৮৮. সূরা গাশিয়াহ -এর তাফসীর


সূরা গাশিয়াহ

(আচ্ছন্নকারী)
সূরা যারিয়াতের পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ৮৮, আয়াত ২৬, শব্দ ৯২, বর্ণ ৩৭৮।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) তোমার কাছে আচ্ছন্নকারী দিবসের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে কি?
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْغَاشِيَةِ
(২) যেদিন অনেক মুখমন্ডল হবে ভীত-নমিত
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ
(৩) ক্লিষ্ট, ক্লান্ত।
عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ
(৪) তারা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে
تَصْلَى نَارًا حَامِيَةً
(৫) ফুটন্ত ঝর্ণা হ’তে তাদের পান করানো হবে
تُسْقَى مِنْ عَيْنٍ آنِيَةٍ
(৬) বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত শুকনা যরী‘ ঘাস ব্যতীত তাদের কোন খাদ্য জুটবে না।
لَيْسَ لَهُمْ طَعَامٌ إِلَّا مِنْ ضَرِيعٍ
(৭) যা তাদের পুষ্ট করবে না এবং ক্ষুধাও মিটাবে না।
لَا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِي مِنْ جُوعٍ
(৮) যেদিন অনেক মুখমন্ডল হবে উৎফুল্ল
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاعِمَةٌ
(৯) স্ব স্ব কর্মফলে সন্তুষ্ট।
لِسَعْيِهَا رَاضِيَةٌ
(১০) তারা থাকবে সুউচ্চ বাগিচায়
فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ
(১১) যেখানে শুনবে না কোন অসার বাক্য
لَا تَسْمَعُ فِيهَا لَاغِيَةً
(১২) যেখানে থাকবে প্রবহমান ঝরণাসমূহ
فِيهَا عَيْنٌ جَارِيَةٌ
(১৩) থাকবে সমুচ্চ আসনসমূহ
فِيهَا سُرُرٌ مَرْفُوعَةٌ
(১৪) এবং রক্ষিত পানপাত্রসমূহ
وَأَكْوَابٌ مَوْضُوعَةٌ
(১৫) ও সারিবদ্ধ বালিশসমূহ
وَنَمَارِقُ مَصْفُوفَةٌ
(১৬) এবং বিস্তৃত গালিচাসমূহ।
وَزَرَابِيُّ مَبْثُوثَةٌ
(১৭) তারা কি দেখে না উষ্ট্রের প্রতি, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?
أَفَلَا يَنْظُرُونَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ
(১৮) এবং আকাশের প্রতি, কিভাবে তাকে উচ্চ করা হয়েছে?
وَإِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ
(১৯) এবং পাহাড় সমূহের প্রতি, কিভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে?
وَإِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ
(২০) এবং পৃথিবীর প্রতি, কিভাবে তাকে বিছানো হয়েছে?
وَإِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ
(২১) অতএব তুমি উপদেশ দাও। তুমি তো কেবল উপদেশদাতা মাত্র।
فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنْتَ مُذَكِّرٌ
(২২) তুমি তাদের উপরে দারোগা নও।
لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ
(২৩) তবে যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেয় ও অবিশবাসী হয়,
إِلَّا مَنْ تَوَلَّى وَكَفَرَ
(২৪) আল্লাহ তাকে সবচাইতে বড় শাস্তি প্রদান করবেন।
فَيُعَذِّبُهُ اللَّهُ الْعَذَابَ الْأَكْبَرَ
(২৫) নিশ্চয় আমাদের কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন।
إِنَّ إِلَيْنَا إِيَابَهُمْ
(২৬) অতঃপর আমাদের দায়িত্বে রয়েছে তাদের হিসাব গ্রহণ।
ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا حِسَابَهُمْ
গুরুত্ব :
নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুই ঈদ ও জুম‘আর ছালাতে সূরা আ‘লা ও গাশিয়াহ পাঠ করতেন। এমনকি জুম‘আ ও ঈদ একদিনে হ’লেও তিনি উক্ত দু’টি সূরাই পাঠ করতেন’।[1]
বিষয়বস্ত্ত :
অত্র সূরায় ক্বিয়ামত দিবসে জান্নাতী ও জাহান্নামী দু’দল মানুষের দু’রকমের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে (১-১৬ আয়াত)। অতঃপর মরুচারী আরবদের পথ প্রদর্শনের জন্য তাদের অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল চারটি নিদর্শন উল্লেখ করে এসবের সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর অপার কুদরতের বিষয় চিন্তা-গবেষণা করার আহবান জানানো হয়েছে (১৭-২০ আয়াত)। সবশেষে রাসূল (ছাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে যে, তুমি তাদের উপর শাসক নও। বরং তোমার দায়িত্ব কেবল উপদেশ দেওয়া। অতঃপর তাদের যথাযথ প্রতিফল দানের দায়িত্ব আমার উপরে ন্যস্ত (২১-২৬ আয়াত)
তাফসীর :
(১) هَلْ أَتَاكَ حَدِيْثُ الْغَاشِيَة ‘তোমার কাছে আচ্ছন্নকারী দিবসের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে কি’? هَلْ أَتَاكَ বাক্যে هَلْ প্রশ্নবোধক অব্যয় হ’লেও প্রকৃত অর্থ হবে قد অর্থাৎ ‘অবশ্যই তোমার নিকট ক্বিয়ামতের খবর পৌঁছেছে’। যেমন هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنْسَانِ (দাহর ৭৬/১)-এর অর্থ قد أتى ‘অবশ্যই এসেছে’। বক্তব্যকে শ্রোতার হৃদয়ে প্রোথিত করার জন্য এটি আরবদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাকরীতি।
‘গাশিয়াহ’-এর আভিধানিক অর্থ (الداهية) ‘আচ্ছন্নকারী’। এখানে অর্থ হবে ‘ক্বিয়ামত’। সেদিনের ভয়াবহতা ও ভয়ংকর অবস্থা সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। ইবনু আববাস, ক্বাতাদাহ ও ইবনু যায়েদ বলেন, ‘গাশিয়াহ’ হ’ল ক্বিয়ামত দিবসের অন্যতম নাম’ (ইবনু কাছীর)। অতঃপর ক্বিয়ামত দিবসে জাহান্নামী লোকদের অবস্থা কেমন হবে সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন-
(২-৩) وُجُوهٌ يَّوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ، عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ ‘যেদিন অনেক মুখমন্ডল হবে ভীত-নমিত’। ‘ক্লিষ্ট, ক্লান্ত’। এখানে وُجُوهٌ অর্থ أصحاب الوجوه ‘চেহারার মালিকগণ’ অর্থাৎ জাহান্নামী ব্যক্তিগণ। কুরতুবী বলেন, وجوه عاملة ناصبة فى الدنيا خاشعة فى الآخرة ‘দুনিয়াতে বহু আমলকারী ক্লান্ত-শ্রান্ত ব্যক্তিগণ আখেরাতে হবে ভীত-নমিত’। ইবনু কাছীর বলেন, أى قد عملت عملا كثيرا ونصبت فيه ‘তারা বহু আমল করেছে ও তাতে পরিশ্রান্ত হয়েছে’ (ইবনু কাছীর)
কাফের-মুশরিক ও বিদ‘আতী লোকদের আমলসমূহ আল্লাহর নিকটে অগ্রাহ্য হবে। দুনিয়াতে নেক আমল ভেবে তারা অনেক বাড়তি কাজ করে থাকে। পোপ-পাদ্রী ও যোগী-সন্ন্যাসীরা এমনকি মুমিন নামধারী ভন্ড তপস্বীরা তাদের দাবী মতে আল্লাহকে পাবার জন্য কৃচ্ছ্র সাধনার নামে নিজেদের জীবনের উপরে অযথা কষ্ট ডেকে আনে। সংসার-ধর্ম ত্যাগ করে দেশে দেশে ও বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। গীর্জা, মঠ-মন্দির ও খানক্বাহে তথাকথিত ধ্যানে ও ভজনে জীবন কাটায়। উত্তম খানাপিনা ও পোষাকাদি পরিত্যাগ করে নোংরা পোষাক, চট ও জটাধারী হয়। কখনোবা উলংগ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এইভাবে একসময় সে মারা যায়। মূর্খরা তাকে ‘কামেল ব্যক্তি’ ভেবে ‘বাবা’ বলে। তার কবরকে ‘মাযার’ বানায় ও সেখানে নযর-নেয়ায দেয়া শুরু করে। কেউবা মূর্তি বানিয়ে তার পূজা করে। জীবনে সে ছিল নফসরূপী শয়তানের পূজারী। মরার পরে মানুষ হয় তার মূর্তি, প্রতিকৃতি বা কবরের পূজারী। অথচ তার অনুসারীরা ভাবে যে, তারাই সর্বাধিক উত্তম আমলকারী। এদের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ অন্যত্র বলেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالاً، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعاً- ‘তুমি বল, আমরা কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের বিষয়ে খবর দিব?’ ‘পার্থিব জীবনে তাদের প্রচেষ্টাসমূহ বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ভাবে যে, তারা সৎকর্ম করেছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)। আল্লাহ বলেন, وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُوْرًا ‘অনন্তর আমরা তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে অগ্রসর হব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলি-কণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)
হাসান বাছরী হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত ওমর (রাঃ) শাম সফরে এলে তাঁর কাছে একজন জীর্ণ-শীর্ণ খ্রিষ্টান পাদ্রী দেখা করতে আসেন। ওমর (রাঃ) তার ক্লিষ্ট-করুণ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, هذا المسكين طلب أمراً فلم يصبه، ورجا رجاء فأخطأه وقرأ : وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ- ‘এই হতভাগা মিসকীন যা চেয়েছিল তা পায়নি, যা আকাংখা করেছিল তাতে সে ব্যর্থ হয়েছে। অতঃপর তিনি অত্র আয়াতটি পাঠ করেন وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ، عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ، تَصْلَى نَارًا حَامِيَةً- ‘বহু চেহারা সেদিন হবে ভীত-নমিত’। ‘ক্লিষ্ট, ক্লান্ত’। ‘তারা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে’ (কুরতুবী)
আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, এই লোকেরা হ’ল খারেজী দল (কুরতুবী)। যাদের কঠোর দ্বীনদারী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন,
تَحْقِرُوْنَ صَلاَتَكُمْ مَعَ صَلاَتِهِمْ، وَصِيَامَكُمْ مَعَ صِيَامِهِمْ، وَعَمَلَكُمْ مَعَ عَمَلِهِمْ، يَمْرُقُوْنَ مِنَ الدِّيْنَ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ-
‘তোমরা তোমাদের ছালাত, ছিয়াম ও অন্যান্য আমলসমূহকে তাদের মুকাবিলায় হীন মনে করবে। অথচ তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে এমনভাবে, যেরূপ তীর বেরিয়ে যায় ধনুক হ’তে’।[2] ইসলামের ইতিহাসে এরাই ছিল ইসলামের নামে সর্বপ্রথম চরমপন্থী জঙ্গীদল। যারা হযরত আলী (রাঃ)-কে কাফের বলে ও তাঁর খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যাদের হাতে হযরত আলী (রাঃ) শাহাদত বরণ করেন। উন্নত চরিত্র ও উত্তম আমলে সমৃদ্ধ হ’লেও চরমপন্থী আক্বীদার কারণে এদের কোন সৎকর্ম আল্লাহর নিকটে কবুল হয়নি। ক্বিয়ামতের দিন শিরক ও বিদ‘আতপন্থী সকল আমলকারীর অবস্থা অত্র আয়াতে বর্ণিত (وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ، عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ ) লোকদের ন্যায় হবে। যা সেদিন কোনই কাজে লাগবে না।
(৪) تَصْلَى نَاراً حَامِيَةً ‘তারা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে’। অর্থাৎ তারা এমন অগ্নিতে প্রবেশ করবে, যা চূড়ান্তভাবে উত্তপ্ত। যে আগুনকে যুগ যুগ ধরে উত্তপ্ত করা হয়েছে, যার সমতুল্য উত্তাপ আর নেই। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, إِذَا أُلْقُوْا فِيْهَا سَمِعُوْا لَهَا شَهِيْقاً وَّهِيَ تَفُوْرُ، تَكَادُ تَمَيَّزُ مِنَ الْغَيْظِ ، ‘যখন তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন তার উৎক্ষিপ্ত গর্জন শুনতে পাবে’। ‘তখন মনে হবে জাহান্নাম যেন ক্রোধে ফেটে পড়ছে’ (মুল্ক ৬৭/৭-৮)। কেননা ঐ সময় জাহান্নামকে আরো বেশী উত্তপ্ত করা হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا الْجَحِيْمُ سُعِّرَتْ ‘যেদিন জাহানামকে উত্তপ্ত করা হবে’ (তাকভীর ৮১/১২)। অর্থাৎ এখানে نَاراً حَامِيَةً বলতে  نارًا منةهى حارة او مةناهية فى الحرارة ‘চূড়ান্তভাবে উত্তপ্ত অগ্নি’ বুঝানো হয়েছে।
(৫) تُسْقَى مِنْ عَيْنٍ آنِيَةٍ ‘ফুটন্ত ঝর্ণা হ’তে পান করানো হবে’ অর্থাৎ এমন ঝর্ণার পানি, যা চূড়ান্তভাবে উত্তপ্ত (قد انتهى حرها)। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, يَطُوْفُوْنَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ حَمِيْمٍ آنٍ ‘তারা জাহান্নামের আগুন ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটাছুটি করবে’ (রহমান ৫৫/৪৪)। آنِيَة অর্থ ‘চূড়ান্তভাবে উত্তপ্ত’।
(৬) لَيْسَ لَهُمْ طَعَامٌ إِلاَّ مِنْ ضَرِيْعٍ ‘বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত শুকনা যরী‘ ঘাস ব্যতীত তাদের কোন খাদ্য জুটবে না’। ইকরিমা ও মুজাহিদ বলেন, যরী‘ এমন একপ্রকার কাঁটাযুক্ত ঘাস, যা মাটির সঙ্গে লেগে থাকে’। যতক্ষণ তা কাঁচা থাকে ততক্ষণ তা উটে খায়। কিন্তু তৃপ্ত হয় না। এসময় একে ‘শিবরিক্ব’ (الشبرق) বলা হয়। কিন্তু যখন শুকিয়ে যায়, তখন বিষাক্ত ও প্রাণ সংহারী হয়ে যায় এবং তখন একে ‘যরী‘ (الضريع) বলা হয়। ঐ সময় উট বা কোন পশু এ ঘাস খায় না বা এর ধারে-কাছেও যায় না’। আরবদের নিকটে এটা হ’ল أخبث الطعام وأشنعه ‘সবচাইতে খবীছ ও নিকৃষ্ট খাদ্য’। খলীল বলেন, এই ঘাস অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত (منتن الريح) (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
এখানে إِلاَّ مِنْ ضَرِيْعٍ ‘যরী ব্যতীত’ বলা হয়েছে। অথচ অন্যত্র বলা হয়েছে, إِلاَّ مِنْ غِسْلِيْنٍ ‘তাদের কোন খাদ্য থাকবে না ক্ষত-নিঃসৃত রক্ত-পূঁজ ব্যতীত’ (হা-ক্কাহ ৬৯/৩৬)। ইমাম কুরতুবী বলেন, এধরনের আয়াত সমূহের মধ্যে সমন্বয় এই যে, জাহান্নামীদের অনেকগুলি স্তর থাকবে। এক এক স্তরের পাপীকে এক এক ধরনের খাদ্য দেওয়া হবে। কাউকে রক্ত-পূঁজ, কাউকে উত্তপ্ত পানি, কাউকে যরী‘ ঘাস, কাউকে যাক্কূম বৃক্ষ ইত্যাদি’। আরবদের বুঝানোর জন্য তাদের পরিচিত এইসব নিকৃষ্ট বৃক্ষের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে জাহান্নামের সবকিছু হবে জাহান্নামের মতই। যা হবে কঠিন কষ্টদায়ক ও নিকৃষ্টতম। দুনিয়াতে যার কোন তুলনা নেই।
(৭) لاَ يُسْمِنُ وَلاَ يُغْنِيْ مِنْ جُوْعٍ ‘যা তাদের পুষ্ট করবে না এবং ক্ষুধাও মিটাবে না’। পূর্ববর্তী বাক্যের ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে যে, যরী‘ এমন ঘাস যা খেয়ে জাহান্নামীরা পুষ্ট হবে না বা তাদের ক্ষুধাও মিটবে না। অথচ প্রচুর ক্ষুধায় বাধ্য হয়ে ওটাই তারা খাবে গোগ্রাসে। নিঃসন্দেহে এটি হবে আরও কষ্টদায়ক।
(৮-৯) وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَّاعِمَةٌ، لِسَعْيِهَا رَاضِيَةٌ ‘যেদিন অনেক মুখমন্ডল হবে উৎফুল্ল’। ‘স্ব স্ব কর্মফলে সন্তুষ্ট’।
১ হ’তে ৭ আয়াত পর্যন্ত হতভাগ্যদের পরিণতি বর্ণনা শেষে এবার সৌভাগ্যবানদের বর্ণনা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন তাদের চেহারা হবে সুন্দর, সজীব ও প্রফুল্ল। স্বীয় কর্মফলে সন্তুষ্ট। দুনিয়ায় তারা যে সৎকর্মাদি করেছিল, জান্নাত হবে তারই প্রতিদান। যেমন আল্লাহ সেদিন তাদের ডেকে বলবেন, وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِيْ أُوْرِثْتُمُوْهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘এই যে জান্নাতের উত্তরাধিকারী তোমরা হয়েছ, এটা তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিদান স্বরূপ’ (যুখরুফ ৪৩/৭২)। তিনি বলবেন, كُلُوْا وَاشْرَبُوْا هَنِيْئًا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ ‘তোমরা এখানে খুশীমনে খাও ও পান কর তোমাদের কর্মের বিনিময় স্বরূপ’ (মুরসালাত ৭৭/৪৩)। তিনি বলেন, أَمَّا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلاً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের কৃতকর্মের প্রতিদানস্বরূপ তাদের আপ্যায়নের জন্য জান্নাত হবে তাদের বাসস্থান’ (সাজদাহ ৩২/১৯)
তবে কেবল আমলই যথেষ্ট নয়, যদি না তার সাথে আল্লাহর রহমত শামিল থাকে। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَنْ يُنَجِّىَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ، قَالُوْا وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ أَنَا، إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِى اللهُ بِرَحْمَةٍ، فَسَدِّدُوا وَقَارِبُوا- ‘তোমাদের আমল তোমাদের কাউকে নাজাত দিবে না। তারা বললেন, আপনাকেও নয় হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, আমাকেও না। যদি না আল্লাহ আমাকে নিজ অনুগ্রহ দ্বারা আবৃত করেন। অতএব তোমরা দৃঢ়ভাবে সৎকর্ম করে যাও এবং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর’।[3]
হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يُدْخِلُ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ الْجَنَّةَ وَلاَ يُجِيرُهُ مِنَ النَّارِ وَلاَ أَنَا إِلاَّ بِرَحْمَةِ اللهِ ‘তোমাদের কাউকে তার কর্ম জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না বা তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারবে না, এমনকি আমাকেও নয়, আল্লাহর রহমত ব্যতীত’।[4]
(১০) فِيْ جَنَّةٍ عَالِيَةٍ ‘তারা থাকবে সুউচ্চ বাগিচায়’। কুরতুবী বলেন, এটা এজন্য বলা হয়েছে যে, জান্নাত হবে আসমানসমূহের উপরে (لأنها فوق السماوات) ’। বিভিন্ন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, জান্নাতে একশত স্তর থাকবে। প্রতিটি স্তরের মধ্যকার দূরত্ব আসমান ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের ন্যায় হবে’। ফেরদৌস হ’ল সর্বোচ্চ স্তর। সেখান থেকেই প্রবাহিত হয় চারটি ঝর্ণাধারা। আর তার উপরেই রয়েছে আল্লাহর আরশ। অতএব যখন তোমরা চাইবে, তখন জান্নাতুল ফেরদৌস চাইবে’।[5] উক্ত চারটি ঝর্ণাধারা হ’ল : নির্মল পানি, দুধ, শারাব ও মধু (মুহাম্মাদ ৪৭/১৫)
(১১) لاَّ تَسْمَعُ فِيْهَا لاَغِيَةً ‘যেখানে শুনবে না কোন অসার বাক্য’। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, لاَ يَسْمَعُوْنَ فِيْهَا لَغْواً وَّلاَ تَأْثِيْماً، إِلاَّ قِيْلاً سَلاَماً سَلاَماً ‘সেখানে তারা কোন অবান্তর বা গুনাহের কথা শুনবে না’। ‘কেবল শুনবে সালাম আর সালাম’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/২৫-২৬)। একই ধরনের বক্তব্য অন্য সূরাতেও এসেছে (যেমন মারিয়াম ১৯/৬২; তূর ৪২/২৩; নাবা ৭৮/৩৫)।
(১২) فِيْهَا عَيْنٌ جَارِيَةٌ ‘যেখানে থাকবে প্রবহমান ঝরণাসমূহ’। অর্থ لا انقطاع لها ‘যা কখনো বন্ধ হবে না’। عَيْنٌ একবচন এলেও অর্থ বহুবচন হবে। কেননা عَيْنٌ এখানে জাতিবোধক। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَنْهَارُ الْجَنَّةِ تَفَجَّرُ مِنْ تَحْتِ تِلاَلٍ أَوْ مِنْ تَحْتِ جِبَالِ الْمِسْكِ- ‘জান্নাতের নদীসমূহ মিশকের টিলা অথবা মিশকের পাহাড়ের তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়।[6]
(১৩) فِيْهَا سُرُرٌ مَّرْفُوْعَةٌ ‘থাকবে সমুচ্চ আসনসমূহ’- অর্থাৎ সুউচ্চ ও সুসজ্জিত নরম গদিযুক্ত চেয়ারসমূহ। যাতে আল্লাহর বন্ধুগণ আল্লাহর বিশাল রাজত্ব ও বিস্তৃত নে‘মতসমূহ স্বচক্ষে দেখতে পান (কুরতুবী)। তারা বসতে চাইলেই চেয়ারগুলি নীচু হয়ে তাদেরকে বসিয়ে নিবে (ইবনু কাছীর)
(১৪) وَأَكْوَابٌ مَّوْضُوْعَةٌ ‘এবং রক্ষিত পানপাত্রসমূহ’। অর্থ مَوْجُوْدَةٌ بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ ‘তাদের সম্মুখে সদা প্রস্ত্তত থাকবে। যখনই সে পানি পান করতে চাইবে, তখনই তা পূর্ণ পেয়ালা সহ তার হাতের কাছে পাবে।
(১৫) وَنَمَارِقُ مَصْفُوفَةٌ ‘সারিবদ্ধ বালিশসমূহ’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, نَمَارِق অর্থ وَسَائِد তাকিয়া বা বালিশসমূহ, যাতে ঠেস দিয়ে বসা হয় বা শোওয়া হয়। একবচনে نُمْرُقَةٌ (কুরতুবী)। অর্থাৎ বিছানার চারপাশে এগুলি মওজুদ থাকবে।
(১৬) وَزَرَابِيُّ مَبْثُوْثَةٌ ‘এবং বিস্তৃত গালিচাসমূহ’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, الزَّرَابِيُّ অর্থ الْبُسُط গালিচা বা কার্পেটসমূহ, যা مَبْثُوْثَةٌ অর্থাৎ مفروشه বিছানো ও বিস্তৃত থাকে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, الطنافس التى لها خَمْل رقيق ‘পাতলা মিহি ঝালরযুক্ত গালিচা’। একবচনে الزُّرْبية (কুরতুবী)। অর্থাৎ জান্নাতের যেখানেই তারা অবস্থান করবে সেখানেই তারা বালিশ, বিছানা, তাকিয়া, চেয়ার, পানপাত্র- সবকিছু হাতের নাগালের মধ্যে পাবে। যা সংখ্যায় একটি নয়। বরং مَبْثُوْثَةٌ অর্থাৎ كثيرة مةفرقة বহু এবং বিক্ষিপ্তভাবে চারিদিকে। যেখানেই তারা যাবে, সেখানেই পাবে সবকিছু প্রস্ত্তত।
(১৭) أَفَلاَ يَنْظُرُوْنَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ ‘তারা কি দেখে না উষ্ট্রের প্রতি, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে’?
أَفَلاَ يَنْظُرُوْنَ তারা কি দেখে না? শুরুতে প্রশ্নবোধক ‘হামযাহ’ (أ) এসেছে অবিশ্বাসীদের ধিক্কার দেওয়ার জন্য। অতঃপর ‘ফা’ (فا) এসেছে প্রশ্ন ও পরবর্তী ক্রিয়াপদের মধ্যে সংযোগের (عطف) জন্য। كَيْفَ خُلِقَتْ (কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?) বাক্যটি পূর্ববর্তী يَنْظُرُوْنَ ক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত (متعلق)। যা الْإِبِلِ (উট) থেকে بدل الاشتمال বা পূর্ণ স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।
এক্ষণে অর্থ হবে, তারা কি দেখেনা এইসব সৃষ্টির প্রতি, যা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর অসীম ক্ষমতার স্পষ্ট প্রমাণ স্বরূপ। যাতে তারা পুনরুত্থানের ব্যাপারে তাঁর ক্ষমতাকে অস্বীকার না করে। অতঃপর তারা যেন রাসূল (ছাঃ)-এর ভয় প্রদর্শনের প্রতি মনোযোগী হয় এবং আল্লাহর উপরে ঈমান আনে ও তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। الْإِبِلُ শব্দটি اسم الجموع বা বহুত্ববোধক শব্দ, যার কোন একবচন নেই এবং এটি সর্বদা স্ত্রীলিঙ্গ হয় (কুরতুবী)
জাহান্নামীদের দুরবস্থা ও জান্নাতীদের সুখ-শান্তির বর্ণনা শেষে আল্লাহ এবার জ্ঞানী লোকদের প্রতি চিন্তা-গবেষণার আহবান জানাচ্ছেন। মরুচারী আরবদের সবচেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান সম্পদ হ’ল উট। দূরের সফরে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে উট তাদের প্রধান বাহন। যারা কম খায় অথচ অধিক বোঝা বহন করে। উঠের পিঠের কুঁজোতে পানি সঞ্চিত থাকে। ফলে একাধারে দশদিনের অধিক সময় পানি না পেলেও সে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ে না। তাবূক অভিযানে যাওয়ার পথে পিপাসায় কাতর হয়ে বাহনের কমতি থাকা সত্ত্বেও ছাহাবীগণ উট যবহ করে তার কুঁজোর পানি পান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মরুভূমির বালুঝড়ে সে বালির মধ্যে মুখ লুকিয়ে থাকতে পারে। তার গোশত ও দুধ অতীব উপাদেয় খাদ্য ও পানীয়। তার পেশাব কঠিন রোগের ঔষধ। তার পশম খুবই উপকারী। সে অত্যন্ত শক্তিশালী। অথচ মনিবের প্রতি অতীব অনুগত ও অতিশয় প্রভুভক্ত। মরুভূমির একমাত্র বাহন হিসাবে উটকে سَفِيْنَةُ الْبَرِّ বা ‘মরু জাহায’ বলা হয় (কুরতুবী)। আরবরা যখন নির্জন মরুতে একাকী সফরে বের হয়, তখন তার একমাত্র সাথী হয় তার বাহন উট। উপরে নিঃসীম নীলাকাশ, নীচে দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি ও পার্শ্বে ভাবগম্ভীর আকাশছোঁয়া পর্বতমালা। সর্বদা এগুলি দেখে তারা ছিল অভ্যস্ত এবং এগুলি ছিল তাদের অত্যন্ত প্রিয়। জাহেলী আরবের শ্রেষ্ঠ কাব্যকীর্তি ‘ঝুলন্ত ক্বাছীদা সপ্তকে’ই (সাব‘আ মু‘আল্লাক্বাত) কেবল উটের বর্ণনায় ৩০টি চরণ লিখিত হয়েছে (তানতাভী ২৫/১৪৫)। জুরজী যায়দান (১৮৬১-১৯১৪খৃঃ) বলেন, উটের আরবী শব্দ ১০০টির মত এবং উষ্ট্রীর আরবী শব্দ ২৫৫টি।[7] এতেই বুঝা যায়, উট তাদের কত প্রিয়। সেকারণ এখানে চারটি বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ উটকে আগে এনেছেন এবং আরবদের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টিকৌশল সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণার আহবান জানিয়েছেন।
(১৮) وَإِلَى السَّمَآءِ كَيْفَ رُفِعَتْ ‘এবং আকাশের প্রতি, কিভাবে তাকে উচ্চ করা হয়েছে’?
سَمَا يَسْمُوْ سُمُوًّا ‘উচ্চ হওয়া’। সেখান থেকে سَمَاءٌ আকাশ, সকল বস্ত্তর ছাদ। বহুবচনে سَمَاوَاتٌ। উটের পরে আল্লাহ আকাশের প্রতি বান্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
আধুনিক বিজ্ঞানের দেওয়া হিসাব থেকে একটা ধারণা করা যায় আকাশ কত উচ্চ। বিজ্ঞান বলছে যে, আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। পৃথিবীর নিকটতম উপগ্রহ চাঁদ হ’তে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ১ মিঃ ৩ সেকেন্ড। যা পৃথিবী থেকে ৪,৮৪,৪০৩ কি.মি. (অর্থাৎ ২,৩৮,৮৫৭ মাইল) দূরে এবং পৃথিবীর চেয়ে ৫০ গুণ ছোট। আর সূর্য থেকে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। যা পৃথিবী থেকে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থিত। অথচ সূর্যের চাইতে দূরে ও তার চাইতে অন্যূন দশহাযার গুণ বড় এমন অগণিত তারকা ও নক্ষত্ররাজি রয়েছে, যাদের আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে মিলিয়ন বা তার চাইতে অধিক আলোকবর্ষ সময় লাগবে (তানতাভী)। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ৪২ আলোকবর্ষ দূরে ৬টি গ্রহ সমৃদ্ধ আরেকটি পৃথিবী (Super Earth)-এর সন্ধান পেয়েছেন এবং আমাদের সৌরজগতের বাইরে ১১০০ কোটি মাইল দূরে আরেকটি সৌরজগতের সন্ধান পেয়েছেন। এতেই বুঝা যায় মহাকাশ কত বড়, কত উচ্চ ও কত বিশাল। আর সে তুলনায় আমাদের পৃথিবী কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য ও কত তুচ্ছ।
আল্লাহ বলেন,أَفَلَمْ يَنْظُرُوْا إِلَى السَّمَآءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِنْ فُرُوْجٍ  ‘তারা কি দেখে না তাদের মাথার উপরে আকাশের দিকে, কিভাবে আমরা তাকে নির্মাণ করেছি এবং সৌন্দর্যমন্ডিত করেছি এবং তাতে নেই কোন ফাটল’ (ক্বাফ ৫০/৬)
(১৯) وَإِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ ‘এবং পাহাড় সমূহের প্রতি, কিভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে’?
جِبَالٌ، أَجْبَالٌ، أَجْبُلُ একবচনে جَبَلٌ অর্থ পাহাড়। প্রাণীজগতে উট, নভোজগতে আকাশ, অতঃপর ভূ-জগতে পাহাড় আল্লাহর এক একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। এখানে সেদিকেই বান্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
পাহাড়ের সৃষ্টি, অবস্থান ও উপযোগিতা রীতিমত তাক লাগানোর বিষয়। পৃথিবীতে বড় বড় পাহাড়গুলির সৃষ্টি হয়েছে সাগরের তলদেশ থেকে। আনুমানিক ৬.৬ সেক্সটিলিয়ন টন ওযনের এই পৃথিবীটাকে যদি একটা ডিমের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে ভূগর্ভ হ’ল ডিমের কুসুমের মত গ্যাসীয় পিন্ড। ডিমের খোসাটি হ’ল ভূপৃষ্ঠ। যার পুরুত্ব কমবেশী সাগরের নীচে গড়ে ৬ কি.মি এবং স্থলভাগে ৩০-৫০ কি.মি.। যা রয়েছে ছয়টি শিলালিক প্লেটের উপরে। এইসব দৃঢ় ও অতীব শক্ত প্লেট সমূহের উপরে রয়েছে ভূপৃষ্ঠ। যেখানে রয়েছে চার ভাগের তিনভাগের মত পানি রাশি। যা ছয়টি মহাসাগরে বিভক্ত। এছাড়াও রয়েছে সাগর-উপসাগর ও নদী-নালা। প্রত্যেকটির গভীরতায় কমবেশী রয়েছে। যেমন বলা হয় যে, আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরতা ৬ মাইল তথা প্রায় ১০ কিলোমিটার। প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা ৫ মাইল তথা ৮ কি. মি. বঙ্গোপসাগরের গভীরতা ২ মাইল তথা ৩ কি. মি.। এক্ষণে ভূপৃষ্ঠের নীচে শিলালিক প্লেট সমূহের ঘর্ষণে যেমন সমুদ্রতলে মাঝে-মধ্যে কম্পনের সৃষ্টি হয় এবং যাতে সাগরের পানিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে ভূপৃষ্ঠ ডুবিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়, যাকে ‘সুনামি’ (Tsunami) বলা হয়। অমনিভাবে কখনো সাগরের তলদেশ থেকে ভূভাগ উঁচু হয়ে সাগর ভেদ করে আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায়। এটাকেই বলা হয় পাহাড়। একইভাবে সৃষ্টি হয় সাগরের বুকে দ্বীপসমূহ।
আজকের ভারতবর্ষ ও আরব ভূখন্ড এক সময় একত্রিত ছিল। কিন্তু ভারত মহাসাগর ভেদ করে হিমালয় পর্বতমালার উত্থান ঘটায় দু’টি ভূখন্ড পৃথক রূপ ধারণ করে। একইভাবে আজকের নিউজিল্যান্ড একসময় সাগর ছিল। যা পরে মাথা উঁচু করে ভূভাগে পরিণত হয়েছে। ‘ইউরোপ ভূখন্ড একসময় আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের সাথে এবং আফ্রিকার অনেক স্থানের সাথে মিলিত ভূখন্ড ছিল। আজকের এশিয়া মহাদেশ একসময় উত্তর আমেরিকার সঙ্গে মিলিত ছিল’ (তানতাভী)
পাহাড়সমূহ মোটামুটি চারভাগে বিভক্ত। এক- পাথরের পাহাড়। এতে কোন গাছ-পালা জন্মে না। সঊদী আরবের তেহামাসহ অনেক স্থানে এরূপ পাহাড় দেখা যায়। প্রচন্ড দাবদাহের সময় এগুলি এমন উত্তপ্ত হয় যে, সেদিকে তাকানো যায় না। দুই- ভূমিজ পাহাড়। যাতে গাছ-পালা, তরু-লতা ইত্যাদি জন্মে। যেমন ফিলিস্তীন, তাবারিস্তান, দার্জিলিং ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়সমূহ। যাতে অসংখ্য বনজ, ফলজ ও ঔষধি গাছ বান্দার উপকারের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা চলে যে, বিশ্বের অধিকাংশ পাহাড়-পর্বত এই শ্রেণীভুক্ত।
তিন- বরফাবৃত পাহাড়। যেমন হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ, দামেষ্ক পাহাড়, আলপস পর্বতমালা এবং পৃথিবীর অন্যান্য বিশাল পর্বতশৃঙ্গ সমূহ। এই সব পর্বতশৃঙ্গের বরফ গলেই সৃষ্টি হয়েছে দেশে দেশে বড় বড় নদী। যেমন বাংলাদেশের গঙ্গা, পদ্মা, ব্রক্ষ্মপুত্র ইত্যাদি।
চার- আগ্নেয়গিরি। ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে এরূপ পাহাড় রয়েছে। তবে উপমহাদেশে এরূপ পাহাড়ের সন্ধান মেলেনি। এসব পাহাড় দিয়ে ভূগর্ভস্থ গ্যাসীয় চাপ অনেক সময় লাভাস্রোত আকারে বেরিয়ে যাওয়াতে ভূপৃষ্ঠ সুস্থির থাকে।
পাহাড়সমূহ পৃথিবীকে দৃঢ় ও স্থিত রাখে, যাতে তা টলতে না পারে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْنَا فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَن تَمِيْدَ بِهِمْ ‘পৃথিবীতে পাহাড় স্থাপন করেছি যাতে জীবকুল নিয়ে পৃথিবী হেলে না পড়ে’…. (আম্বিয়া ২১/৩১)। এছাড়া মেঘমালাকে আটকে দিয়ে এইসব পাহাড় বৃষ্টি ঝরাতে সাহায্য করে। নিজের বুক থেকে ঝর্ণা ঝরিয়ে আল্লাহর হুকুমে পাহাড় আমাদেরকে পানি সরবরাহ করে ও বৃক্ষরাজি উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের রূযির ব্যবস্থা করে। এছাড়াও পাহাড়ের গর্ভে রয়েছে অসংখ্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ এবং এর নীচে রয়েছে গ্যাসের অফুরন্ত ভান্ডার। সবই মানুষের ভোগ ও সেবার জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَّا فِيْ السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَّبَاطِنَةً وَّمِنَ النَّاسِ مَنْ يُّجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَّلاَ هُدًى وَلاَ كِتَابٍ مُّنِيْرٍ-
‘তোমরা কি দেখ না নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবকিছুকে আল্লাহ তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নে‘মতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন? অথচ মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা জ্ঞান, পথনির্দেশ ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বাক-বিতন্ডা করে’ (লোকমান ৩১/২০)
(২০) وَإِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ ‘এবং দেখ পৃথিবীর দিকে, কিভাবে তাকে বিছানো হয়েছে’?
এখানে আল্লাহ পৃথিবী থেকে উপদেশ হাছিলের নির্দেশ দিয়েছেন। যা আল্লাহর এক অপরূপ নিদর্শন। أَرَضَ أَرْضًا أو أَرُضَ أَرَاضَةً অর্থ সবুজ-শ্যামল হওয়া, সুদৃশ্য হওয়া। সেখান থেকে أَرْضٌ অর্থ পৃথিবী। বহুবচনে أَرْضُوْنَ
বান্দার বসবাস ও সহজ বিচরণের জন্য পৃথিবীকে আল্লাহ বিস্তৃত করে দিয়েছেন। মাটিকে তিনি সর্বংসহা করেছেন এবং বান্দার রূযির জন্য শস্য উৎপাদনের উপযোগী করেছেন। পাহাড়ের মত ভূপৃষ্ঠ চার শ্রেণীতে বিভক্ত। এক- ঝোপ-জঙ্গলে পূর্ণ এলাকা। যেমন আফ্রিকার ঘন জঙ্গল বেষ্টিত অঞ্চলসমূহ। তাছাড়া প্রায় প্রত্যেক দেশেই কিছু না কিছু এলাকায় বনভূমি আছে। যার পরিমাণ কমপক্ষে ২৫ শতাংশ হওয়া উচিৎ। নইলে আবহাওয়া বিরূপ হয়ে যায়। দুই- সাগর-নদী বেষ্টিত এলাকা। যেমন বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর অন্যান্য এলাকা। তিন- পাহাড়, মরুভূমি ও উপত্যকা বেষ্টিত এলাকা। যেমন আরব উপদ্বীপ ও আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি এলাকা। চার- তৃণভূমি বেষ্টিত এলাকা। যেমন অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য এলাকা। এছাড়া আবহাওয়ার হিসাবে পৃথিবী ৬টি অঞ্চলে বিভক্ত। যেমন তুন্দ্রা অঞ্চল, উষ্ণ অঞ্চল, মৌসুমী অঞ্চল, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল, তুষার অঞ্চল ও নিরক্ষীয় অঞ্চল। এভাবে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলকে আল্লাহ এক একভাবে সাজিয়েছেন। যাতে প্রত্যেক এলাকার বাসিন্দা অন্য এলাকার বাসিন্দা থেকে উপকৃত হ’তে পারে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপরে নির্ভরশীল থাকে। যাতে এর ফলে মানবজাতি আপোষে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে এবং আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে পারে। আল্লাহ বলেন, أَهُمْ يَقْسِمُوْنَ رَحْمَةَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيْشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضاً سُخْرِياًّ وَّرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ- ‘তারা কি তোমার পালনকর্তার রহমত বণ্টন করে? আমরা তাদের মধ্যে পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকা বণ্টন করে দিয়েছি এবং তাদের একের মর্যাদাকে অন্যের উপরে উন্নীত করেছি, যাতে তারা একে অপর থেকে কাজ নিতে পারে। বস্ত্ততঃ তারা যা সঞ্চয় করে তার চেয়ে তোমার পালনকর্তার রহমত অনেক উত্তম’ (যুখরুফ ৪৩/৩২)
উপরে বর্ণিত চারটি আয়াতে আল্লাহ আরবদের উদ্দেশ্যে চিন্তা-গবেষণার আহবান জানালেও এর মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী মানব জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দুনিয়া ও আখেরাতের উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয় যতক্ষণ না তারা আল্লাহর অস্তিত্বকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে এবং এসব মহান সৃষ্টির সৌন্দর্য ও গূঢ় রহস্য উপলব্ধি করবে। অতঃপর আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর বিধানসমূহ মেনে জীবন পরিচালনা করবে।
বিগত চারটি আয়াতে (১৭-২০) উটের বিস্ময়কর সৃষ্টি কৌশল, আকাশের সীমাহীন উচ্চতা, পাহাড়ের বিশালায়তন সুদৃঢ় স্থাপনা এবং ধরিত্রীর বিপুলা বিস্তৃতি ও তার সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে চিন্তাশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের পর আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
(২১) فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنْتَ مُذَكِّرٌ ‘অতএব তুমি উপদেশ দাও। কেননা তুমি উপদেশদাতা মাত্র’।
তোমার দায়িত্ব পৌঁছে দেওয়া এবং আমাদের দায়িত্ব হিসাব নেওয়া (فإنما عليك البلاغ وعلينا الحساب)। এখানে ইঙ্গিত রয়েছে যে, বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদির সাহায্যে আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনার মাধ্যমে অবিশ্বাসীদের নিকট তাওহীদের দাওয়াত পেশ করা আবশ্যক।
(২২) لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ ‘তুমি তাদের উপরে দারোগা নও’। অর্থাৎ ঈমান আনার বিষয়ে তুমি লোকদের উপর চাপ প্রয়োগকারী কোন শাসক নও। المصيطر و المسيطر অর্থাৎ ছোয়াদ ও সীন উভয় বর্ণে পড়া যায়। অর্থ المسلَّط على الشئ ‘কোন বস্ত্তর উপরে যবরদস্তি চেপে বসা ব্যক্তি’। سَيْطَرَهُ অর্থ صَرَعَهُ ‘সে তাকে পাছড়ে ফেলল’ (কুরতুবী)। صَيْطَرَ او سَيْطَرَ অর্থ দারোগা হওয়া, তত্ত্বাবধায়ক হওয়া। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُوْلُوْنَ وَمَا أَنْتَ عَلَيْهِمْ بِجَبَّارٍ فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَنْ يَّخَافُ وَعِيْدِ- ‘তারা যা বলে তা আমরা সম্যক অবগত আছি। তুমি তাদের উপর যরবদস্তিকারী নও। অতএব যে ব্যক্তি আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে তুমি কুরআন দ্বারা উপদেশ দাও’ (ক্বাফ ৫০/৪৫)। এতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, প্রকৃত জ্ঞানী যারা, তারা সহজেই তাওহীদের দাওয়াত কবুল করে। এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, চাপ দিয়ে কারু হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করানো সম্ভব নয়।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُوْلُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ فَإِذَا قَالُوهَا عَصَمُوا مِنِّى دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّهَا وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ، ثُمَّ قَرَأَ (إِنَّمَا أَنْتَ مُذَكِّرٌ، لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُسَيْطِرٍ)- ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। যখন তারা এটা বলবে, তখন তাদের রক্ত ও সম্পদ আমার থেকে নিরাপদ হবে, তবে ন্যায্য হক ব্যতীত। তাদের হিসাব থাকবে আল্লাহর উপরে। অতঃপর তিনি অত্র আয়াত দু’টি পাঠ করেন’।[8] বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ وَيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ… ‘এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। তারা এগুলো করবে, তখন…।[9]
অত্র হাদীছে কাফির-মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের শর্ত ও সীমারেখা বর্ণিত হয়েছে। এখানে أُقَاتِلَ (পরস্পরে যুদ্ধ করা) বলা হয়েছে, أَقْتُلَ (হত্যা করা) বলা হয়নি। আর লড়াই দু’পক্ষে হয়ে থাকে। কিন্তু হত্যা এক পক্ষ থেকে হয়। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, কাফির-মুশরিকরা যুদ্ধে এলে তোমরা যুদ্ধ করবে। কিংবা তাদের মধ্যেকার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে। নিরস্ত্র, নিরপরাধ বা দুর্বলদের বিরুদ্ধে নয়। কাফের-মুশরিক পেলেই তাকে হত্যা করবে, এর অর্থ সেটা নয়। তাছাড়া উক্ত হাদীছে ‘যারা কালেমার স্বীকৃতি দিবে, তাদের জান-মাল নিরাপদ থাকবে ইসলামের হক ব্যতীত এবং তাদের বিচারের ভার আল্লাহর উপর রইল’ বলা হয়েছে। এত স্পষ্ট যে, আমাদের দায়িত্ব মানুষের বাহ্যিক আমল দেখা। কারু অন্তর ফেড়ে দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে এর অসংখ্য নযীর রয়েছে। হাদীছটি বর্ণনা শেষে রাসূল (ছাঃ) প্রমাণস্বরূপ সূরা গাশিয়াহ ২১ ও ২২ আয়াত দু’টি পাঠ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘নিশ্চয়ই তুমি উপদেশদাতা মাত্র’। ‘তুমি তাদের উপর দারোগা নও’।
অত্র হাদীছের রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ৭ম হিজরীতে খায়বর যুদ্ধের সময় মুসলমান হন। তখন জিহাদ চালু ছিল। কিন্তু কোন নিরস্ত্র ও নিরপরাধ অমুসলিমের বিরুদ্ধে মুসলমানগণ কখনো অস্ত্র প্রয়োগ করেননি।
অত্র হাদীছে শৈথিল্যবাদী মুর্জিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রয়েছে। যারা বলে যে, ঈমানের জন্য মৌখিক স্বীকৃতি বা আমল শর্ত নয়। কেবল হৃদয়ের বিশ্বাসই যথেষ্ট। একইভাবে চরমপন্থী খারেজীদের প্রতিবাদ রয়েছে। যারা বলে যে, আমল ঈমানের অপরিহার্য অংশ। যা না থাকলে সে কাফির হবে ও তার রক্ত হালাল হবে। অথচ সঠিক আক্বীদা এই যে, ঈমান হ’ল মূল, আমল হ’ল তার শাখা। যা না থাকলে কেউ পূর্ণ মুমিন হ’তে পারে না। আমলহীন মুমিন ফাসেক হ’তে পারে। কিন্তু কাফের নয় এবং তার রক্ত হালাল নয়।
(২৩) إِلاَّ مَنْ تَوَلَّى وَكَفَرَ ‘তবে যে ব্যক্তি সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও অবিশ্বাসী হয়ে যায়’। এখানে إِلاَّ অর্থ لكن এবং এটি استثناء منقطع হয়েছে। যা পূর্বে বর্ণিত বিষয়বস্ত্ত (مستثنى منه) থেকে পৃথক। অর্থাৎ لكن من تولى وكفر ‘কিন্তু যে ব্যক্তি উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ এবং কুরআনকে অস্বীকার করে বিশ্বাসে, কথায় ও কর্মে, তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। পক্ষান্তরে إلا -কে استثناء متصل হিসাবে ধরলে استثناء ও مستثنى منه একই বিষয়ভুক্ত (جنس) হবে। তখন অর্থ হবে, لست بمسلط إلا من تولى وكفر فانت عليهم مصيطر ‘তুমি তাদের উপরে চাপ প্রয়োগকারী নও। তবে তারা ব্যতীত, যারা মুখ ফিরিয়ে নেয় ও অস্বীকার করে, তখন তুমি তাদের উপর চাপ প্রয়োগকারী’। কিন্তু এ অর্থ এখানে প্রযোজ্য নয়। কেননা কেউ ঈমান না আনলে তার উপর চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, لاَ إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন যবরদস্তি নেই। নিশ্চয়ই ভ্রষ্টতা হ’তে সুপথ স্পষ্ট হয়ে গেছে’… (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। এজন্য তার পরকালীন শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে। অতএব যদি কেউ কুফরী করে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ‘তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)
(২৪) فَيُعَذِّبُهُ اللهُ الْعَذَابَ الْأَكْبَرَ ‘অতঃপর আল্লাহ তাকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন’। অর্থ لكن من تولى وكفر بعد أن ذكرته فيعذبه الله العذاب الأكبر‘তুমি উপদেশ দেওয়ার পরেও যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেয় ও অস্বীকার করে, আল্লাহ তাকে সবচেয়ে বড় শাস্তি প্রদান করবেন’।
অর্থাৎ চিরস্থায়ী জাহান্নাম। আর সেটাই হ’ল সবচেয়ে বড় শাস্তি। এখানে الْعَذَابَ الْأَكْبَرَ বলার অর্থ এইসব হঠকারী কাফেররা দুনিয়াতে মূর্খতা, হঠকারিতা, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, কারা যন্ত্রণা, হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে যে কষ্ট পায়, তা খুবই নগণ্য। এর বিপরীতে জাহান্নামের শাস্তি হ’ল বড় শাস্তি। তবে এর দ্বারা জাহান্নামে শাস্তির তারতম্য বুঝানো হ’তে পারে পাপের তারতম্য হিসাবে। কেননা জান্নাতের ন্যায় জাহান্নামেরও বহু স্তর থাকবে পাপীদের স্তর হিসাবে।
(২৫) إِنَّ إِلَيْنَا إِيَابَهُمْ ‘নিশ্চয় আমাদের কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন’। অর্থ رجوعهم ومعادهم إلينا بالموت والبعث ‘মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাধ্যমে তারা আমাদের কাছে ফিরে আসবে’। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَاتَّقُوْا يَوْمًا تُرْجَعُوْنَ فِيْهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُوْنَ ‘তোমরা সেদিনকে ভয় কর, যেদিন তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকে পূর্ণরূপে ফলাফল প্রাপ্ত হবে, যা তারা (দুনিয়াতে) অর্জন করেছিল। আর সেদিন তারা কেউ অত্যাচারিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ২১ দিন বা ৭ দিন পূর্বে অবতীর্ণ কুরআনের এটিই সর্বশেষ আয়াত (কুরতুবী)
آبَ يَؤُوْبُ اَوْبًا مَآبًا অর্থ رجع ফিরে আসা। যেমন কবি আবীদ (عبيد) বলেন,
وكــل ذى غَيْبة يَـــؤوبُ + وغـــائبُ الموتِ لا يَــؤُوبُ
‘প্রত্যেক নিখোঁজ ব্যক্তি ফিরে আসে। কিন্তু মৃত্যুর কারণে হারানো ব্যক্তি ফিরে আসে না’ (কুরতুবী)
(২৬) ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا حِسَابَهُمْ ‘অতঃপর আমাদের দায়িত্বে রয়েছে তাদের হিসাব গ্রহণ’। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে তাদের জীবনব্যাপী কর্মের হিসাব আমরা নেব। অতঃপর সে অনুযায়ী তাদের প্রতিদান দেব। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْراً يَّرَهُ، وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرّاً يَّرَهُ- ‘যে ব্যক্তি এক সরিষাদানা পরিমাণ সৎকর্ম করবে, তা দেখা হবে’। ‘এবং যে ব্যক্তি এক সরিষাদানা পরিমাণ অসৎকর্ম করবে, তাও দেখা হবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কোন এক ছালাতে পড়তে শুনলাম اَللَّهُمَّ حَاسِبْنِىْ حِسَابًا يَّسِيْرًا ‘হে আল্লাহ তুমি আমার সহজ হিসাব গ্রহণ কর’। সালাম ফিরানোর পরে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল ما الحسابُ اليسيرُ ‘সহজ হিসাব কি’? তিনি বললেন, أَنْ يَنْظُرَ فِى كِتَابِهِ فَيَتَجَاوَزَ عَنْهُ إِنَّهُ مَنْ نُوْقِشَ الْحِسَابَ يَوْمَئِذٍ يَا عَائِشَةُ هَلَكَ ‘বান্দার আমলনামা দেখা হবে। অতঃপর তা উপেক্ষা করা হবে। কেননা হে আয়েশা! ঐদিন যার হিসাব যাচাই করা হবে, সে ধ্বংস হবে’।[10]
অনেক বিদ্বান অত্র সূরার শেষে অত্র দো‘আটি পাঠ করাকে উত্তম বলেন। যদিও আয়েশা (রাঃ) এর বর্ণনায় সূরার নাম নেই এবং কোন সূরার শেষে রাসূল (ছাঃ) অত্র দো‘আটি পড়েছিলেন, তার উল্লেখ নেই। তবে এটা বুঝা যায় যে, কুরআনের যেসব আয়াতে হিসাব-এর কথা আছে, তা পাঠের পর এ দো‘আ পড়া মুস্তাহাব।
সারকথা :
অত্র সূরায় আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান-গবেষণা সহকারে পূর্ণ সচেতনতার সাথে ঈমান আনার এবং দুনিয়াতে আনুগত্যশীল বান্দা হয়ে আখেরাতে জান্নাতের অধিকারী হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।

[1].মুসলিম হা/৮৭৮, মিশকাত হা/৮৪০ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[2].বুখারী হা/৬৯৩১; মুসলিম হা/১০৬৪; মিশকাত হা/৫৮৯৪ ‘মু‘জেযাসমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[3].মুসলিম হা/২৮১৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৩৭১ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫।
[4].বুখারী হা/৬৪৬৩, মুসলিম হা/২৮১৬, মিশকাত হা/২৩৭২।
[5].তিরমিযী হা/২৫৩০, মিশকাত হা/৫৬১৭ ‘জান্নাত ও তার অধিবাসীদের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ; বুখারী হা/২৭৯০, মিশকাত হা/৩৭৮৭ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[6].ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৬২২, সনদ হাসান।
[7]. জুরজী যায়দান, তারীখু আদাবিল লুগাতিল ‘আরাবিইয়াহ (সম্পাদনা ও টীকা সংযোজনে : ড. শাওক্বী যাইয়েফ; কায়রো : দারুল হেলাল ১৯৫৭) পৃঃ ১/৫৪।
[8].তিরমিযী হা/৩৩৪১; নাসাঈ কুবরা হা/১১৬৭০ সনদ হাসান ছহীহ।
[9].বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১২।
[10]. আহমাদ হা/২৪২৬১; মিশকাত হা/৫৫৬২ ‘হিসাব ও মীযান’ অনুচ্ছেদ; ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীছ ছহীহ।

No comments

Powered by Blogger.