খায়বর যুদ্ধ

পূর্বের অংশ পড়ুন: হোদায়বিয়ার ঘটনা

(৭ম হিজরীর মুহাররম মাস)
রওয়ানা: হুদায়বিয়ার সন্ধি শেষে মদীনায় ফিরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পূরা যিলহাজ্জ ও মুহাররম মাসের অর্ধাংশ এখানে অবস্থান করেন। অতঃপর মুহাররম মাসের শেষভাগে কোন একদিন খায়বর অভিমুখে যাত্রা করেন। মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তিনটি শক্তি- কুরায়েশ, বনু গাত্বফান ও ইহুদী- এগুলির মধ্যে প্রধান কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বনু গাত্বফান ও বেদুঈন গোত্রগুলি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। বাকী রইল ইহুদীরা। যারা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে ৬০ বা ৮০ মাইল উত্তরে খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সেখান থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল প্রকারের ষড়যন্ত্র করে। বরং বলা চলে যে, খায়বর ছিল তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। তাই এদেরকে দমন করার জন্য এই অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে যাতে কোন মুনাফিক যেতে না পারে, সেজন্য আল্লাহ পূর্বেই আয়াত নাযিল করেন (ফাৎহ ৪৮/১৫)। তাছাড়া এ যুদ্ধে যে মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করবে এবং প্রচুর গনীমত লাভ করবে, সে বিষয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী নাযিল হয়েছিল (ফাৎহ ৪৮/২০)। ফলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেবলমাত্র ঐ সকল সাথীকে সঙ্গে নিলেন, যারা হোদায়বিয়ার সফরে ‘বায়‘আতুর রিযওয়ানে’ শরীক ছিলেন। যাদের সংখ্যা ছিল ১৪০০। এঁদের সাথে ২০ জন মহিলা ছাহাবী ছিলেন। যারা আহতদের সেবা-যত্নে নিযুক্ত হন। আল্লাহ পাকের এই আগাম হুঁশিয়ারীর কারণ ছিল এই যে, মুনাফিকদের সঙ্গে ইহুদীদের সখ্যতা ছিল বহু পুরাতন। তাই তারা যুদ্ধে গেলে তারা বরং ইহুদীদের স্বার্থেই কাজ করবে, যা যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর চরম ভাবে ক্ষতি করবে। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রওয়ানা দেবার কয়েকদিন পরেই আবু হুরায়রা (রাঃ) মুসলমান হয়ে মদীনায় আসেন এবং পরে খায়বর যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু তিনি যখন খয়বর পৌঁছেন, তখন যুদ্ধে বিজয় সম্পন্ন হয়ে গেছে। তবুও তাঁকে গনীমতের অংশ দেওয়া হয়।
মুনাফিকদের অপতৎপরতা :
রাসূলের খায়বর অভিযানের গোপন খবর মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই আগেভাগেই তাদের জানিয়ে দিয়ে পত্র  পাঠায়। তাতে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করা হয় এবং একথাও বলা হয় যে, তোমরা অবশ্যই জিতবে। কেননা মুহাম্মাদের লোকসংখ্যা অতীব নগণ্য এবং তারা প্রায় রিক্তহস্ত’। খয়বরের ইহুদীরা এই খবর পেয়ে তাদের মিত্র বনু গাত্বফানের নিকটে সাহায্য চেয়ে লোক পাঠায়। তাদেরকে বলা হয় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলে খয়বরের মোট উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে’। উক্ত লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে বনু গাত্বফানের লোকেরা পূর্ণ প্রস্ত্ততি নিয়ে খয়বর অভিমুখে রওয়ানা হয়। কিছু দূর গিয়েই তারা পিছন দিকে শোরগোল শুনে ভাবল, হয়তবা মুসলিম বাহিনী তাদের সন্তানাদি ও পশুপালের উপরে হামলা চালিয়েছে। ফলে তারা খয়বরের চিন্তা বাদ দিয়ে স্ব স্ব গৃহ অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করল। বলা বাহুল্য, এটা ছিল আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য। এর দ্বারা একথাও বুঝা যায় যে, মুসলমানদের ব্যাপারে তারা দারুণ ভীত ছিল। কেননা ইতিপূর্বে তারা খন্দকের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। এরপর সম্প্রতি কুরায়েশরা মুসলমানদের সঙ্গে হোদায়বিয়ায় সন্ধি চুক্তি করেছে। তাতে মুসলিম ভীতি আরও ব্যাপকতা লাভ করেছে।
খায়বরের পথে রাসূল :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধ কৌশল বিবেচনা করে উত্তর দিকে সিরিয়ার পথ ধরে খায়বর অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাতে বনু গাত্বফানের পক্ষ থেকে ইহুদীদের সাহায্য প্রাপ্তির পথ বন্ধ করা যায় এবং ইহুদীরাও এপথে পালিয়ে যাবার সুযোগ না পায়।
পথিমধ্যের ঘটনাবলী :
(১) আমের ইবনুল আকওয়ার কবিতা পাঠ : সালামা ইবনুল আকওয়া‘ (سلمة بن الأكوع) বলেন, খায়বরের পথে আমরা রাতের বেলা পথ চলছিলাম। ইতিমধ্যে জনৈক ব্যক্তি (আমার চাচা) আমের ইবনুল আকওয়া‘ (عامر بن الأكوع) -কে বলল, يا عامر ألا تسمعنا من هنيهاتك؟ ‘হে আমের! তুমি কি আমাদেরকে তোমার অসাধারণ কাব্যকথা কিছু শুনাবে না? আমের ছিলেন একজন উঁচুদরের কবি। একথা শুনে তিনি নিজের বাহন থেকে নামলেন ও নিজ কওমের জন্য প্রার্থনামূলক কবিতা বলা শুরু করলেন।-
اللهم لولا أنت ما اهتدينا * ولا تصدقنا ولا صلينا
‘হে আল্লাহ! যদি তুমি অনুগ্রহ না করতে, তাহ’লে আমরা হেদায়াত পেতাম না। ছাদাক্বা করতাম না, ছালাতও আদায় করতাম না’।
فاغفر فِدَاءً لك ما اتْقَيْنا * وَثبِّت الأقدام إن لاقينا
‘আমরা তোমার জন্য উৎসর্গীত। অতএব তুমি আমাদের ক্ষমা কর যতক্ষণ আমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করি’। তুমি আমাদের পদগুলিকে দৃঢ় রেখো যদি আমরা যুদ্ধের মুকাবিলা করি’।
وأَلْقِيَنْ سكينةً علينا * إنا إذا صِيحَ بنا أبينا
‘আমাদের উপরে তুমি ‘সাকীনাহ’ নামক বিশেষ শান্তি বর্ষণ কর। আমাদেরকে যখন ভয় দেখানো হয়, আমরা তখন তা অস্বীকার করি’।
وبالصياح عَوَّلُوا علينا
‘আর ভয়ের সময় লোকেরা আমাদের উপরে ভরসা করে থাকে’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, من هذا السائق ‘এই চালকটি কে’? লোকেরা বলল, আমের ইবনুল আকওয়া‘। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, يرحمه الله ‘আল্লাহ তার উপরে রহম করুন’। তখন একজন ব্যক্তি বলল, وجبت يا نبي الله، لولا أمتعتنا به ‘তার উপরে তো শাহাদাত ওয়াজিব হয়ে গেল হে আল্লাহর নবী! যদি আপনি তার দ্বারা আমাদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ করে দিতেন’![1]
অর্থাৎ যদি তার হায়াত বৃদ্ধির জন্য আপনি দো‘আ করতেন’। কেননা ছাহাবায়ে কেরাম জানতেন যে, যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কারু জন্য ‘মাগফেরাতে’র দো‘আ করলে তিনি শাহাদাত প্রাপ্ত হ’তেন। আর খায়বর যুদ্ধে সেটাই বাস্তবে দেখা গেছে আমের ইবনুল আকওয়া‘-র শাহাদাতের মধ্য দিয়ে।
(২) জোরে তাকবীর ধ্বনি করার নিষেধাজ্ঞা : পথিমধ্যে একটি উপত্যকা অতিক্রম করার সময় ছাহাবীগণ জোরে জোরে তাকবীর ধ্বনি করতে থাকেন (আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ)। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, أربعوا على أنفسكم ‘তোমরা নরম কণ্ঠে বল’। কেননা إنكم لا تدعون أصمَّ ولا غائباً إنكم تدعون سمعياً قريباً- ‘তোমরা কোন বধির বা অনুপস্থিত সত্তাকে ডাকছ না। বরং তোমরা ডাকছ একজন সদা শ্রবণকারী ও সদা নিকটবর্তী সত্তাকে’।[2]
তবে বিশেষ ক্ষেত্রে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর ধ্বনি করা জায়েয আছে। যেমন বদর যুদ্ধে বিজয়ের সংবাদ মদীনায় পৌঁছলে ছাহাবায়ে কেরাম তাকবীর ও তাহলীলের শব্দে মদীনা মুখরিত করে তুলেছিলেন। অনুরূপভাবে কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করে ফিরে আসা দলটি বাক্বী‘এ গারক্বাদে পৌঁছে জোরে তাকবীর ধ্বনি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও পাল্টা তাকবীর ধ্বনি করেন। খায়বরের ঘটনায় সম্ভবতঃ যুদ্ধের কৌশলগত কোন কারণ থাকতে পারে।
(৩) কেবল ছাতু খেলেন সবাই : খায়বরের সন্নিকটে ‘ছাহবা’ (الصهباء) নামক স্থানে অবতরণ করে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আছরের ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তিনি খাবার চাইলেন। কিন্তু কেবল ছাতু পাওয়া গেল। তিনি তাই মাখাতে বললেন। অতঃপর তিনি খেলেন ও ছাহাবায়ে কেরাম খেলেন। অতঃপর শুধুমাত্র কুলি করে একই ওযুতে মাগরিব পড়লেন। অতঃপর এশা পড়লেন।[3] এটা নিঃসন্দেহে রাসূলের একটি মু‘জেযা, যেমনটি ঘটেছিল ইতিপূর্বে খন্দকের যুদ্ধে পেটে পাথর বাঁধা ক্ষুধার্ত নবী ও তাঁর ছাহাবীগণের খাদ্যের ব্যাপারে।
খায়বরে উপস্থিতি :
রাসূল (ছাঃ)-এর নীতি ছিল কোথাও যুদ্ধের জন্য গেলে আগের দিন রাতে গিয়ে সেখানে অবস্থান নিতেন। অতঃপর সকালে হামলা করতেন। খায়বরের ক্ষেত্রেও তাই করলেন। তবে শিবিরের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করে অভিজ্ঞ যুদ্ধ বিশারদ ছাহাবী হুবাব ইবনুল মুনযিরের (حباب بن المنذر) পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়ে খায়বরের এত নিকটে গিয়ে শিবির সন্নিবেশ করলেন, যেখান থেকে শহর পরিষ্কার দেখা যায়। তার কিছু পূর্বে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে প্রাণভরে দো‘আ করলেন- اللهم رب السموات السبع وما أظللن، ورب الأرضين السبع وما أقللن، ورب الشياطين وما أضللن، ‘হে আল্লাহ! তুমি সপ্ত আকাশ ও যেসবের উপরে এর ছায়া রয়েছে তার প্রভু, সপ্ত যমীন ও যেসব কিছুকে সে উঠিয়ে রেখেছে তার প্রভু এবং শয়তান সমূহ ও যাদেরকে তারা পথভ্রষ্ট করেছে তাদের প্রভু-
نسألك خير هذه القرية، وخير أهلها، وخير ما فيها، ونعوذ بك من شر هذه القرية، وشر أهلها، وشر ما فيها-
‘আমরা তোমার নিকটে এই জনপদের কল্যাণ সমূহ, এর বাসিন্দাদের কল্যাণ সমূহ ও এর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর কল্যাণ সমূহ প্রার্থনা করছি এবং তোমার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এই জনপদের অনিষ্টতা হ’তে, এর বাসিন্দাদের অনিষ্টতা হ’তে এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে, সবকিছুর অনিষ্টতা হ’তে’।[4] অতঃপর সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, أقدموا، بسم الله ‘আগে বাড়ো, আল্লাহর নামে’। অতঃপর খায়রের সীমানায় প্রবেশ করে শিবির সন্নিবেশ করলেন।
খায়বরে অবস্থান :
মদীনা হ’তে ৬০ অথবা ৮০ মাইল উত্তরে খায়বর একটি বড় শহরের নাম। শহরটি অনেকগুলি দুর্গবেষ্টিত এবং চাষাবাদ যোগ্য জমি সমৃদ্ধ। খায়বরের জনবসতি দু’টি অঞ্চলে বিভক্ত। প্রথম অঞ্চলটিতে ৫টি দুর্গ এবং দ্বিতীয় অঞ্চলটিতে ৩টি দুর্গ ছিল। প্রথম অঞ্চলটি দু’ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নাম ‘নাত্বাত’ (نطاة)। এ ভাগে ছিল সবচেয়ে বড় ‘নায়েম’ (ناعم) -সহ তিনটি দুর্গ এবং আরেক ভাগের নাম ‘শাক্ব’ (الشق)। এভাগে ছিল বাকী দু’টি দুর্গ। অন্য অঞ্চলটির নাম ‘কাতীবাহ’ (شطر الكةيبة)। এ অঞ্চলে ছিল প্রসিদ্ধ ‘ক্বামূছ’ (حصن القموص) দুর্গসহ মোট ৩টি দুর্গ। দুই অঞ্চলের বড় বড় ৮টি দুর্গ ছাড়াও ছোট-বড় আরও কিছু দুর্গ ও কেল্লা ছিল। তবে সেগুলি শক্তি ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে উপরোক্ত দুর্গগুলির সমপর্যায়ের ছিল না। খায়বরের যুদ্ধ মূলতঃ প্রথম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় অঞ্চলের দুর্গ তিনটি বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে।
যুদ্ধ শুরু ও নায়েম দুর্গ জয় :
রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, لأعطين الراية غدًا رجلاً يحب الله ورسوله ويحبه الله ورسوله- ‘কাল আমি এমন একজনের হাতে পতাকা দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন’।[5] সকালে সবাই রাসূলের দরবারে হাযির হ’লেন। প্রত্যেকের ধারণা পতাকা তার হাতে আসবে। এমন সময় রাসূল (ছাঃ) বললেন, أين على بن أبي طالب؟ ‘আলী কোথায়’? সবাই বলল, চোখের অসুখের কারণে তিনি পিছনে পড়েছেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, فأرسلوا إليه ‘তার কাছে লোক পাঠাও’। অতঃপর তাকে আনা হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ মুখের লালা তার চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তার জন্য সুস্থতার দো‘আ করলেন। ফলে তিনি এমনভাবে সুস্থ হ’লেন যেন ইতিপূর্বে তার চোখে কোন অসুখ ছিল না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তার হাতে পতাকা দিয়ে বললেন, أنفذ على رسلك ‘ধীরে-সুস্থে এগিয়ে যাও ও তাদের মুখোমুখি অবস্থান নাও’। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দাও এবং জানিয়ে দাও আল্লাহর হক হিসাবে তাদের উপরে কি কি বিষয় ওয়াজিব রয়েছে। فَوَاللهِ لَأَنْ يَّهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ- ‘আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ পাক তোমার দ্বারা একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের চাইতে উত্তম হবে’।[6] রাসূলের এই বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁর শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।
অতঃপর হযরত আলী সেনাদল নিয়ে খায়বরের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মযবুত বলে খ্যাত ‘নায়েম’ (ناعم) দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হ’লেন ও তাদেরকে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ইহুদীরা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের নেতা মারহাব (مرحب) দর্পভরে কবিতা বলে এগিয়ে এসে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানালো। বীরকেশরী মারহাবকে এক হাযার যোদ্ধার সমকক্ষ মনে করা হ’ত। মারহাবের দর্পিত আহবানে সাড়া দিয়ে পাল্টা কবিতা বলে আমের ইবনুল আকওয়া‘ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর তরবারি আকারে ছোট থাকায় তার আঘাত মারহাবের পায়ের গোছায় না লেগে উল্টা নিজের হাঁটুতে এসে লাগে। যাতে তিনি আহত হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের আঘাতে মৃত্যু হওয়ায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন যে, তিনি দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হবেন।[7]
এরপর মারহাব পুনরায় গর্বভরে কবিতা আওড়াতে থাকে ও মুসলিম বাহিনীর প্রতি দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানাতে থাকে। তখন প্রধান সেনাপতি আলী (রাঃ) তার দর্প চূর্ণ করার জন্য নিজেই এগিয়ে গেলেন এবং গর্বভরে কবিতা বলে সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে এক আঘাতেই শেষ করে দিলেন। এভাবে তাঁর হাতেই মূলতঃ ‘নায়েম’ দুর্গ জয় হয়ে গেল।
হযরত আলী (রাঃ) তাঁর পঠিত কবিতায় নিজের সম্পর্কে বলেন,
أنا الذي سمتني أمي حَيْدَرَهْ * كلَيْثِ غابات كَرِيه الْمَنْظَرَهْ
أُوفِيهم بالصَّاع كَيْل السَّنْدَرَهْ *
‘আমি সেই ব্যক্তি আমার মা যার নাম রেখেছিলেন হায়দার (বাঘ)। তাই বনের বাঘের মত ভয়ংকর আমি’। আমি তাদেরকে ছা‘-এর দ্বারা বর্শার ওযন পূর্ণ করে দেব’।[8]
একারণে হযরত আলীকে ‘আলী হায়দার’ বলা হয়।
‘মারহাব’ নিহত হওয়ার পরে তার ভাই ‘ইয়াসের’ (ياسر) এগিয়ে আসে। সে যুবায়ের (রাঃ)-এর হাতে নিহত হয়। তারপর উভয়পক্ষে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। তাদের নেতৃস্থানীয় ইহুদীদের অনেকে নিহত হয়। ফলে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যায় এবং নায়েম দুর্গ বিজয় সমাপ্ত হয়।
হযরত যুবায়ের যখন ময়দানে অবতরণ করেন, তখন তার মা রাসূলের ফুফু হযরত ছাফিয়া (রাঃ) বলে ওঠেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ছেলে কি নিহত হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, না। বরং আপনার ছেলে তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করবে’। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা বাস্তবায়িত হয়।[9]
অন্যান্য দুর্গ জয় :
নায়েম দুর্গ জয়ের পর দ্বিতীয় প্রধান দুর্গ ছা‘ব বিন মু‘আয (حصن الصعب بن معاذ) দুর্গটি বিজিত হয় হযরত হুবাব বিন মুনযির আনছারী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে তিনদিন অবরোধের পর। এই দুর্গটি ছিল খাদ্য সম্ভারে পূর্ণ। আর এই সময় মুসলিম সেনাদলে দারুণ খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তখন এই দুর্গটি জয়ের জন্য আল্লাহর নিকটে রাসূল (ছাঃ) বিশেষ দো‘আ করেন এবং সেদিনই সন্ধ্যার পূর্বে দুর্গ জয় সম্পন্ন হয়। এই সময় ক্ষুধার তাড়নায় মুসলিম সেনাদলের কেউ কেউ গাধা যবহ করে তার গোশত রান্না শুরু করে দেয়। এ খবর রাসূলের কর্ণগোচর হ’লে তিনি গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেন। এই দুর্গ থেকে সেই আমলের প্রচলিত কিছু ট্যাংক ও কামান (মিনজানীক্ব ও দাববাবাহ) হস্তগত হয়। যা দুর্গ দুয়ার ভাঙ্গা এবং পাহাড়ের চূড়া বা উচ্চ ভূমিতে আগুনের গোলা নিক্ষেপের কাজে পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে খুবই কার্যকর ফল দেয়। যেমন অত্যন্ত মযবুত ‘নেযার’ (نزار) দুর্গটি জয় করার সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত ট্যাংক ও কামানের গোলা ব্যবহার করে সহজ বিজয় অর্জন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটিই ছিল যুদ্ধে সর্বপ্রথম কামান ব্যবহারের ঘটনা। নাত্বাত ও শাক্ব অঞ্চলে ৫টি দুর্গের পতনের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাতীবাহ অঞ্চলে গমন করেন ও তাদেরকে অবরোধ করেন। পরে তাদের উপরে কামানের গোলা নিক্ষেপের হুমকি দিলে ১৪দিন পর তারা বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে ও সন্ধির প্রস্তাব দেয়। অতঃপর সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে ‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের তিনটি দুর্গ বিজিত হয়। এভাবে খায়বর বিজয় সম্পন্ন হয়।
সন্ধির আলোচনা :
‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের বিখ্যাত ‘ক্বামূছ’ (حصن القموص) দুর্গের অধিপতি মদীনা হ’তে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের নেতা আবুল হুক্বাইক্ব-এর দুই ছেলে সন্ধির বিষয়ে আলোচনার জন্য রাসূলের নিকটে আসেন। আলোচনায় স্থির হয় যে, দুর্গের মধ্যে যারা আছে, তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হবে। তাদের সোনা-রূপাসহ অন্যান্য সকল সম্পদ মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হবে। ইহুদীরা সপরিবারে দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাবে। সুনানে আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে যে, নিজ নিজ বাহনের উপরে যতটুকু মাল-সম্পদ নেওয়া সম্ভব ততটুক নেওয়ার অনুমতি তাদের দেওয়া হয়।[10] কিন্তু আবুল হুকাইকের ছেলেরা সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে অনেক মাল লুকিয়ে ফেলে। বিশেষ করে মদীনা থেকে বহিষ্কৃত হবার সময় গোত্র নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব একটি চামড়ার মশক ভরে যে সম্পদ ও অলংকারাদি এনেছিল, সেই মশকটা তারা লুকিয়ে ফেলে। এতদ্ব্যতীত কেনানা বিন আবুল হুকাইকের নিকটে বনু নাযীরের যে মূল্যবান সম্পদরাজি গচ্ছিত ছিল, সেগুলি সে বিজন প্রান্তরের এক স্থানে মাটির তলে পুঁতে রাখে। তাকে জিজ্ঞেস করা হ’লে সে উক্ত বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন কেনানাকে বললেন, উক্ত সম্পদ যদি আমরা তোমার নিকট থেকে বের করতে পারি, তাহ’লে তোমাকে হত্যা করব কি’? সে বলল, হাঁ। ইতিমধ্যে কেননাহর জনৈক চাচাতো ভাই স্থানটির সন্ধান দেয় এবং গচ্ছিত সম্পদের কিছু অংশ পাওয়া যায়। অতঃপর বাকী মালামাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে আগের মতই অজ্ঞতার ভান করে। তখন তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হযরত যুবায়ের (রাঃ)-এর হাতে সমর্পণ করে বলেন, عذبه حتى تستأصل ما عنده ‘একে শাস্তি দিতে থাক,  যতক্ষণ না তার নিকটে যা আছে, তা সব তুমি বের করে নিতে পার’। এর মধ্যে আধুনিক যুগের পুলিশ রিম্যান্ডের দলীল পাওয়া যায়। হযরত যুবায়ের (রাঃ) তার বুকে চকমকি পাথর দিয়ে আঘাত করতে থাকেন (يقدح بزند في صدره) তাতে সে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যায় (حتى أشرف على نفسه)। অতঃপর তাকে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে সমর্পণ করা হ’ল। তিনি তাকে তার ভাই মাহমূদ বিন মাসলামাহকে হত্যার বদলা স্বরূপ হত্যা করেন। মাহমূদ বিশ্রাম গ্রহণের জন্য নায়েম দুর্গের দেয়ালের পাশে বসেছিলেন। তখন কেনানাহ তার উপরে একটি পাথরের চাকি নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করেছিল। তবে ইবনুল ক্বাইয়িম  বলেন, সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে সম্পদ গোপন করার অপরাধে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আবুল হুকাইকের দুই ছেলেকে হত্যা করার নির্দেশ দেন।
ছাফিয়াহর সাথে রাসূলের বিবাহ :
কেনানাহ বিন আবুল হুকাইকের নব বিবাহিতা স্ত্রী ছাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব বন্দী হন। দাসী হিসাবে প্রথমে তাকে দেহিইয়া কালবীকে দেয়া হয়। পরক্ষণেই নেতৃকন্যা হিসাবে তাকে রাসূলের ভাগে দেওয়া হয়। রাসূল (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর তাকে মুক্ত করে তিনি তাকে বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন। এই মুক্তি দানকেই তার মোহরানা হিসাবে গণ্য করা হয়। অতঃপর মদীনায় ফেরার পথে ‘ছাহবা’ (الصهباء) নামক স্থানে পৌঁছে ‘ছাফিয়া’ হালাল হ’লে তার সঙ্গে সেখানে তিনদিন বাসর যাপন করেন।[11] আনাস (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলায়েম তাকে সাজ-সজ্জা করে রাসূলের নিকটে পাঠান। এই সময় তার মুখে সবুজ দাগ দেখে রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হে রাসূল! আপনার খায়বর আগমনের পূর্বে আমি একরাতে স্বপ্ন দেখি যে, চাঁদ কক্ষচ্যুত হয়ে আমার কোলে পড়ল। একথা কেননাকে বললে সে আমার গালে দারুণ জোরে থাপ্পড় মারে, আর বলে যে, تمنين هذا الملك الذي بالمدينة ‘মদীনার বাদশাহর দিকে তোমার মন গিয়েছে’।[12]
রাসূলকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা :
খায়বর বিজয়ের পর রাসূল (ছাঃ) যখন একটু নিশ্চিন্ত হ’লেন, তখন বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা ও কোষাধ্যক্ষ সালাম বিন মুশকিমের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাকে বকরীর ভূনা রান হাদিয়া পাঠায়। সে আগেই জেনে নিয়েছিল যে, রাসূল (ছাঃ) রানের গোশত পসন্দ করেন। এজন্য উক্ত মহিলা উক্ত রানে ভালভাবে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। রাসূল (ছাঃ) গোশতের কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন, গিলেননি। অতঃপর বলেন, إن هذا العظم ليخبرني أنه مسموم ‘এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে, সে বিষ মিশ্রিত’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন উক্ত মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে কৈফিয়ত দিয়ে বলে, এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যদি এই ব্যক্তি বাদশাহ হন, إن كان ملكًا استرحت منه، وإن كان نبيًا فسيخبر، তাহ’লে আমরা তার থেকে নিষ্কৃতি পাব। আর যদি নবী হন, তাহ’লে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে’। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু সাথী বিশর ইবনুল বারা বিন মা‘রূর এক গ্রাস চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। যাতে তিনি মারা যান। ফলে তার বদলা স্বরূপ ঐ মহিলাকে হত্যা করা হয়।[13]
খায়বর যুদ্ধে উভয় পক্ষে নিহতের সংখ্যা :
এই যুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের সংঘর্ষে সর্বমোট শহীদ মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১৬ জন। তন্মধ্যে ৪ জন কুরায়েশ, ১ জন আশজা‘ গোত্রের, ১ জন আসলাম গোত্রের, ১ জন খায়বর বাসী ও বাকী ৯ জন ছিলেন আনছার। তবে এ বিষয়ে ১৮, ১৯, ২৩ বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। ইহুদী পক্ষে মোট ৯৩ জন নিহত হয়।
খায়বরের ভূমি ইহুদীদের হাতে প্রত্যর্পণ ও সন্ধি :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইহুদীদেরকে মদীনার ন্যায় খায়বর হ’তেও নির্মূল করতে চেয়েছিলেন এবং সেমতে কাতীবাহর ইহুদীরা সবকিছু ফেলে চলে যেতে রাযীও হয়েছিল। কিন্তু ইহুদী নেতারা এক পর্যায়ে রাসূলের নিকটে আবেদন করল যে, আমাদের এখানে থাকতে দেওয়া হৌক, আমরা এখানকার জমি-জমা দেখাশুনা ও চাষাবাদ করব ও আপনাদেরকে ফসলের অর্ধেক ভাগ দেব। এখানকার যমীন সম্পর্কে আমাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আপনাদের চেয়ে বেশী রয়েছে’। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের এ প্রস্তাব বিবেচনা করলেন এবং উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ প্রদানের শর্তে রাযী হ’লেন। সেই সাথে বলে দিলেন যতদিন তিনি চাইবেন, কেবল ততদিনই এ চুক্তি বহাল থাকবে। প্রয়োজনবোধে যেকোন সময় এ চুক্তি তিনি বাতিল করে দিবেন। অতঃপর উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে দায়িত্ব দেন।
গণীমত বণ্টন :
খায়বরের যুদ্ধে ভূমি সহ বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যার অর্ধেক অংশ ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য রেখে দিয়ে বাকী অর্ধেক ১৮০০ ভাগে ভাগ করা হয়। হোদায়বিয়ার ১৪০০ সাথীর মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্য অংশ নির্ধারিত ছিল। এদের মধ্যে ২০০ জন ছিলেন অশ্বারোহী। প্রত্যেক পদাতিকের জন্য একভাগ ও ঘোড়ার জন্য দু’ভাগ। এক্ষণে ১২০০ পদাতিকের জন্য ১২০০ ভাগ এবং ২০০ অশ্বারোহীর জন্য ৬০০ ভাগ, সর্বমোট ১৮০০ ভাগে গনীমত বণ্টন করা হয়। উক্ত হিসাবে আল্লাহর রাসূলও একটি ভাগ পান।
ফেদাকের খেজুর বাগান :
এই সময় ফেদাক (فدك) -এর খেজুর বাগান রাসূলের জন্য ‘খাছ’ হিসাবে বণ্টিত হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন প্রথম খায়বরে উপস্থিত হন, তখন তিনি ফিদাকের ইহুদীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য মুহাইছাহ ইবনে মাসঊদ (محيصة بن مسعود) (রাঃ)-কে পাঠান। কিন্তু তারা বিলম্ব করে। অতঃপর যখন খায়বর বিজিত হ’ল, তখন তারা ভীত হয়ে পড়ল এবং রাসূলের কাছে দূত পাঠালো এই মর্মে যে, খায়বর বাসীদের সঙ্গে ফসলের অর্ধাংশ দেবার শর্তে যেরূপ সন্ধি করা হয়েছে, তারাও অনুরূপ সন্ধিতে প্রস্ত্তত। তাদের এ প্রস্তাব কবুল করা হয় এবং ফেদাকের ভূমি রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট  করা হয়। কেননা এই ভূমি জয় করতে কোনরূপ যুদ্ধের প্রয়োজন হয়নি। কেবলমাত্র রাসুলের দাওয়াতের মাধ্যমে তা বিজিত হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে, এই ফিদাকের খেজুর বাগানের উত্তরাধিকার প্রশ্নেই রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে খলীফা আবুবকরের সঙ্গে হযরত ফাতেমা ও আলী (রাঃ)-এর বিরোধ হয়। পরে রাসূলের হাদীছ শোনার পর তাঁরা দাবী প্রত্যাহার করে নেন। হাদীছটি ছিল এই যে, إنَّا معشرُ الأنبياءِ لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَاهُ صَدَقَةٌ ‘আমরা নবীরা কোন সম্পদের উত্তরাধিকার রাখি না। যা কিছু আমরা ছেড়ে যাই, সবই ছাদাক্বা হয়’।[14] শী‘আরা এখনো উক্ত দাবীতে অটল। তারা খলীফা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে দায়ী করে থাকে। অথচ আলী (রাঃ) নিজে খলীফা হয়েও ঐ সম্পত্তি নেননি।
যাই হোক খায়বর যুদ্ধে বিপুল গণীমত লাভ হয়। যে বিষয়ে পূর্বেই مَغَانِمَ كَثِيرَةً تَأْخُذُونَهَا… আয়াত নাযিল হয়েছিল (ফাৎহ ৪৮/১৯-২০)। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, খায়বর যুদ্ধে বিজয়ী হবার পরে আমরা বলতে লাগলাম,الآن نشبع من التمر ‘এখন আমরা খেজুর খেয়ে তৃপ্ত হ’তে পারব’।[15] খায়বর থেকে মদীনায় ফিরে মুহাজিরগণ আনছারগণকে তাদের দেওয়া খেজুর গাছগুলি ফেরৎ দেন। কেননা তখন তাদের জন্য খায়বরে খেজুর গাছের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।[16]
উক্ত গনীমতে হযরত আবু হুরায়রাকে শরীক করা হয়। যিনি মুসলমান হয়ে মদীনায় যান। অতঃপর সেখান থেকে খায়বর আসেন। তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এতদ্ব্যতীত উক্ত গনীমতে জা‘ফর বিন আবু তালিব ও আবু মূসা আশ‘আরীসহ হাবশা হ’তে সদ্য আগত ছাহাবীগণকেও শরীক করা হয়। যাদের সংখ্যা ছিল ১৬। আমর বিন উমাইয়া যামরীকে পূর্বেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে পাঠিয়েছিলেন এদেরকে মদীনায় পাঠিয়ে দেবার জন্য। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এই সময় জা‘ফরকে পেয়ে এত খুশী হয়েছিলেন যে, তিনি উঠে তাকে চুম্বন করে বলেন,والله ما أدري بأيهما أفرح؟ بفتح خيبر أم بقدوم جعفر؟ ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না কোনটাতে আমি বেশী খুশী হয়েছি। খায়বর বিজয়ে না জা‘ফরের আগমনে’?[17]
উল্লেখ্য যে, রাসূলের আবির্ভাবের খবর শুনে আবু মূসা আশ‘আরী ইয়ামন হ’তে তার গোত্রের ৫০-এর অধিক লোক নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাদের নৌকা তাদেরকে নাজ্জাশীর দেশে নামিয়ে দেয়। আর সেখানেই জা‘ফর (রাঃ)-এর সাথে তাদের সাক্ষাত হয়ে যায় এবং তাদের সঙ্গেই সেখানে অবস্থান করেন ও পরে মদীনায় আসেন।[18]
শাদ্দাদ ইবনে হাদ বলেন, জনৈক বেদুঈন মুসলমান হ’লে খায়বরের যুদ্ধের গণীমতের অংশ তাকেও দেয়া হয়। বেদুঈন সকলের পশুপাল চরাত। সন্ধ্যায় ফিরে এসে গণীমতগুলো নিয়ে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল, হে রাসূল! আমি তো এজন্য আপনার সাথী হইনি। আমি তো এসেছিলাম এজন্য যাতে আমার কণ্ঠনালীতে একটা তীর লাগে। আর আমি শহীদ হয়ে জান্নাতে যেতে পারি’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর সঙ্গে তোমার কারবার যদি সত্য হয়, তাহ’লে তিনি তোমার আকাংখা  পূরণ করবেন। এরপর যুদ্ধ হ’ল। যুদ্ধ সমাপ্তির পর তার লাশের পাশ দিয়ে  যাবার সময় রাসূল (ছাঃ) তাকে চিনতে পেরে বলেন, আল্লাহর সঙ্গে তার কারবার সত্য ছিল। আল্লাহ তার আকাংখাকে সত্য করেছেন।[19]
খায়বর বিজয়ের পর :
খায়বর বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পার্শ্ববর্তী ইহুদী জনপদ ওয়াদিল ক্বোরা (وادي القرى) এবং তায়মা (تيماء) -এর দিকে মনোনিবেশ করলেন, যাতে এরা পরবর্তীতে মাথা চাড়া না দেয়। এদের সাথে আরবদের একটি দল গিয়ে মিলিত হয়েছিল।
(১) ওয়াদিল ক্বোরা জয় : মুসলিম বাহিনী ওয়াদিল ক্বোরা উপস্থিত হ’লে ইহুদীরা তীর নিক্ষেপ শুরু করল। তাতে মিদ‘আম (مدعم) নামক রাসূল (ছাঃ)-এর জনৈক গোলাম মৃত্যুবরণ করে। তখন সাথীরা বলে ওঠেন, هنيئًا له الجنة ‘জান্নাত তার জন্য আনন্দময় হৌক’। রাসূল (ছাঃ) রাগতঃস্বরে বললেন, كلا، والذي نفسي بيده، إن الشَّمْلَة التي أخذها يوم خيبر من المغانم، لم تصبها المقاسم، لتشتعلُ عليه نارًا- ‘কখনোই না। সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার জীবন রয়েছে, এই ব্যক্তি খায়বরের দিন গনীমত বণ্টনের পূর্বেই তা থেকে একটা চাদর নিয়েছিল, সে চাদর এখন তার উপরে অবশ্যই আগুন হয়ে জ্বলবে’। একথা শুনে কেউ জুতার একটি ফিতা বা দু’টি ফিতা যা গোপনে নিয়েছিল, সব এনে রাসূলের নিকটে জমা দিল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এ ফিতা ছিল আগুনের’।[20]
এরপর ইহুদীদের নিকটে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা যথারীতি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল। তাদের মধ্য হ’তে একজন এসে দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল। তখন রাসূলের পক্ষে যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এগিয়ে গিয়ে তাকে খতম করে দেন। এইভাবে তাদের ১১ জন ব্যক্তি পরপর খতম হয়। প্রতিবারে দ্বৈতযুদ্ধের পূর্বে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে ইসলাম কবুলের আহবান জানাতেন। কিন্তু তারা অহংকার বশে বারবার তা প্রত্যাখ্যান করত। এভাবে একদিন গত হ’ল। পরদিন রাসূল (ছাঃ) আবার গিয়ে তাদের দাওয়াত দিলেন। তখন তারা আত্মসমর্পণ করে এবং বহু গণীমত হস্তগত হয়। যা ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টিত হয়। তবে জমি-জমা ও খেজুর বাগান ইহুদীদের নিকটে অর্ধাংশের বিনিময়ে রেখে দেওয়া হয়, যেমন খায়বর বাসীদের সাথে চুক্তি করা হয়েছিল।
(২) তাইমা (تيماء) বিজয় : খায়বর ও ওয়াদিল ক্বোরার ইহুদীদের শোচনীয় পরাজয়ের খবর জানতে পেরে তাইমার ইহুদীরা শক্তি প্রদর্শনের চিন্তা বাদ দিয়ে সরাসরি সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের জন্য রাসূলের নিকটে দূত প্রেরণ করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাতে সম্মত হয়ে তাদেরকে তাদের মাল-সম্পদসহ সেখানে বসবাসের অনুমতি দেন।[21] অতঃপর তাদের সঙ্গে নিম্নোক্তভাবে লিখিত  চুক্তি সম্পাদন করেন- هذا كتاب محمد رسول الله لبني عاديا، أن لهم الذمة، وعليهم الجزية، ولا عداء ولا جلاء، الليل مد، والنهار شد- ‘এ দলীল লিখিত হ’ল আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে বনু আদিয়ার জন্য। তাদের জন্য রইল (আমাদের) যিম্মাদারী এবং তাদের উপরে রইল জিযিয়া। কোন শত্রুতা নয়, কোন বিতাড়ন নয়। তাদের রাত্রি ও দিন হবে নিরাপদ’। চুক্তি নামাটি লিপিবদ্ধ করেন খালেদ ইবনু সাঈদ (ইবনু সা‘দ)। চুক্তির ভাষা ও সারগর্ভ বক্তব্য সত্যিই চমৎকার এবং অনন্য।
মদীনায় প্রত্যাবর্তন :
তাইমাবাসী ইহুদীদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে এক স্থানে শেষ রাত্রিতে যাত্রা বিরতি করেন ও বেলালকে পাহারায় নিযুক্ত করে বলেন, اكلأ لنا الليل ‘রাত্রিতে  আমাদের দিকে খেয়াল রেখো (অর্থাৎ ফজরে জাগিয়ে দিয়ো)। কিন্তু বেলালের চোখেও ঘুম চেপে গেল। ফলে সকালের রোদ গায়ে লাগলেও কারু ঘুম ভাঙ্গেনি। রাসূলই সর্বপ্রথম ঘুম থেকে ওঠেন এবং ঐ উপত্যকা ছেড়ে কিছু দূর গিয়ে সবাইকে নিয়ে ফজর পড়েন। তবে এই প্রসিদ্ধ ঘটনাটি অন্য ফজরে ঘটেছিল বলে কথিত আছে।[22] অতঃপর ৭ম হিজরীর ছফর মাসের শেষভাগে অথবা রবীউল আউয়াল মাসে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাসাধিককাল পরে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
১। ইসলাম ও ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের দমন ও নির্মূল করা ইসলামের স্বার্থেই যরূরী।
২। যতবড় শত্রুই হৌক প্রথমে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে। দাওয়াত কবুল না করলে এবং যুদ্ধে এগিয়ে এলেই কেবল তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে।
৩। যুগোপযোগী আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও কলাকৌশল প্রয়োগ করা ইসলামী যুদ্ধনীতিতে সর্বতোভাবে সিদ্ধ।
৪। শত্রুতা না করলে এবং অন্যান্য শর্তাদি পূরণ করলে অমুসলিমদের সাথে কোন যুদ্ধ নেই।
৫। জাতীয় সম্পদ হ’তে খেয়ানত করা জাহান্নামের আগুন খরিদ করার শামিল। এমতাবস্থায় ইসলামী জিহাদে বাহ্যতঃ শহীদ হ’লেও সে ব্যক্তি জাহান্নামী হবে।
৬। চূড়ান্ত বিজয় কেবল ঈমানদারগণের জন্যই নির্ধারিত, মুনাফিকদের জন্য নয়। সেকারণ খায়বর যুদ্ধে মুনাফিকদের যোগদানে নিষেধ করা হয়।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: ক্বাযা ওমরাহ

[1] বুখারী হা/৪১৯৬; মুসলিম হা/১৮০২।
[2] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩০৩।
[3] ওয়াকেদী, মাগাযী পৃঃ ২১২।
[4] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩২৯ হাদীছ ছহীহ, সনদ মুরসাল।
[5] মানছূরপুরী বলেন, প্রথমে মাহমূদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পরপর পাঁচদিন অভিযান ব্যর্থ হবার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত কথা বলেন এবং আলীকে দায়িত্ব দেন (রাহমাতুল ১/২২০-২২২)। কিন্তু মুবারকপুরী এতে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং অধিকাংশ বিদ্বানের নিকটে গৃহীত মত হিসাবে বইয়ে প্রদত্ত বক্তব্য পেশ করেন।
[6] বুখারী হা/৪২১০।
[7] বুখারী হা/৩৮৭৫, ৫৬৮২, ৬৩৮৩; মুসলিম হা/৩৩৮৩।
[8] মুসলিম হা/১৮০৭।
[9] যাদুল মা‘আদ ৩/২৮৭।
[10] আবুদাঊদ হা/৩০০৬, সনদ হাসান।
[11] বুখারী হা/৪২১১।
[12] যাদ ২/১৩৭; ইবনে হিশাম ২/৩৩৬।
[13] বুখারী হা/৩১৬৯; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৩৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ, সনদ ছহীহ।
[14] নাসাঈ, সুনানুল কুবরা হা/৬৩০৯, কানযুল উম্মাল হা/৩৫, ৬০০; বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৯৬৭।
[15] বুখারী হা/৪২৪২।
[16] মুসলিম হা/১৭৭১।
[17] শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৪৬৮৭; ফিক্বহুস সীরাহ, সনদ হাসান।
[18] বুখারী হা/৩১৩৬; মুসলিম হা/২৫০২।
[19] বায়হাক্বী, হাকেম, নাসাঈ হা/১৯৫৩, সনদ ছহীহ।
[20] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৯৭, জিহাদ অধ্যায়-১৯, অনুচ্ছেদ-৭।
[21] যাদুল মা‘আদ ২/১৪৭।
[22] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৪০।

No comments

Powered by Blogger.