কোরানের গল্প বন্দে আলী মিয়া - হাজেরার নির্ব্বাসন
হাজেরার নির্ব্বাসন
হযরত ইব্রাহিম একবার ভ্রমণ করতে বেরিয়ে নানা স্থানে ঘুরতে ঘুরতে হারাম দেশে এসে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে কিচুদিন বাস করার পরে সারা খাতুনকে বিবাহ করবার তার সুযোগ ঘটে। আরো কিছুকাল সেখানে কাটিয়ে তিনি মিশর রাজ্যে গিয়ে সেখানকার সুলতানের আতিথ্য গ্রহণ করলেন। সম্রাট তাঁর সৌজন্য ও সহৃদয়তার পরিচয় পেয়ে অতিশয় আকৃষ্ট হলেন এবং তাঁর ধর্মালোচনায় মুগ্ধ হয়ে একান্ত অনুগত হয়ে পড়লেন। কিছুকাল থাকবার পর ইব্রাহিম মিশর ত্যাগ করবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে সম্রাট তাকে বহু ধনরত্ম পারিতোষিক প্রদাণ করেন এবং সেই সঙ্গে একটি পবিত্র-চরিত্রা বাঁদীও তাকে উপহার দেন। সেই বাঁদীটির নাম হাজেরা। হাজেরাকে সঙ্গে নিয়ে নানা দেশ-বিদেশে পরিভ্রমণ করে অবশেষে তিনি প্যালেস্টাইন এসে উপনীত হলেন।
সারা খাতুনের কোন সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করলো না। প্রতিবেশীরা মনে ভাবলেন, তিনি বন্ধ্যা। হযরত ইব্রাহিম পুত্রমুখ দেখতে না পেয়ে মনের কষ্টে দিন কাটান। তাঁকে সর্বদা অতিশয় ম্লান দেখানো। স্বামীর দুঃখ বুঝতে পেরে সারা খাতুন চিন্তা করলেন, তাঁর নিজের গর্ভে তো সন্তানাদি হলো না। হাজেরার সাথে স্বামীর বিবাহ দিলে হয়তো সকলের মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে।
কথাটা তিনি একদিন প্রসঙ্গক্রমে স্বামীর নিকটে ব্যক্ত করলেন। হযরত ইব্রাহিম অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। অনেক দ্বিধার পর তিনি সারা খাতুনকে খুশী করবার অভিপ্রায়ে অবশেষে স্বীকৃত হলেন। এক শুভক্ষণে ইব্রাহিম বিবি হাজেরার পাণি গ্রহণ করলেন এবং সন্তান কামনা করে খোদাতা’লার অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন।
ভক্তের প্রার্থনা কখনো বিফলে যায় না। খোদাতা’লা তাঁর আরজ মঞ্জুর করলেন। যথাসময়ে ইব্রাহিমের একটি চাঁদের মতো শিশু জন্মগ্রহণ করলে। শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বিষন্নপুরী আনন্দে মশগুল হয়ে উঠলো। শিশুটির নাম রাখা হইল ইসমাইল।
নারীর মন অতি বিচিত্র। যে সন্তানের জন্য সারা খাতুন স্বেচ্ছায় সপত্নী গ্রহণ করলেন চাঁদের মতো সেই সন্তানকে দেখে তাঁর মনে হিংসার উদ্রেক হলো। ক্রমে এমন অবস্থা হলো যে, সতীনের পুত্রকে কিছুতেই তিনি আর বরদাশত করতে পারলেন না। এক বাড়িতে নিজের চোখের সম্মুখে সপত্মীপুত্রকে সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠলো। তিনি হযরত ইব্রাহিমকে সর্বদা বিবি হাজেরার দুর্নাম শোনাতে লাগরেন এবং তাদের পরিত্যাগ করবার জন্য স্বামীকে অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু ইব্রাহিম তাঁর অন্যায় আবদার রক্ষা করলেন না।
কিন্তু ভাগ্য যাদের অপ্রসন্ন দুঃখ তাদের সইতেই হয়! শেষ অবধি হাজেরাও খোদার রোষ থেকে রক্ষা পেলেন না। আল্লাহতা’লা ইব্রাহিমকে হাজেরা ও তাঁর পুত্রকে মক্কা নগরীর নিকটে এক মরুভূমিতে নিয়ে গেলেন, তার পর অশ্রুপূর্ণ কণ্ঠে হাজেরাকে বললেনঃ খোদার হুকুমে তোমাকে এখানে রেখে যাচ্ছি। তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। এই বলে তিনি এক মশক পানি ও কিছু খেজুর তাঁকে দিয়ে চলে গেলেন। কিছু দূরে গিয়ে প্রার্থনা করলেনঃ হে খোদা, তোমারই হুকুমে আমার স্ত্রী ও পুত্রকে এস্থানে রেখে যাচ্ছি। তুমি সকলের রক্ষাকর্তা প্রভু, এরা যেন কোন বিপদে না পড়ে –তুমিই এদের রক্ষা করো।
কিছুদিন পরে খাদ্য এবং পানীয় নিঃশেষ হয়ে গেলো। জননীর বুকের দুধের ধারা ক্ষীণ হয়ে এলো। শিশু ইসমাইল ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় চিৎকার করতে লাগলো। হাজেরা নিকটবর্তী পাহাড়ের ওপরে উঠে জলাশয়ের সন্ধান করতে লাগলেন। নিরাশ হয়ে অপর একটি পাহাড়ের শীর্ষদেশে উঠে নিকটে কোনো জনমানবের বসতি আছে কিনা লক্ষ্য করতে লাগলেন এবং মনে মনে খোদার অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে লাগলেন। বারে বারে নিরাশ হয়েও বেচারী হাজেরা একবার সম্মুখে ও একবার পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে ছুটোছুটি করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও পানির সন্ধান তিনি পেলেন না।
হঠাৎ তাঁর নজরে শিশু ইসমাইলের পায়ের আঘাতে পাথরের টুকরা সরে গিয়ে একটা গর্ত হয়েছে ও তার মধ্যে থেকে ক্ষীণ পানির ধারা ধীরে ধীরে বের হচ্ছে। তিনি পরম দয়াবান খোদাতা’লাকে অন্তরে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রাণভরে পানি পান করলেন এবং শিশুর মুখে দিলেন।
ঝরণার চারিধারে বিবি হাজেরা বাঁধ দিয়ে দিলেন, ফলে সেটা একটা সুমিষ্ট পানীয় কূপ তৈরী হলো। ঐ কূপ চার হাজার বৎসর ধরে লোককে পানীয় জুগিয়ে আজও হযরত হাজেরার মাতৃহৃদয়ের আকুল প্রার্থনার সাক্ষ্য দান করছে। ক্রমে ক্রমে ঐ স্থানে লোকের বসতি হয়ে সুবিখ্যাত মক্কা নগরী তৈরী হয়েছে।
সেই সময়ে সদোম নগরীর লোকেরা খোদাতা’লার বিধিনিষেধ না মেনে নানা রকম কুৎসিৎ কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। হযরত লুত তাদের সৎপথে আনবার এবং ধর্মপথে চালাবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। লুতের সদুপদেশ তাদের একেবারেই ভাল লাগে না।
খোদাতা’লা কয়েকজন ফেরেশতাকে সদোম নগরী ধ্বংস করাবর জন্যে প্রেরণ করলেন।
ফেরেশতারা প্রথমে হযরত ইব্রাহিম নিকটে উপস্থিত হলেন। ইব্রাহিম তাদের যথোচিত সমাদরের ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু ফেরেশতারা কিছুই আহার করলেন না, কারণ, তাঁরা সমস্ত আহার বিহারের অতীত। ইব্রাহিম ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রদান করে বললেনঃ সদোম নগরী ধ্বংস করবার জন্য খোদাতা’লা কর্তৃক তাঁরা প্রেরিত হয়েছেন। কারণ নগরের লোকেরা নানারূপে পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ফেরেশতারা সারা খাতুনকে বললেন যে, শীঘ্রই তাঁর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, তাঁর নাম হবে ইসহাক এবং সেই পুত্রের পুত্র হলে তাঁর নাম হবে ইয়াকুব।
কিন্তু সারা খাতুন তাঁদের কথায় সন্দিহান হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে কি করে তার পুত্র হওয়া সম্ভব।
ফেরেশতারা বললেনঃ খোদাতা’লার কৃপায় সকলই সম্ভব।
হযরত ইব্রাহিম সদোম নগরীর ধ্বংস অনিবার্য জেনে পাপী লোকদের জন্য খোদাতা’লার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। কিন্তু খোদাতা’লা তাঁকে জানালেন সেদাম নগরীর ধ্বংস কিছুতেই নিবারিত হবে না।
ফেরেশতারা হযরত লুতের নিকটেও অতিথির ছদ্মবেশে উপস্থিত হলেন এবং তাকেও সদোম নগরীর ধ্বংস সম্পর্কে আল্লাহর অভিপ্রায় জ্ঞাপন করলেন এবং বললেনঃ
তুমি অনুচরবর্গকে সঙ্গে নিয়ে অদ্য রাত্রেই এ-স্থান পরিত্যাগ করো। নইলে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। কারণ খোদাতা’লার রোষ শীঘ্রই এই লোকদের ওপরে পতিত হবে, এমন কি তোমার স্ত্রীও সে গজব থেকে রক্ষা পাবে না।
হযরত লুত সেই রাত্রেই সদোম নগরী পরিত্যাগ করলেন। রজনী প্রভাতের সঙ্গেসঙ্গে প্রবল ঝঞ্ঝা ও ভূমিকম্পে সেই বিশাল নগরীর বিপুল ঐশ্বর্য, অতুল দম্ভ এবং অগণিত নরনারীসহ চিরদিনের জন্য পৃথিবীর বক্ষ বিলুপ্তহয়ে গেলো।
ইব্রাহিম খলিলুল্লা খোদাতা’লার প্রিয়জন
কোরবানি দেন ইসমাইলে তার সন্তান আপন।
এক রাত্রে তিনি খোয়াব দেখলেন
খোদা যেন তাকে হুকুম করেছেন,
‘ইয়া ইব্রাহিম কোরবানি দে কোরবানি দে’।
(তিনি) তিনি ভোরে উঠে শত উট করলেন জবেহ।
ভাবলেন –খোদার আদেশ হরে সমাপন।
পরের রাতে স্বপন দেখেন হুকুম আল্লাহর
প্রাণের চেয়ে প্রিয় যাহা কোরবাহি দিস তার।
প্রাণের চেয়ে প্রিয়! সে ত অপর কেহ নয়
পুত্র কেবল ইসমাইল জবিউল্লাহ হয়।
ইসমাইলে সঙ্গে নিয়ে ময়দানেতে যান
তাঁরে তিনি বধ করবেন একথা জানান,
শহীদ হবে শুনে পুত্র অতি খুশী হন।
ছুরি হাতে ইব্রাহিম বেঁধে নিলেন আখিঁ,
হয়তো মমতা হবে (খোদার কাজে) আসতে পারে ফাঁকি।
চোখ বেঁধে তাই ছুরি চালন পুত্রের গলায়
দেহ হতে মাথা কেটে ভূমিতে লুটায়।
চোখ খুলে চেয়ে দেখন পুত্র বেঁচে আছে
তার বদলে (এক) দুম্বা জবেহ করিয়াছে;
ঈমান পরীক্ষা হলো –ধন্য হলো সে পাক জীবন।
No comments