তাবুক যুদ্ধ

পূর্বের অংশ পড়ুন: হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধ


তাবুক যুদ্ধ (غزوة تبوك)
(৯ম হিজরীর রজব মাস)
পটভূমি :
এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের শেষ যুদ্ধ এবং যা রোমকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। তৎকালীন সময়ের অর্ধেক পৃথিবীর একচ্ছত্র শাসক রোম সম্রাটের সিরিয় গবর্ণরের বিরুদ্ধে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে পরিচালিত ‘মুতা’ অভিযানে এক অসম যুদ্ধে রোমকদের পিছুটানের ফলে আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রভাব বিস্তৃত হয়। তাতে যুগ যুগ ধরে রোমকদের শাসন-শোষণে নিষ্পিষ্ট আরবদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগরিত হয়। বিশেষ করে আরব ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী রোম শাসিত শাম রাজ্যের জন্য তা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়।
এ সময় মদীনার সাবেক আউস নেতা ও খৃষ্টান ধর্মীয় গুরু আবু আমের আর-রাহেব হোনায়েন যুদ্ধের পর সবদিক দিয়ে নিরাশ হয়ে অবশেষে সিরিয়ায় (শাম) চলে যান। কেননা এটি তখন ছিল খৃষ্টানদের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে গিয়ে তিনি রোম সম্রাটকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে মদীনার মুনাফিকদের সাথে তিনি পুরা যোগাযোগ রাখেন এবং তাদেরকে দিয়ে তিনি মসজিদে ক্বোবার অদূরে ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণ করান মসজিদের মুখোশে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে। রোম সম্রাটকে তিনি বুঝাতে সক্ষম হন যে, মদীনায় মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তার একটি বিরাট দল রয়েছে। যারা বাহ্যিকভাবে মুহাম্মাদের দলে মিশে আছে। বাইরে থেকে রোমকরা হামলা করলেই তারা ঘুরে দাঁড়াবে এবং রোমকদের সহজ বিজয় লাভ হবে। উল্লেখ্য যে, ওহোদ যুদ্ধে শহীদ এবং ফেরেশতারা যার লাশ গোসল করান, সেই বিখ্যাত ছাহাবী হানযালা ছিলেন এই ফাসেক আবু আমেরের পুত্র। আবু আমের আমৃত্যু গোমরাহী ও খৃষ্টবাদের উপরে অবিচল ছিলেন। فسماه رسول الله صلى الله عليه وسلم الفاسق রাসূল (ছাঃ) তার লকব দেন ‘আবু আমের আল-ফাসেক’।[1]
একদিকে রাজনৈতিক বাস্তবতা অন্যদিকে আবু আমেরের এই প্ররোচনা রোম সম্রাটকে উৎসাহিত করল। পূর্ণরূপে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই উঠতি ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করে দেবার সংকল্প নিয়ে তিনি ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততি শুরু করেন। যাতে রোম সাম্রাজ্য সংলগ্ন আরব এলাকা থেকে ভবিষ্যতে কোনরূপ ফিৎনা বা বিদ্রোহ দেখা দেবার সুযোগ সৃষ্টি না হয়।
মদীনায় রোমক ভীতি :
রোম সম্রাটের ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততির খবর মদীনায় পৌঁছে গেলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভীতির সঞ্চার হয়। বিশেষ করে মুনাফিকদের অধিকমাত্রায় অপপ্রচারের ফলে সাধারণ ও দুর্বলমনা মুসলমানদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
রোমকভীতি মুসলমানদের মধ্যে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল, নিম্নের ঘটনাটি দ্বারা বুঝা যায়-
ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, আমার একজন আনছার বন্ধু ছিলেন। যখন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির না থাকতাম, তখন তিনি আমার নিকটে সংবাদাদি পৌঁছে দিতেন। আর তিনি যখন উপস্থিত না থাকতেন, তখন আমি তার নিকটে তা পৌঁছে দিতাম। তাঁরা উভয়ে প্রতিবেশী ছিলেন এবং মদীনার উপকণ্ঠে (عوالى المدينة) বসবাস করতেন। তারা পালাক্রমে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত থাকতেন। তিনি বলেন, আমরা সবাই গাসসানী সম্রাটকে ভয় করতাম। কেননা আমাদের বলা হয়েছিল যে, সত্বর তারা আমাদের উপরে হামলা করবে। ফলে আমাদের অন্তরগুলি সর্বদা তাদের ভয়ে পূর্ণ থাকত।
একদিন হঠাৎ আমার ঐ আনছার বন্ধু দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেন, افتح، افتح দরজা খুলুন, দরজা খুলুন! আমি ভয়ে বলে উঠলাম, جاء الغساني؟ ‘গাসসানী এসে গেছে?’ তিনি বললেন, না, বরং তার চেয়ে কঠিন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়েছেন’।[2] অর্থাৎ তিনি স্ত্রীদের সঙ্গে ‘ঈলা’ (الإيلاء) করেছেন। ৯ম হিজরীর প্রথমভাগের এই সময় স্ত্রীদের উপরে অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের থেকে পৃথক থাকার শপথ করে একমাসের জন্য ‘ঈলা’ করেন এবং তাদের থেকে পৃথক হয়ে একটি নির্জন কক্ষে অবস্থান করেন। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম মূল বিষয়টি বুঝতে না পেরে একে তালাক ভেবেছিলেন। অবশ্য ঈলার মেয়াদ চার মাস অতিক্রম হয়ে গেলে তখন তালাকের প্রশ্ন চলে আসে।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের উপরোক্ত বর্ণনা থেকে সহজে অনুমান করা চলে যে, ঐ সময় রোমকভীতি মুসলমানদের কিভাবে গ্রাস করেছিল। মুনাফিকদের অতিরঞ্জিত প্রচার ও ব্যাপক রটনা উক্ত ভীতিকে আরো প্রকট করে তুলেছিল।
রোমকদের যুদ্ধ যাত্রার খবর :
এইরূপ ভীতিকর অবস্থার মধ্যে শাম থেকে মদীনায় আগত তৈল ব্যবসায়ী নাবাত্বী দলের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া গেল যে, রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার একজন বিখ্যাত সেনাপতির অধীনে ৪০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত করেছেন। যার মধ্যে লাখাম, জোযাম প্রভৃতি খৃষ্টান গোত্রগুলি সহ অন্যান্য আরব মিত্র গোত্রসমূহ রয়েছে। তাদের অগ্রবর্তী বাহিনীটি ইতিমধ্যে সিরিয়ার বালক্বা (البلقاء) নগরীতে পৌঁছে গেছে।
খবরটি এমন সময় পৌঁছল, যখন ছিল গ্রীষ্মকাল এবং ফল পাকার মৌসুম। মানুষের মধ্যে ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্রে্যর তীব্র কষাঘাত। রাস্তা ছিল বহু দূরের এবং অতীব ক্লেশকর।
রাসূল (ছাঃ)-এর যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চিন্তা করলেন যে, আরব এলাকায় রোমকদের প্রবেশ করার আগেই তাদেরকে তাদের সীমান্তের মধ্যেই আটকে ফেলতে হবে। যাতে আরব ও মুসলিম এলাকা অহেতুক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অন্য সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘তাওরিয়া’ (الةورية) করেন। অর্থাৎ একদিকে যাওয়ার কথা বলে অন্যদিকে যেতেন। কিন্তু এবার তিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন যে, রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে। অতঃপর এ ব্যাপারে তিনি সবাইকে জোরালোভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন। যাতে ভীতি ঝেড়ে ফেলে সবাই যুদ্ধের জন্য জোরে শোরে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে পারে। দেখা গেল যে, একমাত্র মুনাফিকরা ব্যতীত সবাই যুদ্ধে যাত্রার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। মক্কাবাসীদের নিকটে ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলির নিকটে খবর পাঠানো হ’ল। একই সময়ে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হ’ল মুনাফিকদের যুদ্ধভীতির বিরুদ্ধে ও মিথ্যা ওযর-আপত্তির বিরুদ্ধে। এতদ্ব্যতীত জিহাদের ফযীলত এবং এতদুদ্দেশ্যে দান-ছাদাক্বার ফযীলত সম্পর্কে অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। গ্রীষ্মের খরতাপ, ফসলের মৌসুম, ক্লেশকর দীর্ঘ সফরের কষ্ট সবকিছু ভুলে গিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় জিহাদে গমন করার ও জিহাদ ফান্ডে দান করার মধুর ও তীব্র প্রতিযোগিতা। এই সময় মুনাফিকেরা মসজিদে ক্বোবার অনতিদূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করে এবং সেখানে গিয়ে ছালাত আদায়ের জন্য রাসূল (ছাঃ)-কে দাওয়াত দেয়। রাসূল (ছাঃ) তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেখানে যাবেন বলে কথা দেন। ইতিহাসে এটি ‘মসজিদে যেরার’ নামে পরিচিত।
জিহাদের প্রস্ত্ততি ও দানের প্রতিযোগিতা :
জিহাদে গমনের নির্দেশ প্রচারিত হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিহাদের প্রস্ত্ততি শুরু করে দেয়। যাদের বাহন ছিল না, তারা ছুটে আসেন রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে বাহনের জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। ফলে যারা বাহন পেলেন না, তারা জিহাদে যেতে না পারার শোকে কেঁদে বুক ভাসালেন। তাদের এই একনিষ্ঠতার কথা আল্লাহ পাক বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাষায়-
وَلاَ عَلَى الَّذِيْنَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّواْ وَّأَعْيُنُهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَناً أَلاَّ يَجِدُواْ مَا يُنْفِقُوْنَ-
‘এবং অভিযোগ নেই ঐসব মুমিনের উপর, যারা আপনার নিকটে এসেছে বাহনের জন্য। অথচ আপনি বলেছেন, তোমাদের জন্য কোন বাহন আমি পাচ্ছি না। তখন তারা ফিরে যাচ্ছে এমতাবস্থায় যে, তাদের চক্ষুগুলি দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল এই দুঃখে যে, তারা ব্যয় করার মত কিছুই পাচ্ছে না’ (তওবাহ ৯/৯২)
জিহাদ ফান্ডে দানের প্রতিযোগিতা :
(১) আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) তাঁর সর্বস্ব এনে হাযির করলেন। আল্লাহ ও রাসূল ব্যতীত তার পরিবারের জন্য কিছুই ছেড়ে আসেননি। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি জিহাদ ফান্ডে দানের সূচনা করেন।
(২) ওমর ফারূক (রাঃ) তার সমস্ত মাল-সম্পদের অর্ধেক নিয়ে এলেন।
(৩) ওছমান গণী (রাঃ) পরপর পাঁচবারে হাওদাসহ ৯০০ উট, গদি ও পালান সহ ১০০ ঘোড়া, প্রায় সাড়ে ৫ কেজি ওযনের কাছাকাছি ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা, প্রায় ২৯ কেজি ওযনের কাছাকাছি ২০০ উক্বিয়া রৌপ্য মুদ্রা দান করেন। স্বর্ণমুদ্রাগুলি যখন রাসূলের কোলের উপরে তিনি ঢেলে দেন, তখন রাসূল (ছাঃ) সেগুলি উল্টে-পাল্টে বলতে থাকেন, مَا ضَرَّ عُثْمَانَ مَا فَعَلَ بَعْدَ الْيَوْمِ ‘আজকের দিনের পর কোন আমলই ওছমানের কোন ক্ষতি করবে না’।[3] এই বিপুল দানের জন্য তিনি مجهز جيش العسرة অর্থাৎ ‘তাবুক যুদ্ধের রসদ যোগানদাতা’ খেতাব প্রাপ্ত হন (ইবনু খালদূন)
(৪) আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) ২০০ উক্বিয়া রৌপ্যমুদ্রা দান করেন।
(৫) আববাস ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিব বহু মাল-সামান নিয়ে আসেন।
(৬) আছেম বিন আদী ৯০ অসাক্ব অর্থাৎ প্রায় ১৩,৫০০ কেজি খেজুর জমা দেন। এতদ্ব্যতীত ত্বালহা, সা‘দ বিন ওবাদাহ, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ প্রমুখ প্রচুর মাল-সম্পদ দান করেন। এভাবে এক মুদ, দুই মুদ করে কম-বেশী দানের স্রোত চলতে থাকে।
মহিলাগণ তাদের গলার হার, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা অলংকার ছিল, রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পাঠিয়ে দেন। কেউ সামান্যতম কৃপণতা করেননি।
এই সময় আবু আকবীল আনছারী (রাঃ) ২ সের যব রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে পেশ করে বলেন, সারা রাত পরের ক্ষেতে পানি সেঁচে ৪ সের যব মজুরি হিসাবে পেয়েছি। তার মধ্যে ২ সের বিবি-বাচ্চার জন্য রেখে বাকীটা নিয়ে এসেছি’। দয়ার নবী তার হাত থেকে যবের থলিটি নিয়ে বললেন, তোমরা এই যবগুলো মূল্যবান মাল-সম্পদের স্ত্তপের উপরে ছড়িয়ে দাও’। অর্থাৎ এই সামান্য দানের মর্যাদা হ’ল সবার উপরে। সুবহানাল্লাহ[4]
মুনাফিকদের বিদ্রূপ :
তবে মুনাফিকেরা নিজেরা তো দান করেনি। উপরন্তু এই দানকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিল। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ يَلْمِزُوْنَ الْمُطَّوِّعِيْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ فِي الصَّدَقَاتِ وَالَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ إِلاَّ جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُوْنَ مِنْهُمْ سَخِرَ اللهُ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ- ‘ঐ সমস্ত লোক যারা বিদ্রূপ করে ঐসব মুমিনদের প্রতি যারা মন খুলে ছাদাক্বা করে এবং ঐসব মুমিনদের প্রতি যারা দান করার মত কিছুই পায় না নিজেদের পরিশ্রমলব্ধ বস্ত্ত ভিন্ন। অতঃপর তাদেরকে তারা ঠাট্টা করে। আল্লাহ তাদের প্রতি ঠাট্টা করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (তওবাহ ৯/৭৯)। তাদের ঠাট্টা যেন এরূপ ছিল যে, বিশ্বশক্তি রোমক বাহিনীকে এরা দু’চারটি খেজুর দিয়েই পরাজিত করতে চায়। কিংবা দু’চারটা খেজুর দিয়েই এরা রোমক সাম্রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখছে।
তাবুকের পথে মুসলিম বাহিনী :
৯ম হিজরীর রজব মাসের এক বৃহস্পতিবারে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ৩০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সেনা অভিযান। এই সময় তিনি মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ আনছারীকে মতান্তরে সেবা‘ বিন আরফাতা (سِبَاعُ بْنُ عَرْفَطَةَ) -কে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করেন এবং হযরত আলীকে তাঁর পরিবারের দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু মুনাফিকেরা তাকে সম্ভবতঃ ভীতু, কাপুরুষ ইত্যাদি বলে ঠাট্টা করায় ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি পুনরায় গিয়ে পথিমধ্যে সেনাদলে যোগ দেন। তখন সেনাদল দু’তিন মনযিল অতিক্রম করে গেছে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে সস্নেহে বলেন, أَلاَ تَرْضَى أَنْ تَكُوْنَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُوْسَى؟ إلاَّ أَنّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِيْ ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার নিকটে অনুরূপ হও যেমন হারূণ ছিলেন মূসার নিকটে? তবে পার্থক্য এই যে, আমার পরে আর কোন নবী নেই’।[5] একথা শুনে আলী (রাঃ) খুশী মনে মদীনায় ফিরে গেলেন।
সেনাবাহিনীতে বাহক ও খাদ্য সংকট :
সাধ্যমত দান-ছাদাক্বা করা সত্ত্বেও তা এই বিশাল সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে প্রতি ১৮ জনের জন্য একটি করে উটের ব্যবস্থা হয়। যার উপরে তারা পালাক্রমে সওয়ার হতেন। অনুরূপভাবে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় তারা গাছের ছাল-পাতা খেতে থাকেন। যাতে তাদের ঠোটগুলো ফুলে যায়। পানির অভাবে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হ’লে বাহন সংকট থাকা সত্ত্বেও তারা মাঝে-মধ্যে উট নহর করতে বাধ্য হ’তেন এবং উটের পিঠের কুঁজোতে (الكرش) সঞ্চিত পানি পান করতেন। বাহন ও খাদ্য-পানীয়ের এই কঠিন সংকটের কারণে তাবুক বাহিনীকে جيش العسرة (জায়শুল উসরাহ অর্থাৎ অভাব-অনটনের বাহিনী) বলা হয়।
পথিমধ্যে সেনাবাহিনী ব্যাপক হারে পানি সংকটে পড়ায় তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে পানির অভিযোগ পেশ করেন। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে পানি প্রার্থনা করলেন। ফলে আল্লাহ বৃষ্টির মেঘ পাঠিয়ে দেন, যা বিপুল বৃষ্টি বর্ষণ করে। সেনাবাহিনী তৃপ্তি সহকারে পানি পান করেন এবং পাত্রসমূহ ভরে নেন।
হিজর অতিক্রম :
গমন পথে মুসলিম বাহিনী ‘হিজর’ এলাকা অতিক্রম করে। যা ছিল খায়বরের অদূরে ওয়াদিল ক্বোরা (وادي القرى) এলাকায় অবস্থিত। এখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত ছামূদ জাতি পাথর কেটে কেটে মযবুত ঘরবাড়ি তৈরী করেছিল (الَّذِينَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ) (ফজর ৮৯/৯)। হযরত ছালেহ (আঃ) তাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাঁকে অমান্য করে। ফলে তারা আল্লাহর গযবে পতিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা এখানকার কুয়ার পানি পান করো না, ঐ পানিতে ওযু করো না। এখানকার পানি দিয়ে যদি আটার খামীর করে থাক, তবে তা উটকে খাইয়ে দাও, নিজেরা খেয়ো না। তিনি বললেন, হযরত ছালেহ (আঃ)-এর উষ্ট্রী যে কুয়া থেকে পানি পান করত, তোমরা সেই কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করো’।
তিনি আরও বলেন, তোমরা  গযবপ্রাপ্ত ছামূদদের ঘরবাড়িতে প্রবেশ করবে না। তোমরা কাঁদতে কাঁদতে এই স্থান অতিক্রম করবে। অতঃপর তিনি মাথা নীচু করলেন এবং দ্রুত উক্ত এলাকা অতিক্রম করলেন’।[6]
শুষ্ক ঝর্ণায় পানির স্রোত :
অতঃপর তাবুকের নিকটবর্তী পৌঁছে রাসূল (ছাঃ) বললেন, إنَّكُمْ سَتَأْتُوْنَ غَدًا إنْ شَاءَ اللهُ تَعَالَى عَيْنَ تَبُوْكَ ‘আগামীকাল ইনশাআল্লাহ তোমরা তাবুকের ঝর্ণার নিকটে পৌঁছবে। তবে দিন গরম হওয়ার পূর্বে তোমরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। যদি তোমরা কেউ আগে পৌঁছে যাও, তবে আমি না পৌঁছা পর্যন্ত যেন কেউ ঝর্ণার পানি স্পর্শ না করে’।
হযরত মু‘আয (রাঃ) বলেন, কিন্তু আমরা গিয়ে দেখি আমাদের দু’জন লোক আগেই পৌঁছে গেছে এবং কিছু পানিও পান করেছে। (হয়তবা তারা রাসূলের নির্দেশ জানতে পারেনি)। এ সময় খুব ধীরগতিতে পানি আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের কিছু বকাঝকা করলেন। অতঃপর ঝর্ণা থেকে অঞ্জলি ভরে একটু একটু করে পানি নিলেন ও সঞ্চয় করলেন এবং তা দিয়ে স্বীয় হাত ও মুখমন্ডল ধৌত করলেন। অতঃপর ঐ পানি পুনরায় ঝর্ণায় নিক্ষেপ করলেন। ফলে ঝর্ণায় তীব্রগতিতে পানির প্রবাহ সৃষ্টি হ’ল এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পানি রাশি জমা হয়ে গেল। ছাহাবায়ে কেরাম তৃপ্তি সহকারে পানি পান করলেন। এসময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আযকে লক্ষ্য করে বললেন, يُوشِكُ يَا مُعَاذُ إنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ أَنْ تُرَى مَا هَا هُنَا قَدْ مُلِئَ جِنَانًا ‘যদি আল্লাহ তোমার হায়াত দারায করেন, তবে তুমি এই স্থানটিকে সবুজ-শ্যামল বাগিচায় পূর্ণ দেখতে পাবে’।[7]
পথিমধ্যে অথবা তাবুক পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে বললেন, আজ রাতে তোমাদের উপর প্রবল (ريح شديد) বালু ঝড় বয়ে যেতে পারে। অতএব তোমাদের কেউ যেন না দাঁড়ায়। যাদের উট আছে, তারা যেন উটকে শক্তভাবে বেঁধে রাখে’। দেখা গেল যে, প্রবল বেগে ঝড় এলো। তখন (সম্ভবতঃ কৌতূহল বশে) একজন উঠে দাঁড়ালো। ফলে ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে ‘ত্বাই’ গোত্রের দুই পাহাড়ের (بجلي طيء) মাঝখানে নিক্ষেপ করল’।[8]
ছালাতে জমা ও ক্বছর :
পথ চলাকালীন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিয়ম ছিল এই যে, তিনি সর্বদা যোহর ও আছরে এবং মাগরিব ও এশাতে জমা (ও ক্বছর) করতেন। এতে জমা তাক্বদীম ও জমা তাখীর দুটিই হ’ত। ‘তাক্বদীম’ অর্থ শেষের ছালাতটি পূর্বের ছালাতের সাথে একত্রে পড়া এবং ‘তাখীর’ অর্থ প্রথমের ছালাতটি শেষেরটির সাথে একত্রে যুক্ত করে পড়া।
তাবুকে উপস্থিতি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সারগর্ভ উপদেশবাণী :
মুসলিম বাহিনী তাবুকে অবতরণ করে যথারীতি শিবির স্থাপন করল এবং রোমকদের  অপেক্ষা করতে থাকল। এই অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এই জান্নাতপাগল সেনাদলের উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ (جوامع الكلم) ভাষণ দান করেন। যা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য  কল্যাণকর। উক্ববা বিন আমের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এবং বায়হাক্বী দালায়েল ও হাকেম হ’তে উদ্ধৃত উক্ত ভাষণটিকে মানছূরপুরী (রহঃ) ৫০টি ক্রমিকে ভাগ করে পেশ করেছেন। আমরাও সেটার অনুসরণ করলাম।-
হামদ ও ছানার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
1- فَإِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ 2- وَأَوْثَقَ الْعُرَى كَلِمَةُ التَّقْوَى 3- وَخَيْرَ الْمِلَلِ مِلَّةُ إبْرَاهِيْمَ-
১. সর্বাধিক সত্য বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব ২. এবং সবচেয়ে মযবুত হাতল হ’ল তাক্বওয়ার কালেমা ৩. সবচেয়ে উত্তম দ্বীন হ’ল ইবরাহীমের দ্বীন।
4- وَخَيْرَ السُّنَنِ سُنّةُ مُحَمَّدٍ 5- وَأَشْرَفَ الْحَدِيْثِ ذِكْرُ اللهِ 6- وَأَحْسَنَ الْقَصَصِ هَذَا الْقُرْآنُ-
৪. শ্রেষ্ঠ তরীকা হ’ল মুহাম্মাদের তরীকা ৫. সর্বোত্তম বাণী হ’ল আল্লাহর যিকর ৬. সেরা কাহিনী হ’ল এই কুরআন।
৭- وَخَيْرَ الْأُمُوْرِ عَوَازِمُهَا 8- وَشَرَّ الْأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا 9- وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ الْأَنْبِيَاءِ-
৭. শ্রেষ্ঠ কাজ হ’ল দৃঢ় সংকল্পের কাজ ৮. নিকৃষ্ট কাজ হ’ল শরী‘আতে সৃষ্ট বিদ‘আত সমূহ ৯. সুন্দরতম হেদায়াত হ’ল নবীগণের হেদায়াত।
10- وَأَشْرَفَ الْمَوْتِ قَتْلُ الشُّهَدَاءِ 11- وَأَعْمَى الْعَمَى الضَّلاَلَةُ بَعْدَ الْهُدَى-
১০. শ্রেষ্ঠ মৃত্যু হ’ল শহীদী মৃত্যু ১১. সেরা অন্ধত্ব হ’ল হেদায়াত লাভের পরে পথভ্রষ্ট হওয়া।
12- وَخَيْرَ الْأَعْمَالِ مَا نَفَعَ 13- وَخَيْرَ الْهُدَى مَا اُتَّبَعَ-
১২. শ্রেষ্ঠ আমল তাই যা কল্যাণকর ১৩. শ্রেষ্ঠ তরীকা সেটাই যা অনুসৃত হয়।
14- وَشَرَّ الْعَمَى عَمَى الْقَلْبِ 15- وَالْيَدَ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنْ الْيَدِ السُّفْلَى-
১৪. সেরা অন্ধত্ব হ’ল হৃদয়ের অন্ধত্ব ১৫. উপরের হাত উত্তম নীচের হাতের চাইতে।
16- وَمَا قَلّ وَكَفَى خَيْرٌ مِمّا كَثُرَ وَأَلْهَى 17- وَشَرُّ الْمَعْذِرَةِ حِينَ يَحْضُرُ الْمَوْتُ-
১৬. অল্প ও যথেষ্ট মাল উত্তম ঐ বেশী মাল হতে যা (মানুষকে আল্লাহ থেকে) গাফেল করে দেয় ১৭. নিকৃষ্ট তওবা হ’ল মৃত্যুকালীন তওবা।
18- وَشَرُّ النّدَامَةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ 19- وَمِنَ النَّاسِ مَنْ لاَ يَأْتِي الْجُمُعَةَ إلاَّ دُبُرًا-
১৮. সেরা লজ্জা হ’ল ক্বিয়ামতের দিনের লজ্জা ১৯. লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা জুম‘আয় আসে সবার শেষে।
20- وَمِنْهُمْ مَنْ لاَ يَذْكُرُ اللهَ إلاَّ هَجْرًا 21- وَمِنْ أَعْظَمِ الْخَطَايَا اللِّسَانُ الْكُذُوْبُ-
২০. এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা আল্লাহকে খুব কমই  স্মরণ করে ২১. সবচেয়ে বড় গোনাহ হ’ল মিথ্যা কথা বলা।
22- وَخَيْرُ الْغِنَى غِنَى النّفْسِ 23- وَخَيْرُ الزَّادِ التَّقْوَى-
২২. শ্রেষ্ঠ প্রাচুর্য হ’ল হৃদয়ের প্রাচুর্য ২৩. সেরা পাথেয় হ’ল আল্লাহভীতি।
24- وَرَأْسُ الْحُكْمِ مَخَافَةُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ 25- وَخَيْرُ مَا وَقَرَ فِي الْقُلُوبِ الْيَقِيْنُ-
২৪. সেরা প্রজ্ঞা হ’ল আল্লাহর ভয় ২৫. হৃদয়সমূহে যা সম্মান উদ্রেক করে, তা হল দৃঢ় বিশ্বাস
26- وَالإِرْتِيَابُ مِنَ الْكُفْرِ 27- وَالنِّيَاحَةُ مِنْ عَمَلِ الْجَاهِلِيّةِ-
২৬. (আল্লাহ সম্পর্কে) সন্দেহ সৃষ্টি কুফরীর অন্তর্ভুক্ত ২৭. মৃতের জন্য উচৈচঃস্বরে কান্নাকাটি করা জাহেলী রীতির অন্তর্ভুক্ত।
28- وَالْغُلُوْلُ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ 29- وَالسّكْرُ كَيٌّ مِنَ النّارِ-
২৮. (গণীমত থেকে) চুরি জাহান্নামের স্ফুলিঙ্গ ২৯. মাদকতা জাহান্নামের টুকরা।
30- وَالشِّعْرُ مِنْ إبْلِيسَ 31- وَالْخَمْرُ جِمَاعُ الْإِثْمِ-
৩০. (নষ্ট) কবিতা ইবলীসের অংশ ৩১. মদ সকল পাপের উৎস।
32- وَشَرُّ الْمَأْكَلِ مَالُ الْيَتِيْمِ 33- وَالسّعِيدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِهِ-
৩২. নিকৃষ্টতম খাদ্য হ’ল ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ ৩৩. সৌভাগ্যবান হ’ল সেই, যে অন্যের থেকে উপদেশ গ্রহণ করে
34- وَالشّقِيُّ مَنْ شَقِيَ فِي بَطْنِ أُمِّهِ 35- وَمَلاَكُ الْعَمَلِ خَوَاتِمُهُ-
৩৪. হতভাগা সেই যে মায়ের পেট থেকেই হতভাগা হয় ৩৫. সেরা আমল হ’ল শেষ আমল।
36- وَشَرُّ الرَّوَايَا رَوَايَا الْكَذِبِ 37- وَكُلُّ مَا هُوَ آتٍ قَرِيْبٌ-
৩৬. নিকৃষ্ট স্বপ্ন হ’ল মিথ্যা স্বপ্ন ৩৭. যেটা ভবিষ্যতে হবে, সেটা সর্বদা নিকটবর্তী।
38- وَسِبَابُ الْمُؤْمِنِ فُسُوْقٌ 39- وَقِتَالُهُ كُفْرٌ-
৩৮. মুমিনকে গালি দেওয়া ফাসেকী ৩৯. তাকে হত্যা করা কুফরী।
40- وَأَكْلُ لَحْمِهِ مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ 41- وَحُرْمَةُ مَالِهِ كَحُرْمَةِ دَمِهِ-
৪০ গীবত করা আল্লাহর অবাধ্যতার অন্তর্ভুক্ত ৪১. মুমিনের মাল অন্যের জন্য হারাম, যেমন তার রক্ত হারাম।
42- وَمَنْ يَتَأَلَّ عَلَى اللهِ يُكَذِّبْهُ 43- وَمَنْ يَغْفِرْ يُغْفَرْ لَهُ-
৪২. যে ব্যক্তি আল্লাহর উপরে বড়াই করে, আল্লাহ তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন। ৪৩. যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, তাকে ক্ষমা করা হয়।
44- وَمَنْ يَعْفُ يَعْفُ اللهُ عَنْهُ 45- وَمَنْ يَكْظِمِ الْغَيْظَ يَأْجُرْهُ اللهُ-
৪৪. যে মাফ করে দেয়, আল্লাহ তাকে মাফ করেন ৪৫. যে ব্যক্তি ক্রোধ দমন করে, আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করেন।
46- وَمَنْ يَصْبِرْ عَلَى الرَّزِيَّةِ يُعَوِّضُهُ اللهُ 47- وَمَنْ يَبْتَغِ السُّمْعَةَ يُسَمَّعِ اللهُ بِهِ-
৪৬. বিপদে যে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহ তাকে উত্তম বদলা দান করেন। ৪৭. যে ব্যক্তি শোনা কথার অনুসরণ করে, আল্লাহ তার লজ্জাকে সর্বত্র শুনিয়ে দেন।
48- وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُضْعِفُ اللهُ لَهُ 49- وَمَنْ يَعْصِ اللهَ يُعَذِّبْهُ اللهُ-
৪৮. যে ব্যক্তি ছবর করে, আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ দল করেন। ৪৯. যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিয়ে থাকেন।
50- ثُمَّ اسْتَغْفَرَ ثَلاَثًا-
৫০. অতঃপর তিনি তিনবার আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ভাষণ শেষ করেন।[9]
রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত ভাষণ ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর ও দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত-শ্রান্ত সেনাবাহিনীর অন্তরে ঈমানের জ্যোতিকে উদ্ভাসিত করে তোলে। সকলে কষ্ট ভুলে প্রশান্তচিত্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করেন।
বিনা যুদ্ধে জয় : আল্লাহর  গায়েবী মদদ :
মুসলিম বাহিনীর তাবুকে উপস্থিতির খবর শুনে রোমক ও তাদের মিত্ররা এতই ভীত হয়ে পড়ল যে, তারা মুকাবিলার হিম্মত হারিয়ে ফেলল এবং তারা তাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তৎকালীন বিশ্বশক্তির এই বিনাযুদ্ধে পলায়নের ফলে সমস্ত আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির জন্য এমন সব অযাচিত রাজনৈতিক সুবিধাদি এনে দিল, যা যুদ্ধ করে অর্জন করা সম্ভব হ’ত না। যেমন- (১) আয়লার (أَيْلَةَ) খৃষ্টান শাসনকর্তা ইউহান্নাহ বিন রু’বাহ (يحنة بن رؤبة) রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে সন্ধি করেন এবং তাঁকে জিযিয়া প্রদান করেন। (২) অনুরূপভাবে আযরুহ (أذْرُح) ও জারবা (جَرْبَاء) -এর নেতৃবৃন্দ এসে জিযিয়া প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের প্রত্যেককে সন্ধির চুক্তিনামা প্রদান করেন, যা তাদের কাছে রক্ষিত থাকে। শুধুমাত্র জিযিয়ার বিনিময়ে তাদের জান-মাল-ইযযত ও ধর্মের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার গ্যারান্টি দেওয়া হয়। (৩) এরপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দূমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা উকায়দিরের (أُكَيْدِرُ) নিকটে ৪২০ জন অশ্বারোহী সৈন্যের একটি বাহিনী সহ খালেদ বিন ওয়ালীদকে প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি বলে দেন যে, إنَّكَ سَتَجِدُهُ يَصِيْدُ الْبَقَرَ তুমি তাকে জংলী নীল গাভী শিকার করা অবস্থায় দেখতে পাবে’।[10] সেটাই হ’ল। চাঁদনী রাতে দুর্গটি পরিষ্কার দেখা যায়, এমন দূরত্বে পৌঁছে গেলে হঠাৎ দেখা গেল যে, একটি নীল গাভী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গদ্বারে শিং দিয়ে গুঁতা মারছে। এমন সময় উকায়দির গাভীটাকে শিকার করার জন্য লোকজন নিয়ে বের হলেন। এই সুযোগে খালেদ তাকে বন্দী করে ফেললেন। এভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়।[11]
উকায়দির রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে আনা হ’ল। অতঃপর ২০০০ উট, ৮০০ দাস, ৪০০ লৌহবর্ম ও ৪০০ বর্শা দেবার শর্তে এবং জিযিয়া কর প্রদানে স্বীকৃত হওয়ায় তার সঙ্গে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হ’ল। যেমন ইতিপূর্বে আয়লাহ, তাবুক, ও তায়মার সাথে সম্পাদিত হয়েছিল। একইভাবে রোমকদের মিত্র অন্যান্য গোত্রসমূহ তাদের পুরানো মনিবদের ছেড়ে মুসলমানদের নিকটে এসে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হ’ল। এভাবে একেবারেই বিনাযুদ্ধে এবং কোনরূপ জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই আল্লাহর গায়েবী মদদে মদীনার ইসলামী খেলাফতের সীমানা বিস্তৃত হয়ে রোম সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ফালিল্লাহিল হাম্দ
বিনা যুদ্ধে শহীদ : যুল বাজাদায়েন :
তাবুকে অবস্থান কালীন সময়ে তরুণ ছাহাবী আব্দুল্লাহ যুল বাজাদায়েন (عبد الله ذو البجادين) -এর মৃত্যু হয়ে যায়। এই নিঃস্ব-বিতাড়িত শাহাদাত পিয়াসী মুহাজির তরুণের জীবন কাহিনী অতীব চমকপ্রদ ও শিক্ষাপ্রদ। শিশু অবস্থায় পিতৃহারা আব্দুল উযযা মক্কায় তার চাচার কাছে প্রতিপালিত হন। তরুণ বয়সে চাচার উট-বকরী চরানোই ছিল তার কাজ। ইতিমধ্যে ইসলামের গুঞ্জনধ্বনি তার কাছে পৌঁছে যায়। তিনি তওহীদের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু চাচার ভয়ে প্রকাশ করেননি। হঠাৎ মক্কা বিজয় সবকিছুকে ওলট-পালট করে দিল। যুবক আব্দুল উযযার লুক্কায়িত ঈমান ফল্গুস্রোত হয়ে বেরিয়ে এলো। চাচার সামনে গিয়ে ইসলাম কবুলের অনুমতি চাইলেন। চাচা তাকে সকল মাল-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিলেন। এমনকি তার দেহের পরিহিত বস্ত্র পর্যন্ত ছিনিয়ে নিলেন। ফলে নগ্ন অবস্থায় ছুটে মায়ের কাছে গেলেন। গর্ভধারিণী মা তার এ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন ও একটা কম্বল তাকে দিলেন। আব্দুল উযযা সেটাকে ছিঁড়ে দু’ভাগ করে একভাগ দেহের নিম্নভাগে ও একভাগ ঊর্ধ্বভাগে পরিধান করে শূন্য হাতে চললেন মদীনা অভিমুখে। পক্ষকাল পরে মদীনা পৌঁছে ফজরের সময় মসজিদে নববীতে রাসূলের সম্মুখে উপস্থিত হ’লেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সবকথা শুনে দুঃখে বিগলিত হ’লেন। নাম পাল্টিয়ে রাখলেন ‘আব্দুল্লাহ’। লকব দিলেন ‘যুল বাজাদায়েন’ (ذو البجادين) ‘দুই টুকরা কম্বল ওয়ালা’। মসজিদের আঙিনায় অবস্থিত ‘আছহাবে ছুফফা’-র মধ্যে তাকে শামিল করা হ’ল। সেখানে তিনি বিপুল আগ্রহে কুরআন শিখতে থাকেন। তার কুরআনের ধ্বনি অনেক সময় মুছল্লীদের ছালাতে ব্যাঘাত ঘটাতো। একদিন ওমর ফারূক (রাঃ) এ বিষয়ে অভিযোগ করলে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ওমর ওকে কিছু বলো না। আল্লাহ ও রাসূলের জন্য সে সর্বস্ব ত্যাগ করে এসেছে’।
এমন সময় তাবুকের যুদ্ধের ঘোষণা চলে আসে। আব্দুল্লাহ ছুটে রাসূলের দরবারে এসে যুদ্ধে যাবার অনুমতি চান।  দয়ার নবী তাকে গাছের একটা ছাল নিয়ে আসতে বলেন। ছালটি নিয়ে রাসূল (ছাঃ) তার হাতে বেঁধে দিয়ে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কাফিরদের জন্য এর রক্ত হারাম করছি’। আব্দুল্লাহ বললেন, হে রাসূল! আমি যে শাহাদাতের কাঙাল’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি খাদ্যের সন্ধানে বের হও, আর রৌদ্রের উত্তাপ বেড়ে যায় ও তোমার মৃত্যু হয়, তাতেও তুমি শহীদ হিসাবে গণ্য হবে’। এতে বুঝা যায় যে, শাহাদাতের একান্ত কামনা নিয়ে বিছানায় মৃত্যুবরণ করলেও তিনি শহীদ হিসাবে গণ্য হবেন। তার ভাগ্যে সেটাই দেখা গেল। তাবুক পৌঁছে হঠাৎ রৌদ্রতাপ বেড়ে গেলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
বেলাল বিন হারেছ আল-মুযানী বলেন, রাত্রিতে তার দাফনকার্য সম্পন্ন হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর মুওয়াযযিন বেলালের হাতে চেরাগ ছিল। আবুবকর ও ওমর তার লাশ বহন করে আনেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে কবরে নামেন এবং বলেন, أَدْنِيَا إِلَىَّ أَخَاكُمْ ‘তোমরা দু’জন তোমাদের ভাইকে আমার নিকটে এনে দাও’। অতঃপর তাকে কবরে কাত করে শোয়ানোর সময় তিনি বলেন, اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَمِسَيْتُ رَاضِيًا عَنْهُ فَارْضِ عَنْهُ- ‘হে আল্লাহ! আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি এ যুবকের উপরে খুশী ছিলাম। তুমিও এর উপরে খুশী হও’। তার দাফনকার্যের এই দৃশ্য দেখে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলে ওঠেন, يَا لَيْتَنِيْ كُنْتُ صَاحِبَ الْحُفْرَةِ ‘হায়! এই কবরে যদি আমি হ’তাম!’[12]
মদীনার পথে রাসূল (ছাঃ) :
২০ দিন তাবুকে অবস্থানের[13] পর এবং স্থানীয় খ্রীষ্টান ও অন্যান্য গোত্রগুলির সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে রোমক বাহিনীর সাথে কোনরূপ সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় ছাড়াই বিজয় সম্পন্ন ও সুসংহত করার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনার পথে রওয়ানা হ’লেন। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলূল সাধারণ মুসলমানদের এই বলে ধোঁকা দিয়েছিল যে, রোম সম্রাট হ’লেন অর্ধপৃথিবীর শাসক। তাঁর সুশিক্ষিত বিশাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে মুহাম্মাদের এইসব নিঃস্ব বাহিনী ফুৎকারে উড়ে যাবে। আর ‘তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো যে, মুহাম্মাদ আর কখনোই মদীনায় ফিতে পারবে না। রোম সম্রাট তাদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেবে’।
কিন্তু বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ জয়ের পর যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীগণ সহাস্য বদনে মদীনায় ফিরে চললেন, তখন উক্ত মুনাফিক নেতার গোপন সাথী যারা ছিল, তারা প্রমাদ গুণলো এবং রাসূলকে পথিমধ্যেই হত্যার পরিকল্পনা নিল।
রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা :
মুবারকপুরী বলেন, মদীনায় ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি সংকীর্ণ গিরিসংকট অতিক্রম করছিলেন। এ সময় তাঁর সাথে কেবল আম্মার বিন ইয়াসির ও হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ছিলেন। প্রথমোক্ত জন রাসূলের উষ্ট্রীর লাগাম ধরে সামনে হাঁটছিলেন এবং শেষোক্ত জন পিছনে থেকে উষ্ট্রী হাঁকাচ্ছিলেন। মুসলিম বাহিনী তখন পিছনে উপত্যকায় ছিল। ১২ জন মুনাফিক যারা এতক্ষণ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, তারা মুখোশ পরে দ্রুত এগিয়ে এসে ঐ গিরিসংকটে প্রবেশ করল এবং পিছন থেকে অতর্কিতে রাসূলকে হত্যা করতে উদ্যত হল। হঠাৎ পদশব্দে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পিছন ফিরে তাকান এবং হুযায়ফাকে ওদের ঠেকানোর নির্দেশ দেন। হুযায়ফা তাঁর ঢাল দিয়ে ওদের বাহনগুলির মুখের উপরে আঘাত  করতে থাকেন। এতেই আল্লাহর ইচ্ছায় তারা ভীত হয়ে পিছন ফিরে দৌড় দিয়ে দ্রুত সেনাবাহিনীর মধ্যে হারিয়ে যায়। এভাবেই মুনাফিকরা অন্যান্য সময়ের ন্যায় এবারেও রাসূলের ক্ষতি সাধনে ব্যর্থ হ’ল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَهَمُّوْا بِمَا لَمْ يَنَالُوْا ‘তারা চেয়েছিল সেটাই করতে, যা তারা পারেনি’ (তওবাহ ৯/৭৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের সকলের নাম ও তাদের অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন। তবে সেগুলি সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। একারণে হুযায়ফাকে صاحب سر رسول الله ‘রাসূলের গোপন রহস্যবিদ’ বলে অভিহিত করা হয়। সেকারণ এদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ فِىْ أُمَّتِىْ اثْنَا عَشَرَ مُنَافِقًا لاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدُوْنَ رِيْحَهَا حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِىْ سَمِّ الْخِيَاطِ ‘আমার উম্মতের মধ্যে ১২ জন মুনাফিক রয়েছে, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। তাদের জান্নাতে যাওয়া ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ সূঁচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব’।[14] মদীনায় কেউ মারা গেলে ওমর (রাঃ) তার জানাযায় যাওয়ার পূর্বে খোঁজ নিতেন হুযায়ফা যাচ্ছেন কি-না। হুযায়ফা না গেলে তিনি যেতেন না, এই কারণে যে, যদি ঐ মৃত ব্যক্তি ঐ মুনাফিকদের মধ্যকার কেউ হয়।[15]
মদীনায় উপস্থিতি ও মদীনাবাসীর অভিনন্দন :
দূর হ’তে দেখতে পেয়ে খুশীতে রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠেন هَذِهِ طَابَةٌ وَهَذَا أُحُدٌ ‘এই যে মদীনা, এই যে ওহোদ’। جَبَلٌ يُحِبُّنَا وَنُحِبُّهُ ‘এই পাহাড় যে আমাদের ভালবাসে এবং আমরা যাকে ভালবাসি’।[16] মদীনার নারী-শিশু ও বালকেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিপুল উৎসাহে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর গর্বিত সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে গেয়ে ওঠেন-
طَلَعَ الْبَدْرُ عَلَيْنَا * مِنْ ثَنِيَّاتِ الْوَدَاع
وَجَبَ الشُّكْرُ عَلَيْنَا * مَا دَعَا لِلّهِ دَاعِي
‘ছানিয়াতুল বিদা টিলা হ’তে আমাদের উপরে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়েছে’।[17] ‘আমাদের উপরে শুকরিয়া ওয়াজিব হয়ে গেছে, যতদিন যাবত আহবানকারী আল্লাহকে আহবান করবে’ (অর্থাৎ ক্বিয়ামত পর্যন্ত)।[18] মানছূরপুরী ও মুবারকপুরী কবিতা পাঠের এই ঘটনাটি মদীনায় হিজরতকালে বলেছেন।[19] তবে এটি দু’বারে হওয়াটা বিচিত্র নয়।
উল্লেখ্য যে, এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ। ৫০ দিনের এই সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে ও ২০ দিন ছিল তাবুকে অবস্থান। রজব মাসে গমন ও রামাযান মাসে প্রত্যাবর্তন।
মদীনায় ফেরার পরবর্তী ঘটনাবলী :
(১) মুনাফিকদের ওযর কবুল : মদীনায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। অতঃপর সেখানেই লোকজনের সাথে বসে পড়েন। এই সময় ৮০ জনের অধিক লোক এসে তাদের যুদ্ধে গমন না করার পক্ষে নানা ওযর-আপত্তি পেশ করে ক্ষমা চাইতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ক্ষমা করে দেন ও আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেন এবং তাদের ভিতরকার গোপন বিষয়সমূহ আল্লাহর উপরে ছেড়ে দেন (وَوَكَلَ سَرَائِرَهُمْ إلَى اللهِ)। তবে এদের ওযর সমূহ যে কপটতাপূর্ণ ছিল, সে বিষয়ে আল্লাহ সূরা তওবার ৯৪-৯৮ আয়াতে বর্ণনা করেছেন এবং রাসূল রাযী হ’লেও আল্লাহ যে কখনো তাদের উপরে রাযী হবেন না, সেকথা বলে দেন। যেমন আল্লাহ বলেন, يَحْلِفُوْنَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللهَ لاَ يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- ‘তারা এজন্য শপথ করবে যেন তোমরা তাদের প্রতি রাযী হয়ে যাও। অতঃপর যদি তোমরা তাদের প্রতি রাযী হয়ে যাও, তবে আল্লাহ তো ফাসেক কওমের উপর রাযী হন না’ (তওবা ৯/৯৬)। এভাবেই মুনাফিকদের সাথে মুমিনদের পার্থক্য পরিস্ফুট হয়ে যায়। আল্লাহর ভাষায় مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ ‘আল্লাহ মুমিনদেরকে বর্তমান অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না, যতক্ষণ না নাপাক লোকগুলিকে পবিত্রদের থেকে পৃথক করে দেন’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)। অবশ্য আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলবল উক্ত ৮০ জনের মধ্যে ছিল না।[20]
(২) পিছনে থাকা তিনজন খাঁটি মুমিনের অবস্থা :
আনছারদের তিনজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, যারা স্রেফ সাময়িক বিচ্যুতির কারণে যুদ্ধে গমন থেকে পিছনে ছিলেন, তাঁরা ওযর-আপত্তি না তুলে সরাসরি সত্য কথা বলেন। এঁরা হলেন, ১- হযরত কা‘ব বিন মালেক, যিনি মক্কায় ঐতিহাসিক বায়‘আতে আক্বাবায় অংশগ্রহণকারী ৭৩ জন পুরুষ ছাহাবীর অন্যতম ছিলেন। ২- মুরারাহ ইবনুর রাবী‘ এবং ৩- হেলাল ইবনু উমাইয়া।
এঁরা সবাই অত্যন্ত মুখলেছ এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণকারী ছাহাবী ছিলেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁদের ওযর কবুল করলেন এবং তাদেরকে পূর্ণ সমাজচ্যুতির নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তাদের তওবা কবুলের বিষয়টি আল্লাহর উপরে ছেড়ে দিলেন। তাদের বিরুদ্ধে বয়কট চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়। এরি মধ্যে তাদের অবস্থা কঠিন আকার ধারণ করল। আপনজন ও বন্ধু-বান্ধব কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কথাও বলে না। সালাম দিলেও জবাব দেয় না। মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। এই দুর্বিষহ জীবনে দুঃখে-বেদনায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হ’ল। চল্লিশ দিনের মাথায় তাদের প্রতি স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ এলো। ফলে তারা স্ব স্ব স্ত্রীদের পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। যা তাদের অবস্থাকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলল। তারা সর্বদা আল্লাহর দরবারে কেঁদে বুক ভাসাতে থাকেন। এই বয়কট চলাকালে হযরত কা‘ব বিন মালেক আরেকটি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। গাসসান অধিপতি তাঁর নিকটে একটি পত্র পাঠিয়ে তাদের তিনজনের প্রতি সহানুভূতি জানান এবং কা‘বকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানান। পত্রে বলা হয় যে, ‘আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমাদের মনিব তোমাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার জন্য রাখেননি এবং তোমাকে নষ্ট করতে চান না। তুমি আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমার প্রতি খেয়াল রাখব ও যথোপযুক্ত মর্যাদা দেব’। চিঠি পড়েই কা‘ব বলেন, এটাও একটি পরীক্ষা’। তিনি বলেন, এরপর আমি পত্রটা নিকটস্থ একটা জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপ করলাম’। অতঃপর ৫০ দিনের মাথায় তাদের খালেছ তওবা কবুল হ’ল এবং আয়াত নাযিল হ’ল নিম্নোক্ত-
وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِيْنَ خُلِّفُوْا حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ وَظَنُّوْا أَنْ لاَ مَلْجَأَ مِنَ اللهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوْبُوْا إِنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ-
‘এবং আল্লাহ দয়াশীল হন সেই তিন ব্যক্তির উপরে, যারা (জিহাদ থেকে) পিছনে ছিল। তাদের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, প্রশস্ত যমীন তাদের উপরে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল ও তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল এবং তারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেছিল যে, আল্লাহ ব্যতীত তাদের অন্য কোন আশ্রয়স্থল নেই। অতঃপর আল্লাহ তদের তওবা কবুল করেন যাতে তারা ফিরে  আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/১১৮)
তওবা কবুলের উক্ত আয়াত নাযিলের সাথে সাথে মুমিনদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ উঠে গেল। সকলে দান-ছাদাক্বায় লিপ্ত হ’ল। এমন আনন্দ তারা জীবনে পায়নি। এটাই ছিল যেন তাদের জীবনের সেরা সৌভাগ্যময় দিন।
কা‘ব বিন মালিক তার বাড়ীর ছাদে নিঃসঙ্গভাবে দুঃখে-বেদনায় পড়েছিলেন। এমন সময় নিকটবর্তী সিলা‘ (السلع) পাহাড়ের উপর থেকে আবুবকর (রাঃ)-এর আওয়ায শোনা গেল- يَا كَعْبُ بْنَ مَالِكٍ أَبْشِرْ ‘হে কা‘ব! সুসংবাদ গ্রহণ কর’ (রাহমাতুললিল আলামীন ১/৩৪৪-৪৫)
কা‘ব বলেন, এ সংবাদ শুনেই আমি সিজদায় পড়ে যাই। অতঃপর দৌড়ে রাসূলের দরবারে চলে যাই। বন্ধু-বান্ধব চারদিক থেকে ছুটে এসে অভিনন্দন জানাতে থাকে। সারা মদীনায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে বলেন, أَبْشِرْ بِخَيْرِ يَوْمٍ مَرَّ عَلَيْكَ مُنْذُ وَلَدَتْكَ أُمُّكَ ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর! জন্মের পর থেকে এমন আনন্দের দিন তোমার জীবনে আর কখনো আসেনি’। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এ (ক্ষমা) আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, না, এ তো আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমি বললাম, হে রাসূল! এর শুকরিয়া স্বরূপ আমি আমার সমস্ত সম্পদ আল্লাহর রাহে ছাদাক্বা করতে চাই। রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। আমি বললাম, অর্ধেক। রাসূল বললেন, না। আমি বললাম, এক-তৃতীয়াংশ। রাসূল বললেন, হ্যাঁ। তবে এটাও খুব বেশী।[21]
(৩) সত্যিকারের অপারগদের জন্য সুসংবাদ :
মদীনায় এমন বহু মুমিন ছিলেন, যারা মনের দিক দিয়ে সর্বক্ষণ রাসূলের সাথী ছিলেন, কিন্তু শারীরিক দুর্বলতা কিংবা আর্থিক অপারগতার কারণে বা অনিবার্য কোন কারণবশতঃ যুদ্ধে যেতে পারেননি। তাদের এই ব্যর্থতার জন্য তারা যেমন দুঃখিত ও লজ্জিত ছিলেন, তেমনি ভীত ছিলেন এজন্য যে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কি-না। আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন। তাই তাদের ক্ষমার সুসংবাদ দিয়ে আয়াত নাযিল হ’ল-
لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ مَا يُنْفِقُوْنَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوْا لِلَّهِ وَرَسُوْلِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِيْنَ مِنْ سَبِيْلٍ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ-
‘কোন অভিযোগ নেই ঐসব লোকদের প্রতি, যারা দুর্বল, রোগাক্রান্ত এবং (যুদ্ধের সফরে) ব্যয়ভার বহনে অক্ষম,  যখন তারা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা পোষণ করবে। সদাচারী লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/৯১)
অবশ্য মদীনার নিকটবর্তী পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এইসব লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, إِنَّ بِالْمَدِينَةِ أَقْوَامًا مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا وَلاَ قَطَعْتُمْ وَادِيًا إِلاَّ كَانُوا مَعَكُمْ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ قَالَ وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ ، حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ ‘মদীনায় এমন কিছু লোক রয়েছে যে, তোমরা যেখানেই সফর করেছ, বা যে উপত্যকা অতিক্রম করেছ, তারা সর্বদা তোমাদের সঙ্গে থেকেছে। ছাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল! তারা মদীনায় থেকেও আমাদের সঙ্গে ছিল? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ তারা মদীনায় থেকেও তোমাদের সঙ্গে ছিল। ওযর তাদেরকে আটকে রেখেছিল’।[22]
(৪) মুনাফিকদের প্রতি কঠোর হবার নির্দেশ লাভ এবং মসজিদে যেরার ধ্বংস :
তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকেরা যে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছিল, তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। বিশেষ করে বহিঃশক্তি রোমক বাহিনীকে মদীনা আক্রমণের আহবান জানানো ও তার জন্য ষড়যন্ত্রের আখড়া হিসাবে ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণ ছিল রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ। এ প্রেক্ষিতে এদের অপতৎপরতা যাতে আর বৃদ্ধি পেতে না পারে এবং রাসূলের উদারতাকে তারা দুর্বলতা না ভাবে, সেকারণ আল্লাহ পাক স্বীয় রাসূলকে তাদের ব্যাপারে কঠোর হবার আদেশ নাযিল করে বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيْرُ- ‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন ও তাদের প্রতি কঠোর হউন। তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম এবং কতই না মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবাহ ৯/৭৩)। এখানে মুনাফিকদের সাথে জিহাদের অর্থ হ’ল মৌখিক জিহাদ। কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কখনোই তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেননি বা তাদেরকে হত্যা করেননি।
মসজিদে যেরার চূর্ণ :
রোমকদের কেন্দ্রভূমি সিরিয়া থেকে ষড়যন্ত্রকারী আবু আমের আর-রাহেব-এর পত্র মোতাবেক মদীনার ১২ জন মুনাফিক ক্বোবা মসজিদের অদূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করে এবং রাসূলকে সেখানে এক ওয়াক্ত ছালাত আদায়ের মাধ্যমে উদ্বোধন করে দেওয়ার অনুরোধ করে। এটা তাদের চক্রান্ত ও অস্ত্র সংগ্রহের কেন্দ্র হ’লেও সাধারণ মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য মসজিদ নাম দেয় এবং রাসূলকে সেখানে গিয়ে ছালাত আদায়ের দাওয়াত দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল মনে দাওয়াত কবুল করেন এবং তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেখানে যাবেন বলে ওয়াদা করেন। কিন্তু তাবুক থেকে ফেরার পথে মদীনার নিকটবর্তী হ’তেই তার নিকটে মুনাফিকদের ঐ ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيْقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَإِرْصَادًا لِمَنْ حَارَبَ اللهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلاَّ الْحُسْنَى وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ، لاَ تَقُمْ فِيْهِ أَبَدًا لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ-
‘আর যারা মসজিদ তৈরী করেছে ক্ষতি সাধনের জন্য, কুফরী বশে এবং মুমিনদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য ও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই যুদ্ধকারীদের ঘাঁটি করার জন্য। তারা অবশ্যই শপথ করে বলবে যে, আমরা সদুদ্দেশ্যেই এটা করেছি। অথচ আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’। لاَ تَقُمْ فِيْهِ أَبَدًا ‘আপনি কখনোই উক্ত মসজিদে দন্ডায়মান হবেন না’… (তওবাহ ৯/১০৭)
প্রকৃত ঘটনা অবহিত হয়ে মদীনায় উপস্থিত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে কয়েকজন ছাহাবীকে নির্দেশ দিলেন মসজিদ নামক উক্ত ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিকে গুঁড়িয়ে ও পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আসার জন্য। এই আদেশ পালনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওয়াহ্শী বিন হারব, যিনি ওহোদ যুদ্ধে রাসূলের চাচা হযরত হামযাকে হত্যা করেছিলেন। তারা গিয়ে উক্ত গৃহটি সমূলে উৎপাটিত করে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেন। মসজিদে ক্বোবা থেকে অনতিদূরে উক্ত অভিশপ্ত স্থানটি আজও বিরান পড়ে আছে। কিছুই সেখানে জন্মে না। একটা পাখিও সেখানে বসে না। কেউ সেখানে ঘর-বাড়িও নির্মাণ করে না। রাসূলের যামানায় ছাবেত বিন আকরামের ভোগদখলে স্থানটি কিছুদিন ছিল। কিন্তু তার ঘরে কোন সন্তানাদি হয়নি বা বাঁচেনি। ফলে জায়গাটি আজও অভিশাপগ্রস্ত হিসাবেই পড়ে আছে। এই সময় সূরা তওবায় মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচন করে অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। ফলে তারা সমাজে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং একেবারেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা :
তাবুক যুদ্ধ থেকে রামাযানে ফেরার পরপরই মাত্র তিন মাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলি ঘটনা ঘটে যায়। যেমন-
(১) লে‘আন (لعان) এর ঘটনা : স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়, আর তার কোন সাক্ষী না থাকে, সে অবস্থায় যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো হয়, তাকে লে‘আন বলা হয়। পদ্ধতি এই যে, স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে আদালতের বিচারকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে স্বামী আল্লাহর কসম করে চারবার বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী এবং পঞ্চমবার বলবে, যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে তার উপরে আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হৌক (নূর ২৪/৬-৭)। ‘স্ত্রীর শাস্তি রহিত হয়ে যাবে যদি সে আল্লাহর কসম করে চারবার বলে যে, তার স্বামী অবশ্যই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবারে বলে, যদি তার স্বামী সত্যবাদী হয়, তবে তার উপর আল্লাহর গযব নেমে আসুক’ (নূর ২৪/৮-৯)। হেলাল ইবনে উমাইয়া এবং ‘উওয়াইমের ‘আজলানীর ঘটনার প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াতগুলি নাযিল হয় এবং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের স্বামী-স্ত্রীকে ডেকে এনে মসজিদের মধ্যে লে‘আন করান। উভয় পক্ষে পাঁচটি করে সাক্ষ্য পূর্ণ হয়ে লে‘আন সমাপ্ত হ’লে ‘উওয়াইমের বলেন, হে রাসূল! এখন যদি আমি তাকে স্ত্রীরূপে রাখি, তাহ’লে আমি মিথ্যা অপবাদ দানকারী হয়ে যাব। অতএব আমি তাকে তালাক দিলাম’। হেলাল বিন উমাইয়ার ঘটনায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) লে‘আনের পর স্বামী ও স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন  করে দেন এবং বলেন যে, স্ত্রীর গর্ভের সন্তান স্ত্রীর বলে  কথিত হবে- পিতার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হবে না। তবে সন্তানটিকে ধিকৃত করা হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمُتَلاَعِنَانِ إِذَا تَفَرَّقَا لاَ يَجْتَمِعَانِ أَبَدًا ‘লে‘আনকারীদ্বয় পৃথক হ’লে তারা কখনোই আর একত্রিত হ’তে পারবে না’।[23] বিচারক বিবাহ বিচ্ছিন্ন করে দেবার পর ইদ্দত পূর্ণ করে উক্ত স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে। এভাবে লে‘আনের মাধ্যমে সে দুনিয়ার শাস্তি থেকে বাঁচলেও আখেরাতের শাস্তি বেড়ে যাবে।
(২) গামেদী মহিলার ব্যভিচারের শাস্তি : গামেদী মহিলার (امرأة غامدية) ব্যভিচারের শাস্তি দানের বিখ্যাত ঘটনাটি এ সময়ে সংঘটিত হয়। উক্ত মহিলা ইতিপূর্বে নিজে এসে ব্যভিচারের স্বীকৃতি দেন ও গর্ভধারণের কথা বলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে গর্ভ খালাছের পর আসতে বলেন। অতঃপর ভূমিষ্ট সন্তান কোলে নিয়ে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে দুধ ছাড়ানোর পর বাচ্চা শক্ত খাবার খেতে শিখলে তারপর আসতে বলেন। অতঃপর বাচ্চার হাতে রুটিসহ এলে এবং জনৈক আনছার ছাহাবী ঐ বাচ্চার লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাকে ব্যভিচারের শাস্তি স্বরূপ প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়।
পরকালের কঠিন শাস্তি হ’তে বাঁচার জন্য দুনিয়ায় প্রাণদন্ডের মত মর্মান্তিক শাস্তি স্বেচ্ছায় বরণ করার এ আকুতি পৃথিবীর কোন সমাজ ব্যবস্থায় পাওয়া যাবে কি? প্রস্তরাঘাতে ফেটে যাওয়া মাথার ঘিলুর কিছু অংশ খালেদ ইবনে ওয়ালীদের গায়ে লাগলে তিনি গালি দিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। তাতে রাসূল (ছাঃ) তাকে ধমক দিয়ে বলেন, مَهْلاً يَا خَالِدُ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا صَاحِبُ مَكْسٍ لَغُفِرَ لَهُ ‘থাম হে খালেদ! যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, এই মহিলা এমন তওবা করেছে, যদি রাজস্ব আদায়ে কারচুপিকারী ব্যক্তিও এমন তওবা করত, তাহ’লে তাকেও ক্ষমা করা হ’ত’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জানাযা পড়েন। তখন ওমর (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি তার জানাযা পড়লেন? অথচ সে যেনা করেছে? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِّمَتْ بَيْنَ سَبْعِيْْنَ مِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ لَوَسِعَتْهُمْ، وَهَلْ وَجَدْتَ تَوْبَةً أَفْضَلَ مِنْ أَنْ جَادَتْ بِنَفْسِهَا للهِ تَعَالَى؟ ‘এ মহিলা এমন তওবা করেছে যে, তা সত্তর জন মদীনাবাসীর মধ্যে বণ্টন করে দিলেও যথেষ্ট হয়ে যেত। তুমি কি এর চাইতে উত্তম কোন তওবা পাবে, যে ব্যক্তি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে?’[24]
(৩) নাজাশীর মৃত্যু ও গায়েবানা জানাযা আদায় : হাবশার বাদশাহ আছহামা নাজাশী (الأصحمة النجاشي) যিনি মুসলমান ছিলেন এবং রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের একান্ত হিতাকাংখী ও নিঃস্বার্থ সাহায্যকারী ছিলেন, তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সবাইকে অবহিত করে বলেন, مَاتَ الْيَوْمَ رَجُلٌ صَالِحٌ، فَقُوْمُوْا فَصَلُّوْا عَلَى أَخِيْكُمْ أَصْحَمَةَ ‘আজ একজন সৎ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। অতএব তোমরা দাঁড়িয়ে যাও এবং তোমাদের ভাই আছহামার জন্য জানাযার ছালাত আদায় কর’।[25]
(৪) উম্মে কুলছূমের মৃত্যু : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছূম নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাভিভূত হন। জামাতা ওছমান গণীকে তিনি বলেন, ‘আমার আর কোন মেয়ে থাকলে তাকেও আমি তোমার সাথে বিবাহ দিতাম। উল্লেখ্য যে, রাসূলের দ্বিতীয়া কন্যা এবং ওছমান (রাঃ)-এর প্রথমা স্ত্রী রুক্বাইয়া মাত্র ২১ বছর বয়সে ২য় হিজরীর রামাযান মাসে বদরের যুদ্ধের সুসংবাদ মদীনায় পৌঁছার দিন মারা যান। অতঃপর ৩য় হিজরীতে ওছমানের সাথে উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। ৯ম হিজরীতে তার মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতই ব্যথিত হন যে, তিনি কবরের পাশে বসে পড়েন। এ সময় তার গন্ড বেয়ে অশ্রুবন্যা বয়ে যাচ্ছিল।
(৫) ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু : তাবূক যুদ্ধ থেকে ফেরার পর মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু হয়। তার ছেলে উত্তম ছাহাবী আব্দুল্লাহর দাবী অনুযায়ী রাসূল (ছাঃ) তার জানাযা পড়েন এবং নিজের ব্যবহৃত জামা দিয়ে তাকে কাফন পরান (মুসলিম ইবনু ওমর হ’তে)। ওমর (রাঃ) আল্লাহর রাসূলকে নিষেধ করলেও রাসূল (ছাঃ) তা মানেননি।[26] তিনি বলেন, আমার জামা তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবে না। তবে আমি একাজটি এজন্য করেছি, আমার আশা যে, এর ফলে তার গোত্রের হাযারো লোক মুসলমান হয়ে যাবে’। মাগাযী এবং কোন কোন তাফসীর গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, এই সৌজন্যমূলক ঘটনা দৃষ্টে খাযরাজ গোত্রের এক হাযার লোক মুসলমান হয়ে যায়।
তার পুত্রের সন্তুষ্টি ছাড়াও উক্ত ঘটনার আরো একটি কারণ থাকতে পারে। সেটি এই যে, বুখারী কর্তৃক জাবের (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, বদরের যুদ্ধে বন্দী রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আববাস-এর জন্য একটি জামার প্রয়োজন হ’লে কারু জামা তার গায়ে হয়নি। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দেওয়া জামাটিই আববাসের গায়ে মিল হয়’। হ’তে পারে তার সেদিনের সেই ইহসানের প্রতিদান হিসাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজের জামা তাকে দিয়ে দেন।
তবে জানাযা পড়ানোর পরপরই মুনাফিকদের জানাযায় অংশগ্রহণের উপরে চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা জারী করে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,  وَلاَ تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلاَ تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَمَاتُوْا وَهُمْ فَاسِقُوْنَ- ‘তাদের মধ্যে কারুর মৃত্যু হ’লে কখনোই তার উপরে ছালাত আদায় করবেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কুফরী করেছে (অর্থাৎ তাঁর বিধানকে প্রত্যাখ্যান করেছে) এবং তারা মৃত্যুবরণ করেছে পাপাচারী অবস্থায়’ (তওবাহ ৯/৮৪)। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আর কোন মুনাফিকের জানাযা পড়েননি।
(৬) ৯ম হিজরীর হজ্জ : বিধি-বিধান সমূহ জারী :
হজ্জের বিধি-বিধান জারী করার উদ্দেশ্যে আবুবকর (রাঃ)-কে ‘আমীরুল হাজ্জ’ হিসাবে হজ্জের মৌসুমে মক্কায় পাঠানো হয়। তাদের রওয়ানা হবার পরপরই সূরা তওবাহর প্রথম দিককার আয়াতগুলি নাযিল হয়। যাতে মুশরিকদের সঙ্গে সম্পাদিত ইতিপূর্বেকার সকল চুক্তি বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে সে যুগের নিয়মানুযায়ী রাসূলের রক্ত সম্পর্কীয় হিসাবে হযরত আলীকে পুনরায় পাঠানো হয়। কেননা পরিবার বহির্ভূত কোন ব্যক্তির মাধ্যমে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা সে যুগে স্বীকৃত বা কার্যকর হ’ত না। আরাজ (الْعَرْج) অথবা যাজনান (الضجنان) উপত্যকায় গিয়ে আলী (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর কাফেলার সাথে মিলিত হন। তখন আবুবকর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, أَمِيْرٌ أَوْ مَأْمُوْرٌ ‘আমীর হিসাবে এসেছেন না মামূর হিসাবে?’ আলী (রাঃ) বললেন, لاَ بَلْ مَأْمُوْرٌ ‘না। বরং মামূর হিসাবে’।
অতঃপর হজ্জের বিধি-বিধান জারী করার ব্যাপারে আবুবকর (রাঃ) তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। অতঃপর কুরবানীর দিন হযরত আলী (রাঃ) কংকর নিক্ষেপের স্থান জামরার নিকটে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে সূরা তওবাহর প্রথম দিককার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি পড়ে শুনান এবং পূর্বের সকল চুক্তি বাতিলের ঘোষণা জারী করে দিলেন।[27] তিনি চুক্তিবদ্ধ ও চুক্তিবিহীন সবার জন্য চার মাসের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিলেন। যাতে এই সময়ের মধ্যে মুশরিকগণ চুক্তিতে বর্ণিত বিষয়সমূহ নিষ্পত্তি করে ফেলে। তবে যেসব মুশরিক অঙ্গীকার পালনে কোন ত্রুটি করেনি বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তাদের চুক্তিনামা পূর্বনির্ধারিত সময় পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়। অতঃপর আবু বকর (রাঃ) একদল লোক পাঠিয়ে ঘোষণা জারী করে দেন যে, لاَ يَطُوْفُ بِالْبَيْتِ عُرْيَانٌ وَلاَ يَحُجُّ مُشْرِكٌ  ‘এ বছরের পর থেকে আর কোন মুশরিক কা‘বা গৃহে হজ্জ করতে পারবে না এবং কোন নগ্ন ব্যক্তি কা‘বা গৃহ ত্বওয়াফ করতে পারবে না’।[28] এর ফলে মূর্তিপূজা চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হ’ল। মূলতঃ ৯ম হিজরীর এই হজ্জ ছিল পরবর্তী বছর রাসূলের বিদায় হজ্জের প্রাথমিক পর্ব। যাতে ঐ সময় মুশরিকমুক্ত হজ্জ সম্পন্ন করা যায় এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দেওয়া যায়।
উল্লেখ্য যে, সূরা তওবাহর ১২৯টি আয়াতের মধ্যে অনেকগুলি আয়াত তাবুক যুদ্ধে রওয়ানার প্রাক্কালে, মধ্যে ও ফিরে আসার পর নাযিল হয়।[29]
তাবুক যুদ্ধের গুরুত্ব :
(১) এই যুদ্ধে বিশ্বশক্তি রোমকবাহিনীর যুদ্ধ ছাড়াই পিছু হটে যাওয়ায় মুসলিম শক্তির প্রভাব আরব ও আরব এলাকার বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
(২) রোমকদের কেন্দ্রবিন্দু সিরিয়া ও তার আশপাশের সকল খৃষ্টান শাসক ও গোত্রীয় নেতৃবৃন্দ মুসলিম শক্তির সাথে স্বেচ্ছায় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে আরব এলাকা বহিঃশক্তির হামলা থেকে নিরাপদ হয়।
(৩) শুধু অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি হিসাবে নয়, সর্বোচ্চ মানবাধিকার নিশ্চিতকারী বাহিনী হিসাবে মুসলমানদের সুনাম-সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দলে দলে খৃষ্টানরা মুসলমান হয়ে যায় এবং যা খেলাফতে রাশেদাহর সময় বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিজয়ে সহায়ক হয়।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
(১) সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া রোমকভীতিকে অগ্রাহ্য করে এবং কঠিন দৈন্যদশা ও দারিদ্র্য ওক্লিষ্ট অবস্থার মধ্যেও গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে দীর্ঘ ও ক্লেশকর অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মধ্যে আল্লাহর রাসূলের অদম্য সাহস ও বিপুল দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। যা প্রতি যুগে প্রত্যেক ইসলামী শাসকের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়।
(২) মুনাফিকরাই যে ইসলামী শাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু তাবুকের যুদ্ধে তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এমনকি মসজিদ-এর অন্তরালে যে তারা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও আত্মঘাতি কাজ করতে পারে, তারও প্রমাণ তারা রেখেছে। রাসূল (ছাঃ)-এর যুগের এসব মুনাফেকী তৎপরতার মধ্যে পরবর্তী যুগের ইসলামী নেতাদের জন্য নিঃসন্দেহে হুঁশিয়ারী সংকেত লুকিয়ে রয়েছে।
(৩) জীবন ও সম্পদ সবকিছুর চেয়ে ঈমানের হেফাযতের জন্য আমীরের আদেশ পালনে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া যে সর্বাধিক যরূরী, তার সর্বোত্তম পরাকাষ্ঠা দেখা গেছে তাবুক যুদ্ধে গমনকারী শাহাদাত পাগল মুজাহিদগণের মধ্যে এবং বাহন সংকট ও অন্যান্য কারণে যেতে ব্যর্থ হওয়া ক্রন্দনশীল মুমিনদের মধ্যে। ইসলামী বিজয়ের জন্য সর্বযুগে এরূপ নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী অবশ্যই যরূরী।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: ইসলামের যুদ্ধনীতি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর যুদ্ধ সমূহের উপর পর্যালোচনা


[1] আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৫৮।
[2] বুখারী হা/৪৬২৯।
[3] তিরমিযী হা/৩৭০১; মিশকাত হা/৬০৬৪।
[4] রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১৩৬।
[5] বুখারী হা/৪১৫৪।
[6] বুখারী হা/৪২৩।
[7] মুসলিম হা/২২৮২।
[8] বুখারী হা/১৪১১; মুসলিম হা/২২৮৩।
[9] যাদুল মা‘আদ ১/৪৬২; সিলসিলা যঈফাহ হা/২০৫৯।
[10] বায়হাক্বী হা/১৮৪২২।
[11] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৫২৬।
[12] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৫২৮।
[13] মানছূরপুরী তাবুকে অবস্থানের মেয়াদ এক মাস বলেছেন এবং সফরের মেয়াদ ৫০ দিন বলেছেন (রাহমাতুল্লিল আলামীন ১/১৩৭, ১৪৪।
[14] মুসলিম, মিশকাত হা/৫৯১৭।
[15] মির‘আত ১/১৪০ ‘হুযায়ফার জীবনী’ দ্রষ্টব্য।
[16] আহমাদ, মুত্তাফাক্ব আলাইহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৭০১১।
[17] সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৯৮।
[18] যাদুল মা‘আদ ৩/১০; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৩৬।
[19] রাহমাহ ১/৯৫; আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৭২ টীকা।
[20] ফাৎহুল বারী ৮/১১৯।
[21] বুখারী হা/৪৪১৮, মুসলিম হা/২৭৬৯।
[22] বুখারী হা/৪৪২৩; ঐ, মিশকাত হা/৩৮১৫; ইবনু মাজাহ হা/২৭৬৫।
[23] দারাকুৎনী হা/৩৬৬৪ ‘বিবাহ’ অধ্যায়, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৬৫।
[24] মুসলিম হা/১৬৯৫-৯৬, মিশকাত হা/৩৫৬২।
[25] বুখারী হা/৩৮৭৭।
[26] বুখারী হা/১২৬৯।
[27] ছহীহ বুখারী হা/৩৬৯, ১৬২২, ৩১৭৭; আর-রাহীক্ব ৪৪০ পৃঃ; রহমাতুল লিল আলামীন ১/২২৮। গ্রন্থকার মানছূরপুরী এখানে বুখারী ‘হজ্জ’ অধ্যায় ৬৭ অনুচ্ছেদের (হা/১৬২২) বরাতে সূরা তওবার ৪০টি আয়াত পড়ে শুনান বলেছেন। অথচ সেখানে কেবল সূরা তওবার কথা রয়েছে, ৪০টি আয়াতের কথা নেই। -লেখক।
[28] বুখারী হা/১৬২২, ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, ৬৭ অনুচ্ছেদ।
[29] আর-রাহীক্ব ৪৩৮-৩৯ পৃঃ।

No comments

Powered by Blogger.