রাসূল (ছাঃ) -এর দাওয়াতী কার্যক্রম
পূর্বের অংশ পড়ুন: রাসূল (ছাঃ) -এর নবুঅত লাভ ও ছালাতের নির্দেশনা
দাওয়াতের স্তরসমূহ :
১ম স্তর : গোপন দাওয়াত: যেকোন সংস্কার আন্দোলন শুরু করতে গেলে প্রথমে গোপনেই শুরু করতে হয়। পুরা সমাজ যেখানে ভোগবাদিতায় ডুবে আছে, সেখানে ভোগলিপ্সাহীন আখেরাত ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত নিয়ে অগ্রসর হওয়া সাগরের স্রোত পরিবর্তনের ন্যায় কঠিন কাজ। এ পথের দিশা দেওয়া এবং এ পথে মানুষকে ফিরিয়ে আনা দু’টিই কঠিন সাধনার বিষয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেকাজের জন্যই আদিষ্ট হয়েছিলেন। তিনি অতি সংগোপনে দাওয়াত শুরু করলেন। প্রথমেই তাঁর দাওয়াত কবুল করে ধন্য হ’লেন তাঁর পুণ্যশীলা স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)। অতঃপর মুক্ত দাস যায়েদ বিন হারেছাহ, আলী ইবনু আবী তালেব, আবুবকর ইবনু আবী কুহাফা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)। অতঃপর ইসলাম কবুল করেন বেলাল, আমর ইবনু আম্বাসাহ, খালেদ ইবনু সা‘দ ইবনু আছ (রাঃ)। অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-এর দাওয়াতে ইসলাম কবুল করেন ওছমান গণী, যুবায়ের, আবদুর রহমান বিন ‘আওফ, ত্বালহা, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)। অরঃপর আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ, আবদুল আসাদ বিন বিলাল, ওছমান বিন মায‘ঊন, আমের বিন ফুহাইরা, আবু হোযায়ফা বিন ওৎবা, সায়েব বিন ওছমান বিন মায‘ঊন, আরক্বাম (রাঃ) প্রমুখ। মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদীজার পরে রাসূলের চাচা আববাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল, আবুবকরের মেয়ে আসমা, ওমরের বোন ফাতেমা ও তার স্বামী সাঈদ ইবনু যায়েদ, অতঃপর আবুবকরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়েস (রাঃ) প্রমুখ। এতদ্ব্যতীত খাববাব ইবনুল আরত, আবু সালামাহ ও আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ সহ প্রথম তিন বছরে চল্লিশ জনের অধিক ভাগ্যবান ব্যক্তি ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে এরপর পুরুষ এবং মহিলাগণ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকেন। ফলে ইসলাম মক্কায় প্রকাশ্য হয়ে পড়ে ও তা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা হ’তে থাকে।
উপরে যাদের নামের তালিকা দেওয়া হ’ল, তারা কুরায়েশ গোত্রের প্রায় সকল শাখা-প্রশাখার সাথে সরাসরি কিংবা আত্মীয়তা সূত্রে যুক্ত ছিলেন। কুরায়েশ নেতাদের কাছে এঁদের খবর পেঁŠছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা এটাকে স্রেফ ব্যক্তিগত ধর্মাচার মনে করে তেমন কোন গুরুত্ব দেননি।
দ্বিতীয় স্তর : প্রকাশ্য দাওয়াত
আত্মীয়-স্বজনের কাছে তিন বছর যাবৎ গোপন দাওয়াত দেওয়ার পর এবার আল্লাহর হুকুম হ’ল প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার। নাযিল হ’ল, وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ‘নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে ভয় প্রদর্শন করুন’ (শো‘আরা ২৬/২১৪)। কিন্তু প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার প্রতিক্রিয়া যে অতীব কষ্টদায়ক হবে, সে বিষয়ে আগেভাগেই স্বীয় নবীর মন-মানসিকতাকে প্রস্ত্তত করে নেন সূরা শো‘আরা নাযিল করে। ২২৭ আয়াত বিশিষ্ট এই সূরার শুরুতেই আল্লাহ তার নবীকে বলেন,
لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلَّا يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ، إِنْ نَشَأْ نُنَزِّلْ عَلَيْهِم مِّنَ السَّمَاء آيَةً فَظَلَّتْ أَعْنَاقُهُمْ لَهَا خَاضِعِينَ-
‘লোকেরা ঈমান আনছে না বলে হয়ত আপনি মর্মবেদনায় আত্মঘাতি হবার উপক্রম করেছেন’। ‘জেনে রাখুন, আমরা যদি ইচ্ছা করি, তাহ’লে আকাশ থেকে তাদের উপরে এমন নিদর্শন (গযব) অবতীর্ণ করতে পারি, যা দেখে এদের সবার (উদ্ধত) গর্দান অবনত হয়ে যাবে’ (শো‘আরা ২৬/৩-৪)। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, গর্বিত সমাজনেতাদের আচরণে বেদনাহত হয়ে তাওহীদের দাওয়াত থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। বরং আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে বুকে বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এরপরে আল্লাহ অতীতের সাতজন শ্রেষ্ঠ নবীর দাওয়াতী জীবন ও তাদের স্ব স্ব কওমের অবাধ্যাচরণ ও তার পরিণতি সংক্ষেপে আকর্ষণীয় ভাষায় পেশ করেছেন। যাতে আগামীতে প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে শেষনবীর কোনরূপ মনোকষ্ট না হয়। শুরুতেই হযরত মূসা (আঃ)-এর জীবনালেখ্য ১০-৬৮ আয়াত পর্যন্ত, অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) ৬৯-১০৪, তারপর নূহ (আঃ) ১০৫-১২২, অতঃপর হূদ (আঃ)-এর কওমে ‘আদ ১২৩-১২৪, তারপর হযরত ছালেহ (আঃ)-এর কওমে ছামূদ ১৪১-১৫৯, তারপর হযরত লূত্ব (আঃ)-এর কওম ১৬০-১৭৫, অতঃপর হযরত শু‘আয়েব (আঃ)-এর কওম আছহাবুল আইকাহ ১৭৬-১৯১ পর্যন্ত তাদের কওমের উপরে আসমানী গযব নাযিল হওয়ার ঘটনাবলী বর্ণনা করার পর তিনি স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
فَلاَ تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهاً آخَرَ فَتَكُوْنَ مِنَ الْمُعَذَّبِيْنَ- وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ- وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ- وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ-
‘অতএব আপনি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করবেন না। করলে আপনি আযাবে পতিত হবেন’। ‘আপনি আপনার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে সতর্ক করুন’। ‘এবং আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হৌন’। ‘যদি তারা আপনার অবাধ্যতা করে, তবে বলে দিন, তোমরা যা কর, তা থেকে আমি মুক্ত’। আপনি ভরসা করুন পরাক্রমশালী ও দয়াবান (আল্লাহর) উপরে’ (শো‘আরা ২৬/২১৩-২১৭)।
উল্লেখ্য যে, কুরআনে বর্ণিত নবীগণের উপরোক্ত ক্রমধারায় আগপিছ রয়েছে। প্রকৃত ক্রমধারা হবে প্রথমে নূহ (আঃ), অতঃপর হূদ, অতঃপর ছালেহ, অতঃপর ইবরাহীম, লূত্ব, শু‘আয়েব ও মূসা (আলাইহিমুস সালাম)। কুরআন তার নিজস্ব বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে এরূপ আগপিছ করেছে। কেননা ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করা নয়, বরং বিষয়বস্ত্ত পেশ করাই কুরআনের মূল উদ্দেশ্য।
এলাহী নির্দেশের সারকথা
বর্ণিত পাঁচটি আয়াতের প্রথমটিতে (২১৩) রাসূলকে তাওহীদের উপরে যেকোন মূল্যে দৃঢ় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সম্প্রদায়ের ভয়ে শিরকের সাথে আপোষ করলে এলাহী গযবের ধমকি প্রদান করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে (২১৪) নিজ নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে’। এতে অবশ্যই একদল তাঁর পক্ষে আসবে, একদল তার বিপক্ষে যাবে। এটা নিশ্চিত জেনেই বলা হয়েছে, আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হৌন এবং বিরোধীদের বলে দিন যে, তোমাদের কর্মের ব্যাপারে আমি মুক্ত। আমার দায়িত্ব ছিল তোমাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকা। সে দায়িত্ব আমি পালন করেছি। না মানলে তার ফল ভোগ করবে তোমরাই। শেষে বলা হয়েছে, তাদের বিরোধিতায় আপনি মোটেই ঘাবড়াবেন না। সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা করুন।
দাওয়াতের কৌশল সমূহ
আত্মীয়দের নিকটে প্রকাশ্যে দাওয়াত দানের জন্য তিনি একাধিক কৌশল অবলম্বন করেন। যেমন- (১) তিনি নিজ গোত্র বনু হাশেম-এর নেতৃস্থানীয় লোকদের নিজ বাড়ীতে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। ঐ সমাবেশে বনু মুত্ত্বালিবের কিছু লোক সহ সর্বমোট প্রায় ৪৫ জনের মত মেহমান ছিলেন। রাসূলের গোপন দাওয়াত সম্পর্কে নিকটতম প্রতিবেশী আবু লাহাব আগেই জেনে গিয়েছিল। তাই সে মনে মনে খুব ক্রুদ্ধ ছিল। আজকের নেতৃবৃন্দের সমাবেশ দেখে তার সন্দেহ জেগেছিল যে, মুহাম্মাদ তার নতুন দাওয়াত এখানে পেশ করতে পারেন। সেকারণ আগেভাগেই সে রাসূলকে ধমকের সুরে অনেকগুলি আজেবাজে কথা বলল। যাতে কথা বলার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেল। ফলে সেদিন নীরবেই তিনি সকলকে বিদায় দিলেন।
(২) কয়েকদিন পরে তিনি দ্বিতীয়বার অনুরূপ সম্মেলন আহবান করেন। এইদিন তিনি আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপনের পরে স্বীয় গ্রোত্রনেতাদের নিকটে খোলামেলা বলে দেন যে,
إِنِّىْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُمْ خَاصَّةً وَإِلَى النَّاسِ وَاللهِ لَتَمُوْتُنَّ كَمَا تَنَامُوْنَ وَلَتُبْعَثُنَّ كَمَا تَسْتَيْقِظُوْنَ ولَتُحَاسَبُنَّ بِمَا تَعْمَلُوْنَ وإنَّهَا الجنةُ أَبدًا أَوِ النارُ أَبدًا-
‘আমি আপনাদের প্রতি বিশেষভাবে এবং সকল মানুষের জন্য সাধারণভাবে আল্লাহর রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহর কসম! আপনারা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবেন যেভাবে ঘুমিয়ে যান এবং অবশ্যই পুনরুত্থিত হবেন যেভাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। অতঃপর অবশ্যই আপনাদের কৃতকর্মের হিসাব নেওয়া হবে। অতঃপর চিরস্থায়ী জান্নাত লাভ হবে। নতুবা চিরস্থায়ী জাহান্নাম’।
এ পর্যন্ত শুনে চাচা ও গোত্রনেতা আবু তালেব কিছু ভূমিকা স্বরূপ বলার পরে বললেন,
فَامضِىْ لما أُمِرْتَ به لاَ أَزَالُ أَحُوْطُكَ وَأَمْنَعُكَ غَيْرَ أَنَّ نَفْسِىْ لاَتُطَاوِعُنِىْ على فِرَاقِ دِيْنِ عَبْدِ المطَّلِبِ-
‘তোমাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, সেমতে তুমি কাজ চালিয়ে যাও। আল্লাহর কসম! আমি অবিরতভাবে তোমার দেখাশুনা করব এবং হেফাযত করব। তবে আবদুল মুত্ত্বালিবের দ্বীন ত্যাগ করতে আমার অন্তর সায় দেয় না’। তখন আবু লাহাব লাফিয়ে উঠে রাসূলের উদ্দেশ্যে বাজে উক্তি করে তাকে গ্রেফতার করতে বলল। সাথে সাথে আবু তালেব বলে উঠলেন, واللهِ لَنَمْنَعُهُ مَابَقِيْنَا ‘আল্লাহর কসম! যতদিন আমরা বেঁচে থাকব, তার হেফাযত করব’।
এভাবে রাসূলের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হ’লেও দ্বিতীয় প্রচেষ্টা এক অর্থে সফল হ’ল এজন্য যে, কেউ না হৌক অন্ততঃ চাচা ও গোত্রনেতা আবু তালেবের প্রকাশ্য সমর্থন নিশ্চিত হ’ল।
(৩) এবারে তিনি কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রকে একত্রিত করে তাদের সামনে দাওয়াত দিতে মনস্থ করলেন। তৎকালীন সময়ে নিয়ম ছিল যে, বিপদসূচক কোন খবর থাকলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে আহবান করতে হত। আসন্ন কোন বিপদের আশংকা করে তখন সবাই সেখানে ছুটে আসত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেমতে একদিন ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে ডাক দিলেন, يَاصَبَاحَاه (প্রত্যুষে সবাই সমবেত হও!)। কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রের লোক দ্রুত সেখানে জমা হয়ে গেল। এবার তিনি তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের উপরে ঈমান আনার আহবান জানালেন। অতঃপর বললেন, হে কুরায়েশগণ! যদি আমি বলি যে, এই পাহাড়ের অপর পার্শ্বে একদল পরাক্রান্ত শত্রুসৈন্য তোমাদের উপরে হামলার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহ’লে তোমরা কি কথা বিশ্বাস করতে? সকলে সমম্বরে বলে উঠল, অবশ্যই করব। কেননা مَاجَرَّبْنَا عَلَيْكَ إِلاَّصِدْقًا ‘আমরা এযাবৎ আপনার নিকট থেকে সত্য ব্যতীত কিছুই পাইনি’। তখন রাসূল বললেন, فَإِنِّىْ نَذِيْرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍ شَدِيْدٍ ‘আমি কিয়ামতের কঠিন আযাবের প্রাক্কালে তোমাদের নিকটে ভয় প্রদর্শনকারী রূপে আগমন করেছি’।[1]
অতঃপর তিনি আবেগভরে এক একটি গোত্রের নাম ধরে ধরে ডেকে বলতে থাকলেন, يَامَعْشَرَ قُرَيْشٍ! أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ ‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুওয়াই! হে বনু আবদে মানাফ! … হে বনু আবদে শাম্স! .. হে বনু হাশেম! … হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। অতঃপর ব্যক্তির নাম ধরে ধরে বলেন, হে আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! আপনি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান! হে ছাফিয়াহ, রাসূলুল্লাহর ফুফু! আপনি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান। يَا فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ! أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ، وَاللهِ لاَ أُغْنِيْ عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا- হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! তুমি আমার মাল সম্পদ থেকে যা খুশী নাও! কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না’।[2]
এই মর্মস্পর্শী আবেদন গর্বোদ্ধত আবু লাহাবের অন্তরে দাগ কাটেনি। সে মুখের উপরে বলে দিল- تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا؟ ‘সকল দিনে তোমার উপরে ধ্বংস আপতিত হৌক! এজন্য তুমি আমাদের জমা করেছ’? অতঃপর সূরা লাহাব নাযিল হয় تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ ‘আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হৌক এবং সে ধ্বংস হয়েছে’।
তিনি নিজ সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বাজারে-ঘাটে সর্বত্র বিশেষ করে হজ্জের মৌসুমে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, قُوْلُوْا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا ‘তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’।
আবু লাহাবের পরিচয় ও তার পরিণতি :
আবু লাহাব ছিল আব্দুল মুত্ত্বালিবের অন্যতম পুত্র। তার নাম ছিল আব্দুল উযযা। লালিমা যুক্ত গৌরবর্ণ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ার কারণে তাকে ‘আবু লাহাব’ অর্থাৎ ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ওয়ালা’ বলা হ’ত। আল্লাহ তার জন্য এই নামই পসন্দ করেছেন। কেননা এর মধ্যে তার জাহান্নামী হবার দুঃসংবাদটাও লুকিয়ে রয়েছে। তাছাড়া ‘আব্দুল ওযযা’ নাম কুরআনে থাকাটা তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। তার স্ত্রী ছিল আবু সুফিয়ানের বোন আরওয়া (أروى) অথবা ‘আওরা’ (العوراء) ওরফে উম্মে জামীল বা সুন্দরের উৎস। তবে তার চোখ ‘ট্যারা’ ছিল বিধায় ইবনুল ‘আরাবী উক্ত মহিলাকে ‘আওরা উম্মে ক্বাবীহ’ (عوراء ام قبيح) মন্দের উৎস বলেন’ (কুরতুবী)। তিনিও স্বামীর অকপট সহযোগী ছিলেন এবং সর্বদা রাসূলের বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকতেন। চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায় حمالة الحطب বা খড়িবাহক বলা হ’ত। অর্থাৎ ঐ শুষ্ককাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন বিস্তার লাভ করে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করতেন আড়ালে থেকে। সেকারণ আল্লাহ তাকেও স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন। রাসূলের বিরুদ্ধে হেন অপপ্রচার নেই, যা আবু লাহাব করত না। আবু লাহাব ছিল রাসূলের আপন চাচা এবং নিকটতম প্রতিবেশী। (১) তার দুই ছেলে উৎবা ও উতাইবার সাথে নবুঅত পূর্বকালে রাসূলের দুই মেয়ে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। কিন্তু নবী হওয়ার পরে সে তার ছেলেদেরকে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করে। এই দুই মেয়েই পরবর্তীতে একের পর এক হযরত উছমানের সাথে বিবাহিতা হন। (২) রাসূলের দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ (যার লকব ছিল তাইয়েব ও তাহের) মারা গেলে সে খুশীতে বাগবাগ হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলে মুহাম্মাদ এখন লেজকাটা নির্বংশ (الأتبر) হয়ে গেল। যার প্রেক্ষিতে সূরা কাওছার নাযিল হয়। (৩) হজ্জের মৌসুমে সে রাসূলের পিছে লেগে থাকত। যেখানেই রাসূল দাওয়াত দিতেন, সেখানেই সে তাঁকে গালি দিয়ে লোককে ভাগিয়ে দিত, আর বলত إِنَّهُ صَابِئِىْ كَذّابٌ فَلاَتُصَدِّقُوْهُ ‘এ লোকটি বিধর্মী মিথ্যাবাদী তোমরা এর কথা বিশ্বাস করো না’।[3] এমনকি ‘যুল মাজায’ নামক বাজারে যখন তিনি লোকদের বলছিলেন, তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তাহ’লে সফলকাম হবে, তখন পিছন থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে সে পাথর ছুঁড়ে মারে। তাতে রাসূলের পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যায়।[4]
(৪) তার স্ত্রী আরওয়া ওরফে উম্মে জামীল রাসূলের বিরুদ্ধে নানাবিধ দুষ্কর্মে পটু ছিল। সে রাসূলের যাতায়াতের পথে বা তাঁর বাড়ীর দরজার মুখে কাঁটা ছড়িয়ে বা পুঁতে রাখত। যাতে রাসূল কষ্ট পান। (৫) অন্যতম কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের বোন এই মহিলা ছিল একজন কবি। নানা ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ করে লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলত। সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে পাথর খন্ড নিয়ে রাসূলকে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল সামনে থাকা সত্তেবও সে তাঁকে দেখতে পায়নি। (৬) তাই পাশে দাঁড়ানো আবুবকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসা মূলক কবিতা বলে ফিরে আসে। উক্ত কবিতায় সে ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলে। যেমন مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا- ‘নিন্দিতের আমরা নাফরমানী করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করি’।[5] উল্লেখ্য যে, কুরায়েশরা রাসূলকে গালি দিয়ে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলত।[6]
পরিণতি :
বদর যুদ্ধের এক সপ্তাহ পরে আবু লাহাবের গলায় প্লেগের ফোঁড়া দেখা দেয়। আজকের ভাষায় যাকে গুটি বসন্ত (Small Pox) বলা যায়। যার প্রভাবে তার সারা দেহে পচন ধরে। সংক্রামক মহামারীর কারণে তার পরিবারের লোকেরা তাকে দূরে নির্জন স্থানে ফেলে রেখে আসে এবং সেখানে সে এক সময় নিঃসঙ্গ-নিঃসহায় অবস্থায় মরে পড়ে থাকে। তার বিপুল ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যে কোন কাজে লাগেনি, সেটা সে নিজ চোখেই দেখে যায়। তিন দিন যাবৎ তার মৃতদেহ আপনজন কেউ দেখেনি। অবশেষে দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেখানেই গর্ত খুঁড়ে তাকে পুঁতে ফেলা হয়। অহংকারীর পরিণাম এরূপই হয়ে থাকে।
স্ত্রীর পরিণতি :
মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিত। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, সে রাতের বেলায় একাজ করত। একদিন সে বোঝা বহন করে আনতে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়ে। তখন ফেরেশতা তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে এবং হালাক করে দেয়’ (কুরতুবী)।
তৃতীয় স্তর : প্রকাশ্য দাওয়াত মক্কাবাসীদের নিকটে
ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কুরায়েশ বংশের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর পর এবার আল্লাহর রাসূলকে সর্বস্তরের মানুষের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ-
‘আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে বর্ণনা করুন এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না।’ ‘বিদ্রূপকারীদের জন্য আমরাই আপনার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)।
উল্লেখ্য যে, ঐ সময় বিদ্রূপকারীদের নেতা ছিল পাঁচ জন: ‘আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনে মুত্ত্বালিব, আসওয়াদ ইবনে আব্দে ইয়াগূছ, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ এবং হারিছ ইবনে তালাতিলা। এই পাঁচ জনই আল্লাহর হুকুমে একই সময়ে মৃত্যুবরণ করে। এভাবেই আল্লাহর ওয়াদা সত্যে পরিণত হয়।
প্রকাশ্য দাওয়াতের ব্যাপক নির্দেশ পাওয়ার পর আল্লাহর রাসূল মক্কার হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাজারে-বস্তিতে সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে থাকলেন। তিনি ও তাঁর সাথীরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এই সময় তাঁরা মূর্তিপূজার অসারতা, শিরকী আক্বীদার ক্ষতিকারিতা এবং তাওহীদের উপাকরিতা বুঝাতে থাকেন। সাথে সাথে মানুষকে আখেরাতে জবাবদিহিতার বিষয়ে সচেতন করতে থাকেন। উল্লেখ্য যে, মাক্কী জীবনে যে ৮৬টি সূরা নাযিল হয়েছে, তার প্রায় সবই ছিল আখেরাত ভিত্তিক। এর মাধ্যমে দুনিয়া পূজারী বস্ত্তবাদী মানুষকে আখেরাতমুখী করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এটাই হ’ল সমাজ পরিবর্তনের ও ইসলামী সমাজ গঠনের প্রধান হাতিয়ার। সেই সাথে আরবের গোত্রীয় হিংসা, দলাদলি ও হানাহানির অবসানকল্পে এবং দাস-মনিব ও সাদা-কালোর উঁচু-নীচু ভেদাভেদ চূর্ণ করার লক্ষ্যে তিনি এক আল্লাহর গোলামীর অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ঘোষণা করেন।
[1] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৬।
[2] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৭৩।
[3] আহমাদ হা/১৬০৬৬, ১৬০৬৯, সনদ হাসান; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯, সনদ ছহীহ।
[4] ছহীহ ইবনু হিববান, হাকেম ২/৬১১; দ্বারাকুৎনী হা/২৯৫৭, সনদ হাসান; তফসীরে কুরতুবী।
[5] আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮৭।
[6] বুখারী, মিশকাত হা/৫৭৭৮।
No comments