কোরানের গল্প বন্দে আলী মিয়া শাদ্দাদের বেহেশত


শাদ্দাদের বেহেশত
অনেক আগের কথা। আরব দেশে সাদ নামে একটি বংশ ছিলো। এই বংশের লোকদের চেহারা ছিলো যেমন খুব লম্বা এবং চওড়া, গায়েও তেমনি ভীষণ শক্তি।
তারাই ছিলো তখন আরব দেশে প্রবল এবং প্রধান।
তাদের একজন বাদশাহ ছিলো –তার নাম শাদ্দাদ। শাদ্দাদ ছিলো সাত মুলুকের বাদশাহ। তার ধন-দৌলতর সীমা ছিলো না। হাজার হাজার সিন্দুকে ভরা মণি, মুক্তা, হীরা জহরৎ। পিলপানায় লক্ষ লক্ষ হাতী, আস্তাবলে অসংখ্য ঘোড়া। সিপাই-শাস্ত্রী যে কত তার লেখাজোকা ছিলো না। উজীর-নাজীর, পাত্র-মিত্র, আমলা-গোমস্তায় তার রঙমহল দিনরাত গম-গম করতো।
সাধারণতঃ মানুষের ধনদৌলত যদি একটু বেশি থেকে থাকে তবে সে একটু অহঙ্কারী হয়ই। শাদ্দাদ বাদশাহের দেমাগ এত বেশী হয়েছিলযে, একদিন সে দরবারে বসে উজীর-নাজীরদের ডেকে সিংহের মতো হুঙ্কার দিয়ে বললোঃ দেখ, আমার যে রকম শক্তি সামর্থ্য আর খুবসুরৎ চেহারা, তাতে আমি কি খোদা হবার উপযুক্ত নই?
উজীর-নাজীরেরা তাকে তোষামোদ করে বললোঃ নিশ্চয়ই।এত যার ধন-দৌলত, লোক-লস্কর, উজীর-নাজীর, দালান-কোঠা, হাতী-ঘোড়া তিনি যদি খোদা না হন, তবে আর খোদা হবার উপযুক্ত এ দুনিয়ায় কে? এত সিন্দুক ভরা মণিমুক্তা, হীরা-জহরৎ এত হাতী-ঘোড়া আর দরবার ভরা আমাদের মতো উজীর-নাজীর খোদা তার চৌদ্দপুরুষেও দেখেনি। সুতরাং আপনিই আমাদের খোদা।
আরব দেশের লোকেরা সে সময়ে গাছ, পাথর প্রভৃতি পূজা করতো। শাদ্দাদ এটা মোটেই পছন্দ করতো না। সে হুকুম জারি করলোঃ কেউ ইটপাথর বা অন্য মূর্তি পূজা করতে পারবে না, তার বদলে সম্রাট শাদ্দাদকে সকলের পূজা করতে হবে।
সাত মুলুকের বাদশাহ শাদ্দাদ, তার হুকুমের ওপরে কথা বলে এমন সাধ্য কারো নেই। সুতরাং তার হুকুম মতো কাজ চলতে লাগলো।
একদিন গুদ নামক একজন পয়গম্বর তার দরবারে এসে হাজির হলেন। পয়গম্বরেরা খোদার খুব প্রিয়। তাঁরা নবাব বাদশাহদের ভয় করতে যাবেন কেন। হুদ পয়গম্বর তাকে বললেনঃ তুমি নাকি খোদার ওপর খোদকারী করার চেষ্টা করছো? তোমার এ দুঃসাহস কেন? পরকালের ভয় যদি থাকে তবে আল্লাহতা’লার উপর ঈমান আনো।
হুদ নবীর দুঃসাহস দেখে দরবারের সকলে অবাক! উজীর-নাজীর, পাত্র-মিত্র যার ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত-স্বয়ং বেগম সাহেবা যার কথার ওপরে কথা বলতে পারেন না, সামান্য একজন দরবেশ কিনা তাকে দিচ্ছে উপদেশ! এত বাচালতা! ক্রোধে শাদ্দাদের চোখ দুটো দাল হয়ে উঠলো। মেঘগর্জনের মতো হুঙ্কার দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলোঃ মূর্খ ফকির, তোমার খোদাকে মানতে যাবো কিসের জন্য?
হুদ নবী বললেনঃ তিনি পরম মঙ্গলময়। তিনি দুনিয়াতে তোমাকে সুখে রাখবেন এবং মৃত্যুর পর তোমাকে বেহেশতে থাকতে দিবেন।
শাদ্দারেদ ওষ্ঠে এইবার ক্রোধের পরিবর্তে হাসি ফুটে উঠলো। বললোঃ তোমার খোদা কি আমার থেকেও বেশী সুখী।
হুদ হেসে জবাব দিলেনঃ নিশ্চয়ই! খোদাতা’লা নেকবান্দার জন্য বেহেশত তৈরি করেছেন। দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলে পরকালে বেহেশত। বেহেশতের অতুলনীয় শোভা, অনন্ত শান্তি, অফুরন্ত সুখ, চাঁদের মতো খুবসুরৎ হুরী তো তুমি ভোগ করতে পারবে না।
শাদ্দাদ অবজ্ঞা ভরে হো-হো করে হেসে উঠলো। বললোঃ রেখে দাও তোমার খোদার বেহেশতের কাহিনী। অমন আজগুবি গল্প ঢের ঢের শুনেছি।
হুদ বললেনঃ আজগুবি নয় –সত্যি সত্যিই। খোদার এমন অপরূপ বেহেশত কি তোমার পছন্দ হয় না?
শাদ্দাদ জবাব দিলোঃ হবে না কেন –এমন আজব বেহেশত কার অপছন্দ বলো? কিন্তু তাই বলে তোমার খোদার পায়ে আমি মাথা ঠুকতে যাবো কেন? আমি কি খোদার মতো বেহেশত তৈরি করতে পারি না!
হুদ বললঃ বাদশাহ, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, নইলে এমন কথা বলতে না। খোদা যা করতে পারেন তা মানবের সাধ্যাতীত।
শাদ্দাদ সহাস্যে বললোঃ মূর্খেরা এমন কল্পনাই করে বটে! কিন্তু আমি নিশ্চয়ই পারবো। তোমার খোদার চেয়ে আমার টাকা পয়সা লোক-লস্কর কিছু অভাব আছে নাকি? আমি দেখিয়ে দেবো, তোমার খোদার বেহেশত থেকে আমার বেহেশত কত বেশি সুন্দর।
শাদ্দাদের কথা শুনে হুদ ভয়ানক রেগে গেলেন। বললেনঃ মূর্খ বাদশাহ এত স্পর্ধা তোমার! শীঘ্রই দেখতে পাবে –এত অহঙ্কার কিছুতেই খোদা সহ্য করবেন না।
শাদ্দাদ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলেনঃ কে আছ, এই ভিখারীটাকে ঘাড় ধরে বের করে দাও।
হুদ নবী অপমানিত হয়ে চলে গেলেন।
কিছুদিন পরের কথা।
বদখেয়ালী শাদ্দাদ তার তাঁবেদার বাদশাহদের ফরমান জারি করে জানালেনঃ খোদার বেহেশতের চেয়ে বেশী সুন্দর করে অপর একটি বেহেশত আমি সৃষ্টি করতে সঙ্কল্প করেছি। সুতরাং উপযুক্ত জায়গায় সন্ধান করো।
হুকুম মাত্র জায়গা তল্লাসের ধুম পড়ে গেলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আবার দেশের এয়মন স্থানটি সকলের পছন্দ হলো। স্থানটি লম্বায় আট হাজার মাইল আর চওড়ায় ছিলো পাঁচ হাজার মাইল।
বেহেশতের উপযুক্ত জায়গা পাওয়া গেছে শুনে শাদ্দাদ খুশী হলো। তারপর হুকুম জারি করলো যে সাত মুলুকে যে, সব হীরা, মণি, মুক্তা, জহরৎ আছে সব এক জায়দগায় জড়ো করতে হবে। বাদশাহের হুকুম কেউ অমান্য করতে সাহস করলো না।
দেখতে দেখতে দামী দামী হীরা, মণি, পান্না, জহরৎ এয়মন মুলুকে জমা হতে লাগলো।
দুনিয়ার যেখানে যত সুন্দর মূল্যবান জিনিস ছিলো বেহশত সর্বাঙ্গ সুন্দর ইয়াকুত ও মার্বেল যোগার করা হলো। লক্ষ লক্ষ মজুর ও কারিগর কাজ করতে আরম্ভ করলো। দিনরাত পরিশ্রম করে তিনশ’ বছর ধরে বেহেশত রচনা করা হলো। তা সত্য সত্যই বিচিত্র কারুকার্যময় ও অপূর্ব চমকপ্রদ হয়েছিল।
এই বেহেশতের যে দিকে নজর দেওয়অ যায় সেই দিকেই অপরূপ। চারিদিকে শ্বেত পাথরের দেওয়াল ও থাম, তাতে কুশলী শিল্পীদের চমৎকার কারুকার্য-দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দেয়ালের গায়ে নানা রঙের ইয়াকুত পাথর দিয়ে এমন সুন্দর লতাপাতা ও ফুল তৈরি করা হয়েছে যে, ভ্রমর ও মৌমাছির জীবন্ত মনে করে তার ওপরে এসে বসে। রঙমহলের চারিপাশে হাজার হাজার ঝড় লণ্ঠন ঝুলছ, কিন্তু বাতির দরকার হয় না। অন্ধকার রাত্রেও সেই ঘরগুলো চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল।
মহরে ধারেই বসবাস ঘর ও হাওয়াখানা। মণিমুক্তা-খচিত শ্বেত ও কৃষ্ণবর্ণ পাথরের কৌচ ও মেঝে সজ্জিত রয়েছে। মেঝের ওপরে নানারঙের নানা আকারের সুন্দর সুন্দর ফুলদানী, তাতে সাজানো রয়েছে জমরদ ও ইয়াকুত পাথরের নানা রকমের ফুলের তোড়া। তা থেকে আতর গোলাপ মেশক ও জাফরাতের খোশবু ছুটছে।
মহলের চারিপাশে বাগান। বাগানে সোনা রূপার গাছ। তার পাতা, ফল, ফুল, নানা বর্ণের পাথর দিয়ে তৈরি। ভ্রমর ও মৌমাছিগুলো এমন সুন্দরভাবে নির্মিত যে তারা বুঝি সত্য সত্যই ফুলের ওপরে বসে মধু পান করছে। সেই সব ফুলফল থেকে যে সৌরভ বের হচ্ছে তাতে চারিদিকের বাতাস ভর ভর করছে।
এই সব গাছের নিচে দিয়ে কুল কুল শব্দে বয়ে চলেছে গোলাপপানির নহর। তার পানি এত স্বচ্ছ যে, মনে হয় তরর মুক্তার ধারা বয়ে যাচ্ছে। সেই নহরের ধারে ধারে হীরা-মণি-মুক্তার বাঁধানো ঘাট। সেখানে চুনি-পান্নার তৈরি শত শত সুন্দরীরর যেন গোসল করছে।
তার পরেই নাচঘর। কোনো ঘরে ওস্তাদেরা হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে নানা অঙ্গতরী করে গান করছে, বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে –কোনো ঘরে কিন্নকণ্ঠি সুন্দরী বালিকারা তালে তালে নাচছে এবং গান গাইছি। এরাই শাদ্দাদের বেহেশতের হুরী। নানা দেশ-বিদেশ থেকে সংগ্রহ করে এদের এখানে জমায়েত করা হয়েছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নাচছে চাঁদের মতো খুবসুরৎ হাজার হাজার কচি কচি বালক।
অনিন্দ্য সুন্দর করে বেহেশত নির্মাণ করা হয়ে গেলো। শাদ্দাদকে সংবাদ দেওয়া হলো। সে তখন অধীন নবাব বাদশাহদিগকে হুকুমজারি করে জানিয়ে দিলো, তারা যেন শীগগিরই শাদ্দাদের সহিত মিলিত হয়। তাদের সঙ্গে নিয়ে সে তার বেহেশত দেখতে যাবে। প্রজাগণকে আমোদ আহলাদ করবার হুকুম দেওয়া হলো। বাদশাহের হুকুম মেনে তারা নাচ করতে লাগলো এবং হরদম বাজি পোড়াতে লাগলো।
এক শুবদিনে সুন্দর সুসজ্জিত ঘোড়ায় চড়ে পাত্র-মিত্র, উজীর-নাজীর, লোক-লস্কর, সৈন্য-সামন্ত সঙ্গে নিয়ে ঢাক, ঢোল, কাড়া, নাকাড়া, দামামা বাজাতে বাজাতে হাজারবাদশাহ তার সৃষ্ট বেহেশত দেখতে চললো।
গল্পগুজব করতে তারা এগিয়ে চললো। দূর থেকে নজর পড়লো বেহেশতের একটা অংশ। এত চমকপ্রদ, এত জমকালো যে, চোখ ঝলসে যেতে লাগলো। আনন্দে শাদ্দাদের মুখ দিয়ে কথা সরলো না। তাপর একটু সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলোঃ ঐ আমার বেহেশত! ঐ বেহেশতের সিংহাসনে আমি খোদা হয়ে সববো, আর তোমরা হবে আমার ফেরেশতা। হুরীর যখন হাত পা নেড়ে নাচবে আর গাইবে তখন কি মজাই না হবে।
উজীর-নাজীর ওমরাহগণ তার কথায় সায় দিয়ে তোষামোদ করে তাকে কুশী করতে লাগলো। এমনি করতে করতে তারা বেহেশতের দরজায় এসে হাজির হলো। শাদ্দাদ সকলের আগে আগে যাচ্ছিল! সে বেহেশতের দ্বারদেশে একটি রূপবান যুবক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো। তার সুন্দর চেহারা দেখে খুশী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলোঃ তুমি কি এই বেহেশতের দারোয়ান?
যু্বক উত্তর করলোঃ আমি মালাকুল মওৎ!
শাদ্দাদ চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলোঃ তাঁর মানে?
যুবক উত্তর করলোঃ আমি আজরাইল। তোমার প্রাণ বের করে নিয়ে যাবার জন্য খোদা আমাকে পাঠিয়েছেন।
শাদ্দাদ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলো। চিৎকার করে বললোঃ সাবধান! আমার সঙ্গে তামাসা! কে আছিস বলে অন্যের প্রতীক্ষা না করে নিজেই খাপ থেকে তরবারী বের করে যুবককে কাটতে অগ্রসর হলো।
কিন্তু কি আশ্চর্য! তার হাত উঁচু হয়েই রইলো। উত্তেজনায় শরীর দিয়ে দরদর ধারায় ঘাম নির্গত হতে লাগলো। চিৎকার করে বললোঃ সৈন্যগণ, শয়তানকে মাটিতে পুঁতে ফেলো।
যুবক অট্টহাসি হেসে প্রশ্ন করলোঃ কই তোমার সৈন্য সামন্ত?
শাদ্দাদ পিছন ফিরে দেখতে পেলো, তার লোক-লস্কর, সৈন্য-সামন্ত একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভয়ে সে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো। তারপর ভীত কণ্ঠে বললোঃ সত্যই তুমি কি আজরাইল?
আজরাইল বললোঃ হ্যাঁ। দেরী করবার ফুরসৎ আমার নেই। আমি এখনই তোমার প্রাণ বের করে নেবো।
শাদ্দাদ চারিদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলো। সে শিশুর মতো নিঃসহায়ভাবে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো। মিনতি করে বললোঃ একটু সময় আমাকে দাও ভাই আজরাইল। অনেক সাধ করে আমি বেহেশত তৈরি করেছি, একটিবার আমায় তা দেখতে দাও! এই বলে সে ঘোড়া থেকে নামবার চেষ্টা করলো।
মেঘের মতো গর্জন করে আজরাইল বললোঃ খবরদার, এক পা এগিয়ে আসবে না। শাদ্দাদ হাউ-মাউ করতে শুরু করে দিলো। সেই অবস্থাতেই আজরাইলতার প্রাণ বের করে নিয়ে চলে গেলো।
তারপর কি হলো?
হঠাৎ একটা ভীষণ আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে শাদ্দাদের অতি সাধের বেহেশত, তার শ্রী, ঐশ্বর্য, লোক-লস্কর, উজীর-নাজীর, পাত্র-মিত্র সবকিছু চক্ষের পলকে মাটির মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেলো। দুনিয়ার ওপরে তার আর কোন চিহ্নই রইলো না। শুধু মানুষের মনে চিরদিনের মতো আঁকা হয়ে রইলো আত্মম্ভরিতা অহঙ্কারের শাস্তি কিরূপ ভয়ঙ্কর।

No comments

Powered by Blogger.