মক্কা বিজয়ের পর প্রতিনিধি দল সমূহের আগমন
৯ম ও ১০ম হিজরী সনকে আমরা প্রতিনিধি দল সমূহের আগমনকাল (عام الوفود) হিসাবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে পারি। মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম কবুলের স্রোত জারি হয়ে যায়। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভের জন্য সমগ্র আরব জাহান যেন মক্কা বিজয়ের অপেক্ষায় ছিল। কেননা তারা বলত, اتركوه وقومه، فإنه إن ظهر عليهم فهو نبي صادق ‘মুহাম্মাদ ও তাঁর কওমকে ছেড়ে দাও। কেননা যদি তিনি তাদের (অর্থাৎ কুরায়েশদের) উপরে জয় লাভ করেন, তাহ’লে তিনি সত্য নবী’।[1] অতঃপর ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে যখন তিনি মক্কা জয় করলেন এবং কুরায়েশ নেতারা ইসলাম কবুল করল, এমনকি হোনায়েন যুদ্ধে রাসূলের পক্ষ হয়ে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করলেন, তখন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন গোত্রের পক্ষ হ’তে দলে দলে প্রতিনিধি দল মদীনায় আসতে শুরু করল এবং ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’ল। ফলে দেখা গেল যে, মক্কা বিজয়ের মাত্র নয় মাসের মাথায় ৯ম হিজরীর রজব মাসে তাবুক অভিযানের সময় ৩০,০০০ ফৌজ জমা হয়ে গেল। তার এক বছর পর ১০ম হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে বিদায় হজ্জের সময় আল্লাহর রাসূলের সাথী ছিলেন এক লক্ষ অথবা এক লক্ষ চবিবশ হাযার মুসলমান। যাদের লাববায়েক, আল্লাহু আকবার, সুবহান্নাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহর ধ্বনিতে গগন-পবন মুখরিত হয়েছিল। দু’দিন আগেও যারা লাত, মানাত, উয্যা, হোবলের নামে জয়ধ্বনি করত ও তাদের সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন নযর-নেয়ায নিয়ে তাদের অসীলায় পরকালে মুক্তি লাভের জন্য সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ত।
প্রতিনিধি দল সমূহ : চরিতকারগণ ৭০-এর অধিক প্রতিনিধি দলের কথা বর্ণনা করেছেন। মানছূরপুরী তাদের মধ্যেকার ২৬টি বিশেষ দলের নাম ও বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। যেমন দাওস, ছাদা, ছাক্বীফ, আব্দুল ক্বায়েস, ত্বাই, বনু হানীফা, আশ‘আরী, আযদ, হামদান, বনু সা‘দ, বনু আসাদ, বনু নাজীব, ওয়াফদে তারেক বিন আব্দুল্লাহ, বাহরা, উযরাহ, খাওলান, মুহারিব, গাসসান, বনুল হারেছ, বনু আয়েশ, গামেদ, বনু ফাযারাহ, সালামান, নাজরান, নাখঈ (نخع) এবং ফারওয়া বিন আমরের দূত। মুবারকপুরী ১৬টি প্রতিনিধি দলের বর্ণনা দিয়েছেন, যার মধ্যে চারটি রয়েছে মানছূরপুরীর তালিকার বাইরের। যেমন- বালী, কা‘ব বিন যুহায়ের, ইয়ামনের শাসকদের দূত এবং বনু আমের বিন ছা‘ছা‘আহ প্রতিনিধি দল। আমরা উভয়ের দেওয়া তালিকা থেকে উদ্ধৃত করব। কেননা প্রত্যেকটিতেই রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়, যা অতীব যরূরী।
১. আব্দুল ক্বায়েস প্রতিনিধি দল (وفد عبد القيس) :
এই গোত্রের নেতা মুনক্বিয বিন হাইয়ান (منقذ بن حيان) ৫ম হিজরী বা তার পূর্বে ব্যবসা উপলক্ষে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন এবং তাঁর গোত্রের প্রতি ইসলাম কবুলের দাওয়াত দিয়ে তার মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ) একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পাঠ অন্তে ইসলাম কবুল করে নিজ গোত্রের ১৩/১৪ জন লোক নিয়ে আল-আশুজ্জ আল-আছরীর নেতৃত্বে তারা মদীনায় আসেন। মদীনা এবং আব্দুল ক্বায়েস গোত্রের মাঝখানে শত্রুভাবাপন্ন ‘মুযার’ (مضر) গোত্র থাকায় তারা ‘হারাম’ মাসে মদীনায় আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে চারটি বিষয়ে নির্দেশ ও চারটি বিষয়ে নিষেধ করেন, যার বিবরণ মিশকাত সহ (হাদীছ সংখ্যা ১৭) বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থে রয়েছে। এই সময় রাসূল (ছাঃ) দলনেতাকে বলেছিলেন, إِنَّ فِيْكَ خَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ الْحِلْمُ وَالْأَنَاةُ ‘তোমার মধ্যে দু’টি স্বভাব রয়েছে, যা আল্লাহ পসন্দ করেন: ধৈর্য ও দূরদর্শিতা’।[2]
উক্ত গোত্রের ৪০ জনের দ্বিতীয় দলটি আগমন করে ৯ম হিজরীতে। যাদের মধ্যে জারূদ ইবনুল ‘আলা আল-আবদী নামক জনৈক খৃষ্টান ছিলেন। যিনি ইসলাম কবুল করেন এবং তাঁর ইসলাম অত্যন্ত সুন্দর থাকে’।
[শিক্ষণীয় : স্রেফ দাওয়াতের মাধ্যমেই এই বিখ্যাত গোত্রটি ইসলাম কবুল করে]
২. দাউস প্রতিনিধি দল (وفد دَوْس) :
ইয়ামনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই গোত্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল। প্রথমে ১০ম নববী বর্ষে দাউস গোত্রের নেতা ও বিখ্যাত কবি তোফায়েল বিন আমর মক্কায় যান। মক্কাবাসীগণ শহরের বাইরে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাদের মতে যাদুগ্রস্ত (?) রাসূলের কাছে যেতে তারা তাকে নিষেধ করে। কিন্তু তিনি একদিন খুব ভোরে কা‘বাগৃহে যান ও রাসূলকে পেয়ে যান। তিনি তাঁর কুরআন তেলাওয়া শুনে মুগ্ধ হন এবং ইসলাম কবুল করেন’। অতঃপর তিনি ফিরে গিয়ে তার কওমকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। দীর্ঘদিন দাওয়াত দিয়ে কোন ফল না পেয়ে এক পর্যায়ে নিরাশ হয়ে তিনি রাসূলকে এসে তার কওমের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার আহবান জানান। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের জন্য হেদায়াতের দো‘আ করে বলেন, اللَّهُمَّ اهْدِ دَوْسًا وَائْتِ بِهِمْ ‘হে আল্লাহ! তুমি দাউস কওমকে সুপথ প্রদর্শন কর এবং তাদেরকে (মুসলমান করে) নিয়ে এসো’।[3] ফলে সত্বর তার গোত্রের লোকেরা ইসলাম কবুল করল এবং ৭০ অথবা ৮০ জনের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে তিনি মদীনায় আসেন। কিন্তু ঐ সময়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খায়বর অভিযানে থাকায় তারা খায়বরে চলে যান এবং রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে ধন্য হন। এই দলেই ছিলেন পরবর্তীতে খ্যাতনামা ছাহাবী ও শ্রেষ্ঠতম হাদীছজ্ঞ আবু হুরায়রা (রাঃ)। যদি সেদিন রাসূল (ছাঃ) বদদো‘আ করতেন, আর দাউস কওম ধ্বংস হয়ে যেত, তাহ’লে আবু হুরায়রার মত ছাহাবীর খিদমত থেকে মুসলিম জাতি বঞ্চিত হয়ে যেত। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
[শিক্ষণীয় : দ্বীনের দাওয়াতে দ্রুত ফল লাভের আশা করা যাবে না বা নিরাশ হওয়া যাবে না। ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং বদদো‘আ করা যাবে না। বরং সর্বদা লোকদের হেফাযতের জন্য দো‘আ করতে হবে]
৩. ফারওয়া বিন আমর আল-জুযামীর দূতের আগমন (رسول فَرْوَة بن عمرو الجُذَامي) :
রোমক সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের আরবীয় গভর্ণর ফারওয়া বিন আমর-এর রাজধানী ছিল মু‘আন (معان)। জর্ডান, সিরিয়া ও ফিলিস্তীনের সংশ্লিষ্ট এলাকা তাঁর শাসনাধীনে ছিল। মুবারকপুরী বলেন, ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে সংঘটিত মুতার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অপূর্ব বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইসলামের সত্যতার উপরে বিশ্বাসী হন এবং ইসলাম কবুল করেন। তবে মানছূরপুরী বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। অতঃপর তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং উপঢৌকন হিসাবে একটি সাদা খচ্চর সহ রাসূলের নিকটে একজন দূত প্রেরণ করেন।
গভর্ণর ফারওয়া ইসলাম কবুল করেছেন এ খবর জানতে পেরে রোম সম্রাট তাকে ডেকে পাঠান। অতঃপর তাকে ইসলাম ত্যাগ অথবা মৃত্যু দু’টির একটা বেছে নেবার এখতিয়ার দেন এবং সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দানের জন্য কারাগারে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু প্রকৃত মুমিন ফারওয়া বিন আমর (রাঃ) ইসলাম ত্যাগের বদলে মৃত্যুকেই বেছে নেন। অতঃপর তাঁকে যেরুযালেম নগরীর ‘আফরা’ (عفراء) নামক ঝর্ণার পাড়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তবে মুবারকপুরী বলেন, তাঁকে শূলবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
ফাঁসির মঞ্চে পৌঁছে ফারওয়া (রাঃ) নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেন,
الأهل أتى سلمى بأن حليلها * على ماء عفرى فوق إحدى الرواحل
على ناقة لم يضرب الفحل أمها * مشذبة أطرافها بالمناجل
অতঃপর ফাঁসির দড়ি গলায় পরার প্রাক্কালে তিনি নিম্নের কবিতা পড়েন,
بلغ سراة المؤمنين بأنني * سلم لربي وأعظمي ومقامي
ফারওয়া বিন আমর ও অন্যান্য নও মুসলিমদের বিরুদ্ধে রোমক সম্রাটের এহেন নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পূর্বে অর্থাৎ ১১ হিজরীর ছফর মাসে এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রস্ত্তত করেন এবং উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে শামের বালক্কা অঞ্চল এবং দারূমের ফিলিস্তীনী অঞ্চল সমূহে গমনের নির্দেশ দেন। যার উদ্দেশ্য ছিল রোমকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা এবং ঐ অঞ্চলের আরব ও নও মুসলিমদের সাহস দেওয়া। মদীনা থেকে বেরিয়ে তিন মাইল যেতেই রাসূলের মৃত্যু সংবাদে অগ্রগমন স্থগিত হয়ে যায়। পরে আবু বকরের খেলাফতের শুরুতে তারা পুনরায় গমন করেন এবং অভিযান শেষে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন।
[শিক্ষণীয় : মুসলমান সবকিছু ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু ঈমান ত্যাগ করতে পারে না]
৪. ছাদা প্রতিনিধি দল (وفد صداء) :
ইয়ামন সীমান্তবর্তী ছাদা অঞ্চলের নেতা যিয়াদ ইবনুল হারেছ ছুদাঈ প্রথমে একবার রাসূলের দরবারে হাযির হন। অতঃপর ফিরে গিয়ে নিজ কওমকে ইসলামের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন এবং নেতৃস্থানীয় ১৫ জনকে নিয়ে ৮ম হিজরীতে দ্বিতীয়বার মদীনায় আসেন। তারা রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে তাঁর নিকটে বায়‘আত করে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর ফিরে গিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেন। ফলে ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের সময় এই সম্প্রদায়ের ১০০ জন লোক রাসূলের সাথী হন।
[শিক্ষণীয় : দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ঘটেছে, এটি তার অন্যতম প্রমাণ]
টীকা : মানছূরপুরী ও মুবারকপুরী উভয়ে অত্র ঘটনাটি ৮ম হিজরীর বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মানছূরপুরী উক্ত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সেনাদল প্রেরণের কথা বলেননি। মুবারকপুরী ৪০০ সৈন্য প্রেরণের কথা বলেছেন। সেকথা জানতে পেরে গোত্র নেতা যিয়াদ বিন হারেছ রাসূলের দরবারে এসে সেনাদল ফেরৎ নেবার অনুরোধ করেন এবং নিজে তার সম্প্রদায়ের যামিন হন। ফলে সেনাদল ফিরে আসে মুবারকপুরী উক্ত ঘটনাটিকে হোনায়েন যুদ্ধের শেষে জেইররানা থেকে ফেরার পরের ঘটনা বলেছেন। অথচ জেইররানা থেকে ফিরে মক্কায় ওমরা করে ৮ হিজরীর ২৪শে যুলক্বা‘দাহ মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ৯ম হিজরীর মুহাররমের আগে আগে আর কোন অভিযান প্রেরিত হয়েছিল বলে তিনি তাঁর প্রদত্ত যুদ্ধ তালিকার কোথাও উল্লেখ করেননি।
৫. ছাক্বীফ প্রতিনিধি দল (وفد ثقيف) :
ত্বায়েফের বিখ্যাত ছাক্বীফ গোত্রের এই প্রতিনিধিদল ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে মদীনায় আসে। এগারো মাস আগে ত্বায়েফ দুর্গ হ’তে অবরোধ উঠিয়ে ফিরে আসার সময় তাদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার জন্য সাথীদের দাবীর বিপরীতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হেদায়াতের দো‘আ করে বলেছিলেন। اللَّهُمَّ اهْدِ ثَقِيفًا وآتِ بِهِمْ ‘হে আল্লাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত করো ও তাদের এনে দাও’।[4] আল্লাহ তাঁর রাসূলের দো‘আ কবুল করেছিলেন এবং তিনি ত্বায়েফ থেকে ফিরে মক্কায় ওমরাহ করে ৮ম হিজরীর ২৪শে যুলক্বা‘দাহ মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পরপরই[5] ছাক্বীফ গোত্রের নেতা ওরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী মদীনায় চলে আসেন এবং রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে ইসলাম কবুল করেন। তাঁর দশজন স্ত্রী ছিল। মুসলমান হওয়ার পর রাসূলের হুকুমে চার জনকে রেখে বাকীদের তালাক দেন। ইতিপূর্বে হুদায়বিয়া সন্ধির প্রাক্কালে তিনি কুরায়েশদের পক্ষে রাসূলের নিকটে দুতিয়ালি করেন। ইনি প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত মুগীরা বিন শো‘আ (রাঃ)-এর চাচা ছিলেন। যিনি আগেই ইসলাম কবুল করেছিলেন।
ওরওয়া ফিরে এসে নিজ সম্প্রদায়ের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। বহু লোক তাঁর দাওয়াতে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। একদিন তিনি নিজ বালাখানায় ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় এক দুষ্টমতি তাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারে। তাতে তিনি শহীদ হয়ে যান।
কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর দাওয়াত সকলের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই আবদে ইয়ালীল (عَبْد يالِيل بن عمرو) -এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে মদীনায় পৌঁছে। এই দলে মোট ছয় জন সদস্য ছিলেন। যাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন পরবর্তীকালে খ্যাতনামা ছাহাবী ও হযরত ওমরের সময়ে প্রথম ভারত অভিযানকারী বিজয়ী সেনাপতি ওছমান বিন আবুল আছ ছাক্বাফী। এঁরা মদীনায় পৌঁছলে রাসূলের হুকুমে মুগীরা বিন শো‘বা এঁদের আপ্যায়ন ও দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
উল্লেখ্য যে, প্রতিনিধি দলের নেতা আবদে ইয়ালীল ছিলেন সেই ব্যক্তি, যার নিকটে ১০ম নববী বর্ষের শাওয়াল মোতাবেক ৬১৯ খৃষ্টাব্দের মে/জুন মাসের প্রচন্ড খরতাপের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেবলমাত্র যায়েদ বিন হারেছাহকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে ৬০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি ত্বায়েফের কিশোর ছোকরাদেরকে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। তারা তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে তিন মাইল পর্যন্ত পিছু ধাওয়া কর তাড়িয়ে দিয়েছিল। ফেরার পথে তিনি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহর আঙ্গুর বাগানে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বসে সেই প্রসিদ্ধ দো‘আটি করেছিলেন, যা ‘মযলূমের দো‘আ’ (دعاء المظلوم) বলে খ্যাত। অতঃপর ‘ক্বারনুল মানাযিল’ নামক স্থানে অবস্থানকালে পাহাড় সমূহের নিয়ন্ত্রক ফেরেশতা (ملك الجبال) -কে নিয়ে জিব্রীল (আঃ) অবতরণ করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদদো‘আ না করে হেদায়াতের দো‘আ করে বলেছিলেন, بَلْ أَرْجُو أَنْ يُّخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَّعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا ‘বরং আমি আশা করি তাদের ঔরসে এমন সন্তানগণ জন্মগ্রহণ করবে, যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না’।[6] দীর্ঘ এক যুগ পরে ত্বায়েফের সেই দুর্ধর্ষ নেতাই আজ রাসূলের দরবারে হেদায়াতের ভিখারী। আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা!
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাক্বীফ প্রতিনিধি দলের জন্য মসজিদে নববীর নিকটবর্তী স্থানে তাঁবুর ব্যবস্থা করতে বললেন। যাতে তারা সেখান থেকে মসজিদে ছালাতের দৃশ্য দেখতে পায় ও কুরআন শুনতে পায়।
রাসূলের এই দূরদর্শী ব্যবস্থাপনায় দ্রুত কাজ হ’ল। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের অন্তরে ইসলাম প্রভাব বিস্তার করল। আবদে ইয়ালীলের নেতৃত্বে তারা একদিন এসে রাসূলের নিকটে ইসলামের বায়‘আত গ্রহণ করল। তবে অত্যন্ত হুঁশিয়ার নেতা হিসাবে এবং স্বীয় মূর্খ সম্প্রদায়কে বুঝানোর স্বার্থে বায়‘আতের পূর্বে নিজ সম্প্রদায়ের লালিত রীতি-নীতি ও মন-মানসিকতার আলোকে বেশ কিছু বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন, যাতে পরবর্তীতে কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ না থাকে এবং লোকেরা বলতে না পারে যে, কোনরূপ আলোচনা ছাড়াই তোমরা মুসলমান হয়েছে। বিষয়গুলি এবং তার উত্তরে রাসূলের জবাব সমূহ নিম্নে বর্ণিত হ’ল-
১ম বিষয় : আমাদেরকে ছালাত পরিত্যাগের অনুমতি দেওয়া হৌক।
জওয়াব : রাসূল (ছাঃ) বললেন, لاَ خَيْرَ فِى دِينٍ لاَ رُكُوعَ فِيهِ ‘ঐ দ্বীনে কোন কল্যাণ নেই, যার মধ্যে ছালাত নেই’।[7]
২য় বিষয় : আমাদেরকে জিহাদ ও যাকাত থেকে মুক্ত রাখা হৌক।
জওয়াব : রাসূল (ছাঃ) এটিকে আপাততঃ মেনে নিলেন। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইসলামের প্রভাবে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগুলি করবে’ (সুনানে আবুদাঊদ ওয়াহাব ও ওছমান বিন আবিল আছ হ’তে। তায়েফের খবর’ অনুচ্ছেদ)।[8]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) আবদে ইয়ালীলের আরও কিছু বিষয়ের উপরে কথোপকথন উদ্ধৃত করেছেন। যেমন-
৩য় বিষয় : আমাদের লোকেরা অধিকাংশ সময় কার্যোপলক্ষে বাইরে থাকে। সেকারণ তাদের জন্য ব্যভিচারের অনুমতি আবশ্যক।
জওয়াব : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা বনু ইস্রাঈল ৩২ আয়াতটি পাঠ করে শুনান এবং এ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান।
৪র্থ বিষয় : আমাদেরকে মদ্যপানের সুযোগ অব্যাহত রাখা হৌক। কেননা আমাদের লোকেরা এতে এমনভাবে অভ্যস্ত যে, তারা তা ছাড়তেই পারবে না।
জওয়াব : রাসূল (ছাঃ) তাকে সূরা মায়েদা ৯০ আয়াতটি পাঠ করে শুনান এবং একে সিদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই বলে জানান। কথাগুলি শুনে আবদে ইয়ালীল তাঁবুতে ফিরে গেলেন এবং রাতে সঙ্গীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। পরের দিন এসে পুনরায় রাসূলের সাথে কথাবার্তা শুরু করলেন।
৫ম বিষয় : আমরা আপনার সব কথা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের উপাস্য দেবী ‘রববাহ’ (ربَّه) সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
জওয়াব : রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা ওটাকে গুঁড়িয়ে দিবে। একথা শুনে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হায় হায় করে উঠে বলল, দেবী একথা জানতে পারলে আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেবে। তাদের এই অবস্থা দেখে ওমর ফারূক (রাঃ) আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বলে উঠলেন, হে ইবনু আবদে ইয়ালীল! তোমাদের জন্য আফসোস। তোমরা কি বুঝ না যে, ওটা একটা পাথর ছাড়া কিছুই নয়? আবদে ইয়ালীল ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ওমর! আমরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসিনি। অতঃপর তিনি রাসূলকে অনুরোধ করলেন যে, দেবী মূর্তি ভাঙ্গার দায়িত্বটা আপনি গ্রহণ করুন’। রাসূল (ছাঃ) তাতে রাযী হলেন এবং বললেন, ঠিক আছে আমি ওটা ভাঙ্গার জন্য লোক পাঠাব’। প্রতিনিধি দলের জনৈক সদস্য বললেন, আপনার লোককে আমাদের সাথে পাঠাবেন না। বরং পরে পাঠাবন।
এইভাবে বিস্তারিত আলোচনা শেষে তারা সবাই ইসলাম কবুল করলেন। অতঃপর বিদায়কালে বললেন, হে রাসূল! আমাদের জন্য একজন ইমাম নিযুক্ত করে দিন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওছমান বিন আবুল আছ ছাক্বাফীকে তাদের ইমাম ও নেতা নিযুক্ত করে দেন। কেননা দলের মধ্যে তিনিই কুরআন ও শরী‘আতের বিধান সমূহ বেশী লিখেছিলেন। যদিও বয়সে ছিলেন সবার ছোট। বয়োকনিষ্ঠ হ’লেও তিনি অত্যন্ত যোগ্য নেতা প্রমাণিত হন। ১১ হিজরীতে রাসূলের মৃত্যুর পর ধর্ম ত্যাগের হিড়িক পড়ে গেলে ছাক্বীফ গোত্র ধর্মত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে। তখন তিনি স্বীয় গোত্রকে ডেকে বলেন, يا معشر ثقيف كنتم آخر الناس إسلاما فلا تكونوا أول الناس ردة ‘হে ছাক্বীফগণ! তোমরা সবার শেষে ইসলাম গ্রহণ করেছ। অতএব সবার আগে ইসলাম ত্যাগী হয়ো না’। তার একথা শুনে সবাই ফিরে আসে। ইসলাম কবুল করার পর ত্বায়েফ ফিরে যাবার পথে প্রতিনিধিদল নিজ সম্প্রদায়ের নিকটে নিজেদের ইসলাম কবুলের কথা গোপন রাখার ব্যাপারে একমত হ’লেন। যাতে লোকেদের মন-মানসিকতা পরখ করে নেয়া যায়। অতঃপর তারা বাড়ীতে পৌঁছে গেলে লোকজন জমা হয়ে গেল এবং মদীনার খবর জানতে চাইল। তারা বললেন, রাসূল তাদেরকে বলে দিয়েছেন যে, তোমরা ইসলাম কবুল কর। ব্যভিচার, মদ্যপান, সূদখোরী ইত্যাদি ছাড়। নইলে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হও’। একথা শুনে লোকদের মধ্যে জাহেলিয়াত মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো এবং ‘আমরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত’ বলে হুংকার দিয়ে উঠলো। প্রতিনিধিদল বললেন, ঠিক আছে। তোমরা যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ কর। দুর্গ মেরামতে লেগে যাও। লোকেরা চলে গেল এবং দু’দিন বেশ তোড়জোড় চলল। কিন্তু তৃতীয় দিন তারা এসে বলতে শুরু করল, মুহাম্মাদের সঙ্গে আমরা কিভাবে লড়ব। সারা আরব তার কাছে নতি স্বীকার করেছে। অতএব إِرْجِعُوا إلَيْه فَأَعْطُوْهُ مَا سَأَلَ ‘তার কাছে ফিরে যাও এবং তিনি যা চান কবুল করে নাও’। এভাবে আল্লাহ তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিলেন।
এতক্ষণে প্রতিনিধিদল প্রকৃত তথ্যসমূহ প্রকাশ করে দিলেন এবং লোকেরা সবকিছু শুনে ইসলাম কবুল করে নিল।
মূর্তিভাঙ্গা (لات أو ربة) :
কয়েকদিন পরেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খালেদ বিন ওয়ালীদের নেতৃত্বে মুগীরাহ বিন শো‘বা সহ একটি দল প্রেরণ করেন ছাক্বীফ গোত্রের দেবীমূর্তি ‘রববাহ’ ভেঙ্গে ফেলার জন্য। মুবারকপুরী এই মূর্তির নাম ‘লাত’ (لات) বলেছেন। মুগীরা (রাঃ) সাথীদের বললেন, وَاللهِ لَأُضْحِكَنَّكُمْ مِنْ ثَقِيفٍ ‘আল্লাহর কসম! আমি আপনাদেরকে ছাক্বীফদের ব্যাপারে হাসাবো’। অতঃপর তিনি মূর্তির প্রতি গদা নিক্ষেপ করতে গিয়ে নিজেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাত-পা ছুড়তে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে ছাক্বীফের লোকেরা হায় হায় করে উঠে বলল, أَبْعَدَ اللهُ الْمُغِيرَةَ قَتَلَتْهُ الرَّبَّةُ ‘আল্লাহ মুগীরাকে ধ্বংস করুন। দেবী ওকে শেষ করে দিয়েছে’। একথা শুনে মুগীরা লাফিয়ে উঠিয়ে দাঁড়ালেন এবং ছাক্বীফদের উদ্দেশ্যে বললেন,قَبَّحَكُمْ اللهُ إنَّمَا هِيَ لَكَاعُ حِجَارَةٍ وَمَدَرٍ ‘আল্লাহ তোমাদের মন্দ করুন। এটা তো পাথর ও মাটির একটা মূর্তি ছাড়া আর কিছু নয়’। অতঃপর তিনি মূর্তিটি গুড়িয়ে দিলেন এবং ভিতসমেত মন্দির গৃহটি নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। সেখানে রক্ষিত মূল্যবান পোষাকাদি ও অলংকার সমূহ উঠিয়ে মদীনায় নিয়ে আসেন। রাসূল (ছাঃ) সেগুলিকে ঐদিনই বণ্টন করে দেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন।[9]
শিক্ষণীয় : অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তাকে মেনে নিলেও মানুষ স্বভাবত দৃশ্যমান কোন মূর্তি, প্রতিকৃতি বা বস্ত্তর প্রতি শ্রদ্ধা ও পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করতে আগ্রহশীল। এর ফলে আল্লাহ গৌণ হয়ে যান এবং মূর্তি মুখ্য হয়। এটা স্পষ্ট শিরক। বর্তমান যুগে মুসলমানেরা কবরপূজা, প্রতিকৃতি পূজা, স্মৃতিসেŠধ পূজা ইত্যাদি নামে ক্রমেই এ দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
৬. কবি কা‘ব বিন যুহায়ের বিন আবী সুলমার আগমন (قدوم كعب بن زهير بن أبي سلمى) :
ইনি ছিলেন মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি যুহায়ের বিন আবী সুলমার পুত্র এবং আরবের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম। তার ছোট ভাই বুহায়েরও কবি ছিলেন এবং তিনি পিতার অছিয়ত মোতাবেক মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই কা‘ব পিতার অছিয়ত অমান্য করে রাসূলের কুৎসা রটনা করে কবিতা লিখতে থাকেন। ফলে মক্কা বিজয়ের সময় যে সকল কুৎসা রটনাকারীদের বিরুদ্ধে আগাম মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়, ইমাম হাকেমের মতে কা‘ব ছিলেন তাদের মধ্যকার অন্যতম। ৮ম হিজরীর শেষে হোনায়েন ও তায়েফ যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর কা‘বের ছোট ভাই বুহায়ের (অথবা বুজায়ের) তাকে পত্র লিখলেন যে, মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন কুৎসা রটনাকারীকে হত্যা করেছেন। তবে কেউ তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে থাকেন। অতএব বাঁচতে চাইলে তুমি সত্বর মদীনায় গিয়ে তওবা করে রাসূলের নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। দু’ভাইয়ের মধ্যে এভাবে পত্রালাপ চলতে থাকে এবং কা‘ব ক্রমেই ভীত হয়ে পড়তে থাকেন। অবশেষে তিনি একদিন মদীনায় এলেন এবং জোহায়না গোত্রের জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। অতঃপর তিনি জোহানী ব্যক্তির সাথে গিয়ে মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাত আদায় করেন। ছালাত শেষে জোহানীর ইশারায় তিনি রাসূলের সামনে গিয়ে বসেন এবং তাঁর হাতে হাত রেখে বলেন, হে রাসূল! কা‘ব বিন যুহায়ের তওবা করে মুসলমান হয়ে এসেছে আপনার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য। আমি যদি তাকে আপনার নিকটে নিয়ে আসি, তাহ’লে আপনি কি তার প্রার্থনা কবুল করবেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বলে উঠলেন, আমিই কা‘ব বিন যুহায়ের’। উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বকে চিনতেন না। এ সময় জনৈক আনছার লাফিয়ে উঠে বললেন, হে রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন, ওর মাথা উড়িয়ে দিই’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ছাড় ওকে। সে তওবা করে এসেছে এবং সব কালিমা থেকে মুক্ত হয়েছে’। এই সময় কা‘ব রাসূলের প্রশংসায় তার বিখ্যাত ক্বাছীদা (দীর্ঘ কবিতা) পাঠ করেন যার শুরু হ’ল নিম্নোক্ত বচন দিয়ে-
بَانَتْ سُعَادُ فَقَلْبِي الْيَوْمَ مَتْبُوْلُ * مُتَيِّمٌ إثْرَهَا لَمْ يُفْدَ مَكْبُوْلُ
‘প্রেমিকা সু‘আদ চলে গেছে। বিরহ ব্যথায় আমার হৃদয় বিদীর্ণ। তার ভালোবাসার শৃংখলে আমি আবদ্ধ। আমার মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি। আমি বন্দী’।
অতঃপর রাসূলের প্রশংসা এবং নিজের ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি বলেন,
نُبِّّئْتُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ أَوْعَدَنِيْ * وَالْعَفْوُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ مَأْمُوْلُ
‘আমি জানতে পেরেছি যে, আল্লাহর রাসূল আমাকে ধমকি দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের নিকটে সর্বদা ক্ষমাই কাম্য’।
مَهْلًا هَدَاكَ الَّذِيْ أَعْطَاكَ نَافِلَةَ الْ * قُرْآنِ فِيْهَا مَوَاعِيْظُ وَتَفْصِيْلُ
‘থামুন! আল্লাহ আপনাকে সুপথ প্রদর্শন করুন যিনি আপনাকে বিশেষ পুরস্কার হিসাবে কুরআন দান করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে উপদেশ সমূহ এবং সকল বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা সমূহ’।
لاَ تَأْخُذَنِّيْ بِأَقْوَالِ الْوُشَاةِ وَلَمْ * أُذْنِبْ وَلَوْ كَثُرَتْ فِيَّ الْأَقَاوِيْلُ
‘নিন্দুকদের কথায় আমাকে পাকড়াও করবেন না। আমি কোন অপরাধ করিনি। যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে।
لَقَدْ أَقُوْمُ مَقَامًا لَوْ يَقُوْمُ بِهِ * أَرَى وَأَسْمَعُ مَا لَوْ يَسْمَعُ الْفِيَلُ
‘আমি এমন এক স্থানে দাঁড়িয়েছি এবং দেখছি ও শুনছি, যদি কোন হাতি সেখানে দাঁড়াতো ও সেকথা শুনতো-
لَظَلَّ يَرْعَدُ إلاَّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ * مِنْ الرَّسُوْلِ بِإِذْنِ اللهِ تَنْوِيْلُ
‘তাহ’লে সে অবশ্যই কাঁপতে থাকত। তবে যদি আল্লাহর হুকুমে রাসূলের পক্ষ হ’তে তার জন্য অনুকম্পা হয়’।
حَتَّى وَضَعْتُ يَمِيْنِيْ مَا أُنَازِعُهُ * فِي كَفِّ ذِيْ نَقِمَاتٍ قِيْلُهُ الْقِيْلُ
‘অবশেষে আমি আমার ডান হাত রেখেছি যা আমি ছাড়িয়ে নেইনি, এমন এক হাতের তালুতে, যিনি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতাশালী এবং যাঁর কথাই চূড়ান্ত কথা’।
فَلَهُوَ أَخْوَفُ عِنْدِيْ إذْ أُكَلّمُهُ * وَقِيْلَ إنَّكَ مَنْسُوْبٌ وَمَسْئُوْلُ
‘অতঃপর নিশ্চয়ই তিনি আমার নিকটে অধিক ভীতিকর ব্যক্তি, যখন আমি তাঁর সাথে কথা বলি, এমন অবস্থায় যে আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তুমি (অমুক অমুক ব্যঙ্গ কবিতার দিকে) সম্পর্কিত এবং সেগুলি সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসিত হবে’।
مِنْ ضَيْغَمٍ بِضَرَّاءِ الْأَرْضِ مُخْدَرُهُ * فِيْ بَطْنِ عَثَّرَ غَيْلٌ دُوْنَهُ غَيْلُ
‘(তিনি অধিক ভীতিকর) যমীনের কঠিনতম স্থানের ঐ সিংহের চাইতে, যার অবস্থানস্থল এমন উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছানোর আগেই ঘাতক নিহত হয়ে যায়’।
إنَّ الرَّسُوْلَ لَنُوْرٌ يُسْتَضَاءُ بِهِ * مُهَنَّدٌ مِنْ سُيُوْفِ اللهِ مَسْلُوْلُ
‘নিশ্চয়ই রাসূল আলোকস্তম্ভ স্বরূপ, যা থেকে আলো গ্রহণ করা হয়। তিনি আল্লাহর তরবারি সমূহের মধ্যেকার হিন্দুস্থানী কোষমুক্ত তরবারি সদৃশ’।
এ সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে নিজের চাদর কবির গায়ে চড়িয়ে দেন। এজন্য কবির এ দীর্ঘ কবিতাটি ‘ক্বাছীদাতুল বুরদাহ’ (قصيدة البردة) বা চাদরের ক্বাছীদা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
শিক্ষণীয় : মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা রটনা করা জঘন্যতম অপরাধ। এ থেকে তওবা করার পথ হ’ল পুনরায় প্রশংসা করা। এর মাধ্যমেই কেবল তাকে ক্ষমা করা যেতে পারে। আজকালকের মিডিয়া কর্মীদের জন্য উপরোক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
৭. উযরাহ প্রতিনিধিদল (وفد عُذْرَة) :
১২ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি ৯ম হিজরীর ছফর মাসে মদীনায় আসে। মানছূরপুরী ১৯ সদস্য বলেছেন। হামযাহ বিন নু‘মান তাদের মুখপাত্র ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন, আমরা বনু উযরাহর লোক এবং মায়ের দিক থেকে (কুরায়েশ নেতা) কুছাইয়ের ভাই। যারা কুছাইকে সাহায্য করেছিলেন এবং বনু খোযা‘আহ ও বনু বকরকে মক্কার নেতৃত্ব থেকে বিতাড়িত করতে সহযোগিতা করেছিলেন। আমাদের সঙ্গে আপনার আত্মীয়তা ও বংশীয় সম্পর্ক রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে ‘মারহাবা’ জানালেন এবং সুসংবাদ দিলেন যে, সত্বর শাম বিজিত হবে এবং হেরাক্লিয়াস ঐ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হবে। বস্ত্ততঃ রাসূলের এই ভবিষ্যদ্বাণীর পাঁচ মাসের মধ্যেই ৯ম হিজরীর রজব মাসে তাবুক অভিযানে বিনা যুদ্ধে শাম বিজিত হয় এবং রোমকরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তবে পূর্ণ বিজয় সম্পন্ন হয় হযরত ওমরের খেলাফতকালে হযরত আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহর অভিযানের মাধ্যমে।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে গণৎকারদের নিকটে যেতে নিষেধ করেন এবং বেদীর নিকটে তারা যেসব যবেহ করে থাকে, তা থেকে নিষেধ করেন এবং বললেন যে, আগামী থেকে কেবল ঈদুল আযহার কুরবানী বাকী থাকবে। অতঃপর তারা ইসলাম কবুল করলেন এবং কয়েকদিন অবস্থান করে ফিরে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে উত্তম উপঢৌকনাদিসহ বিদায় দেন।
শিক্ষণীয় : রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় যত দূরেরই হৌক, তাকে সম্মান করা ইসলামের নীতি।
৮. বালী প্রতিনিধি দল (وفد بلي) :
এরা ছিলেন শামের অধিবাসী। হযরত আমর ইবনুল আছ-এর দাদী ছিলেন এই গোত্রের মহিলা। সেই সুবাদে মুতা যুদ্ধের পরে ৮ম হিজরীর জুমাদাল আখেরাতে উক্ত অঞ্চলে আমর ইবনুল আছ-এর নেতৃত্বে ৩০০ সৈন্যের একটি বাহিনী পাঠানো হয়েছিল। যাতে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রোমকদের সঙ্গে একজোট না হয়। যেটি ‘যাতুস সালাসেল’ অভিযান নামে পরিচিত। ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে আবুয যাবীব (أبو الضبيب) -এর নেতৃত্বে ‘বালী’ গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় আসেন এবং ইসলাম কবুলের পর তিন দিন অবস্থান করেন। এ সময় তারা জিজ্ঞেস করেন, মেহমানদারীতে কোন ছওয়াব আছে কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হাঁ। كل معروف صنعته إلى غني أو فقير فهو صدقة ‘প্রতিটি পুণ্যকর্ম চাই তা ধনীর প্রতি করা হউক বা ফকীরের প্রতি করা হউক সেটি ছাদাক্বা হবে’।[10] এরপর তারা জিজ্ঞেস করলেন, মেহমানদারীর সময়সীমা কত? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তিনদিন’। অতঃপর প্রশ্ন করলেন, হারানো বকরীর হুকুম কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ওটা তোমার বা তোমার ভাইয়ের অথবা নেকড়ের’। তাদের শেষ প্রশ্ন ছিল, হারানো উটের হুকুম কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, دَعْهُ حَتَّى يَجِدَهُ صَاحِبُهُ ‘ওটাকে ছেড়ে দাও, যতক্ষণ না ওর মালিক ওকে পেয়ে যায়’।
শিক্ষণীয় : কেবলমাত্র বিশ্বাস নয় বরং বিধি-বিধান সমূহের অনুসরণের নাম হ’ল ইসলাম।
৯. ইয়ামনের শাসকদের পত্রবাহকের আগমন (رسالة ملوك اليمن) :
তাবুক অভিযান থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর ইয়ামন থেকে হিমইয়ার শাসকদের (ملوك حِمْيَر) পত্র নিয়ে তাদের দূত মালেক বিন মুররাহ আর-রাহাভী (مالك بن مرة الرَّهَاوي) রাসূলের খিদমতে আগমন করেন। পত্রে তাদের শাসকদের ইসলাম কবুলের এবং শিরক ও শিরককারীদের থেকে সম্পর্ক চ্যুতির খবর ছিল। ঐ শাসকগণের নাম ছিল হারেছ বিন আবদে কেলাল (الحارث بن عبد كلال) , তার ভাই নাঈম বিন আবদে কেলাল, নু‘মান বিন ক্বীল যী রাঈন (النعمان بن قيل ذي رعين) এবং হামদান ও মু‘আফির (هَمْدَان ومُعَافِر)।
জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি পত্র সহ মু‘আয বিন জাবালের নেতৃত্বে একদল ছাহাবীকে সেখানে শিক্ষা দানের জন্য প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি মুমিনদের করণীয় বিষয় সমূহ এবং জিযিয়া প্রদানের বিষয়াদি উল্লেখ করেন।
শিক্ষণীয় : শিরক ও তাওহীদ কখনো একত্রে চলতে পারে না। শাসকদের ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য। মুসলমান নামধারী ধর্মনিরপেক্ষ এবং তথাকথিত মডারেট বা উদার লোকদের জন্য উপরের ঘটনায় শিক্ষণীয় রয়েছে।
১০. হামদান প্রতিনিধি দল (وفد همدان) :
হামদান ইয়ামানের একটি গোত্রের নাম। যাদের প্রতিনিধি দল তাবুক অভিযানের পর অর্থাৎ ৯ম হিজরীর শেষ দিকে মদীনায় আসে। ইতিপূর্বে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য খালেদ ইবনু ওয়ালীদকে পাঠানো হয়। তিনি দীর্ঘ ছয় মাস সেখানে অবস্থান করা সত্ত্বেও কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একটি পত্রসহ হযরত আলীকে প্রেরণ করেন এবং খালেদকে প্রত্যাহার করেন। হযরত আলী (রাঃ) তাদের নিকটে রাসূলের পত্রটি পড়ে শুনান এবং তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেন। ফলে তাঁর দাওয়াতে এক দিনেই সমস্ত গোত্রের লোক ইসলাম কবুল করে। এই সুসংবাদ জানিয়ে প্রেরিত আলী (রাঃ)-এর পত্র পাঠ করে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশীতে ‘সিজদায়ে শুকর’ আদায় করেন এবং সিজদা থেকে উঠে তাঁর যবান মুবারক থেকে বেরিয়ে যায়, السَّلَامُ عَلَى هَمْدَانَ السَّلَامُ عَلَى هَمْدَانَ ‘হামদানদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক, হামদানদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক’!
শিক্ষণীয় : যেসব নিন্দুকরা বলেন, ইসলাম তরবারির জোরে প্রসার লাভ করেছে, তারা বিষয়টি লক্ষ্য করুন। হামদানের লোকদের ইসলামের পথে আমার জন্য খালেদের তরবারিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ছয় মাসেও তিনি তা ব্যবহার করেননি। অবশেষে হযরত আলীর উপদেশ তাদের মনের মধ্যে পরিবর্তন এনে দেয়। তাই তরবারি নয়, দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলাম প্রসার লাভ করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে ইনশাআল্লাহ।
হযরত আলীর নিকটে ইসলাম কবুলের পর হামদান গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলের দর্শন লাভের জন্য মালেক বিন নিমতের (مالك بن النّمط) নেতৃত্বে মদীনায় আসে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে রাসূলের সম্মুখে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেন-
إلَيْك جَاوَزْنَ سَوَادَ الرِّيْفِ * فِيْ هَبَوَاتِ الصَّيْفِ وَالْخَرِيْفِ
مُعَظَّمَاتٍ بِحِبَالِ اللِّيْفِ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মালেক বিন নিমতকে উক্ত কওমের নেতা মনোনীত করেন এবং তাদের নিকটে পত্র প্রেরণ করেন।
১১. বনু ফাযারার প্রতিনিধি দল (وفد بني فَزَارة) :
তাবুক অভিযানের পর ১০/১৫ জনের এই দলটি মদীনায় আসে। এরা আগেই ইসলাম কবুল করেছিল। তাদের সওয়ারী ও চেহারা দুর্দশাগ্রস্ত ছিল। রাসূল (ছাঃ) তাদের এলাকার অবস্থা জিজ্ঞেস করলে তারা চরম দুর্ভিক্ষের কথা জানালো। তারা তাদের এলাকায় বৃষ্টি বর্ষণের জন্য রাসূলকে আল্লাহর নিকটে দো‘আ করার আবেদন জানালো। তখন তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে দু’হাত উঁচু করে (সম্ভবতঃ জুম‘আর খুৎবায়) নিম্নোক্ত দো‘আ করলেন, যে দো‘আটি পরবর্তীকালে ইসতেসক্বার ছালাতে সচরাচর পড়া হয়ে থাকে।-
اللَّهُمَّ اسْقِ عِبَادَكَ وَبَهَائِمَك وَانْشُرْ رَحْمَتَك وَأَحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتَ اللَّهُمَّ اسْقِنَا غَيْثًا مُغِيْثًا مَرِيْئًا مَرِيْعًا نَافِعًا، طَبَقًا وَاسِعًا عَاجِلًا غَيْرَ آجِلٍ نَافِعًا غَيْرَ ضَارٍّ اللَّهُمَّ سُقْيَا رَحْمَةٍ لَا سُقْيَا عَذَابٍ وَلَا هَدْمٍ وَلَا غَرَقٍ وَلَا مَحْقٍ اللَّهُمَّ اسْقِنَا الْغَيْثَ وَانْصُرْنَا عَلَى الْأَعْدَاءِ-
‘হে আল্লাহ! তোমার বান্দাদের ও তোমার চতুষ্পদ জন্তুদের পরিতৃপ্ত কর। তোমার রহমতকে বিস্তৃত করো ও তোমার মৃত জনপদকে জীবিত কর। হে আল্লাহ! আমাদেরকে এমন বারি বর্ষণ কর, যা শান্তিদায়ক, কল্যাণকর, সমতল বিস্তৃত এবং যা দ্রুত, দেরীতে নয়। যা উপকারী, ক্ষতিকর নয়। হে আল্লাহ! রহমতের বৃষ্টি চাই, আযাবের বৃষ্টি নয়। যা ধ্বসিয়ে না দেয়, ডুবিয়ে না দেয় এবং নিশ্চিহ্ন করে না দেয়। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত কর এবং আমাদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’।
শিক্ষণীয় : বৃষ্টি বর্ষণ ও অভাব দূরীকরণের মালিক আল্লাহ। তাই সবকিছুর জন্য কেবল তাঁর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে।
১২. সালামান প্রতিনিধি দল (وفد سلامان) :
হাবীব বিন আমরের নেতৃত্বে ১০ম হিজরীর শাওয়াল মাসে ১৭ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি রাসূলের খিদমতে এসে ইসলাম কবুল করে। তারা প্রশ্ন করে, হে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)! أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, الصَّلاَةُ لِوَقْتِهَا ‘ওয়াক্ত মোতাবেক ছালাত আদায় করা’।[11]
তারা তাদের এলাকায় অনাবৃষ্টি ও খরার অভিযোগ করল এবং দো‘আর আবেদন করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করে বললেন, اللَّهُمَّ اسْقِهِمْ الْغَيْثَ فِيْ دَارِهِمْ ‘হে আল্লাহ! এদেরকে তাদের এলাকায় বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত কর’। দলনেতা হাবীব আরয করলেন, হে রাসূল! আপনার পবিত্র হাত দু’খানা উঠিয়ে একটু দো‘আ করুন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুচকি হেসে হাত উঠিয়ে দো‘আ করেছিলেন। প্রতিনিধি দল ফেরৎ গিয়ে দেখল, ঠিক যেদিন দো‘আ করা হয়েছিল, সেদিনই তাদের এলাকায় বৃষ্টি হয়েছিল’।
শিক্ষণীয় : অন্য হাদীছে এসেছে, দো‘আ কখনো সাথে সাথে কবুল হয়, কখনো দেরীতে হয়, কখনো আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেওয়া হয়। এজন্য নেক্কার মুমিনের দো‘আ সর্বদা সকলের জন্য কাম্য।
১৩. গামেদ প্রতিনধি দল (وفد غامد) :
১০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দল ১০ম হিজরীতে মদীনায় আসে। তারা মদীনার বাইরে তাদের সরঞ্জামাদি একটি বালকের যিম্মায় রেখে রাসূলের দরবারে আসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের জিজ্ঞেস করেন, মাল-সামান কার কাছে রেখে এসেছ? তারা বললেন, একটা বালকের যিম্মায়’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা আসার পরে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। একজন এসে তোমাদের خورجي চুরি করে নিয়ে গেছে। প্রতিনিধি দলের জনৈক সদস্য বলে উঠল, হে রাসূল! ওটা তো আমার। রাসূল বললেন, ভয় পেয়ো না। বাচ্চাটা উঠেছে এবং চোরের পিছে পিছে ছুটেছে ও তাকে পাকড়াও করেছে। তোমাদের সব মালামাল নিরাপদ আছে’। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ফিরে গিয়ে ছেলেটির কাছে যা শুনলো, তা সবকিছু রাসূলের বক্তব্যের সাথে মিলে গেল। ফলে এতেই তারা মুসলমান হয়ে গেল। রাসূল (ছাঃ) উবাই বিন কা‘বকে তাদের জন্য নিযুক্ত করেন, যাতে তাদের কুরআন মুখস্থ করান এবং ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ শিক্ষা দেন। ফিরে যাবার সময় তাদেরকে উক্ত বিধি-বিধান সমূহ একটি কাগজে লিখে দেওয়া হয়’।
শিক্ষণীয় : এর মধ্যে রাসূলের যুগে হাদীছ লিখনের দলীল পাওয়া যায়।
১৪. গাসসান প্রতিনিধি দল (وفد غسَّان) :
সিরিয়া এলাকা হ’তে তিন সদস্যের এই খৃষ্টান প্রতিনিধি দলটি ১০ম হিজরীতে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর তাঁরা নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে ইসলামের প্রচার-প্রসারে নিয়োজিত হন। হযরত ওমরের খেলাফতকালে সেনাপতি আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহর নেতৃত্বে সিরিয়া বিজয়ের সময়েও ঐ তিন জনের একজন জীবিত ছিলেন। তার পূর্বে অন্য দু’জন মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষণীয় : অমুসলিমদের কখনোই জোর করে মুসলমান করা হয়নি, এটি তার অন্যতম প্রমাণ।
১৫. বনুল হারেছ প্রতিনিধি দল (وفد بني الحارث) :
১০ম হিজরীতে এই প্রতিনিধি দল মদীনায় আসে। ইতিপূর্বে উক্ত অঞ্চলে হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদকে ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠানো হয়। তাঁর শিক্ষাগুণে গোত্রের লোকেরা সব মুসলমান হয়ে যায়। এ সংবাদ মদীনায় পাঠিয়ে হযরত খালেদ (রাঃ) তাদের অধিকতর শিক্ষা দানের জন্য সেখানে থেকে যান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানকার কিছু নেতৃস্থানীয় লোককে সাথে নিয়ে তাঁকে মদীনায় ফিরে আসার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। সেমতে অত্র প্রতিনিধি দল রাসূলের সাথে মুলাক্বাতের জন্য মদীনায় আসে। যাদের মধ্যে ক্বায়েস ইবনুল হুছায়েন (قَيْسُ بْنُ الْحُصَيْنِ) এবং আব্দুল্লাহ বিন ফুরাদ (عبد الله بن فراد) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) জিজ্ঞেস করেন, জাহেলী যুগে যারাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করত, তারাই পরাজিত হ’ত, এর কারণ কি ছিল’? জবাবে তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা কখনোই আগ বেড়ে কাউকে হামলা করতাম না বা যুলুমের সূচনা করতাম না। কিন্তু যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হ’লে আমরা দৃঢ় থাকতাম, ছত্রভঙ্গ হতাম না’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ঠিক বলেছ। এটাই মূল কারণ’।
শিক্ষণীয় : সেনাপতি হৌক আর আলেম হৌক, মুসলমান মাত্রই ইসলামের একক প্রচারক, খালেদ (রাঃ)-এর ভূমিকা তার বাস্তব প্রমাণ।
১৬. নাজরান প্রতিনিধিদল (وفد نجران) :
নাজরান ৭৩টি পল্লী সমৃদ্ধ খ্রিষ্টানদের একটি বিরাট নগরীর নাম। একটি দ্রুতগামী ঘোড়ার পক্ষে উক্ত নগরী একদিনে পরিভ্রমণ করা সম্ভবপর ছিল না। উক্ত নগরীতে এক লক্ষ দক্ষ যোদ্ধা পুরুষ ছিলেন। নগরীটি মক্কা হ’তে ইয়ামনের দিকে সাত মনযিল দূরত্বে অবস্থিত ছিল। রাষ্ট্রনেতা, ধর্মনেতা, রাজনৈতিক নেতা, অর্থনৈতিক নেতা প্রভৃতি পদবীধারী দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ দ্বারা নগরীটি পুরোদস্ত্তর একটি সুশৃংখল নগর-রাষ্ট্ররূপে সারা আরবে সুপরিচিত ছিল।
নাজরান প্রতিনিধি দলের মদীনায় আগমন সম্পর্কে হাদীছ সমূহে যেসকল বিবরণ এসেছে, তাতে মানছূরপুরীর বক্তব্য মতে দু’বার এই প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটেছিল। প্রথমবার তিন জনের এবং পরের বার ৬০ জনের। দু’টি দলই সম্ভবতঃ অল্পদিনের ব্যবধানে ৯ম হিজরীতে মদীনায় এসেছিল এবং ইসলাম কবুল করা ছাড়াও রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। আমরা এখানে মানছূরপুরী ও মুবারকপুরী উভয়ের আলোচনার সার-সংক্ষেপ ধারাবাহিকভাবে পেশ করার চেষ্টা পাব।-
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ হাকেম কর্তৃক ইউনুস বিন বুকায়ের (يونس بن بكير) (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজরানবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র লেখেন। من محمد رسول الله إلى أسقف نجران : إن أسلمتم فإني أحمد إليكم الله إله إبراهيم وإسحاق ويعقوب، أما بعد : فإني أدعوكم إلى عبادة الله من عبادة العباد وأدعوكم إلى ولاية الله من ولاية العباد، فإن أبيتم فالجزية، فإن أبيتم فقد آذنتكم بحرب والسلام- ‘আল্লাহর রাসূল-এর পক্ষ হ’তে নাজরানের বিশপ-এর প্রতি: যদি তোমরা ইসলাম কবুল কর, তাহ’লে আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রশংসা করব, যিনি ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূব-এর উপাস্য। অতঃপর আমি তোমাদেরকে মানুষের দাসত্ব হ’তে আল্লাহর দাসত্বের প্রতি আহবান জানাচ্ছি এবং আমি তোমাদেরকে মানুষের বন্ধুত্ব হ’তে আল্লাহর বন্ধুত্বের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। যদি তোমরা অস্বীকার কর, তাহ’লে জিযিয়া দিবে। যদি সেটাও অস্বীকার কর, তাহ’লে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি। ওয়াসসালাম।[12] পত্র পাওয়ার পর তাদের ধর্মনেতা ‘বিশপ’ (الأسْقُف) সকলের সঙ্গে আলোচনা করে তিনজন প্রতিনিধিকে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে প্রেরণ করেন। তারা হ’লেন হামদান গোত্রের শুরাহবীল বিন ওয়াদা‘আহ হামদানী (شرحبيل بن وداعة) , হিমইয়ার গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন শুরাহবীল আছবাহী এবং বনুল হারেছ গোত্রের জাববার বিন ফায়েয হারেছী (جبار بن فيض)। তারা মদীনায় গিয়ে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা করেন। তারা পূর্ব থেকেই ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ঈসা ও মারিয়ামকে আল্লাহর বেটা ও বিবি হিসাবে আল্লাহর সাথে শরীক করতেন। তাদের ধারণা ছিল মুহাম্মাদ (ছাঃ) সত্যিকারের নবী হ’লে উক্ত ধারণায় বিশ্বাসী হবেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা কাল এসো। পরদিন সকালে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-
إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ- الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلاَ تَكُنْ مِّنَ الْمُمْتَرِيْنَ- فَمَنْ حَاجَّكَ فِيْهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَّعْنَتَ اللهِ عَلَى الْكَاذِبِيْنَ- (آل عمران ৫৯-৬১)-
‘নিশ্চয়ই ঈসার দৃষ্টান্ত আল্লাহর নিকটে আদমের ন্যায়। তাকে তিনি সৃষ্টি করেন মাটি দিয়ে। অতঃপর বলেন, হয়ে যাও, তখন হয়ে গেল’। ‘সত্য আসে আপনার প্রভুর পক্ষ হ’তে। অতএব আপনি সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’। ‘অতঃপর যে ব্যক্তি আপনার সাথে তার (ঈসা) সম্পর্কে ঝগড়া করে আপনার নিকটে সঠিক জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তাহ’লে আপনি ওদের বলে দিন, এসো আমরা ডাকি আমাদের সন্তানদের ও তোমাদের সন্তানদের, আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের। তারপর চল আমরা সবাই মিলে আল্লাহর নিকটে কাকুতি-মিনতি করে প্রার্থনা করি। অতঃপর তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি, যারা মিথ্যাবাদী’ (আলে ইমরান ৫৯–৬১)। ‘মুবাহালা’ অর্থ পরস্পরকে ধ্বংসের অভিশাপ দিয়ে আল্লাহর নিকট বিনীতভাবে প্রার্থনা করা।
উক্ত আয়াতগুলি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতিনিধি দলকে শুনিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি হাসান, হোসায়েন ও তাদের মা ফাতেমাকে নিয়ে মুবাহালার জন্য বেরিয়ে এলেন। কোন কোন বর্ণনায় হযরত আলীর কথাও এসেছে। এর দ্বারা তিনি তাদের জানিয়ে দিতে চাইলেন যে, মুবাহালার জন্য তিনি এখুনি প্রস্ত্তত। যদিও প্রতিনিধি দলের পরিবার তাদের সাথে ছিল না।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এই দৃঢ় মনোভাব দেখে প্রতিনিধি দলের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি হ’ল। তারা প্রথমদিন অস্বীকার করলেও পরের দিন রাতের বেলা একান্তে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মুবাহালা করে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনার চাইতে তাঁর অধীনতা স্বীকার করার মধ্যেই আমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। অতএব সকালে এসে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করেন এবং সন্ধিচুক্তির আগ্রহ ব্যক্ত করেন। অতঃপর নির্দিষ্ট পরিমাণ জিযিয়া কর দেবার শর্তে রাসূল (ছাঃ) তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন।
চুক্তিপত্রটি লেখেন হযরত মুগীরাহ বিন শো‘বা (রাঃ) এবং তাতে সাক্ষী হিসাবে নাম স্বাক্ষর করেন আবু সুফিয়ান ইবনু হারব (সাবেক কুরায়েশ নেতা), গায়লান বিন আমর, মালেক বিন আওফ, আক্বরা বিন হাবেস (রাঃ)।[13]
অতঃপর প্রতিনিধি দলটি নিজ গোত্রে ফিরে আসে। তাদেরকে অভ্যর্থনার জন্য বিশপের নেতৃত্বে একটি দল আগেই নগরীর বাইরে এসে গিয়েছিল। চুক্তিনামাটি বিশপের হাতে সমর্পণ করলে তা পড়ার জন্য তার চাচাতো ভাই আবু আলক্বামা বিশর বিন মু‘আবিয়া ঝুঁকে পড়লে তিনি উটের পিঠ থেকে নীচে পড়ে যান ও রাসূল (ছাঃ)-কে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ঐ ব্যক্তির মন্দ হৌক যিনি আমাকে এই কষ্ট দিলেন’। তখন বিশপ তাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, তুমি কি বলছ হিসাব করে বলো। وَاللهِ إِنَّهُ نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، ‘আল্লাহর কসম! ইনি আল্লাহর প্রেরিত নবী’। واللهِ إنه لَلنَّبِىُّ الذى كُنَّا نَنْتَظِرُ ‘আল্লাহর কসম! ইনি অবশ্যই সেই নবী, আমরা যার প্রতীক্ষা করে আসছি’। একথা শোনার সাথে সাথে আবু আলক্বামা তার উটের মুখ মদীনার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন এবং ঐ অবস্থাতেই রওয়ানা করলেন। বিশপ তাকে বারবার অনুরোধ করেও ফিরাতে ব্যর্থ হ’লেন। আবু আলক্বামা সোজা মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন ও সেখানেই থেকে যান ও পরে শহীদ হন।
অতঃপর প্রতিনিধিদল গোত্রের গীর্জায় পৌঁছে গেলে সেখানকার পাদ্রী সবকিছু শুনে ইসলাম কবুলের জন্য তখনই মদীনায় রওয়ানা হ’তে চাইলেন। তিনি গীর্জার দোতলায় তার কক্ষ হ’তে চীৎকার দিয়ে বলতে থাকেন, আমাকে এখুনি নামতে দাও। নইলে আমি এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জীবন বিসর্জন দিব। পরে লোকেরা তাকে নামতে দিল। তিনি একটি পেয়ালা, একটি লাঠি ও একটি চাদর রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য হাদিয়া স্বরূপ নিয়ে তখনই মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তিনি ইসলাম কবুল করার পর বেশ কিছু দিন মদীনায় অবস্থান করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর অনুমতি নিয়ে নাজরান ফিরে আসেন। তাঁর দেওয়া উপঢৌকন আববাসী খলীফাদের সময় পর্যন্ত রক্ষিত ছিল।
প্রথম প্রতিনিধিদলটি ফিরে আসার অল্প দিনের মধ্যেই ৬০ সদস্যের বিরাট প্রতিনিধিদল নিয়ে স্বয়ং বিশপ আবুল হারেছ অথবা আবু হারেছাহ বিন আলক্বামা রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হন। তার সঙ্গে ২৪ জন নেতার মধ্যে সর্বোচ্চ তিনি সহ আরও দু’জন ছিলেন। যাদের একজন হ’লেন নাজরানের শাসক (عاقب) আব্দুল মাসীহ এবং প্রধান বিচারপতি ও প্রশাসক (سيد) আইহাম (الأيهم) অথবা শুরাহবীল। ইনি সামাজিক ও আর্থিক বিষয়াদিও দেখাশোনা করতেন।
সম্ভবতঃ এটা রবিবার ছিল। আছরের সময় মদীনায় পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে মসজিদে নববীতে ছালাত আদায়ের অনুমতি দেন। তারা সেখানে প্রবেশ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে ফিরে ছালাত আদায় করেন। কিছু মুসলমান তাদেরকে বাধা দিতে চাইলে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেন।
খ্রিষ্টানদের এই বিরাট দলটি মদীনায় উপস্থিত হওয়ায় কিছু ইহুদী এসে তাদের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে বচসায় লিপ্ত হ’ত। একদিন তারা এসে বলল, ইবরাহীম (আঃ) ইহুদী ছিলেন। জওয়াবে খ্রিষ্টান নেতারা বললেন, ইবরাহীম (আঃ) নাছারা ছিলেন। তখন সূরা আলে ইমরান ৬৫-৬৮ আয়াতগুলি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয় যে, مَا كَانَ إِبْرَاهِيْمُ يَهُوْدِيًّا وَلاَ نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًا ‘ইবরাহীম না ইহুদী ছিলেন, না নাছারা ছিলেন। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম’ (আলে ইমরান ৩/৬৭)।[14]
আরেকদিন তারা এসে খ্রিষ্টান ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলল, তোমাদের এই নবী কি চান যে, আমরা তার ইবাদত করি, যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসার পূজা করে থাকে? তখন এর প্রতিবাদে সূরা আলে ইমরানের ৭৯ ও ৮০ আয়াত দু’টি নাযিল হয়’
مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤْتِيَهُ اللّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُواْ عِبَاداً لِّي مِن دُونِ اللّهِ وَلَـكِن كُونُواْ رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنتُمْ تَدْرُسُونَ، وَلاَ يَأْمُرَكُمْ أَن تَتَّخِذُواْ الْمَلاَئِكَةَ وَالنِّبِيِّيْنَ أَرْبَاباً أَيَأْمُرُكُم بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنتُم مُّسْلِمُونَ- (آل عمران 79-80)
‘এটা কোন মানুষের জন্য বিধেয় নয় যে, তাকে আল্লাহ কিতাব, হিকমত ও নবুঅত প্রদান করেন, অতঃপর সে লোকদের বলে যে, তোমরা সবাই আল্লাহকে ছেড়ে আমার গোলাম হয়ে যাও। বরং একথা বলবে যে, তোমরা সবাই আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও। এটা এজন্য যে, তোমরা মানুষকে কিতাব শিক্ষা দিয়ে থাক এবং তোমরা তা পাঠ করে থাক’। ‘আর তিনি তোমাদের এটা আদেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ কর। মুসলিম হওয়ার পরে কি তিনি তোমাদের কুফরীর নির্দেশ দিবেন? (অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করাটা কুফরী) (আলে ইমরান ৩/৭৯–৮০)।[15]
মুহাম্মাদ বিন সাহ্ল-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এই প্রতিনিধিদল মদীনায় অবস্থান কালীন সময়ে সূরা আলে ইমরানের শুরু থেকে ৮০ পর্যন্ত আয়াত সমূহ নাযিল হয়।
অতঃপর প্রতিনিধিদল বিদায় গ্রহণকালে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আরয করেন যে, তাদের নিকট থেকে চুক্তির মালামাল আদায়ের জন্য একজন আমানতদার ব্যক্তিকে প্রেরণ করা হউক। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-কে উক্ত কাজের দায়িত্ব দেন এবং বলেন যে, هَذَا أَمِيْنُ هَذِهِ الْأُمَّة ‘ইনি হ’লেন এই উম্মতের আমীন’ অর্থাৎ সবচেয়ে বড় আমানতদার ব্যক্তি। পরে আবু ওবায়দাহর সর্বোত্তম আমানতদারী, অনুপম চরিত্র ও অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে নাজরানবাসী দলে দলে মুসলমান হ’তে থাকেন। স্বয়ং ‘আক্বেব’ (শাসক) ও ‘সাইয়েদ’ (প্রধান বিচারপতি) মুসলমান হয়ে যান। পরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আলী (রাঃ)-কে পাঠান জিযিয়া ও ছাদাক্বা সংগ্রহের জন্য। অর্থাৎ মুসলমানদের নিকট থেকে যাকাত এবং অমুসলমানদের নিকট থেকে জিযিয়া কর। ক্রমে সমস্ত নাজরানবাসী মুসলমান হয়ে যায়।[16]
[শিক্ষণীয় : এক ফোঁটা রক্তপাত না ঘটিয়ে স্রেফ ইসলামের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে খৃষ্টানরা দলে দলে মুসলমান হয়েছিল। আজও তা সম্ভব। যদি আমরা ইসলামকে সঠিকভাবে মানবজাতির কাছে তুলে ধরতে পারি।]
১৭. বনু হানীফার প্রতিনিধি দল (وفد بني حنيفة) :
ইয়ামামাহর হানীফাহ গোত্রের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল (ثمامة بن أثال) যিনি রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা করার মতলবে ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে মদীনায় যাওয়ার পথে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে পাকড়াও হয়ে মদীনায় নীত হন। তিনদিন বন্দী থাকার পর রাসূল (ছাঃ) তাকে মুক্তি দিলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল করেন। প্রধানতঃ তাঁরই তাবলীগে উদ্বুদ্ধ হয়ে উক্ত গোত্রের ১৭ সদস্যের অত্র প্রতিনিধি দলটি ৯ হিজরী সনে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। উক্ত প্রতিনিধি দলে ইয়ামামার নেতা মুসায়লামা ছিলেন। তিনি শর্ত দিলেন إنْ جَعَلَ لِيْ مُحَمَّدٌ الْأَمْرَ مِنْ بَعْدِهِ تَبِعْتُهُ ‘যদি মুহাম্মাদ তাঁর পরে আমাকে তাঁর ক্ষমতা অর্পণ করেন, তাহ’লে আমি তাঁর অনুসারী হব’ (অর্থাৎ বায়‘আত করব)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর হাতে রাখা খেজুরের শুকনো ডালটির দিকে ইশারা করে বললেন, لَوْ سَأَلْتَنِيْ هَذِهِ الْقِطْعَةَ مَا أَعْطَيْتُكهَا ‘এই শুকনা ডালের টুকরাটিও যদি তুমি চাও, তাহ’লেও আমি তোমাকে দিব না’। অর্থাৎ নেতৃত্বের শর্তে বায়‘আত নেব না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি সে বায়‘আত না করে, তবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। তার পরিণতি আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছেন। ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, আমার হাতে দু’টি সোনার বালা এসেছে। এতে আমি খুব বিব্রত বোধ করি। তখন স্বপ্নেই আমাকে বলা হয় যে, ফুঁক দিয়ে উড়িয়ে দাও। আমি ফুঁক দিতেই বালা দু’টি উড়ে গেল’। আমার ধারণা ঐ দু’টি বালা হ’ল ইয়ামামার মুসায়লামা এবং ছান‘আর আসওয়াদ আনাসী’।[17]
উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া নিষেধ।
অতঃপর মুসায়লামা ফিরে গিয়ে নিজেই নবুঅত দাবী করেন এবং তার অনুসারীদের জন্য মদ ও যেনা হালাল করে দেন। তবে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কেও নবী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। যাতে তার এলাকার মুসলমানগণ তার বিরুদ্ধে চলে না যায়। ১০ম হিজরীতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিম্নোক্ত পত্র লেখেন-
مِنْ مُسَيْلِمَةَ رَسُوْلِ اللهِ إلَى مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ : سَلاَمٌ عَلَيْكَ؛ أَمَّا بَعْدُ فَإِنِّيْ قَدْ أُشْرِكْتُ فِي الْأَمْرِ مَعَكَ، وَإِنَّ لَنَا نِصْفَ الْأَرْضِ وَلِقُرَيْشٍ نِصْفَ الْأَرْضِ وَلَكِنَّ قُرَيْشًا لا يُنْصِفُوْنَ- والسلام عليك-
‘আল্লাহর রাসূল মুসায়লামার পক্ষ হ’তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি। অতঃপর জনপদের অর্ধেক আমাদের জন্য এবং বাকী অর্ধেক কুরায়েশের জন্য। কিন্তু কুরায়েশরা ন্যায় বিচার করে না’। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক।’ উক্ত পত্রের জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লেখেন,
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إلَى مُسَيْلَمَةَ الْكَذَّابِ … سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى-
‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে মিথ্যুক মুসায়লামার প্রতি। অতঃপর জেনে রাখা আবশ্যক যে, যমীনের মালিকানা আললাহর হাতে। স্বীয় বান্দাগণের মধ্য হ’তে তিনি যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করে থাকেন এবং পরিণাম ফল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত’। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন’। লেখক ছিলেন উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত পত্র হাবীব বিন যায়েদ বিন আছেম ও আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব (রাঃ) বহন করে নিয়ে যান। কিন্তু আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি লংঘন করে মুসায়লামা কাযযাব হাবীব বিন যায়েদ-এর দু’হাত ও দু’পা কেটে দেয়।[18] অথচ ইতিপূর্বে মুসায়লামার পত্র নিয়ে যে দু’জন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এসেছিল, তারা তাঁর সামনে চূড়ান্ত বেআদবী করা সত্ত্বেও তিনি তাদের কোনরূপ শাস্তি দেননি। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুসায়লামার দূতদ্বয় রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দিবে? তারা বলল نَشْهَدُ أَنَّ مُسَيْلِمَةَ رَسُولُ اللهِ ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুসায়লামা আল্লাহর রাসূল। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনছি। لَوْ كُنْتُ قَاتِلاً رَسُولاً لَقَتَلْتُكُمَا ‘যদি আমি কোন দূতকে হত্যা করতাম, তাহ’লে তোমাদের দু’জনকে হত্যা করতাম’।[19]
আল্লাহ পাক মুসায়লামাকে দুনিয়াতেই এর শাস্তি দেন এভাবে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১২ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে হযরত খালেদ ইবনু ওয়ালীদকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয় এবং হযরত হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহশী বিন হারব, যিনি তখন উত্তম মুসলমান ছিলেন, তার হাতেই এই ভন্ডনবী নিহত হয়। ওয়াহ্শী তাই প্রায়ই বলতেন, কাফের অবস্থায় আমি একজন মহান মুসলমানকে হত্যা করেছিলাম। মুসলমান হওয়ার পরে আমি একজন নিকৃষ্টতম কাফেরকে হত্যা করেছি। আল্লাহ যেন এর দ্বারা আমার পূর্বের গোনাহের প্রায়শ্চিত্ত করে দেন’।
অতঃপর দ্বিতীয় ভন্ডনবী ইয়ামনের আসওয়াদ আনাসী, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ওফাত প্রাপ্তির মাত্র একদিন ও একরাত পূর্বে ফীরোয (রাঃ) তাকে হত্যা করেন এবং সে খবর সাথে সাথে অহী মারফত রাসূল (ছাঃ)-কে জানানো হয়। তিনি খুশী হয়ে ফীরোযের জন্য দো‘আ করেন।
[শিক্ষণীয় : ইসলামী দাওয়াতের লক্ষ্য হ’ল আখেরাত লাভ, দুনিয়া উপার্জন নয়। কিন্তু ভন্ডরা চিরকাল দুনিয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।]
১৮. বনু আমের বিন ছা‘ছা‘আহর প্রতিনিধি দল (وفد بني عامر بن صعصعة) :
নাজদ হ’তে আগত এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন আল্লাহর শত্রু আমের বিন তোফায়েল যার ইঙ্গিতে ও চক্রান্তে ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে বীরে মাঊনায় ৭০ জন ছাহাবীর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। আরও ছিলেন বিখ্যাত কবি হযরত লাবীদ বিন রাবী‘আহ (রাঃ)-এর বৈপিত্রেয় ভাই আরবাদ বিন ক্বায়েস এবং খালেদ বিন জা‘ফর ও জাববার বিন আসলাম। এরা সবাই ছিলেন তাদের সম্প্রদায়ের নেতা এবং শয়তানের শিখন্ডী। মদীনায় আসার সময় কুচক্রী আমের ও আরবাদ রাসূল (ছাঃ)-কে অতর্কিতে হত্যা করার ব্যাপারে একমত হয়। সেমতে মদীনায় উপস্থিত হওয়ার পর প্রতিনিধিদল নিয়ে আমের যখন রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে আলাপে লিপ্ত হয়, তখন আরবাদ সবার অলক্ষ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর পিছন দিকে চলে যায় এবং কোমরে ঝুলানো তরবারির বাঁটে হাত দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তার হাতকে আটকে দেন। ফলে সে তরবারি বের করতে ব্যর্থ হয় এবং অলৌকিকভাবে রাসূল (ছাঃ) বেঁচে যান। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ দুই বদমায়েশের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করেন, যা পরদিনই ফলে যায়।
ছহীহ বুখারীতে এসেছে যে, আমের বিন তোফায়েল আল্লাহর রাসূলকে তিনটি বিষয়ে প্রস্তাব দেন। (১) আপনার পরে আমি আপনার স্থলাভিষিক্ত (খলীফা) হব। (২) আপনার জন্য থাকবে উপত্যকার লোকজন এবং আমার জন্য থাকবে লোকালয়ের জনপদ। (৩) না মানলে আমি আপনার বিরুদ্ধে দু’হাযার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে গাত্বফানে যুদ্ধ করব’।[20] সমস্ত আরব নেতৃবর্গ ও রোম সম্রাট যে রাসূল ও তাঁর ইসলামী বাহিনীর নামে ভয়ে কম্পমান, সেখানে তাঁর সামনে এসে খোদ রাজধানী মদীনায় দাঁড়িয়ে এ ধরনের হুমকি দিয়ে কথা বলা ও তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টার মধ্যে হাস্যকর বোকামী ও অদূরদর্শিতার পরাকাষ্ঠা যাই-ই থাক না কেন আরবরা যে প্রকৃত অর্থেই নির্ভীক ও দুর্দান্ত সাহসী তার বাস্তব প্রমাণ মেলে।
অতঃপর তারা রাসূল (ছাঃ)-এর দরবার থেকে চলে যায় এবং পথিমধ্যে বজ্রপাতে আরবাদ নিহত হয়। আমের বিন তোফায়েল এক সালূলিয়া মহিলার বাড়ীতে আশ্রয় নেন। সেখানে তার ঘাড়ে হঠাৎ এক ফোঁড়া ওঠে এবং তাতেই ঐ রাতে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে সে আরেক আল্লাহর শত্রু আবু জাহলের মতই অহংকার দেখায় এবং বলে ওঠে, غُدَّةٌ كَغُدَّةِ الْبَعِيرِ فِى بَيْتِ امْرَأَةٍ مِنْ بَنِى فُلاَنٍ ‘উটের ফোঁড়ার ন্যায় ফোঁড়া? আবার অমুক বংশের মহিলার ঘরে মৃত্যু?’ এটাকে সে তার বীরত্বের জন্য অপমানজনক ভেবে তখনই তার ঘোড়া আনতে বলে। অতঃপর তার পিঠে উঠে বসে ও সে অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।[21] এভাবেই তাদের দু’জনের উপরে রাসূল (ছাঃ)-এর বদ দো‘আ দ্রুত কার্যকর হয়।
[শিক্ষণীয় : হতভাগা হয়ে যারা জন্মগ্রহণ করে, উপদেশ, উদারতা, ভয়–ভীতি কোন কিছুই তাদেরকে সুপথে আনতে পারে না। ধ্বংসই তাদের পরিণতি হয়।]
১৯। নাজীব গোত্রের প্রতিনিধিদল (وفد نجيب) :
এরা আগেই মুসলমান হয়েছিলেন এবং তাঁদের ১৩ জন প্রতিনিধি নিজ গোত্রের মাল-সম্পদ ও গবাদি-পশুর যাকাত সাথে করে এনেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা এগুলি ফেরৎ নিয়ে যাও এবং নিজ কওমের ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করে দাও। তারা বললেন, হে রাসূল! তাদেরকে বণ্টন করার পর উদ্বৃত্তগুলিই এখানে এনেছি’।
হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এদের চেয়ে উত্তম কোন প্রতিনিধিদল এযাবত আসেনি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘হেদায়াত আল্লাহর হাতেই নিহিত। তিনি যার কল্যাণ চান, তার বক্ষকে ঈমানের জন্য প্রশস্ত করে দেন’।
তারা দ্বীনের বিধি-বিধান শেখার জন্য খুবই উদগ্রীব ছিল। সেকারণ রাসূল (ছাঃ) তাদের তা‘লীমের জন্য বেলাল (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেগুলির জওয়াব তাদের লিখিয়ে দেন। তারা ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হ’লে ছাহাবায়ে কেরাম তাদের বললেন, এত তাড়া কিসের জন্য? তারা বললেন, রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে থেকে আমরা যেসব কল্যাণ লাভ করেছি, দ্রুত ফিরে গিয়ে আমরা সেগুলি আমাদের সম্প্রদায়কে জানাতে চাই।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বহু উপঢৌকন প্রদান করলেন এবং বিদায়ের সময় জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দলের কেউ বাকী আছে কি? তারা বললেন, হাঁ একজন নওজোয়ান বাকী আছে। যাকে আমরা আমাদের মাল-সামানের পাহারায় রেখে এসেছি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা গিয়ে তাকে পাঠিয়ে দাও। তারপর নওজোয়ানটি এসে রাসূলকে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি আপনার নিকটে কেবল একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি যে, আপনি আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করবেন যেন তিনি আমাকে ক্ষমা করেন ও আমার উপরে রহম করেন এবং আমার অন্তরকে মুখাপেক্ষীহীন করেন’। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার জন্য অনুরূপ দো‘আ করেন। অতঃপর ১০ম হিজরীতে রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জে গেলে উক্ত গোত্রের লোকেরাও হজ্জে গমন করে ও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের জিজ্ঞেস করেন, ঐ নওজোয়ানের খবর কি? তারা বলল, ছেলেটির অবস্থা এমন হয়েছে যে, দুনিয়ার সম্পদ তার সামনে ঢেলে দিলেও সে চোখ তুলে সেদিকে তাকায় না’। সে সর্বদা অল্পে তুষ্ট থাকে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে যখন লোকদের মধ্যে ধর্মত্যাগের ঢেউ ওঠে, তখন উক্ত নওজোয়ান তার কওমকে নছীহত করে। যার ফলে তারা ইসলামের উপরে দৃঢ় থাকে।
[শিক্ষণীয় : (ক) প্রত্যেক জনপদে যাকাত ঠিকমত আদায় ও বণ্টন করা হ’লে মুসলিম সমাজে গরীবের অস্তিত্ব থাকবে না। (খ) অল্পে তুষ্ট থাকাই সচছলতার মাপকাঠি। (গ) অত্র ঘটনায় রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় হাদীছ লিখনের দলীল রয়েছে।]
২০। ত্বাই প্রতিনিধি দল (وفد طئ) :
আরবের এই প্রসিদ্ধ গোত্রটির প্রতিনিধি দল তাদের বিখ্যাত অশ্বারোহী বীর যায়েদ আল-খাইলের[22] (زيد الخيل) নেতৃত্বে রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়। অতঃপর প্রয়োজনীয় কথোপকথন শেষে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যান এবং তাদের ইসলাম খুবই সুন্দর থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দলনেতা যায়েদ-এর প্রশংসা করে বলেন, আমার সম্মুখে আরবের যে সব ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়েছে, সামনে আসার পর তাদের আমি তার চেয়ে কম পেয়েছি, কেবল যায়েদ ব্যতীত। কেননা তার খ্যাতি তার সকল গুণের নিকটে পৌঁছতে পারেনি’। অতঃপর তিনি তার নাম পরিবর্তন করে যায়েদ আল-খায়ের (زيد الخير) অর্থাৎ ‘যায়েদ অশ্বারোহী’র বদলে ‘যায়েদ কল্যাণকারী’ রাখেন।
উল্লেখ্য যে, ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে ‘ত্বাই’ গোত্রের খ্যাতনামা দানবীর হাতেম ত্বাই-এর পুত্র বিখ্যাত খ্রিষ্টান পন্ডিত ও পুরোহিত আদী বিন হাতেম স্বীয় বোন সাফানাহর (سفانة) দাওয়াতে সাড়া দিয়ে শাম থেকে মদীনায় এসে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে মর্যাদা প্রদর্শন করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। অতঃপর কুশল বিনিময়ের পর আলোচনা শুরু করেন। যথারীতি হামদ ও ছানার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন বস্ত্ত থেকে তোমরা পালিয়ে গেছ? তুমি কি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা থেকে পালিয়ে গেছ? আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য আছেন বলে কি তুমি মনে কর? আদী বললেন, না। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহু আকবর’ আল্লাহ সর্বোচ্চ একথা বলা থেকে কি তুমি পালিয়ে যাচ্ছ? তুমি কি আল্লাহর চাইতে অন্য কিছুকে বড় মনে কর? আদী বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَإِنَّ الْيَهُوْدَ مَغْضُوبٌ عَلَيْهِمْ وَإِنَّ النَّصَارَى ضَالُّوْنَ ‘মনে রেখ ইয়াহূদ হ’ল অভিশপ্ত এবং নাছারা হ’ল পথভ্রষ্ট’। তখন আদী বললেন, فَإنِّّيْ حَنِيْفٌ مُسْلِمٌ ‘তবে আমি একজন একনিষ্ঠ মুসলিম’। এ জওয়াব শুনে রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অতঃপর তিনি তাকে এক আনছার ছাহাবীর বাড়িতে মেহমান হিসাবে রেখে দেন এবং সেখান থেকে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে নিয়মিত দু’বেলা যাতায়াত করতে থাকেন। এভাবে দৈনিক যাতায়াতে তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা হয়। বিভিন্ন হাদীছে যার বর্ণনা এসেছে। যেমন- (১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ألم تكن رَكُوسِيًّا؟ أو لم تكن تسير في قومك بالمِرْبَاع؟ ‘হে আদী! তুমি কি পুরোহিত ছিলে না? তুমি কি তোমার কওমের কাছ থেকে (বায়তুল মালের) সিকি গ্রহণের নিয়ম চালু করোনি? আদী বললেন, হাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَإِنَّ ذَلِكَ لَمْ يَحِلُّ لَكَ فِيْ دِيْنِكَ ‘অথচ এটি তোমার দ্বীনে হালাল নয়’। আদী বললেন, أجل والله ‘আল্লাহর কসম! এটা ঠিক কথা’। আদী বলেন, আমি তখুনি বুঝে নিয়েছিলাম যে, أَنَّهُ نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، يَعْرِفُ مَا يُجْهَلُ ‘ইনি আল্লাহ প্রেরিত সত্য নবী। যিনি সেসব কথা জানেন, যা অন্যেরা জানে না’।[23]
[শিক্ষণীয় : ধর্মনেতারা দুনিয়াবী স্বার্থে অনেক সময় এলাহী বিধানের বিকৃতি সাধন করে থাকেন, এটা তার অন্যতম প্রমাণ।]
(২) আর একদিনের ঘটনা। আদী বিন হাতেম বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণ বা রৌপ্যের ক্রুশ ঝুলানো ছিল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমার গলা থেকে ঐ মূর্তিটা ফেলে দাও’ (اطْرَحْ عَنْكَ هَذَا الْوَثَنَ)। এ সময় তিনি সূরা তওবাহর ৩১ আয়াতটি পাঠ করছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে যে, اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘ইহুদী-নাছারাগণ আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পীর-পুরোহিতদের ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’। তখন আমি বললাম, لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা ওদের ইবাদত করি না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, أَلَيْسَ تُحَرِّمُوْنَ مَا أَحَلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُوْنَهُ وَ تُحِلُّوْنَ مَا حَرَّمَ اللهُ فَتَسْتَحِلُّوْنَهُ؟ ‘তোমরা কি ঐসব বস্ত্তকে হারাম করতে না, যা আল্লাহ হালাল করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হারাম করত? তোমরা কি ঐসব বস্ত্ত হালাল করতে না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হালাল করত? আদী বললেন, হাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘এটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[24]
উক্ত হাদীছের ও কুরআনী আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, أَنَّهُمْ لَمْ يَأمُرُوْهُمْ أَنْ يَّسْجُدُوْا لَهُمْ وَلَكِنْ أَمَرُوْهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ فَأَطَاعُوْهُمْ ঐসব পীর-দরবেশরা তাদের সিজদা করার জন্য বলতেন না। বরং তারা এমন বিষয়ে নির্দেশ দিতেন, যা আল্লাহ দেননি, এমন বিষয়ে নিষেধ করতেন, যা আল্লাহ করেননি (আর লোকেরা সেটা চোখ বুঁজে মেনে নিত ও তাদের অন্ধ আনুগত্য করত)। আর একারণেই فَسَمَّاهُمُ اللهُ اَرْبَابًا ‘আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন’।[25]
(৩) ছহীহ বুখারীতে আদী বিন হাতেম হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে তার অভাব-অনটনের কথা পেশ করল। আরেকজন এসে রাহাযানির (قطع السبيل) কথা বলল। (তাদের সমস্যাবলী সমাধান শেষে) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে আদী! তুমি কি (ইরাকের সমৃদ্ধ নগরী) হীরা চেন? শোন,
فَإِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتَرَيَنَّ الظَّعِيْنَةَ تَرْتَحِلُ مِنَ الْحِيْرَةِ، حَتَّى تَطُوْفَ بِالْكَعْبَةِ، لاَ تَخَافُ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ، … وَلَئِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتُفْتَحَنَّ كُنُوْزُ كِسْرَى. … وَلَئِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ، لَتَرَيَنَّ الرَّجُلَ يُخْرِجُ مِلْءَ كَفِّهِ مِنْ ذَهَبٍ أَوْ فِضَّةٍ، يَطْلُبُ مَنْ يَقْبَلُهُ مِنْهُ، فَلاَ يَجِدُ أَحَدًا يَقْبَلُهُ مِنْهُ-
(ক) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহ’লে তুমি দেখবে একজন হাওদানশীন মহিলা একাকী হীরা থেকে এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করবে। অথচ রাস্তায় কাউকে ভয় করবে না আল্লাহ ছাড়া। (খ) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়। তাহ’লে তোমরা কিসরার ধনভান্ডার জয় করবে (গ) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তুমি দেখবে যে, একজন ব্যক্তি হাত ভরে সোনা-রূপা নিয়ে ঘুরবে, অথচ তা নেবার মত কাউকে সে খুঁজে পাবে না’। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যের প্রবাহ সৃষ্টি হবে। কোন দরিদ্র লোকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
উক্ত হাদীছ বর্ণনা করার পর হযরত আদী বিন হাতেম বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম দু’টি ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন আমি স্বচক্ষে দেখেছি। অর্থাৎ আমি পর্দানশীন মহিলাদের একাকী হীরা থেকে এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দেখেছি। পারস্য সম্রাট কিসরা বিন হুরমুযের ধন-ভান্ডার জয়ের অভিযানে আমি নিজেই শরীক ছিলাম। এখন কেবল তৃতীয়টি বাকী রয়েছে।وَلَئِنْ طَالَتْ بِكُمْ حَيَاةٌ لَتَرَوُنَّ مَا قَالَ النَّبِىُّ أَبُو الْقَاسِمِ صلى الله عليه وسلم ‘যদি তোমাদের হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তোমরা অবশ্যই তৃতীয়টি দেখতে পাবে। যা বলে গেছেন আবুল কাসেম মুহাম্মাদ (ছাঃ)’। অর্থাৎ হাত ভরে স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে ঘুরেও তা নেবার মত কোন দরিদ্র লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।[26]
[শিক্ষণীয় : যোগ্য শিষ্য পেলেই কেবল যোগ্য উত্তর সমূহ পাওয়া সম্ভব]
২১। আশ‘আরী প্রতিনিধি দল (وفد الأشعريين) :
ইয়ামনের প্রসিদ্ধ আশ‘আরী গোত্র মুসলমান হয়েই মদীনায় আসে। তারা মদীনায় প্রবেশ করার সময় খুশীতে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করছিলেন।
غَدًا نَلْقَى الْأَحِبَّةَ * مُحَمَّدًا وَحِزْبَهُ
‘কাল আমরা বন্ধুদের সাথে মিলিত হব। মুহাম্মাদ ও তাঁর দলের সাথে’। অতঃপর তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলেন এবং পরস্পর মুছাফাহা করলেন। তাদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম মুছাফাহার রীতি চালু হয়।[27] রাসূল (ছাঃ) তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ইয়ামনবাসীরা এসে গেছে। তাদের অন্তর খুবই নরম ও কোমল। ঈমান ও প্রজ্ঞা ইয়ামনীদের জন্য। গর্ব ও গৌরব উটওয়ালাদের জন্য। স্বস্তি ও সহিষ্ণুতা বকরীওয়ালাদের জন্য’।[28]
উল্লেখ্য যে, খ্যাতনামা ছাহাবী আবু মূসা আশ‘আরী ছিলেন এই গোত্রের মানুষ। ৭ম হিজরী সনে ৫০-এর অধিক লোক নিয়ে তিনি মদীনায় আগমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু তাদের নৌকা তাদেরকে নাজ্জাশীর হাবশায় নামিয়ে দেয়। সেখানে তাঁদের সঙ্গে হযরত জা‘ফর ইবনে আবু তালেবের সাক্ষাত হয়। ফলে জাফরের সঙ্গে তাঁরা মদীনায় আসেন। অতঃপর সেখান থেকে খায়বরে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ঐ সময় খায়বর বিজয় সবেমাত্র শেষ হয়েছিল এবং রাসূল (ছাঃ) তখনও সেখানে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু মূসা আশ‘আরী বর্ণিত একটি হাদীছে এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতকালে প্রতিনিধিদলের দু’জন সদস্য, যারা আমার চাচাতো ভাই ছিল, তাদের একজন বলল, হে রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ আপনাকে বিরাট এলাকার শাসন ক্ষমতা দান করেছেন। আমাকেও আপনি একটি এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করুন। অপর ভাইটিও অনুরূপ দাবী করল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, إِنَّا وَاللَّهِ لاَ نُوَلِّى عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ وَلاَ أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ – ‘আমরা এমন কাউকে আমাদের শাসনকার্যে নিযুক্ত করি না, যে ব্যক্তি তা চেয়ে নেয় বা তার লোভ করে বা তার আকাংখা করে’।[29] আলোচ্য প্রতিনিধি দলটি সম্ভবতঃ ৯ম হিজরীতে আগমন করে। যারা পূর্বের প্রতিনিধি দলের দাওয়াতে ইসলাম কবুল করেছিলেন।
[শিক্ষণীয় : এ হাদীছ প্রমাণ করে যে ইসলামে নেতৃত্ব বা কোন প্রশাসনিক পদ চেয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ। আধুনিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যা অপরিহার্য। আর দল ও প্রার্থীভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে পারস্পরিক হানাহানি ও সামাজিক অশান্তির মূল কারণ। আদর্শিক ভালোবাসাই হ’ল সবচেয়ে বড় ভালোবাসা। যা মানুষকে পরস্পরে নিকটতম বন্ধুতে পরিণত করে।]
২২। আযদ প্রতিনিধি দল (وفد أزد) :
রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত মুবাল্লিগগণের দ্বারা এঁরা পূর্বেই মুসলমান হন। অতঃপর তাদের গোত্রের পক্ষ হ’তে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মদীনায় এসেছিলেন। রাসূল (ছাঃ) তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কারা? তারা বললেন, আমরা মুসলমান। রাসূল (ছাঃ) বললেন, প্রত্যেক বস্ত্তরই কিছু সারবত্তা (حقيقت) থাকে। তোমাদের বক্তব্যের সারবস্ত্ত কি? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে ১৫টি বিষয় রয়েছে। ৫টি আক্বীদা বিষয়ক এবং ৫টি আমল বিষয়ক, যা আপনার প্রেরিত মুবাল্লিগগণ আমাদের শিখিয়েছেন। বাকী ৫টি বিষয় আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। এক্ষণে আকবীদা বিষয়ক পাঁচটি বস্ত্ত হ’ল :
বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর উপরে, ফেরেশতাগণের উপরে, আল্লাহর কিতাবসমূহের উপরে, তাঁর প্রেরিত রাসূলগণের উপরে এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের উপরে।
অতঃপর আমল বিষয়ক পাঁচটি বস্ত্ত হ’ল : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কলেমা মুখে স্বীকৃতি দেওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা, যাকাত দেওয়া, রামাযানের ছিয়াম পালন করা, বায়তুল্লাহর হজ্জ করা, যদি সামর্থ্য থাকে।
পাঁচটি বিষয় যা আগে থেকেই আমাদের মধ্যে ছিল, তা হ’ল: সচ্ছলতার সময় আল্লাহর শুকরগুযারী করা, বিপদের সময় ছবর করা, আল্লাহর ফায়ছালার উপরে সন্তুষ্ট থাকা, পরীক্ষার সময় সততার উপরে দৃঢ় থাকা, শত্রুকে গালি না দেওয়া।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যারা তোমাদেরকে কথাগুলি শিখিয়েছেন, নিশ্চয়ই তারা অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। সম্ভবতঃ তারা নবীগণের মধ্যেকার কেউ হবেন। আচ্ছা আমি তোমাদেরকে আরও পাঁচটি বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছি।-
(১) ঐ বস্ত্ত জমা করো না, যা খাওয়া হয় না (২) ঐ ঘর তৈরী করো না, যাতে বাস করা হয় না (৩) এমন কথার মুকাবিলা করো না, যা কালকে পরিত্যাগ করতে হবে (৪) আল্লাহর ভয় বজায় রাখো, যার কাছে ফিরে যেতে হবে ও যার কাছে উপস্থিত হতে হবে (৫) ঐসব বস্ত্তর প্রতি আকর্ষণ রাখো, যা তোমার জন্য আখেরাতে কাজ দেবে, যেখানে তুমি চিরস্থায়ীভাবে থাকবে’।
প্রতিনিধিদল কথাগুলি মুখস্থ করে নিল এবং তারা এর উপরে সর্বদা আমলদার ছিল।
[শিক্ষণীয় : প্রকৃত সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে অন্যের সদুপদেশ গ্রহণ করে।]
২৩। তারেক বিন আব্দুল্লাহর প্রতিনিধিদল (وفد طارق بن عبد الله) :
তারেক বিন আব্দুল্লাহ ছিলেন ‘রাবযাহ’ (ربذة) এলাকার বাসিন্দা। তাঁর ইসলাম গ্রহণ বিষয়ে তিনি বর্ণনা করেন যে, একদা আমি মক্কার ‘মাজায’ নামক বাজারে (سوق المجاز) দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক সেখানে এসে বলতে থাকেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُوْلُوْا : لآ إلَهَ إلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا ‘হে জনগণ! তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’। কিন্তু সেখানেই তার পিছে পিছে তাকে পাথরের টুকরা ছুঁড়ে মারতে মারতে একজন লোককে বলতে শুনলাম, يَا أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ كَذَّابٌ ‘হে লোকেরা! তোমরা ওর অনুসরণ কর না। সে মহা মিথ্যাবাদী’। পরে লোকদের কাছে জানতে পারলাম যে, দু’জনেই বনু হাশেমের লোক। প্রথম জন ‘মুহাম্মাদ’ যিনি নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবী করেন এবং দ্বিতীয়জন তার চাচা আব্দুল ‘ওযযা যিনি তাকে অস্বীকার করেন। আবু লাহাবের প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল ‘ওযযা।[30]
তারেক বিন আব্দুল্লাহ বলেন, তারপর কয়েক বছর অতিবাহিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে চলে গেছেন। এক সময় আমি ও আমার সাথীগণ ব্যবসা উপলক্ষে মদীনায় গেলাম সেখান থেকে খেজুর ক্রয়ের জন্য। মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছে আমরা অবতরণ করলাম এজন্য যে, সফরের পোষাক পরিবর্তন করে ভাল পোষাক পরে মদীনায় প্রবেশ করব। এমন সময় পুরানো কাপড় পরিহিত একজন ব্যক্তি এসে আমাদের সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছেন এবং কোথায় যাবেন? আমরা বললাম, রাবযাহ থেকে এসেছি। এখানেই আমাদের গন্তব্য’। তিনি বললেন, কি উদ্দেশ্যে? আমরা বললাম, খেজুর ক্রয়ের উদ্দেশ্যে’। ঐ সময় লাগাম দেওয়া অবস্থায় আমাদের লাল উটটি দাঁড়ানো ছিল। তিনি বললেন, উটটি বিক্রি করবেন কি? আমরা বললাম, হাঁ। বললেন, দাম কত? বললাম, এত পরিমাণ খেজুরের বিনিময়ে দিতে পারি’। অতঃপর তিনি মূল্য কমানোর কোনরূপ চেষ্টা না করেই উটের লাগাম ধরে নিয়ে গেলেন। উনি শহরে পৌঁছে গেলে আমাদের হুঁশ হ’ল যে, অচেনা লোকটি আমাদের উট নিয়ে গেল, অথচ মূল্য পরিশোধের বিষয়ে কোন কথা হ’ল না। আমরা এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। তখন আমাদের গোত্রনেতার স্ত্রী যিনি আমাদের সাথে হাওদানশীন ছিলেন, তিনি বললেন, আমি লোকটির চেহারা দেখেছি, যা পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায়। এমন একজন ব্যক্তি যদি উটের মূল্য না দেন, তবে আমিই তোমাদের মূল্য দিয়ে দেব’।
ইতিমধ্যে একজন ব্যক্তি এসে বললেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পাঠিয়েছেন। এই নিন আপনাদের উটের বিনিময় মূল্য বাবদ খেজুর এবং বাকী এগুলি তিনি পাঠিয়েছেন আপনাদের আপ্যায়নের জন্য। আপনারা খেতে থাকুন এবং খেজুরগুলি মেপে নিন।
অতঃপর আমরা খেয়ে দেয়ে তৃপ্ত হয়ে শহরে প্রবেশ করলাম। যেয়ে দেখি যে, উটের খরিদ্দার সেই ব্যক্তিই মসজিদে মিম্বরে দাঁড়িয়ে লোকদের উপদেশ দিচ্ছেন-
تَصَدَّقُوْا فَإِنَّ الصَّدَقَةَ خَيْرٌ لَّكُمْ، الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مَّنَ الْيَدِ السُّفْلَى، أُمَّكَ وَأَبَاكَ وَأُخْتَكَ وَأَخَاك وَأَدْنَاكَ أَدْنَاكَ-
‘তোমরা ছাদাক্বা কর। কেননা ছাদাক্বা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। জেনে রাখো উপরের হাত নীচের হাতের চাইতে উত্তম। তোমার মাকে, তোমার বাপকে, তোমার বোনকে, তোমার ভাইকে এবং অন্যান্য নিকটতম ব্যক্তিদেরকে দান কর’।[31]
অর্থাৎ তারেক বিন আব্দুল্লাহ তাওহীদের শিক্ষা পেয়েছিলেন মক্কার বাজারে। অতঃপর তার গোত্রসমেত সবাই মুসলমান হয়ে যায়।
[শিক্ষণীয় : বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে উত্তম আচরণ সংযুক্ত হ’লেই কেবল তা অন্যের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে এবং পরকালে মুক্তির কারণ হয়ে থাকে।]
২৪। বনু সা‘দ প্রতিনিধিদল (وفد بني سعد هذيم) :
এটি বনু কুযা‘আহর (بنو قضاعة) একটি শাখা গোত্রের নাম। প্রতিনিধি দলটি মুসলমান হয়ে মদীনায় আসে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করার জন্য। তারা যখন মদীনায় উপস্থিত হন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি জানাযায় ছিলেন। জানাযা শেষে যাওয়ার পথে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মুসলমান? তারা বললেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য দো‘আয় (জানাযায়) কেন শরীক হ’লে না? তারা বললেন, বায়‘আতের পূর্বে আমাদের কিছুই করার অনুমতি নেই বলে আমরা মনে করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা যখনই ইসলাম কবুল করেছ, তখনই মুসলমান হয়ে গেছ’। এরি মধ্যে তাদের সঙ্গী ছোট ছেলেটি এসে পৌঁছলো, যাকে তারা তাদের সওয়ারীর কাছে বসিয়ে রেখে এসেছিল। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ছেলেটি আমাদের মধ্যে ছোট এবং সে আমাদের খাদেম’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হাঁ। أَصْغَرُ الْقَوْمِ خَادِمُهُمْ بَارَكَ اللهُ عَلَيْهِ ‘ছোটরা তাদের মুরববীদের খাদেম হয়ে থাকে। আল্লাহ তাকে বরকত দান করুন’। রাসূল (ছাঃ)-এর এই দো‘আর ফল এই হ’ল যে, ঐ ছেলেটিই কুরআন মাজীদ বেশী শিখলো এবং উক্ত গোত্রের ইমাম নিযুক্ত হ’ল। এই প্রতিনিধি দল ফিরে গেলে তাদের পুরা গোত্রে ইসলাম প্রসার লাভ করে।[32]
২৫। বনু আসাদ প্রতিনিধি দল (وفد بني أسد) :
১০ জন লোকের এই প্রতিনিধি দলটি মদীনায় আসে। যাদের মধ্যে ওয়াবেছাহ বিন মা‘বাদ (وابصة بن معبد) এবং ত্বালহা বিন খুওয়াইলিদ ছিলেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে ছিলেন। তারা এসে নিজেরা কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা কিন্তু নিজেরা এসে ইসলাম কবুল করেছি। আপনি আমাদের নিকটে কোন মুবাল্লিগ পাঠাননি।
তাদের উক্ত কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন-
يَمُنُّوْنَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوْا قُلْ لاَ تَمُنُّوْا عَلَيَّ إِسْلاَمَكُمْ بَلِ اللهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيْمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ-
‘তারা মুসলমান হয়ে আপনাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহ ঈমানের পথ প্রদর্শন করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা (ঈমানের দাবীতে) সত্যবাদী হয়ে থাক’ (হুজুরাত ৪৯/১৭)।
অতঃপর তারা কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। যেমন, পাখির বোল থেকে শুভাশুভ নির্ধারণ করা যাবে কি না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে এসব থেকে নিষেধ করলেন।
[শিক্ষণীয় : আল্লাহর রহমত ব্যতীত কেউ হেদায়াত লাভ করতে পারে না। তাই কোন বিষয়ে হেদায়াত লাভের পর হাদী–র শুকরিয়া আদায়ের সাথে সাথে অধিক হারে আল্লাহর দরবারে বিনম্রচিত্তে কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ করা কর্তব্য।]
২৬। বাহরা প্রতিনিধি দল (وفد بهراء) :
এই প্রতিনিধি দলটি মদীনায় এসে খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত মিক্বদাদ বিন আমর (রাঃ)-এর বাসার সম্মুখে তাদের উট বসিয়ে দেয়। মিক্বদাদ (রাঃ) বাসায় তাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করার কথা বলে বেরিয়ে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানান। অতঃপর তাদের ঘরে এনে বসান এবং ‘হায়েস’ (حيس) নামক উন্নত মানের খানা পরিবেশন করেন। ‘হায়েশ’ হ’ল খেজুর, ছাতু ও ঘি মিশ্রিত অত্যন্ত সুস্বাদু একপ্রকার খাদ্য। হযরত মিক্বদাদ (রাঃ) একটি পাত্রে করে উক্ত খাদ্যের কিছু অংশ রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য হাদিয়া পাঠান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা থেকে কিছুটা খেয়ে পাত্রটি ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। মিক্বদাদ (রাঃ) দু’বেলা ঐ পাত্রে করে মেহমানদের জন্য খানা পরিবেশন করতে থাকেন। মেহমানগণ অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে উক্ত খাদ্য খেতে থাকেন। একদিন আশ্চর্য হয়ে তারা মেযবানকে বললেন, আমরা শুনেছিলাম মদীনাবাসীর খাদ্য হ’ল ছাতু, যব ইত্যাদি। কিন্তু এখন দেখছি তার উল্টা। সবচাইতে মূল্যবান ও সুস্বাদু খাদ্য আমরা দু’বেলা খাচ্ছি। এরকম খাদ্য তো আমরা কখনো খাইনি’।
জওয়াবে মিক্বদাদ (রাঃ) বললেন, প্রিয় ভাইয়েরা! এসবই আমাদের প্রিয় রাসূল (ছাঃ)-এর বরকত। তিনি ঐ পাত্র থেকে কিছু খেয়ে ফেরত দিয়েছিলেন। আর তাতেই বরকত হয়ে তা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, শেষ হচ্ছে না। একথা শুনে প্রতিনিধি দল বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল’। অতঃপর তারা মুসলমান হয়ে যান ও মদীনায় কিছু দিন অবস্থান করেন এবং পবিত্র কুরআন ও ইসলামের হুকুম-আহকাম শিখে ফিরে যান।[33]
[শিক্ষণীয় : অনেক সময় আল্লাহ পাক নবীগণের মু‘জেযার মাধ্যমে অথবা কোন প্রিয় বান্দার প্রতি কারামত প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্য বান্দাকে হেদায়াত দান করে থাকেন। এটা স্রেফ আল্লাহর এখতিয়ারাধীন বিষয়। তিনি যাকে খুশী তাকে দিয়ে এটা করাতে পারেন। এটি শরী‘আতের কোন দলীল নয়]
২৭। খাওলান প্রতিনিধি দল (وفد خولان) :
১০ম হিজরীর শা‘বান মাসে দশ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি মদীনায় আসে। তারা এসে বলেন, আমরা ইতিপূর্বে ঈমান এনেছি। কিন্তু দীর্ঘ পথ সফর করে আমাদের মদীনায় আসার একটাই কারণ প্রিয় রাসূল (ছাঃ)-এর সাক্ষাত লাভ করা।
অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের পূর্বের দেবপ্রতিমা ‘আম্মে আনাস’ (عَمُّ أَنَسٍ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বললেন, আল্লাহর হাযার শোকর! আপনার শিক্ষা আমাদেরকে ঐ ফিৎনা থেকে রক্ষা করেছে। কিছু বুড়া-বুড়ীই কেবল এখনো ঐ মূর্তির পূজা করে থাকে। এবার ফিরে গিয়ে ইনশাআল্লাহ আমরা মূর্তিটা গুঁড়িয়ে দেব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা ঐ মূর্তিপূজার দু’একটি ঘটনা শোনাও তো’। তারা বললেন, হে রাসূল! একদিন আমরা একশত বলদ একত্রিত করি এবং সবগুলি একই দিনে ‘আম্মে আনাসের উদ্দেশ্যে কুরবানী করি। অতঃপর সেগুলি সব জন্তু-জানোয়ারে খেয়ে যায়। অথচ আমরা নিজেরাই ছিলাম অভাবী এবং গোশতের মুখাপেক্ষী’।
তারা বলেন, হে রাসূল (ছাঃ)! গবাদিপশু এবং উৎপাদিত খাদ্যশস্য হ’তে আমরা ‘আম্মে আনাসের জন্য নির্ধারিত অংশ বের করে রাখতাম। ক্ষেতের মধ্যবর্তী উন্নত ফসলের অংশটি আম্মে আনাসের জন্য এবং এক কোণের অনুন্নত অংশটি আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করতাম। আর ফসল খারাপ হলে আল্লাহর অংশ দিতাম না। বরং আল্লাহর অংশটা আম্মে আনাসের নামে উৎসর্গ করতাম। কিন্তু আম্মে আনাসের অংশ কখনোই বাদ যেত না।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে দ্বীনের ফরয-ওয়াজিবাত শিক্ষা দিলেন এবং বিশেষ করে তাদেরকে নিম্নের বিষয়গুলি শিক্ষা দিলেন।-
(১) অঙ্গীকার পূর্ণ করা (২) আমানত আদায় করা (৩) প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা (৪) কারু প্রতি যুলুম না করা। কেননা যুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে (الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ)।
[শিক্ষণীয় : শিরকী আক্বীদা কেবল পরকাল ধ্বংস করে না, তা মানুষের দুনিয়াও ধ্বংস করে। কবরপূজারী ও প্রতীক পূজারীদের দিকে তাকালেই এর দৃষ্টান্ত মিলবে।]
২৮। মুহারিব প্রতিনিধি দল (وفد محارب) :
দশ সদস্যের এই প্রতিনিধিদল দশম হিজরীতে মদীনায় আসে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হযরত বেলাল (রাঃ)-কে তাদের মেহমানদারীর জন্য নিযুক্ত করেন। সকাল-সন্ধ্যা তিনি তাদের খাবার পরিবেশন করতেন। একদিন রাসূল (ছাঃ) যোহর থেকে আছর পর্যন্ত তাদের জন্য সময় দেন। এ সময় তিনি এক ব্যক্তির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে বলেন, তোমাকে আমি যেন ইতিপূর্বে কোথায় দেখেছি? লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আপনি আমাকে দেখেছেন এবং আমার সাথে কথাও বলেছেন। আর সেটা হ’ল মক্কার ‘ওকায’ (عكاظ) মেলায় যখন আপনি লোকদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। অথচ আমি আপনার বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ করি এবং নিকৃষ্ট বাক্য সমূহ প্রয়োগ করি’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হাঁ। ঠিক’। ঐ ব্যক্তি বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! ঐদিন আমার সাথীদের মধ্যে আমার চাইতে বেশী আপনাকে কেউ গালি দেয়নি এবং আমার চাইতে বেশী ইসলামের বিরোধিতাকারী সেদিন কেউ ছিল না। আমার সেই সব সাথীরা সকলেই স্ব স্ব পিতৃধর্মে মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, তিনি আজও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং আপনার উপরে ঈমান আনার তাওফীক দান করেছেন’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘সকলের অন্তর সমূহ আল্লাহর দু’আঙ্গুলের মাঝে রয়েছে। তিনি যেভাবে খুশী সেটাকে পরিচালিত করেন’। অতঃপর ঐ ব্যক্তি বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! আমার প্রথম জীবনের গোনাহ মাফের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, الْإِسْلاَمُ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ ‘ইসলাম তার পূর্বেকার সকল গোনাহ দূর করে দেয়’।
[শিক্ষণীয় : প্রকৃত তওবা মানুষকে নতুন মানুষে পরিণত করে।]
২৯। বনু আয়েশ প্রতিনধি দল (وفد بني عيش) :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর চার মাস পূর্বে এই প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটে। এরা ছিলেন নাজরান এলাকার বাসিন্দা এবং মুসলমান হয়েই তারা মদীনায় এসেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা শুনেছি, আপনি একথা বলেছেন যে, لاَ إسْلاَمَ لِمَنْ لاَ هِجْرَةَ لَهُ ‘যার হিজরত নেই, তার ইসলাম নেই’। সেকারণ আমরা চাই যে, আমাদের মাল-সম্পদ, জমি-জমা সব বিক্রি করে দিয়ে পরিবার-পরিজন সহ মদীনায় চলে আসি এবং রাসূলের সাহচর্যে জীবন কাটিয়ে দিই’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, اتّقُوا اللهَ حَيْثُمَا كُنْتُمْ فَلَنْ يَلِتْكُمْ اللهُ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا ‘যেখানে তোমরা আছ, সেখানে থেকেই আল্লাহ ভীতি অবলম্বন কর। তোমাদের নেক আমলের ছওয়াবে কোনই কমতি হবে না’।
[শিক্ষণীয় : মুসলমান যেখানে যে অবস্থায় থাক, সেখানে সে অবস্থায় দ্বীনের দাওয়াত দিবে। বিশেষ কোন একটি স্থানে অবস্থান করা আবশ্যিক নয়।]
৩০। নাখ‘ঈ প্রতিনিধি দল (وفد نخع) :
রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর দু’মাস পূর্বে ১১ হিজরীর মুহাররম মাসের মধ্যবর্তী সময়ে সর্বশেষ এই প্রতিনিধি দলটি মদীনায় আগমন করে। এদের পরে আর কোন প্রতিনিধি দল আসেনি। দু’শো জনের এই বিরাট প্রতিনিধি দলটি আগেই মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-এর হাতে মুসলমান হয়েছিলেন। তাদেরকে জাতীয় মেহমানখানায় (دار الضيافة) রাখা হয়।
তাদের মধ্যে একজন ছিলেন যুরারাহ বিন আমর (زرارة بن عمرو)। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আসার সময় রাস্তায় আমি কয়েকটি আজব স্বপ্ন দেখেছি। এর ব্যাখ্যা কি হবে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, শুনাও দেখি’।
১ম স্বপ্ন : যুরারাহ বললেন, আমি দেখলাম যে, বকরী বাচ্চা দিয়েছে, যা সাদা ও কালো রংয়ের ডোরাকাটা (أبلق)।
ব্যাখ্যা : রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার স্ত্রীর ছেলে হয়েছে এবং সেটা তোমারই ছেলে।
যুরারাহ বললেন, কিন্তু সাদা-কালো ডোরাকাটা কেন হ’ল? রাসূল (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে গোপনে আস্তে আস্তে বললেন, তোমার দেহে শ্বেতকুষ্ট ব্যাধি রয়েছে, যা তুমি লোকদের থেকে লুকিয়ে রাখো। তোমার সন্তানের মধ্যে সেটারই প্রভাব পড়েছে। যুরারাহ বলে উঠলেন, কসম আল্লাহর, যিনি আপনাকে সত্য রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন, আমার এই গোপন রোগের খবর এ যাবত কারুরই জানা ছিল না।
২য় স্বপ্ন : যুরারাহ বললেন, আমি নু‘মান বিন মুনযিরকে হাতে বাযুবন্দ, কোমরে কংকন ইত্যাদি অলংকারাদি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম।
ব্যাখ্যা : রাসূল (ছাঃ) বললেন, এর দ্বারা আরব দেশকে বুঝানো হয়েছে। যা এখন শান্তি ও সচ্ছলতা লাভ করেছে।
৩য় স্বপ্ন : আমি একটা বুড়ীকে দেখলাম মাটি থেকে বেরিয়ে আসছে এবং যার চুলের কিছু সাদা ও কিছু কালো।
ব্যাখ্যা : রাসূল (ছাঃ) বললেন, এর দ্বারা ‘দুনিয়া’ বুঝানো হয়েছে। যার (ধ্বংসের) বাকী সময়টুকু এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।
৪র্থ স্বপ্ন : আমি দেখলাম যে, একটা দাবানল মাটি থেকে উত্থিত হ’ল। যা আমার ও আমার ছেলের মধ্যবর্তী স্থানে এসে গেল। আগুনটি বলছে, পোড়াও পোড়াও চক্ষুষ্মান হৌক বা অন্ধ হৌক। হে লোকেরা! তোমাদের খাদ্য, তোমাদের বংশ, তোমাদের মাল-সম্পদ সব আমাকে খাবার জন্য দাও’।
ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এটা হ’ল ফাসাদ, যা আখেরী যামানায় বের হবে। যুরারাহ বললেন, সেটা কেমন ফিৎনা হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, লোকেরা তাদের খলীফাকে (امام) হত্যা করবে। তারা আপোষে এমন লড়াইয়ে মত্ত হবে, যেমন দু’হাতের পাঞ্জার আঙ্গুলগুলি পরস্পরে জড়িয়ে যায়। বদকার লোকেরা ঐ সময় নিজেদের নেককার মনে করবে। ঈমানদারগণের রক্ত পানির মত সস্তা মনে করা হবে। যদি তোমার ছেলে মারা যায়, তবে তুমি দেখবে। আর তুমি মারা গেলে তোমার ছেলে এই ফেৎনা দেখবে’।
যুরারাহ বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! দো‘আ করুন যেন আমি এই ফিৎনা না দেখি। রাসূল (ছাঃ) তার জন্য দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! সে যেন এই ফেৎনার যামানা না পায়’। পরে দেখা গেল যে, যুরারাহ মারা গেলেন। তার ছেলে বেঁচে থাকল। যে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর বায়‘আত ছিন্ন করেছিল।[34]
[শিক্ষণীয় : দুনিয়াবী স্বার্থ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। মুসলমানেরা তা থেকে নিরাপদ থাকবে না। আখেরাত পিয়াসীগণ হবেন উক্ত হামলার প্রধান টার্গেট। অতএব সাবধান!]
চলমান…
– ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
No comments