রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ
পূর্বের অংশ পড়ুন: বদর যুদ্ধ, ক্বিবলা পরিবর্তন ও ঈদ-উল-ফিতরের উৎসব
(১ম হিজরীর রামাযান হ’তে ১১ হিজরীর ছফর পর্যন্ত)
১। সারিইয়াতু সীফিল বাহর (سرية سيف البحر) : মদীনায় হিজরতের ৭ মাসের মাথায় ১ম হিজরীর রামাযান মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নেতৃত্বে ৩০ জনের মুহাজির বাহিনী। প্রতিপক্ষে ছিল আবু জাহলের নেতৃত্বে ৩০০ জনের একটি সিরিয়া ফেরত বাণিজ্য কাফেলা। লোহিত সাগরের তীরবর্তী ‘ঈছ’ (العيص) নামক স্থানে মুখোমুখি হ’লেও যুদ্ধ হয়নি। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে সূরা হজ্জ ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয়।
২। সারিইয়াতু রাবেগ (سرية رابغ) : ১ম হিজরীর শাওয়াল মাসে। ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ ইবনুল মুত্ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৬০ জনের মুহাজির বাহিনী। প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ২০০ জনের বাণিজ্য কাফেলা। রাবেগ নামক স্থানে উভয় পক্ষের মুকাবিলায় কিছু তীর নিক্ষেপ ব্যতীত আর কিছু হয়নি। তবে মাক্কী বাহিনীতে লুকিয়ে থাকা দু’জন মুসলমান মিক্বদাদ বিন আমর বুহরানী এবং উৎবাহ বিন গাযওয়ান মাযেনী মুসলিম বাহিনীর সাথে এসে মিলিত হন।
৩। সারিইয়াতুল খাররার (سرية الخرار) : ১ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছের নেতৃত্বে জুহফার নিকটবর্তী খাররার নামক স্থানে ২০ জনের মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয়। কিন্তু কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা আগের দিন চলে যাওয়ায় সাক্ষাৎ মেলেনি।
৪। গাযওয়া ওয়াদ্দান (غزوة ودَّان) : ২য় হিজরীর ছফর মাসে (৬২৩ খৃঃ আগষ্ট মাস) রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে একটি কুরায়েশ কাফেলার বিরুদ্ধে পরিচালিত ৭০ জনের মুহাজির বাহিনী। যুদ্ধ হয়নি। তবে স্থানীয় বনু যামরাহ গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটাই ছিল রাসূলের জীবনে প্রথম যুদ্ধাভিযান। এই সফরে তিনি ১৫ দিন অতিবাহিত করেন। পতাকাবাহী ছিলেন হামযাহ (রাঃ)।
৫। গাযওয়া বুওয়াত্ব (غزوة بواط) : ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে রাসূলের নেতৃত্বে ২০০ জনের বাহিনী। প্রতিপক্ষে ছিল উমাইয়া বিন খালাফের নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি বাণিজ্য কাফেলা। যাতে ছিল ২৫০০ উট। সংঘর্ষ হয়নি।
৬। গাযওয়া সাফওয়ান (غزوة سفوان) : ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রাসূলের নেতৃত্বে ৭০ জনের দল। প্রতিপক্ষ মক্কার নেতা কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী পালিয়ে যায়। সে ছিল মদীনার উপকণ্ঠে প্রথম হামলাকারী এবং গবাদি-পশু লুটকারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই লুটেরাদের ধাওয়া করে বদরের উপকণ্ঠে সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত গমন করেন। এজন্য এই অভিযানকে গাযওয়া বদরে ঊলা বা প্রথম বদর যুদ্ধ বলা হয়।
৭। গাযওয়া যিল উশাইরাহ (غزوة ذي العشيرة) : ২য় হিজরীর জুমাদাল ঊলা ও আখেরাহ মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে রাসূলের নেতৃত্বে ১৫০/২০০ লোকের বাহিনী। সিরিয়া যাত্রী কুরায়েশ কাফেলা নাগালের বাইরে চলে যায়। এই কাফেলাটিকে মক্কায় ফেরার পথে আটকানোর জন্য রামাযানের ৮ অথবা ১২ তারিখে আল্লাহর রাসূল মদীনা থেকে বের হন, যা পরে বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে গণ্য হয়। এই অভিযানে বনু মুদলিজ ও তাদের মিত্র বনু যামরাহর সাথে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৮। সারিইয়াহ নাখলা (سرية نخلة) : ২য় হিজরীর রজব মাসে। আব্দুল্লাহ বিন জাহশের নেতৃত্বে মাত্র ১২ জনের একটি ছোট্ট দল। কুরায়েশ পক্ষের বাণিজ্য কাফেলার নেতা আমর ইবনুল হাযরামী নিহত ও ২ জন বন্দী হয়। এটাই ছিল ইসলামে প্রথম নিহত ও প্রথম দুই বন্দী। গনীমতের মালামাল সহ মদীনায় প্রত্যাবর্তন। কিন্তু হারাম মাসের শেষ দিন হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রক্তমূল্য দেন এবং বন্দীদের মুক্তি দেন। এ প্রসঙ্গে বাক্বারাহ ২১৭ আয়াত নাযিল হয়। যাতে বলা হয় যে, হারাম মাসে যুদ্ধ করা অন্যায়। তবে আল্লাহর পথে বাধা দান ও মসজিদুল হারামে যেতে বাধা দান এবং তার বাসিন্দাদের বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকটে তদপেক্ষা বড় অন্যায়। এই যুদ্ধে নিহতের বদলা নিতেই আবু জাহল বদরে এসেছিল। এই অভিযান শেষে শা‘বান মাসে মুসলমানদের উপরে জিহাদ ফরয হয় (বাক্বারাহ ২/১৯০-৯৩; মুহাম্মাদ ৪৭/৪-৭, ২০)।
৯। গাযওয়ায়ে বদর (غزوة بدر الكبرى) : ২য় হিজরীর ১৭ রামাযান মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১১ মার্চ শুক্রবার। রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের অপ্রস্ত্তত বাহিনী। কুরায়েশ পক্ষে আবু জাহলের নেতৃত্বে ১০০০ লোকের সুসজ্জিত বাহিনী। মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার সহ ১৪ জন শহীদ এবং কুরায়েশ পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। আবু জাহল সহ নিহতদের অধিকাংশ ছিল মক্কার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বদর যুদ্ধ উপলক্ষে সূরা আনফাল নাযিল হয়। যাতে গনীমতের বিধান বর্ণিত হয়।
১০। সারিইয়াহ ওমায়ের ইবনুল আদী আল-খুত্বামী (عمير بن العدي الخطمى) : ২য় হিজরীর রামাযান মাসে। একাকী স্বীয় সম্পর্কিত বোন আছমা (عصماء) বিনতে মারোয়ান খুত্বামিয়াকে হত্যা করেন। কেননা মহিলাটি সর্বদা তার গোত্রকে রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচনা দিত। ওমায়ের ছিলেন তার গোত্রের প্রধান এবং সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী। তার পিতা আদী বিন খারশাহ একজন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন।
১১। সারিইয়াহ সালেম বিন ওমায়ের আনছারী (سالم بن عمير) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে। একাকী জনৈক ইহুদী আবু ওকফা (ابوعكفه) -কে হত্যা করেন। কারণ সে সর্বদা অন্য ইহুদীদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উষ্কানী দিত।
১২। গাযওয়া বনু সুলায়েম (غزوة بني سليم) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে বদর যুদ্ধ হ’তে প্রত্যাবর্তনের মাত্র সাতদিন পরে সংঘটিত হয়। বনু গাত্বফান গোত্রের শাখা বনু সুলায়েম মদীনা হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে জানতে পেরেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং ২০০ উষ্ট্রারোহীকে নিয়ে মক্কা ও সিরিয়ার বাণিজ্যপথে কুদর (الكدر) নামক ঝর্ণাধারার নিকটে পেঁŠছে তাদের উপরে আকস্মিক হামলা চালান। তারা হতবুদ্ধি হয়ে ৫০০ উট রেখে পালিয়ে যায়। ইয়াসার (يسار) নামে একটি গোলাম আটক হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে মুক্ত করে দেন।
১৩। গাযওয়া বনু কায়নুক্বা (غزوة بني قينقاع) : ২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল শনিবার থেকে ১৫ দিন অবরোধ করে রাখার পর এই প্রথম চুক্তি ভঙ্গকারী এবং তাদের বাজারে এক দুধ বিক্রেতা মুসলিম মহিলাকে বিবস্ত্রকারী এই নরাধম ইহুদী গোত্রটি ১লা যিলক্বা‘দ আত্মসমর্পণ করে। এরা ছিল খায়বার গোত্রের মিত্র। ফলে মাত্র একমাস পূর্বে ইসলাম কবুলকারী খাযরাজ গোত্রভুক্ত মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের একান্ত অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রাণদন্ড মওকুফ করে মদীনা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। এদের মধ্যে ৭০০ জন ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা এবং মদীনার সেরা ইহুদী বীর। এরা সবকিছু ফেলে সিরিয়ার দিকে চলে যায় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সেখানে মৃত্যুবরণ করে। মানছূরপুরী বলেন, তারা খায়বরে যেয়ে বসতি স্থাপন করে।[1]
১৪। গাযওয়া সাভীক্ব (غزوة سويق) : ২য় হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে। বদর যুদ্ধের মন্দ পরিণতিতে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান শপথ করেছিলেন যে, মুহাম্মাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত তার মস্তক নাপাকীর গোসলের পানি স্পর্শ করবে না। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য তিনি ২০০ অশ্বারোহী নিয়ে মদীনায় এসে ইহুদী গোত্র বনু নাযীর নেতা ও তাদের কোষাধ্যক্ষ সালাম বিন মুশকিমের সঙ্গে শলা পরামর্শ শেষে ফিরে যান। কিন্তু যাওয়ার আগে একটি দল পাঠিয়ে দেন। যারা মদীনার আরীয (العريض) নামক স্থানে হামলা করে কয়েক সারি খেজুর গাছ কেটে জ্বালিয়ে দেয় এবং একজন আনছার ও তার এক মিত্রকে তাদের জমিতে কর্মরত পেয়ে হত্যা করে ফিরে যায়।
এখবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্রুত গতিতে পশ্চাদ্ধাবন করেন। আবু সুফিয়ান ভয়ে এত দ্রুত পলায়ন করেন যে, বোঝা হালকা করার জন্য তাদের পাথেয় সম্ভার এবং ছাতুর অনেকগুলি বস্তা রাস্তায় ফেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বারক্বারাতুল কুদর (قرقرة الكدر) পর্যন্ত ধাওয়া করে ফিরবার পথে তাদের ফেলে যাওয়া ছাতুর বস্তাগুলো নিয়ে আসেন। ছাতুকে আরবীতে ‘সাভীক্ব’ (السويق) বলা হয়। সেজন্য এই অভিযানটি ‘গাযওয়া সাভীক্ব’ বা ছাতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছে।
এখবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্রুত গতিতে পশ্চাদ্ধাবন করেন। আবু সুফিয়ান ভয়ে এত দ্রুত পলায়ন করেন যে, বোঝা হালকা করার জন্য তাদের পাথেয় সম্ভার এবং ছাতুর অনেকগুলি বস্তা রাস্তায় ফেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বারক্বারাতুল কুদর (قرقرة الكدر) পর্যন্ত ধাওয়া করে ফিরবার পথে তাদের ফেলে যাওয়া ছাতুর বস্তাগুলো নিয়ে আসেন। ছাতুকে আরবীতে ‘সাভীক্ব’ (السويق) বলা হয়। সেজন্য এই অভিযানটি ‘গাযওয়া সাভীক্ব’ বা ছাতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছে।
১৫। সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী (سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে আগ্রাসী বনু সুলায়েম বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে তিন দিন অবস্থান শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় ফিরে আসার পর শত্রুরা পুনরায় সংগঠিত হয়েছিল। তখন এদের বিরুদ্ধে পুনরায় এই অভিযান প্রেরিত হয়। যাতে শত্রুপক্ষের কয়েকজন এবং মুসলিম পক্ষের তিন জন মারা যায়।
১৬। গাযওয়া যী আমর (غزوة ذي أمر) : ৩য় হিজরীর ছফর মাস। বনু ছা‘লাবাহ ও বনু মুহারিব গোত্রদ্বয় বিরাট এক বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমন করবে এ মর্মে খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ৪০০ সৈন্য নিয়ে তাদের মুকাবিলায় বের হন। পথিমধ্যে বনু ছা‘লাবাহ গোত্রের জাববার (جبار) নামক জনৈক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে মুসলমান হয়ে যায় এবং মুসলিম বাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে। শত্রুপক্ষ পালিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ঘাঁটি এলাকায় পৌঁছে যী আমর (ذي أمر) নামক ঝর্ণাধারার পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে পুরা ছফর মাস অতিবাহিত করেন। যাতে মুসলিম শক্তির প্রভাব ও প্রতিপত্তি শত্রুদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
১৭। সারিইয়া মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ : ৩য় হিজরীর ১৪ রবীউল আউয়াল। মদীনার নামকরা ইহুদী পুঁজিপতি ও কবি কা‘ব বিন আশরাফ সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীদেরকে যুদ্ধে প্ররোচনা দিত। বদর যুদ্ধের পর সে মক্কায় গিয়ে কুরায়েশ নেতাদের উস্কে দেয়। তারপর মদীনায় ফিরে এসে ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলতে থাকে। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সেমতে আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি দল ১৪ই বরীউল আউয়াল চাঁদনী রাতে তার বাড়ী গিয়ে তাকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর ইহুদীরা সম্পূর্ণরূপে হিম্মত হারিয়ে ফেলে এবং রাসূলের সাথে পূর্বের কৃত চুক্তি মোতাবেক আচরণ করার স্বীকৃতি প্রদান করে। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আভ্যন্তরীণ গোলযোগের আশংকা হ’তে মুক্ত হন এবং বহিরাক্রমণ মুকাবিলার দিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পান।
১৮। গাযওয়া বাহরান (غزوة بحران) : ৩য় হিজরীর রবীউল আখের মাসে। একটি কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলাকে আটকানোর জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ৩০০ সৈন্য নিয়ে হেজাযের ফারা (الفرع) সীমান্তের বাহরান অঞ্চলে গমন করেন। সেখানে তিনি রবীউল আখের ও জুমাদাল ঊলা দু’মাস অবস্থান করেন। কিন্তু কোন যুদ্ধ হয়নি।
১৯। সারিইয়া যায়েদ ইবনু হারেছাহ : ৩য় হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ। মদীনার পথে ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মদীনার পূর্বদিক দিয়ে দীর্ঘ পথ ঘুরে সম্পূর্ণ অজানা পথে নাজদ হয়ে সিরিয়া যাবার মনস্থ করে। এ খবর মদীনায় পেঁŠছে গেলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি অশ্বারোহী দল প্রেরণ করেন। তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে ‘ক্বারদাহ’ (قردة) নামক প্রস্রবণের কাছে পৌঁছে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতর্কিতে এই হামলার মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে কাফেলা নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া সবকিছু ফেলে পালিয়ে যান। কুরায়েশদের পথ প্রদর্শক ফুরাত বিন হাইয়ান (فرات بن حيان) এবং বর্ণিত হয়েছে যে, আরও দু’জন বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হয়। অতঃপর তারা রাসূলের হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন। আনুমানিক এক লক্ষ দেরহামের রৌপ্য সহ বিপুল পরিমাণ গনীমতের মাল হস্তগত হয়। এই পরাজয়ে কুরায়েশরা হতাশ হয়ে পড়ে। এখন তাদের সামনে মাত্র দু’টি পথই খোলা রইল। অহংকার পরিত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করা অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা। বলা বাহুল্য, তারা শেষটাই গ্রহণ করে এবং যা ওহোদ যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
২০। গাযওয়া ওহোদ (غزوة الأحد) : ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকাল। কুরায়েশ বাহিনী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদীনার তিন মাইল উত্তরে ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির সন্নিবেশ করে। এই বাহিনীর সাথে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবার নেতৃত্বে ১৫ জনের একদল মহিলা ছিল, যারা নেচে-গেয়ে ও উত্তেজক কবিতা পাঠ করে তাদের সৈন্যদের উৎসাহিত করে। এই যুদ্ধে রাসূলের নেতৃত্বে প্রায় ৭০০ সৈন্য ছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে একটি ভুলের জন্য মুসলমানদের সাক্ষাৎ বিজয় অবশেষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মুসলিম পক্ষে ৭০ জন শহীদ ও ৪০ জন আহত হন। কুরায়েশ পক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়। যাদের মধ্যে হামযা একাই ৩১ জনকে হত্যা করেন ও নিজে শহীদ হন। মুসলমানদের ক্ষতি হ’লেও কুরায়েশরা বিজয়ী হয়নি। বরং তারা ভীত হয়ে ফিরে যায়। এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানের ১২১-১৭৯ পর্যন্ত ৬০টি আয়াত নাযিল হয়।
২১। গাযওয়া হামরাউল আসাদ (غزوة حمراء الأسد) : ৩য় হিজরীর ৮ই শাওয়াল। আবু সুফিয়ানের বাহিনী পুনরায় মদীনা আক্রমণ করতে পারে, এই আশংকায় ওহোদ যুদ্ধের পরদিনই তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা হয়। মদীনা থেকে ৮ মাইল দূরে হামরাউল আসাদে পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেখানে তিনদিন অবস্থান করেন। সেখানে মা‘বাদ আল-খুযাঈ ইসলাম কবুল করলে তাকে পাঠানো হয় আবু সুফিয়ানের কাছে। মক্কার পথে ‘রাওহা’ নামক স্থানে পৌঁছে আবু সুফিয়ান পুনরায় মদীনা আক্রমণের অভিসন্ধি করেছিল। কিন্তু মা‘বাদের কূটনীতিতে এবং মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবনের কথা শুনে তারা ভীত হয়ে দ্রুত মক্কায় ফিরে যায়। মুসলিম বাহিনী নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসে। এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সূরা আলে ইমরান ১৭৩-৭৪ আয়াতে। এ সময় হামরাউল আসাদে আবু সুফিয়ানের দু’জন গুপ্তচর আবু উযযা জামহী ও মু‘আবিয়া বিন মুগীরা গ্রেফতার হয় ও পরে নিহত হয়। শেষোক্ত ব্যক্তি ছিল পরবর্তীতে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের নানা।
২২। সারিইয়া আবু সালামা (سرية أبي سلمة) : ৪র্থ হিজরীর ১লা মুহাররম। ত্বালহা ও সালামা বিন খুওয়াইলিদ নামক দুই কুখ্যাত ডাকাত ভাই বনু আসাদ গোত্রকে মদীনা আক্রমণের প্ররোচনা দিচ্ছে মর্মে খবর পৌঁছলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় দুধভাই আবু সালামাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মুহাজির ও আনছারের ১৫০ জনের একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। বনু আসাদের প্রস্ত্ততি গ্রহণের পূর্বেই তাদের ‘কুত্বন’ (القطن) নামক ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণের ফলে তারা হতচকিত হয়ে পালিয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী তাদের ফেলে যাওয়া উট ও বকরীর পাল ও গনীমতের মাল নিয়ে ফিরে আসে। এই যুদ্ধ থেকে ফিরে কিছু দিনের মধ্যে আবু সালামা মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তার বিধবা স্ত্রী উম্মে সালামা রাসূলের সাথে বিবাহিতা হন। আবু সালামা ইতিপূর্বে ওহোদের যুদ্ধে যখমী হয়েছিলেন।
২৩। সারিয়াহ আব্দুল্লাহ বিন আনীস (سرية عبد الله بن أنيس) : ৪র্থ হিজরীর ৫ই মুহাররম। মুসলমানদের উপরে হামলার জন্য খালেদ বিন সুফিয়ান হুযালী সৈন্য সংগ্রহ করছে বলে সংবাদ পেয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আব্দুল্লাহ বিন আনীস আল-জুহানী আনছারীকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে গিয়ে ১৮ দিন অবস্থান করেন এবং অবশেষে খালেদকে হত্যা করে তার মাথা নিয়ে মদীনায় ফেরেন।
২৪। সারিইয়া রাজী‘ (سرية رجيع) : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে আযাল ও ক্বারাহ (عضل وقارة) গোত্রের সাতজন লোককে রাসূলের দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরয করে যে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। এক্ষণে তাদের অধিক তা‘লীমের প্রয়োজন। সেকারণ কয়েকজন উঁচু মর্তবার ছাহাবীকে পাঠালে আমরা উপকৃত হ’তাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে আছেম বিন ছাবিতের নেতৃত্বে ১০ জন বুযর্গ ছাহাবীকে প্রেরণ করেন। আছেম হযরত ওমরের শ্বশুর ছিলেন এবং আছেম বিন ওমরের নানা ছিলেন। তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী ‘রাজী’ নামক প্রস্রবণের নিকটে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা মতে হুযায়েল গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দায তাদেরকে হামলা করে। যুদ্ধে আছেম সহ আটজন শহীদ হন এবং দু’জনকে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তারা হ’লেন হযরত খোবায়েব বিন আদী ও যায়েদ বিন দাছনা। সেখানে ওকবা বিন হারেছ খোবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া যায়েদকে হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা হিসাবে। শূলে চড়ার আগে খোবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর কাফেরদের বদ দো‘আ করেন এবং সাত লাইনের মর্মন্তুদ কবিতা বলেন, যা ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ ও জীবনী গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। খোবায়েবের বদ দো‘আ ছিল নিম্নরূপ- اَللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا- ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে এক এক করে গুণে রাখ। তাদেরকে এক এক করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও বাকী রেখো না’। অতঃপর তাঁর সাত লাইনের কবিতার শেষের দু’লাইন ছিল নিম্নরূপ-
ولست أبالى حين أقتل مسلما + على أي شق كان فى لله مصرعي
وذلك في ذات الاله وإن يشاء + يبارك في أوصال شلو ممزع
وذلك في ذات الاله وإن يشاء + يبارك في أوصال شلو ممزع
‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোন পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে শোয়ানো হচ্ছে’। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।[2] এরপর আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, যে তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবার সহ বেঁচে থাক? তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে মুহাম্মাদ আসুক এবং তাকে একটি কাটারও আঘাত লাগুক’। হারাম থেকে দূরে তানঈম নামক স্থানে তাকে হত্যা করা হয়। বীরে মা‘উনার মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ছাহাবী আমর বিন উমাইয়া যামরী পাহারাদারকে লুকিয়ে অতীব চতুরতার সাথে তার লাশ এনে সসম্মানে দাফন করেন। অন্যদিকে দলনেতা আছেম-এর লাশ আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা লোক পাঠান। কিন্তু আল্লাহ তার লাশের হেফাযতের জন্য এক ঝাঁক ভীমরুল পাঠান। ফলে মুশরিকরা তার লাশের ধারে যেতে পারেনি। কেননা আছেম আল্লাহর নিকটে অঙ্গীকার দিয়েছিলেন যে, তাকে যেন কোন মুশরিক স্পর্শ না করে এবং তিনিও কোন মুশরিককে স্পর্শ না করেন। পরে হযরত ওমর বলেন, আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাকে মৃত্যুর পরেও হেফাযত করেন, যেমন তাকে জীবিত অবস্থায় হেফাযত করে থাকেন’।
কুরায়েশরা খোবায়েরকে হারেছ বিন আমেরের বাড়ীতে কয়েকদিন বন্দী রাখে। এ সময় তাকে কোন খাদ্য বা পানীয় দেওয়া হয়নি। একদিন হঠাৎ হারেছ-এর ছোট বাচচা ছেলে ধারালো ছুরি নিয়ে খেলতে খেলতে তার কাছে আসে। তিনি তাকে আদর করে কোলে বসান। এ দৃশ্য দেখে বাচ্চার মা চিৎকার করে ওঠে। তখন খোবায়েব বলেন, মুসলমান কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। মৃত্যুর পূর্বে খোবায়েবের শেষ বাক্য ছিল- اللهم بلغنا رسالة فبلغه ما يصنع بنا- ‘হে আল্লাহ, আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি এবং তুমি তাকে আমাদের খবর পৌঁছে দিয়ো। ওমরের গবর্ণর সাঈদ বিন আমের (রাঃ) যিনি খোবায়েবের মৃত্যু দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের হত্যাকান্ডের দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কতবড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে থোকা থোকা আঙ্গুর খেতে দেখা যায়। অথচ ঐসময় মক্কায় কোন ফল ছিল না।
২৫। সারিইয়া বিরে মাঊনা (سرية بئر معونة) : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। পূর্বোক্ত ঘটনাটির চাইতে এটি ছিল আরও বেশী মর্মন্তুদ এবং দু’টি ঘটনা একই মাসে সংঘটিত হয়। নাজদের নেতা আবু বারা আমের বিন মালেকের আমন্ত্রণক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদবাসীদের দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য মুনযির বিন আমের (রাঃ)-এর নেতৃতেব ৭০ জনের একটি দল প্রেরণ করেন। যাদের সকলে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ক্বারী ও বিজ্ঞ আলেম। মাঊনা নামক কুয়ার নিকটে পৌঁছলে বনু সুলাইমের তিনটি গোত্র উছাইয়া, রে‘ল ও যাকওয়ান (عصية، رعل و ذكوان) চতুর্দিক হ’তে তাদের উপরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে হত্যা করে। একমাত্র আমর বিন উমাইয়া যামরী রক্ষা পান মুযার গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে। এতদ্ব্যতীত কা‘ব বিন যায়েদ জীবিত ছিলেন। তাঁকে নিহতদের মধ্য থেকে উঠিয়ে আনা হয়। পরে তিনি ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধের সময় শহীদ হন। এই সময় রাসূলের পত্র বাহক হারাম বিন মিলহানকে প্রাপক গোত্র নেতা আমের বিন তোফায়েল-এর ইংগিতে অতর্কিতে পিছন থেকে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করা হ’লে তিনি বলে ওঠেন, اللهُ أكْبَرُ فُزْتُ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ ‘আল্লাহু আকবর! কা‘বার রবের কসম! আমি সফল হয়েছি’। হারাম বিন মিলহানের মৃত্যুকালীন শেষ বাক্যটি হত্যাকারী জাববার বিন সুলমা (جبار بن سلمى) -এর অন্তরে এমনভাবে দাগ কাটে যে, পরে তিনি মদীনায় গিয়ে রাসূলের নিকটে ইসলাম কবুল করেন।[3]
মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পরপর দু’টি হৃদয় বিদারক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দারুনভাবে ব্যথিত হন এবং বনু লেহিয়ান, রে‘ল ও যাকওয়ান এবং উছাইয়া গোত্র সমূহের বিরুদ্ধে এক মাস যাবত বদ দো‘আ করে ফজরের ছালাতে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।
২৬। সারিইয়াহ আমর ইবনে উমাইয়া যামরী (سرية عمرو بن أمية الضمري) : ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বি’রে মাঊনার মর্মান্তিক ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ছাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া যামরী বি’রে মাঊনা হ’তে মদীনায় ফেরার পথে ক্বারক্বারা নামক বিশ্রাম স্থলে পৌঁছে বনু কেলাব গোত্রের দু’ব্যক্তিকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। এর মাধ্যমে তিনি সাথীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত গোত্রের সঙ্গে যে রাসূল (ছাঃ)-এর সন্ধিচুক্তি ছিল, তা তিনি জানতেন না। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য প্রদান করেন। কিন্তু এই ঘটনা পরবর্তীতে বনু নাযীর যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২৭। গাযওয়া বনু নাযীর (غزوة بني نضير) : ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। মদীনার মুনাফিক ও মক্কার কুরায়েশ নেতাদের চক্রান্তে বনু নাযীরের ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করে এবং রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে এলে তারা তাঁকে শঠতার মাধ্যমে বসিয়ে রেখে দেওয়ালের উপর থেকে পাথর ফেলে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তখন সেখান থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। অতঃপর ছয় বা পনের দিন অবরোধের পরে তারা আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে মদীনা থেকে চিরদিনের মত বহিষ্কার করা হয় ও তারা খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। এ ঘটনা উপলক্ষে সূরা হাশর নাযিল হয়। ইবনু আববাস একে ‘সূরা বনী নাযীর’ বলতেন। এই যুদ্ধে ফাই-য়ের বিধান নাযিল হয়। মুনাফিকরা বনু নাযীরকে রাসূলের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে সটকে পড়ায় তাদের বিরুদ্ধে সূরা হাশরের ১৬-১৭ আয়াত দু’টি নাযিল হয়।
২৮। গাযওয়া নাজদ (غزوة نجد) : ৪র্থ হিজরীর রবীউল আখের মাস। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সংবাদ পেলেন যে, বনু গাত্বফানের দু’টি গোত্র বনু মুহারিব ও বনু ছা‘লাবাহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বেদুঈন ও পল্লীবাসীদের মধ্য হ’তে সৈন্য সংগ্রহ করছে। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদ অভিমুখে যাত্রা করেন। এই আকষ্মিক অভিযানে উদ্ধত বেদুঈনরা ভয়ে পালিয়ে যায় ও তাদের মদীনা আক্রমণের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
২৯। গাযওয়া বদর আখের (غزوة بدر الآخر) : ৪র্থ হিজরীর শা‘বান মোতাবেক ৬২৬ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে দেড় হাযার সৈন্য নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদর অভিমুখে রওয়ানা হন। গত বছর ওহোদ যুদ্ধ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান আগামী বছর পুনরায় মদীনা হামলা করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। তার হামলা মুকাবিলার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আগে ভাগেই বদর প্রাপ্তরে উপস্থিত হন। ওদিকে শত্রুপক্ষের অবস্থা ছিল এই যে, আবু সুফিয়ান ২০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে যথাসময়ে রওয়ানা হয়ে মার্রুয যাহরান পৌঁছে ‘মাজিন্নাহ’ (مجنة) ঝর্ণার নিকটে শিবির স্থাপন করেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেন এবং বিভিনণ অজুহাত দেখিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে চান। তাতে সৈন্যদের সকলে এক বাক্যে সায় দেয় এবং সেখান থেকেই তারা মক্কায় ফিরে যায়।
৮ দিন অপেক্ষার পর শত্রু পক্ষের দেখা না পেয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এরি মধ্যে মুসলমানেরা সেখানে ব্যবসা করে দ্বিগুণ লাভবান হন। উল্লেখ্য যে, বদর ছিল অন্যতম বড় ব্যবসা কেন্দ্র। সংঘর্ষ না হ’লেও এই অভিযানকে বদরে আখের বা বদরের শেষ যুদ্ধ বলা হয়। আবু সফিয়ানের পশ্চাদপসারণের ঘটনায় সারা আরবে মুসলিম শক্তির প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়।
৩০। গাযওয়া দূমাতুল জান্দাল (غزوة دومة الجندل) : ৫ম হিজরীর ২৫শে রবীউল আউয়াল। খবর এলো যে, সিরিয়ার নিকটবর্তী দূমাতুল জান্দাল শহরের একদল লোক সিরিয়া যাতায়াতকারী ব্যবসায়িক কাফেলা সমূহের উপরে লুটপাট চালায়। তারা মদীনায় হামলার জন্য বিরাট এক বাহিনী প্রস্ত্তত করছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কালবিলম্ব না করে ১০০০ ফৌজ নিয়ে মদীনা হ’তে ১৫ রাত্রির পথ অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন। কিন্তু শহরে পৌঁছে কাউকে পেলেন না। শত্রুপক্ষ টের পেয়ে আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন ও চারদিকে ছোট ছোট সৈন্যদল প্রেরণ করেন। কিন্তু শত্রুদের কারু নাগাল পাওয়া যায়নি। অবশেষে কিছু গবাদিপশু নিয়ে তিনি ফিরে আসেন। কিন্তু এতে লাভ হয় এই যে, শত্রুরা আর মাথা চাড়া দেয়নি। তাতে ইসলাম প্রচারের শান্ত পরিবেশ তৈরী হয়। পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওয়ায়না বিন হিছন-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করেন।
৩১। গাযওয়া আহযাব (غزوة الأحزاب) বা খন্দকের যুদ্ধ : ৫ম হিজরীর শওয়াল ও যুলক্বা‘দাহ মাস। বিতাড়িত বনু নাযীর ইহুদী গোত্রের নেতাদের উস্কানীতে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কেনানাহ ও তেহামার মিত্র গোত্র সমূহ মিলে ৪০০০ কুরায়েশ বাহিনী এবং বনু গাত্বফান ও নাজদীদের ৬০০০ সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনীর ১০,০০০ সৈন্য মদীনা অবরোধ করে। যা ছিল মদীনার মোট লোকসংখ্যার চাইতে বেশী। কিন্তু সালমান ফারেসীর পরামর্শক্রমে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনার উত্তর পার্শ্বে ওহোদের দিকে দীর্ঘ খন্দক বা পরিখা খনন করে তার পিছনে ৩০০০ সৈন্য সমাবেশ করেন। এই নতুন কৌশল দেখে কাফের বাহিনী হতচকিত হয়ে যায়। পরিখা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে উভয় পক্ষে তীর চালনায় ৬ জন মুসলিম ও ১০ জন কাফির মারা যায়। অতঃপর দীর্ঘ প্রায় এক মাস অবরোধে খাদ্যকষ্টে পতিত কাফের বাহিনীর উপরে হঠাৎ একরাতে উত্তপ্ত বায়ুর ঝড় নেমে আসে। তাতে তাদের তাঁবু সমূহ উড়ে যায় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র হ’তে পালিয়ে যায়। সম্মিলিত বাহিনীর এই পরাজয়ের ফলে সমগ্র আরবে মদীনা রাষ্ট্রের সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং সম্ভাব্য শত্রুরা মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। কেননা আহযাব যুদ্ধের ন্যায় বিশাল বাহিনীর সমাবেশ ঘটানো পুনরায় আরবদের জন্য সম্ভবপর ছিল না।
৩২। গাযওয়া বনু কুরায়যা (غزوة بني قريظة) : ৫ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ ও যিলহাজ্জ মাস। মদীনার সর্বশেষ এই ইহুদী গোত্রটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে আহযাব যুদ্ধে আক্রমণকারী বাহিনীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় ও তাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করে। বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের নেতা হুয়াই বিন আখত্বাবের প্ররোচনায় তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। আহযাব যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন যুলক্বা‘দাহ মাসের শেষ সপ্তাহের বুধবারে। এসে যোহরের সময় যখন তিনি উম্মে সালামার গৃহে গোসল করছিলেন, তখন জিব্রীলের আগমন ঘটে এবং তাকে তখনই বনু কুরায়যার উপরে হামলা পরিচালনার আহবান জানিয়ে বলেন, আপনি দ্রুত আসুন! আমি আগে গিয়ে দুর্গে কম্পন সৃষ্টি করে ওদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাথে সাথে সবাইকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, যেন সবাই বনু কুরায়যায় গিয়ে আছর পড়ে। এই সময় রাসূলের সাথে ৩০০০ সৈন্য ছিলেন। ২৫ দিন অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের মিত্র সা‘দ বিন মু‘আযের সিদ্ধান্ত মতে তাদের বয়স্ক পুরুষ বন্দী ছয় থেকে সাত শতের মত লোককে হত্যা করা হয়। বাকীদের বহিষ্কার করা হয়। এই অবরোধকালে মুসলিম পক্ষে একজন শহীদ ও একজন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে হযরত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) মৃত্যু বরণ করেন। যিনি ইতিপূর্বে খন্দকের যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন।
৩৩। সারিইয়া আব্দুল্লাহ বিন আতীক আনছারী : ৫ম হিজরীর যিলহাজ্জ মাস। বনু কুরায়যার শত্রুতা থেকে মুক্ত হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার পর খায়বারের আবু রাফে‘ দুর্গের অধিপতি অন্যতম শীর্ষ দুষ্টমতি ইহুদী নেতা এবং মদীনা থেকে বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম সর্দার সালাম বিন আবুল হুক্বাইক্বকে হত্যার জন্য খাযরাজ গোত্রের বনু সালামা শাখার লোকেরা রাসূলের নিকটে দাবী করে। সালামের উপনাম ছিল আবু রাফে‘। সে ছিল কা‘ব বিন আশরাফের ন্যায় প্রচন্ড ইসলাম ও রাসূল বিদ্বেষী ইহুদী নেতা। মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বদা সে শত্রুপক্ষকে সাহায্য করত। ওহোদ যুদ্ধের দিন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্ররোচনায় বনু সালামা গোত্রের লোকেরা ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা যায়নি। এ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরান ১২২ আয়াত নাযিল হয়। খন্দকের যুদ্ধের দিনও এরা মুনাফিকদের প্ররোচনায় যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে যেতে চেয়েছিল এবং রাসূলের নিকটে ওযর পেশ করেছিল (আহযাব ১২-১৩)। সেই বদনামী দূর করার জন্য এবং ইতিপূর্বে ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে আউস গোত্রের লোকেরা মুহাম্মাদ বিন মাসলামার নেতৃত্বে রাসূলের নির্দেশে কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, অনুরূপভাবে একটি দুঃসাহসিক কাজ করার জন্য তারা রাসূলের অনুমতি প্রার্থনা করে। অতঃপর রাসূলের অনুমতি নিয়ে আব্দুল্লাহ বিন আতীকের নেতৃত্বে তাদের পাঁচ সদস্যের একটি দল খায়বর অভিমুখে রওয়ানা হয় এবং কৌশলে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আবু রাফে‘ সালাম বিন আবিল হুক্বাইক্বকে হত্যা করে ফিরে আসে।
৩৪। সারিইয়া মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (سرية محمد بن مسلمة) : ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাস। মদীনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী নাজদের বনু বাকর বিন কিলাব গোত্রের প্রতি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ আনছারীর নেতৃত্বে ৩০ জনের এই দলকে ১০ই মুহাররম তারিখে মদীনা থেকে প্রেরণ করা হয়। মুসলিম বাহিনী সেখানে পেঁŠছানোর সাথে সাথে তারা পালিয়ে যায়। তাদের পরিত্যক্ত ধন-সম্পদ নিয়ে ফিরে আসার পথে ইয়ামামার হানীফা গোত্রের সরদার ছুমামাহ বিন আছাল হানাফী (ثمامة بن أثال) তাদের হাতে গ্রেফতার হয়। উক্ত ব্যক্তি ইয়ামামার নেতা মুসায়লামার নির্দেশ মতে ছদ্মবেশে মদীনায় যাচ্ছিল রাসূলকে গোপনে হত্যা করার জন্য। উল্লেখ্য যে, মুসায়লামা ১০ম হিজরী সনে নিজেই মিথ্যা নবুঅত দাবী করে এবং হযরত আবুবকরের খেলাফত কালে দ্বাদশ হিজরী রবীউল আউয়াল মাসে ইয়ামামার যুদ্ধে ওয়াহশীর হাতে নিহত হয়। ছুমামাকে এনে মসজিদে নববীর খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন ما عندك يا ثمامة ‘তোমার নিকটে কি আছে হে ছুমামাহ! সে বলল, عندي خير يا محمد ‘আমার কাছে মঙ্গল আছে হে মুহাম্মাদ’! এভাবে তিনদিন একই প্রশ্নের একই জবাব দিলে রাসূল (ছাঃ) তাকে মুক্তির নির্দেশ দেন। মুক্তি পেয়ে সে গোসল করে এসে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করে। অতঃপর সে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ করে। সেখানে কুরায়েশ নেতারা তাকে বলে, صبأة يا ثمامة হে ছুমামা! তুমি কি বেদ্বীন হয়ে গেছ? জবাবে তিনি বলেন, না আমি মুসলমান হয়েছি। অতঃপর তিনি কুরায়েশ নেতাদের হুমকি দেন যে, ইয়ামামা থেকে তোমাদের জন্য গমের একটি দানাও আর আসবে না, যে পর্যন্ত না রাসূল নির্দেশ দেন’। ঐ সময় ইয়ামামা ছিল মক্কাবাসীদের জন্য শস্যভান্ডার স্বরূপ। হুমকি মতে শস্য আগমন বন্ধ হয়ে গেলে মক্কাবাসীগণ বাধ্য হয়ে রাসূলের নিকটে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে পত্র লেখে। তখন রাসূলের নির্দেশে পুনরায় শস্য রফতানী শুরু হয়।
মুহাররম মাসের একদিন বাকী থাকতে এই অভিযাত্রী দল মদীনায় ফিরে আসে। যা পরবর্তী সময়ের জন্য খুবই ফলদায়ক প্রমাণিত হয়।
মুহাররম মাসের একদিন বাকী থাকতে এই অভিযাত্রী দল মদীনায় ফিরে আসে। যা পরবর্তী সময়ের জন্য খুবই ফলদায়ক প্রমাণিত হয়।
৩৫। গাযওয়া বনু লাহিয়ান (غزوة بني لَحْيان) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবীউল আউয়াল অথবা জুমাদাল ঊলা মাস। ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে এই গোত্রের লোকেরা প্রতারণার মাধ্যমে ডেকে নিয়ে মক্কা সীমান্তে রাজী‘ নামক স্থানে ১০ জন নিরীহ ছাহাবীকে হত্যা করে। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত খোবায়েব (রাঃ)। তাদের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং ২০০ সৈন্য নিয়ে এই অভিযানে বের হন। রাজী‘ পৌঁছে ‘গারান’ (بطن غران) উপত্যকার যে স্থলে ৮ জন ছাহাবীকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদর উপর করুণাসিক্ত হয়ে পড়েন ও তাদের জন্য দো‘আ করেন (ترحم عليهم ودعا لهم)। বনু লাহিয়ান গোত্রের লোকেরা পালিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানে দু’দিন অবস্থান করেন। পরে তিনি আসফান ও মক্কার দিকে ছোট ছোট দল প্রেরণ করেন। কিন্তু কারু নাগাল না পেয়ে ১৪ দিন পরে মদীনায় ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি বেদুঈন হামলা বন্ধের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট অভিযান সমূহ প্রেরণ করতে থাকেন।
৩৬। সারিইয়াহ উক্কাশা বিন মিহছান (سرية عكاشة بن محصن) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবীউল আউয়াল অথবা আখের। ৪০ জনের একটি সেনাদল নিয়ে বনু আসাদ গোত্রের গামার (ماء غمر) প্রস্রবণের দিকে উক্কাশার নেতৃত্বে প্রেরিত হয়। কেননা বনু আসাদ গোত্র মদীনায় হামলা করার জন্য সৈন্য সংগ্রহ করছিল। মুসলিম বাহিনীর আকস্মিক উপস্থিতিতে তারা পালিয়ে যায়। পরে গণীমত হিসাবে ২০০ উট নিয়ে বাহিনী মদীনায় ফিরে আসে।
৩৭। সারিইয়াহ মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (سرية محمد بن مسلمة) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবীউল আউয়াল অথবা আখের। ১০ সদস্যের একটি বিদ্বান দল মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে বনু ছা‘লাবাহ অঞ্চলের যুল-ক্বিছছা (ذو القصة) নামক স্থানে প্রেরিত হয়। মানছূরপুরী বলেন, এঁরা সেখানে দ্বীনের দাওয়াত ও তা‘লীমের জন্য গিয়েছিলেন। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় শত্রুদের প্রায় একশত লোক এসে তাদেরকে হত্যা করে। দলনেতা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ আহত অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হন।
৩৮। সারিইয়া আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (سرية أبي عبيدة بن الجراح) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবীউল আখের। পূর্বের হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ৪০ জনের এই দল যুল-ক্বিছছায় প্রেরিত হয়। কিন্তু বনু ছা‘লাবাহ গোত্রের সবাই পালিয়ে যায়। একজন গ্রেফতার হ’লে সে মুসলমান হয়ে যায়। ফলে তাদের পরিত্যক্ত গবাদি-পশু নিয়ে তারা ফিরে আসেন।
৩৯। সারিইয়া যায়েদ বিন হারেছাহ (سرية زيد بن حارثة) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবীউল আখের মাস। যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে একটি সেনাদল মাররুয যাহরানের বনু সুলায়েম গোত্রের ‘জুমূম’ (ماء جموم) ঝর্ণার দিকে প্রেরিত হয়। বনু সুলায়েমের কয়েকজন লোক বন্দী হয়। হালীমা নাম্নী একজন বন্দী মহিলা সহ বাকী বন্দী ও গবাদিপশু নিয়ে যায়েদ মদীনা ফিরে আসেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বন্দীদের ছেড়ে দেন ও মহিলাকে মুক্ত করে বিবাহের ব্যবস্থা করে দেন।
৪০। সারিইয়া যায়েদ ইবনু হারেছাহ (سرية زيد بن حارثة) : ৬ষ্ঠ হিজরীর জুমাদাল ঊলা। ১৭০ জনের একটি দল নিয়ে তিনি শামের নিকটবর্তী ঈছ (العيص) অভিমুখে প্রেরিত হন। ঐপথে তখন রাসূলের জামাতা আবুল ‘আছ বিন রবী‘ বিন আবদে শামস বিন আবদে মানাফ বিন কুছাই-এর নেতৃত্বে একটি কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মক্কা অভিমুখে অতিক্রম করছিল। আবুল ‘আছ দ্রুত মদীনায় এসে নবী তনয়া যয়নবের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং রাসূলকে কাফেলার সব মালামাল ফেরত দানের অনুরোধ করেন। সেমতে তাকে সব মাল ফেরৎ দেওয়া হয়। আবুল ‘আছ মক্কায় গিয়ে পাওনাদারদের মালামাল বুঝিয়ে দেন ও প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেন। অতঃপর তিনি মদীনায় ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রায় তিন বছরের কিছু পরে যয়নবকে পূর্বের বিবাহের উপরে তার স্বামীর নিকটে অর্পণ করেন। উল্লেখ্য যে, আবুল ‘আছ ছিলেন যয়নবের আপন খালাতো ভাই এবং খাদীজার জীবদ্দশায় তাদের বিবাহ হয়।
৪১। সারিইয়া যায়েদ ইবনু হারেছাহ (سرية زيد بن حارثة) : ৬ষ্ঠ হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ। ১৫ সদস্যের একটি বাহিনীসহ তিনি বনু ছা‘লাবা গোত্রের তরফ (الطرف) অথবা তুরুক্ব (طرق) নামক স্থানে প্রেরিত হন। কিন্তু শত্রুপক্ষ পালিয়ে যায়। ৪ দিন অবস্থান শেষে যায়েদ মদীনায় ফিরে আসেন।
৪২। সারিইয়া যায়েদ বিন হারেছাহ (سرية زيد بن حارثة) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রজব মাস। ১২ জনের একটি দল ওয়াদিল ক্বোরা (وادي القرى) এলাকায় প্রেরিত হন শত্রুপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। কিন্তু এলাকাবাসী তাদের উপরে অতর্কিতে হামলা করে ৯ জনকে হত্যা করে। যায়েদ সহ তিনজন রক্ষা পান।
৪৩। গাযওয়া বনুল মুছত্বালিক্ব বা মুরাইসী (غزوة بني المصطلق أو المريسيع) : ৬ষ্ঠ হিজরীর ৩রা শা‘বান। মুরাইসী‘ নামক ঝর্ণাধারার নিকট উপনীত হওয়ার পর উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলমানগণ সহজ বিজয় অর্জন করেন। কাফের পক্ষের ১০ জন নিহত ও ১৯ জন আহত হয়। মুসলিম পক্ষে একজন নিহত হন। জনৈক আনছার তাকে শত্রু ভেবে ভুলক্রমে হত্যা করেন। গোত্রনেতা হারেছ কন্যা জুওয়াইরিয়া (جويرية) -এর সঙ্গে রাসূলের বিবাহ হয়। ফলে শ্বশুর গোত্রের লোক হওয়ায় বিজিত দলের একশত পরিবারকে মুক্তি দিলে তারা সবাই ইসলাম কবুল করে। এই যুদ্ধে ওহোদ যুদ্ধের পর সর্বপ্রথম মুনাফিকদের একটি দলকে রাসূলের সাথে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। এই যুদ্ধ হ’তে ফেরার সময় ইফকের ঘটনা ঘটে। এই সময় সূরা মুনাফিকূন নাযিল হয় এবং পরে হযরত আয়েশার পবিত্রতা বর্ণনায় সূরা নূর ১১-২০ পর্যন্ত ১০টি আয়াত নাযিল হয়।
৪৪। সারিইয়া আব্দুর রহমান ইবনে ‘আওফ (سرية عبد الرحمن بن عوف القرشي) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে। দূমাতুল জান্দাল এলাকায় বনু কলব খৃষ্টান গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয় এবং সহজ বিজয় অর্জিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে তার মাথায় পাগড়ী বেঁধে দেন ও যুদ্ধে সর্বোত্তম পন্থা গ্রহণের উপদেশ দেন। তিনি এখানে তিনদিন অবস্থান করে সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দেন। ফলে খৃষ্টান গোত্রনেতাসহ সকলে মুসলমান হয়ে যায়।
৪৫। সারিইয়া আলী ইবনে আবু ত্বালিব (سرية على بن أبي طالب) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে। ২০০ জনের একটি সেনাদল নিয়ে হযরত আলী (রাঃ) খায়বরের ফিদাক অঞ্চলে বনু সা‘দ বিন বকর গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হন, যারা ইহুদীদের সাহায্যার্থে প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। বনু সা‘দ পালিয়ে যায়। তাদের ফেলে যাওয়া ৫০০ উট ও ২০০০ ছাগল মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হয়।
৪৬। সারিইয়া আবুবকর ছিদ্দীক (سرية أبي بكر الصديق) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাসে। ওয়াদিল ক্বোরা এলাকার বনু ফাযারাহ গোত্রের একটি শাখার নেত্রী উম্মে কুরফা (أم قرفة) ৩০ জন সশস্ত্র ব্যক্তিকে প্রস্ত্তত করেছে রাসূলকে অপহরণ ও হত্যা করার জন্য। এই ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হয়ে হযরত আবু বকর অথবা হযরত যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সেখানে একটি বাহিনী প্রেরিত হয়। উক্ত ৩০ জনের সবাইকে হত্যা করা হয় এবং দলনেত্রীর কন্যা অন্যতম সেরা আরব সুন্দরী মেয়েকে (من أحسن العرب) দাসী হিসাবে মক্কায় পাঠিয়ে তার বিনিময়ে সেখান থেকে কয়েকজন মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করা হয়।[4]
৪৭। সারিইয়া কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী (سرية كرز بن جابر الفهري) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসে উরাইনা গোত্রের প্রতি তিনি ২০ জন অশ্বারোহী সহ প্রেরিত হন। দলনেতা কুরয ছিলেন কুরায়েশ নেতা, যিনি ২য় হিজরীর রবীউল আওয়াল মাসে সর্বপ্রথম মদীনার উপকণ্ঠে হামলা চালিয়ে বহু গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যান এবং রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং যার পশ্চাদ্ধাবন করে বদরের উপকণ্ঠে সাফওয়ান পর্যন্ত পৌঁছে যান (দ্রঃ গাযওয়া সাফওয়ান ক্রমিক সংখ্যা-৬)। পরে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং মক্কা বিজয়ের দিন শহীদ হন। অত্র অভিযানের কারণ ছিল এই যে, ওক্ল ও উরাইনা (عكل وعرينة) গোত্রের কিছু লোক ইসলাম কবুল করে মদীনায় বসবাস করতে থাকে। কিন্তু তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে কিছু দূরে উটের চারণ ক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে তাদেরকে উটের দুধ ও পেশাব পান করতে বলা হয়। এতে তারা দ্রুত সুস্থতা লাভ করে। কিন্তু একদিন তারা রাসূলের রাখালকে হত্যা করে উটগুলো সব নিজেদের এলাকায় খেদিয়ে নিয়ে যায় এবং পুনরায় কাফির হয়ে যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়।
অভিযান প্রেরণের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করেছিলেন যে, اللهم اعم عليهم الطريق واجعلها عليهم اضيق من مسك ‘আল্লাহ তুমি ওদের রাস্তা অন্ধকার করে দাও এবং তা তাদের উপরে …. চাইতে সংকীর্ণতর করে দাও’। প্রেরিত সেনাদল তাদের গ্রেফতার করেন এবং হাত-পা কেটে ও চোখ অন্ধ করে ‘হাররাহ’ (حرّة) নামক স্থানে ছেড়ে দেন। সেখানেই তারা মরে পড়ে থাকে।[5] মানছূরপুরী এদের সংখ্যা ৮ জন বলেছেন।
অভিযান প্রেরণের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করেছিলেন যে, اللهم اعم عليهم الطريق واجعلها عليهم اضيق من مسك ‘আল্লাহ তুমি ওদের রাস্তা অন্ধকার করে দাও এবং তা তাদের উপরে …. চাইতে সংকীর্ণতর করে দাও’। প্রেরিত সেনাদল তাদের গ্রেফতার করেন এবং হাত-পা কেটে ও চোখ অন্ধ করে ‘হাররাহ’ (حرّة) নামক স্থানে ছেড়ে দেন। সেখানেই তারা মরে পড়ে থাকে।[5] মানছূরপুরী এদের সংখ্যা ৮ জন বলেছেন।
৪৮। সারিইয়াহ আমর ইবনে উমাইয়া যামরী (سرية عمرو بن أمية الضمري) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসে। সালামাহ বিন আবু সালামাহ সহ দুইজনের এই ক্ষুদ্র দলটি প্রেরিত হয় আবু সুফিয়ানকে হত্যা করার জন্য। কেননা তিনি ইতিপূর্বে একজন বেদুঈনকে মদীনায় পাঠিয়েছিলেন রাসূলকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু কারু কোন অভিযানই সফল হয়নি।
৪৯। সারিইয়া আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (سرية أبي عبيدة بن الجراح) : ৬ষ্ঠ হিজরীতে যুলক্বা‘দাহ মাসে হুদায়বিয়া সন্ধির পূর্বে। আবু ওবায়দাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৩০০ অশ্বারোহীর এ দলটি প্রেরিত হয় একটি কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য। অভিযানে কোন ফল হয়নি। কিন্তু সেনাদল দারুণ অন্নকষ্টে পতিত হন। ফলে তাদের গাছের ছাল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়। সেকারণ এই অভিযান جيش الخبط বা ‘ছাল-পাতার অভিযান’ নামে অভিহিত হয়। এই সময় সমুদ্র হ’তে একটি বিশালাকারের মাছ কিনারে নিক্ষিপ্ত হয়। যাকে আম্বর (العنبر) বলা হয়। বাংলাতে যা ‘তিমি মাছ’ বলে পরিচিত। এই মাছ তারা ১৫দিন যাবৎ ভক্ষণ করেন। এই মাছ এত বড় ছিল যে, সেনাপতির হুকুমে তার একটি কাঁটার ঘেরের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যকার সবচেয়ে দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি সবচেয়ে উঁচু উটটির পিঠে আরোহন করে অনায়াসে চলে যায়। বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে উক্ত মাছের কিছু অংশ মদীনায় আনা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘হাদিয়া’ প্রদান করা হয়। তিনি বলেন, هو رزق أخرجه الله لكم ‘এটি রূযী, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্গত করেছিলেন’।[6]
৫০। গাযওয়া হুদায়বিয়া (غزوة حديبية) : ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার স্ত্রী উম্মে সালামাহ সহ মদীনা হ’তে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত তাদের সাথে অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মক্কার অদূরবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কুরায়েশ নেতাদের বাধার সম্মুখীন হন। অবশেষে তাদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে চুক্তির শর্তানুযায়ী তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর ওমরা করেন। এই সময় ‘আসফান’ (عسفان) নামক স্থানে সর্বপ্রথম ছালাতুল খাওফের হুকুম নাযিল হয় (নিসা ১০১-১০২)। কেননা খালেদ বিন ওয়ালীদ আছরের ছালাতের সময় ছালাতরত অবস্থায় মুসলমানদের উপরে হামলা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। উল্লেখ্য, খালিদ তখনও মুসলমান হননি। খালেদ ও আমর ইবনুল আছ ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন।
৫১। গাযওয়া যী ক্বারদ (غزوة ذي قرد أو الغابة) : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে এটাই ছিল রাসূলের প্রথম যুদ্ধ, যা খায়বর যুদ্ধে গমনের মাত্র তিনদিন পূর্বে সংঘটিত হয়। বনু গাত্বফানের ফাযারা গোত্রের আব্দুর রহমান ফাযারীর নেতৃত্বে একটি ডাকাত দল মদীনায় এসে রাসূলের রাখালকে হত্যা করে চারণ ভূমি থেকে রাসূলের উট সমূহ লুট করে নিয়ে যায়। দক্ষ তীরন্দায সালামা বিন আকওয়া একাই পদব্রজে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে যী ক্বারদ প্রস্রবণ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তাড়িয়ে নিয়ে যান। তারা সমস্ত উট ছাড়াও তাদের নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। পিছে পিছে রাসূল (ছাঃ) ৫০০ ছাহাবীর এক বাহিনী নিয়ে সন্ধ্যার পরে উপস্থিত হন। ডাকাত দলের নেতা আব্দুর রহমানের নিক্ষিপ্ত বর্শার আঘাতে ছাহাবী আখরাম শহীদ হন। পরে আবু ক্বাতাদার বর্শার আঘাতে আব্দুর রহমান নিহত হয়। সালামা বিন আকওয়া-এর দুঃসাহস ও বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে গনীমতের দুই অংশ দান করেন এবং মদীনায় ফেরার সময় সম্মান স্বরূপ নিজের উটের পিঠে তাকে বসিয়ে নেন।
৫২। গাযওয়া খায়বর (غزوة خيبر) : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহুদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়‘আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদের নেননি। এতে মুসলিম পক্ষে ১৮ জন শহীদ ও ৫০ জন আহত হন। ইহুদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়। ইহুদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয়। যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গনীমত লাভ হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফিদাকের ইহুদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাইছাহ বিন মাসঊদকে প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পরে তারা নিজেরা রাসূলের নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূলের দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফিদাক ভূমি কেবল রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।
৫৩। গাযওয়া ওয়াদিল ক্বোরা (غزوة وادي القرى) : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। খায়বার যুদ্ধের পরে রাসূল (ছাঃ) এখানকার ইহুদীদের প্রতি গমন করেন। দিনভর যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে রাসূলের একজন দাস এবং ইহুদী পক্ষে ১১ জন নিহত হয়। বিপুল গনীমত হস্তগত হয়। ইহুদীরা সন্ধি করে এবং চাষের জমিগুলি তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ দেওয়ার শর্তে, যেভাবে খায়বারে করা হয়েছিল। ফেদাক ও তাইমার ইহুদীরা বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে ও সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করে।
৫৪। সারিইয়া আবান বিন সাঈদ (سرية أبان بن سعيد) : ৭ম হিজরীর ছফর মাসে মদীনার আশপাশের লুটেরা বেদুঈনদের ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আবান বিন সাঈদের নেতৃত্বে নাজদের দিকে প্রেরিত হয় এবং যথাসময়ে তারা অভিযান সফল করে ফিরে আসে।[7]
৫৫। গাযওয়া যাতুর রিক্বা‘ (غزوة ذات الرقاع) : ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। খন্দকের যুদ্ধে শত্রুদের তিনটি প্রধান পক্ষের দু’টি অর্থাৎ কুরায়েশ ও ইহুদী পক্ষকে দমন করার পর তৃতীয় শক্তি নাজদের বনু গাত্বফানের দিকে এই অভিযান প্রেরিত হয়, যারা প্রায়ই মদীনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুটতরাজ করত। এদের কোন স্থায়ী জনপদ বা দুর্গ ছিল না। এরা ছিল সুযোগসন্ধানী ডাকাত দল। তাই মক্কা ও খায়বরবাসীদের ন্যায় এদের দমন করা সহজ ছিল না। ফলে এদের বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সমূহ প্রতিহত করার জন্য অনুরূপ আকস্মিক হামলা সমূহ পরিচালনা করার প্রয়োজন ছিল। সেমতে খায়বর বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ৪০০ অথবা ৭০০ সাথী নিয়ে এদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আনমার অথবা বনু গাত্বফানের ছা‘লাবা ও মুহারিব গোত্রের লোকেরা একত্রিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে মর্মে সংবাদ পেয়ে তিনি অগ্রসর হন এবং নাখল (نخل) নামক স্থানে তাদের মুখোমুখি হন। কিন্তু তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আবু মূসা আশ‘আরী বলেন, আমাদের ৬ জনের জন্য মাত্র একটি উট ছিল, যা আমরা পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলাম। এ কারণে আমাদের পা সমূহ আহত হয় ও আমার নখ ঝরে পড়ে। ফলে আমরা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পায়ে পট্টি বাঁধি। এ কারণ এ যুদ্ধের নাম হয় যাতুর রিক্বা‘ বা ছেঁড়া পট্টির যুদ্ধ।[8]
সরাসরি যুদ্ধ না হ’লেও এই অভিযানে অনেকগুলি ঘটনা ঘটে। যেমন, (১) তরবারি গাছে ঝুলিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগে জনৈক মুশরিক বেদুঈন গাওরাছ ইবনুল হারেছ অথবা দা‘ছূর এসে রাসূলের তরবারি নিয়ে নেয় ও তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) যখন বলেন যে, আমাকে রক্ষা করবেন ‘আল্লাহ’ তখন তার হাত থেকে তরবারি পড়ে যায় এবং পরে সে মুসলমান হয়ে যায়। (২) রাসূল (ছাঃ) সবাইকে নিয়ে ‘ছালাতুল খাওফ’ আদায় করেন (৩) যুদ্ধ হ’তে ফেরার পথে বন্দীনী এক মুশরিক মহিলার স্বামী বদলা হিসাবে মুসলিম বাহিনীর রাতের বেলায় বিশ্রামের সুযোগে পাহারায় নিযুক্ত ছাহাবী আববাদ বিন বিশরের উপরে ছালাতরত অবস্থায় তিন তিনটি তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে মারাত্মক আহত করা সত্ত্বেও তিনি ছালাত ভঙ্গ করেননি। পরে অন্য পাহারা আম্মার বিন ইয়াসার যখন বলেন, আমাকে কেন জাগাননি? তখন তিনি বলেন, إنِّيْ كُنْتُ فِيْ سُوْرَةٍ فَكَرِهْتُ أَنْ اَقْطَعَهَا ‘আমি একটি সূরা পাঠ করছিলাম। যা থেকে বিরত হওয়াটা আমি অপসন্দ করেছিলাম’।
এই অভিযানের ফলে বনু গাত্বফানের লোকেরা আর মাথা উঁচু করেনি। তারা ক্রমে ক্রমে সবাই ইসলাম কবুল করে। তাদের অনেকে মক্কা বিজয়ের অভিযানে ও তার পরে হুনায়েন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সাথে ছিল এবং হুনায়েনের গনীমতের অংশ লাভ করেছিল।
৫৬। সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী (سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ৭ম হিজরীর ছফর অথবা রবীউল আউয়াল মাস। ক্বাদীদ (قديد) অঞ্চলের বনু মলূহ (بنو ملوح) গোত্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক এই অভিযান প্রেরিত হয়েছিল। কেননা তারা ইতিপূর্বে বাশীর বিন সুওয়াইদের (بشير بن سويد) সাথীদের হত্যা করেছিল। রাতেই হামলা করে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয় ও গবাদি-পশু নিয়ে সেনাদল ফিরে আসে। প্রতিপক্ষ বিরাট দল নিয়ে পশ্চাদ্ধাবন করলেও হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামায় তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে ও মুসলিম বাহিনী নিরাপদে ফিরে আসে।
৫৭। সারিইয়া যায়েদ বিন হারেছাহ (سرية زيد بن حارثة) : ৭ম হিজরী জুমাদাল আখেরাহ। রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের নিকটে রাসূলের প্রেরিত দূত ও পত্রবাহক দেহিইয়া কালবী সম্রাট প্রদত্ত উপঢৌকনাদিসহ ফেরার পথে হুসমা (حسمى) নামক স্থানে পৌঁছলে জুযাম (جذام) গোত্রের কিছু লোক তার উপরে হামলা করে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। মদীনায় ফিরে তিনি নিজ গৃহে প্রবেশের আগে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হয়ে সব ঘটনা বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ৫০০ সৈন্যের একটি দল হুসমার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তারা জুযাম গোত্রের কিছু লোককে হত্যা করেন এবং ১০০০ উট, ৫০০০ ছাগল ও শ’খানেক নারী ও শিশুকে পাকড়াও করে মদীনায় ফিরে আসেন।
উক্ত গোত্রের সাথে যেহেতু পূর্বেই সন্ধিচুক্তি ছিল এবং অন্যতম গোত্র নেতা যায়েদ সহ কয়েকজন আগেই ইসলাম কবুল করেছিল ও তারা ডাকাত দলের বিরুদ্ধে দেহিইয়াকে সাহায্য করেছিল, সেহেতু যায়েদ বিন রেফা‘আহ জুযামী কালবিলম্ব না করে মদীনায় আসেন ও রাসূলের নিকটে সবকিছু বর্ণনা করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে গণীমতের সব মাল ফেরৎ দানের নির্দেশ দেন।
৫৮। সারিইয়া ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (سرية عمر بن الخطاب) : ৭ম হিজরীর শা‘বান মাস। হাওয়াযেন গোত্রের বিরুদ্ধে তুরবাহ (ةربة) নামক স্থানে ৩০ জনের এই অভিযান প্রেরিত হয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ ভয়ে পালিয়ে যায়। ওমর (রাঃ) সেখানে পৌঁছে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসেন।
৫৯। সারিইয়া আবুবকর ছিদ্দীক (سرية أبي بكر الصديق) : বনু কেলাব গোত্রের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়। এরা বনু গাত্বফানের মুহারিব ও আনমার গোত্র সমূহের সহযোগী ছিল এবং মুসলমানদের উপরে হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হয়। শত্রুদের কিছু নিহত ও কিছু আহত হয়।[9]
৬০। সারিইয়া বাশীর বিন সা‘দ (سرية بشير بن سعد الأنصاري) : ৭ম হিজরীর শা‘বান মাস। খায়বরের ফিদাক অঞ্চলের সীমান্তবর্তী বনু মুররাহ গোত্রের বিরুদ্ধে বাশীর বিন সা‘দ আনছারীর নেতৃত্বে ৩০ জনের এই সেনাদল প্রেরিত হয়। তিনি সেখানে পৌঁছে কাউকে না পেয়ে কিছু গবাদিপশু খেদিয়ে নিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হন। কিন্তু রাত্রি বেলায় শত্রুদল পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের উপরে অতর্কিতে হামলা করে। এমন সময় তাদের তীর ফুরিয়ে যাওয়ায় সবাই শহীদ হয়ে যান। দলনেতা বাশীর আহত অবস্থায় ফিদাকে নীত হন এবং এক ইহুদীর নিকটে অবস্থান করেন। পরে সুস্থ হয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। উল্লেখ্য যে, ফিদাকের ইহুদীদের সাথে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর যুদ্ধের সময় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
৬১। সারিইয়া গালেব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী (سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ৭ম হিজরীর রামাযান মাস। বনু আওয়াল (بنو عوال) অথবা জুহায়না (جهينة) গোত্রের বিরুদ্ধে মীফা‘আহ[10] অথবা হারাক্বাত (حرقات) নামক স্থানে ১৩০ জনের এই সেনাদল প্রেরিত হয়। যুদ্ধে তারা জয়ী হন এবং উট ও গবাদি-পশু নিয়ে ফিরে আসেন।
এই যুদ্ধে তরুণ যোদ্ধা উসামা বিন যায়েদ (ঐ সময় তাঁর বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে) শত্রু পক্ষের মিরদাস বিন নাহীক (مرداس بن نهيك) -কে হত্যা করেন কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করার পরেও (তিনি ভেবেছিলেন যে, লোকটি মৃত্যুর ভয়ে কলেমা পাঠ করেছে)। একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুবই মর্মাহত হন এবং তাকে বলেন, فَهَلاَّ شققتَ عن قلبه فتعلم أصادق هو أم كاذب؟ ‘তাহ’লে কেন তুমি তার অন্তর চিরে দেখলে না, সে সত্যবাদী ছিল না মিথ্যাবাদী ছিল’?[11]
৬২। সারিইয়া আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (سرية عبد الله بن رواحة) : ৭ম হিজরীর শাওয়াল মাস।[12] ৩০ জন অশ্বারোহীর এই দলটি খায়বরে প্রেরিত হয় আসীর অথবা বাশীর বিন রেযাম (أسير أو بشير بن رزام) -কে দমন করার জন্য। কেননা তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বনু গাত্বফানকে একত্রিত করছিল। আসীরকে এই বলে প্রলুব্ধ করা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তোমাকে খায়বরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করবেন’। আসীর তার ত্রিশজন সঙ্গীসহ মুসলমানদের সাথে মদীনায় রওয়ানা হয়। কিন্তু পথিমধ্যে কুধারণার বশবর্তী হয়ে উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয় এবং আসীর ও তার ৩০ সাথীর সকলে নিহত হয়।
৬৩। সারিইয়া বাশীর বিন সা‘দ (سرية بشير بن سعد الأنصاري) : ৭ম হিজরীর শাওয়াল মাস। বনু গাত্বফান অথবা ফাযারা গোত্রের ইয়ামন ও জাবার এলাকায় ৩০০ সৈন্যের এই দলটি প্রেরিত হয়। কেননা শত্রুরা তখন মদীনার সীমান্তবর্তী অঞ্চল সমূহের উপরে হামলার জন্য বিরাট একটি দল একত্রিত করেছিল। মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাদের দল বিক্ষিপ্ত হয়ে পালিয়ে যায়। বহু গনীমত হস্তগত হয় ও দু’জনকে বন্দী করে মদীনায় আনা হ’লে তারা মুসলমান হয়ে যায়।
৬৪। সারিয়াহ আবু হাদরাদ আসলামী (سرية أبي حدرد الأسلمي) : ৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে রাসূলের ওমরাহ পালনের পূর্বে। মাত্র দু’জন সঙ্গী সহ আবু হাদরাদকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রেরণ করেন জাশম বিন মু‘আবিয়া (جشم بن معاوية) গোত্রের একটি দলের বিরুদ্ধে বনু গাত্বফানের গাবাহ (الغابة) নামক স্থানে। যেখানে তারা জমা হয়েছিল ক্বায়েস গোত্রের লোকরদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল করার জন্য। আবু হাদরাদ (রাঃ) সেখানে গিয়ে এমন এক যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন যে, শত্রুপক্ষ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং বহু উট ও গবাদি পশু হস্তগত হয়।
৬৫। সারিইয়া ইবনু আবিল ‘আওজা (سرية ابن أبي العوجاء) : ৭ম হিজরীর যিলহাজ্জ মাস। বনু সুলায়েম (بنو سليم) গোত্রকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য ৫০ জনের এই দলটিকে পাঠানো হয়। কিন্তু তারা অগ্রাহ্য করে বলে, لا حاجة لنا إلى ما دعوتنا ‘তুমি যেদিকে আমাদের আহবান করছ, আমাদের তার কোন প্রয়োজন নেই’। অতঃপর তারা মুসলিম দলটির বিরুদ্ধে ঘোরতর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দলনেতা আহত হন। তবে শত্রু পক্ষের দু’জনকে তারা বন্দী করতে সক্ষম হন।[13]
৬৬। সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী (سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ৮ম হিজরীর ছফর মাস। ২০০ লোকের একটি সেনাদল নিয়ে তিনি ফেদাক অঞ্চলের বনু মুররাহ গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হন বশীর বিন সা‘দের ৩০ জন সাথীর শাহাদাত স্থলে। যা ৭ম হিজরীর শা‘বান মাসে সংঘটিত হয়েছিল। শত্রুদের অনেকে নিহত হয় ও বহু গবাদি পশু হস্তগত হয়।
৬৭। সারিইয়াহ যাতে আত্বলাহ (سرية ذات أطلح) : ৮ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। মুসলমানদের উপরে হামলা করার জন্য বনু কুযা‘আহ (بنو قضاعة) বিরাট একটি দলকে একত্রিত করছে জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘ব বিন ওমায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি সেনাদল সেখানে প্রেরণ করেন। তারা যাতু আত্বলাহ (ذات أطلح) নামক স্থানে শত্রুদের মুখোমুখি হন। তাঁরা প্রথমে তাদের ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যাতে সকল ছাহাবীকে তীর দিয়ে ছিদ্র করে করে শহীদ করা হয় নিহতদের মধ্যে একজন মাত্র কোনভাবে বেঁচে যান।
৬৮। সারিইয়াহ যাতে ইরক্ব (سرية ذات عرق) : ৮ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বনু হাওয়াযেন গোত্র বারবার শত্রুদের সাহায্য করে যাচ্ছিল। ফলে তাদের দমনের জন্য শুজা‘ বিন ওয়াহাব আল-আসাদীর নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি সেনাদল উক্ত গোত্রের যাতু ইরক্ব (ذات عرق) নামক স্থানে প্রেরিত হয়। যুদ্ধ হয়নি। তবে কিছু গবাদি পশু হস্তগত হয়।
৬৯। সারিইয়া মুতা (سرية مؤةة) : ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মোতাবেক ৬২৯ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাস। রোম সম্রাট ক্বায়ছারের পক্ষ হ’তে সিরিয়ার বালক্বায় (البلقاء) নিযুক্ত গবর্ণর শোরাহবীল বিন আমর আল-গাসসানীর নিকটে পত্র সহ প্রেরিত রাসূলের দূত হারেছ বিন উমায়ের আযদীকে হত্যা করা হয়। যা ছিল তৎকালীন সময়ের রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ফলে মুসলমানদের যুদ্ধ করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। অতএব যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরিত হয়। পক্ষান্তরে শোরাহবীলের ছিল প্রায় ২ লাখ সৈন্যের এক বিশাল খৃষ্টান বাহিনী। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নিকটবর্তী ‘মুতা’ নামক স্থানে সংঘটিত এই যুদ্ধে সেনাপতি যায়েদ বিন হারেছাহ, অতঃপর সেনাপতি জাফর বিন আবু ত্বালিব, অতঃপর সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা পরপর শহীদ হ’লে সকলের ঐক্যমতে খালিদ বিন ওয়ালীদ সেনাপতি হন। তিনি সম্মুখের দলকে পিছনে, পিছনের দলকে সম্মুখে ডাইনের দলকে বামে এবং বামের দলকে ডাইনে নিয়ে এক অপূর্ব রণকৌশলের মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীকে সসম্মানে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনেন। নতুন সেনাদল যুক্ত হয়েছে ভেবে এবং মুসলমানেরা তাদেরকে মরু প্রান্তরে নিক্ষেপ করবে সেই ভয়ে রোমানরা পিছু হটে যায়। মুসলিম বাহিনীর মাত্র ১২ জন শহীদ হন। রোমক বাহিনীর হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও একা খালেদ বিন ওয়ালীদের যেখানে নয় খানা তরবারি ভেঙ্গেছিল, তাতে অনুমান করা চলে কত সৈন্য তাদের ক্ষয় হয়েছিল।
তৎকালীন বিশ্বের এই সেরা পরাশক্তির সঙ্গে মুসলিম বাহিনীর এই বীরত্বপূর্ণ মুকাবিলায় খৃষ্টান বিশ্ব যেমন ভয়ে চমকে যায়, আরব বিশ্ব তেমনি হতচকিত হয়ে পড়ে। মাথা উঁচু করার স্বপ্ন ভুলে গিয়ে চির বৈরী বনু গাত্বফান, বনু সুলায়েম, বনু আশজা‘, বনু যুবিয়ান, বনু ফাযারাহ প্রভৃতি গোত্রগুলো ইসলাম কবুল করল। অন্যদিকে রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন আরব অঞ্চলে ও দূরবর্তী অঞ্চল সমূহে মুসলিম বিজয়ের সূচনা হ’ল।
৭০। সারিইয়া যাতুস সালাসেল (سرية ذات السلاسل) : ৮ম হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ। আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রথমে ৩০০ এবং পরে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ২০০ মোট ৫০০ সৈন্যের এই দলটি সিরিয়া সীমান্তে বনু কুযা‘আহ (بنو قضاعة) গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয়। এরা রোমানদের সঙ্গে মিলে মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। মুসলিম বাহিনী উক্ত গোত্রের ‘সালসাল’ (السلسل) নামক প্রস্রবণের নিকটে অবতরণ করে বিধায় অভিযানটির নাম হয় ‘যাতুস সালাসেল’। শত্রুরা ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। শেষোক্ত সাহায্যকারী বাহিনীতে হযরত আবু বকর ও ওমর (রাঃ) ছিলেন। কিন্তু আমর ইবনুল আছকে সেনাপতি করার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তাঁর দাদী অর্থাৎ পিতার মা ছিলেন অত্র এলাকার ‘বালী’ (بلى) গোত্রের মহিলা। সেই সুবাদে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে তারা রোমকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুসলমানদের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়।
৭১। সারিইয়া আবু ক্বাতাদাহ (سرية أبي قةادة) : ৮ম হিজরীর শা‘বান মাস। নাজদের বনু গাত্বফানের শাখা ‘মুহারিব’ (محارب) গোত্রের লোকেরা মদীনায় হামলার জন্য তাদের এলাকায় খাযেরাহ (خضرة) নামক স্থানে সেনা প্রস্ত্তত করছে জানতে পেরে ১৫ জনের এই দলটি প্রেরিত হয়। তারা তাদের অনেককে হত্যা করেন ও বাকীরা পালিয়ে যায়। অনেক গনীমত হস্তগত হয়। তারা এ সফরে ১৫ দিন মদীনার বাইরে থাকেন।
৭২। গাযওয়া ফাৎহে মাক্কা (غزوة فةح مكة) বা মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ : ৮ম হিজরীর ১০ই রামাযান মঙ্গলবার ১০,০০০ ছাহাবী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা হ’তে রওয়ানা হন এবং ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার আকস্মিকভাবে মক্কায় উপস্থিত হন ও একপ্রকার বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। মুসলিম পক্ষে দলছুট ২ জন শহীদ ও কাফের পক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রবর্তী ১২ জন নিহত হয়। মক্কা বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ৬ষ্ঠ হিজরীর যুল-ক্বা‘দাহ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করার অপরাধেই কুরায়েশদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
৭৩। সারিইয়া খালেদ বিন ওয়ালীদ (سرية خالد بن وليد) : ৮ম হিজরীর ২৫ রামাযান। কুরায়েশ ও বনু কেনানার সবচেয়ে বড় দেবতা উযযা (العزى) দেবীমূর্তি ভাঙ্গার জন্য একটি ছোট্ট সেনাদল সহ তিনি ‘নাখলা’ উপত্যকায় প্রেরিত হন। মূর্তি ভেঙ্গে ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পুনরায় পাঠান। সেবারে একজন বিক্ষিপ্ত চুলবিশিষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ নগ্ন নারীকে বেরিয়ে আসতে দেখে খালেদ তাকে এক কোপে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন। ফিরে এসে এ ঘটনা বললে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, نعم تلك العزي وقد أيست أن تعبد في بلادكم أبدًا ‘হাঁ এটাই উযযা। তোমাদের দেশে পূজা পাওয়ার ব্যাপারে সে এখন চিরকালের জন্য নিরাশ হয়ে গেল’।[14] ‘মূর্তিপূজারীরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নারীদের আহবান করে’ (নিসা ১১৭)-এর ব্যাখ্যায় ছাহাবী উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, مع كل صنم جنية ‘হাঁ, প্রত্যেক মূর্তির সাথে একজন করে মাদী জিন থাকে’।[15] এরা মানুষকে অলক্ষ্যে থেকে প্রলুব্ধ করে এবং দলে দলে লোকেরা বিভিন্ন মূর্তি, প্রতিকৃতি, বেদী, মিনার ও কবরে গিয়ে অযথা শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং মিথ্যা আশায় প্রার্থনা করে। যে বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ হ’তে কোনরূপ দলীল অবতীর্ণ হয়নি।
৭৪। সারিইয়াহ ‘আমর ইবনুল ‘আছ (سرية عمرو بن العاص) : ৮ম হিজরীর রামাযান মাস। মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে রেহাত (رهاط) নামক স্থানে রক্ষিত হোযায়েল গোত্রের বড় দেবমূর্তি সুওয়া‘ (سواع) ভেঙ্গে ফেলার জন্য আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে একদল সঙ্গীসহ প্রেরণ করা হয়। প্রহরী বলল, তুমি এ কাজে সক্ষম হবে না। স্বাভাবিক ভাবেই তুমি বাধাপ্রাপ্ত হবে’। তিনি বললেন, তোমরা এখনো বাতিলের উপরে আছ? এ মূর্তি কি শুনতে পায় না দেখতে পায়? বলেই তিনি ওটাকে গুঁড়িয়ে দিলেন’। প্রহরীকে বললেন, এবার তোমার মত কি? সে বলল, أسلمت لله ‘আমি আল্লাহর জন্য ইসলাম কবুল করলাম’।
৭৫। সারিইয়া সা‘দ বিন যায়েদ আশহালী (سرية سعد بن زيد الأشهلى) : ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে। ২০ জন অশ্বারোহী দল সহ সা‘দ বিন যায়েদ (রাঃ)-কে অন্যতম প্রসিদ্ধ দেবী মূর্তি মানাত (مناة) -কে ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করা হয়, যা ক্বাদীদের (قديد) মোশাল্লাল (مشلل) নামক জায়গায় স্থাপিত ছিল। এই মূর্তিকে বিশেষ করে আউস, খাযরাজ ও গাসসান গোত্রের লোকেরা পূজা করত। সা‘দ মূর্তির দিকে অগ্রসর হ’তেই একটি কৃষ্ণাঙ্গ ও বিক্ষিপ্ত চুল বিশিষ্ট উলঙ্গ নারীকে স্বীয় বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়ে আসতে দেখেন। এ সময় সে কেবল হায় হায় করছিল (تدعو بالويل)। সা‘দ তাকে এক আঘাতে খতম করে দিলেন। অতঃপর মূর্তি ও ভান্ডারগৃহ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলেন।
৭৬। সারিইয়া খালেদ বিন ওয়ালীদ (سرية خالد بن وليد) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। মুহাজেরীন, আনছার ও বনু সুলায়েম গোত্রের সমন্বয়ে ৩৫০ জনের একটি দলকে বনু জুযাইমা (بنو جُذَيْمَة) গোত্রের লোকদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য পাঠানো হয়, যুদ্ধের জন্য নয়। কিন্তু স্থানীয়রা স্পষ্টভাবে أسلمنا ‘আমরা ইসলাম কবুল করলাম’ না বলে صبأنا ‘আমরা ধর্মত্যাগী হয়েছি’ বলে। এতে সন্দেহে পতিত হয়ে খালেদ তাদের হত্যা করতে থাকেন ও বন্দী করতে থাকেন এবং পরে প্রত্যেকের নিকটে ধৃত ব্যক্তিকে হত্যা করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেন। কিন্তু বনু সোলায়েম ব্যতীত মুহাজেরীন ও আনছার ছাহাবীগণ কেউ এ নির্দেশ মানেননি। এ ব্যাপারে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) ও তার সাথীগণ ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সব ঘটনা বললে তিনি খুবই মর্মাহত হন এবং আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দু’বার বলেন, اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَبْرَأُ إِلَيْكَ مِمَّا صَنَعَ خَالِدُ ‘হে আল্লাহ! খালেদ যা করেছে, আমি তা থেকে তোমার নিকটে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করছি’।[16] উক্ত ঘটনায় খালেদ (রাঃ)-এর সাথে মুহাজির ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন ‘আওফের কিছু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। একথা শুনে খালেদকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, مهلا يا خالد، دع عنك أصحابي، فوالله لو كان لك أُحُدٌ ذهبًا ثم أنفقته في سبيل الله ما أدركتَ غدوة رجل من أصحابي ولا روحته- ‘থেমে যাও খালেদ! আমার ছাহাবীগণ থেকে বিরত হও। আল্লাহর কসম! যদি ওহোদ পাহাড় সোনা হয়ে যায়। আর তা সবটাই তুমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর, তথাপি আমার একজন ছাহাবীর একটি সকাল বা একটি সন্ধ্যার সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না’।[17]
পরে আলী (রাঃ)-কে পাঠিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিহত ব্যক্তিদের রক্তমূল্য এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণ দান করেন। মানছূরপুরী বলেন, এ ঘটনায় বনু জুযাইমার ৯৫ ব্যক্তি নিহত হয়। তবে এই সংখ্যা সঠিক নাও হ’তে পারে। উল্লেখ্য যে, খালেদ বিন ওয়ালীদ ও আমর ইবনুল আছ (রাঃ) ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে এবং বনু সুলায়েম মুতা যুদ্ধের পর ৮ম হিজরীর শেষার্ধ্বে ইসলাম কবুল করেন। সে হিসাবে এঁরা সবাই ছিলেন অপেক্ষাকৃত নতুন মুসলমান।
৭৭। গাযওয়া হোনায়েন (غزوة حنين) বা হুনায়েন যুদ্ধ : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হাওয়াযেন ও ছাক্বীফ গোত্রের আত্মগর্বী নেতারা মক্কা হ’তে আরাফাতের দিকে ২৬ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে হুনায়েন উপত্যকায় মালেক বিন আওফের নেতৃত্বে ৪০০০ দুঃসাহসী সেনার সমাবেশ ঘটায়। ফলে মক্কা বিজয়ের ১৯তম দিনে ৬ই শাওয়াল শনিবার আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কার ২০০০ নও মুসলিম সহ মোট ১২,০০০ সাথী নিয়ে হুনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ১০ই শাওয়াল বুধবার রাতে গিয়ে উপস্থিত হন। যুদ্ধে শত্রুপক্ষে ৭১ জন নিহত হয় ও মুসলিম পক্ষে ৬ জন শহীদ হন। যুদ্ধে বিশাল পরিমাণের গনীমত হস্তগত হয়।
৭৮। গাযওয়া ত্বায়েফ (غزوة طائف) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হুনায়েন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের নেতা মালেক বিন আওফ সহ পরাজিত ছাক্বীফ গোত্রের লোকেরা পালিয়ে গিয়ে ত্বায়েফের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথমে খালিদের নেতৃত্বে ১০০০-এর একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে গমন করেন। তারা তায়েফের দুর্গ অবরোধ করেন। এই অবরোধ কতদিন স্থায়ী ছিল এ বিষয়ে ১৫ দিন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত মতামত রয়েছে। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১২ জনের অধিক শহীদ হন ও অনেকে আহত হন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে ফিরে আসেন। এ সময় ছাহাবীগণ তাঁকে ছাক্বীফ গোত্রের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার আবেদন জানালে তিনি উত্তম দো‘আ করে বলেন, اللهم اهد ثقيفا وآت بهم ‘হে আল্লাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত কর এবং তাদেরকে নিয়ে এসো’।[18] আল্লাহ সেটাই কবুল করলেন এবং কিছুদিন পর তারা নিজেরা এসে ইসলাম কবুল করল।
৭৯। সারিইয়া উয়াইনা বিন হিছন ফাযারী (سرية عيينة بن حصن الفزاري) : ৯ম হিজরীর মুহাররম মাস। বনু তামীম গোত্রের লোকেরা অন্য গোত্রের লোকদের জিযিয়া প্রদান না করার জন্য উত্তেজিত করছিল। সেকারণ তাদের বিরুদ্ধে ‘ছাহরা’ (الصحراء) এলাকায় ৫০ জন অশ্বারোহীর একটি দল প্রেরিত হয়। বনু তামীম পালিয়ে যায়। তাদের পুরুষ-নারী-শিশু মিলে ৬২ জনকে বন্দী করে মদীনায় আনা হয়। পর দিন তাদের ১০ জন নেতা মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করে এবং সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।[19]
৮০। সারিইয়া কুত্ববাহ বিন ‘আমের (سرية قطبة بن عامر) : ৯ম হিজরীর ছফর মাস। তুরবার (ةربة) নিকটবর্তী তাবালা (ةبالة) অঞ্চলে খাছ‘আম (خثعم) গোত্রের একটি শাখার বিরুদ্ধে ২০ জনের এই দলটি প্রেরিত হয়। এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। যুদ্ধে তাদের অনেকে হতাহত হয়। মুসলিম বাহিনী উট, বকরী, নারী সহ অনেক গনীমত নিয়ে ফিরে আসে। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেন।
৮১। সারিইয়া যাহহাক বিন সুফিয়ান কেলাবী (سرية ضحاك بن سفيان الكلابي) : ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বনু কেলাব গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য এই দলটিকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বনু কেলাব তাতে অস্বীকার করে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের একজন নিহত হয়।
৮২। সারিইয়া আলী ইবনে আবী ত্বালেব (سرية على بن أبي طالب) : ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বিখ্যাত খৃষ্টান গোত্র ত্বাঈ (الطيئ) -এর ‘ফুলস’ (الفلس) মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য ১৫০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। মূর্তি ভাঙ্গার পর দানবীর হাতেম তাঈ-এর পরিবার সহ অনেকে বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে সসম্মানে মুক্তি দেন। হাতেম তাঈ-এর বৃদ্ধা কন্যা সাফানাহ (سفانة) মুক্তি পেয়ে পলাতক ভাই খ্যাতনামা বিদ্বান ও গোত্রনেতা ‘আদী ইবনে হাতেমকে পাবার জন্য সিরিয়ায় যান। পরে ‘আদী মদীনায় এসে মুসলমান হয়ে যান।
৮৩। সারিইয়া আলক্বামা বিন মুজযিয আল-মুদলেজী (سرية علقمة بن مجزز المدلجي) : ৯ম হিজরীর রবীউল আখের। হাবশার কিছু নৌদস্যু জেদ্দা তীরবর্তী এলাকায় সমবেত হয়ে মক্কায় হামলা করার ষড়যন্ত্র করছে জানতে পেরে ৩০০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। আলক্বামা একদল সাথী নিয়ে সাগরে নেমে যান ও একটি দ্বীপে পেঁŠছে যান। এ খবর পেয়ে দস্যুদল দ্রুত পালিয়ে যায়।[20] মানছূরপুরী দলনেতার নাম আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ আল-ক্বারশী আস-সাহমী (عبد الله بن حذافة القرشي السهمي) লিখেছেন।[21]
৮৪। গাযওয়া তাবূক (غزوة تبوك) : ৯ম হিজরীর রজব মাস। এটাই ছিল রাসূলের জীবনের শেষ যুদ্ধ এবং যা রোমকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এ সময় মুসলিম বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০,০০০ এবং রোমকদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০-এর বেশী। গত বছরে মুতার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা সরাসরি মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নেয়। তাতে মদীনার সর্বত্র রোমক ভীতির সঞ্চার হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রতিরোধে রোমান সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করলে তারা ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। রামাযান মাসে মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরে আসে।
এই অভিযান কালে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। ৫০ দিনের এই সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে এবং ২০ দিন তাবূকে অবস্থানে ব্যয়িত হয়। এই যুদ্ধকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী ছিল নিম্নরূপ- (১) যুদ্ধের প্রাক্কালে মদীনায় কঠিন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। এমনকি পর্যাপ্ত ভরণ-পোষণ দাবী করায় ও তাতে ব্যর্থ হওয়ায় রাসূল (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীদের সাথে মাসব্যাপী সঙ্গত্যাগের অর্থাৎ ‘ঈলা’ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন (২) অন্য দিকে মুনাফিকরা মুসলিম বাহিনীতে ফাটল সৃষ্টির জন্য ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ তৈরী করে এবং রাসূলকে সেখানে ছালাত আদায়ের আমন্ত্রণ জানায়। তাবূক থেকে ফিরে এসে তিনি সেখানে যাবেন বলে কথা দেন। (৩) যুদ্ধের ফান্ডে দানের প্রতিযোগিতা হয়। আবুবকর (রাঃ) তাঁর সকল সম্পদ মিলিয়ে ৪০০০ দিরহাম, ওমর (রাঃ) তাঁর অর্ধেক সম্পদ, মহিলাগণ তাদের গহনা-পত্র এবং অন্যান্য ছাহাবীগণ তাদের সাধ্যমত দান করেন। এদিন সবার উপরে দান ছিল হযরত ওছমানের। রাসূলের কোলে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও তিনি ৯০০ উট ও ১০০ ঘোড়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দান করে রাসূলের বিশেষ দো‘আ লাভ করেন। কিন্তু মুনাফিকরা দান করা থেকে বিরত থাকে। (৪) দুর্বল অজুহাত দেখিয়ে তিন জন নিষ্ঠাবান মুসলমান এদিন যুদ্ধে যাননি (৫) গড়ে ১৮ জনের একটি দলের জন্য বাহন ছিল মাত্র ১টি উট (৬) গাছের ছাল-পাতা খেয়ে ও যবেহকৃত উটের নাড়ী-ভুঁড়ির পানি পান করে ছাহাবীগণ অতিকষ্টে বেঁচে থাকেন। এজন্য এ যুদ্ধকে ‘জায়শুল ‘উসরাহ’ (جيش العسرة) বা ‘কষ্টের যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়। (৭) ছামূদ জাতির গযবের স্থান ‘হিজর’ অতিক্রম করার সময় সেখানকার পানি পান না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় (৮) মু‘জেযার মাধ্যমে একটি শুষ্ক ঝর্ণা হ’তে অবিরাম পানি নির্গত হয় (৯) ছালাত তাক্বদীম ও তাখীরের মাধ্যমে জমা ও ক্বছর করা হয় (১০) প্রবল ঘুর্ণিঝড়ের ফলে শত্রু পক্ষের মনে ভীতির সঞ্চার হয় (১১) মদীনায় ফেরার সময় একটি সংকীর্ণ গিরিপথে ১২ জন মুখোশ ধারী মুনাফিক রাসূলকে হত্যা প্রচেষ্টা চালায় (১২) তাবূক থেকে ফেরার দিন মদীনায় কিশোর-কিশোরীরা বিজয়ী রাসূলকে জানায় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় طلع البدر علينا… বলে।
এই অভিযান কালে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। ৫০ দিনের এই সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে এবং ২০ দিন তাবূকে অবস্থানে ব্যয়িত হয়। এই যুদ্ধকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী ছিল নিম্নরূপ- (১) যুদ্ধের প্রাক্কালে মদীনায় কঠিন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। এমনকি পর্যাপ্ত ভরণ-পোষণ দাবী করায় ও তাতে ব্যর্থ হওয়ায় রাসূল (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীদের সাথে মাসব্যাপী সঙ্গত্যাগের অর্থাৎ ‘ঈলা’ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন (২) অন্য দিকে মুনাফিকরা মুসলিম বাহিনীতে ফাটল সৃষ্টির জন্য ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ তৈরী করে এবং রাসূলকে সেখানে ছালাত আদায়ের আমন্ত্রণ জানায়। তাবূক থেকে ফিরে এসে তিনি সেখানে যাবেন বলে কথা দেন। (৩) যুদ্ধের ফান্ডে দানের প্রতিযোগিতা হয়। আবুবকর (রাঃ) তাঁর সকল সম্পদ মিলিয়ে ৪০০০ দিরহাম, ওমর (রাঃ) তাঁর অর্ধেক সম্পদ, মহিলাগণ তাদের গহনা-পত্র এবং অন্যান্য ছাহাবীগণ তাদের সাধ্যমত দান করেন। এদিন সবার উপরে দান ছিল হযরত ওছমানের। রাসূলের কোলে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও তিনি ৯০০ উট ও ১০০ ঘোড়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দান করে রাসূলের বিশেষ দো‘আ লাভ করেন। কিন্তু মুনাফিকরা দান করা থেকে বিরত থাকে। (৪) দুর্বল অজুহাত দেখিয়ে তিন জন নিষ্ঠাবান মুসলমান এদিন যুদ্ধে যাননি (৫) গড়ে ১৮ জনের একটি দলের জন্য বাহন ছিল মাত্র ১টি উট (৬) গাছের ছাল-পাতা খেয়ে ও যবেহকৃত উটের নাড়ী-ভুঁড়ির পানি পান করে ছাহাবীগণ অতিকষ্টে বেঁচে থাকেন। এজন্য এ যুদ্ধকে ‘জায়শুল ‘উসরাহ’ (جيش العسرة) বা ‘কষ্টের যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়। (৭) ছামূদ জাতির গযবের স্থান ‘হিজর’ অতিক্রম করার সময় সেখানকার পানি পান না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় (৮) মু‘জেযার মাধ্যমে একটি শুষ্ক ঝর্ণা হ’তে অবিরাম পানি নির্গত হয় (৯) ছালাত তাক্বদীম ও তাখীরের মাধ্যমে জমা ও ক্বছর করা হয় (১০) প্রবল ঘুর্ণিঝড়ের ফলে শত্রু পক্ষের মনে ভীতির সঞ্চার হয় (১১) মদীনায় ফেরার সময় একটি সংকীর্ণ গিরিপথে ১২ জন মুখোশ ধারী মুনাফিক রাসূলকে হত্যা প্রচেষ্টা চালায় (১২) তাবূক থেকে ফেরার দিন মদীনায় কিশোর-কিশোরীরা বিজয়ী রাসূলকে জানায় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় طلع البدر علينا… বলে।
৮৫। সারিইয়া খালেদ বিন ওয়ালীদ (سرية خالد بن وليد) : ৯ম হিজরীর রজব মাস। বিনা যুদ্ধে বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাবূকে অবস্থানকালেই পার্শ্ববর্তী দূমাতুল জান্দালের (دومة الجندل) খৃষ্টান নেতা উকাইদারের (أكيدر) বিরুদ্ধে ৪২০ জনের সেনাদল সহ খালেদকে প্রেরণ করেন। খালেদ তাকে বনদী করে রাসূলের দরবারে আনেন এবং তার সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৮৬। সারিইয়া উসামাহ বিন যায়েদ বিন হারেছাহ (سرية أسامة بن زيد بن الحارثة) : ১১ হিজরীর ছফর মাস। রোম সম্রাটের অহংকার চূর্ণ করার জন্য এবং মো‘আন (معان) ও পার্শ্ববর্তী আরব অঞ্চলের রোমক গবর্ণর ফারওয়াহ বিন ‘আমর আল-জোযামীকে ইসলাম কবুলের অপরাধে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য এ অভিযান প্রেরিত হয়। সিরিয়ার বালক্বা‘ ও ফিলিস্তীন অঞ্চল অশ্বারোহীদের দ্বারা পদদলিত করে রোমকদের ভীত করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। অভিযান প্রেরণকালে উসামার হাতে পতাকা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, سر إلى موضع قتل أبيك فأوطنهم الخيل ‘যাও তোমার পিতার নিহত হওয়ার স্থানে এবং সেখানকার লোকদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করো’। বড় বড় ছাহাবী উসামাকে সেনাপতি হিসাবে মেনে নিতে না পারলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়ে বলেন, তোমরা তার পিতার ব্যাপারেও এরূপ বলেছিলে। আল্লাহর কসম! সে যোগ্য ছিল। তার পুত্রও যোগ্য’।
কিন্তু মদীনা হ’তে তিন মাইল দূরে ‘জুরফ’ নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর শুনে বাহিনী সেখানেই যাত্রা বিরতি করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আবুবকরের খেলাফতকালে উক্ত বাহিনী পুনরায় যাত্রা করে এবং বিজয়ী বেশে ফিরে আসে।
উল্লেখ্য যে, মানছূরপুরী ৮২টি অভিযানের তালিকা দিয়েছেন। আমরা তাঁর তালিকা ও মুবারকপুরীর তালিকা মিলিয়ে মোট ৮৬টি পেয়েছি, যা লিপিবদ্ধ করলাম। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
উল্লেখ্য যে, মানছূরপুরী ৮২টি অভিযানের তালিকা দিয়েছেন। আমরা তাঁর তালিকা ও মুবারকপুরীর তালিকা মিলিয়ে মোট ৮৬টি পেয়েছি, যা লিপিবদ্ধ করলাম। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
উভয় পক্ষে শহীদ ও নিহতদের সংখ্যা :
মাদানী জীবনে ৮ বছরে সংঘটিত ৮৬টি গাযওয়া ও সারিইয়ার মধ্যে ২৯টি গাযওয়া ও ৫৭টি সারিইয়াতে উভয় পক্ষে নিহত ও শহীদগণের সঠিক তালিকা নির্ণয় করা মুশকিল। মানছূরপুরী যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় যে, মুসলিম পক্ষে শহীদ হয়েছেন ২৫৯ জন এবং কাফের পক্ষে নিহত হয়েছেন ৭৫৯ জন। উভয়পক্ষে সর্বমোট নিহতের সংখ্যা ১০১৮ জন।[22] কিন্তু মানছূরপুরী ও মুবারকপুরী উভয়ের দেওয়া যুদ্ধের বর্ণনা সমূহ হিসাব করে দেখা গেছে যে, মুসলিম পক্ষে ৩৩৯ জন এবং কাফির পক্ষে ১০৯১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে মানছূরপুরী সারিইয়া ইবনু আবিল আওজা-তে (ক্রমিক ৬৫) মুসলিম পক্ষে ৪৯ জন শহীদ বলেছেন, যেটা ৩৩৯ জনের হিসাবে ধরা হয়েছে। কিন্তু মুবারকপুরী উক্ত বিষয়ে কিছু বলেননি। অনুরূপভাবে গাযওয়া বনু কুরায়যাতে ইহুদীপক্ষে নিহতের সংখ্যা মানছূরপুরী ৪০০ বলেছেন। কিন্তু মুবারকপুরী ৬০০ থেকে ৭০০-এর মধ্যে বলেছেন। মানছূরপুরী ৪০০ ধরে হিসাব করেছেন। কিন্তু আমরা ৬০০ ধরে হিসাব করেছি। ফলে কাফের পক্ষে আমাদের হিসাব তাঁর চাইতে বেশী হয়েছে। এর পরেও ৭টি সারিইয়ায় প্রতিপক্ষের নিহতের সংখ্যা উল্লেখ না করে বলা হয়েছে ‘কিছু লোক’। অতএব কাফের পক্ষে নিহতের সংখ্যা আরও কিছু বাড়তে পারে। উল্লেখ্য যে, সবচেয়ে বড় ৯টি যুদ্ধে অর্থাৎ বদর (ক্রমিক- ৯) ওহোদ (২০), খন্দক (৩১), খায়বর (৫২), মুতা (৬৯), মক্কা বিজয় (৭২), হোনায়েন (৭৭), ত্বায়েফ (৭৮) ও তাবূক (৮৪) যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে যথাক্রমে ১৪, ৭০, ৬, ১৮, ১২, ২, ৬, ১২, ০০=১৪০ জন এবং কাফের পক্ষে ৭০, ৩৭, ১০, ৯৩, ০০, ১২, ৭১, ০০, ০০=২৯৩ জন সহ সর্বমোট ৪০৩ জন নিহত হয়েছে। তাবূক যুদ্ধে কোন পক্ষে হতাহত হয়নি। আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগে তথাকথিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যেভাবে দেশে দেশে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়, তার তুলনায় এগুলি তৃণসম বলা চলে।
অভিযান সমূহ পর্যালোচনা:
অভিযানগুলির মধ্যে ১ হ’তে ৭২-এর মধ্যে মোট ২১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে কুরায়েশদের বিরুদ্ধে। ১১ হ’তে ৫৩-এর মধ্যে মোট ৮টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে ইহুদীদের বিরুদ্ধে। ৪৪ হ’তে ৮৬-এর মধ্যে ৬টি অভিযান খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং ১০ হ’তে ৮৩-এর মধ্যে মোট ৫১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে নাজদ ও অন্যান্য এলাকার বেদুঈন গোত্র ও সন্ত্রাসী ডাকাত দলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ২৪, ২৫ ও ৩৭ নং সারিইয়াহ তিনটি ছিল স্রেফ তাবলীগী কাফেলা এবং প্রতারণামূলকভাবে যাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। বদর সহ প্রথম দিকের ৯টি অভিযান ছিল কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি ভন্ডুল করার জন্য।
শুরুতে কুরায়েশদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের ভাষায় ছাবেঈ (صابئي) বা বিধর্মী মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথী মুষ্টিমেয় মুহাজিরদের নির্মূল করা এবং সেখানে আক্রোশটা ছিল প্রধানতঃ ধর্মবিশ্বাস গত। কিন্তু পরে তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মদীনা হয়ে সিরিয়ায় তাদের ব্যবসায়িক পথ কণ্টকমুক্ত করা। সেই সাথে ছিল তাদের বড়ত্বের অহংকার। কেননা মুহাম্মাদ তাদের বহিষ্কৃত সন্তান হয়ে তাদের চাইতে বড় হবে ও তাদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করবে, এটা ছিল তাদের নিকটে নিতান্তই অসহ্য। তাদের এই ক্ষুব্ধ ও বিদ্বেষী মানসিকতাকেই কাজে লাগায় ধূর্ত ইহুদী নেতারা ও অন্যান্যরা। ফলে মক্কা বিজয়ের পূর্বেকার মুসলিম অভিযানগুলির অধিকাংশ ছিল প্রতিরোধ মূলক।
ইহুদীদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলি হয় তাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে এবং অবিরত ভাবে তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে। খৃষ্টানদের কোন তৎপরতা মদীনায় ছিল না। সিরিয়ার নিকটবর্তী দূমাতুল জান্দালে প্রথম যে অভিযানটি (ক্রমিক-৪৪) তাদের দিকে প্রেরিত হয়, সেটি ছিল মূলতঃ তাবলীগী মিশন এবং তাতে তাদের গোত্রনেতাসহ সকলে মুসলমান হয়ে যায়। পরে যে মুতার যুদ্ধ (ক্রমিক-৬৯) হয়, সেটি ছিল সিরিয়া অঞ্চলে রোমক গবর্ণর শোরাহবীলের মুসলিম দূত হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে। তাবূক যুদ্ধ ছিল আগ্রাসী রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং তার প্রেরিত বিশাল বাহিনীর মদীনা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। অবশেষে রোমকরা ভয়ে পিছু হটে গেলে কোন যুদ্ধ হয়নি।
উল্লেখ্য যে, ৩য় হিজরীতে ওহোদ যুদ্ধে মুনাফেকী করার কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে আর কোন যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেননি। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও অন্যান্যদের প্রকাশ্যে তওবা ও বারবার অনুরোধে তিনি তাদেরকে ৫ম হিজরীতে মুছত্বালিক যুদ্ধে (ক্রমিক-৪৩) যাবার অনুমতি দেন। কিন্তু তারা যথারীতি মুনাফেকী করে। পরে তাদেরকে আর কোথাও অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাবূক অভিযানে (ক্রমিক-৮৪) তাদের ১২ জন এজেন্ট গোপনে ঢুকে পড়ে ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
পরিশেষে বলা চলে যে, ইসলামের দাওয়াত মক্কায় ছিল কেবল প্রচারমূলক। কিন্তু মদীনায় ছিল প্রচার ও প্রতিরোধ উভয় প্রকারের। যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াতে উভয় নীতিই প্রযোজ্য হয়েছে। এখানে হারাম মাসে যুদ্ধ করার অনুমতিও পাওয়া গেছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। যার সূত্রপাত ঘটে নাখলা যুদ্ধে (ক্রমিক-৮)। এ প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারাহ ২১৭নং আয়াতটি নাযিল হয়।
পরবর্তী অংশ পড়ুন: রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা প্রচেষ্টা সমূহ
[1] রহমাতুল লিল আলামীন ১/১৩০।
[2] বুখারী হা/৩৯৮৯।
[3] রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১১৪।
[4] মুসলিম ২/৮৯।
[5] মুসলিম, আনাস হ’তে ২/৮৯ পৃঃ।
[6] বুখারী ২/৬২৫ ও মুসলিম ২/১৪৫। মুবারকপুরী বলেন যে, চরিতকারগণ এটিকে ৮ম হিজরীর রজব মাসের ঘটনা বলে থাকেন। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক (السياق) বিবেচনায় দেখা যায় যে, এটি হুদায়বিয়ার পূর্বের ঘটনা। কেননা ৬ষ্ঠ হিজরীর যুল ক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধি হওয়ার পরে কুরায়েশ কাফেলাকে হামলা করার জন্য আর কোন মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হয়নি’।
[7] বুখারী, মানছূরপুরী এটা ধরেননি।
[8] বুখারী ২/৫৯২; মুসলিম ২/১১৮।
[9] মুবারকপুরী এটা ধরেননি। মানছুরপুরী সাল-তারিখ ও সেনা সংখ্যা বলেননি।
[10] মানছূরপুরী মুনক্বা‘আহ (منقعة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন, ৩/১৯৭।
[11] মুসনাদ আবু ইয়া‘লা হা/১৫২২ সনদ হাসান; মুসলিম হা/২৭৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ৪৩ অনুচ্ছেদ; বুখারী হা/৬৮৭২-এর ব্যাখ্যা, ফাৎহুল বারী ১২/২০৩; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৪৫০, ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়; মানছূরপুরী এটাকে পৃথক ‘খারবাহ অভিযান’ (سرية خربة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৭।
[12] মানছূরপুরী এটি ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস লিখেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৫।
[13] কিন্তু মানছূরপুরী বলেন যে, মুসলিম বাহিনীর ১ জন আহত ও ৪৯ জন শহীদ হন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৮।
[14] নাসাঈ কুবরা হা/১১৫৪৭; তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ২/১৪৫-৪৬।
[15] আহমাদ হা/২১২৬৯, সনদ হাসান।
[16] বুখারী হা/৪৩৩৯; মিশকাত হা/৩৯৭৬ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৫ অনুচ্ছেদ।
[17] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৩১; ছাহাবীগণের উচ্চ মর্যাদায় বর্ণিত উক্ত মর্মে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
[18] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৮৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৯৮৬।
[19] চরিতকারগণ এই ঘটনাকে ৯ম হিজরীর মুহাররম মাস বললেও মুবারকপুরী এতে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। যদিও তিনি পৃথক কোন সাল বা তারিখ উল্লেখ করেননি।
[20] ফাৎহুল বারী ৮/৫৯ পৃঃ।
[21] রহমাতুল্লিল আলামীন ২/২০২।
[22] রহমাতুল লিল আলামীন ২/২১৩ পৃঃ।
No comments