায় ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ-এর মূলনীতি অনুসরণ করে চলতে হবে। তবেই সমাজ পরিশুদ্ধ হবে। দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা আসবে।
অবশ্য সবকিছুর মূলে হ’ল ঈমান। ঈমানে যদি ভেজাল বা দুর্বলতা বা কপটতা থাকে, তাহ’লে বাকী তিনটিতে তার প্রভাব পড়বেই। ঈমান হ’ল বীজ ও বাকীগুলি হ’ল ফলের মত। তাই ঈমান যত সঠিক, সুদৃঢ় ও সুন্দর হবে, আমল তত নিখুঁৎ, নির্ভেজাল ও স্বচ্ছ হবে। তার পরকাল আরও সুন্দর হবে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তোমার পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও -আমীন!
আরেকটি যরূরী বিষয় এই যে, আল্লাহ এখানে أُوْصُوا ‘তোমরা উপদেশ দাও’ না বলে تَوَاصَوا ‘তোমরা পরস্পরকে উপদেশ দাও’ বলেছেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, এটি প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। তাই এটা স্পষ্ট যে, সূরা আছরের একটি বড় শিক্ষা হ’ল, মুক্তির জন্য কেবল নিজের কর্ম সংশোধিত হওয়াই যথেষ্ট নয়, অপরের কর্ম সংশোধনের চেষ্টা করাও অবশ্য কর্তব্য। নইলে ক্ষতি থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কেননা সমাজকে নিয়েই মানুষ। সমাজ অশুদ্ধ হয়ে গেলে ব্যক্তি একাকী শুদ্ধ থাকতে পারে না।
সারকথা :
দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য চারটি গুণ অর্জন করা অপরিহার্য। ঈমান, আমল, দাওয়াত ও ছবর। যার কোন একটি গুণের কমতি থাকলে কেউ পূর্ণাঙ্গ মুমিন হ’তে পারবে না এবং ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।
[3]. তাফসীর তানতাভী, ২৫/২৬৫; তিনি ‘তূর পাহাড়’ এবং ‘জোড় ও বেজোড়’ উল্লেখ করেননি। এটা আমরা যোগ করলাম। এতদ্ব্যতীত তিনি الفلق লিখেছেন। অথচ এই শব্দে কোন শপথ নেই। সেখানে আমরা بِالْخُنَّسِ যোগ করলাম -লেখক।
No comments